
দিনের পর দিন ॥ কিস্তি ৪
চাতালের কাজ থেকে ছুটি মেলে সন্ধ্যায়। গোধূলীর মুমূর্ষু আলো গায়ে মাখতে মাখতে ঘরে ফেলে জমেলা। রোজকার মতো হাঁস-মুরগিগুলো উঠোনে মাহফিল বসিয়েছে। মেয়ে জলি বারান্দায় বসে হারিকেনের চিমনির কালি মুছছে রোজকার মতো। কলপাড়ে গলা শোনা যাচ্ছে জামি-হামির। হাত-মুখ ধুয়ে সাফ-সুতরো হচ্ছে তারা। শুধু ধলি-লালি বাঁধা থাকত যে পৈঠায়, সেটা খাঁ খাঁ বিরান! চাড়ি দুটো মুখ হা করে পড়ে আছে শূন্য!
বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে জমেলার। মানুষটা কত আদর-যত্ন করে পালত গরু দুটোকে! নিজে শাকান্ন খেত, শুধু আলু ভর্তা দিয়ে পান্তা খেত, কিন্তু গরু দুটোকে কোনোদিন খৈল-ভূষি ছাড়া রাখেনি। প্রতি সোমবারের হাটে চিটাগুড় কিনত। প্রতি শুক্রবারে পুকুরে নামিয়ে সাবান দিয়ে ডলে ডলে স্নান করাত ধলি-লালিকে। সেই মানুষটা হুট করে চলে গেল! সঙ্গে সঙ্গে কয়দিন বাদে চুরি হয়ে গেল গরু দুটোও। ওই গরুর খুঁটিতে, ওই চারিতে কত মমতার স্পর্শ লেগে আছে মানুষটার! কত স্মৃতি লেগে আছে ধলি-লালির! এখন সব পড়ে আছে, শুধু মানুষটা নেই! ধলি-লালি নেই! আহারে!
চোখ মুছতে মুছতে উঠোন ছেড়ে ঘরে প্রবেশ করে জমেলা। ততক্ষণে হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে হাঁস-মুরগি খোয়ারে উঠাতে গেছে জলি। মেয়েটা বড্ড শান্ত। বড্ড চুপচাপ। দিনকে দিন আরও লক্ষ্মীমন্ত হয়ে উঠছে। মা মরা মেয়েরা সাধারণত এমন হয়। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় স্বেচ্ছায়। কিন্তু জলির তো মা মরেনি। পিতার মৃত্যুই তাকে এক অদৃশ্য দার্শনিক ছবক দিয়ে গেছে। ছেলে দুটো এখনো তেমন কিছু উপলব্ধি করতে পারছে না। তাদের রোজকার রুটিনে তেমন কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। রোজ সকালে ইশকুলে যায়, ইশকুল থেকে ফিরে বিকেলে খেলতে বেরোয়, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে হারিকেনের আলোয় পড়তে বসে, পড়া শেষে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ফের সকাল হলে বগলে বই-খাতা নিয়ে ইশকুলে যায়, ইশকুল থেকে ফিরে খেলতে বেরোয়, খেলা শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পড়তে বসে, পড়া শেষে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ফের সকাল হলে…।
ঘাস-মুরগির খোয়ার বন্ধ করে দিয়ে ঘরে ফিরে আসে জলি। ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে দিয়ে হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দেয়। বই-খাতা নিয়ে সে বসবে এখন। জামি-হামিও যোগ দিবে এই পঠনযজ্ঞে। কিন্তু জমিদার পুত্রদ্বয় এখনো ঘরে ফেরেনি কলপাড় থেকে। ঘর থেকেই শোনা যাচ্ছে তাদের কলধ্বণি। জমেলা হাঁক ছাড়ে—‘লবাবের বাচ্চাকেরে হাত-মুখ ধোয়া হয়নি একনো? নাকি পান্টি লিয়া যামো?’
মায়ের গলা শুনে দ্রুতই ছুটে আসে জামি-হামি। কোনো কথা না বলে সুবোধ বালকের মতো বই-খাতা নিয়ে বসে পড়ে বড় বোনের পাশে। জমেলা খাতুন শাড়ির আঁচলের গিট খুলতে খুলতে বলে, ‘দেখ তো সোনারা, কী আনিছি তোমাকেরে জন্যি।’ তারপর হারিকেনের আলোর সামনে মেলে ধরে সন্দেশগুলো।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কন্যা-পুত্রদের মুখ। ‘সন্দেশ তুই কোন্টে পালু, মা?’ জামিল জিজ্ঞেস করে।
‘কোন্টে আর পামো! বাজারৎ থ্যাকা কিনা আনিছি।’
জমেলার কথা শেষ না হতেই বাইরে একটা পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ শোনা যায়—‘ভাবি, ও ভাবি। বায়িৎ আছিন?’ কণ্ঠটা চিনতে অসুবিধা হয় না জমেলার। এ তো আলতাব মুন্সীর গলা! জমেলা দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে উঠানে দাঁড়িয়ে আছে আলতাব মুন্সী। ‘আসিন ভাই, ভিতরে আস্যা বসিন’। আলতাবকে আহ্বান জানায় জমেলা। এর আগেও একদিন এসেছিল সে। কিছু একটা বলতে চায় জমেলাকে। কিন্তু বলে না। আজ আবার কেন এলো কে জানে! আলতাব মুন্সীর মতিগতির অতল স্পর্শ করতে পারে না জমেলা। সে ভাবে, মানুষের মুখ দেখেই যদি মনের ভেতরটা পড়া যেত কতই না ভালো হতো।
উঠোন লাগোয়া বারান্দায় ছিল একটি বসার টুল। সেখানেই বসতে বসতে আলতাব মুন্সী বলে, ‘না থাক ভাবি, ঘরের ভিতরে আর যামো না। ছলেরা পড়িচ্ছে মনে হয়। পড়ুক। ছোলপলোক লেকাপড়া শিখাইয়ো ভাবি। ওরাই কিন্তুক তোমার অন্ধের যষ্টি। যষ্টি মানে বুচ্ছিন তো। লাঠি, লাঠি। লাঠি হারালে সব শ্যাষ।’
‘হয় ভাই। ঠিকই কছিন। কানার লাঠি হারালে তো আর কিছু থাকে না।’
‘সেই জন্যই কচ্ছি, সাবধানে থাকো। আর একটা কথা কবার চাছনু ভাবি। কিন্তু ক্যাংকা কর্যা যে কমো। তোমার এত বিপদ। গরুগুলাও চুরি হয়্যা গেল। এই দিকে হামিও পড়িছি বিপদে। না কইয়া থাকপারও পারিচ্ছি না।’
‘কন ভাই কন। মনের মদ্যে কোনো সংকোচ থুয়েন না ভাই। কন, কী কবার চাচ্ছিন।’ মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিতে দিতে কথাগুলো বলল জমেলা। তার এক হাতে ছিল হারিকেন। সেটি মাটিতে নামিয়ে রেখে বারান্দায় বসে পড়ল সে। হাত তিনেক দূরে কাঠের টুলের উপর বসে আছে আলতাব মুন্সী। তার মাথা নিচু। হারিকেনের মৃদু আলোয় তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। সন্ধ্যা উৎরে গেছে অনেক আগেই। আকাশে চাঁদ ওঠেনি এখনো। জমেলার উঠোনের এক কোনায় ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি কামরাঙা গাছ। তার তলায় একরাশ অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে হাত কচলাতে শুরু করে আলতাব মুন্সী। তারপর থেমে থেমে একটু ধীর গলায় বলে, ‘ঘটনা হছে কী ভাবি, একরাম ভাই বাঁচ্যা থাকতে হামার কাছ থাক্যা দশ হাজার ট্যাকা ধার লিছলো। কছলো, পরে আস্তে আস্তে শোধ কর্যা দিবে। কিন্তু আল্লার কি কাম দেখলিন! মানুষটা ধাম কর্যা মর্যা গেল! এখন হামিও তো গরিব মানুষ। কষ্টেবিষ্টে ট্যাকা কয়টা জড়ো করিছিনু। হামার তো আর কোনো জমানো ট্যাকা নাই ভাবি। ট্যাকাডা দিলে উপকার হলোহিনি। তোমার ভাবির কি এক ব্যরাম হছে। অ্যানা ডাক্তার দেখানুহিনি।’
হঠাৎ করে যেন বাজ পড়ল জমেলার মাথার উপর। তার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে। এমন কথা তো সে কখনো শোনেনি! জমেলার স্বামী একরাম বেঁচে থাকতে কখনো তো টাকা ধার করার কথা বলেনি। আর এত টাকা ধার করে সে কী করেছে? কোথায় খরচ করেছে? কাকে দিয়েছে? নাকি আলতাব মুন্সী মিথ্যা কথা বলে জমেলার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে? নানা প্রশ্ন একসাথে আছড়ে মনে জমেলার মনে। কিন্তু আলতাবকে কোনো প্রশ্ন করতে পারে না সে। এতদিনের পরিচিত আলতাব মুন্সী, এত বিশ্বস্ত, সবসময় তার স্বামী একরাম আর এই আলতাব মুন্সী একসঙ্গে কুলির কাজ করেছে, সে কি মিথ্যা কথা বলতে পারে জমেলার কাছে? জমেলার বিশ্বাস হয় না। সে তাই আলতাব মুন্সীর কথাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে এবং ধরে নেয় সত্যিই একরাম তার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। কিন্তু টাকা ধার নিয়ে সে কী করেছে সেই প্রশ্নের উত্তর পায় না জমেলা। অদূরে কামরাঙা গাছের তলা থেকে জমাটবাঁধা অন্ধকারটা পায়ে পায়ে উঠে এসে জমেলার বুকের উপর যেন চেপে বসে। সে শ্বাস নিতে পারে না।
‘আজ তালে উঠি ভাবি। তুমি ক্যাংকা কর্যা কী করবিন, তোমার সিদ্ধান্তের কথা পরে তালে হামাক জানাইও।’
উঠোন পেরিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় আলতাব মুন্সী। তার চলে যাওয়া পথের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে জমেলা। তার শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে।
(চলবে)