
দিনের পর দিন ॥ কিস্তি- ২
ওদিকে ‘হাম্বাআআআ’ বলে আওয়াজ ছাড়ে ধলি আর লালি। জমেলার মনে পড়ে যায়, গরু দুটোকেও খাবার দেয়া হয়নি। গোয়ালঘরে তোলার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ‘জলি… ও জলি, গরুর চারির মদ্যে অ্যানা ভূষি দে তো মা।’ হাঁসগুলোকে খোঁয়ারে তুলতে তুলতে হাঁক ছাড়ে জমেলা খাতুন।
হারিকেনে চিমনি লাগিয়ে ঘরে যায় জলি। প্লাস্টিকের গামলায় করে কয়েক মুঠো ভূষি নিয়ে গিয়ে গরুর চারিতে ঢেলে দেয়। জমেলা খাতুন হাঁস-মুরগিকে খোঁয়ারে ঢুকিয়ে দিয়ে ফিরে আসে গরুর কাছে। খড়, ভূষি, পানি একসঙ্গে মিশিয়ে গরু দুটোকে খাওয়াতে খাওয়াতে ফের গলা ছাড়ে, ‘জমিদার দুডা একনো বাড়িৎ আসেনি লয়? জলি… ও মা জলি…। পান্টি দিয়া পিটতে পিটতে দুডাক ধর্যা লিয়া আয় তো মা।’
জমিদার বলতে জামিল আর হামিদকেই ইঙ্গিত করছে মা। জলি জানে, তার ভাই দুটো সেই দুপুরের পর খেলতে বেরিয়েছে। অঘ্রাণের ফসলশূন্য মাঠে ধান গাছের নাড়া কেটে মাটিকে সমান করে ক্রিকেট খেলার পিচ বানিয়েছে ছেলেরা। সেখানেই খেলতে গেছে দুজন। কিন্তু সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে প্রায়। এতক্ষণ কীসের খেলা? জলি সত্যি সত্যি একটা কাঁচা কঞ্চি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। দিনের আলো নিভু নিভু এই সময়ে রিক্ত ফসলের জমির আইল ধরে হেঁটে যায় এক কিশোরী, তার দুই কাঁধের উপর দুলতে থাকে লাল ফিতেই বাঁধা চুলের বেণী। অঘ্রাণের এমন সময়ে কুয়াশার পাতলা ঝালর নামে আকাশ থেকে। সেই ঝালরের ভিতর দিয়ে আবছা আবছা দেখা যায়, গোলাপী ফ্রকপড়া জলিবু হাতে কাঁচা কঞ্চি ঘুরাতে ঘুরাতে এগিয়ে আসছে।
এমন দৃশ্য দেখার পরও কি মাঠে তিষ্টা যায়? উল্টোপথে ভোঁ দৌড় দেয় জামি-হামি দুই ভাই। একজনের বয়স সাড়ে ছয়, আরেকজনের পাঁচ।
রাতের খাবার খেয়ে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে জমেলা খাতুন। কিন্তু শয়ন মানেই তো নিদ্রা নয়। সে হঠাৎ টের পায় তার পিঠের নিচে যেন রাশি রাশি শর বিছানো। শরশয্যায় শুয়ে শুয়ে জমেলার মনে পড়ে ছোটবেলার এক ঘটনা। তাদের বাড়ির পাশের বড় নয়নজুলিতে পড়ে গিয়েছিল সে। সাঁতার না জানা ছোট্ট এক মেয়ে। হাবুডুবু খেতে খেতে পেট ভরে উঠছিল পানিতে। আর ক্রমেই তালিয়ে যাচ্ছিল মাটির দিকে। হাত উঁচিয়ে, পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে কেবলই চেষ্টা করছিল একটুখানি শ্বাস নেবার। চোখ মেলে শেষবারের মতো কাকে যেন দেখতে চেয়েছিল। বাবাকে? মাকে? নাকি হাঁসের ছানা দুটোকে? খইরঙা দুটো হাঁসের ছানা খুব প্রিয় ছিল তার। সেসব কিছুই দেখতে পায়নি সে। জলের অতলে পাথরের টুকরোর মতো ডুবে যেতে যেতে দেখেছিল শুধুই আলোর বুদবুদ। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ— হরেক রঙের আলো। বলা বাহুল্য, সে যাত্রায় মরেনি জমেলা। কেউ একজন চিলের মতো ছোঁ মেরে পানির ভিতর থেকে উদ্ধার করেছিল তাকে। আজ হঠাৎ নিজেকে ওই ডুবে যাওয়া শিশুর মতো মনে হচ্ছে তার। বিশাল এক নয়নজুলির মাঝখানে ডুবে যাচ্ছে সে। ডুবে যাচ্ছে।
সকালে আবার খোনকার বাড়ির দিকে পা বাড়ায় জমেলা। ধান কাটা শুরু হয়েছে যখন, অন্তত সপ্তাহখানেক কাজের অভাব হবে না খোনকার বাড়িতে, এই আশাতেই সে আশরাফ খোনকারের বউয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বড় বউ খুশি হয় জমেলাকে দেখে। ‘তুমি আসিছিন, ভালোই হলো চাচি। ধান ঝাড়া লাগবে, খ্যাড় মলম দেওয়া লাগবে, চৌদ্দজন মানুষ ধান কাটিচ্ছে, তারকেরে জন্যি ভাত আন্দা লাগবে। ম্যালা কাম। ল্যাও চাচি, তাড়াতাড়ি হাত লাগাও।’
এভাবে মাসখানেক, অর্থাৎ ধান কাটার মৌসুমটা খোন্দকার বাড়িতে কাজ করে কাটিয়ে দিলো জমেলা খাতুন। কিন্তু তারপর? এর-ওর বাড়িতে ধর্না দিলো কাজের জন্য। কেউ মুখ তুলে চাইলো না। বিমর্ষ জমেলা একদিন বারান্দায় বসেছিল পা এলিয়ে। কী করা যায়, ভেবে কোনো কূল পায় না সে। তার বাপ-মা দুজনেই দুনিয়া ছেড়েছে। আছে তিন ভাই বটে, তারা নিজেদের সংসার নিয়েই বড় পেরেশান। তাছাড়া দিনের পর দিন তো আর ভাইদের সংসারে গিয়ে থাকা যায় না। জমেলা ঠিক টের পায়, সে এখন আর নয়নজুলিতে পড়ে যাওয়া ছোট্ট জমেলা নয়, সে এবার পড়েছে কূল নাই কিনার নাই এক অথই দরিয়ার মাঝে। এবং যথারীতি সাঁতার জানে না।
তার ভাবনায় ছেদ পড়ে মোজাম্মেলের মায়ের ডাকে। ‘জামিলের মাও… ও জামিলের মাও। বাইৎ আছু?’
জমেলা খাতুন চমকে উঠে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে উত্তর পাড়ার মোজাম্মেলের মা ঢুকছে বাড়িতে। মোজাম্মেলের মায়ের আর কোনো নাম আছে কি না কেউ জানে না। গ্রামসুদ্ধ লোক, ছেলেবুড়ো সবাই তাকে ডাকে মোজাম্মেলের মা বলে। মোজাম্মেলকেও দেখেনি অনেকেই। জন্মের চার দিনের মাথাতেই নাকি মরে যায় সে। সেই মোজাম্মেলের মা জমেলার কাছে বসতে বসতে বলে, ‘তালুকদারের চাতালৎ কাম করবু? খুব একটা খাটনির কাম লয়। খালি বস্তাকে বস্তা চাউল ঝাড়া লাগবে। দিনে পঞ্চাশ ট্যাকা কর্যা পাবু। কম কী? ছোলপল লিয়্যা তাও খায়্যা বাঁচপা পারবু।’ তারপর জমেলার কানের কছে মুখ এনে কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে, ‘চাউলও চুরি করবার পারবু!’
চাউল চুরি করতে পারবে সেই লোভে নয়, বরং বেঁচে থাকার দায় মেটাতেই তালুকদারের চাতালে কাজ করতে রাজি হয়ে যায় জমেলা। জলি, জামিল, হামিদ—তিনটি সোনামুখ ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে। চাতালটা গ্রাম থেকে একটু দূরে, আধ মাইলটাক হবে। এই পথটুকু হেঁটে যেতে যেতে, কীভাবে কাজ করতে হবে সে বিষয়ে জমেলাকে নানা পরামর্শ দেয় মোজাম্মেলের মা। শেষে বলে, ‘খালি অ্যানা ম্যানেজারের সাথে তাল দিয়া চলবু। তালে দেখপু আর কোনো সুমিস্যাই হচ্চে না।’
মোজাম্মেলের মায়ের পরামর্শমতো নতুন কর্মজীবন শুরু করে জমেলা। একটু একটু ভাব জমে ওঠে চাতাল ম্যানেজার লিয়াকতের সঙ্গে। লিয়াকত চল্লিশোর্ধ। নাকের তলায় পুরো গোঁফ। সুন্দর করে ছাঁটা। গালে দাড়ি নেই। সুন্দর করে কামানো। শ্যামবর্ণ গাট্টাগোট্টা লিয়াকতকে চাতালের লেবারেরা আড়ালে বলে ‘লায়ক জসিম’! জসিম তখন বাংলা সিনেমার সুপারহিরো। শুক্রবার বিকেলে কাজ ফেলে সবাই সিনেমা দেখে। সেই সিনেমার নায়ক জসিমের সঙ্গে লিয়াকতের চেহারা-সুরতের মিল খুঁজে পায় তারা।
জমেলা এসব মিলটিল খুঁজে পায় না অবশ্য। তার কাছে মহিমাগঞ্জ থেকে কাজ করতে আসা লেবার মিরাজকেই বেশি ভালো লাগে। ‘কি সোন্দর ধলা! উঁচা, লম্বা!’ তবে জমেলা সেয়ানা আছে। সে ম্যানেজারকেই তোয়াজ করে চলে। তাতে তার কাজের চাপ কমে। ফাঁক-ফোকর পেলে ধানের গুঁড়া চুরি করে বিক্রি করতে পারে। ম্যানেজার টের পেলেও কিছু বলে না।
কিন্তু এভাবে চুরি-চামারি করে আর পঞ্চাশ টাকার উপার্জন দিয়ে কতদিন? জলির বয়স দশে পড়েছে। মেয়ে তো কলা গাছের মতো ধাঙ্গর হয়ে উঠছে। জামি-হামিও বড় হচ্ছে। খোরাকি বাড়ছে। ইশকুলে যাচ্ছে তিনজনই। ইশকুলে যদিও বেতন-টেতন লাগে না, কিন্তু খাতা-কলম কেনার খরচ তো আছে! আবার নয়নজুলি দশা অনুভব করে জমেলা। চারপাশে থইথই পানি, সে ডুবে যাচ্ছে। কেবলই ডুবে যাচ্ছে।
এ রকম এক ডুবন্ত দিনে জমেলাকে পুরোপুরি তলিয়ে দিতে এক ভোর আসে সাক্ষাৎ আল্লার গজব হয়ে। সেদিন সোমবার। ঘড়িতে ফজরের ওয়াক্ত। খানিক আগে আযান হেঁকেছে চান্দের বাপ। হেমন্তের হিম হিম ভোর। কুয়াশার ঝালর সরিয়ে ফর্সা হচ্ছে প্রকৃতি। রোজকার মতো ঘুমন্ত ছেলেমেয়েদের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায় জমেলা। গোয়াল ঘর থেকে ধলি-লালিকে বের করতে হবে। হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়টা খুলে দিতে হবে। এগুলোই তার নিদানের সম্বল। মানুষটা মরে যাওয়ার আগে জমেলার ঘরে নগদ কিছুই রেখে যায়নি, এ দুটো গাই গরু আর চার পাঁচটা হাঁস-মুরগি ছাড়া। জমেলা তাই এগুলো আগলে আগলে রাখে। যত্ন করে খাবার-দাবার দেয়।
নিজের শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে গোয়ালঘরের দিকে যায় জমেলা। গোয়াল ঘরটা উঠানের অপর প্রান্তে। দশ কদমের হাঁটা পথ। ঘুমজড়ানো টলমল শরীর নিয়ে থপথপ করে হাঁটে জমেলা। চোখ থেকে ঘুম যায়নি তখনো। কিন্তু গোয়ালঘরের সামনে এসে এক লহমায় ঘুম ছুটে যায় তার চোখ থেকে। গোয়ালঘরের দরজা ভাঙা! ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে ধলি-লালি নেই! খাঁ খাঁ গোয়ালঘর পড়ে আছে শূন্য! মুহূর্তে জমেলার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যায়। মাথাটাও শূন্য হয়ে যায়। সে আর কিছু ভাবতে পারে না। তার চোখের সামনে সমগ্র দুনিয়া চরকির মতো চক্কর দিয়ে ঘুরতে থাকে। সে গোয়ালঘরের মেঝেতেই ধপ করে বসে পড়ে।
একি সর্বনাশ হলো তার! একি গজব নাযিল হলো ভোরবেলা! দরজা ভেঙে গরু দুটো চুরি করে নিয়ে গেল, তবু কিছুই টের পেল না সে! কোনো শব্দ শুনতে পেল না? গরু দুটোও কোনো চিৎকার করলো না? নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল চোরের হাত ধরে? এত আদর-যত্ন করে খৈল-ভূষি খাওয়ানোর এই প্রতিদান?
ডুকরে কেঁদে ওঠে জমেলা।
(চলবে)