
দুধরাজ
বালিয়াপাড়া গ্রামে আচানক ঘটনা ঘটে গেছে, আজমীর আলীর পরানের পরান জানের জান লালসুন্দরী গর্ভধারণ না করেই দুধ দেওয়া শুরু করেছে। ফলে ডাক ডাক করে মানুষ জড়ো হতে থাকে আজমীর আলীর বাড়িতে।
ঘটনার এই জল গড়ায় বহু দূর পর্যন্ত, স্বয়ং আজমীর আলী ও আসমা আক্তারকে ইন্টারভিউ দিতে হয় টিভিতে।
অথচ কয়দিন আগেও আসমা আক্তার সুযোগ পেলেই লালসুন্দরীকে অপয়া-অলক্ষ্মী বলে গালিগালাজ করত, মাথা বেশি গরম হয়ে গেলে পিঠে ভাঙত চেলাকাঠ; বাঞ্জা মাগিটাকে বেচে একটা কাজলা বকনা কেনার কথা বলত।
আজমীর আলী বউকে বুঝাত আর বলত সবুর করো ফারজানার মা, সবুর করো, সবুরে মেওয়া ফলে। আসলে আজমীর আলীর নরম মন, অন্তরে তার গভীর মায়া, এই মায়া ছাড়তে পারেনি বলেই তো ৯ বছর আগে ফিরে এসেছে বাপের ভিটায়, আবারও সংসার পেতেছে।
তাই যে লালসুন্দরীকে নিজের হাতে টেনে বের করেছে, আদর যত্ন করে বড় করেছে, সোহাগ করে নাম রেখেছে লালসুন্দরী তাকে বেচে দেওয়ার মতো পাষাণ হতে পারে না সে।
আসমা আক্তার যতই তেলম তেলম করুক না কেন আজমীর আলী বলত,
– ফারজানার মা, এত পাষাণ হইয়ো না, এই লালসুন্দরীই কিন্তু আকালের সময় বুক পাইত্যা দিব।
অতিমারির আকালে আজমীর আলীর কথা হাতে নাতে ফলে গেছে। লকডাউনে যখন কহর পড়ে সবখানে, যখন দোকান খোলার অপরাধে এক হাজার টাকা জরিমানা খেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন লালসুন্দরীর ওলানে দুধের নহর বয়।
গত শুক্রবার বাতির আজানের আগে আগে আসমা আক্তারের আতকা চিৎকারে কান তব্দা হয়ে যায়। আসমা আক্তার বলে লালসুন্দরীর ওলানে দুধ টইটম্বুর করছে।
আজমীর আলী বউয়ের কথা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বলে,
– তুমি আর আলাপ পাইলা না ফারজানার মা, লালসুন্দরী ঝাপই রাখতে পারল না, আর তুমি কও দুধ আইছে ওলানে।
আসমা আক্তার তর্কে জড়ায় না; রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বালতি এনে বাঁট টানতে থাকলে চিঁউ চিঁউ করে দুধ পড়তে থাকে।
প্রথম প্রথম লালসুন্দরীর দুধ খেতে চায়নি কেউ, কয়েদিন পরে টিভিতে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ইন্টারভিউ দিয়ে বলে, হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে এমন হয়েছে, এটা খুবই রেয়াস কেইস, তবে এই দুধ খাওয়া যাবে, কোনো সমস্যা নেই।
এতে অবশ্য কাজ হয় না, পরবর্তী শুক্রবারে বরমী বাজারের আশরাফ আলী যখন বলে এই দুধ খেয়ে তার পেটের অসুখ ভালো হয়ে গেছে, এই দুধের কুদরতি শক্তি আছে তখন আর পিছনে তাকাতে হয় না আজমীর আলীকে।
প্রতিদিন মানুষ এসে ভিড় করে কুদরতি দুধ নিতে। কেউ বলে এই দুধ খেয়ে মাথাব্যথা ভালো হয়েছে, কেউ বলে বাতের ব্যথা ভালো হয়েছে, কেউ বলে এই দুধ খাওয়ার ফলে স্বপ্নদোষ থেকে রক্ষা পেয়েছে।
ফলে রোগবালাইয়ের দাওয়াই হিসেবে এবং মনোবাসনা পূরণের আশায় মানুষ দুধ নিতে আসে; কেউ আসে সন্তান লাভের আশায়, কেউ আসে মনের মানুষকে বশ করার বাসনায়, কেউ আসে স্বামী বা স্ত্রীকে পরপুরুষ বা পরনারী আসক্তি থেকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষায়।
আজমীর আলীর বাড়ি আশেপাশে অস্থায়ী মেলা জমে যায়, করোনার কারণে প্রশাসনের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মানুষের চাপ বাড়তে থাকে, দুধের চাহিদা বাড়তে থাকে।
কিন্তু আজমীর আলী ও আসমা আক্তার লালসুন্দরীর বাঁট টেনে দুই সেরের বেশি দুধ বের করতে পারে না, লালসুন্দরীর বাঁট এত শক্ত যে হাতের রগে টান ধরে, আঙুলে ঝিঁঝিঁ ধরে বেঁকে বেঁকে যায়; যদিও ওলানে দুধ থেকে যায় তখনও।
কী আর করার, এই বয়সে যতটুকু শক্তি আছে ততটুকু দিয়েই দুধ বের করে যাচ্ছে তারা, সকাল সন্ধ্যা ওলান ও বাঁট ধরে বসে থাকা সম্ভব না, সংসারে আরও কাজ থাকে, মানুষ পীড়াপীড়ি করলেও লাভ নেই, দুধ যা পাওয়া যায় তা-ই ভাগ করে দেওয়া হয় সবাইকে।
আজমীর আলী ঠিক করে একজনকে এক পোয়ার বেশি দুধ দিবে না। ফলে দুই সের দুধ আট জনকে দিতে পারে।
তখন এগিয়ে আসে আজমীর আলীর চাচত ভাইয়ের জমজ নাতি ওয়াসিম-জসিম। তারা বলে, দুধ বের করার জন্য বাঁটে সরিষার তেল দিয়ে ওলানে বিশেষ কায়দায় মালিশ করে সময় মতো জোরে টানতে পারলে দুধ পাওয়া যাবে, তা যত ছোট ও শক্ত বাঁটই হোক না কেন, কায়দাটা জানতে হবে।
আজমীর আলী এই বয়সেও গেরস্থটা শিখতে পারল না, যেখানে দুই দিনের ছেলে ওয়াসিম-জসিম কত কায়দা-কানুন জানে।
আর জানবে না কেন, ওদের তো গাইয়ের অভাব নেই, জমির অভাব নেই, এই তল্লাটের অর্ধেকটাই বলা চলে ওদের; ওরা জোয়ান মস্ত পোলা, তরুণ ফার্মার হিসেবে বেশ নামডাক করেছে; টিভিতে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানেও জমজ ভাইয়ের সফলতার গল্প দেখিয়েছে।
আজমীর আলীর পাশে দাঁড়ায় ওয়াসিম-জসিম, দুধ দোহনের কাজটা নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়, ওরা বলে একবার নয় সকাল-সন্ধ্যা দুধ দোহন করলে দুধ পাওয়া যাবে বেশি, আর যখনই ওলান ফোলা ফোলা দেখাবে, আর বাঁটগুলো টনটনে মনে হবে তখনই দুধ দোহন করতে হবে, দেরি করলে দুধ উজায়া যাবে।
ওয়াসিম-জসিম লালসুন্দরীর বাঁট থেকে দুধ বের করতে থাকে। মানুষের সামনেই দুধ দোহন করে। তখন হাসি-তামাশা ও রঙ্গ-লীলায় জমে যায় সব।
ওয়াসিম-জসিমও কম কামেল না, ওরা জমজ ভাই হলেও দুই বন্ধু, গলায় গলায় লেগে থাকে। আজমীর আলী যখন ঠাট্টা করে বলে,
– তোদের দুইডারে একটা বউও আইন্যা দেম
তখন ওয়াসিম-জসিম বলে,
– না না, দুই জনের জন্য না, তিনজনের জন্য কও, তোমারেও ভাগ দিমু নে, কী কও নানি?
নানি রাগে না, কিন্তু এসব কথোপকথনে হাসির রোল পড়ে যায়, ঠাট্টার সম্পর্ক যাদের তারা যোগ দেয়, অন্যরা মুচকি হাসে।
লালসুন্দরীর বাঁট এত শক্ত যে ওয়াসিম-জসিম পর্যন্ত ঘেমে যায়, তখন তারা ফারজানাকে বলে,
– আম্মাজান পানি দেও
আম্মাজান পানি আনে, আরাম করে পানি খেয়ে আবারও দোহন কাজে লেগে পড়ে তারা। তাদের শরীরে শক্তির অভাব নেই, জায়গায়-আজায়গায় বীরত্ব দেখানো ও শক্তিশালী প্রমাণের চেষ্টারও কমতি নেই, ফলে ঘেমে গেলেও বাঁট টানতে থাকে তারা।
লালসুন্দরী আরামসে দাঁড়িয়ে থাকে, ওলান থেকে যেন বিষ সরানো হচ্ছে, আরামের চোটে চোখের পাতা চিকচিক করে ওঠে।
দুধ দোহনের কাজ শেষ হলে ফারজানা পানি দেয় আরও; তারপর আজমীর আলীর বাড়ির পাশে গড়ে ওঠা অস্থায়ী পান-সিগারেটের দোকান থেকে বাদাম-চানাচুর ও চা-বিস্কুট আসে।
তখন মানুষ দেখার মতো অনেক কিছুই পায়, ছেলে হোক কিংবা বুড়া হোক, তারা লালসুন্দরীকে দেখে, ওয়াসিম-জসিমের কায়দা-কানুন দেখে, আর দেখে পরির মতো ফুটফুটে ফারজানাকে।
ক্লাস নাইনে পড়া ফারজানার লাউডগার মতো হাত, টোল পড়া গাল ও টকটকে ঠোঁটের দিকে না তাকিয়ে পারা যায় না।
ফারজানার হাত থেকে চা-বিস্কুট খেতে খেতে ওয়াসিম-জসিম বলে,
– নানা, বাজারে দুধ ৭০/৮০ টাকা সের, আপনে এই দুধ ৭০ টাকা বেচবেন ক্যারে, এই কুদরতি দুধের দাম কমসে কম ১৭০ টাকা হওয়া উচিত।
আজমীর আলী ওয়াসিম-জসিমের বলিষ্ঠতায় খাবি খায়, মিনমিন করে বলে,
– ভাই, তোরা যা ভালা মনে করোছ, কর্, তোরা তো আমার ভালাই চাস, না কি?
ফলে ওয়াসিম-জসিম হয়ে ওঠে দুধ পাওয়ার প্রধান এজেন্ট, কে দুধ পাবে কে পাবে না, তা নির্ধারণ করে দেয় তারা।
রাতারাতি দুধের দাম ১৭০ টাকা হলেও কাস্টমার কমে না, বরং বাড়ে। কিন্তু দিন এভাবে যায় না, কয়েকদিনের মধ্যে লালসুন্দরীর বাঁট থেকে দুই সেরের বেশি দুধ দোহন করা সম্ভব হয় না।
আসমা আক্তার হাহুতাশ করতে থাকে। আজমীর আলী বলে সব দয়ালের খেলা, দয়াল যাকে ইচ্ছা দেয়, যার থেকে ইচ্ছা কেড়ে নেয়, এটা নিয়ে হাহুতাশ করার কিছুই নেই।
তখন ওয়াসিম-জসিম বলে কয়দিনের ব্যবধানে দুধ কমে যাওয়ার কথা না, নিশ্চয় গভীর রাতে দুধরাজ এসে সব দুধ খেয়ে নিচ্ছে।
ওয়াসিম-জসিম আশ্বস্ত করে তারা সবাই মিলে লালসুন্দরীকে পাহারা দিবে। আর এখন থেকে গোয়ালঘরে রাখা যাবে না, লালসুন্দরী থাকবে বারান্দায়, সবার চোখের সামনে।
সন্ধ্যা না হতেই ওয়াসিম-জসিম চলে আসে, ফারজানাকে পানি দিতে বললে আসমা আক্তার পানি এনে দিলে ওয়াসিম-জসিম বলে,
– নানি, তুমি কষ্ট কইরা আনতে গেলা ক্যারে?
আসমা আক্তার বলে,
– ভাইরে তোমগোরে তো পোলাও গোস্ত খাওয়াইতে পারতাম না, তাই বইলা কী এক গেলাস পানিও খাওয়াইতে পারতাম না!
ফারজানা বই-খাতা নাড়াচাড়া করে, লকডাউনে স্কুল বন্ধ থাকলেও অ্যাসাইনমেন্ট করতে হয়।
আজমীর আলী, আসমা আক্তার আর ওয়াসিম-জসিম আলাপ করে অনেক, দুধরাজ কীভাবে মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুধ খেয়ে চলে যায়।
আজমীর আলী ভাবে, জীবন ও জগত সম্পর্কে ওয়াসিম-জসিম কত কী জানে, সময়মতো ছেলে দুইটা পাশে না দাঁড়ালে কী যে হত।
এই যে জ্বরসর্দির কথা শুনে ওষুধ-বড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, আজকাল এত লক্ষ্মী ছেলে পাওয়া যায় না, চোখে জল চলে আসে, এই জীবনে আর কিছুই পাওয়ার নেই তার, মেয়েটাকে নিয়েই যত চিন্তা, মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করতে পারলে শান্তিতে দয়ালের কাছে যেতে পারবে।
এসব কথা যখন মগজ থেকে মুখে আসে তখন ওয়াসিম-জসিমের কলিজায় গেঁথে ধরে, তারা মন খারাপ করে বলে,
– নানা এত চিন্তা কইরো না তো, আমরা মরছি নাকি? নানি, ওই নানি, নানারে কও চিন্তা না করতে; চিন্তা থইয়া এহন ঘুমাও, না ঘুমাইলে শরীল আরও খারাপ করব।
আসমা আক্তারের জ্বর বাড়ে, শরীরের ব্যথাও বাড়ে, তবে ওষুধ খাওয়ার পর কেমন ঘুম ঘুম লাগে, ফলে ফারজানাকে নিয়ে শুয়ে পড়ে।
আজমীর আলী শুয়ে পড়লেও জেগে থাকার চেষ্টা করে। চকির ওপর আসমা আক্তার ঘুমিয়ে গেলেও ফারজানা মনে হয় ঘুমায়নি।
আজমীর আলী ভাবে, ওয়াসিম-জসিম বলল গ্রামে নাকি করোনা চলে আসছে, অথচ ছেলে দুইটা ভয় না পেয়ে ওষুধ নিয়ে আসছে, কৃতজ্ঞতায় চোখ ছোট হয়ে আসে, জগতে আসলে ভালো মানুষের সংখ্যা কম না, আপন নাতি না হয়েও জান দিয়ে দিচ্ছে ওরা।
আজমীর আলীর কত কত কথা মনে পড়ে।
একদিন আগুনলাগা এক সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে এসে দেখে বাপের আমলের ঘরটা নেই, ওখানে ওয়াসিম-জসিমের নানা গোয়ালঘর দিয়েছে, ফলে ওই রাতে জব্বার চাচার ঘরে ঠাঁই হয়।
ওই রাতে শাওন মাসের বৃষ্টি নামে, জব্বার চাচার পুরানা টিনের ছাপরা দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটার কারণে তারা ঘুমাতে পারেনি; ৬ বছরের ফারজানাকে বুকে নিয়ে সারা রাত জেগে ছিল, পুকুরে ডুবে যাওয়া মেয়ে ফারজানাকে খুঁজে পেয়েছিল আসমা আক্তারের পেটের মেয়ে ফারজানার মধ্যে, ওর কচি নরম মুখের দিকে তাকিয়ে ডুবে যাওয়া মেয়ে ফারজানাকে খুঁজে পেয়ে ঘরে ফিরেছিল, আসমা আক্তারের সঙ্গে সংসার নামক প্রাচীরে ঢুকেছিল; ভেবেছিল মেয়েটাকে বুকে নিয়েই বাকি জীবনটা পার করে দিবে। কিন্তু সব কি আর নিজের মতো হয়, সবাই কি আর আজমীর আলীর মতো ভাবে? সংসার কি আর আলাদা হয় কারও, ফকির হোক, মিসকিন হোক, রাজা-বাদশা হোক, সংসার চলে সংসারের নিয়মে।
আজমীর আলীর মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা, মায়ের মৃত্যুর কথা; কী করুণ মৃত্যু! কিন্তু বাবা খানে জাহান আলীর মৃতুর পর যখন একা হয়ে যায়, তখন জব্বার চাচা বউ এনে দেয়, কিন্তু সেই বউ ও চাঁদের মতো ফুটফুটে মেয়ে কীভাবে যে পুকুরে পড়ে মরল এটা আজও বুঝতে পারে না সে। ওয়াসিম-জসিমের নানা শুধু বলে মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে মা-মেয়ে দুইজনই মরেছে, কিন্তু এই কথা সে মানতে পারত না, মা-মেয়ে দুই জনই সাঁতার জানত। ৬ বছরের ফারজানাকে নিজের হাতে সাঁতার শিখিয়েছে সে।
বউ-বাচ্চার আকস্মিক মত্যৃর পরে তাদের কবরের পাশে গড়াগড়ি দিয়ে কান্দাকাটি করার সময় সাঁইজি তাকে শান্ত করে বলেছিল,
– কান্দিস না, কান্দিস না, মানুষ হইয়া জন্মাইছোস, জরা আসব, ব্যাধি আসব, মৃত্যু আসব, তুফান উঠব, আবার গাঙের পানির মতো টলটল হইয়া যাইব সব, ছলছল কইরা বাতাস আসব, শরীর মন সব ঠান্ডা হইয়া যাইব।
সাঁইজির কথাবার্তায় সে সম্মোহিত হয়ে পড়েছিল, আর তখন ঘরদোর ফেলে দেশছাড়া হয়েছিল। কিন্তু ৯ বছর আগে আসমা আক্তার ও ফারজানাকে নিয়ে উপস্থিত হয়।
প্রথমে বাড়ির মানুষ তাকে না চেনার ভান ধরে, বিশেষ করে ওয়াসিম-জসিমের নানা, কিন্তু এতে কাজ হয় না।
পাড়াপড়শিরা হাহুতাশ করে, জব্বার চাচা গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
– এইডা না আমগোর আজমীর।
অথচ ওয়াসিম-জসিমের নানা প্রচার করেছিল আজমীর আলী আজমীর শরিফ চলে গেছে আর কখনও ফিরে আসবে না।
আসমা আক্তার ও ফারজানাকে নিয়ে আবার শুরু হয় তার সুখের সংসার, ৬ বছরের ফারজানাকে আবারও সাঁতার শেখায়, স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়, মেয়েটাও বাবা ছাড়া কিছুই বোঝে না; কিন্তু ফারজানা একটু বড় হয়ে যেতে থাকলে আসমা আক্তার আজমীর আলীর কাছে ঘেঁষতে দেয় না, অথচ আজমীর আলী ফারজানার জন্যই আসমা আক্তারের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল, সেই আসমা আক্তার ফারজানাকে জড়িয়ে কুৎসিত ভাবনার খেলা খেলে যায়।
আজমীর আলী এই কথা মুখ ফুটে আসমা আক্তারকে বলে না, আসমা আক্তারও মুখ ফুটে কিছুই বলে না, কিন্তু আচরণ ও হাবভাবে বুঝিয়ে দেয় সব।
এই জ্বালা যে কত কঠিন তা আজমীর আলীই জানে। না কি সে ঘুমের ঘোরে কোনো দিনে কোনো কাজ করেছে? সেই ছোটবেলা থেকে ফারজানাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছে, কিন্তু তার মনের কোথাও কি লুকিয়ে আছে কুৎসিত কোনো উদ্দেশ্য? নইলে আসমা আক্তার কেন টতস্থ থকে? আসমা আক্তার কেন আকারে ইঙ্গিতে কথার ঝাঁজে বুঝিয়ে দিতে চায় ফারজানা শুধুই তার মেয়ে?
আজমীর আলী ঘুমিয়ে পড়েছিল ভাবতে ভাবতে। ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে লালসুন্দরীর কথা মনে পড়ে। যদি বাতাস আসে, যদি পানির ঝাপটায় লালসুন্দরী ভিজে যায়! ওয়াসিম-জসিম কি থাকবে?
যে বৃষ্টি, শাওন মাসের বৃষ্টির রাতের চেয়ে সুন্দর রাত হয় না। শরীর সুস্থ থাকলে হয়ত লালসুন্দরীকে পাহারা দিত।
একটু আগে চোখের পাতা এক করতেই শৈশবে চলে গিয়েছিল; সে দেখে ছেলেবেলার কাজলা গাইয়ের বাঁট চুষে খাচ্ছে, এটা দেখে বাবা-মা ‘হাইসা-ভাইঙা’ বলছে,
– আমার পোলা দুধরাজ হইছে একটা।
তারপর দেখে একটা দুধরাজ লালসুন্দরীকে পেঁচিয়ে ধরেছে, আরেকটা দুধরাজ বাঁট চুষে খাচ্ছে, অথচ লালসুন্দরী আরামসে শুয়ে আছে। তারপর দেখে একটা দুধরাজ তাকে পেঁচিয়ে ধরে কপালে ছোবল মারছে।
আজমীর আলী আবারও ঘুমানো চেষ্টা করে, কিন্তু চোখ একটু লেগে এলেই দেখে একটা দুধরাজ লালসুন্দরীকে পেঁচিয়ে ধরেছে, আরেকটা দুধরাজ বাঁট চুষে খাচ্ছে আর লালসুন্দরী আরামসে ওলান পেতে দিয়ে শুয়ে আছে।
নাহ্, আর শুয়ে থাকতে পারে না আজমীর আলী। বৃষ্টিও কমে গেছে, সে বিছানা ছেড়ে ওঠে, ঘরে থেকে বের হয়ে দেখে জোছনার মেলা বসেছে, সঙ্গে ঝিরঝিরে বাতাস, পরান শীতল করে দেয়, শরীরে শীত ধরিয়ে দেয়, মাঘ মাসের বাতাসের মতো কনকনে বাতাস হাড়ের ভিতরে ঢুকে পড়ে।
আজমীর আলী দেখে ওয়াসিম-জসিম নেই, কিন্তু লালসুন্দরীর শরীরে পেঁচিয়ে ধরেছে কিছু একটা, আর ওলানের পাশেও কিছু একটা নড়ছে, তার স্বপ্ন কি তবে সত্যি হয়ে গেছে? নিশ্চয় দুধরাজ হবে। সে একটুও শব্দ করে না, সাবধানে মোবাইলটা হাতে নেয়। এখন যদি ওয়াসিম-জসিমকে পাওয়া যায় তাহলে হয়ত দুধরাজকে ধরা যাবে, ছেলে দুইটা বলেছে যখন ইচ্ছে তখন ফোন করতে, এখন ফোন করা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারে না? কিন্তু ফোন করবে না করবে না করেও ওয়াসিমকে ফোন করে বসে, তখন কানে আসে ভো…ও…ভো…ও…শব্দ, পরে জসিমকে কল দিলেও ভো…ও…ভো…ও… শব্দ পায়।
কিন্তু আজমীর আলীর মনে হয় সে যখন ওয়াসিম-জসিমকে কল দিয়েছিল তখন গোয়ালঘরের দিক থেকে ভো…ও…ভো…ও…শব্দটা এসেছিল।
গোয়ালঘরে লালসুন্দরীর জন্য রাখা শুকনো খড় ছাড়া কিছুই নেই। গতকাল রাতেও এই গোয়ালঘরেই লালসুন্দরী ছিল। না কি এই মাত্র যেটা দেখেছে ওটা দড়ি অথবা জোছনার আলো ছিল, আর গোয়ালঘরে লালসুন্দরীকে না পেয়ে দুধরাজ ফোঁস ফোঁস করছে?
আজমীর আলী পা টিপে টিপে গোয়ালঘরের কাছে যেতে থাকে, যতই কাছে যায় ততই শব্দটা পরিচিত লাগে, আদিম আওয়াজের মতো লাগে, একদম কাছে চলে গেলে দেখে শাওন মাসের জোছনার আলোয় তিন জন মানুষ নড়াচড়া করছে।
আজমীর আলীর গলা শুকিয়ে যায়, আর কিছুই ভাবতে পারে না, সে বিছানা ছেড়ে আসার সময় আসমা আক্তারকে পড়ে থাকতে দেখলেও ফারজানাকে দেখেছে কি না মনে করতে পারে না। সে দ্রুত ঘরের দিকে যেতে থাকে, কিন্তু তার পা নড়ে না, একটুও না, বুক ধরফর করতে থাকে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে থাকে।