
নদীরা মরে গেলে
স্মৃতিহত্যা
আমার এই বেঁচে থাকা নিয়ে যে উপহাস করে
যে আমাকে অনাহূত ঘোষণা করে প্রতি মুহূর্তে
এবং অবহেলায় ছুড়ে মারে মৃত্যুকূপে,
যে আমাকে প্রতিমুহূর্তে তিলে তিলে খুন করে,
একদিন আমিও তার টুটি চেপে ধরব কায়দা করে
বিশ্রীভাবে আমি প্রতিশোধ নেব; আমি খুনি হব।
স্মৃতিহত্যা বৈধ;
আত্মরক্ষার বর্মের মতো স্মৃতিহত্যা বৈধ ও স্বতঃসিদ্ধ।
স্মৃতিহত্যার জন্য কোনো দণ্ড থাকতে নেই;
না মৃত্যুদণ্ড, না যাবজ্জীবন।
যে স্মৃতি মানুষকে গোপনে গোপনে সুচারুভাবে হত্যা করে
সেই স্মৃতি হত্যার জন্য আমার কোনো দণ্ড হতে পারে না।
নিম্নমধ্যবিত্তের মায়াব্যঞ্জন
বাড়িতে ফিরতে রোজই বাবার সন্ধ্যা হয়ে যেত
রোজ আমরা বাবার জন্য অপেক্ষা করতাম
সব ভাইবোন আমাদের বাড়বাড়িতে গিয়ে দাঁড়াতাম,
পথের শেষ প্রান্তে চান রাইতের চাঁদের মতো করে
আমরা বাবাকে খুঁজতাম
আমাদের ভাঙাচুরা মা-ও ইতিউতি বাবাকে খুঁজতেন।
সন্ধ্যায় বাবা যখন বাড়ি ফিরে আসতেন
তখন আমাদের মনে ঈদের মতো প্রবল আনন্দ হতো,
সারা দিন খেটেখুটে বাবা যা কিছু রুজি করতেন
তা দিয়ে হাট থেকে তিনি এটা-ওটা কিনে আনতেন
আমাদের বাবা কখনোই ব্যাগভর্তি সদাই কিনতে পারেননি
কোনো দিন চাল কিনলে নুন থেকে যেত বকেয়ার খাতায়
কোনো দিন মাছ কিনলে চালের পরিমাণ টপাস করে কমে যেত
অবশ্য এ নিয়ে আমাদের মায়ের কোনো অভিযোগ বা আক্ষেপ ছিল না।
অথচ মায়ের হাতে কি অদ্ভুত জাদুই না ছিল
অভাবের উনুনেও তিনি রাঁধতে পারতেন সুখের অষ্টব্যঞ্জন!
থালায় ধোঁয়া ওঠা সুখগুলো খেতে খেতে আমরা দেখতাম
বাবার ফোসকা পড়া হাতে মা তেল মালিশ করছেন
মায়ের ঊনপেটের ওপর হাত রেখে বাবা দিব্যি ঘুমাচ্ছেন।
আর আমাদের মা রাত জেগে জেগে নতুন মন্ত্র শিখছেন—
কীভাবে কম মসলা দিয়ে সুখের মায়াব্যঞ্জন রাঁধতে হয়।
এপার ওপার
ওপারে থৈ থৈ করা আলো ঠিকরে পড়ছে
ওপারে গলে পড়ছে আগুনের মত কমলা রঙের জোছনা,
মানুষের হৈচৈ; পাখিদের বিক্ষিপ্ত উড়াউড়ি-হাঁকডাক,
ওপারের রাতটা কবির চোখে আঁকে যায় উৎসবের ছবি।
এপারে বসে কবি নিজের চোখকে আরাম দেন
অমাবস্যার উরুতে বসে কবি গড়ে তুলেন কবিতার তুলতুলে শরীর
কবি লিখে চলেন- অবাক জোছনা ও উৎসবের কবিতা!
তারপর
হেমন্তের বাতাস ওপার থেকে এপারে নিয়ে আসে
আগুনে পোড়া ঘরবাড়ির ছাই
গবাদিপশু ও মানুষ পোড়ার উৎকট গন্ধ।
নদীরা মরে গেলে
বেশ কিছু নদী অপঘাতে মরে গেছে
কিছু নদী মুমূর্ষু হয়ে পড়ে আছে আইসিইউতে
নদীকে খুন করার জন্য মানুষের দারুণ প্রস্তুতি চলছে!
কিছু নদীর ডায়াগনোসিস রিপোর্টও বেশ জটিল
আঘাতে অপঘাতে একদিন সব নদী মরে যাবে,
জলশূন্য চরাচরে তখন বালুকাবেলা চিকচিক করে হাসবে
দলছুট বালি ধূসর প্রান্তরে বাতাসে এলোমেলো উড়বে
ধীরে ধীরে মুছে যাবে যাপিত জীবনের সমস্ত চলনের দাগ।
মানুষ,
একদিন কান্না করার মত একফোটা জলও কোথাও পাবে না।
জলের স্বভাব
জলেরও রাগ আছে
জলেরও গোস্বা হয়
গোস্বা হলে বানের জলে ভেসে যায় দুই তীর,
সাপের মত ফুঁসতে ফুঁসতে জল ঢুকে যায়
কৃষাণ-কৃষাণীর বাসর ঘরে
ভাসিয়ে নেয় বাসরের ফুল চন্দন ও সোহাগী রাত
জল ভাসিয়ে নেয় থালাবাটি, চুড়ি, ফিতে, প্রেম ও কাম
রেখে যায় পিচ্ছিল পথ, নষ্ট ধানক্ষেত, মাছের কংকাল।
জলের তুমুল ক্ষোভে ও আঘাতে নদীর দুই তীর ভাঙে
নিশ্চিহ্ন করে যায় বিস্তৃত এঁটেল ও বেলেমাটির স্থলভাগ
তারপর চারিদিকে শুধু জল আর জল; খোলস মানুষ!
জলেরও রাগ আছে
এই নিস্তরঙ্গ- এই নির্লিপ্ত জলেরও গোস্বা হয়
জল ক্ষেপে গেলে নেমে যায় নিচে; যতটুকু সে পায়।
স্বভাবতই জল নিম্নগামী হয়…