
দ্রুতগামী নভোনীল
আবু হেনা মোস্তফা এনাম মূলত কথাশিল্পী। ছোটগল্প ও উপন্যাসের এলাকায় তাঁর বিচরণ। মাঝে মধ্যে সমালোচনামূলক প্রবন্ধও লেখেন। এই প্রথম তাঁর একগুচ্ছ সনেট প্রতিকথায় প্রকাশিত হল।
১
লিথিয়াম শহরের ছায়াপথে, শোনো, আমাদের
ধূলিশ্বাস। রুপার কৌটায় ভরা চন্দ্রমল্লিকার
উপকূলে, এঁকে দেব চৈত্রপূর্ণিমার স্নানযাত্রা।
অথচ এখানে, সহসা স্যাঁতসেঁতে হাড়ের মতো
অনিকেত হয়ে ওঠো তুমি, লাঞ্ছিত শরীর ছেড়ে।
বিদীর্ণ নিশ্বাসে ছায়াচিত্রাবলি সহস্র লোকের
ভিড়ে পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়লে ডুবে যাই,
চন্দ্রবিলের জলতলদেশে; পদ্মমেঘের নিভৃতে
ছায়ার শিরায় ফুটে থাকো। তোমার অনিন্দ্যচরণ
পড়ে থাকে দ্বিধাকরুণ তারার অন্ধকার গাছে,
ধ্বনিময় ইশারায় স্মৃতিচূর্ণ যোনির ভেতর
ম্লান হরিণীর মতো রাতে, নিঃশব্দ সঞ্চারে জেগে
উঠেছিলে; কী অভিপ্রেত! যত হিম কথার সুরে
আমার অপেক্ষার পাশে ভেঙে পড়ে মৌন প্রদীপ!
২
গাছের গ্রীবায় সন্ধ্যা নামে, পুরোনো চন্দ্রমল্লিকা
বনে, ডানা ভাঙা জোনাকির দিকে বৈদূর্য স্বপ্নের
ভেতর আঁকড়ে ধরি ফুলপাতার বিগ্রহকাল,
যেন গোধূলিগামী চিলঘুম। গহন পথে ছড়ানো
সন্ন্যাসিনীর চিপায় জাগে ইরেকটাইল হৃত
গৌরব; হয়তো লোহিত মাটির ভেতর যে প্রেম
ফেলে গেছ, সেইসব গাছের নূপুর ও নৃপতি,
রাজ্যপাট–পুষ্পজন্মের নিগূঢ় বেদনার ধ্বনি
ফুল ভেবে জীর্ণ পাতার ছলনা থেকে তুলে ফেলি
তোমাকে, মল্লিকাদি; সুগন্ধি বাকল জড়িয়ে ছিল
তোমার পায়ে। চন্দ্রকলা জ্যোৎস্নার হৈম করাগার
ছড়িয়ে পড়ুক মলিন নৌকায়। এখানে ঘুমন্ত
হাড়ের নিশ্বাসে বাজে করুণ অধ্যায়। যেন তুমি
পতঙ্গশিকারি, তোমার নূপুরে ভ্রমরের মৈথুন।
৩
নদী ডুবে গেলে ছড়ানো বালুতটে তুমি জলের
চক্রাবর্তে ফেরো কি? আচানক বৃক্ষশস্যের শীর্ষে
তোমার মুখ। মুখে ফলবতী রং, করুণ পাখির
গর্ভকোষে জন্ম ঢেকে যায় গাঙুড়ের জ্যোৎস্নায়
অসমাপ্ত রঙের অভিপ্রায়ে! গোলাপের পূর্বাপরে
মায়াবিভ্রমী গ্রামগুলো নীলিমাশিখরে হারিয়ে
গেলে তোমার মুখ লোধ্ররেণুময়। ধূসর হয়ে
আছ এই নভোমণ্ডলে, পাখিদের ঘুমে দুলছ;
এই নৈসর্গিক নদীবৃক্ষগ্রাম বাষ্পাকুল, নিঃস্ব
গাছগুলো। মাটির অন্ধকারে পুড়ে যাওয়া মানে
লাখো লাখো পাতার ডানা ভেঙে উপদ্রুত চৈত্রের
অভীপ্সায়, দূর ধ্বনিসংকেতে ভেসে ওঠা মেঠো
ঝিঁঝি। কীভাবে তারা নির্বাসিত হয়, আঙুলে গেঁথে
দেয় রেণুর করাতে কাটা পাখিদের বৃষ্টিঘুম।
৪
তুমি বসে আছ বাঙ্ময় বিড়ালের মসৃণ নন্দনে,
চারদিকে হৈহুল্লোড়, তোমার পায়ে উড়ছে নীল
নাচের আসর। দ্রুত ধাবমান গ্লেসিয়ার রোদ
ভেঙে যারা শোনে মোমের মিউজিক, অর্গাজমের
যাবতীয় বিন্যাস সেখানে ময়ূরের নিদ্রাহীন
বর্ণবিকিরণ প্রিজমের সোনালি সন্ত্রাস যেন।
ঘোড়াদের লুব্ধ গিটার–উত্তেজিত, বাজে ত্রস্ত
অজস্র রঙিন পশমের অলীক নিভৃতি ভেঙে;
সোনালি বিড়াল তুমি, রক্তভেজা, যেন ধুলোমাখা
সময়ের বিষণ্ন প্রমিথিউস। অবিনাশী সাপ
পাহারায়, তারার ঋতুগন্ধ শোঁকে চন্দ্রমল্লিকা
চৈত্রদুপুর ঘিরে। তোমার অগ্নিপথে যারা দাস,
তাদের প্রশ্বাসের ফেনায় উড়ে যায় আভারূপে
রজোঘ্রাণের সহস্র নাচ, শকুনের গ্রীবার মতো।
৫
বিড়াল হেঁটে বেড়ায় যোনিগন্ধে, ঈশ্বরবাড়ির
ছাদে; তার নখের মূঢ় শব্দ শুনতে পাও তুমি,
নিশ্বাসে, দৃষ্টি ও শ্রবণে; লণ্ঠনের নিঃশব্দ পায়ে
জাগে ঘুঘুর পালকে লুকানো ধ্বনির অনুরাগ।
কেউ শোনেনি সেইসব বাজুবন্ধ ও নূপুরের
ঘ্রাণ। রূপসি ফড়িঙের নাচে তোমার পদধ্বনি
মুখর, বিড়ালরূপিণী; তোমার অদৃশ্য পদশব্দ
রাক্ষসের রক্তের মতো চলে যায় দূরের কৌশলে;
নাচের নিঃশব্দে লাখ লাখ নখ লুকানো মেঠো
ইঁদুর অচিহ্নিত পদশব্দের দুর্গন্ধে মিশে যায়
অপস্রিয়মাণ আলোর কুহকিনী জ্যোতিষ্কে! শ্রুতি
ও লীলার আদিকৃত্য কীভাবে সিংহের কেশরে
লীন; এসব নাচের শব্দে মুখরিত কালখণ্ড।
তুমিও কি বিড়ালের ছায়াশিকারে ছদ্মপ্রেতিনি?
৬
স্বপ্নলোলুপ দুপুরগুলো দীপিত ছায়াপুষ্পের
মুঠোয় তুলে রেখেছিলাম। কফিনে মুড়িয়ে গেল
নিভৃত শ্রাবণ দেখো, অঝোর নয়নতারাপথে
যারা আলো জ্বেলেছিল চন্দ্রবিলের দেশে, তারার
কদমঘেরা ঝিরিকুটির বৌদ্ধলিপিগুচ্ছে ভরে
তোলে নীলিমামণ্ডল–তারাও যদি মেঘমল্লারে
বিকেলের সৌরভ ঝুলিয়ে রাখে মৌন এপিটাফে,
যেন তুমি ভেসে যাচ্ছ দূরবর্তিনী শিরিষডালে;
ছায়া ফেলে তুমি চলে গেছ বিষণ্ন খঞ্জনার ঘরে,
সন্ধ্যামালতিরা সেখানে ফুলের ছদ্মবেশে নীল
ভ্রমরের পাখায় ফোটে। বিকেলের রৌদ্রভাষায়
শোনা যায় মেঘের মৃত্যু বৈভব। হারানো ফুলের
শোকে, জেগে থাকে বসন্তকফিন, অদৃশ্য গানের
ভেতর তুমি মাটির পাখি, ডানায় নীলকণ্ঠমেঘ!
৭
দ্রুতগামী নীল ট্রেন নাভিজ্যোৎস্নায় ডুবে গেলে
সহস্র খড়ের জীবন ডাঙা থেকে ছিটকে পড়ে,
যেন ধুলোর বিকীর্ণ ভূমিকায় শরণার্থী ভ্রমণ।
রান্নার যাবতীয় আয়োজন, লাল মরিচ আর
কৃষ্ণচূড়ার চিরল পাতার বিচূর্ণ ছায়া ঝরে
খড়ের মুদ্রায়–ঋতুমনীষার নাচে, নিদ্রা জ্বলে
গেলে গোধূলিতে জন্মায় অপরিণত মুথা ঘাস;
মাংসের অর্কেস্ট্রায় খেলা করে রুপালি কুয়াশা,
ট্রেনগুলো ধুলোর ভাষায় মৌন, জ্যোৎস্নামুখর
রাতে আমিও ট্রেনের জীবন পাব। নাচের ছন্দে
অলৌকিক সোনালি খড়ের কেয়ূর নক্ষত্রপরিখা
খুঁড়ে রাখে চৌদিকে। মেঘমঞ্জরি ছিঁড়ে উড়ে যায়
তোমার ত্রস্ত পোশাকের অন্তর্জাল, যেন মেঘের
শিথানে তুমি দুলিয়ে দিচ্ছ শোচনীয় অস্তরাগ।
৮
বর্ষাকালের দিকে একটা খঞ্জনার গ্রাম পড়ে
আছে ধূলির মতো, তার মুখর ডানায় বিকেল
ভেসে যায় অবসাদে, দূর ঈর্ষাগন্ধে। স্বপ্নময়
চিলের আর্তধ্বনির মতো মধুকূপি পৃথিবীর
ঠিকানায় নক্ষত্রকুটির জেগে থাকে। গুঞ্জরিত
অন্ধকারে তুমি আলোকনন্দন বলে ডেকে ডেকে
চলে যাও, সেইখানে; আমাদের হৃদয়ে জাগৃতি
বৃষ্টির পুরোনো মুখ ঈশ্বরের কান্নায় মিশে যায়;
আর হাড়ের শৈলী আঁকা বুকের পাশে জমা ধূলি
উড়ে গেলে ঝরে পড়ে লাল লাল চিলের পালক,
তারা রক্তের জ্যোৎস্নায় বিপন্ন হরিণের মতো
হৃদয়ের ঘাস খায়। এইসব দুর্বাদল, বুনো
হলুদ পাতার শুকনো পুষ্পবিষাদে রৌদ্রচঞ্চল
দিন ফিরে যায়, শ্লেষ্মা ঝরে পড়ে, চৈত্রকুয়াশায়।
৯
বিস্ময় নিয়ে চলে গেল যারা, তাদের পদচিহ্নে
রোদ পড়ে আছে; এত খেলা তবু পরিত্রাণ নেই।
গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার চেপে ধরে জানু, কূটাভাসে
চেনা হয়ে যায় অলকানন্দা রাত; জ্যোতির্ময়তা
এইসব শহরে সেজে থাকে অপরূপ, সিঁড়ির
স্বপ্নকল্প হাতছানি দেয়। এই যে দাঁড়িয়ে আছি
ভুল উচ্চারণে বিবৃতিময় গোধূলির ভেতর,
তোমার উন্মাদ আঁচলে পড়ে আছে হারানো রোদ,
বিস্ময় নিয়ে কতদূর যাবে, দ্বিধাকরুণ মৌন
শহরে, দিগন্তলীন সন্ধ্যার মুদ্রাদোষেরা জাগে,
তবু তুমি পড়ে আছ; যেন এই নিয়তিলালিত্যে
তোমার বিস্ময় আঙুর ফলের শান্ত গ্রেভিয়ার্ড।
আমি দূরদ্বীপ থেকে অবিরল আলো জ্বেলে দেখে
ফেলি বিকীর্ণ এপিটাফ–তুমি সমাধি, রৌদ্রগান।
১০
কমা চিহ্নের মতো তোমার শরীর, বিষাদময়।
উপদ্রুত নীলকণ্ঠ ধ্বনির ভেতর পাখিদের
শিহরিত পুষ্প দেখে পায়ে জড়িয়েছি শিশিরের
বিবস ইশারা। দ্বিতীয়া চাঁদের পরিচয়চিহ্ন
অদৃশ্য বেদনার মতো নুয়ে পড়েছে, অস্তগামী
ভুবনজ্যোৎস্নায় বিষাদ এমন প্লাবিত, যেন
মৃত্যু আমাদের নিঃশব্দ কৃষিকাজ, গানের বাদ্য
অবিনাশে জড়িয়েছে মৃত্যুর আনন্দপ্রতিভায়;
কমা চিহ্ন তুমি, তৃষ্ণার ভেতর কেউটের ফণা;
অধোমুখী অভিলাষে আমাদের প্রণয় ডুমুর
ফুলের অরণ্যস্বপ্নে লীন হয়ে আছ। তবু চন্দন
আর করবীডালে পাখিমৃত্যুর উৎসব এলে,
রক্ত হাতে গোলাপের জঙ্গলে লুকানো শঙ্খচূড়
ও প্রাচীন যাজকের ছিন্ন মাথা কোলে বসে থাকি!