
দ্য সেপারেশান
নিরুপমা ভেবেছিলো সম্পর্কটা টিকে যাবে। একটা সম্পর্কে নানারকম দীঘল স্বপ্ন থাকে।
বিনিসুতোর কষ্টের মালাও কম লম্বা থাকে না, যদিও। তবু একটা সুতো জড়িয়ে আছে ভাবলেই শান্তিতে স্নিগ্ধতায় মনটা ভরে ওঠে। নিরুর একার দোষটাই বা কী? কোথায়? নিরুর নিজের কাছেই এক ধরণের খারাপলাগা আছে। ভাঙ্গনের কথা উঠলেই অপরাধবোধ নয়, এক ধরণের অপরাধপ্রবণতাই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যেহেতু, সম্পর্কে দু’জনের মতামত নিয়েই শুরু ও শেষ হয়। নিরু তাই কেঁপে ওঠে একপাক্ষিক জটিলতায় সম্পর্কটা ভেঙে যাচ্ছে দেখে। আর এ-ই কথা ভাবলেই সে শিহরিত হয় প্রথম স্পর্শের মত, প্রথম চুম্বনের শিহরণের মত।
নিরু। পঁচিশের মেয়ে ছিলো বিয়ের সময়। যদিও সে বিয়েতে আগ্রহী ছিলো না একবিন্দুও। সে চেয়েছিলো লিভ-ইন। লন্ডনের পড়াশোনা তাকে অন্তত এইটুকু শিখিয়েছে যে স্বাধীনতা সম্পর্কে না জড়িয়েও উপভোগ করা যায়। আবার সম্পর্কের স্বাদও নেয়া যায় পুরোপুরি। কিন্তু অনুপম তার বাঙালি মানসিকতা থেকে বের হতে চায়নি। পারেওনি। বিয়ে নিয়ে এক প্রকার সামাজিক চাপে সে অনুর কথা রেখেছে। অনু সেই অর্থে ভীতুই। ভালোবাসার ক্ষেত্রে অনুকে তবু সাহসীই বলা যেতো— অন্তত আজকের আগ পর্যন্ত। অনুর বাবা, সৎমা, বোন ইত্যাদি সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। তাই অনু নিরুপায়।
তবু কোথায়ও কেঁপে ওঠছে কী অনুর জগৎ!
সেই কলেজ জীবন! অল্পক’টা টাকা জমিয়ে আড়ং থেকে ছোট্ট একটা মোমদানি, এবং একটা মেনিকিউর সেট দিয়েছিলো সে অনলাইন থেকে অর্ডার করে। এই সামান্য গিফট নিরুকে ভীষণ ভালোলাগায় ভাসিয়েছে, কাঁপিয়েছে উন্মুল। নিরুর বারবার মনে পড়ছে এসব। ভালোবাসার ক্ষেত্রে তুচ্ছ তুচ্ছ জিনিস ভয়ানক নাড়া দেয়। নিরুকেও দিচ্ছে। তাছাড়া, সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিরু একেবারে নবিশ ছিলো। কড়া পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে একটু স্পেইস নিতে নিতেই অনুর অনুপ্রবেশ! কে জানে সেই অনুপ্রবেশই ওর জীবনে বিশাল প্রবেশিকা এবং শেষপর্যন্ত একটা ভয়ানক যবানিকা হয়ে যাবে! সবই তৃতীয় পক্ষের তাণ্ডবে ভেঙে ছুড়ে তছনছ হয়ে যাবে। নিরুকে আর কোনোদিন বলা যাবে না!
নিরু চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু অনুর বাবার ভয়ংকর চেঁচামেচি, ধমকানো, আর বোনের ব্যক্তিগত জীবনের ঘাঁটাঘাঁটি নিরু নিতে পারেনি। শ্রদ্ধাবোধটাই সম্পর্কের প্রাণ। সেটা না থাকলে সম্পর্কে আর কী-ই বা থাকে। একসাথে থাকার কোন মানেই নেই তাহলে। আর অনুর সৎ মা, যে একটা জীবন অনুকে অমানুষিক কষ্ট দিয়েছেন তিনি এখন ছেলে বলতে অজ্ঞান অবস্থায় নিরুকে তার নারীত্বের ভিতে আঘাত দিয়েছেন। অনু সেসব শুনছে কই?
এইসব পারিবারিক ক্যাচাল থেকেই অনেক সম্পর্কই ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রতিদিন।
নিরু ভাবছে আর কোনোদিন সম্পর্কে যাবে না। ব্যাপারটাই প্যানিক। কেমন প্যানপ্যানে একটা ব্যাপার আছে। জড়ায়া রাখে ঠিকই কিন্তু খোলে গেলে নাড়ি-নক্ষত্রশুদ্ধ নিয়ে যায়। সেইক্ষেত্রে লিভ-ইনই বেটার অপশান, সে ভাবে। নো কম্প্রোমাইজিং। নো বদারনেস। কিন্তু অনভ্যস্ত সেই জীবনের ভিতরেও হানা দিচ্ছে সেই সামাজিকতাই। কুরে কুরে খাচ্ছে জীবনকে যে সিস্টেম সেই সিস্টেমেরই বা দরকার কী মানুষের জীবনে। এসব প্রশ্ন কাকে করবে নিরু?
অনু। পঁয়ত্রিশে বিয়ে করা। ম্যাচিউরড। শান্ত। সুন্দর। মানবিক। নিরুর সাথে একটা অসাধারণ সম্পর্ক ছিলো তার। কী সব লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গেলো হঠাৎ করেই। কী যে হয়— নিরু ভাবছিলো বাচ্চার কথা। তিন বছর কম সময় নয়— নানা রক্তচোখ এড়িয়ে থাকার। অনুর অনুভবে একটা ছোট্ট পা দুলে ওঠেছিলো ব্যাকফ্লাশে। আর ঘুম ঘুম চোখে এক্কাদোক্কা, বাবুসোনার আদল হয়ে ওঠেছিলো জীবন্ত। সেই অনুভূতি অনু কোনোদিন পাবে না আর!
আর নিরু বাচ্চার স্বপ্ন দেখেনি। তার ক্যারিয়ার এসব নানাবিধ চিন্তায় সে অস্থির। অনুর বন্ধু-বান্ধবীদের খোঁচা হজম করা কোনো ব্যাপারই ছিলো না। কিন্তু যখন তারা নিরু সম্পর্কে অনাস্থাশীল আর অশালীন কথাবার্তা বলতে শুরু করল তখন আর ঠিক থাকতে পারেনি। তাছাড়া, তারা অনুকে বেটার অপশান দেবে। প্রচণ্ড নারীবাদি নিরু এরচে ভালো অপশান আর খুঁজে পায়নি। আর অধরা বাচ্চার স্বপ্ন বুকে পিষে মেরে ফেলেছে। কেনো আমরা নিজেদের কথা না শুনে অন্যদের কথা প্রমাণ করতে গেলাম! বিড়বিড় করে নিরু।
নিরু একাই কাটিয়েছে তার সমস্ত শৈশব, কৈশোর এমনকি তার পূর্ণ জীবনে অনুকে মাঝে মাঝে দেখা গেলেও মূলত সে একাই ছিলো— জেদি, চাপা, একরোখা এবং এককথার। তার মায়ের অত্যাচারে কলেজেই ঘাট বেধেছিলো। বাবা টাকা পাঠাতেন নিয়মিত। আধুনিক বাবা নিরুর আকাশ ছিলেন কিন্তু সংস্কারাচ্ছন্ন মায়ের আঁচল থেকে বেরুতে পারেননি কোনোদিন। ফলে নিরুকে একা সংগ্রাম করতে হয়েছে তার স্বাধীনতার জন্য। তার এ-ই সংগ্রাম এ-ই সমাজের মেয়েদের প্রেরণা দিচ্ছে কিনা এসব ভাবার সময় কোথায়? তাছাড়া, এইসব তাকে ভাবায়ওনা। নিজের জীবনের স্ট্রাগল সে একা একা করেছে। ফেসবুক বা যেকোন সামাজিক সাইটে গিয়ে নাকিকান্নার তার সময় কোথায়। গ্র্যাজুয়েশান কমপ্লিট করার পর লন্ডনের চার বছর। স্কলারশিপ আর পিএইচডি সবই কমপ্লিট হল কেবল সংসারটাই বাদ। পরে দেশে ফিরে অনুকে বিয়ে। ব্যস্।
অনু যে খুব সাংসারিক তাও নয়। তার নিজের যে পারিবারিক জীবন সে ফেলে এসেছে সেটা বিত্তময় থাকলেও সংস্কারহীন নয় একবিন্দুও। তার বোন এখনো বিশ্বাস করে এসব ছেনাল মাগীদের পাল্লায় পড়ে তার ভাই উচ্ছন্নে গেছে। অনু সেসব বিশ্বাস করে না যদিও। কিন্তু সংস্কার রক্তে থাকে। সংক্রমণের ফণা তুলেনি এখনো কিন্তু তুলতে কতক্ষণ। তুলবে যে না তার প্রমাণ কী?
এসব ঝামেলা মিটাতে অনেক সময় গেলো নিরুর। নিরু ডিসিশান নিয়েছে সে লন্ডনেই যাচ্ছে ফের। তার আগের বসকে ই-মেইল করতেই উচ্চস্বিত তিনি। সে চলে যাবে। একঘর শূন্যতা, একবোঝা ফার্নিচার, পেইন্টিং, কবিতার বই, ফিকশান ননফিকশান নানাবিধ স্মৃতিঘেরা জিনিশপত্তর। নিরু নিরুপায় বসে থাকে। ঘুমিয়ে যায়। কালকেই ফ্লাইট।
অনুকে তার বাবা নিয়ে গেছে। সব সম্পর্কের শেষ পরিণতি হিশেবে একগাদা কাগজে সই-সাবুদ করিয়ে অনুর টেবিলে উড়ছে পতপত করে। এসবের মূল্য একবিন্দুও নাই তার জীবনে আর। এতসব জটিলতা অনুকে ঠিক অস্বস্তি নয়, পাগল করে দিচ্ছে। সে কাউকে বোঝাতে পারছে না তা নয়, সে আসলে কথাই বলছে না। তার এরকম বাজে সময় এরকম পরিস্থিতি আর আসেইনি।
অনেক বছর পরে। নিরু দেশে এসেছে একটা সেমিনারে অংশ নিতে। অনু সেই সেমিনারেরই হোস্ট কিন্তু সে বুঝতেই পারেনি। অনুও বুঝতে পারে নি সে-ই বিখ্যাত নারীবাদি লেখক তার সাবেক ঘরনি। তার জরুরি কাজে সে অন্যত্র ছিলো বিধায় তার সাথে নিরুর দেখা হয়নি। তাছাড়া, আমন্ত্রণপত্রে বোঝার উপায়ই নেই। কারণ, সেখানে শুধু প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ থাকে। সে বুঝতে পারে সে ভুল জায়গায় চলে এসেছে। সে ভাবে, কী করা যায় এই মুহূর্তে। চলে যাওয়া যায়। কিন্তু হলভর্তি লোক যাদেরকে নানাভাবে বোঝানো হয়েছে নিরুপমা হক এখানেই আছেন।
নিরু মঞ্চে ওঠে। তার প্রেজেন্টেশান পেপার, ল্যাপটপ, আইপ্যাড, সেলফোন সবই পড়ে থাকে ব্যাকস্টেজে। সে অবিচল দাঁড়ায় মঞ্চে। আর দর্শক সারির প্রথম দিকে অনুরা বসা। সে বলে যায় অনর্গল তার সহজ কিন্তু বন্ধুর জীবন। সেইখানে তার বাবা, তার অত্যাচারি মা, তার সমস্ত বন্দি শৈশব, তার কলেজ, তার কিশোরবেলা, তার খোলা হাওয়ার গান, তার স্বাধীনতা শব্দটি নিজের হবার গল্প এবং সবমিলে সে যেভাবে স্বাধীনতা বুঝতে শিখলো সেই লেখক ও আদর্শের কথা একটানা বুক চিতিয়ে ঋজু ভঙ্গিমায় বলে যায়। তারপর মুহুর্মুহু হাততালি, অভিনন্দন এসবকে সাথে করে সে মঞ্চ থেকে নেমে সোজা যাওয়ার পথে নামলো। তার আর পিছনে তাকানোর সময় কোথায়!