
নজরুলের দ্রোহ-প্রণয় ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ অসাম্প্রদায়িক মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে মানবতা, মুক্তি ও বিদ্রোহ; সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। জাতীয় কবি নজরুল বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। কবির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিকথা’র বিশেষ আয়োজন, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখা একগুচ্ছ প্রবন্ধ।
কাজী নজরুল ইসলাম দ্রোহের অনল জ্বেলেছিলেন ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে; অঙ্কের হিসেবে ২০২১ সালে শতবর্ষ পূরণ হলো। নজরুল যে অন্যায়-অত্যাচার আর শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে অগ্নিবীণা বাজিয়েছিলেন, সেই বীণার সুর হয়তো সর্বত্রই পৌঁছেছে, কিন্তু বন্ধ হয়নি—অত্যাচার, নির্যাতন, অন্যায়, অবিচার। ব্রিটিশ ঔপনিবেশের বিরুদ্ধে নজরুল রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাক্ষাত ‘ধূমকেতু’ হয়ে; কিন্তু আজ স্বাধীন দেশে শাসকগোষ্ঠী সেই একই পথে নির্যাতন করছে, অত্যাচার-অন্যায়-অবিচার আর লুটপাট করছে জনগণের সম্পদ। আমাদের নজরুল-চর্চা বৃথা অথবা শুধুই মুখের কথা হয়ে আছে কিংবা কাগজে কলমে লিখে রেখেছি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমানাধিকারের কথা, বাস্তবে শাসকগোষ্ঠীর সাথে শাসিতের আকাশ-পাতাল ফারাক কিছুতেই বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
কাজী নজরুল ইসলাম ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যে শতবর্ষ আগে যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, তা শতবর্ষ পরেও যেন সমানভাবে প্রযোজ্য। আজও একই দ্রোহের প্রয়োজন। আপামর জনগণের কণ্ঠ রুদ্ধ করে রেখেছে শাসক, শোষণ করছে, নির্যাতন করছে, লুটপাট করছে জনসম্পদ। কাজী নজরুল ইসলামকে এদেশের জাতীয় জাতীয় কবির মর্যাদায় আসীন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কী বাংলা ও বাঙালির ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন! নয়তো নজরুরের সাম্যের বাণী আজও বাংলায় এত প্রাসঙ্গিক কেন, কেন এত প্রাসঙ্গিক তাঁর বিদ্রোহের প্রতিটি শব্দ-বাক্য! ভবিষ্যৎদ্রষ্ট কিংবদন্তী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো সত্যিকার অর্থেই নজরুল সাহিত্যের মর্মবাণী অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, আর দেখেছিলেন— যুগে যুগে বাংলায় নজরুলের দ্রোহের ভাষা উচ্চারিত না হলে অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার কিংবা শোষণের অবসান হবে না। এজন্যই তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় আসীন করেছিলেন।
‘অগ্নিবীণা’য় রুদ্র রণবাদ্য বাজিয়ে লেটো দলের উড়নচণ্ডী আত্মভোলা বাউলের অভিষেক ঘটেছিল বাংলা কবিতার ইতিহাসে কবি হিসেবে, যখন রবির [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] প্রখর কিরণে চারদিকে আলোর বন্যা তখন স্বীয় প্রতিভায় স্বাতন্ত্র্যে নিজেকে আলাদা পরিচয়ে প্রতিষ্ঠা দিলেও মেধার সবটুকু উজাড় করে দেয়ার চল্লিশ বছর আগেই ফুলের জলসায় নজরুল নির্বাক হয়ে গেলেন।
ঝাঁকড়া চুলের নজরুল ব্রিটিশের ‘লৌহ কপাট’ কাঁপিয়ে দিয়েছেন পৌরুষদীপ্ত অহংকারে, অথচ তিনি স্বেচ্ছায় দীর্ঘ চল্লিশ বছর [বাকরুদ্ধ অবস্থা] স্বেচ্ছা কারাবাস মাথা পেতে নিলেন যেন। তারপরও একথা সত্য যে, নির্বাক হওয়ার আগেই কবি নজরুল পরাধীন ভারতবাসীকে লৌহ ‘জিঞ্জির’ ছেঁড়ার অভয় মন্ত্র শুনিয়ে জাগিয়ে দিয়েছিলেন এবং দিকে দিকে শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত-শাসিতের মনেপ্রাণে বৃত্ত ‘ভাঙার গান’ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অকুতভয় এই কলম সৈনিক।
অখণ্ড ভারতবাসীর হৃদয়ে স্বাধীনতার বীজ অবশ্য তিনি ‘অগ্নিবীণা’র সুরেই সংযোজন করেছিলেন; যে সুরের জোরে ব্রিটিশদের কবল থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল, সেই স্বাধীনতাও দেখেছেন তিনি কিন্তু সাতচল্লিশে কবি নজরুল স্বীয় অভিব্যক্তি কিংবা পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির উপলব্ধি কাব্যভাষায় আর শোনাতে পারেন নি অসুস্থ হয়ে পড়ায়। কবি নজরুল সুস্থ থাকলে কিংবা সবাক থাকলে তিনি সাতচল্লিশের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিভাজন কিভাবে নিতেন, তা বাঙালির জানা সম্ভব হয়নি—অসাম্প্রদায়িক কবির কণ্ঠ নিঃসৃত বাণী অথবা কবিতা থেকে। কারণ, তিনি তো সবসময় সাম্প্রদায়িক চেতনার উর্ধ্বে উঠেই মানুষের জয়গান করেছেন, মানুষের প্রকৃত মুক্তি ও শোষিত শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন—কবিতা গল্পে উপন্যাসে।
কবির বিদ্রোহী সত্তার অভ্যন্তরে প্রবাহিত ছিল ফল্গুধারার মতো প্রেম। সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখলেও আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবি নজরুলের প্রেমিক সত্তার প্রাবল্য। অন্যার্থে বলা যেতে পারে, তাঁর বিদ্রোহের প্রেরণা বা উৎসই ছিল প্রেম। প্রেম যেমন কবি নজরুলকে বিদ্রোহী হতে সহায়তা করেছে, একইভাবে তাঁর প্রেমের কবিতার শিল্পসার্থকতাও তাঁকে কবি হিসেবে সার্থক করে তুলেছে। তাই বোধ হয়, ‘অগ্নিবীণা’র অগ্নিগর্ভ নজরুলের উচ্চকণ্ঠ ‘দোলনচাঁপা’য় একেবারে নিচে নেমে এসেছে। ‘অগ্নিবীণা’র নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী এক দুঃসাহসী সৈনিক, কিন্তু ‘দোলনচাঁপা’য় তিনি প্রেমিক-হৃদয় এক সম্পূর্ণ পুরুষ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, কবি নজরুল ‘অগ্নিবীণা’য় যে বজ্র-নির্ঘোষে কবিতার পঙ্ক্তি উচ্চারণ করেছেন, তিনিই ‘দোলনচাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘পূবের হাওয়া’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘চক্রবাক’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে প্রেমের স্নিগ্ধ কোমল সুরের মধুর তানে মোহিত করেছেন।
শিল্প-সাহিত্যের দাবি অন্যত্র; সমালোচনার নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে তাঁর রচনাদির ইতিহাস-নির্ভর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, নজরুলের বিদ্রোহ কালের তাগিদে সৃষ্টি হয়েছিল এবং সময়ের সাথে সাথে প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে গিয়েছে; যদি সাধারণ দৃষ্টিতে তাঁর টেক্সট বিচার করি, তাহলে বিদ্রোহী নজরুল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছিলেন তা ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর কার্যত মূল্যহীন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হয়, কবি নজরুলের টেক্সট বিবেচনার সময় যে, তিনি এক হাতে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছেন অন্য হাতে বাঁশিতে প্রেমের মোহন সুর তুলেছেন। যদিও তাঁর বিদ্রোহের ধ্বজা নির্দিষ্টভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ছিল, তথাপি এর নিখুঁত পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁর টেক্সট নির্মিত হয়েছে প্রলেতারিয়েট শ্রেণীর পক্ষে। অসহায়, শোষিত, নির্যাতিত যে সকল মানুষের মুক্তি আজও মেলে নি। এই বিবেচনায় বিদ্রোহী নজরুলের টেক্সট কালিক সীমা পেরিয়ে বর্তমান যুগেও মূল্য হারায়নি। অর্থাৎ নজরুলের নির্মিত টেক্সটে মুল বিষয় হিসেবে মানুষ এবং মানবিক মূল্যবোধ উচ্চারিত হয়েছে, দ্রোহ-প্রতিবাদ প্রভৃতি বিষয়াদি কালের সাময়িক অনুষঙ্গে-প্রসঙ্গে তাঁর কবিতায় যুক্ত হয়েছিল। মূলত মানব-প্রীতি এবং প্রেমের চেতনায় তাঁর টেক্সট সমৃদ্ধ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং তাঁর রচনাদির সমালোচনা করতে গিয়ে যদি আমরা মনে রাখি যে, কোনো কিছুর উপযোগ তার স্ব-কালেই সীমিত, তাহলে আর চিরন্তনত্ব বিষয়ক তত্ত্ব কিংবা কালজয়িতার প্রশ্ন উঠবে না। প্রকৃত প্রস্তাবে চিরন্তনত্ব বিষয়ক তত্ত্বের মধ্যে মানুষের স্বকল্পিত মোহমায়া প্রধান অনুষঙ্গ। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিরন্তনত্বের তত্ত্ব অযৌক্তিক এবং অবান্তর; এটা আবেগের প্রতিফলন, উপযোগ-বুদ্ধি কিংবা যৌক্তিক চেতনার ফল নয়। প্রকৃতির জগতে ফুল-পাতা, অথবা আম-জাম, কলা-মূলো স্বল্পজীবী ক্ষণস্থায়ী বস্তু মাত্র, তাই বলে কোনো অর্থে তাদের অস্তিত্ব মিথ্যে বা ব্যর্থ নয়। তেমনি মানুষের জীবনে ও সমাজে কোনো কিছুরই উপযোগ আছে, কিন্তু তা চিরস্থায়ী নয়। তাছাড়া বস্তুর স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পার্থক্য ও পরিবর্তন-রূপান্তর আছে।
কোনো পুরাতনই নতুন কালের মানুষের চাহিদা পুরণ করতে পারে না। এখানে নতুন অর্থে বর্তমান আর পুরাতন অর্থে অতীতকে বোঝানো হয়েছে। সমকালে যা নতুন; অতিক্রান্ত সময়ে বা কালে তা উপযোগহীন এবং জরাজীর্ণ পুরাতন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আজো নতুন। তাঁর উপযোগ ও প্রয়োজনীয়তা নিঃশেষিত হয়নি। কেননা আমাদের সমাজে-ধর্মে-অর্থনীতিতে-রাজনীতিতে মনীষাদের প্রত্যাশিত পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটেনি। নজরুলকে যদি শুধু বিদ্রোহী কবি হিসেবেও আখ্যায়িত করে তাঁর টেক্সট বিশ্লেষণ করা হয়, তথাপি দেখা যাবে তিনি যাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছিলেন, তারা অদ্যাবধি সমাজে-রাষ্ট্রে বহাল তবিয়তে আছে। পার্থক্য শুধু এটুকু আগে বিদেশীরা এই শাসন-শোষণ নির্যাতন করেছে, সেখানে বিদেশীদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন নব্য-ধনিক শ্রেণীর দেশীয় শোষক শ্রেণী।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় মানব অস্তিত্বের গৌরবময় অতীত স্পন্দমান এভাবে, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ তাই তিনি নিজেকে ছাড়া পৃথিবীর আর কারো কাছেই মাথা নত করেন না। এই বিদ্রোহী কবির অন্তরে একাধারে আছে সংগ্রামমুখর প্রতিবাদের তীব্র ভাষা এবং প্রেম-বিরহ, শোক এবং বিচ্ছেদ-বেদনা। নজরুলের কবিতায় নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। অর্থাৎ তিনি নারী ও পুরুষকে সমান চোখে দেখেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় মানব অস্তিত্বের গৌরবময় অতীত স্পন্দমান এভাবে, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ তাই তিনি নিজেকে ছাড়া পৃথিবীর আর কারো কাছেই মাথা নত করেন না। এই বিদ্রোহী কবির অন্তরে একাধারে আছে সংগ্রামমুখর প্রতিবাদের তীব্র ভাষা এবং প্রেম-বিরহ, শোক এবং বিচ্ছেদ-বেদনা। নজরুলের কবিতায় নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। অর্থাৎ তিনি নারী ও পুরুষকে সমান চোখে দেখেছেন।
জীবন বন্ধ্যাত্বের নয়; যে জীবন বন্ধ্যাত্বের, সৃজনহীন যে জীবনে কোনো আশার আলোক নেই, সেখানে না বিদ্রোহ না প্রেম; কোনো কিছুরই চাষ হতে পারে না। পৃথিবী মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্র গ্রহ মাত্র, যা কিনা মহাশূন্যে ভাসমান। যেকোনো মুহূর্তে হতে পারে প্রলয়। তারপরও জীবন, জীবনের জয়গান, বেঁচে থাকার আকুল আকাঙ্ক্ষা! পৃথিবী নামক গ্রহে জীবনের বা প্রাণের অস্তিত্ব বিদ্যমান। আমরা এ পর্যন্ত যতটা বৈজ্ঞানিক দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে এবং মহাশূন্যের যতদূর পর্যন্ত গমন করতে পেরেছে, তার কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব মেলেনি। পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষও একটি প্রাণী; তবে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। কেননা তারই কেবল রয়েছে বুদ্ধি-বিবেচনা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-যন্ত্রণা কিংবা মিলনের আনন্দ সুখ। অত্যন্ত সংবেদনশীল কবি নজরুল স্বীয় অনুভূতির আবেগস্ফূর্ত প্রকাশ করেছেন অবলীলায়। তিনি এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিভার রশ্মিতে নিজে যেমন আলোকিত তেমনি অন্যকেও আলোড়িত-আন্দোলিত করেছেন জীবন বন্ধ্যাত্বের নয়; যে জীবন বন্ধ্যাত্বের, সৃজনহীন যে জীবনে কোনো আশার আলোক নেই, সেখানে না বিদ্রোহ না প্রেম; কোনো কিছুরই চাষ হতে পারে না। পৃথিবী মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্র গ্রহ মাত্র, যা কিনা মহাশূন্যে ভাসমান। যে কোনো মুহূর্তে হতে পারে প্রলয়। তারপরও জীবন, জীবনের জয়গান, বেঁচে থাকার আকুল আকাঙ্ক্ষা! পৃথিবী নামক গ্রহে জীবনের বা প্রাণের অস্তিত্ব বিদ্যমান।
সাতচল্লিশের ধর্মীয় রাষ্ট্র বিভাজন যে নজরুল কিছুতেই মেনে নিতেন না কিংবা এর বিরোধিতা করতেন, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একইসময় আবার একথাও সত্য যে, ধর্মের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজিত সেই রাষ্ট্রের ভিত্ও মজবুত ছিল না; আর ছিল না বলেই অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতি আবারো ‘হাতুড়ি শাবল’ হাতে ‘ভাঙার গান’ শুরু করে দিল; ব্রিটিশকে তাড়াতে নজরুল যে ভূমিকা নিয়েছিলেন সেই ভূমিকায় এবারে বাঙালির পরমাত্মীয় বঙ্গবন্ধু অবতীর্ণ হলেন; নজরুলের দ্রোহ ছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে—ভারতবাসীর মুক্তির লক্ষ্যে আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্রোহ ঘোষণা করলেন পাকিস্তানী শাসন-শোষণ-অত্যাচার-নির্যাতন ও সাংস্কৃতি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তখনো বিদ্রোহী কবি নজরুল জীবিত, অথচ তিনি বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতির ন্যায্য স্বাধিকার আন্দোলনের সহযাত্রী হয়ে বাঙালিকে উজ্জীবিত করতে পারলেন না। রোগশয্যায় শায়িত নজরুলের অন্তরও সেদিন নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অমর উক্তি : ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ গুঞ্জরিত হয়েছিল।
অতঃপর কবির নির্বাক নিশ্চল চোখের সামনেই রক্তস্রোতে ভেসে গেল সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলা জনপদ—পশ্চিমাদের পাশবিক হত্যা উৎসবে। নজরুল দেখলেন বাঙালির রক্ত এবং স্বাধীনতার লাল সবুজের আকাঙ্ক্ষিত পতাকা। তবে নজরুল একটিও চরণ রচনা করতে পারলেন না দেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার পরও। স্বাধীন বাংলায় কবিকে নিয়ে আসলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হলো অথচ কবি নীরব রইলেন তাঁর সম্মানে আয়োজিত ফুলের জলসায়। বলা বাহুল্য নীরব অবস্থায়ই কবি চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ছিয়াত্তরের ২৯ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ চত্বরে।
কবি কাজী নজরুল যেমন বিপ্লব-বিদ্রোহ আর সংগ্রামে প্রতিবাদমুখর তেমনি প্রেমের কোমল পরশে এক বিগলিত কবিসত্তা। ‘গুবাক তরুর সারি’ কবিতায় নজরুল হৃদয়ের সবটুকু ঢেলে দিয়ে তাই লিখতে পারেন, ‘বিদায় হে মোর বতায়ন পাশে নিশীথ জাগার সাথী।/ ওগো বন্ধুরা পাণ্ডুর হয়ে এলো বিদায়ের রাতি!’ [বাতায়ন-পাশে গুবাক তরুর সারি, চক্রবাক] নজরুলের ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনায় শ্রী মধুসূদন বসু যথার্থ মন্তব্য করেছেন, ‘চক্রবাক-চক্রবাকীর বিরহ-বেদনার মাধ্যমে ‘চক্রবাক’ কাব্যে কবি মানুষের চিরন্তন বিরহ-বেদনার সুরকে আভাসিত করেছেন।’ [শ্রী মধুসূদন বসু, নজরুল কাব্য পরিচয়, ১৯৯৪] সুতরাং দ্রোহী নজরুল যদি হারিয়েও যান তারপরও এই প্রেমিক নজরুল চিরন্তন যে মানবিক আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ তাঁর টেক্সেট থেকে পাওয়া যায় সেই আবেদন কখনো ফুরিয়ে যাবে না। সুতরাং কবি নজরুল হুজুগের যুগের কবি হলেও হারিয়ে যাবে না কোনো যুগেই।
কবি নজরুল স্বাধীনতার জন্য যেমন এক হাতে তুলে নিয়েছিলেন ‘রণতূর্য’ অন্য হাতে তাঁর মোহনীয় প্রেমের বাঁশি। বিদ্রোহের ডঙ্কা বাজিয়েছেন যে হাতে নজরুল সেই হাতেই তিনি ‘দোলন চাপা’র কোমল পাপড়ি পরম আবেগে স্পর্শ করেছেন। কিংবা বিরহতুর হয়েছেন ‘চক্রবাকে’ অথবা ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ রচনার সময়। তাঁকে দেয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অভিভাষণে দূরদর্শী নজরুল তাঁর কাব্যচর্চার মর্মোদ্ধার করে নিজেই বলেছিলেন, তিনি প্রেম দিতে ও নিতে এসেছিলেন। আর হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন শোষিত বঞ্চিত নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায় ও ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। তাঁর জীবদ্দাশায় ভারতবর্ষ ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হলেও সেই স্বাধীনতা নিয়ে নজরুলের বক্তব্য আর জানা যায়নি। তবে তিনি চিরবঞ্চিত অবহেলিত বা লাঞ্ছিতদের ভাগ্যোন্নয়ন অথবা মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীন সমাজ ব্যবস্থা দেখে যেতে পারেন নি। নির্নিমেষ চোখে মেলে মুক্ত বাংলায় বুক ভরে তিনি শ্বাস নিয়েছেন কিন্তু জানিয়ে যেতে পারেননি মুক্তির আনন্দ উপলব্ধির কথা। অথবা পরাধীন ভারতে যে কুলি মুটে মজুর শ্রমিক নির্যাতিত হয়েছিল স্বাধীন দেশেও যখন তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটল না, শাসকশ্রেণী যে একই নিয়মে তাদের ওপর নির্যাতনের রোলার চালাল, তার বিহিত কী হওয়া উচিত তাও বলে যেতে পারলেন না কবি নজরুল ইসলাম।
মৃত্যুর অনেক আগেই তিনি লিখেছিলেন ‘মসজিদের পাশে আমায় কবর দিও ভাই’। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই তাঁকে কবর দেয়া হয়েছে। তবে কবরে যাওয়ার আগে এই মহৎ মহাপ্রাণ মানুষটি দেখে গেছেন ইতিহাসের নির্মম ও জঘন্য হত্যাকাণ্ড। যে মানুষটি বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন তাঁকে মুক্তির বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার অধিকার এনে দিয়েছিলেন তার বুকে ঘাতকের বুলেট বিদ্ধ হলে নজরুল সম্ভবত বেঁচে থাকার মতো আর ঝুঁকি নিতে চাননি। এজন্য বঙ্গবন্ধু পঁচাত্তরে শহীদ হওয়ার পরের বছরই কবিও নীরবতা ভঙ্গ করে সরব হলেন এবং বাঙালির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে। এভাবেই দীর্ঘ চল্লিশ বছরের নির্বাক জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করলে তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদায় কবরে শুইয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের জাতীয় কবির আত্মা কি শান্তিতে ঘুমাতে পারছে?