
দিনের পর দিন ॥ কিস্তি ৬
আব্দুল তার বউকে চোখ ইশারা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বউ তার কাছে এলে সে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘শার্টের পকেটত তিনশো ট্যাকা আছে। লিয়া আয়। এদ্দিন পর জমেলা আসিছে। বাজারত থ্যাকা মাছ লিয়া আসি। তুই আন্দাবারির জোগাড় কর।’
যতই ফিসফিস করে বলুক, কথাগুলো আসলে সকলেই শুনতে পায়। জমেলা হা হা করে ওঠে—‘কিচ্চু করার দরকার নাই ভাইজান। হামি এখনই যামো। ছোলেকরক ঘুমত থুয়্যা আসিছি। এখনই যাওয়া লাগবে হামার।’
ছোট বউ এবার বড় গামলায় করে মুড়ি এনেছে। কাঁচা মরিচ, পেয়াজ আর সরিষার তেল দিয়ে মাখা। সে গোল জমায়েতের মাঝখানে গামলা রাখতে রাখতে বলে—‘এদ্দিন পর আসিছিন। ভাত না খাইয়া বলে যাবার দিমো! কলেই হলো? স্থির হয়্যা বসে থেকে মুড়ি খাও।’
মুড়ির পরিমাণ দেখে এবারও সবার আক্কেল গুড়ুম। এতগুলো মুড়ি সন্ধ্যা পর্যন্ত চিবালেও শেষ হবে না। ছোট বউয়ের নির্বুদ্ধিতায় এবার কেউ কিছু বলে না, সবাই সবার মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেঁসে ওঠে।
আব্দুল বলে, ‘বসে থাকলু ক্যা। ব্যাগটা দে। বাজারৎ যাই।’
আব্দুলের বউ হাসি থামিয়ে ব্যাগ আর টাকা আনতে ঘরের ভেতরে যায়।
বাজার ঘুরে মাঝারি সাইজের একটা কাতল মাছ কেনে আব্দুল। তার মনে পড়ে, শিকদার বাড়ির বড় পুকুরে একবার সাত কেজি ওজনের কাতল মাছ ধরা পড়েছিল। জমেলা তখন ছোট। ওই শিশুমনে কাতল মাছ খাওয়ার ইচ্ছা জেগেছিল খুব। সে বাড়িতে এসে খুব কান্নাকাটি করেছিল কাতল মাছ খাওয়ার জন্য। কিন্তু কাতল মাছ কেনার মতো সামর্থ ছিল না তাদের। জমেলার কান্না থামাতে আব্দুলের বাবা জাল নিয়ে বিলের ধারে গিয়েছিল। বোয়াল, শিং, মাগুর, টাকি, খলসে, পুটি অনেক মাছ পেয়েছিল। কিন্তু কাতল পায়নি। ছোটবেলায় তারা শিং, মাগুর, বোয়াল এমনকি ইলিশের মৌসুমে অনেক ইলিশ মাছও খেয়েছে। তখন ইলিশ এত দুর্লভ ছিল না। দুর্লভ ছিল রুই, কাতলা, মৃগেল এসব চাষের মাছ। তখন শিকদারদের পুকুরে, মোল্লাদের পুকুরে এসব চাষ হতো। অনেক দামে বিক্রি হতো সেসব। আব্দুলদের কেনার সামর্থ ছিল না।
পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে মন খারাপ হয় আব্দুলের। কতদিন আগের কথা সেসব। অথচ মনে আছে। মানব মনের কারবার বড়ই আচানক। না পাওয়ার কষ্ট, অতৃপ্তি, বেদনা সব মনে রাখে সে। অথচ দুদিন আগের কোনো আনন্দের কথা কিছুই মনে রাখে না।
কানকোর মধ্যে দড়ি ঢুকিয়ে মাছটা ঝুলিয়ে নিয়ে বাড়ির পথ ধরে সে। কাছে ব্যাগ আছে, কিন্তু ব্যাগের মধ্যে মাছটা ঢুকাতে ইচ্ছে করে না তার। মানুষ দেখুক, বেন্নার ব্যাটা আব্দুলও বড় মাছ কিনতে পারে, এই প্রদর্শনেচ্ছা হয়ত তার অবচেতনে সুক্ষ্মভাবে কাজ করে। আব্দুল একহাতে লুঙ্গির খুঁট ধরে, আরেক হাতে কাতল মাছ ঝুলিয়ে বীরদর্পে হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে ফেরে।
বাড়ি ফেরার পর আরেকদফা হইচই হয়। এ হইচই অবশ্য আনন্দের হইচই। এত্ত বড় মাছ! বাড়ির খুদে ছেলেপুলেরা আনন্দে লাফাতে থাকে। তাদের বাড়িতে আজ অনেকদিন পর ভালোমন্দ রান্না হতে চলছে। একটা উৎসব উৎসব ভাব। আজ কারও ইশকুলে যাওয়ার দরকার নেই বলে ঘোষণা করে বাড়ির বড় ছেলে আব্দুল।
এতসব আয়োজন দেখে মন দু ভাগ হয়ে যায় জমেলার। একভাগে খুশির নাচন আরেক ভাগে দুশ্চিন্তা। যে ভাই এতদিন তার খোঁজ নেয়নি সেই ভাই-ই তাকে কাছে পেয়ে কত জোগাড়যন্তর করে ফেলেছে। এজন্যই বুঝি বলে, ভাই বড়ধন রক্তের বাঁধন। খুশিতে বুকটা ভরে ওঠে জমেলার। কিন্তু পরক্ষণেই একটা দুশ্চিন্তা গ্রাস করে তাকে। যা বলতে এসেছে ভাইদের কাছে তা কি বলতে পারবে সে? ওদিকে ছেলেমেয়েদেরকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে এসেছে। তারা এখন কী করছে কে জানে! দিনকাল ভালো না। মেয়েটা ডাঙ্গর হয়ে উঠেছে। তার দিকে নানা জনের কুনজর। একলা বাড়ি পেয়ে কেউ যদি কিছু করে বসে?
জমেলা একবুক অস্বস্তি নিয়ে চুলার পাড়ে গিয়ে ভাতৃবধুঁদের পাশে গিয়ে বসে। আব্দুলের বউ পিড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে, তোমাক কিছু করা লাগবে না বুবু। তুমি খালি বস্যা থ্যাকা দেখ।
জমেলা মৃদু হেসে বলে, তুমি যখন বাপের বাড়িত যাও তখন তোমার ভাবিরাও ইঙ্কা করে লয়? কোনো কাম করব্যা দেয় না।
‘হামার কি আর সেই কপাল আছে রে বুনি।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আব্দুলের বউ। ‘কপালত থাক্যা বাপের বাড়ির রিজিক উঠা গেছে। বাপ মরার পর সম্পত্তি ভাগাভাগি হলো। হামার বাপ তো আর জমিদার লয়। অল্প কয়ডা জমি। দুই আড়াই বিঘার মতো। ভাইয়েরা কলো, তুই যদি ভাগ লিবা চাস, তাইলে একবারে লিয়া যা। আর কোনোদিন হামাকেরে বাড়িত আসপু না। হামি তোমার ভাইওক কনু, কত্তটুকু আর ভাগ পামো, ওইটুক সম্পত্তির জন্য বাপের বাড়ি কানা করমো? তোমার ভাইওক তো চিনেন। কুত্তার মতো খাঁও খাঁও করা উঠল। শ্বউয়ের বাড়ির সম্পত্তি তার লাগবেই।
শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল আব্দুলের বউ। সম্পত্তির ভাগ লিয়া সেই যে আসিছি, আর যাইনি বু। কোন মুখ লিয়া যামো, কও?
জমেলা কী বলবে ভেবে পায় না। এই মুহূর্তে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার। বাপের বাড়ির প্রসঙ্গ সে না তুললেও পারত। কে জানত এই সামান্য কথাতেই এক দুঃখের অগ্নিগিরির লাভামুখ খুলে যাবে?
জমেলা হঠাৎ দেখতে পায় সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ডুকছে ছোটভাই জায়েদুল। তার হাতে কাগজের একটা ঠোঙ্গা। কখন সে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল টের পায়নি কেউ। জমেলা আর আব্দুলের বউ যখন চুলার পাড়ে বসে দুঃখের ধারাপাত গুণছিল তখনই সম্ভবত সে বাইরে গিয়েছিল।
জায়েদুল ঠোঙ্গাটা এগিয়ে দেয় জমেলার দিকে।
বুবু, তোর মনে আছে, এই চুলার পাড়ে বস্যা থাক্যা হামরা কত পিঠা খাছি। মা পিঠা ভাজিচ্ছিল আর হামরা গোল হয়্যা এটি বস্যা থ্যাকা খাচ্ছিনু। তুই খালি কালাইপুরি খাচ্ছিলু। এত পছন্দ আছলো তোর।
জমেলা ঠোঙ্গা খুলে দেখে মাস কালাইয়ের ডাল! সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ডালের দিকে। জামেলা আসলে মাসকালাইয়ের ডাল দেখছিল না, দেখছিল অনেক দূরের কিছু। অনেক দূরের অতীত, যে অতীত একটু আগে বেরিয়ে আসছিল জায়েদুলের কণ্ঠ ফুঁড়ে।
জায়েদুল আব্দুলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবি, অল্প করা কালাইপুরি বানাও। ডাল আনিছি। হামার বউ কোনটে গেল? ওক অ্যানা কামত লাগাও ভাবি। কোনো কিছুই তো পারে না।
জমেলার চোখ ভিজে ওঠে ভাইদের আয়োজন দেখে। জমেলা কী খেতে পছন্দ করে এরা ভোলেনি কেউ। এক ভাই নিয়ে এসেছে কাতল মাছ আরেক ভাই নিয়ে এসেছে মাসকালাইয়ের ডাল। অথচ এই ভাইদের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না বহু বছর। একদিনের জন্যও খোঁজ নেয়নি এরা। শুধু তার স্বামী মারা গেলে কবর দিতে গিয়েছিল একঘণ্টার জন্য। কবরের উপর একমুঠো মাটি দিয়েই চলে এসেছিল। জমেলা ভেবেছিল ভাইয়েরা ভুলে গেছে তাকে। তার জন্য ভাইদের মনে কোনো ভালোবাসা নেই। কিন্তু আজ সে উপলব্ধি পারছে, ভালোবাসা আসলে মরে না। পলিমাটির নিচে গোপন স্রোতের মতো বয়ে যায়। সময় শুধু পলি ফেলে ফেলে সে স্রোতকে ঢেকে দেয়।
জমেলার মন আবার অস্থির হয়ে ওঠে। যে বিশাল জোগাড়যন্তর শুরু হয়েছে, এটা শেষ হতে হতে তো বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাবে। তার আসল কথা মনে হয় বলাই হবে না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এতদিন পর এসেছে তা কী ভেস্তে যাবে? ওদিকে বাড়িতে ছেলেমেয়েরা কী করছে কে জানে! জমেলার বুকের ভেতরের পাখিটা ছটফট করে ওঠে।
কিন্তু এই আয়োজন ফেলে যাওয়ার তো উপায় নেই!
(চলবে)