
নচিকেতা—চেতনায় যার শব্দের চাবুক
নচিকেতা—বাংলা গানের বাঁক ঘুরানো এক ক্ষ্যাপাটে কারিগর। নব্বই দশকের গোড়ায় যখন সুমন চট্টপাধ্যায় নতুন এক ধারায় বাংলা গানে ব্যতিক্রমী শব্দ বসালেন, তার মাধ্যমে সংগীত পিপাসু মানুষ পেল শব্দ-সুরের এক ভিন্ন স্বাদ। চেনা সংগীতে ঐ সময়টাতে যে পরিবর্তনটুকু এলো তার সবটুকুই মানুষ যেন পুরোটা গলাধঃকরণ করতে লাগলো। এর অল্পদিনের মধ্যেই এক প্রবল ঝড় হয়ে যেন আচমকা সামনে এসে দাঁড়ালো নচিকেতা। নচিকেতা চক্রবর্ত্তী। এমন এক প্রবাহ নিয়ে সে এলো তাতে গতানুগতিক সংগীতায়তন এক ঝটকায় যেন কেঁপে উঠলো। চারিদিকে ত্বারস্বরে গুঞ্জন শুরু হলো, হৈ হৈ পড়ে গেলো! নচিকেতার গানের সুর যতোটা নয় বরং তার শব্দ আর বাচন ধৃষ্টতা সংগীত পিপাসুগণকে অনেকদিক থেকেই ভাবিয়ে তুললো। মানুষ তাঁর গান শুনে এক ঘোরলাগা মূর্চ্ছনায় ডুবে যেতে থাকল। বলা বাহুল্য, সংগীতের জগতে নবীন হয়েও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এক শক্তিশালী সংগীতব্যক্তিত্বের পূর্বাভাস পাওয়া গেল।
কিন্তু কেন এমন গান সে লিখল? কোন প্রেক্ষাপটে এমন জীবনমূখী, চেনাজগত-সংসারকে চ্যালেঞ্জ করে গান লিখবার প্রয়োজন বোধ করলো? তা এক্ষণে তাঁর বয়ানে শুনি। সে বলছে—
আমি তখন মণীন্দ্র কলেজের ছাত্র। আশুতোষ কলেজের উল্টোদিকে চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হসপিটাল। মায়ের দূরারোগ্য ক্যান্সার। সেখানে ভর্তি-মা। তাই গ্র্যাজুয়েশনের পর রবীন্দ্রভারতীতে মিউজিক নিয়ে পড়তে যাওয়াকে মনে হয়েছিল বিলাসিতা। আমাকে রোজগার করতে হবে। আমার বাবা-স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। আজীবন স্বপ্ন দেখে গেছেন দিন বদলের। ‘আমি ভবঘুরেই হব’- এটা কি আমি বাবার কাছ থেকেই ইনহেরিট করেছিলাম ? হয়তো তাই। বাবা হঠাৎ চোখ বুজলেন। তারপরই সব পাল্টে গেল।
বিয়ে করলাম এবং অবশ্যই ভালবেসে। বিয়ে করার পর বুঝলাম পৃথিবী অনেক কঠিন জায়গা। মাঝে মাঝে ফ্রীল্যান্সে ফাংশন করি। আর ঘুরে বেড়াতাম বিভিন্ন প্রডাকশন হাউসগুলোতে, কাজের খোঁজে। কিন্তু কোথাও কাজ খুঁজে পাচ্ছি না। ভিতরে ভিতরে সে কী অসহ্য যন্ত্রণা ! কোথাও আলোর চিহ্ন নেই। এভাবে বেকার আর ঠিকঠাক রোজগার ছাড়া কেটেছিল এগারো বছর।—“কেয়ার অফ ফুটপাথ, নচিকেতা দু’টি হাত।”
গত শতাব্দির শেষ দশকের গোড়ায় যখন তার প্রথম এ্যালবাম ‘‘এই বেশ ভালো আছি” আসে তখন তা প্রথমেই বড় ধরনের ধাক্কা দেয় সংগীতপিপাসুদের। সংগীতপ্রিয় মানুষ কান খাড়া করে শুনতে থাকে ভিন্নধারার শব্দ-বিন্যাস আর সুরে বাঁধা সেসব গান। সংগীতের সমঝদার যারা তারা কৌতুহলী হয়ে ওঠে তার ব্যাপারে। আর প্রথম এ্যালবাম হিসেবে ‘‘এই বেশ ভালো আছি” হয়ে যায় একবারে ইন্সটেন্ট হিট! এসব ক্ষেত্রে যা খুব সহজ নয় নচিকেতার ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। এরপর প্রতিবছরই এসেছে নতুন নতুন গানের এ্যালবাম। নতুন নতুন কথায় আর সুরবিন্যাসের গান শুনিয়ে সমাজ-রাজনীতিসচেতন মানুষের সম্পূর্ণ মনযোগ কেড়ে নেন। খুব অল্পদিনেই নচিকেতা সংগীতবোদ্ধা, সাধারণ শ্রোতা এবং নতুন-পুরানো সবধরনের মানুষের পছন্দের প্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠে।
১ লা সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ সালে কলকাতায় জন্ম নেয়া এই মানুষটি যার পূর্বপুরুষের বাড়ি বাংলাদেশের পিরোজপুরে। পড়াশোনা করেছেন কলকাতার মনীন্দ্র কলেজে। রাজনীতি সচেতন একটি ঘরানায় বেড়ে ওঠার পথে ছোটবেলা থেকেই গান লেখা, সংগীত চর্চা শুরু। প্রথম এ্যালবামে অভাবনীয় সাফল্য তাঁকে আরও জীবনমূখী এবং জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে লিখতে ও গাইতে অনুপ্রেরণা দেয়।
গান নিয়ে তাঁর কাজ, গানের কথা, গানের মাধ্যমে সমাজ সচেতনতার বার্তা প্রদানের যে সচেষ্ট চেষ্টা এবং এর পাশাপাশি লেখালেখি ইত্যাদি মিলিয়ে নচিকেতাতে একজন অতিসংবেদনশীল রাজনীতি ও সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব হিসেবেই শুরু থেকেই পেয়েছি। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না থেকেও তাঁর প্রায় প্রতিটি গানেই রয়েছে রাজনীতি, সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে কোনো না কোনো দিক থেকে সচেতনতার বার্তা। সেই প্রথম এ্যালবামে শুরু করে এখন পর্যন্ত গানে গানে ছড়ানো শব্দ আর উচ্চারণে সে সমাজ সচেতনতার এক নতুন বাতাবরণ তৈরি করে চলেছে।
প্রথম এ্যালবাম ‘‘এই বেশ ভালো আছি” তে তার লেখা-সুর ও গায়কি সম্পূর্ণ আদালা। এ্যালবামের প্রতিটি গানই যেন একেকটি জীবনঘনিষ্ঠ ইস্যুতে নতুন ধারণা আর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাজির হয়েছে। যখন সে বলছে—
এই বেশ ভালো আছি,
কর্ম-কাজ নেই, গাড়ি-ঘোড়া কিছু নেই,
অফিস-কাছারি নেই, হাজিরা-কামাই নেই,
শব্দ বা পরিবেশ দূষণ বালাই নেই,
সময় দেয় না বলে তেলেবেগুনে জ্বলে গিন্নির রাগ নেই,
টেলিফোনে ডাক নেই………..নেই নেই কিছু নেই,
তবুও তো আছে কিছু বলতে যা বাধা নেই।
এই গানের কথায় উঠে এসেছে প্রচলিত গতানুগতিকতার একঘেয়েমি আর অন্তঃসারশুণ্যতা বিরুদ্ধাবেগ। কিন্তু তবুও থেমে থাকার সুযোগ নেই। তবুও কথা বলা দরকার রয়েছে বলে সে বলছে।
যখন সে গায়—হেই, তুমি কি আমায় ভালোবাসো? যদি না বাসো তবে পরোয়া করি না। এই প্রথম কোনো উঠতি কিশোর জীবনের সুতীব্র ভাবাবেগকে পাশ কাটিয়ে বলবার সাহস দেখাল যেনতেনভাবে, ব্যক্তিজীবনের যতোকিছু অহংকার সব বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসা পেতে সে চায় না। সেই প্রথম বলছে- সে প্রয়োজন হলে সূর্যের থেকে ভালোবাসা নিয়ে, তার রঙ দিয়ে হৃদয়কে রাঙ্গাবে কিন্তু তথাকথিত পোষাকীপ্রেমের প্রয়োজন তার নেই। শুধু তাই নয়, ঐ গানেই কেন সে অমন প্রেম প্রত্যাখ্যান করতে চায় সেই নিগূঢ় সত্যটি উন্মুক্ত করে দিচ্ছে এই বলে যে—যখন তার বাড়িতে একফোঁটা কেরোসিনের অভাবে আলো জ্বলে না, যখন সংসারের সামান্য প্রয়োজন মেটাতে তার বুড়োবাপের জেরবার অবস্থা হয় তখন সে কিছুতেই নামীদামী দোকানের দামী খাবার খেতে পারবে না।
গতানুগতিক, প্রেমের ভাবালুতা আর সুরপ্রধান গানের একঘেয়েমী সে ভাঙতে চেয়েছে। গানের ভাষায় দিনবদলের কথা থাকুক—এটাই নচিকেতা চাইত। সে বলছে—
শুনবো না গান আর শুনবো না।
একঘেষে ঘ্যানঘ্যান, বিরহ-প্রেমের গান
আমি-তুমি, তুমি-আমি পারমোটেশান আর কম্বিনেশন
অথবা শাসকদের কালোহাত ভেঙে দাও, ভেঙে দাও।
এই বলে চিৎকার—এটাও তো গান
শোষকের ক’টা হাত, ক’টা মাথা ক’টা দাঁত
এর কোনো উত্তর দেয়না যে গান,
উত্তর একটাই—নিজে খুঁজে নাও
নিজে যদি খুঁজবো, নিজেদেরই বুঝবো, শুনবো না গান আর শুনবো না।
চারিদিকে যা ঘটছে তাতে নতুন কিছুর আভাস নেই। নেই কোনো গতি। সবকিছুই কেমন যেন একইরকম, চর্বিতচর্বণ। কোথাও আবিস্কার নেই, স্বপ্ন নেই। দিনবদলের আহ্বান নেই রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে, নেই কোথাও।
নচিকেতা যেই সময়ে তাঁর প্রথম এ্যালবামের কাজ করে তখনকার বন্ধ্যাসময়কে নিয়ে তার কলমে উঠে আসল এক অসাধারণ গান। সে গাইলো—
যখন সময় থমকে দাঁড়ায় নিরাশার পাখি দু’হাত বাড়ায়
খুঁজে নিয়ে মন নির্জন কোণ কী আর করে তখন
স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখে মন।
একই গানে সে আরও বলছে—
যখন এ মনে প্রশ্নের ঝড়, ভেঙে দেয় যুক্তির খেলাঘর
তখন বাতাস অন্য কোথাও শোনায় তার উত্তর
যখন আমার ক্লান্ত চরণ অবিরত বুকে রক্তক্ষরণ
খুঁজে নিয়ে মন নির্জন কোণ কী আর করে তখন……………..।
জীবনটা যে কন্টকাকীর্ণ, কুসুমাস্তীর্ণ নয় সেটা নচিকেতা ভালো করেই বুঝে ফেলেছে। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেড়িয়ে যতোটা পথ তাঁর আসা সেটাতেই পোক্ত হয়েছে জীবন। তাইতো সে গাইছে—
অন্তবিহীন পথে চলাই জীবন, শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন
জীবন প্রসব করে চলাই জীবন
শুধু যোগ-বিয়োগের খেলাই জীবন।
এই একটি গানেই জানা যায় জীবন সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি। এইসকল গান যখন সে লিখছে তখন তার বয়সই বা কতো? তিরিশ বা কিছু বেশী। ঐ বয়সেই জীবন সম্পর্কে অনেকগুলি জায়গায় তার বক্তব্য একেবারেই পরিস্কার হয়ে উঠেছে। জীবনের সৌন্দর্য নিয়ে অনেকেই বলেছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো বলবে কিন্তু জীবনের অন্ধকার যে দিকগুলি সেগুলি তাহলে কে তুলে ধরবে। এক্ষেত্রে নচিকেতা অকপট। তাইতো সে বলতে পারছে—
ফুটপাতে বেওয়ারিশ শিশুরাই জীবন
রাম, ইসলাম আর যীশুরাই জীবন
যে মেয়েটা রোজ রাতে বদলায় হাতে হাতে
তার অভিষাপ নিয়ে চলাই জীবন!
কোটি কোটি মানুষের জীবন সংগ্রাম, না পাওয়ার বেদনা, জীবন সংগ্রামে হেরে যাওয়া তাঁর মনকে সবচেয়ে বেদনাহত করেছে। সমাজের উঁচুনীচু ভেদরেখা, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া মানুষের ইতর আস্ফালনও তাকে বিশেষভাবে ভাবাতো। কেন, কীভাবে এবং কাদের ইশারায় এমন সব অনিয়মই নিয়ম হয়ে ওঠে সেটাও তাঁর গানের নিরন্তর গবেষণার বিষয়। নচিকেতাই খুব সম্ভবত প্রথম এমন তেঁজীভাবভঙ্গি নিয়ে শব্দের গায়ে আটপৌঁঢ়ে সুর লাগিয়ে যখন গাইলেন তখন চারিদিয়ে শোরগোল পড়ে গেল। তাঁর এ বিষয়ে গানটির কথাগুলো—
হাসপাতালের বেডে টিবিরোগীর সাথে খেলা করে শুয়োরের বাচ্চা
তবু রেডিওটা টিভিটার সাথে সুর ধরে—সারে জাঁহাছে আচ্ছা।
এই গানেই নচিকেতা বলছে—
আমার পরিচয় বেকার যুবক আমি সম্বল একটাই—দৈন্য
ডিগ্রির ভাঁড়ারেতে তবু কিছু মাল আছে—পকেটের ভাঁড়ারটা শুণ্য
যেদিকে তাকাই না দেখি জনঅরণ্য, সে অরণ্যেই দেখি মানুষেরা পণ্য
বধুকে পোড়ানো হয়, অধর্ম জয়ী হয়
মানুষের রক্তেই দিনলিপি সই হয়।
দেশের শাসন কাঠামোর দূর্বলতা, অনিয়ম এবং তজ্জনিত নেতিবাচক প্রভাবে জীবনে যে দূর্বিসহ অবস্থা হয় সেটা তাঁর চোখ এড়ায় নি। সে বলছে—
চাকুরির সন্ধানে সুকতলা ক্ষয়ে যায়
গঙ্গার জল তবু একইভাবে বয়ে যায়
ঘুষ ঘুষ ঘুষের এক খুশখুশে জ্বরে গোটাদেশ চিকৎকার করে ডাকে ডাক্তার
ডাক্তার উঠে আসে দ্বীনের ওষুধ নিয়ে,
গঙ্গার পুজো হয় গঙ্গার জল দিয়ে।
বছরের অন্তে বাজেটের যন্ত্রে পিষে দেয় জীবনটা গচ্চা
তবু রেডিওটা টিভিটার সাথে সুর ধরে সারে জাঁহাছে আচ্ছা।
নানা অনিয়ম, ব্যভিচার আর দুঃশাসনে পিষ্ট হয়ে অতিষ্ঠ হয়েও তো মানুষ বাঁচতে চায়। জীবনের ধর্মে বেঁচে থাকার যে অদম্য আকাঙ্ক্ষা সেটা তো সবাই শেষতক ছুঁয়ে দেখতে পারে না। কেউ কেউ পারলেও অনেকের জীবনেই থেকে যায় না পাওয়ার হাহাকার। জীবনসংগ্রামের সেইরকম কিছু কিছু অনুভূতি নিয়ে সে লিখেছে—
শুধু বিষ, শুধু বিষ দাও, অমৃত চাই না
অমরত্বের লোভ করুক বিক্ষোভ, জীবনকে যদি দাও নীল বিষাক্ত ছোপ
থাকবে না থাকবে না ক্ষোভ।
ধ্বংশের ব্যবসায় মগ্ন যে সভ্যতা, তার অমৃত চাই না
বিভেদমন্ত্রে দিক্ষীত যে সভ্যতা তার অমৃত চাই না
সবুজ পৃথিবীটাকে যন্ত্রের কালো হাতে
শ্বাসরোধ করে যে প্রগতি
পরিসংখ্যানে মানে জীবনের ক্ষয়ক্ষতি
এমন প্রগতি চাই না,
শুধু বিষ, শুধু বিষ………………..।
চলমান উন্নয়নের হিপোক্র্যাসি নিয়েও কথা বলেছে তার গান। সমাজে যে অনিয়ম, দূর্ণীতি আর অসমতা তার কারণ যে অনেকাংশেই রাজনৈতিক, উৎপাদন আর বন্টনব্যাবস্থার ক্রটি সেটি তার গানে নচিকেতা স্পষ্ট করে বলার চেষ্টা করেছে। সে বলছে—
ভীড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সোনারোদ
ছোট ছোট শিশুদের শৈশব চুরি করে গ্রন্থকীটের দল বানায় নির্বোধ
এরপর একটি চুরি গেলে বাবুদের ব্রিফকেস, অথবা গৃহিণীদের সোনার নেকলেস
সকলইে সমস্বরে চিৎকার করে উঠে চোর চোর চোর………………..।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার অন্তঃসারশূণ্যতা এবং বেনিয়া শিক্ষাব্যবসায় সম্পর্কে নচিকেতার গানই প্রথম যারা প্রকাশ্যে এর কদর্য রূপটাতে প্রকাশ্যে আনলো। শিক্ষার চলমান ধারা যে একটা সিন্ডিকেট, এটাতে পুঁজি লগ্নি করে অল্পদিনে টুপাইস কামিয়ে নেয়ার একটি মহার্ঘ্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে সেটা এতো চাছাছোলা কথায় জনসম্মুক্ষে আর তো কেউ আনলো না। একটি দেশের শিক্ষা, জাতির ভবিষ্যত তৈরির অন্যতম একটি ম্যাকানিজম বেনিয়াদের হাতে পড়ে ভেতর থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে বিষয়গুলি নিয়ে লেখা তার এ গানটি অনন্য। সেখানে সে স্যাটায়র করে বলছে—
……….মন দিয়ে লেখাপড়া করে যেইজন বড় হয়ে গাড়িঘোড়া চড়বে সেজন
মুছে যাবে অভাব সব অনটন হবে রাশি রাশি হাসিমাখা তোমার জীবন।
বাচ্চা হবেই শুনে চারিদিকে খোঁজ খোঁজ কোথা ভালো স্কুল আছে আলোচনা রোজ রোজ
কারা ক’টা ফরম দেবে, কারা ক’টা ছেলে নেবে
ক্ষতি নেই যদি দাও ওভার ওভার ডোজ।
রাতজেগে বাবাদের লাইন দিয়ে ফরম তোলা
ডোনেশন দিলে পড়ে পেছনদরজা খোলা—ছেলে কি প্রতিভাবান?
প্রতিভা ট্রতিভা সব নাথিং বাট ফান
রাম রাম মনে করে জপে যান বার বার একটি ছোট্ট কথা-ম্যানুপুলেশন!
এমন যখন চলছিল সেই সময় ১৯৯২ তে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে অসহ্য অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। সময় বিচারে মানুষ নানা হিসেবী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। কিন্তু নচিকেতা অন্য ধাতুতে গড়া বলেই লিখলেন—
এই বেশ ভাল আছি!
এই বেশ ভালো আছি, কর্মকাজ নেই, গাড়ি-ঘোড়া কিছু নেই
অফিস কাচারি নেই, হাজিরা-কামাই নেই
শব্দ বা পরিবেশ দূষণ বালাই নাই।
একঝাঁক চারধারে ফুটপাথে থাকে যারা
কেউ কোত্থাও নেই—
নেই নেই কিছু নেই
তবুও তো আছে কিছু বলতে যা বাধা নেই
সে সময়ে সুভাষ চক্রবর্তীর আয়োজনে একটা অনুষ্ঠানে সে ঐ গানটি গাইল। শ্রোতারা এই প্রথম এমন ভাষা, এই ভাবনার কোনও গান শুনল। সবাই কেমন বিহ্বল হয়ে গেল। একদিকে তাদের শিহরণ জাগছে, ভাল লাগছে, কিন্তু ঠিকঠাক বোঝাতে পারছে না। তার কয়েকদিন পরে গঙ্গা উৎসবে আরতি মুখার্জি, ভুপেন হাজারিকার উপস্থিতিতে নচিকেতা ‘এই বেশ ভাল আছি’ আর ‘চোর’ গান দুটি গাইলে শ্রোতাদের অনুরোধে আরও ন’টা গান গেয়েছিল। সেদিন শ্রোতারা তাঁর কাছে আরও গান শোনার অনুরোধ করেছিল। দর্শক-শ্রোতারা যখন একটা রোম্যান্টিক গান শুনতে চেয়ে অনুরোধ করেছিল তখন নচিকেতা গেয়েছেন, ‘হেই, তুমি কি আমায় ভালবাসো?” নচিকেতা জানাচ্ছেন—সেদিন প্রচলিত গানের সব ব্যাকরণ তছনছ হয়ে গিয়েছিল গঙ্গায়!
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দিনবদলের স্বপ্ন বোনা, জীবন যাপনের জন্য নিজের মতো করে পথ করে নেয়ার সাহস আর চলমান অসহ্য অচলায়তনকে চ্যালেঞ্জ করার যে বারতা তাঁর গানে আছে—তাই মানুষকে দিয়েছিল এক আশা জাগানিয়া বারতা। সংগীতপ্রেমী মানুষ যেন প্রবল হর্ষধ্বনি আর গানের মঞ্চে সদর্ভ উস্থিতিতি দিয়ে নীরবেই তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিল—নচিকেতা, তুমি থেমো না, লিখে যাও-গেয়ে যাও।
নচিকেতা চলতে শুরু করলো—কথা আর সুর বসিয়ে বসিয়ে। অল্প কয়েক বছরে সে লিখা আর সুরে ভরে দিল শ্রোতাদের আকাঙ্ক্ষার উঠোন। ফি বছর আসতে থাকলো এ্যালবাম।
১৯৯৩ সালে আসলো তাঁর প্রথম (অ্যালবাম আকারে)-এই বেশ ভালো আছি। এ অ্যালবামে পরিবেশিত হল- অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন, এই বেশ ভালো আছি, যখন সময় থমকে দাঁড়ায় এবং সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’র মতো ভিন্নধর্মী লিরিক আর সুর। বলা বাহুল্য, অ্যালবামটি সে সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে আর একটি অ্যালবামে সে লিখলো—বিষ, শুধু বিষ দাও, কলকাতা, মন দিয়ে লেখাপড়া করে যেই জন, তুমি কি আমায় ভালোবাসো? কেউ বলে বুড়ো ভাম, শুনবো না গান আর শুনবো না এবং নীলাঞ্জনা। ‘‘মন দিয়ে লেখাপড়া করে যেই জন” এবং ‘নীলাঞ্জনা’ গান দু’টি নচিকেতার জাত চিনিয়ে দিল। দর্শকরা এই অ্যালবামের সবকটি গানই পছন্দ করেছিল। পছন্দ করেছিল বলেই হয়তো সে সময় মানুষ গুনগুন করে গাইত শুধু বিষ, শুধু বিষ দাও—অমৃত চাই না; শুনবো না গান, গান শুনবো না।
একই বছর ‘‘কে যায়” নামে আরও একটি অ্যালবাম রিলিজ হয়। যার প্রতিটি গান দর্শকপ্রিয়তা পায়। এই অ্যালবামের অ্যাম্বিশান, অনির্বাণ, একদিন ঝড় থেমে যাবে এবং নীলাঞ্জনা-২ অধিক জনপ্রিয় হয়। অ্যাম্বিশান শিরোনামে যে গানটি সেখানে নচিকেতা শোনালেন অন্য এক অ্যাম্বিশানের কথা। গৎবাধা সমাজমানসে যে অ্যাম্বিশান চর্চা হয় বলা যায় তা পুরোটাই বৈষয়িক। যেখানে সবাই হয় ডাক্তার, না হয়-ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। কিন্তু না, নচিকেতার অ্যাম্বিশান হলো-বাউল হওয়ার। অনির্বাণ-গানটি ধরে নেয়া হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতি আর গ্লানি থেকে লিখা। রাজনৈতিক চেতনা আর আদর্শেও ধ্বজা ধরে এখনও যারা আছেন অনির্বাণ তাঁদের প্রতিরূপ। কিন্তু নচিকেতা মনে করছে—তাঁর মতো অনেকেই সেই আদর্শের পতাকা আর ধরে নেই। নচিকেতা অনির্বাণের মুখ দিয়ে শোনালেন—তাঁর আসলে কোথায় থাকার কথা ছিল। ‘‘কালো মেয়ে” শিরোনামে যে গানটি সেখানে সে নারীর প্রতি গতানুগতিক পুরুষ সমাজের ক্লিশে দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে দেখিয়েছে—নারী এখনও পণ্য। বিয়ের বাজারে একজন নারীকে জিম্মি করে পুরুষের দর চড়িয়ে নেয়ার যে বিশ্রি প্রবণতা সেটাই গানটিতে তুলে ধরেছে নচিকেতা।
পচানব্বইতে আসে ‘‘কি হবে” নামে নতুন অ্যালবাম। এতে ‘ভয়’ শিরোনামে গানটিতে সে তুলে ধরে আদর্শহীন রাজনীতির দৈন্যতা আর কাপুরুষতা। চলমান রাজনীতির একটি বড় অংশই যে আসলে ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ফন্দি সেটাই এ গানে সে দ্বর্থহীন ভাষার তুলে ধরে। এ গানের শুরুটা এমন—
ডাইনে-বায়ে, গঞ্জে-গ্রামে
পুরোনো অথবা নতুন অধ্যায়
বিশৃঙ্খলা যতোই বাড়ুক
গণতন্ত্র-রাষ্ট্রযন্ত্র দু’চোখ বুজে রয়
ভয়, ভয়, ভয় ভয়—পাছে ভোট নষ্ট হয়!
এই অ্যালবামেই নচিকেতা বর্তমান সময়ের তথাকথিত যন্ত্রসর্বস্ব সংগীত চর্চাকে উপহাস করে স্তুতি করেছে পুরোনো দিনের বাংলাগানের বিশাল ঐশ্বর্যকে। সে নাম ধরে ধরে দেখিয়ে দিয়েছে কোন কোন প্রবাদপ্রতিম কন্ঠশিল্পী এই বাংলাতেই ছিলেন। তাঁর এই গানের মাধ্যমে অনেকেই হয়তো জানতে পারলো-হেমন্ত, মান্ন দে আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছাড়াও আরও অনেক শিল্পী একই কাতারে উচ্চরিত হওয়ার মতো ছিলেন। যেমন- অখিল বন্ধু ঘোষ, সতীনাথ মুখার্জি, নীলা বসু, তালাত মাহমুদ, নির্মলা মিশ্র, মানবেন্দ্র মুখার্জি, প্রতিমা মুখার্জি প্রমূখের নাম। ‘‘উল্টো রাজার দেশে” গানটিতে নচিকেতা নষ্ট রাজনীতির প্রতি আবার খড়গহস্ত হলো। সোজাসাপ্টা কথায় সে বলল—এদিকে ধর্ম, ধর্ম, ধর্ম নিয়ে চলছে দামাল, আসলে ধর্মকে তোয়াজ করে সব শালারাই সাদা বা লাল!
’৯৬ তে এলো ‘‘চল যাবো তোকে নিয়ে” আরেকটি অ্যালবাম। এতে ২০১ ধর্মতলা, ফেরিওয়ালা, পৌলমী, অনির্বাণ-২ সহ আরও কিছু গান। এটাও সমান জনপ্রিয়তা পায়। ফেরিওয়ালা গানটি অ্যাম্বিশান-গানটিরই যেন সিক্যুয়াল। এখানে সে বলছে—আমি এক ফেরিওয়ালা ভাই, স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াই। ‘পৌলমী’ গানটিতে নচিকেতা তুলে ধরল পুঁজিবাদী আর ভোগবাদী সমাজ বাস্তবতায় প্রেম যে ডিক্লাসড হতে পারছে না সেটাই। কী দুর্দান্ত প্রেম তাও সে অভাবের সংসারের জানালা দিয়ে একদিন যে ফাঁকি দিতে পারে তেমন একটি বাস্তবতা।
সাতানব্বইতে এলো- কুয়াশা যখন। এখানে নচিকেতা যেন কিছু স্তিতধী। চেনা নচিকেতার উচ্চকন্ঠ এখানে অনেকটা ঠান্ডা প্রকৃতির। খুব নরম সুরে আর ঢিমেতালে সে শোনাল- এ মন ব্যাকুল যখন তখন, ফিরে যায় বারে বারে, ঘিরে ধরে কুয়াশা যখন। সে আবারও প্রেমের তথাকথিত অভিনয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে গাইল—এটস এ গেইম, ইটস এ গেইম।
উন্নিশ শ আটানব্বইতে ‘‘আমি পারি” অ্যালবামে সে আবার উচ্চকন্ঠ, প্রতিবাদী। এখানে সে লিখে গেয়ে বসলো—সরকারি কর্মচারিদের ফাঁকিবাজী আর দায়িত্বহীন কর্মকান্ড নিয়ে। সে যা বলল—তার কিচ্ছুটি অসত্য নয়। যেমন সে বলছে—বারোটায় অফিস আসি, দু’টোয় টিফিন, তিনটেয় যদি দেখি সিগনাল গ্রিন, চটিটা গলিয়ে পায় নিপাট্টের দ্বিধায় চেয়ারটা কোনোমতে ছাড়ি, চারটেয় চলে আসি বাড়ি। ‘রাজশ্রী তোমার জন্য” আর একটি অধিক জনপ্রিয় গান। এখানে নচিকেতা ‘রাজশ্রী’কে রূপক ধরে আসলে বলল—আমরা তথাকথিত প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য সমাজের সর্বজন স্বীকৃত মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতাকে কীভাবে বিসর্জন দিচ্ছি সেই কথা। ‘‘নিলামে উঠছে দেশ’’ গানটিতে নচিকেতা বললো—
নিলামে উঠছে দেশ
কালখন জীবন বাঁচতে চাওয়াটা বিলাসিতা,
বাজে প্রচারের ঢাকা, মগজটা করে তাক্
বৃহন্নলাই আজ সীতা!
’ ৯৯ তে এলো ‘দলছুট’। এই অ্যালবামের বিবাহিত জীবনে পুরুষের বিড়ম্বনা নিয়ে গাইল—জীবিত বিবাহিত শিরোনামে একটি গান। গানের কথা কিছুটা চটুল হলেও এরমধ্যে কিছু যে অপ্রিয় সত্যতা আছে সেটা বলা যায় বৈকি। কিন্তু একই অ্যালবামের ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটি যেন আর সবকটা গানকে ছাপিয়ে গেল। সমাজের ভেতর নিরবে চলতে থাকা এক ভয়ঙ্কর অসুখ-পিতামাতার প্রতি অবহেলা এবং বার্ধক্যে পিতা-মাতার যে অসহায়ত্ব সেটা উঠে এলো তাঁর কথায় আর সুরে। গানটি ওপার বাংলা-এপার বাংলায় অনেকেই শুনেছেন আর সবাই মিলিয়ে নিয়েছেন যার যার অবস্থান। তবে, এটা ঠিক-নচিকেতার গানটির মাধ্যমে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্বে যে অবহেলা এবং এ নিয়ে প্রজন্মের মধ্যে বিশেষ সচেতনতা যে দরকার সেটা বেশ জোড়ালো হয়েছে। একই সালে ‘‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’’ ও ‘‘শ্রীচরণেষু” দর্শকদের হাতে আসে। দুটি অ্যালবামে বেশ কয়েকটি গান জনপ্রিয় হয়। তারমধ্যে ‘‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়” গানটিতে বহুলশ্রুত একটি গানে পরিনত হয়। গানটিতে একইসাথে রয়েছে রূঢ় বাস্তবতা, ভাবালুতা এবং আফসোস। আর এসব কিছুর মিশেলে গানটি মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। এছাড়া, একা একা পথ চলা, একদিন ঝড় থেমে যাবে-পৃথিবী আবার শান্ত হবে গান দুটিও কম জনপ্রিয়তা পায়নি।
২০০০ সালে পরপর তিনটি অ্যালবাম ‘‘আনতে ভোর”, জলসিঁড়ি ও ‘‘চলতি এ জীবন” বাজারে আসে। অ্যালবামগুলির- চলো নতুন করে, আঁধারে ভরা রাতি, এই যে রক্তে ঘামে, চলতে চলতে গানগুলি সমান জনপ্রিয়তা লাভ করে।
‘‘নচিকেতার আবিষ্কার” অ্যালবামটি আসে ২০০১-এ। এই অ্যালবামের সঘন মগন, একদিন যাবেই চলে, মাঝে মাঝে পৃথিবীটা শিরোনামের গানগুলি দর্শকদের মাঝে সহজেই পৌঁছে যায়।
২০০২ সাথে ‘প্রজন্ম’ অ্যালবামের হয়তো সে আমারই ভুল, কন্ঠ ভরে গান দিয়েছে এবং কি ব্যাথায় ঝড়ে যায় দর্শকপ্রিয়তা পায়।
একই বছর আসে ‘দায়ভার’ এবং ‘‘একলা চলতে হয়” অ্যালবামগুলি। এ অ্যালবামে ‘পেসমেকার’ গানটি প্রেমিক মন, প্রেম ও সম্পর্কের এক অদ্ভুত সমীকরণ সামনে হাজির করে। গানের বিবরণে পাওয়া যায় দু’টি অসমবয়সী নারী-পুরুষের প্রেম আর দ্বিধার এক নস্টালজিক সালতামামি। বয়সী পুরুষ একদিকে প্রেমিক আর একদিকে পিতা। ঘরে সুন্দরী স্ত্রী-কে রেখে কী কারনে আবারও প্রেমে পড়েছে এবং তার ফলশ্রুতিতে সেই পুরুষের যে অসহ্য দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা তৈরি হয় সেটাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ গানটির উপজীব্য। ‘খোকন’ নামে গানটিতে উঠে আসে সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বাভাবিক প্রত্যাশা এবং একইসাথে দুঃশ্চিন্তা। ছোট্ট খোকনের জন্য বাবার যে স্বপ্ন সেটা নিতান্তই আটপৌড়ে কিন্তু চলমান বাস্তবতায় সেটাও যদি না মেলে তাহলে কী হবে? এমনই একটি সাধারণ চিত্র উঠে এসেছে তাঁর এ গানটিতে যার সাথে প্রায় সব পিতা-মাতা বা অভিভাবকের সমান আকাঙাক্ষা ফুটে উঠেছে। ‘ইন্টেলেকটুয়াল’ নামে আর একটি গানে নচিকেতা তার স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে স্যাটায়ার করেছে ইদানিংকার সো-কল্ট বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে। যেসকল লোকদেখানো বুদ্ধিজীবী দলদাস হয়ে দিনে-রাতে রাজনীতির হাটবাজারে বিক্রি হয় তাদের সস্তা দেমাক নিয়ে কথা বলেছে এখানে। যারা বুদ্ধি’র ব-ও জানে না এমন অনেক মানুষ আছে যারা ইদানিং সবকিছু নিয়ে তত্ত্ব কপচায়, জ্ঞান দিতে আসে গায়ে পড়ে। গানটি তাঁদের অন্তঃসারশূণ্যতা নিয়ে।
দ’হাজার তিন-এ ’’যদি কোনো সন্ধ্যায়” এবং ‘‘বন্ধু নামো পথে” নামে দুটি অ্যালবাম বাজারে আসে। এ দুটি অ্যালবামে বেশ কয়েকটি গান যেমন-যাও মেঘ যাও, এই পথে আজও, সারাটা আকাশ, স্বপ্নের পাতা ঝরা, সারাজীবন ধরে ও সারমতি এক্সপ্রেস-গানগুলি শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে। সেবছরই আসে ‘’নচিকেতার ফিরে দেখা” আরেকটি অ্যালবাম।
‘‘এই আগুনে হাত রাখো” অ্যালবামটি সে রিলিজ করে ২০০৪ এর গোড়ার দিকে। এতে ‘‘ও ডাক্তার’’ গানটি তো একেবারে বোমা ফাটানোর মতো! সকলকে বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের একেবারে ভিমরি খাওয়ার অবস্থা। মানুষের রোগ-শোক আর অসহায়ত্ব নিয়ে ডাক্তাররা যে ব্যবসায়িক মনেবৃত্তি নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে থাকে সেটাকেই কটাক্ষ করেছে তীব্র ভাষায়। সরাসরি বলেছে—
ডাক্তার মানে সে তো মানুষ নয়
মানুষের কাছে সে তো ভগবান
কসাই আর ডাক্তার একই তো নয়
কিন্তু দু’টোয় আজ প্রফেশন
কসাই জবাই করে প্রকাশ্য দিবালোকে
ওদের আছে ক্লিনিক আর চেম্বার
ও ডাক্তার!
গানটি রিলিজ হওয়ার পর আলোচনা-সমালোচনা দুটোয় চলেছে সমানতালে। যারা নচিকেতাকে চেনেন তারা আশ্চর্য কিছু হয়তো হয়নি। কিন্তু যারা ডাক্তার বা চিকিৎসা প্রফেশনের মানুষকে একরকম শুদ্ধা-ভক্তি করেন তারা বিষয়টিকে ঠিকভাবে নিতে পারেনি। ফলে, নচিকেতা এ গানের মাধ্যমে বেশ সমালোচিতই হয়েছে বলা যায়। কিন্তু তাতে কী? নচিকেতার ধাঁতে আপোষ বলে কিছু নেই। সে যা সঠিক মনে করেছে বা যাকে অন্যায় জ্ঞান করেছে সে নিয়ে লিখতে বা বলতে কখনও দ্বিধা করেনি। আর কে না জানে—ডাক্তারদের অনেক অপ্রিয় কর্মকান্ড আলোচ্য গানটিতে সঠিকভাবেই তো এসেছে। একই অ্যালবামের ‘‘তুমি আসবে বলে আকাশ মেঘলা বৃষ্টি এখনও হয়নি, তুমি আসবে বলে কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো ঝড়ে যায়নি” গানটিও তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। একই সালে ‘বনলতা’ ও ‘‘গানই শ্রেষ্ঠ সাধনা’ নামে তাঁর আরও দুটি অ্যালবাম রিলিজ হয়। সেখানে ‘‘বন্ধু নামো পথে, বনলতা, ঝড়ে পাগল হাওয়া, আনমনে তারই ছবি আঁকছি, চেনাজানা সুরে, হৃদয়ে জাগে শিহরণ, আমি আধফোটা সূর্যমূখী গানগুলিও দর্শকপ্রিয়তা পায়।
‘‘নচিকেতার হঠাৎ আবার” আসে ২০০৫-এ। এতে কী নামে ডাকবো তোমায়, একটু দেখা, দৃষ্টি ঝাপসা গান তিনটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। একই সালে আসে ‘বালিকা’ ও ‘‘পলাশ প্রিয়া” অ্যালবাম দুটি। যার বালিকা, যদি হঠাৎ আবার, সবুজের ফিঁকে রং, মায়া মেঘের ছায়ার ঢাকা, যতই বানাও তাজমহল এবং জ্বলে বুকে কী আগুন গানগুলি দর্শকদের কাছে সাদরে গৃহিত হয়। একই বছর ’’আমার কথা আমার গান” নামে নচিকেতার আরও একটি অ্যালবাম দর্শকদের হাতে আসে।
২০০৬-এ ‘‘মনের হদিস” ২০০৭-এ ‘তীর্যক’, ২০০৮-এ ‘‘এবার নীলাঞ্জনা”, ‘‘আমি নই সে আমি” ও ‘যাত্রা’, ২০০৯-এ ‘‘এবার সফর”, ২০১০-এ ‘‘হাওয়া বদল” এবং ২০১১-তে ‘‘দিন বদলের গান” বাজারে আসে এবং যথারীতি দর্শক প্রিয়তা পায়। হাওয়া বদল অ্যালবামে ‘‘অন্ধের দেশে” গানটিতে নচিকেতা সমাজের কূপমণ্ডুকতাকে তীর্যক ভাষায় আক্রমন করেছে। এখানে সে বলছে—আমি এমন এক সমাজে গান গাইছি যা অন্ধের দেশে চশমা বিক্রি করার মতো হয়ে যাচ্ছে। তার মানে, এখানে নচিকেতা কিছুটা হতাশ! মানুষের বিবেক, ইতর-ভদ্রজ্ঞান যেভাবে লোভ পেয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে তাতে তাঁর চেষ্টা তো ব্যর্থ হওয়ার মতই। দু’হাজর বারো-তে ’’সব কথা বলতে নেই”, ‘‘ইশ্ক বাওরি”, ২০১৩-তে ‘ক্যানভাস’, ২০১৪-তে দৃষ্টিকোন এবং ২০১৫-তে আসে ’’আয় ডেকে যায়”, ‘‘ফেরারী পাখি”, ‘‘দ্রোণ এবং একলব্য”, ‘‘আয় ভোর”, ‘‘মডার্ণ কাওয়ালি”, অ্যালবামগুলি।
উক্ত অ্যালবামগুলির- না হয় একটা কথা দিব্যি দিয়ে, মিথ্যা নিয়ে বেঁচে থাকার মানে, নাইবা হলো আবার দেখা, এসো বৈশাখ, তোমার সাথে, জোৎসনায় ভরা, কতো কি ব্যাথা গান দর্শকদের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। ঐ সকল গানে নচিকেতার সেই স্বভাবসুলভ ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ তেমন নেই বললেই চলে তবে সেগুলো সে গেঁথে গেছে সুর-আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কথকথা।
যতো দিন গেছে নচিকেতা তত ভার্সেটাইল হয়েছে। নিজেকে নিংড়ে দিয়ে ঋদ্ধ হয়েছে তার কথার গাঁথুনি, সুরের বুনন এবং গায়কী। এবার শুধু একক অ্যালবাম নয়, নচিকেতা সে সময়ে করলো বেশ কিছু যৌথ অ্যালবাম। অ্যালবামগুলি হলো- ও মেঘ পরদেশী; জীবন সমুদ্রে; না না না, ভালোবাসি না; এ কোন অজানায়; শ্রাবণ মেঘে; থাক সময়ের অতলে; আর কতো দিন এবং একদিন স্বপ্নের ভোর।
তাঁর সংকলিত অ্যালবামের সংখ্যাও কম নয় কিন্তু। এই যেমন- সে প্রথম প্রেম আমার (১৯৯৪); বাটা গানের ক্যাসেট ত্রিবেণী (১৯৯৭); অ্যাম্বিশান (১৯৯৭); সময়ের ডানায় (১৯৯৯); আগামী পৃথিবী শোনো (১৯৯৯); বৃদ্ধাশ্রম (২০০১); আজকের জন্য (২০০১); এইচএমভি’র সাথে নচিকেতা (২০০৫); এখন তখন (২০০৫); সরকারি কর্মচারী (২০০৬); গ্রাফিতি (২০০৬); বেস্ট অফ নচিকেতা (২০০৭); সোনার বাংলা-১ (২০০৭); দিন যাপনের তারা (২০০৭); আনন্দগান (২০০৮); নগর বাউল (২০০৮); এরাই সেরা (২০১০); বেস্ট অফ নচিকেতা (২০১২); বেস্ট অফ নচিকেতা-২ (২০১২); লাভ সংস-বেঙ্গলি হিটস (২০১২); চৌদ্দয় (২০১২) এবং সময়ের পথ ধরে (২০১২)।
নচিকেতা গীতিকবি হিসেবে এবং কন্ঠশিল্পী হিসেবে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য সদা প্রস্তুত বলে মনে হয়। সেই দিক ধাবমান নচিকেতা নেপথ্য কন্ঠ সম্পাদনা করল- ‘‘মহীনের ঘোড়াগুলি”-তে। বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীতায়োজন করল- প্রজাপতি (১৯৮০), ধুলো আর ধোঁয়া মাখা, প্রজাপতি হতে চায় যদি মন, সেদিন চৈত্রমাস, এবং তুমি আর আমি, চুপি চুপি, খেলাঘর এবং হঠাৎ বৃষ্টি, চৌধুরী পরিবার, অনামিকা, চাকা, চোর ও ভগবান, স্বপ্নের শহর, রাস্তা ইত্যাদি ছবিতে। এছাড়া ২০০৩-২০০৯ সালের মধ্যে নচিকেতা আরও প্রায় পনেরটি চলচ্চিত্রে সংগীতায়োজন করেছে। বলাবাহুল্য, তার প্রতিটিই যথেষ্ট দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘‘হঠাৎ বৃষ্টি” সংগীতায়োজন, কন্ঠ এবং গায়কী তো এককথায় অসাধারণ। ছোট ছোট স্বপ্নের নীল, একদিন স্বপ্নের দিন, সোনালী প্রান্তরে গানগুলিতো এখনও সংগীত প্রিয় মানুষের মুখে মুখে ফেরে। গানের কথা যেমন অর্থবহ, সুরও তেমনি। অনেকেই তো বলে থাকে ছবিটি দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম কারন এর সংগীতায়োজন।
নচিকেতা সমাজসচেতন মানুষ। রাজনীতি করা মানুষ এবং পোড়খাওয়াও। ফলে, তাঁর মাথা থেকে গীতিকবিতা হবে, কন্ঠে গান হবে আর হাতে লিখা হবে না—তা তো হতে পারে না। নচিকেতা লিখেছেন বেশকিছু কন্টেম্পরারি লেখাও। তাঁর কবিতা—আমাকে দে। গল্প—শর্টকাট, পন্ডশ্রম, অদ্বৈত, স্বোপার্জিত ছায়াজগৎ, আগুনপাখির আকাশ, ঘুম, সাপলুডু, অভিযোজন, যমের অরুচি, অস্তচলের দূর্গ। রম্যরচনা—আমার দেখা সবচেয়ে বড় গণেশ পলিটব্যুরো, এজ্ঞে, দু-গালে চড় মারার পর, সুভাসদা জিতে গেলেন, অমল রুদ্র, চাপে ছোট মাপে বড়। তাঁর এ পর্যন্ত ক্যাকটাস, জন্মদিনের রাত দুটি উপন্যাস বেড়িয়েছে।