
দিন যাপনের কলাবিদ্যা
এ সময়ের মানুষ কী ভয়ানক নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে! যৌথতার বোধ খুব দ্রুত ভেঙে পড়ছে- শহর তো বটেই, গ্রামেও। যৌথ বিচরণের ক্ষেত্রগুলোও হারিয়ে যাওয়ার পথে। কিছু বিষয় তো ইতোমধ্যে অতীতের গর্ভে চিরদিনের জন্য চলে গেছে। পত্রিকা, বই, টেলিভিশনকে কেন্দ্র করেও যে মেলবন্ধনের দেখা মেলতো তা-ও হারিয়ে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য কী একসময় কমন ছিল না যে, পাশাপাশি কয়েকজন বসে পত্রিকার একেকটা পাতা হাতে নিয়ে পড়ছে? এখন আর এমন দেখা যায় না। পাঠাগারে যাওয়া মানে এখন লোকে মনে করে সময়ের অপচয়। আর পাঠচক্র তো বিলীন হওয়ার পথে। এগুলোকে কেন্দ্র করে একটা সামাজিক যোগাযোগ তৈরি হতো। জনপ্রিয় গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন উপযোগিতা হারাচ্ছে। টেলিভিশনকে কেন্দ্র করে যে অন্তত পারিবারিক একটা সম্মিলন হতো তা-ও খুব কম হয়। পরিবারের সদস্যরা একেকটা ডিভাইস নিয়ে নিজের মতো করে ব্যস্ত। মা-বাবা মজে থাকেন কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর বাচ্চারা মেতে থাকে কোনো গেইমে বা ইউটিউবে কোনো ভিডিও কন্টেন্ট নিয়ে। মুঠোফোনে পত্রিকা পড়া যাচ্ছে, বই পড়া যাচ্ছে, সিনেমা, গান, খবর শোনা যাচ্ছে। প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজতর করে দিচ্ছে, এ নিয়ে কোনো দ্বিধা করার অবকাশ নাই। কিন্তু এর সাথে কিছু জটিলতাও কী তৈরি করছে না?ভার্চুয়াল জীবন রিয়েল জীবনকে নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভাবে। সাইবার অপরাধের জালে কে কোথায় আটকে যাচ্ছে, কে জানে?
২
আমাদের সময় এখন আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি এই অদৃশ্য ভূগোলের ভার্চুয়াল কেন্দ্র থেকে। এতে প্রাযুক্তিক যোগাযোগ বেড়ে মানুষের এক্সেসকে আপাতভাবে বহুমুখীকরণ করলেও আদতে কে লাভবান হচ্ছে? অর্থনীতির পাঠ থেকে এখানেও মুক্তি মেলে না যে। অর্থনীতির আবেষ্টনে আমরা জেগে জেগে স্বপ্ন দেখলেও পেছনে তৈরি হতে থাকে নিজেকে হারানোর ক্ষত। দিনে দিনে এ ক্ষত গভীর হয়। পুঁজ জমে। আর পুঁজিবাদের জয়ধ্বনি ঘোষিত হতে থাকে চতুর্দিক থেকে। আমার একাকীত্ব পুঁজি হয়, আমার বিষণ্নতা পুঁজি হয়, আমাদের যৌথতাও পুঁজি হয়। অদৃশ্য জগতে আমাদের মোহ জাগানীয়া পুঁজি তৈরি হতে খুব দ্রুত গতিতে। আমাদের রাত কাড়ে, আমাদের দিন কাড়ে, আমাদের বিশ্রাম ও আলস্য কাড়ে। আর মেঘের পাখায় ভর দিয়ে ওড়ে চলে যায় আমাদের একান্ত দিনের অন্তরঙ্গতা।
প্রাযুক্তিক ঈশ্বরের হাতে আমরা সমর্পিত হই। আমাদের পাঠ্যবই থেকে হারাতে থাকে মানবিক বিদ্যার অক্ষরগুলো। সাইবার স্পেসে যেন-বা আর সেগুলো মানানসই নয়, হারিয়েছে তার কালোত্তীর্ণ সামাজিক প্রভাব। আমরা নিমগ্ন হই এক কর্কশ আলো-আঁধারিতে। আমাদের চারপাশে দেখা দেয় নানান ধরনের হাতছানি। এর কারণে মানবিক বিদ্যার সূত্রগুলো আমাদের ভেতর আর আলোড়ন তোলে না। ফলে ক্রমশ সরলতার খোলস ছাড়িয়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে মাকড়সার জালের মতো জটিল গ্রন্থি।
দিনে দিনে এমন অনেক গল্প তৈরি হতে থাকে যা অচেনা লাগে। অথবা কোনো গল্পই তৈরি হয় না। গল্পহীনতা আমাদের গ্রাস করে ফেলে। হাওয়ার ঠিকানায় উড়িয়ে দেই আমাদের সবকিছু।
৩
তবে কি আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াচ্ছি বিজ্ঞানের, তবে কি আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াচ্ছি অবাধ যোগাযোগের- যার সাথে আগের সময়ের তুলনা করলে মনে হবে আহা! সেদিনও মানুষ কেমন গুহাবাসী ছিল। না, তা নয় মোটেও। আমাদের চলমান বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাই কেমন করে। কালের স্রোতকে কোনো ‘কাল‘ এড়াতে পেরেছে? কে পেরেছে দাঁড়াতে সময়ের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিপক্ষে?
বাস্তবতারও তো প্রতি-বাস্তবতা থাকতে পারে, যেখান নিজস্ব আকাশটা দেখা যায়। ঘুম হারানোর, সময় কাড়ানোর বিস্তৃত আয়োজন থেকে খানিকটা অবসর চাই। কেননা আমাদের ঘুম দরকার, শস্য ফলানোর জন্য আমাদের অবসর দরকার। শিশুদের সাথে মিশে তাদের হাসি-কান্নার সাথে একাত্ম হয়ে উপভোগ করা দরকার কিছু ব্যতিক্রমী মূহুর্ত।