
দাদন
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি সংসারটাকে ম্যাড়া গাছের পাতার মতোই অসংখ্য ছিদ্র করে দিচ্ছে। বশির ছিদ্র ভরাটের নিরন্তর চেষ্টায় রত থেকেও সংসার গোছাতে পারছে না। একদিক ভরাট করতে গিয়ে অন্যদিকের ছিদ্র অভদ্র রকমের উলঙ্গতা প্রকাশ করছে। সে উলঙ্গতায় মনের স্বস্তি ও সম্ভ্রমসহ সবই হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে, জলে ডোবা মানুষের মতোই হাবুডুবু খেতে খেতে তলিয়ে যাচ্ছে সে।
তলিয়ে যাওয়া ঠেকাতে প্রাত্যহিক কিছু সৌখিনতা ঝেড়ে ফেলতে হচ্ছে বশিরকে। সকাল-বিকাল আয়েশি নাস্তা, কফি, পরোটা, খাসির মাংস, দেশি মুরগি, রেস্টুরেন্ট খাবার এসব এখন অপ্রয়োজনীয় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে মনের রসনাহীন ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। চা-মুড়ি, সবজি-ডালসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যে লাগাম দিয়ে রসনাকে নিয়ন্ত্রিত করে খুঁটি পুঁতে দিয়েছে।
এভাবেই বেপরোয়া মূল্যবৃদ্ধির খড়গ স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনকে কঠিন দীক্ষায় সমর্পিত করেছে। বশিরের মনটা দমে গিয়েছে। শান্তির কপোত মন থেকে নির্বাসিত। জীবন তাকে যেন এক কঠিন যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়েছে।
ছুটির দিনে সাপ্তাহিক বাজার করে বশির। আজ বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় কয়েকটি জিনিস কিনতেই বাজেট ফুরিয়ে গেল। আরো অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেল। মেজাজ খুব খারাপ হলো তার। দেখা হলো প্রতিবেশি রফিকের সাথে। তাকে দেখে রফিক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন-
: বশির ভাই যে, কেমন আছেন?
: এই তো ভালোই। আপনি কেমন আছেন?
: আছি কোনরকম। দেখলেন তো কেমন যুদ্ধ বেঁধে গেলো? আমার তো মনে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই হতে যাচ্ছে।
: যুদ্ধ,… ও রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ? হ্যাঁ ভাই যুদ্ধ তো কবেই শুরু হলো। আর আমরা তো যুদ্ধের ময়দানেই আছি।
: এটা কী বলেন বশির ভাই। আমরা তো এখনো কোন দেশকেই সাপোর্ট করছি না। যুদ্ধের ময়দানে গেলাম কী করে?
: সাপোর্টার হই বা না হই, তাতে কী। যুদ্ধ তো করছি। গতকাল দেখলাম খবরে, রাশিয়া গম দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তেলের দামসহ সব জিনিসের দাম তো হুহু করে বাড়ছে। কিনতে পারছি কই? সব আকাশে ওঠে যাচ্ছে। এরচে বড় যুদ্ধ আর কী হবে ভাই? গত সপ্তাহে দুকেজি আটা কিনেছি পয়ঁষট্টি টাকায় আর আজ কিনলাম নব্বই।
: তা ভাই ঠিকই বলেছেন, দাম বাড়ছে। আতঙ্কে আছি, শ্রীলঙ্কার মতো দুর্দশা হবে কিনা।
: জানি না ভাই, কী হবে। আজ কোনরকমে চালাচ্ছি। কাল কী হবে জানি না।
বশির আর কথা না বাড়িয়ে বিদায় নেয়। বাড়ি ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। আজ ঝুনুদের আসার কথা। পুষ্প অপেক্ষায় থাকবে। বাজার সেরে বাড়ির পথে পা বাড়ায় বশির।
পুষ্প রান্না করতে করতে অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বসে।
: জানো তো আজ ঝুনুরা আসবে। বাজার থেকে ভালো কিছুই তো আনোনি। কী খাওয়াবো ওদের?
: যা আছে, তা দিয়েই খাবে। আমাদের অবস্থা যেমন তেমনই খাবে।
: ওরা কী আর এসবে খেতে পারবে? কতো ভালো অবস্থা ওদের। আমাকে তুমি খুব ঝামেলায় ফেলে দিলে।
: ঝামেলায় আমি ফেলিনি, ওরা ফেলেছে আমাদের।
: এসব কী বলছো তুমি? ওরা ফেলেছে মানে?
: সে তুমি বুঝবে না।
বশির জানে পুষ্প অসন্তোষ প্রকাশ করবে। কিন্তু উপায় নেই। বাড়ি ভাড়া, দু সন্তানের টিউশন ফি, মায়ের ঔষধ ছাড়াও অনেক প্রয়োজনীয় খরচ তাকে সামলাতে হয়। কষ্ট করে চলবে কিন্তু কারো কাছে হাত পাততে সে পারবে না কখনো। আত্মসম্মানের ঝাঁঝটা তার বরাবরই তীব্র।
ঝুনুরা এলো দুপুরে। সঙ্গে করে নিয়ে এলো পাঁচ লিটার তেলের বোতল।
বশির দেখে বিরক্ত হলো।
:শ্যালিকা, এই দুর্মূল্যের বাজারে তেল পেলে কোথায়? আমি তো কাল বাজার ঘুরে ঘুরে কোথাও তেল পাইনি।
: তেলের খবর তো আমি জানি না দুলাভাই, কবির জানে। আপনি ওকে জিজ্ঞেস করেন।
বশির খবর জেনেছে যে, কবির তেল কোম্পানিকে দাদন দিয়ে তেল মজুদ করে। আর এভাবেই বাজারে সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা লুটছে।
বশির কবিরের পাশে বসে।
: কি ভায়রা, কেমন আছো?
কবির বশিরকে দেখে খুব সম্ভ্রমের সাথে সালাম করে, হাত মিলায়। তারপর বলে,
: জি দুলাভাই, খুব ভালো আছি।
: ভালো তো থাকবে জানি। তো এই তেল কেন নিয়ে এসেছো? আমার তো তেল লাগে না। তেল ছাড়াই চলে।
:কী যে বলেন দুলাভাই, এ সামান্য তেল। আপনার জন্যে নিয়ে এলাম।
: শুনেছি ইংরেজ আমলে ইংরেজরা দাদন দিয়ে এদেশের চাষীদের নীল চাষ করাতো। ইংরেজরা চলে গেছে আজ প্রায় প্লাটিনাম জুবলি (৭৫ বছর) হতে চললো কিন্তু তাদের এই পুরোনো নির্যাতনের কৌশলের ভুত এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এদেশে। কী বলো কবির?
: দুলাভাই কী বলেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।
: বুঝতে কি সত্যিই পারছো না? আচ্ছা ভেবে দেখো ইংরেজরা ছিল বিদেশি। এদেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট ওরা বুঝতে না ই পারে কিন্তু তোমরা তো ইংরেজদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। নিজের ভাইয়ের সর্বনাশ তোমরা নিজরাই করছো। বেঈমানি করছো। অর্থলোভে নিজের ভাইয়ের কবর নিজরাই খুঁড়ছো।
বশিরের নির্ভেজাল অপ্রিয় সত্য শুনতে একদমই প্রস্তুত ছিলো না কবির। এভাবে আক্রমণের কোপানলে পড়ে নিজেকে আর স্থির রাখতে না পেরে ওঠে রান্না ঘরে যায় ঝুনুর খোঁজে। ঝুনুকে বাড়ি যাওয়ার তাড়া দেয়।
বশির বলে যে না খেয়ে কোনভাবেই যেতে পারবে না।
কবিরের দুর্বল নতজানু ভীত মন সে আদেশ উপেক্ষা করতে পারে না। খাবার খেয়ে ওরা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে বশির বলে,
: কবির, তেলের বোতলটা নিয়ে যাও। এটা আমি রাখতে পারবো না। যদি পারো ন্যায্য দামে কোনো দোকানে বিক্রি করে দিও।
কবির বশিরের কথাকে অগ্রাহ্য না করে তেলের বোতল নিয়ে বেরিয়ে যায়।
কবিরের প্রতি বশিরের ব্যবহার পুষ্পকে আহত করে। বশির তা প্রশ্রয় দেয় না।
আজ বশিরের মনে এক ধরণের প্রশান্তির হাওয়া বিরাজ করে। হোক আত্মীয় তাতে কী… একজন দুর্নীতি পরায়ণ কালোবাজারি দেশের শত্রুকে সে বর্জন করে উপযুক্ত কথা শুনাতে পেরেছে। আর এভাবেই যদি উপড়ে ফেলা যেতো সব আগাছাগুলোকে, তাহলে নিজের মাটিতে নিজের মতো করে বাঁচা যেত। প্রাণভরে শ্বাস নেয়া যেত।