
দিনের পর দিন ॥ কিস্তি ৩
কান্নায় মনের দুঃখ লাঘব হয় হয়তো, কিন্তু তাতে দুর্দিন অপসারিত হয় না। জমেলা পরিত্রাণ খোঁজে। ভাবে, মেয়েটাকেও তার সঙ্গে তালুকদারের চাতালে নিয়ে যাবে। দু’জন মিলে কাজ করলে কিছু বাড়তি টাকা আসবে হাতে। কিন্তু ম্যানেজারের নজর খারাপ। তার শকুনদৃষ্টি থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে পারবে তো? মেয়ে তার বাড়ন্ত। প্রতিদিনই শরীরে যেন একটু একটু করে কৈশোরের কাঁচা সোনার প্রলেপ পড়ছে। মেয়ে তার বালিকা থেকে কিশোরী হয়ে উঠছে। এই মেয়েকে ম্যানেজারের লেলিহান জিহ্বা থেকে রক্ষা করা জমেলার কম্ম নয়। সে কী করবে এখন? ছেলে দুটো একেবারেই গ্যাদা। নাবালক। তাদেরকে কোনো কাজেই লাগানো যাচ্ছে না। বড় দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না জমেলার।
ঠক ঠক ঠক!
শব্দ ওঠে জমেলার বাড়ির দরজায়। সন্ধ্যা উৎরে গেছে তখন। হারিকেন জ্বালিয়ে ঘরে গেছে জমেলা। জামি-হামি-জলি পড়তে বসেছে মাদুর পেতে। ঠকঠক শব্দের পর পরই আওয়াজ শুনতে পায় জমেলা, ‘ভাবি, ও ভাবি। বায়িৎ আছিন?’
দরজা খুলে বাইরে এসে জমেলা দেখতে পায়, উঠানে দাঁড়িয়ে আছে মুন্সী পাড়ার আলতাব মুন্সী। ‘ওমা! এডা যে আলতাব ভাই! আসিন ভাই আসিন। ঘরৎ আসিন। বসিন।’
বারান্দায় একটা কাঠের টুল ছিল। সেখানেই বসতে বসতে আলতাব মুন্সী বলে, ‘বসমো না ভাবি বসমো না। ম্যালা কাম। বাজারৎ যাচ্চি। কুন্ডু বাবুর আড়তৎ বলে ট্রাক আস্যা লাগিছে। ধানের বস্তা লোড করা লাগবে। এই আতের বেলা এগলা কাম করতে ক্যাঙ্কা লাগে কও? মিচ্চি অ্যানা পর এশার আজান দিবে, এখন হামাক যাওয়া লাগিচ্চে কামৎ। শালার একটা জীবন হলো এডা?’
জমেলা কী বলবে ভেবে পায় না। এই আলতাব মুন্সীর সঙ্গেই বজারে কুন্ডু ব্যাপারীর ধানের আড়তে কুলির কাজ করত জমেলার স্বামী একরাম। দুজনের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। মাঝে মাঝে জমেলাদের বাড়িতে আসত সে। শেষবার এসেছিল একরামের মৃত্যুর দিনে। তারপর এলো আজ। কী মনে করে, কে জানে! জমেলা কিছুই আন্দাজ করতে পারে না। সে আমতা আমতা করে পূর্ববৎ কথার রেশ ধরে বলে, ‘কি করবিন ভাই! গরীব মানষের জীবনডাই তো ইঙ্কা!’
আলতাব মুন্সী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর মন্থর গলায় বলে, ‘শুননো তোমাকেরে দুডা গরুই বলে চুরি হয়্যা গেছে! আহারে, এই গরীব মানুষডার এতো বড় ক্ষতি মানষে ক্যাংকা কর্যা করলো? মানষের কি অ্যানাও বিবেক নাই? ছোট ছোট ছোলপোল লিয়া তুমি তো অথই দরিয়াত পড়লিন, ভাবি!’ তারপর আরো একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলতাব মুন্সী বলে, ‘আল্লা যা করে ভালোর জন্যিই নাকি করে ভাবি। তুমি দুক্কু করিন না।’ আলতাব মুন্সীর দীর্ঘশ্বাসে হারিকেনের আলো কেঁপে ওঠে। কম্পমান সে আলোয় দেখা যায়, জমেলার অশ্রুভারাক্রান্ত মুখ। দাঁত দিয়ে আঁচল কামড়ে ধরে কান্নার বেগ সামলায় সে। এই দৃশ্য খানিক হতবিহ্বল করে দেয় আলতাব মুন্সীকে। তিরিশও স্পর্শ করেনি জমেলার বয়স। এরমধ্যেই তিন সন্তানের মা হয়ে বৈধব্য বরণ করেছে সে। শরীর ভরা যৌবন থইথই করছে জমেলার। সামনে পড়ে আছে জীবনের লম্বা এক পথ। এমন সর্বপ্লাবী যৌবন নিয়ে কী করে পাড়ি দেবে সেই পথ? মেয়েটাও ধাঁই ধাঁই করে বড় হচ্ছে। চেহারাও হয়েছে মায়ের মতোই! এখন দুজনকে দেখলে মনে হয় দুই বোন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সামনে আরও দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে জমেলার জন্য।
জমেলার আঁচলচাপা মুখের দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনার বাক্য ছোড়ে আলতাব। ‘কান্দিন না ভাবি, কান্দিন না। ক্যান্দা আর কি হবে! শক্ত হও। ছোলপোলগুলা মানুষ করা লাগবে না?’ তারপর মনে মনে একটু বিব্রতই হয়। যা বলতে এসেছিল আলতাব মুন্সী তা বলতে পারেন না। জমেলার চোখের অশ্রু এবং অদূরবর্তী ভবিষ্যৎ জীবনের দুর্ভোগের চিত্র কল্পনা করে তার মন বড় আর্দ্র হয়ে ওঠে। সে শুধু বলে, ‘একটা কতা কবার চাছনু, ভাবি। কিন্তু তুমি যে বিপদের মদ্দে আছিন, খুবই বেতালা দিন যাচ্চে তোমার, এই অবস্তায় ক্যাংকা কর্যা কই!’
‘কী কতা কবার চাচ্চিন, কন ভাই! কোনো সুমিস্যা নাই। হামি ঠিক আছি। কন।’
‘না থাক। আজগা লয়। আরেক দিন কমোহিনি।’
টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আলতাব মুন্সী। তারপর মাথা নিচু করে ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় সদর দরজা দিয়ে। পেছনে পেছনে ব্যাকুল পায়ে এগিয়ে আসে জমেলা। ‘আলতাব ভাই, ও আলতাব ভাই! কী কবার চাচ্চিন কয়্যা যাও।’ আলতাব মুন্সী পেছন ফিরে তাকায় না আর। জমেলার আকুতিতে কর্ণপাত করে না সে। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যায় সে বাজারগামী রাস্তার দিকে। অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া আলতাব মুন্সীর পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জমেলা ভাবতে থাকে, কী বলতে এসেছিল আলতাব মুন্সী? কেনই বা না বলে চলে গেল? ম্যানেজারের মতো তারও কী নজর পড়েছে জমেলার শরীরের দিকে? নাকি জলির কচি শরীরের দিকে নজর পড়ল তার? নাকি মৃত একরামের কোনো বিষয় বলতে এসেছিল সে? একরাশ এলোমেলো ভাবনা তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।
সকালে তালুকদারের চাতালে গিয়ে অবশ্য সারারাত্রির নিদ্রাহীনতার ক্লান্তি দূর হয়ে যায় জমেলার। চাতালের বারান্দায় পা রাখতেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে মিরাজের। মিরাজ চোখের ইশারায় আড়ালে যেতে বলে জমেলাকে; কারণ পাশেই ছিল মোজাম্মেলের মা। চাল ঝাড়ার কাজ ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে সে। জমেলা কোমরে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে কুলা নিয়ে বসে পড়ে মোজাম্মেলের মায়ের পাশে। চাল ঝাড়তে শুরু করে সে-ও। তারপর আরেকবার মিরাজের সঙ্গে চোখাচোখি হলে সে পুণরায় জমেলাকে আড়ালে যাওয়ার ইশারা করে চাতালঘর থেকে বেরিয়ে যায়। জমেলা এই ইশারার অর্থ অনুধাবন করতে পারে না। সে নানা কিছু ভাবতে ভাবতে চাল ঝাড়তে থাকে। তারপর দুই কুলা চাল ঝাড়ার পর সে মোজাম্মেলের মায়ের উদ্দেশে বলে, ‘প্যাট ক্যাম্বা মোচড় দিচ্চে বু, অ্যানা পায়খানাৎ থাক্যা ঘুর্যা আসি।’
চাতালের পেছনে খোকশা গাছের আড়ালে মিরাজের মুখোমুখি হয় জমেলা। ‘ইশারায় শিস্ দিয়া হামাক তুই ডাকিস না…’ ঢলঢল কণ্ঠে গান গাইতে গাইতে খিলখিল করে হেসে ওঠে সে। মিরাজের চোখেমুখে হঠাৎ এক ধরনের লজ্জার আভা ফুটে ওঠে কেন জানি। জমেলা গান থামিয়ে বলে, ‘কাম ফেলা থুয়্যা আসিছি। কী কবু তাড়াতাড়ি ক।’ মিরাজ কিছু বলে না। সে লুঙ্গির ট্যাঁক থেকে একটা কাগজের ঠোঙা বের করে জমেলার হাতে ধরিয়ে দেয়। তখন তার তামাটে মুখ আরও রক্তাভ হয়ে ওঠে। এ কি লজ্জার দরুণ? কে জানে!
ঠোঙা খুলে বিস্মিত হয় জমেলা— ‘সন্দেশ! ছানার সন্দেশ কুটি পালু তুই?’
‘কালকা গোপের হাটৎ গেইছিনু বাহে। সন্দেশ দেইখে মনে পড়ল, তুই একদিন কইছুলু, সন্দেশ পছন্দ করিস, তাই এ্যালা লিয়া আইনু।’
খুশিতে, আনন্দে কিংবা অন্য কোনো এক নাম না জানা অনুভূতির আলোয় চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে জমেলার। জমেলা সন্দেশে কামড় দিতে দিতে ঢঙ গলেপড়া গলায় বলে, ‘এ্যাই ছোড়া! তুই কি হামার প্রেমে পড়িছু নাকি রে?’
মিরাজ যেন সদ্য গোঁফ গজানো কিশোর। লজ্জায় আরও রক্তিম হয়ে বলে, ‘আরে ধুর! কি যে কবার নাগছেন!’
— ‘ক্যা? হামার কি চিহারা ভাল্ লয়? হামি কি বুড়ি হয়্যা গেছি?’
— ‘না বাহে, তা লয়। তোমার বয়স তো এ্যালা তিরিশও হয়নি। এখনই ক্যান বুড়ি হইবেন! তোমাক তো নায়িকা রুজিনার লাকান লাগে!’
— ‘সত্যি কচ্চু? হামাক রুজিনার মতো লাগে?’
— ‘মুই কী কোনোদিন মিছা কতা কছি তোর সাথে? তুই এ্যালা এখনো মোক চিনিবার পারলু লয়!’ একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে পড়ে মিরাজের গলা থেকে।
মানুষকে চেনা কী এতই সোজা? জমেলা মনে মনে ভাবে, নিজের মায়ের পেটের আপন ভাই, ছোটকালে কত আদর করত জমেলাকে, হাট থেকে সন্দেশ-বাতাশা এনে খাওয়াতো, সেই ভাই এখন ভুলকি দিয়াও তাকায় না। এই যে দুই দুইটা গাই-গরু চুরি হয়ে গেল জমেলার, একটাবার খবরও নিলো না তার ভাইয়েরা। হাহ! একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জমেলা। আর এ তো কোথাকার কোন মহিমাগঞ্জের মিরাজ। কী আছে মনে কে জানে! তাকে সে চিনবে কী করে?
জমেলা কাগজের ঠোঙাটা শাড়ির আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘ম্যালাক্ষণ হলো আসিছি। মোজাম্মেলের মাও আবার ঢুঁরবা আসপে। হামি যাই।’
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জমেলার প্রস্থান দেখে মিরাজ। কী সুন্দর কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটে জমেলা। তার হাঁটার তালে তালে ঘাড়ের নিচে ঝুলে থাকা চুলের খোঁপা সরে যায় ডানে ও বাঁয়ে। তখন ঘাড়ের নিচের মসৃন পিঠ নজর কাড়ে মিরাজের। মিরাজ ভেবে পায় না, সমস্ত রূপের ডালি উজার করে কেন জমেলাকেই ঢেলে দিলো খোদা?
(চলবে)