
দিনের পর দিন | কিস্তি- ৮
৮.
বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায় জমেলার। তার ফেরার পথ ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হয়। পা চলে না। গুলি খাওয়া বাঘের মতো টলমল করে। অথচ গুলিটা তার পায়ে লাগেনি, লেগেছে হৃদয়ে। মানুষ কি তবে হৃদয়চালিত প্রাণি?
বিকেলের আলো মরে এসেছে জমেলার হৃদয়ের মতো। সে বাড়ির উঠোনে পা দিয়ে দেখে হাস-মুরগি হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেলেছে। মলত্যাগ করে নস্ট করে ফেলেছে সারা উঠোন। তাদের চিৎকারে কানপাতা দায়। অথচ এর ভিতরেই পা ছড়িয়ে ধুলো নিয়ে খেলছে জামি ও হামি। জলির দেখা নেই।
জলি… মা জলি…। হাঁক ছাড়তে ছাড়তে ঘরে প্রবেশ করে জমেলা।
চৌকির উপর বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে জলি। ঘর অন্ধকার প্রায়। মশা গুনগুন করছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই জলির।
জমেলা নিজে থেকেই কৈফিয়ত দেয়—‘তোর মামুর বাড়িত গেছনু একটা দরকারে। ভাবিছিনু যামো আর আসমো। কিন্তু অনেক দিন পর গেছি তো, না খাইয়া আসপার দিলো না। তাই দেরি হয়্যা গেলো।’
জমেলা বুঝতে পারে, ছেলেমেয়েদের না বলে যাওয়াটা তার ভুল হয়েছে। তারা নিশ্চয় অনেক দুশ্চিন্তা করেছে। কান্নাকাটি করেছে। সেই জন্যই মেয়ে হয়তো অভিমান করে শুয়ে আছে। মায়ের সঙ্গে কথা বলছে না। কিন্তু জলির অভিমানের কারণ কি শুধুই তার মায়ের অকস্মাৎ অনুপস্থিতি, নাকি আরও কিছু? এই অনাবিষ্কৃত আরও কিছু কি করে জানবে জমেলা?
হাত পায়ের ধুলো ঝারতে ঝারতে ঘরে প্রবেশ করে জামি ও হামি। তাদের মুখ শুকনো। দেখেই বোঝা যায়, উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় নেতিয়ে পড়েছে তারা।
‘মা, খিদা লাগিছে।’ হামি বলে।
জমেলার চোখেমুখে এবার বিস্ময় ফুঁটে ওঠে। ছেলেরা এখনো খায়নি! ‘জলি, ছলেকরোক খাবার দেস নি ক্যা?’ খেকিয়ে ওঠে জমেলা।
বিছানা থেকে উঠতে উঠতে ভীষণ শান্ত গলায় ‘ভাত রান্ধিনি’ বলে জলি। তারপর বিছানার উপর হাঁটু মুড়ে বসে পিঠময় ছড়ানো চুলগুলো খোঁপা বাঁধতে থাকে।
মেয়ের নির্বকারত্ব আরও অবাক করে জমেলাকে। সে বলে, ‘রান্ধিসনি ক্যা’?
জলির তেমনি ভাবলেশহীন নির্বিকার উত্তর—‘এমনি’। তারপর চৌকি থেকে নেমে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মেয়ের মতিগতির তল খুঁজে পায় না জমেলা। জামি হামির শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ছলছল করে ওঠে তার। আহা রে! সারাদিন কিছু খায়নি ছেলেমেয়েরা। অথচ সে কাতল মাছ, এটা সেটা কতকিছু খেয়ে এসেছে। একটা অপরাধবোধের সাপ মুহূর্মুহু ছোবল দেয় জমেলাকে। তার সারা অন্তর নীল বিষে ছেয়ে যায়। অথচ দেখা যায় না বিষটা।
জমেলা দেরি না করে চুলায় ভাত উঠিয়ে দেয়। হাস-মুরগিগুলোর উৎপাত থামাতে তাদের সামনে খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেয়। জামি-হামি শাড়ির আঁচল ধরে মায়ের পিছু পিছু ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে—‘খিদা লাগিছে… ও মা, খিদা লাগিছে’।
জমেলা বলে, ‘মিচ্চি অ্যানা সবুর কর, বাবা। এই তো ভাত তুল্যা দিছি।’ তারপর ঢাকনা উঠিয়ে দেখে ভাতের বলক উঠতে শুরু করেছে। এই ফাঁকে তরকারির ডালা নিয়ে বসে জমেলা। আলু আর পটল আছে। কাঁচের বয়ামে একটু ডালও আছে। জমেলা ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়, আলু ভর্তা, পটল ভাজি আর ডাল করা যাক। মেয়েটা যে কোথায় গেল! মায়ের সাথে একটু হাত লাগালেও তো পারে। আগে তো এমন ছিল না। মায়ের সব কাজেই সে সাহায্য করত। কি হলো হঠাৎ। জলি… মা, জলি। কোনটে গেলু মা…। গলা ছেড়ে ডাক পাড়ে জমেলা।
জলির কোনো সাড়া নেই।
বিকেলের সূর্যটা তাড়াহুড়ো করছে। এত তাড়া কেন তার ডুবে যাওয়ার? জমেলা বুঝে উঠতে পারে না। ভাত অবশ্য হয়ে গেছে। সে চুলায় তরকারি উঠিয়ে দিয়ে উঠান ঝাড়ু দিতে শুরু করে। জলির এখনো দেখা নেই। জমেলা আবার গলা ছাড়ে—জলি…।
জামি হামি আবার ধুলা নিয়ে খেলতে বসেছে। জমেলা ধমক লাগায়—‘সারাদিন ধুলা লিয়া খ্যালে, সারাদিন ধুলা লিয়া খ্যালে। যা, হাতমুখ ধুয়্যা আয়।’
জামিল, হামিদ হাত মুখ ধুয়ে এলে জমেলা বারান্দায় মাদুর পেতে খেতে দেয়। তখন তার আবার জলির কথা মনে পড়ে। জলি এখনো এলো না। কোথায় গেছে মেয়েটা? পশ্চিম আকাশ কমলা রঙে ছেয়ে গেছে। অর্ধেক ডুবে যাওয়া সূর্যটা জানান দিচ্ছে, সন্ধ্যা হতে খুব দেরি নেই আর। হয়ত আধাঘণ্টা বাদেই মাগরিবের আজান ফুঁকবে চাঁন্দের বাপ।
জমেলা এবার কোমরে শাড়ির আঁচল বেঁধে জলিকে খুঁজতে বের হয়। বেশি দূর যেতে হয় না অবশ্য। বাড়ির পাশেই পুকুর পাড়ে নতমুখে বসে আছে জলি। তার দৃষ্টি কোথায় বুঝে ওঠা ভার। সামনেই তাকিয়ে আছে, কিন্তু স্থির চোখ বলে দিচ্ছে, তার দৃষ্টি দূরে কোথাও। ওই অনন্তে।
পেছন থেকে গিয়ে আলগোছে মেয়ের মাথায় হাত রাখে জমেলা। ‘কী হছে মা জলি? এটি ইঙ্ক্যা মন খারাপ করে বস্যা আছু ক্যা?’
মায়ের স্নেহভরা হাতের স্পর্শ আর আদুরে গলার ডাক কিশোরী জলিকে আবেগাপ্লুত করে ফেলে। তার সমস্ত আবেগ জলীয় বাষ্প হয়ে আছড়ে পড়ে হৃদয়ের উপকূলে। কান্নার ঢেউ আটকানো কঠিন হয়ে যায়। সে হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। জমেলা মেয়ের মাথাকে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। মায়ের আদর পেয়ে কান্না আরো বেগবান হয়। এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে জলি।
‘কী হছে মা? হামাক খুলা ক তো।’ মেয়ের কান্না দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে মাতৃহৃদয়। শাড়ির আঁচলে মেয়ের চোখ মুছে দিতে দিতে বারবার জিজ্ঞেস করে জমেলা। মাত্রই ডাঙ্গর হয়ে উঠেছে মেয়ে। দেখতে শুনতেও হয়েছে মাশাল্লাহ! ফজলি আমের মতো লম্বা মুখ। ফর্সা টকটকে গায়ের রং। মাথাভর্তি মা কালীর মতো ঘনকৃষ্ণ চুল। দিন দিন প্রতিমার মতো সুন্দর হয়ে উঠছে জলি। তার দিকে নানাজনের নানা নজর। দক্ষিণ পাড়ার নজু কি কিছু বলেছে? নাকি মণ্ডল পাড়ার উজ্জ্বল পথ আটকেছিল? এসব বখাটেরা যে ওৎ পেতে থাকে তা জমেলা ভালো করেই জানে। জলির বাপ মরার পর এদের উৎপাত আরো বেড়েছে। সুযোগ পেলেই শিয়াল শকুনের মতো হামলে পড়বে জলির উপর। পিতৃহীন ডাঙ্গর মেয়ে মানে উদলা ঘর। ছাউনি নেই। মাথার কোনো নিরাপত্তার চাল নেই। এ অবস্থায় জমেলা একা আর কতটা সামলাবে? অসহায়ের মতো করুণ চোখে মেয়ের দিকে তাকায় জমেলা। তারও বুক ফেটে কান্না আসে।
(চলবে)