
‘দেশ ছেড়ে আসা মানুষকে সাধারণভাবে গ্রহণ করলে হবে না’
[সাহিত্যে সারা বিশ্বে তিনটি পুরষ্কার অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ : নোবেল পুরস্কার, পুলিৎজার পুরস্কার ও ম্যান বুকার পুরস্কার। তবে নোবেল পুরস্কার নিয়ে সবচেয়ে বেশী হৈ চৈ হয় পাঠক ও সাধারণ মহলে। চলতি বছর (২০২১ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার ক্ষেত্রে কিছুটা চমক ছিল। চলতি বছর সাহিত্যে এ পুরস্কার দেয়া হয় তানজানিয়ার ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহকে।
সাহিত্যে ‘আপোষহীন ও নিবিড়ভাবে’ ঔপনিবেশিকতার প্রভাব ও উপসাগরীয় অঞ্চলে শরনার্থীদের জীবন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে এ পুরস্কার দেয়া হয়। তিনি দশটি উপন্যাস লিখেন। সবকটি ইংরেজিতে। বিশ্বব্যাপী শরনার্থীদের অভিজ্ঞতাকে এবং তাদের দুর্বিসহ জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। তার জনপ্রিয় উপন্যাস হচ্ছে ‘প্যারাডাইস’। এ উপন্যাসের জন্যই তিনি নোবেল পুরস্কার পান। ‘ডিসারশন’ ও ‘বাই দ্যা সি’ তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।
পুরস্কার ঘোষণার পর আফ্রিকার এ ঔপন্যাসিককে নিয়ে আফ্রিকা তথা তানজানিয়ায় তেমন কোন আলোচনা নেই। কেননা, তারা মনে করেন আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ ইংল্যান্ডের সাহিত্যিক এবং তাদের এতিনিধি। তিনি কোনোভাবেই ঔপনিবেশবিরোধী ও আফ্রিকা অঞ্চলের বঞ্চিত মানুষের সাহিত্যিক নন। তবে এ বিষয়ের বিতর্কের অবসান হতে বেশ কয়েক বছর লাগবে। বিশেষ করে তার কর্মের উপর গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে পরিস্কার হবে তিনি কোন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে তাঁর নাম প্রকাশ পাবার পর নোবেল প্রাইজ ওয়েবসাইট প্রতিনিধি এডাম স্মিথ তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেন টেলিফোনে। সে সাক্ষাৎকারের হুবহু অনুবাদ তুলে ধরা হলো। —মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন]
[টেলিফোনের অপরপ্রান্তে]
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : হ্যালো!
এডাম স্মিথ : হ্যালো, আমি আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহের সাথে কথা বলছি?
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : হ্যাঁ, আপনি ঠিক তার সাথেই কথা বলছেন, ঠিক তাই।
এডাম স্মিথ : হ্যালো, আমি হচ্ছি…
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : আমি আমার কম্পিউটারে বসে একটি ঘোষণা শোনছিলাম। আপনি কে বলছেন, প্লিজ?
এডাম স্মিথ : জ্বি অবশ্যই। আমি এডাম স্মিথ। আমি নোবেল প্রাইজ ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে আপনার সাথে কথা বলছি। আপনি কি এখন আমার সাথে কথা বলতে পারবেন? না আপনি এখন ঘোষণাটা দেখতে থাকবেন? আমি আপনাকে অহেতুক বিরক্ত করতে চাই না।
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : ভালো। না, ঠিক আছে [বেশ শান্ত কিন্তু উত্তেজনাকর অবস্থায়।] আপনি কি বিষয়ে কথা বলতে চান? আমি রিপোর্টারদের নিকটে কিছু শুনিনি। আশা করি শীঘ্রই শোনতে পাব।
এডাম স্মিথ : নিশ্চয়ই আপনি পারবেন। আমি মনে করি এ সংবাদটা খুব দ্রুত আপনার জীবনকে পাল্টে দেবে। এটা একটা প্রলয়ের সৃষ্টি করবে। আপনি এ সম্ভাবনাকে কিভাবে অনুভব করছেন?
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : হ্যাঁ, আমি এটাকে বুঝে উঠার চেষ্টা করছি। হ্যাঁ, ঠিক এটা একটা অনিবার্য… এটা এক ধরনের… এটা এক ধরনের বড় পুরস্কার নিঃসন্দেহে। ভালো, খুব ভালো, এটা আমাকে অগ্রসর হতে সাহায্য।
এডাম স্মিথ : সংবাদটা আপনার কাছে কিভাবে পৌঁছালো?
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : ঐ যে তিনি ফোন করেছিলেন। কি জানি তার নাম? নোবেল কমিটির স্থায়ী সেক্রেটারি?
এডাম স্মিথ : ম্যাটস্ ম্যালম।
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : হ্যাঁ, তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন ১০ সিনিট, না, না ১৫ মিনিট আগে। এবং আমি মনে করলাম হয়তো কেউ আমার সাথে ঠাট্টা করছে। সত্যি আমি তাই মনে করেছিলাম। কারণ আপনি জানেন কারা এবার পুরস্কার পেতে পারে তা বেশ কয়েক সাপ্তাহ ধরেই মুখে মুখে ভেসে বেড়াচ্ছিল। এমনকি কয়েক মাস আগে থেকেই। আপনি এটাও জানেন কারা এ দৌড়ে শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল। এটাই তখন আমার মনে ঘুরছিল। আমি চিন্তা করছিলাম, ‘কে এ সৌভাগ্যবান ব্যক্তি!’
এডাম স্মিথ : নিশ্চয়, নিশ্চয়। এবং ঠিকই আছে। আপনি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত নিজেকে কিভাবে বিশ্বাস করালেন?
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : আসলে তিনি খুব শান্ত ও ধীরভাবে কথা বলছিলেন, এবং আমি … এবং আমি … পরে তিনি আমাকে বললেন… ওয়েবসাইট, সুইডিশ একাডেমি ওয়েবসাইট, এবং আমি বললাম ঠিক আছে, “আমি এক মিনিটে ওটা দেখে নেব, কিন্তু এখন আপনি আমাকে কিছু বলুন।” সুতরাং, এরপর তিনি শান্তভাবে বলতে লাগলেন এবং আমার মনে হচ্ছে আমি শেষ পর্যন্ত ভাবছিলাম, ‘আমি অপেক্ষা করব যতক্ষণ আমি এটা না দেখি, বা শুনি।’ এবং এটাই আমি এখন বসে করছিলাম। অতএব, …
এডাম স্মিথ : ভালো, সত্যি ওটা ওখানে আছে। এটাই সত্যি।
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : হ্যাঁ নিশ্চয়। হ্যাঁ, নিশ্চয় আছে।
এডাম স্মিথ : আপনি জানেন … আমি… নোবেল পুরস্কার…
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : আমি দুঃখিত, কেননা ক্রমাগত ফোন আসছেই…।
এডাম স্মিথ : নিশ্চয়, আসবেই। এ কারণে আমি চেষ্টা করছি খুব দ্রুত শেষ করতে। আমি আশাকরি আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি যদি আমার সাথে মাত্র কয়েক মিনিট থাকেন তবে এটা সত্যি খুবই স্বরণীয় হতে পারে।
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : আমি কি এ ভদ্র লোকের ফোনাটা একটু ধরতে পারি?
এডাম স্মিথ : নিশ্চয়, আপনি পারেন।
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : হ্যালো, আমি কি… আমি ধারনা করছি আপনি নিশ্চয় সংবাদটা শুনতে পেয়েছেন? আমি এখন সুইডিশ একাডেমির সাথে কথা বলছি। আমাকে ৫ মিনিট পরে ফোন দিলে ভাল হয়। এখন রাখি। হ্যালো, আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? আসলে ওটা বি বি সি ছিল।
এডাম স্মিথ : অবশ্যই, তারা নিশ্চয় আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। যে বিষয়টা আমি জানতে চাচ্ছি আপনি মূলত ‘শরনার্থীদের ভাগ্য’ ও ‘উপসাগরীয় অঞ্চলের সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন’। এটা একটা সুনির্দিষ্ট মুহূর্ত- আমরা এখন সারা বিশ্বে শরনার্থী সমস্যার মধ্যে আছি। আপনি কি একটু বলবেন সংস্কৃতির এ পার্থক্যকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : আমি মনে করি না এ সমস্যা স্থায়ী, বা অসমাধানযোগ্য বা এ জাতীয় কিছু। অবশ্যই মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি মনে করি, আমি ভাবি… সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আফ্রিকান যারা ইউরোপে আসছে নিঃসন্দেহে তারা তাদের বিষয়ে অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। এবং অবশ্যই অন্যদের বেলাতেও… ইউরোপে মানুষের আগমন নতুন নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা আসছি। অতএব, এটা সত্যিই ইউরোপের জন্য বেশ অস্বস্তিকর। যখন অনেকে আসেন, তারা তাদের প্রাথমিক প্রয়োজন নিয়ে আসেন, এবং কারণ সত্যিকার অর্থে তাদের অনেক কিছু থাকে দেয়ার মতো। তারা কিন্তু… তারা কিন্তু খালি হাতে আসে না। তাদের অনেকই অনেক মেধাবী, পরিশ্রমী যারা অনেক কিছু দিতে পারে। সুতরাং তাদের নিয়ে ভিন্নভাবে কিছু ভাবতে হবে। আপনি এদের যেভাবে দেখছেন সেভাবে নিতে পারবেন না। তারা কেবল দারিদ্র পিড়ীত এটা ভাবা ঠিক হবে না।
এডাম স্মিথ : ধন্যবাদ, অবশ্যই। আরেকটি বিষয়. . . নোবেল পুরস্কার প্রতি বছর বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিকদের সংযুক্ত করে থাকে আক্টোবরের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে তাদের কাজের একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে। আপনি কী ভাবেন যখন আপনি কোন একটা বিষয় নিয়ে লিখেন?
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : আমি খুবই আনন্দ অনুভব করি যখন কোন লেখা শেষ করি। [হাসি দিলেন] কিন্তু এটাও সত্য কোনো সময় কিছু জিনিস বাধ্য করে কোনো কোনো লেখা শেষ করতে দশকের পর দশকও লেগে যায়। আপনি কোনো কিছু ভালোভাবে করতে পারবেন না, যদি আপনার সে কাজকে ঘৃণা করেন। কিন্তু এটাই বাস্তবতা… এটা একাধারে আনন্দের কোনো কিছু সৃষ্টি করা কিন্তু এটা ভালো কোনো লক্ষ্য অতিক্রম করতে পারা।
এডাম স্মিথ : ধন্যবাদ আপনাকে। এটাই সত্য। আমি মনে করি আপনি বেশ সহায়ক ফলে সবাই সহজে আপনাকে বুঝতে পারে।
আব্দুলরাজ্জাক গুরনাহ : ঠিক আছে, ঠিক আছে। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ আপনাকে।
এডাম স্মিথ : আপনার প্রতি শুভ কামনা থাকল।