
থৈ থৈ জোছনা কিংবা অথৈ অমাবশ্যার করোটি-চিত্র
প্রতিকথা’র এবারের আয়োজন এই সময়ের ১০ জন কথাসাহিত্যিকের গল্পভাবনা। কেন তাঁরা গল্প লেখেন, গল্প লিখে আসলে কী হয়, গল্প কেমন হওয়া উচিত, বাংলা গল্প কতদূর অগ্রসর হল, গল্প নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি, এমন নানা বিষয় নিয়ে ব্যাক্ত করেছেন প্রত্যেকে তাঁদের নিজস্ব ভাবনা। গল্পভাবনার সঙ্গে রয়েছে একটি করে গল্প।
পড়ুন সাগর রহমানের গল্পভাবনা ও গল্প।
‘আমি, এবং এক চিলতে কমলা আলো, এক শেষ বিকেলে, হুড়মুড় খেয়ে পড়ে গেলাম নীলু নামক এক কিশোরীর রাঙা গালে। আলোটি ছিল লম্পট চরিত্রের। কিয়ৎক্ষণ পরে হাত-পা ঝেড়ে দিব্যি উঠে চলে গেছে অন্য গালের দিকে। কিন্তু আমি আর উঠতে পারিনি। আজো পড়ে আছি সেই গোলাপী ওমের ভেতরে। অথচ…’—(গল্প: নীলুদের জন্য সচরাচর)
লাইন ক’টি লিখে, লিখা শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে, খুব মনে আছে, আমি প্রায় আঁতকে উঠেছিলাম। শব্দ এবং বাক্য এবং যতিচিহ্নের অবয়বে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আদুরে চেহারার এক কিশোরীকে, যার নাম নীলু, তার গাল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে কনে দেখা মায়াবী আলোক রশ্মি। অথচ, নীলু নামক কোনো কিশোরীকে আমি চিনি না, চিনতাম না কোনো জন্মেই, অন্তত প্রেমে পড়েনি কোনো নীলুর সাথেই। কিন্তু ঐ তো আমি, পড়ে আছি তার ঘেরাটোপে। আর শেষের ঐ ‘অথচ…’ তৈরি করেছে হাহাকারের সূচণা, বিরহ গাঁথার কোন প্রেক্ষাপট, যা আমি লাইনটি লিখার এক মুহূর্ত আগেও ভাবিনি। মাত্র কয়েকটা ছোট ছোট বাক্য। নীলু তৈরি হল। তৈরি হল তার সাথে অপার প্রেমের সম্ভাবনা। এবং, প্যারা শেষ হতে না হতে—তুমুল বিরহের পূর্বাভাসও।
এই যে এক মুহূর্ত আগেও কিচ্ছু ছিল না, অথচ মুহূর্ত পরে তৈরি হলো অপার জীবনের সম্ভাবনা—ফিকশানের এই শক্তিই মুগ্ধ করে রাখে আমাকে। এই নিদারুণ ম্যাজিকে বুঁদ হয়ে থাকি আমি—যখন লিখি, যখন পড়ি, এবং যখন লিখি না, কিংবা পড়ি না—তখনও। কতবার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে নিতাইয়ের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে উঠেছি, ’এই খেদ আমার মনে, ভালোবেসে মিটল না সাধ, কুলাল না এ জীবনে? হায়, জীবন এত ছোট কেনে?’ কার ছাঁচে কোন নিতাইকে গড়ে তুলেছিলেন তারাশংকর, তার গলায় কেন উঠে আসল আমার মনের খেদ, আমাদের সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাস? যখন আদমশুমারি হবে, যখন তৈরি করা হবে ভোটার তালিকা, তখন এই নিতাইকে কেউ গুনবে না, আইডি কার্ড তৈরি হবে না তার নামে। অথচ কী ভীষণ সত্যি করেই না সে আছে, যেই তারাশংকর লিখলেন, আর আমরা পড়ে উঠলাম কবি, সেই থেকে নিতাই নাম্নী একজন রক্তমাংসের স্বভাব-কবির আস্তানা গাঁড়া হয়ে গেছে এই পৃথিবীতে, যে কথায় কথায় গান বাঁধত, হাসত, খেলত, দুঃখ পেলে হু হু করে কাঁদত।
এই যখন আমি জীবনের তুমুল প্রয়োজনে এ ঘর থেকে ও ঘরে দৌড়াচ্ছি, ফর্দ মিলিয়ে সব্জি কিনছি, মাছের কানকো পরখ করতে করতে মানিব্যাগের ব্যালেন্স হিসেব কষছি, এবং রিকশার হুডের কোণায় পাঞ্জাবী ছিঁড়ে যাবার ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি-ঘুমুচ্ছি, সহজ আবেগে হাহাহিহি করছি, কাঁদছি, ঘাড়ের পেছনে চুলকাতে চুলকাতে অস্ফুট স্বরে বলে উঠছি, উফ, আর পারছি না… সেই আমি দিন শেষে খানিকটা ফুরসত পেতেই যেই খুলে বসছি ওয়ার্ড প্রসেসর, লিখছি: ’’আলাইয়ারপুরের লোকজনের কথায় যখন কোন কারণে হিঁদোল চোরের কথা উঠে আসে, তারা বলে, ‘আমগো হিঁদোল চুরা’…’’—(উপন্যাস: হিঁদোল চোরা)। বুঝতে পারছি যাপিত জীবনের সমান্তরালে এক লহমায় ঢুকে পড়েছি আরেক জীবনে, সে এলাকার নাম আলাইয়ারপুর, সেখানে হিঁদোল নাম্নী এক চোর থাকে…, এবং তারচেয়েও বড় কথা, এই একটু আগেও এ জনপদে বসে যাকে ফিকশান ভাবছিলাম, এখন দেখছি—সে জনপদের বাস্তবতায় আমার এই জনপদও তো নেহায়েত ফিকশনই!
তবে কি বলতে চাই যে, সাহিত্যের মোড়কে আসলে যা করছি, গল্প লিখার আড়ালে যার আয়োজন, তার অন্য নাম—পলায়নপরতা? এ বাস্তবতায় মন তিষ্টিয়ে গেলে মধুর পরশ চাইছি বানানো জনপদের জল-হাওয়ায়? এখানকার মানুষগুলোর সাথে না পেরে উঠে অন্তত সাময়িক সময়ের জন্য হলেও তৈরি করছি নিজ-হাতে-গড়া মানুষ, নাক-মুখ-চোখ টিপে টিপে তৈরি করছি তার কাঠামো, শরীরে প্রতিস্থাপিত করছি মন, মিস্তিরির কৌশলে তৈরি করছি তার মনের চরিত্র, এবং যখন ইচ্ছে যা ইচ্ছে—তাকে দিয়ে তাই ঘটাচ্ছি? ঘাড় বাঁকা করে, জোর গলায় আপত্তিকর ঐ ‘পলায়নপরতা’-টাতে আপত্তি জানানর আগে মোলায়েম কণ্ঠে জানান যেতেই পারে যে, শুধু শিল্প-সাহিত্য নয়, বরংচ তথাকথিত মৌলিক চাহিদাগুলো মিটে গেলে আর যা যা করে আমরা প্রত্যেকেই দিন কাটাই, তা আসলে কোন-না-কোন অর্থে পলায়নপরতাই! না হলে, যখন জানছি, আজ রাত্রে বিশ্বজুড়ে অন্তত আটশো মিলিয়ন লোক না খেতে পেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা চেপে ঘুমুতে যাবে, কী করে পারছি আমি চোব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়’তে হাত ডুবাতে, মুখ মজাতে! যখন জানছি, আমার বাসার পাশের কবরস্থানে মরে-পচে কংকাল হয়ে গেছে সহস্র মানুষ, প্রতিদিন যোগ দিচ্ছে সেই মিছিলে আরো অজস্র, কী করে পারছি জীবনের সহজ আবেগে কেঁপে উঠতে, সামান্য না-পাওয়া অথবা পাওয়ায় যথাক্রমে ক্ষেপে অথবা হেসে ওঠায়! এই সব হয়। জীবন প্রতিনিয়ত ‘ট্রিকস’ করছে আমাদেরকে, একেকজনের জন্য একেকরকম। এবং অজস্র পলায়নপথ তৈরি করে দিচ্ছে নিতিনিত্য। যদি হয় আমার জন্য যে ‘ট্রিকস’টি খেলছে জীবন, সেটির নাম— ‘গল্প-লেখা’, তবে তাই সই। বরংচ নিজেকে ভীষণ সৌভাগ্যবান ভাবছি আমি এই জীবন-কর্তৃক-নির্দিষ্ট প্রতারণায়!
কোন কিছু না পড়ে, এবং অন্তত কয়েক লাইনও না লিখে, আমি কাটাতে পারি না একটা দিনও—শুনতে কথাটি যেমনই শোনাক না কেন, আমার জন্য এটি যেন নিয়তি নির্দিষ্ট। যখন করছি না কোন শারিরিক পরিশ্রম, এবং ঘুমুচ্ছি না, তখন, আমার চোখ ও মনের একমাত্র আরাম অক্ষরে, শব্দে, যতিচিহ্নে। এবং অন্তত ব্যর্থ কয়েকটা লাইনও যদি না লিখা হয় প্রতিদিন, ঘুমের ঘোরেও ব্যর্থ একটি দিনের খতিয়ান আমাকে অস্থির করে রাখে। জন স্টেইন নামক এক ভদ্রলোকের সাথে সামান্য সখ্যতা ছিল আমার। জাতিতে আইরিশ। চিত্রশিল্পী। ওর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। ছবি আঁকতে বসার সময় ও ধোয়া, ইস্ত্রি করা জামাকাপড় পরে, রীতিমত ধোপদুরস্ত হয়ে বসত। কিন্তু যখন ছবি আঁকতো না, বাইরে কোথাও অন্য কোন কাজে যেত, ওর গায়ে পরা থাকত পেইন্ট ছিটকে লাগা, কাঁচা রঙের গন্ধমাখা কাপড়-চোপড়। বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য করার পর কৌতূহলের কাছে পরাজিত হয়ে ওকে বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞেস করে যে উত্তর পেলাম, তা হয়তো যে কোন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যই আপ্তবাক্য হতে পারে। ও আমাকে বলেছিল, আমি যখন আঁকার ইজেলের কাছে যাই, সেটা অভিসারে যাওয়ার মতো আমার কাছে, তখন সবচেয়ে সুন্দর হয়ে ওর কাছে যাই। আর যখন কাজ করি না, পারছি না করতে—তখন আমার কেমন হাঁসফাঁস লাগে, খুব বিষন্ন লাগতে থাকে নিজেকে, তাই রঙের গন্ধ কাপড়ে নিয়ে ঘুরি, মনে হতে থাকে, কাজের আশেপাশেই তো আছি!
ব্যর্থ লাইনের কথাটি কেবলি বলার জন্য বলিনি। আমার মতে, একটি ভালো লাইনের জন্য অসংখ্য ব্যর্থ লাইন লিখতে হয়। অন্তত আমাকে হয়। আমি যেহেতু মেধাবী বা জাত লেখক নই, ও ধারার কিছু আদতে আছে বলেও যখন আমি জানি না, তখন আমার একমাত্র ভরসা ঐ ব্যর্থ-বাক্য লিখে লিখে অপেক্ষাকৃত কম-ব্যর্থ বাক্য লিখার প্রাত্যহিক প্রচেষ্টায়। আমার প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আমাকেই তৈরি করতে হয়। প্রতিটি স্পেইসে এসে থমকাতে হয়, উপযুক্ত শব্দটির জন্য প্রায়শই হাতড়াতে হয় এগলি ওগলি। এবং তাতে আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত হই না, যখন দেখি মুরাকামির মতো লেখকও কী নির্দ্ধিধায় স্বীকার করেন: ‘নিড়ানি দিয়ে পাথর সরিয়ে, গভীর গর্ত খুঁড়ে আমাকে আমার সৃষ্টিশীলতার সন্ধান পেতে হয়। প্রতিবার যখন আমি নতুন উপন্যাস শুরু করি, প্রতিবারই নতুন গর্ত খুঁড়তে হয় আমাকে। কিন্তু, যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে এ কাজটি আমি করে চলেচি, এখন আমি শারিরীক ও প্রায়োগিকভাবে এ ধরনের গর্ত খুঁড়ে নতুন পানির শিরা সন্ধানে দক্ষ হয়ে পড়েচি। যখন আমি দেখি একটা উৎস শুকিয়ে এসেছে, আমি অন্য উৎস সন্ধান করি…”।
যারা কলম হাতে নেন, আর তরতর করে লিখে উঠেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা—তাদের আমি ইর্ষা করি, কিন্তু নিজে অমন সৌভাগ্য পেলে খুব খুশি হব বলে মনে হয় না। কারণ, লেখালেখির পুরো প্রক্রিয়াটি একটি যাদুকরী প্রক্রিয়া বলে মনে হয় আমার কাছে। এবং সেই যাদুটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি আমি, উপভোগ করতে চাই এই পূর্ণাঙ্গ প্রক্রিয়াটি।
আমার লেখা প্রতিটি গল্পই আমার নিজের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া একটি প্রচণ্ড ধাঁধাঁ। হয়তো কিছু একটা করছি, রাস্তায় হাঁটছি কি দাঁত মাজছি—হঠাৎ একটা লাইন বুব করে জন্ম নিল মাথায়। লাইন নয়, একটা দৃশ্য হয়তো। তাতে কোন একটি চরিত্র কিছু একটা বলছে, কিংবা করছে—যার আগ কিংবা পর কিছু নেই।
একবারের কথা বলি। বাসে বসেছিলাম। বসে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। হঠাৎ বাইরে কেমন শব্দ হতেই জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম। দেখার মতো তেমন কিছু ছিল না, রাস্তায় যেমন লোক চলাচল থাকে—সেরকমই। চোখ ঘুরিয়ে পত্রিকায় ফিরিয়ে আনতেই প্রায় স্পষ্ট দেখলাম, পাগলাটে একটা লোক, নাম দিনু, গ্রামের স্কুলমাঠে শতশত দর্শকদের ভীড়ে বসে খেলা দেখছে। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, দর্শক সারিতে ভোঁ দৌড় দিয়ে মাঠে নেমে গেল লোকটি, এবং গিয়ে রেফারির সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠল, ‘পেলেয়ার (প্লেয়ার) একজন কম ক্যান? ও রেফারি সাব, পেলেয়ার একজন কম ক্যান?’ কোথা থেকে জন্ম নিল এ দৃশ্য, চারপাশের কোন অণুঘটকটি উত্তেজিত করেছে আমার মস্তিষ্কের কোন অংশটিকে, যাতে কোন রকম ক্লু ছাড়াই তৈরি হলো এ ছবিটি—কোন ধারণাই পেলাম না আমি। ছবি সরে গেল বটে, চিন্তাটা কিন্তু ঢুকে গেল ভেতরে। সময়ে-অসময়ে দিনু পাগলার ব্যাকুল কণ্ঠটি শুনতে শুরু করলাম আমি। যেন আমিই সেই রেফারি, যার কাছে সে একজন প্লেয়ারের অনুপুস্থিতির কারণটি জানতে চাইছে? কী উত্তর দিব আমি ওকে! বুঝতে পারলাম, একটি গল্প জন্ম নিতে চাইছে ভিতরে। দিনের পর দিন এই অপার্থিব ধাঁধাঁটি জ্বালাতে শুরু করল। এবং একসময় তার ঝট ছাড়াতে শুরু হল একটি সূক্ষ্ম সুতোর বয়ন। শেষ পর্যন্ত তৈরি হল ছোটগল্প ‘দিনু পাগলা’।
গল্প কিংবা উপন্যাসের ‘তৈরি হওয়া’ শব্দটি খুব পছন্দের আমার। ‘তৈরি’র সাথে যেন কুমোরের মাটির ঢেলা দিয়ে মূর্তি গড়া, কিংবা ময়দা ছেনে হাত দিয়ে কচলে পিঠা বানানোর মতো সরাসরি স্পর্শের ব্যাপারটি উঠে আসে। গল্প তৈরি হওয়াটাও সেই একই বোধ দেয় আমাকে। গল্পটিকে আমি ছুঁতে চাই, গড়ে তুলতে চাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে, তার চরিত্রের সঙ্গে কথা বলতে চাই, এবং চাই উপভোগ করতে আমারি হাতে তৈরি হওয়া গল্পের চুড়ান্ত পরিণতি একজন নিষ্ক্রিয়, কিন্তু অপার কৌতূহলী দর্শকের মতো চেয়ে চেয়ে দেখতে। হঠাৎ ভাবলে ‘গল্প তৈরি হওয়া’র যে ধারণার কথাটি আলোচনা করলাম, সেটি যেন হোঁচট খায় পূর্বোক্ত বাক্যের শেষাংশের সাথে। কিন্তু আদতে তা নয় মোটেই। আমি বলিনি ‘গল্প তৈরি করা’র কথা। তৈরির পরে ঐ ‘হওয়া’ শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন লেখক হিসেবে আমি বড়জোর একটা চরিত্রকে টেনে নামাতে পারি কোন পংকে, কিন্তু সেই উদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে তার উত্তরণের পথ খোঁজার দায়িত্ব দিতে চাই সেই চরিত্রটিকেই। আমার ভূমিকাটি তখন গৌণ, আমি কেবলি দেখছি, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি চরিত্রটির কার্যকলাপ, এবং প্রয়োজনীয় ধারা বর্ণনাটি লিখে রাখছি। এ পংক থেকে উঠল তো, বড়জোর টোকা দিয়ে ফেলে দিতে পারি অন্য পংকে! ব্যস, এটুকুই। মাঝে মাঝে ঘটনার ‘ঘুঁটা’ দেয়া ভিন্ন গল্প লেখার পুরো প্রক্রিয়াটিই আমার কাছে গ্যালারিতে বসে থাকা দর্শক-সংবাদকর্মীর। কখনও কখনও খেলোয়াড়রা অফ-ফর্মে থাকেন, ভাল খেলেন না। একজন দর্শক হিসেবে আমি তখন হা পিত্যেশ করি, একটা উত্তেজক ফলাফলের জন্য মাথা কুঁটে মরি, খেলোয়াড়দের উৎসাহ যোগানোর জন্য গলা-ভাঙা চিৎকার করি, গালি-গালাজ করি। এবং প্রার্থনা, এবং ধৈর্য্য, এবং অপেক্ষা। কেননা, পরের পৃষ্ঠায় কী ঘটতে চলেছে, তা যদি আমি জেনে ফেলি আগেই, তবে আর ও পৃষ্ঠা পর্যন্ত লেখার দরকারই বা কী!
কোথা থেকে আসে এ চরিত্রগুলো? আমি না হয় টিপে টিপে অবয়ব দিলাম নিজের মতো করে, কিন্তু কাঁচামালটি কোথা থেকে এলো আমার কাছে? ‘কৃষ্ণপক্ষের দিনরাত্রি’র যে গোরখোদক কালামুন্সী, তার সাথে আমার কোথাও দেখা হয়েছিল? —মাঝে মাঝে এ প্রশ্নগুলোকে নিজের ভেতরে পোনা মাছের ঝাঁকের মতো সাঁতরে চলতে দেখি, এই বুব্ করে জেগে উঠে, তো, নাই হয়ে যায় সহসা। ব্যাপারটা আমার কাছে ‘হাঁসজারু’ হয়ে যাওয়ার মতো মনে হয় কখনো কখনো। প্রতিদিন যে অসংখ্য মানুষগুলোকে দেখি প্রতিদিন, কথা বলি, পাশে পাশে চলি—তাদের কারো হয়তো একটু অন্য রকম করে হাঁটার ভঙ্গিটি চোখে লেগে রইল, অন্য কারো বলার ভঙ্গিটি লেগে রইল কানে, হাসার ভঙ্গিটি লেগে রইল স্মৃতিতে—এমন অসংখ্য টুকরো প্রয়োজন মতো জোড়া লাগতে থাকে গল্পের দাবী অনুযায়ী চরিত্রের ক্যাটালগ তৈরি করতে। লেখক হিসেবে—এই জোড়া লাগানো অবয়বটি যেন ‘হাঁসজারু’ না হয়ে যায়—সে দিকটিতে সর্তক দৃষ্টি রাখার দায়িত্ব আমার। পূর্ণাঙ্গ অবয়ব পেয়ে চরিত্রটি যখন অবশেষে গল্পের চৌহদ্দীতে হাঁটতে শুরু করে, অংশগ্রহণ করে কর্মকাণ্ডে, লেখক হিসেবে আমাকে মাতৃদৃষ্টির মতোই চোখে চোখে রাখতে হয়—বেচারা এ ধারে ও ধারে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল না তো! শরীরের তুলনায় বড়ো জামা পড়ে জড়িয়ে গেল না তো এবড়ো-থেবড়ো পথে! কিন্তু অবয়বটি যদি বুনতে পারি গল্পের দাবী অনুযায়ী, যদি সে দাঁড়িয়ে যায় শক্ত জমিনে নিজের মতো করে, তখন তারই দায়িত্ব আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে তীরে পৌঁছে দিয়ে বলা—সো লং…।
একটা খুব জনপ্রিয় কথা আছে, লেখকরা প্রায়ই কথাটি বলতে পছন্দ করেন, এবং প্রায়শই সেটা গর্বের সাথেই যে—তারা পাঠকের কথা ভেবে নয়, স্রেফ নিজের জন্য, নিজের খেয়ালখুশিতে লিখেন। তথাস্তু। যে কেউ নিজের জন্য লিখতেই পারেন। পারেন হাসতে, এবং নিজ খুশিতে গাইতে পারেন। গান না আপনি যতখুশি নিজ ঘরে। কিন্তু, গোল বাঁধে যখন সেটা সামনে আনেন! মাইকটি তাক করে ধরেন পড়শীর দিকে! কেন করেন? অর্থাৎ, চান সেটা যেন আমরাও শুনি, শুনে আন্দোলিত হয়, আবিষ্ট হই আপনার গায়কিতে? বয়েই গেছে আমাদের আপনার নিজের জন্য বানানো জামাটি পছন্দ করে আমার গায়ে পরতে! কাউকে না পড়াতে চাইলে আমি, অন্তত, লিখতাম না। কিংবা, লিখলেও স্রেফ ডায়েরি লিখতাম, গল্প লিখতাম না। যে ভিন্ন বাস্তবতার জগৎটি তৈরি হল আমার ভেতর, ঘটল একটি ঘটনা যা আর কেউ দেখতে পারছে না, তার ভাগ আমি দিতে চাই এন্তার লোকজনকে। ডেকে ডেকে দেখাতে চাই, এই যে, দেখো, এরাও আছেন! এমনও ঘটে! এমনও ঘটে বলেই আমাদের থাকাটা উল্লেখযোগ্য হয়! তেলেনাপোতা কোথাও আছে হয়তো—এই বোধটি আরেকটু আনন্দময় করে তুলল না কি আমার বেঁচে থাকার বোধটিকে? মনে কি হয় না—একদিন অবসর করে বেরিয়ে পড়তে হবে রতি নাপিতের বাড়িটি দেখতে, যার ’অবস্থানক্ষেত্র বড়ো চমৎকার—বাড়ির পূর্বে নদী কামদা, পশ্চিমে বাগান; উত্তরে বেণুবন; দক্ষিণে যতোদূর দৃষ্টি চলে ততোদূর বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র’ (দিবসের শেষে/জগদীশ গুপ্ত)? যে গল্পজগৎটি লেখকের মনোজগতকে কাঁপিয়েছে তুমুল, সেই কম্পনটি আমার মাঝে চাউর করে দিতে চাইলে আমি চাইব তিনি ভাববেন আমার ভাবনার ব্যাকরণটির কথাও। বলছি না—আমার কথা ভেবে তিনি পাল্টান নিজেকে, বলছি অন্তত আমার জন্য চা তৈরি করতে চাইলে দুধ-চিনির পরিমাণটিতে একটু সহানুভূতি দেখাবেন, কাপের যে হাতলে ধরে চা’টি বানিয়েছেন, আমাকে দেবার সময় সে হাতলটি ঘুরিয়ে আমা-মুখি করে দেবেন—এটা খুব বেশি চাওয়া নয় বোধহয়! লেখক তো নিজের মতোই লিখবেন, লিখবেন নিজের আনন্দেই, কিন্তু লেখার টেবিলে বসলে আমি কেবল সামনের ঐ কাগজ-কলম কিংবা কি-বোর্ডটিই দেখি না, একই সংগে দেখতে পাই সদরে-অন্দরে বসে আছেন সারি সারি অগুণতি শ্রোতা, উন্মুখ হয়ে আছে স্তদ্ধ পৃথিবী, লেখা তৈরির অন্তরালে সেই মুখগুলো আমাকে আন্দোলিত করে, উদ্দীপিত করে প্রতিটি শব্দ-প্রক্ষেপণ মুহূর্তে! অবশ্যই আমি আমার গল্পটি বলতে চাই আমার মতো করে, আমার একান্ত ভঙ্গি এবং মুদ্রাদোষ সমেত, চাই বাক্য উচ্চারণ করার সময় আমার নিজস্ব হাত ও মুখের জ্যামিতিক চলাচলটি চারিয়ে দিতে পাঠকের মাঝে, এবং অতি অবশ্যই চাই সেই ভঙ্গি, সেই মুদ্রাদোষ, সেই হাত ও মুখের জ্যামিতিক চলাচলটি যেন পাঠক গ্রহণ করেন, প্রশ্রয় দেন, ভালবাসেন। সে জন্যই তো এতসব নিয়মিত কসরত, শত শত ব্যর্থ বাক্য পর একটি পরিবেশনযোগ্য বাক্য লিখে আনন্দে আত্নহারা হয়ে থাকা।
স্টিফেন কিংয়ের ‘অন রাইটিং’ বইয়ের যে সংস্করণটি আমার সংগ্রহে, তার প্রচ্ছদটি এরকম: একটি জানালা। জানালার পর্দা প্রায় খোলা। রাত বলে ঘরে আলো জ্বালানো। সেই আলোর সামনে লেখককে দেখা যাচ্ছে, তিনি ঝুঁকে আছেন টেবিলের ওপরে, লিখছেন। ছবিটির দিকে হঠাৎ করে তাকালে মনে হয় যেন কিংয়ের লেখার ঘরে উঁকি দিচ্ছি, আর তাতে তিনি নিঃসঙ্গ লিখে চলেছেন একমনে। কিন্তু দ্বিতীয়বার তাকিয়ে অন্য একটি সম্ভাব্য চিত্রও কিন্তু দেখতে পাওয়া যায়। ঐ লেখার টেবিল হতে হঠাৎ করে যদি কিং ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান, তাকান খোলা জানালার বাইরের দিকে, দেখতে কি পাবেন না আমাকে, আমাদেরকে? তার পাঠককে—যাদের জন্য ঘাড় গুঁজে লিখে চলেছেন রাত জেগে? চোখাচোখি কি হবে না আমাদের, এবং আমরা কি মুচকি হাসব না পরস্পরের দিকে তাকিয়ে? মাথা ঝুঁকিয়ে পরস্পরকে সান্তনা দেবো না কি যে—হুম, আমরা আছি বলেই আপনারা আছেন, কিংবা, আপনারা আছেন বলেই আমরা আছি! এই থাকাথাকি—থাকুক অনন্তকাল!
লেখালেখির জগৎটি আপাত নিঃসঙ্গ বলে মনে করা হলেও, আমার ক্ষেত্রে মোটেই তা নয়; এবং খুব সম্ভব আরো অনেক লেখকের জন্যও তাই। যখন লিখি, চরিত্র আঁকছি, সংলাপ সাজাচ্ছি, তখন লেখার চরিত্রগুলোর কলকাকলিতে মুখর তো থাকছিই সারাক্ষণ, এবং একই সঙ্গে মুখর থাকছি আমার অনাগত পাঠকদের সঙ্গে পেয়ে। চল্লিশ হাজার শব্দের একটি উপন্যাস পড়তে পড়তে কেউ একজন—যাকে আমি চিনি না, হয়তো কখনোই দেখা হবে না তার সাথে, তিনি বিচরণ করছেন আমারি মনোজগতে তৈরি হওয়া এক জনপদে, যাতে এই মাত্র প্রতিস্থাপিত করে দেওয়া একটি ভাঙা সাঁকো তিনিও দেখতে পাচ্ছেন আমার মতোই—এই বোধটি ভরে রাখে আমার লেখাসৃষ্টির পুরোটা সময়। অতএব, সহজ করে বলে উঠতে চাই যে—আমি গল্প ভাবতে শুরু করি আমার জন্য, তাকে প্রশ্রয় দেই আমার সৃষ্টিশীল এবং কৌতূহলোদ্দীপক মনটির খাবার জোগানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শব্দ-বাক্য-রূপকে সাজিয়ে লিখে উঠি পাঠকের জন্য, পাঠকদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞানটিকে ভাগাভাগির জন্য। আমার সৃষ্টির আনন্দ পাঠকের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রয়াস থেকেই তো এইসব টাইপিং, প্রিন্ট, প্রকাশ।
আমরা যারা বেড়ে উঠেছি গত শতাব্দির শেষাশেষি, এবং লিখতে শুরু করেছি এ শতাব্দির শুরুর দিকে—তাদের প্রায় প্রত্যেকই, কিংবা নিজের কথাই যদি বলি (যেহেতু শেষ পর্যন্ত এটা একান্তই আমার নিজস্ব গল্প-ভাবনা), যে চ্যালেঞ্জটির মুখোমুখি হই প্রতিদিন, তা হলো—সময়, আরো নির্দিষ্ট করে বললে—বদলে যাওয়া সময়। আমাদের আগে আর কোন প্রজন্মের লেখকই বোধহয় এতটা দ্রুত বদলে যাওয়া পৃথিবীর ভেতর দিয়ে ডানা মেলেননি, গতকাল শান দেয়া কলমের নিবে মরচে পড়ার ভয় পেয়ে বসেনি আজ সকালে, কাটতে হয়নি প্রতিদিন পেন্সিলের ডগা বাইরের হাওয়াটির দিকে তাকিয়ে। এই বদলের বেশিরভাগটাই যদিও স্থূল অর্থে প্রযুক্তিগত, কিন্তু তারই ক্রমবর্ধমান নখ আঁচড়ের দাগ রেখে যাচ্ছে জীবনের সব কয়টি ক্ষেত্রে। ঘর-নগর-রাষ্ট্র ভাঙছে প্রতিদিন। এবং সম্পর্ক, এবং সমাজ, এবং মানুষ—ভাঙছে, ভেঙে পড়া হয়ে উঠেছে নতুন স্বাভাবিকতা, নতুন দিনের ইশতেহার। আহা! আমরা প্রত্যক্ষ করছি ভাঙনের মহামারি। আমাদের আগের সময়ে যে পরিবর্তনগুলো প্রত্যক্ষ হয়ে উঠত, সেগুলোর পরিস্ফুটন ছিল বেশ ধীর গতিতে। ফলে, অমন হুট করে বদলে যাওয়া সমাজের নাড়ি বোঝার ঝক্কি সামলাতে হয়নি আর কোন প্রজন্মের লেখককেই। এক রেডিও থেকে টেলিভিশনে আসতে কত দিন লেগেছে হিসেব করে, যদি তুলনা করি মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট আমাদের চারপাশে আস্তানা গাঁড়ার পর আমাদের কোন কোন ক্ষেত্রটি আছে আর আগের মতো—তা হলে আমি ঠিক কী বলতে চাইছি, সেটি দৃশ্যমান হয়ে উঠবে এক লহমায়। যে মানুষগুলো এবং সমাজটিকে এক রকম দেখতে দেখতে আমি বড় হয়েছি, এবং বড় হতে না হতে, সেই মানুষ এবং সমাজের গল্পগুলো লিখে উঠতে না উঠতে সেটি এত বদলে যাচ্ছে কিংবা গেছে এত রাতারাতি, এই পাগলাটে ‘ফাইভ-জি’ পরিবর্তন এবং আমার মনোজগতে স্থির হওয়া প্রতিচ্ছবি প্রায়ই তাল সামলাতে পারে না। স্বীকার করা দরকার, বিশেষত আমার মতো যারা বেশ কিছুকাল দেশের বাইরে রয়েছেন, বাইরে বসে লিখছেন বাংলাদেশের গল্প—তাদের জন্য এই তাল সামলানোটা রীতিমত দৈনন্দিনের চ্যালেঞ্জ। আমাদের স্মৃতির দেশ এবং পাল্টে যাওয়া সময়কালকে বোঝার জন্য শুধু এক কেজি আলুর দামের একাল-সেকাল তুলনা করলেও হয়তো আরো সহজে বোঝা যাবার কথা!
মনে আছে, আমার এক গল্পে মবিন নামক একটি ছেলে ফার্মগেট ছন্দ সিনেমা হলের সামনে থেকে টেম্পুতে চড়ে নিউমার্কেট যাবে। ভাড়া দিচ্ছে—দুই টাকা। গল্পটি প্রকাশ হবার পর এক শুভাকাংখি পাঠক আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছেন, ভাই, এ দেশের ভিক্ষুকরাও যে এখন দুই টাকা ভিক্ষা নেয় না, এ কথা বোধহয় আপনি জানেন না। যে ভাড়ার কথাটি আমি লিখেছিলাম, সেই স্মৃতি যে অন্তত বারো বছর আগের—সেটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম আমি। মূলত এ ধরনের কিছু সমস্যার কারণে আমার লেখা এমন অনেকগুলো গল্প, বা আধা-গল্প কি আধা-উপন্যাস আমি অসমাপ্ত ফেলে রেখেছি। মাঝে মাঝে সেগুলোকে উল্টে-পাল্টে দেখি বটে, কিন্তু বুঝতে পারি, ওরা আর হয়ে উঠবে না। যে ঘেরাটোপে রেখে ঐ মানুষটির যে গল্পটি আমি বলতে চেয়েছিলাম, সেই ঘেরাটোপ কখন কেটে বেরিয়ে এসেছে সে, এই নতুন বাস্তবতায় সেই গল্পটি নেহায়েত বেমানান, বেখাপ্পা। অর্থাৎ বলতে চাইছি, মাত্র এক যুগ আগের বাস্তবতায় তৈরি কোন চরিত্র, বছর কয়েকের ব্যবধানে নির্মম সেকেলে, তার উত্তরণের জন্য তৈরি হয়ে আছে অনেকগুলো পথ—যা এই ক’দিন আগেও ছিল না। একটি মেয়ে ও একটি ছেলের মধ্যে ‘নাই টেলিফোন, নাই রে পিয়ন’ জাতীয় ঘটনা, তা যতই আমার গল্প দাবী করুক, দেখানোর সুযোগ (প্রায়) নেই আর। অমনটা দেখালে এ সময়ের পাঠক মুহূর্তে গোস্বা করে বলে উঠবেন, কেন—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না?
করোটিতে অর্ধ-তৈরি কতগুলো চরিত্র নিয়ে আমি কোন কোন দিন যখন ঘুমুতে যাই, বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখি। একদিন দেখলাম, ভীষণ কুয়াশার ভিতরে দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছি। কেননা, গায়ে কোন কাপড় নেই। চারপাশ ভীষণ শাদা। ধোঁয়ার দেয়াল আমার চর্তুপার্শ্বে। কেন এমন আদুল গায়ে অনির্দিষ্ট দাঁড়িয়ে আছি—সে কথাটি যখন ভাবছি, তখন স্পষ্টতই মনে হলো, কুয়াশার ওপারে কিছু একটা আছে। নড়ছে। আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। দৌড়ে স্থানটি ত্যাগ করার কথা ভাবতেই দেখলাম, একটা মানুষ এগিয়ে আসছে কুয়াশা ভেদ করে। মানুষটিকে আমি চিনি। উনার নাম মাওলানা আজিম উদ্দিন। গ্রামের একটা নিরীহ ছেলেকে খুন করেছিলেন তিনি। ছেলেটির অপরাধ ছিল, এক রাতে উনি যখন তার অল্পবয়সী দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠ হচ্ছিলেন, তখন ছেলেটি তার বাড়ির পাশের উঁচু ঢিবিতে বসে বাঁশী বাজাচ্ছিল। বাঁশীর সুরে আজিম উদ্দীনের সুন্দরী স্ত্রী স্বামীর আদর থেকে অমনোযোগী হয়ে পড়ে, এবং আনমনে বলে উঠে: ইস, পোলাটা এমন বাঁশী বাজায় গো, কলিজা যেন মোচড় দিয়া উঠে! ব্যস, এই একটি কথাতেই আজিম উদ্দিনের জগত এলোমেলো হয়ে যায়। বেগানা একটি পুরুষের বাঁশীর সুরে স্ত্রীর কলিজা মোচড়ানোর কথা শুনে তার বর্তমান মোচড়ানো শরীরটি নিমেষে শীতল হয়ে যায়। একটি অকারণ প্রতিহিংসায় জ্বলে-পুড়ে যান আজিমউদ্দিন। এবং দিন যত যায়, প্রতিহিংসাটি বাড়তেই থাকে তার। অবশেষে একদিন হালিম নাম্নী বংশীবাদক ছেলেটিকে খুন করেন তিনি। তারপর সেই খুনটিকে ধামাচাপা দেবার জন্য একের পর এক কাণ্ড ঘটাতে থাকেন আজিমউদ্দিন। উপন্যাসটির প্রায় দশ হাজার শব্দ লিখা হয়েছিল। তারপর আর কাজ করিনি ওটা নিয়ে। সেই আজিমউদ্দিনকে দেখলাম বেরিয়ে আসছে এখন কুয়াশা ভেদ করে। স্থির শান্ত পদক্ষেপ। বুক অব্দি লম্বা দাড়ি। মাথায় পাঁচ-কল্লির টুপি। কিন্তু হাতে একটা লম্বা বাঁশী। বাঁশীটি ধীরে ধীরে মুখে তুলছেন তিনি, আর আমি অস্থির হয়ে উঠছি সে দৃশ্য দেখতে দেখতে। যেন বাঁশীটিতে ফুঁ দিলেই ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে…। হাঁসফাঁস করতে করতে ঘুম ভেঙে জেগে উঠি। বুঝতে পারছি, আজিম উদ্দিন তার গল্প শেষ করার তাগাদা দিতে আসছেন। কিন্তু তবু আজিম উদ্দিনের ঘটনার কোন চুড়ান্ত রূপ দিতে মন সায় দেয় না আমার।
এমন হয়! প্রায়ই এমন হয় আমার! গল্পটিকে আমি জানি, কোথায় যেতে চাচ্ছি এ গল্পটি নিয়ে—সে কথাটিও মনের দূর জানালায় উঁকি ঝুঁকি মারছে, অথচ এগুতে সায় দিচ্ছে না। তার প্রধাণ কারণটি বোধ হয় ‘সময়ের’ সাথে তাল সামলাতে না পারার সমস্যা। আজিম উদ্দিন এবং তার হাঁটুর বয়সী বালক হালিমের সময়-কালের যে লক্ষ্যণীয় পার্থক্য, এবং তজ্জন্য তাদের মানসিক গড়নের যে ব্যবধান, সে রূপটি উদঘাটিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি আমি। ফলে দুইটি চরিত্র পড়ে থাকছে দুই কালে, সময় ফ্রেমের গ্যাপটি ভরাতে পারছি না বলে মাঝে মাঝে ‘মেকি’ ঘটনা বর্ণনা তৈরি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তা নিজের কানে লাগছে, চোখে বিঁধছে, সুতরাং, অর্ধ-তৈরি গল্পটি আধাআধি হবার নিয়তিতে স্থির হয়ে গেল, জমে রইল মোমগলায় আটকে যাওয়া জোনাকির মতো চির চলৎশক্তিহীন। অন্য কথায়, স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, এ গল্পের ‘হয়ে ওঠা’র সম্ভাবনা নেই আর, এটি পড়ে থাকবে কম্পিউটারের বাতিল ফোল্ডারে। নির্মম ব্যর্থতাই এর নিয়তি!
তবে কি বলছি, যে ক’টি গল্প কিংবা উপন্যাস শেষ করেছি, প্রকাশিত হয়েছে এখানে ওখানে, মলাট বন্দী হয়েছে কিংবা হওয়ার তোড়জোড় চলছি, সেগুলোতে আমি নিজেকে ভাবছি—‘সফল’? না, এবং অবশ্যই না। একটি গল্প বা উপন্যাস শেষ হবার পর বড়জোর সপ্তাহখানেক সেই গল্পটি আমাকে পরিতৃপ্ত করে রাখে। তারপর সেটি আমার কাছে মৃত। তার গল্পটি, তার চরিত্ররা। যে কল-কল্লোলে মেতে ছিল একটি গল্প অনেক দিন ধরে (একটি ছোট গল্পও আমাকে অনেক দিন লাগিয়ে লিখতে হয়), তারা ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে আমার আগ্রহের জায়গা থেকে, খালি করে যেতে থাকে আমার লেখার টেবিলের ওপাশের স্টেজটি, যাতে নতুন চরিত্ররা আস্তানা গাঁড়বেন, এবং অভিনয় করে চলবেন নিয়তি নির্দিষ্ট ঘটনাক্রমের।
যা হয়—কোন গল্প বা উপন্যাস প্রকাশ হয়ে গেলে আমার মাঝে একটি আতংক এসে ভিড় করে। লেখাটি পড়তে ইচ্ছে করে না আমার। না, গল্পটির আগপাশতলা আমার জানা আছে বলে নয়, পড়তে ইচ্ছে করে না, কেননা, পড়লেই আমি দেখতে পাব—কতটা ব্যর্থ হয়েছি আমি সেটি লিখতে! আরো কতোটা পরিশ্রম করার দরকার ছিল, দরকার ছিল আরো কতোটা মনোযোগের, সাবধানতার, এবং অবিসম্ভাবী পরিপক্কতার—সে সবই আমার সম্মুখে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হতে থাকে। অনভিজ্ঞতাগুলো দাঁত ভেংচায়, মূর্খের প্রগলভতাগুলো চোখ ঠারে। ইচ্ছে হয়—পালাই। চোখ বন্ধ করে রাখি। কিন্তু পালাই না। শেষ পর্যন্ত। অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে সেটি আমি পড়ি। এবং দাঁতে জিভ কাটতে কাটতে, মনে মনে নাক খত দিতে দিতে এ ধরনের ভুল আর করব না বলে নিজেকে শাসন করি। হাতে ধরা লাল কলমে বইয়ের লাইনে লাইনে কাটাকুটি করি। নিজের ভুলগুলো, বিচ্ছিরি ব্যর্থতাগুলো খোঁজার তাগিদ থেকেই নিজের প্রকাশিত লেখা পাঠ আমার। না হলে, যখন লিখি, এত অসংখ্যবার সেটি পাঠ হয়, নতুন লাইন যোগ করার আগে পুরনো লাইনগুলো এতবার পড়া হয় যে প্রায় মুখস্ত হয়ে যায় গল্পটি, এবং পুরোটা শেষ হলে অন্তত তিনবার পুনঃসম্পাদনা না করে লেখাটি হাতছাড়া করতে চাই না আমি। তবু এই যে প্রতিবার গল্প প্রকাশ হবার পরে ব্যর্থতার স্বাদ পেতে হয় আমাকে, সেটি তৈরি করে একটা জিদ—পরের গল্পটিতে ‘তুলনায় কম ব্যর্থ’ হবার জিদ। অর্থাৎ, আজীবন স্বপ্ন দেখছি, একদিন একটি সত্যিকারের সফল গল্প লিখব। এবং সেটি বাস্তব করার ভেতরের তাগিদ থেকে লিখছে একটি গল্প। অথচ, হচ্ছে না। পারছি না। পারছি না বলে লিখছি পরেরটা, এবং তৈরি করছি ধারাবাহিক ব্যর্থতার গল্পমালা। নিজের একটি বিশেষ গল্পই প্রিয় আমার। এ মুহূর্তে যেটি লিখছি—সেটি। কিংবা, যে গল্পটি লিখব বলে অপেক্ষা করে আছি, মনের অন্দরে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে পাচ্ছি যার আগমনীর—সেটি। যেটি লিখা হয়ে গেছে, যার ভাবনায় আমার ধমনী উছলে উঠছে না আর, কী হবে পরবর্তী পৃষ্ঠায়—সে কৌতূহল যেখানে মৃত, সেসব গল্প আমি পরম আদরে ডানার ওমে আগলে রাখব বটে, কিন্তু সে যত্ন-আত্তির মূল কারণটি নেহায়েত মানব মনের ‘মালিকানা-সূচক’ বদগুণটির কারণে। না হলে, ওদের যা হবার কথা ছিল, তা হয়ে গেছে, ঝরে-মরে-বিছিয়ে গেছে অতলে —তাদের নিয়ে আমার আর আদিখ্যেতা নেই তেমন। মোদ্দা কথাটি হলো এই, গল্প প্রকাশ আমার কাজের পুরস্কার নয়, গল্প লিখাটা। লিখতে যে আনন্দ পাচ্ছি—সে আনন্দেই আমি লিখছি। গল্প বলতে যে অলৌকিক খুশীতে বিভোর থাকছি, সে খুশীতেই আমি লিখছি। এবং ব্যর্থ হব জেনেও যে লিখছি, সেই ব্যর্থতাই আমার কাজের পুরস্কার।
আমেরিকান কবি রুথ স্টোনকে মনে পড়ছে। রুথ স্টোন দেখতেন, হঠাৎ তার দিকে নতুন একটা কবিতা উড়ে আসছে, উড়ে আসছে ঘোড়ার মতো উচ্চ হ্রেষা-ধ্বনি করতে করতে, কিন্তু এসে থমকে থাকবে না, অন্যদিকে চলে যাবে, তাই এর আভাস পাওয়া মাত্র তিনি যেখানেই থাকতেন, দৌড়ে ঘরে ঢুকে কাগজ-কলম নিয়ে বসতেন, তারপর স্রেফ ‘উড়ে আসা কবিতা’টিকে লিখে ফেলতেন কাগজে। কিন্তু এভাবে কাজ করার বিপত্তিও আছে, এবং সেটাও ঘটতো কখনো কখনো। কোন কোন দিন তিনি লিখার জন্য প্রস্তুত হতে হতে কবিতাটি তার মাথার উপর দিয়ে পার হয়ে যাবার মতো অবস্থা হত। অগত্যা তিনি নিরুপায় হয়ে একহাতে কবিতাটির লেজ টেনে ধরে, অন্য হাতে খাতায় লিখে যেতেন একটি একটি শব্দ। এভাবেও শেষ পর্যন্ত কবিতাটি মর্ত্যে নেমে আসত বটে, তবে আসত সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে। ইন্টারেস্টিং? বটে। গল্পের জন্য এমন ‘নাযিল’ হবার কোন সুবিধা থাকলে বেশ হতো, আর কারো জন্য এমন ব্যবস্থা আছে কি-না, আমি জানি না, তবে, আমার জন্য— নেই (হিসেবের বাইরে রাখছি কোনরকম পূর্বাভাষ ছাড়াই করোটিতে জেগে উঠা কোন কোন দৃশ্যকণার কথা)। গল্প ফাঁদার প্রস্তুতি স্বরূপ আমার জানা আছে একটিই টোটকা: সেটি পাঠ। আমার প্রাত্যহিকের একটা সুনির্দিষ্ট কর্ম এটি, এবং পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হয়, ঐ যে…, ঐ গল্পটি… ওটি আমি পড়তে চাই। কিন্তু সেটি খুঁজে পাই না। অচিরেই জানা যায়, হায়! কেউ তো এখনো লিখেননি সেই গল্পটি। তখন সেটা আমি লিখি। লিখে, সেটি পড়ে, কিচ্ছু হয়নি বলে ফেলে ছড়িয়ে দিয়ে নতুন গল্প ফাঁদতে চাই।
একটি ভাল গল্প—আমার বিবেচনায়, একটি আট হাত বিশিষ্ট অক্টোপাশের মতো। এর ছয়টি হাত আঁকড়ে ধরে আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়সহ পাঁচটি শারিরিক ইন্দ্রিয়: তখন আমরা গল্পটিকে সম্মুখে অভিনীত হতে দেখি, শুনতে পাই তার চরিত্রদের আলাপচারিতা, ঘ্রাণ পাই তার দৃশ্যাবলীর, স্পর্শ করে উঠি ঘটনার এবড়োথেবড়ো বাঁকগুলো, শব্দপাঠের একটি বিচিত্র স্বাদের আমেজ লেগে থাকে জিহ্বায়, এবং ঘটনাপরম্পরায় ডুবতে ডুবতে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টি সজাগ হয়ে উঠে—লেখক শেষ দৃশ্য অংকন করার আগেই কী হতে পারে তার উদ্দিষ্ট নির্বাণ—সেটি আন্দাজ করার এক অসর্তক প্রতিযোগীতায় নেমে পড়ি নিজেদের অজান্তেই। কিন্তু এতো গেল ছয় হাতের হিসেব। অক্টোপাশই যদি, তবে বাকি দুটো হাত? বাকি দুটো হাত, যতক্ষণ সেই গল্পটি আমরা পড়ি, পরম মমতায় আদরের হাত বোলাতে থাকে আমাদের মাথায়, চুলে বিলি কাটতে গুনগুন করে আবৃত্তি করে: গল্পের ওপারে কে?/ কে গল্পের ওপারে?/ আমি নই তো?/ অস্থি-মজ্জা-মাংস নিয়ে বিব্রত যে, গল্পের এপারে? (কবিতা: প্রতিবিম্ব)।
এ কথা স্বীকার করে ফেলা দরকার যে, আধুনিক মানুষের প্রত্যেকের জন্যই নির্দিষ্ট করা আছে গ্রেগর সামসার নিয়তি। কাফকা কেবল সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের। এই বোধটি যে ভয়ংকর বাস্তবতায় দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের, তার ফোটানো হুল সহনীয় করে তোলার জন্য একেকটি মানুষের টেকনিকটি নিশ্চয় একেকরকম। আমার ক্ষেত্রে টেকনিকটি স্রেফ লিখা, গল্প গড়া। গল্প লিখা—পামুক থেকে ধার করে বলি—আমার জন্য দৈনন্দিনের বরাদ্দকৃত ঔষুধের মতো! যখন না গড়ি, না লিখা হয় যখন কোন কোন দিন, তখন যেন মৃত হয়ে আছি, অবশ অক্ষম অকর্মণ্য হয়ে চুপসে গেছি নিজ লাশের ভেতরে, আর তাতে পূর্ণবার সাড় ফেরাতে হলে গল্পের ফুঁ ভিন্ন আর কোন তাবিজ-কবজ জানা নেই আমার।
সবিনয় নিবেদন: এ নিবন্ধে ব্যবহৃত প্রতিটি বাক্য, ধারণা এবং অনুকল্প, শুধুমাত্র বর্তমান নিবন্ধকারের জন্য প্রযোজ্য। অন্য কারো সাথে তা মিলে গেলে, বা আলোচ্য একই বোধে যদি অন্য কেউও তাড়িত হন, তা নেহায়েত কাকতালীয় বলে ধরতে হবে, অথবা, ধরতে হবে—আমরা হয়তো এক ক্ষুরে মাথা কামিয়েছিলাম।
গল্প : টি২০ ক্রিকেটে কল্যাণপুরের অবদানের নেপথ্যে
মুখবন্ধ: নিচের গল্পটি মূলত একটি সরেজমিনে তদন্তের প্রতিবেদন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমে কল্যাণপুর নাম্নী একটি অজ-পাড়া-গাঁ থেকে এক সঙ্গে দুইজন খেলোয়াড় অন্তভূর্ক্ত হওয়ায় জনমনে এই এলাকার ক্রিকেট সাফল্যের গূঢ় রহস্যের প্রতি কৌতূহল সৃষ্টি হয়। সেই কৌতূহল নিবৃত্তির নিমিত্তে নিন্মোক্ত প্রতিবেদনটি।
এক.
কল্যাণপুরে ক্রিকেট খেলা আমদানীর পূর্বে ডাণ্ডা সদৃশ লাঠির ব্যবহার দেখা যেত গরুর পিঠে এবং ড্যাংবাড়ি (ডাংগুলি) খেলায়। লাঠির বাড়ি খেয়ে গরুগুলো হাম্বা হাম্বা স্বরে এবং ড্যাংবাড়ি খেলতে খেলতে ছেলেরা বাড়ি, দুড়ি, তেড়ি, চাঘল, চাম্পা, ঝেঁক, মেক গুনতে গুনতে চেঁচাত।
তারপর একদিন দিন বদলাল; হুড়মুড় করে কল্যাণপুরে ক্রিকেট খেলা ঢুকে পড়ল।
তখন, কল্যাণপুরের হাড় জিরজিরে ছেলেরা গরুর পাছায় লাঠি মারা এবং ডাংগুলির বাড়ি-দুড়ি ছেড়ে, পাঁজর ফুলিয়ে চার-ছক্কা মারতে শুরু করল। দিন কতক যেতে না যেতে কল্যাণপুরবাসী একে অপরকে বলাবলি শুরু করল, বিটিশগো খেলা রে ভাই, বিশাল বেরেনি খেলা। তারা ব্রিটিশদের ব্রেইনি খেলায় মশগুল হয়ে গেলে, খেলা শেষে গা জুড়াতে বসে গ্রামে এ খেলাটির আমদানীকারক ও প্রচলনকারী মোশাররফের গুণ গাইতে গাইতে বলতে লাগল, ঢাকা তন একটা ভাল জিনিস আনছে পোলাটায়। এবং এ প্রসঙ্গে গ্রামে ক্রিকেট প্রচলনের প্রথম দিনটির কথাও তাদের স্পষ্ট করে মনে পড়তে লাগল:
দিনটি ছিল শনিবার। বাদ আছর। একতা সংঘের সামনে ছোট্ট মাঠে বদির গ্রুপ বনাম বশির গ্রুপ ডাংগুলি খেলছিল।
বদি বলে বেড়াত, বইশ্যা আমার লগে পারবো মনে করছোস? কেনে আঙুল দিয়া খেলমু বেটা।
বশির বলে বেড়াতো, বইদ্যা আ কইরা চাইয়া থাকবো, ডাণ্ডার এক বাড়ি দিয়া ফুত্তিরে দরিয়ার ঐ পারে পাডামু। আমার লগে সেয়ানামি?
বদি বলে বেড়াতো, বইশ্যাতো ডাণ্ডাই ধরতে পারে না। বাড়ি দুড়ি তেড়ি চাঘল গুনতে গিয়া উলট পালট করে। হের কাম বুঝি আমার লগে খেলন?
বশির বলে বেড়াতো, বইদ্যার লগে খেলতে আমার গর্ত-মর্ত কিচ্ছু লাগত না। গর্ত ছাড়াই ফুত্তি সমান মাটির উপর শোয়াইয়া বাইড়ামু। কইছ বইদ্যারে।
এভাবে বদি এবং বশির পরস্পরকে ডাংগুলি খেলার ব্যাপারে হুমকি-ধামকি দিতে থাকলে, এ ব্যাপারে একটা শ্রেষ্ঠত্বের ফায়সালা দরকার হয়ে পড়ে। তখন একতা সঙ্গের ছেলেরা ঠিক করে, হোক, একটা ম্যাচ হোক। বদি গ্রুপ বনাম বশির গ্রুপ।
এবং খালি খালি তো ম্যাচ হয় না। ‘বেট’ও ধরা লাগে। তখন তারা ঠিক করে, তাইলে ঠাণ্ডা খাওনের বেট হোক। দুই লিটারের বাজি।
এই মর্মে এক লিটার করে দুইটি ঠাণ্ডা, মানে ‘কোকাকোলা’ পানীয় বোতলের বাজিতে শনিবার বাদ আছর একতা সংঘের সামনের মাঠে বদি গ্রুপ বনাম বশির গ্রুপের ডাংগুলি খেলার আয়োজন করা হয়। যদিও কল্যাণপুর বাজারে যে কোক পাওয়া যায়, তা ঠাণ্ডা হওয়ার উপায় নেই। বাজারে কারেন্ট না থাকায় ফ্রিজ নেই, এবং ফ্রিজ না থাকায় যেসব কোকাকোলা পাওয়া যায়, তা ঠাণ্ডা হয় না। তবু তারা কোকের বাজি ধরলে বলে ‘ঠাণ্ডা খাওনের বাজি’ এবং বাজার থেকে কোকা কোলার বোতল কিনে এনে খালের পানিতে কচুরীপানার নিচে ডুবিয়ে রাখে ঘন্টা তিনেক। পানীয়টি কচুরীপানার ছায়ার নীচে থেকে মোলায়েম রকম ঠাণ্ডা হয়, আর বাজির জয় পরাজয় নির্ধারণ হয়ে গেলে, বিজয়ী পক্ষ খালের পানিতে চুবানো ঠাণ্ডা খেয়ে, এবং বিজিত পক্ষ মুন্সী বাড়ির ডিপ টিউবওয়েলের পানি খেয়ে ওক্ক করে ঢেঁকুর তোলে।
সুতরাং, ম্যাচের দিন, শনিবার বাদ আছর ‘বদির গ্রুপ’ এবং ‘বশির গ্রুপ’ বাড়ি, দুড়ি, কড়ি, চাঘল, চাম্পা, ঝেঁক, মেক গুনতে গুনতে তার স্বরে চেঁচাতে লাগল। দুই দলের ‘গুটে’র হিসাব রাখার জন্য কল্যাণপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস টেনের সেকেন্ড বয় নিজাম-উদ-দৌলাকে হায়ার করা হল। ভাল ছাত্রত্বের দাবিতে ফার্স্ট বয় আব্দুর সোবহানকে হিসাব রাখার দায়িত্ব দেয়াই সমীচিন ছিল, তবে কি-না সে বদির মামাতো ভাই হয়। সুতরাং, হিসাব রাখার দায়িত্ব একজন নিরপেক্ষ লোকের হাতেই হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন লতিফ জোয়ার্দ্দার। তিনি আজকের বিশেষ অতিথি, পেছনের দিকে হেলানো তার নিজস্ব আরাম কেদারা তিনি সাথে করে নিয়ে এসেছেন। তাতে বসে নানাবিধ বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন। মতামতের সাথে সাথে তার গলা সপ্তমে চড়ে সময়ে সময়ে, তিনি আধশোয়া অবস্থা হতে লাফ দিয়ে উঠেন, এবং নানাবিধ খিস্তি সহকারে একজন অভিজ্ঞ কোচের মতো কৌশল বাতলাতে থাকেন:
—এইটা, এইটা কি কইরলো পোলাটায়, এত সোজা মাইর, এত সোজা মাইর!
—দেখ দেখ, কাণ্ডটা দেখ, হারামজাদা এইটা কোন বাড়ির রে, ডাণ্ডা ধরতেও তো জানে না দেখি।
—বেকুবের বেকুব, এই পোলাটারে খেলায় নামাইছে যে, হেই বড় বেকুব।
—ওরে ফুত্তি এমনে নি বাড়ি মারে? তোর হাত বেঁকা নি রে ব্যাডা?
ইত্যাদি ইত্যাদি।
তার মুখ সমানে চলছেই। ব্যাপারটা শুধু এ বিষয় নিয়েই নয়। কল্যাণপুরের বড় দিঘীতে ভাগের মাছ মারা থেকে শুরু করে সর্ব বিষয়ের জমায়েতে লতিফ জোয়ার্দ্দার তার আরাম কেদারা নিয়ে গিয়ে বসেন, এবং বিষয়ে অংশগ্রহণকারী সবাইকে ধমকা-ধমকি করতে থাকেন।
নিজাম-উদ-দৌলা হিসাব রাখার উত্তেজনায় ঘেমে গেছে, একটু পর পর তার গলা শোনা যায়, এই খাড়ান, খাড়ান, লেইখ্যা লই, লেইখ্যা লই।
দো-চালা ঘর এবং সামনের মাঠ কল্যাণপুরের উত্তেজনা পিয়াসী পুরুষরা খেলার উত্তেজনা ও হতাশা মোতাবেক ক্ষণে ক্ষণে আ-আ-আ কিংবা ও-ও-ও করে উঠে সমস্বরে। তখন আশেপাশের বাড়ির অতি উৎসাহী মহিলারাও নানাবিধ বেড়ার ফাঁক ফোঁকর গলে এদিকে চোখ রাখলে কেবলি মাথার নিচ থেকে ‘ব্যাটা মাইনষের’ শরীরের পিছন দিক দেখতে পায়। এতগুলো পুরুষ মানুষের শরীরের পিছনের দিক দেখে দেখে তাদের বিমমিষা জাগে। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে তারা বলে, ‘দুত্তোরি তোর, বুড়া বুড়া ব্যাডাগুলায় কাম কাইজ ছাড়ি …’, কথার বাকি অংশটা শেষ হবার আগেই একটা বিকট শোর গোল শুরু হয়ে যায় খেলার মাঠে।
লতিফ জোয়ার্দ্দারের মেঝ ছেলে মোশাররফ ইলিশ মাছের ডিম তরকারী দিয়ে ভরপেট ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছিল। ডাংগুলি খেলার চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে গেলে সে গত দুইদিনে প্রথমবারের মতো বাড়ির বাহির হয়। ঢাকার যাত্রাবাড়ি ডিগ্রি কলেজে দুই বছর ধরে পড়ার ফলে সে গ্রামে আসলে ডাঙা তোলা মাছের মতো অনুভব করে। দুইবছর আগে কীভাবে সে জিন্স প্যান্ট ছাড়া কল্যাণপুরের রাস্তায় বেরুত—ভাবতেই তার কাছে অবাক লাগে। জিন্স প্যান্ট পরিহিত অন্য সঙ্গীর অভাবে সে গ্রামে বেড়াতে আসলে ঘর হতে বের হয় না। কিন্তু আজকে আর পারা গেল না। সে তড়িঘড়ি করে তার চিপা জিন্স প্যান্ট পরে একতা সংঘের সামনে এলো। তারপর চারদিকের উত্তেজনাকে চাপিয়ে শুদ্ধ ভাষায় যা বলল, এক লাইনে তার সারমর্ম: এইসব খেলা এখনও দুনিয়াতে আছে? আপনারা এইসব খেলা এখনও খেলেন?
তখন কল্যাণপুরবাসী থতমত খেয়ে যায়, তার কথার মর্মার্থ বোঝার জন্য তারা ঘেমে উঠা স্ব স্ব ঘাড় চুলকাতে থাকে। মর্মার্থ বোঝাবার জন্য মোশাররফ বেশিক্ষণ সময় অবশ্য নেয় না। চুলকানোর উদ্দেশ্যে তোলা লোকজনের হাত ঘাড় হতে নামতে না নামতেই মোশাররফ আবারও ঘোষণা দেয়: এইগুলান খেলা রাখেন দেখি। দুনিয়া কই গেছি গিয়া, আর আপনেরা এখনও লেত্রা পোলাপাইনের মতো বাড়ি দুড়ি চাঘল গনেন। এখন হইল ক্রিকেটের যুগ। শুনছেন ক্রিকেট খেলার নাম? হুহ হু।
উপস্থিত কেউ ক্রিকেট খেলার নাম শুনেছে কি-না, এ প্রশ্নের পরে উচ্চারিত ‘হুহ হু’ ধ্বনিটি তার নাক এবং মুখ হতে এমন অবজ্ঞা ভরে বেরুয় যে, লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ ক্রিকেট খেলার নাম ‘আলি-ঝালি’ শুনে থাকলেও ক্ষনিকের জন্য বিলকুল বিস্মৃত হয়ে যায়, এবং এতক্ষণ ডাংগুলি খেলাকে কেন্দ্র করে চারদিকে যে একটা উত্তেজনা চলছিল, তা থম মেরে যায় সহসা। মোশাররফের বাবা লতিফ জোয়ার্দ্দারের গলাই শোনা যায় প্রথম, কিরকেট আবার কি ধরনের খেলা মিয়া মোশাররফ জোয়ার্দ্দার?
ছেলের নামের আগে মিয়া এবং শেষে জোয়ার্দ্দার সহযোগ ছাড়া তিনি কখনও ডাকেন না, শত হলেও অত্র এলাকার একমাত্র ‘টাউনে’ পড়া ছেলে তার, একটা আলাদা মর্যাদা তো তার পাওনাই।
এতক্ষণ মোশাররফের হাত তার জিন্সের প্যান্টের সামনের দুই পকেটে ঢোকানো ছিল, সে অবস্থাতেই সে উপরোক্ত বাক্য বর্ষন করছিলো জনতার উপর, এবার হাত দুটি বেরিয়ে এসে তার চুলে যায়। সে কয়েকবার চুলে তা দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আব্বা, ক্রিকেট খেলা বোঝাইতে হইলে জিনিসপাতি লাগবো, এমনে এমনে হইবো না। হুহ হু।
হুহ হু শব্দবন্ধ মোশাররফের আধুনিক কেতায় সর্বশেষ সংযোজন। এ ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় সে মাথার সামনের অংশটিকে এমনভাবে ঝোঁকায়, যাতে তার সামনের দিকে ল্যাঞ্জা বের হওয়া চুলও তাল দেয়। সুতরাং, উপস্থিত শ্রোতাদের হতবিহ্বল না হয়ে আর উপায় থাকে না। মোশাররফ চারপাশে গোল হয়ে থাকা লোকজনের দিকে অনির্দিষ্ট ভঙ্গিতে তাকিয়ে আশ্বস্থ করার গলায় যোগ করে, পাইরবেন। একটু ব্রেইন থাকলেই পারবেন। বেশি জটিল কিছু না। ড্যাংবাড়ি খেলার সাথে মিল আছে। আগামী মাসে বাড়ি আসার সুমে জিনিসপাতি নিয়া আসমু ঢাকা থেকে।
এ আশ্বাস দিয়ে, এবং দ্বিতীয় আর কোন বাক্য ব্যয় না করে মোশাররফ বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যায়। তার দুই হাত তখন আবার জিন্সের দুই পকেটে ঢুকে পড়েছে, এবং ‘টাইট-ফিটিং’ জিন্সের চাপে দুই পা হাঁসের মতো বাঁকিয়ে চলতে হচ্ছে। সেই চলার দিকেই তাকিয়ে উপস্থিত জনতার হতবিহ্বল চোখগুলো।
বলা বাহুল্য, অতঃপর ড্যাংবাড়ি খেলার উত্তেজনা হঠাৎ কেমন ঝিমিয়ে আসে। লোকজন এ কোণায় ও কোণায় জটলা করে ‘কিরকেট খেলা’ সম্পর্কে আলোচনা করে। কিন্তু সে আলোচনায় ক্রিকেট সম্পর্কে কোন সারকথা ব্যক্ত না করতে পারায়, কল্যাণপুরবাসী সিদ্ধান্ত নেয়: তাইলে মাসখানিক ধৈর্য ধরি থাকি। দেখি, হেতে ঢাকা তন কি ডাইল আর কদু নিয়া আসে।
‘ডাইল আর কদু’ বলে নিজেদের ক্রিকেট সম্পর্কে অজ্ঞতাকে চাপা দিয়ে হাসাহাসির একটা ব্যর্থ চেষ্টা তারা করলেও এক মাস অপেক্ষা করতে হবে ভেবে মনটা দমে যায় তাদের।
এক মাস তারা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে থাকে। কিংবা হয়তো দুই মাস চলে যায়, তিন মাস চলে যায়, এবং দীর্ঘদিন ড্যাংবাড়ি না খেলা তাদের হাতগুলোতে যখন নিশপিশানির পরিমাণ অসম্ভব রকম বেড়ে উঠে, তখনই এক শুভদিনে ঢাকা হতে মোশাররফ গ্রামে আসে, সাথে আসে একটা ব্যাট ও বল। আরেকটা ব্যাট বানানোর জন্য কয়েকজন মিলে দৌড় দেয় বাজারের জহির কাঠকলের পেছনে রাখা বাজে কাঠের জঞ্জালের দিকে। এবং আরো কয়েকজন মিলে লতিফ জোয়ার্দ্দারের অনুমতি সাপেক্ষে তার বরাবাঁশের মুড়ায় ঢুকে চিকন-দেখে-শক্তমক্ত বাঁশ কেটে নিয়ে আসে ‘উইকেট’ বানাবে বলে।
এই সব আয়োজন হয়ে গেলে মাঘ মাসের এক পড়ো পড়ো বিকেলে একতা সংঘের মাঠের স্মৃতিতে ড্যাংবাড়ি খেলাটি চির দিনের জন্য ঢুকে পড়ে, তার বুকে জায়গা করে নেয় ক্রিকেট খেলা। সকাল সন্ধ্যায় জায়গাটিতে বাড়ি-দুড়ি-ছাগল-চম্পা-ঝেক-মেকের বদলে আউট-ক্যাচ-রান-এল বি ডব্লিউসহ যাবতীয় ভিনদেশী-শব্দ এ-দেশীয় উচ্চারণে শোনা যেতে থাকে।
এই খেলা ভিন্ন এত দিন তারা কোন প্রাচীনে পড়ে ছিল—তা ভেবে কল্যাণপুরবাসী রীতিমত বিব্রত বোধ করতে শুরু করে।
দুই.
কিন্তু ড্যাংবাড়ি ছেড়ে ক্রিকেট খেলার প্রচলন—আপাত নিরীহ এই পরিবৃত্তিক প্রক্রিয়াটি কল্যাণপুরবাসীর পোশাক-ঐতিহ্যে একটা সমস্যার জন্ম দেয়।
এতদিন নানান ছাপা, রঙ, ডিজাইনের সুতি কিংবা প্রিন্ট কিংবা ট্রেটনের লুঙি পরে তারা ড্যাংবাড়ি খেলা খেলত। খেলার শুরুতে সেসব লুঙি তারা মালকোঁচা মেরে রেখে দিত, অথবা হাঁটুর উপর কাপড় ওঠা হারাম বিবেচনায় কেউ কেউ মালকোঁচা না মেরে হাঁটু পর্যন্ত খাটো করে লুঙিটি পরত। কিন্তু খেলার উত্তেজনা মুহূর্তে অবশ্যম্ভাবীভাবে লুঙির মালকোঁচার খুঁট খুলে পড়ত, বা হাঁটুর বহু উপরে উঠে পড়ত। আর এভাবেই তারা লুঙির তলায় ঢেকে দেয়া পরস্পরের শরীরের কোন অংশে শুকনো ঘা অথবা দাদ আছে, তা জেনে যেত। জেনে যেত পরস্পরের নাবালেগ হবার পূর্বাপর ইতিহাস।
অতএব, যত সহজে ডাংগুলি ছেড়ে ক্রিকেট ধরা গেল, তত সহজে লুঙি ছেড়ে প্যান্ট ধরা গেল না।
প্রথম প্রথম মোশাররফের প্রবল আপত্তিজনক ঠাট্টা সত্ত্বেও তারা লুঙি পরেই ক্রিকেট খেলতে শুরু করে। মোশাররফের বলা ‘লুঙি পরি ক্রিকেট খেলন ঠিক না, বিদাশী খেলা, খেলাটার একটা মান ইজ্জত তো আছে’ কথাটিকে তারা তেমন একটা আমলে নেয়নি। কল্যাণপুরে এমনিতেই প্যান্ট পরে কেউ রাস্তায় বের হলে তারা হাসাহাসি করে বলতো, তুই এই চুঙাটার ভিতর ঢুকছস কেমনে, ক চাই?
কিন্তু ক্রিকেট প্রচলনের সপ্তাহ তিনেক যেতে না যেতে বিপত্তিটা ঘটল।
ভুঁইয়া বাড়ির মিনহাজুল একদিন বিকেলে খেলার সময় ক্যাচ ধরতে গিয়ে বুঝতে পারে, অত উপর হতে উড়ে আসা বলটি দুই হাতের তালুতে বন্দি করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। তখন সে বিপুল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখিয়ে দ্রুত হাতে তার মালকোঁচা মারা লুঙির খুঁট খুলে লুঙিটিকে জালের মতো বলের নীচে পেতে দেয়। আর বলটিও সুরুত করে এসে তার পেতে রাখা লুঙির আশ্রয়ে ধরা পড়ে। যেহেতু বলটি মাটিতে পড়েনি, শূণ্যেই ধরা পড়েছে, তাই নিয়মানুযায়ী ব্যাটসম্যানকে আউট ঘোষনা করা হয়। আর তখুনি বিপত্তিটা লাগে। ক্রিকেট খেলায় লুঙি পেতে ক্যাচ ধরা ‘জায়েয’ কি-না, এই নিয়ে দুই প্রতিপক্ষের মতে ভীষণ বিবাদ লেগে যায়। বিবাদের দিন কল্যাণপুরের ক্রিকেটের জনক মোশাররফ গ্রামে উপস্থিত ছিল না, সে ইতিমধ্যে ঢাকা ফিরে গিয়েছে। তাই এ বিবাদটির কোন মীমাংসা করা তাদের পক্ষে সহজ হয় না। তারা তখন ‘কেন লুঙি পরে ক্রিকেট খেলা ঠিক না’—তা কিছুটা বুঝতে পারে।
কিন্তু, এ ‘বুঝ’ তাদের উত্তেজনা প্রশমিত করতে কাজে লাগে না। বাদানুবাদ ক্রমে উত্তেজনায় রূপ নেয়। এবং, উত্তেজনার এক পর্যায়ে তাদের অজান্তেই ছয়টি উইকেট ও দুইটি ব্যাট মোট আটজন খেলোয়াড়ের হাতে হাতিয়ারের মতো উঠে এলে ক্রিকেট খেলার ভিন্ন একটা ‘মাজেজা’ তাদের মনে ‘তিরিক’ করে ঢুকে পড়ে।
এ ঘটনার দিন তিনেকের মধ্যেই কল্যাণপুর হাটের মমিন খলিফার দোকানে উঠতি যুবা-পুরুষের লম্বা লাইন শুরু হয়। মমিন খলিফা প্রতি জনের কোমর আর লম্বার দৈর্ঘ্য ফিতায় মেপে তার খাতায় মাপগুলো টুকে নিতে নিতে পাখি পড়ার মতো বলে যায়, পেন্ট পিন্দবা ভালো কথা, কিন্তুক বেশী চেগাইয়ো না, তাইলে কিন্তুক মাঝখানের সেলাই খুলি যাইব। তখন আবার আমারে দোষ দিয়ো না কইলাম।
অগত্যা তারা বেশী ‘না চেগানোর’ (পা বেশী ফাঁক করা) প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়। এবং স্বল্প দিনের মধ্যেই স্ব স্ব প্যান্ট পরে কল্যাণপুরের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে শুরু করে। শুধু কল্যাণপুরের বুড়ো-বুড়িরা এই প্যান্ট পরা উঠতি যুবা-পুরুষদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকায় আর ভাবে, এই সব পোলাপাইনগুলা এই চোঙা পিন্দি পিশাব করে ক্যামনে?
তিন.
কল্যানপুরের উঠতি যুবাপুরুষদের গণহারে এহেন ‘চোঙা পরিধান’ ও সকাল সন্ধ্যা ক্রিকেট নিয়ে মেতে উঠাতে বয়োবৃদ্ধরা ওদের ‘পিশাব’ করার পন্থা ছাড়াও অন্য আরেকটি বিষয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়।
ড্যাংবাড়ি খেলাটিকে তারা দেখত গরুর পিঠে এবং পাছায় লাঠি চালানোর প্রায়োগিক অনুশীলন হিসেবে। কেননা, কথায় বলে—জরু এবং গরুকে রাখতে হয় ডাণ্ডার আগায়। হাল চাষ থেকে শুরু করে ফসল মাড়াই পর্যন্ত যাবতীয় কাজে ব্যবহৃত গ্রামের গরুগুলোর ‘ত্যাদড়ামির’ খবর তাদের ভালই জানা আছে। লাঠি চালানোর অনুশীলন ভিন্ন এদেরকে যে সোজা রাখা যাবে না, তা তারা জানত। এছাড়াও ড্যাংবাড়ি খেলার আরো একটা প্রয়োজনীয়তাও তারা খুঁজে পেত। কল্যাণপুরের বাচ্চারা মক্তবে, স্কুলে এবং বাড়িতে নিয়মিতভাবে যথাক্রমে হুজুর, মাস্টার ও বাপ-মায়ের বেত্রাঘাত খেয়ে খেয়ে কলেমা-সুরা-কেরাত, অ-য়ে অজগর ঐ আসছে তেড়ে এবং নানাবিধ আদব-লেহাজ শিখতো। আশৈশব এসব বেতের বাড়ি খাওয়ার ঝাল তাদের মনে জমা হতে থাকত। তাই একটু বড়ো হতেই তারা ড্যাংবাড়ি খেলা ধরত এবং মনের মধ্যে বিবিধ জমে থাকা ক্ষোভ ও ঝাল মিটাত ‘ফুত্তি’কে পিটানোর মাধ্যমে।
কিন্তু এখন এই ড্যাংবাড়ি খেলা ছেড়ে ‘বিদাশী খেলা কিরিকেট’ খেললে কী লাভ হবে, তা খুঁজে না পেয়ে বয়োবৃদ্ধদের চিন্তার উদ্রেক হয়।
সুখের কথা, এইসব চিন্তার উত্তর পেতে তাদের খুব বেশী দিন অপেক্ষা করতে হয় না।
কল্যাণপুরে যখন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হতো, তখন প্রতিপক্ষের পোষ্টার ছেঁড়া, ভোটের বাক্স ভরা, প্রতিপক্ষের কোন অপপ্রচারকে প্রতিহত করা এবং একই সঙ্গে ভোটারদের সমীহ আদায়ের জন্য দূরদুরান্তের গাঁ হতে লাঠিয়াল ভাড়া করে আনার প্রচলন ছিল।
ভোটের কয়েকদিন আগেই এই সব ভাড়াটে লাঠিয়ালরা কল্যাণপুরে টহল দিতে শুরু করত। তাদের ঠাক-ঠমক, চাল-চলনে যে দৃপ্ততা ফুটে উঠত, তাতে কল্যাণপুরবাসী মুগ্ধ হয়ে যেত। কোনো নির্বাচন শুরু হলেই তারা খবর নিত— এবার কোন পক্ষ কোন গাঁ থেকে লাঠিয়ার আনছে, বা কয়জন আনছে? এ খবরের পুলকে তাদের শরীর গরম হয়ে উঠত, ভিন গাঁয়ের লাঠিয়ালরা মিছিলে থাকলে তারা একদিন বিকেলে ‘দোয়াতকলম’ মার্কার জন্য এবং পরদিন বিকেলে ‘বটগাছ’ মার্কার জন্য ‘ভোট দিবেন কী সে?’ শ্লোগানে রাস্তা-ঘাট-মাঠ-হাট-বাট গরম করে ফেলত। এবং নিজে—কোন মার্কায় ভোট দিবে—তার সিদ্ধান্ত নিতে ভোটের আগের দিন মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করত। ভোট দেবার সিদ্ধান্তে তারা প্রার্থীদের বরাদ্দকৃত পান-বিড়ি-সিগারেট-মুড়ির গোল্লা-বেলা বিস্কুট খাওয়ানোটাকে বিন্দুমাত্র আমলে নিত না। বরংচ, কোন মার্কায় লাঠিয়ালদের জোর বেশী বলে মনে হচ্ছে, কারা দরকার মতো ভোটের বাক্স কেড়ে নিয়ে ইচ্ছা মত সিল দিয়ে জিতে যেতে পারবে—এই সব খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করত। কেননা, ভোট দেবার প্রতিশ্রুতি বাবদ খাওয়া-খাদ্য তাদের প্রাপ্য রিজিক বলেই তারা জানত। তার চেয়ে বরং জোরওয়ালা মার্কায় ভোট দেয়াই ভালো, তারা বলাবলি করত, ‘ভোট পঁচাইয়া লাভ আছে নি কোনো?’
এ প্রক্রিয়ার ব্যতয় ঘটেছিল সেবার।
উনিশ শো পচাঁশির এক বৃহস্পতিবার কল্যাণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠটিতে তারা কোন রকম লাঠিয়ালের অংশগ্রহণ ছাড়াই ভোট দিতে উপস্থিত হয়। ভোটটিকে তারা বলে ‘মেন্দা মারা ভোট! মার্কা নাই, গরমা-গরমি নাই, কীসের ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ ভোট? এইটা কোন মার্কা হইল?’
তবু তারা মনের সুখে ভোট দিতে যায়। কেবল তারা না, নানান বয়সী বাচ্চাদেরকেও তারা কাঁধে বসিয়ে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যায়। তখন তাদের দেখাদেখি বাচ্চারাও গোঁ ধরে বলে, ‘আব্বা, আমিও একটা ভোট দিমু।’ প্রথমে তারা ভাবে, এটা বোধহয় সম্ভব হবে না। সে মোতাবেক তারা বাচ্চাগুলোকে মৃদু ধমকে উঠে গুলগুলা কিনে দেবার প্রতিশ্রুতিতে ক্ষান্ত করার চেষ্টা করে। তারা বলে, ‘ধুর অ। ভোট দিয়া কী লাভ! তার চাইতে তোরে আবুলের দোকান থেকি গুলগুলা খাওয়ামু।’ বাচ্চাগুলো অন্যদিন হলে যে কোন কিছুর চাইতে গুলগুলা খেতে রাজি হয়ে শান্ত হয়ে যেত। অথচ সেদিন কেন জানি গুলগুলার চাইতে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট দেয়াটাকে তাদের অধিকতর উপাদেয় মনে হয়। তাই তাদের ‘ঘ্যানর ঘ্যানর’ আর থামতেই চায় না। ভাগ্য গুণে সে নির্বাচনের পোলিং এজেন্টদের মন খুব নরম ছিল। তারা বাচ্চাদের কান্না শুনে ঠিক থাকতে পারত না। তাই তারা বাচ্চাগুলোর আব্বাদেরকে বলে, ‘আরে দেক না, দেক একটা ভোট। অসুবিধা নাই। পোলাপাইনের একটা শখ। শখের দাম লাখ টেকা।’ এই সব বলতে বলতে পোলিং এজেন্টরা ব্যালট পেপার বের করে বাচ্চাগুলোকে ‘হ্যাঁ’ লেখা জায়গাটাতে একটা টিপসই দিতে বলে। বাচ্চাগুলোও নরম দিলের পোলিং এজেন্টদের মহানুভবতায় তাদেরকে ‘কাক্কু, আপনে বড়ো ভালো’ বলে প্রশংসা করতে করতে ‘হ্যাঁ’-চিহ্নিত জায়গার উপরে আঙুলের টিপ দিতে থাকলে যুগপৎ বাচ্চাগুলো, তাদের বাবা এবং পোলিং এজেন্টদের মুখ স্বর্গীয় আনন্দে ভরে উঠতে তাকে।
সন্ধ্যা নাগাদ কল্যাণপুরের ‘গ্যাঁদা-আণ্ডা-ছানা’ বয়সী বাচ্চাদের সবগুলো আঙুল ভোটদাতা চিহ্নিত কালিতে রঙিন হয়ে উঠে। সবগুলো আঙুলেই কালি লাগে, কারণ ভোট দিতে তাদের খুব ভালো লেগেছিল, এবং একটা ভোট দিয়েই তারা পুর্নবার দেবার জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর জুড়ে দিয়েছিল। আর মন নরমওয়ালা এজেন্টরা মহা উৎসাহে বাচ্চাগুলোর দিকে ব্যালট পেপার এগিয়ে দিয়েছিল। এভাবে একেকজন আট দশটা করে ভোট দিয়ে, ভোটের কালি মাখা আঙুল মুখে ঢুকিয়ে চুষতে চুষতে মিছিল করে বেড়াতে লাগলো, ভোট দিবেন কী সে? ‘হ্যাঁ’ মার্কা বাকসে।
যদিও এমন নিস্তেজ ভোটে কিছুক্ষনের মধ্যেই কল্যাণপুরের বয়স্কদের মন উঠে যায়, তারা পূর্বে উক্ত ‘মেন্দা মার্কা ভোট’টিকে এবারে ‘দুধ খাওয়া পোলাপাইনের ভোট’ আখ্যা দিয়ে এবং ভোট দেয়া বাদ দিয়ে নিজেরাই আবুলের দোকানে দুধ চা আর গুলগুলা খেতে খেতে হাসাহাসিতে মেতে উঠে।
এ মেন্দা মার্কা নির্বাচনের বছর খানেক পরেই তাদের আফসোস মিটিয়ে দেবার জন্য আরেকটি নির্বাচনের ঢেউ আছড়ে পড়ে তাদের জীবনে। এবং তখুনি মূলতঃ ক্রিকেট খেলাটার অতি প্রায়োগিক দিকটি তাদের কাছে ধরা পড়ে।
চার.
ক্রিকেট খেলা রপ্ত হয়ে যাবার পর থেকে কল্যাণপুরের চল্লিশের ধোক্কায় পড়ার ও বাতের ব্যথায় কাতর হওয়ার আগ পর্যন্ত যাবতীয় পুরুষেরা ক্রিকেট খেলতে শুরু করে। তখন আবার ড্যাংগুলি খেলার চিরপ্রতিদ্বন্ধি ‘বদির গ্রুপ’ ও ‘বশির গ্রুপ’ পরস্পরের সাথে ছক্কা মারার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়।
বদি জোরসে ছক্কা মেরে তালগাছের আগায় বল তুলে দিয়ে বশিরকে দেখায়, ভাল করে চাইয়্যা দেখ, কেমনে ছক্কা মারতে হয়?
বশির ফিরতি ছক্কায় বলটিকে মিধ্যা বাড়ির দিঘির মাঝখানে পাঠিয়ে বলে, ছক্কা মারি গেরাম পার করি দিমু, আমার লগে টাল্টি বাল্টি?
বদি বলে বেড়ায়, টিমও লাগতো না ব্যাটা। আমি একলা খেলুম বইশ্যার টিমের লগে।
বশির বলে বেড়ায়, বইদ্যারে কইছ বস্তা লই আইতে খেলার সময়। রান বস্তাত বাইন্দা নিতে পারব।
বদি বলে বেড়ায়, বইশ্যারে কইছ, শরীলে জোব্বা-জাব্বা বান্দি আসতে। আমি বল বাইড়ান ধরলে রে, মা মা কইয়া চিল্লাইব।
বশির বলে বেড়ায়, বইদ্যার লগে দুই চোখ বান্ধি ব্যাট করমু। হে টেরও পাইব না, চার ছক্কা হইব কোন দিক দিয়া।
দেখা যায়, সেই পুরনো ধারা মোতাবেক হুমকি ধামকি চলছেই। তখন তারা ঠিক করে, তাইলে পনের ওভার করি প্রতিযোগীতার খেলা হোক। তাইলেই কার হেডম কতদূর বোঝা যাইব। ঠাণ্ডা খাওনের বেট।
এই হেতু বাজার হতে দুই লিটারের কোকা কোলার একটি বোতল এনে খালের কচুরিপানা ছাওয়া পানির তলে ডুবিয়ে কল্যাণপুর প্রাইমারী স্কুলের মাঠে ‘বেটের খেলা’ শুরু হয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, দিনটি ছিল রবিবার। ঊনিশশো ছিয়াশি সালের চৌঠা মে, একুশে বৈশাখ তেরোশো বিরানব্বই বঙ্গাব্দ।
কয়দিন ধরেই প্রতি বিকেলে বিকেলে আকাশ কালো করে আসছিল, আর আচমকা কালবৈশাখী শুরু হয়ে যাচ্ছিল। তাই ঝড়-বৃষ্টি হবার আশংকায় একতা সংঘের পক্ষ হতে চাঁদা তুলে শুক্রবার মসজিদে মিলাদও পড়ানো হয় যাতে আকাশ পরিষ্কার থাকে। মসজিদের ইউনুস মাওলানা—খেলাধূলার জন্য মিলাদ পড়ান ঠিক হবে কি না, ভেবে ইতস্তত করেছিলেন, তখন লতিফ জোয়ার্দ্দার (যিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি) হুজুরকে মৃদু ভৎর্সনা করে বললেন, ‘পোলাপাইনের একটা শখ। শখ মিটানোও একটা ছওয়াবের কাজ। শখ মিটানোর জন্য মিলাদ পড়া হইব, তাইলে তো ছওয়াব দ্বিগুণ হওনের কথা! কী আপনে গোঁ গোঁ করেন—’। এ কথায় কাজ হয় ‘তুরগ’ গতিতে, ইউনুস মাওলানা আর কোন কথা না বাড়িয়ে সুরেলা গলায় শুরু করে দেন, ইয়া নাবী সালা মালাইকা, ইয়া রাসূল সালা মালাইকা…
রবিবার দিন সকালে আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হলে তারা মনে মনে ভাবতে শুরু করল, তবে কি মিলাদের নারিকেলি বিস্কুট খাওয়ান বাবদ বার টাকা আর হুজুরকে দেয়া পাঁচটাকা মিলিয়ে পুরো সতের টাকা জলে গেল? দোয়ায় তাইলে কাজ হইল না? কিন্তু দুপুর গড়াতে না গড়াতেই তাদের আশংকা মিথ্যে প্রমাণ করে সারা আকাশ হতে মেঘ সরে গিয়ে ঝকঝকা রোদ উঠল, এবং তারা দলে দলে কল্যাণপুর প্রাইমারী স্কুলের মাঠে জমা হতে লাগলো।
অবশ্য মাঠে দলে দলে জমায়েত হতে তাদের আলাদা কষ্ট করে দল পাকাতে হয়নি। গত কিছুদিন ধরে তারা দলে দলেই ঘুরছিল। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে জাতীয় নির্বাচনের ঢেউতে যে বিয়ে লাগার মতো সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল, তার ধাক্কায় কল্যাণপুরের যাবতীয় দোকান পাট, ঘরের বেড়া, পায়খানার পর্দা, স্কুলের দেয়ালসহ জায়গা-অজায়গায় নানাবিধ মার্কাকে ভোট দেবার জন্য অনুরোধ-হুমকি-ধামকি উৎকীর্ণ হতে দেখা যাচ্ছিল। এক বছর আগের মেন্দা মার্কা ভোটটির যাবতীয় শোক ভুলিয়ে দিতেই যেন নানান প্রতীক, ব্যানার, পোষ্টার, টুপি, কোট-প্যান্ট, শেরোওয়ানীতে ছয়লাপ হয়ে যায় চারদিকে। স্কুলের মাঠে খেলা দেখতে জমায়েত হলে তারা দেখতে পায় সমগ্র স্কুল, স্কুলের মাঠ অতি চমৎকার সাজে সাজানো। মাঠের এপাশ হতে ওপাশ লম্বা লম্বা টানানো দড়িতে নানান পোষ্টার আর ব্যানারে শোভিত। তখন তাদের মনে পড়ে, আরে দুই দিন পরে এই স্কুলের মাঠেই তো ভোট হইব। এ রঙিন সাজে দর্শক এবং খেলোয়াড়দের মন অতি প্রফুল্ল হয়ে উঠে। তারা জেয়াফত খাবার আনন্দে মেতে উঠার মতো হেসে উঠে।
কিন্তু, খেলা শুরু হতেই শুরু হয় বিপত্তি।
ছক্কা মারতে না পারলে ক্রিকেট খেলায় সুখ নাই, সম্মানও নাই। তাই প্রথমে টসে জিতে যখন বশির গ্রুপের দল ব্যাট করতে নামে, নেমেই তারা দমাদম ছক্কা হাঁকাতে যায়। অথচ ছক্কা হাঁকাতে গেলেই বল গিয়ে লাগে উপরে টানানো কোন পোষ্টারে, লেগে ‘ফটাস’ করে শব্দ হয়। সে শব্দে তাবত লোকজন হেসে উঠে, পোষ্টারটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। আর ‘ত্যাদড়’ বলটি গিয়ে লাগে হয় পোষ্টারে ছাপানো নূরানী চেহারার প্রার্থীর গাল ফোলা চোয়ালে, না হলে ’অমুক ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র’ শ্লোগানে। একটা করে পোষ্টার ফেটে চৌচির হয়, আর সবাই হুড়াহুড়ি করে দেখতে যায় বলটি ‘গালে’ লেগেছে না ‘চরিত্রে’। তখন তারা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে থাকে। এবং গড়াগড়ি দিতে দিতে পরস্পর বলাবলি করতে থাকে, ‘দেখ দেখি, ছক্কা লাগি অমুক কেরুম ভ্যাটকাইয়া রইছে, হা হা হা হা।’ অথবা, ‘ছক্কাটায় অমুকের চরিত্রে কালি লাগাইয়া দিছে, ছিঁড়ি ভিতরের খবর সব বাহির হই গেছে, হি হি হি।’
এ হাসি-ঠাট্টায় বদির গ্রুপ যোগ দিলেও বশির গ্রুপের ব্যাটসম্যানরা এ দূর্গতিতে মারাত্নক ব্যাজার হয়। সারা মাঠ জুড়ে ফটাস ফটাস শব্দ শোনা যেতে থাকে, অথচ ছক্কার দেখা পাওয়া যায় না। তখন তারা বদির গ্রুপকে বলে, ‘দেখি, তোরা কেমনে ছক্কা মারস!’
কিছুক্ষণ পর বদির গ্রুপ যখন ব্যাটিং করতে শুরু করে, দেখা যায় সমান রকম বিপত্তি তাদেরকেও পেয়ে বসে। কেননা, মাঠে পোষ্টারের কোন কমতি ছিল না। তারাও সমানে ছক্কা মারতে থাকে, আর এ কোণায় ও কোণায় ফটাস ফটাস করে কোন প্রার্থীর গালে লাগে কিংবা কোন প্রার্থীর চরিত্রে লেগে যথাক্রমে উক্ত প্রার্থীর চেহারা ভ্যাটকাতে থাকে অথবা তার চরিত্রের ভিতরের খবর বের হতে থাকে।
এ অবস্থায় যেহেতু স্বাভাবিক জয়-পরাজয় নির্ধারণ করা দুরুহ হয়ে পড়ে, তখন তারা মাঠে উপস্থিত প্রধান অতিথি লতিফ জোয়ার্দ্দারের শরনাপন্ন হয়।
লতিফ জোয়ার্দ্দার তার আরাম কেদারাটিতে বসে খেলোয়াড়দেরকে অভ্যাসমত টিপস দিয়ে যাচ্ছিলেন। সমস্যা গুরুতর বিবেচনায় তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করেন। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি দেন: তাইলে এক কাম কর, রান-টান বাদ দাও। ফাটা-ফাটির খেলা খেল।
সিদ্ধান্তটি হয় এরকম: যে দল যত বেশি পোষ্টার ফাটাতে পারবে, সে দল জয়ী হবে।
এ দারুণ আইডিয়ায় আবার প্রথম থেকে খেলা শুরু হয়। এবারে ব্যাটসম্যানরা চার-ছক্কা মেরে রান করা বাদ দিয়ে উপরে টানানো পোষ্টার লক্ষ্য করে ব্যাট করতে থাকে, আর একটা একটা করে পোষ্টার ফেটে চৌচির হয়ে উড়তে থাকে আকাশে বাতাসে।
পাঁচ.
সেই প্রথম কল্যাণপুরের জনগণ বুঝতে পারে, ছক্কা মেরে নির্বাচনের পোষ্টার ফাটানো কত আনন্দের!
একই সংগে আরেকটা গূঢ় আনন্দও তাদের চোখে ধরা পড়ে।
এই যে পোষ্টারের পর পোষ্টার জুড়ে নূরানী চেহারা আর ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রের ছড়াছড়ি, তাদের প্রতি একটা বিজাতীয় বিতৃষ্ণা তাদের সবসময়ই ছিল। কল্যাণপুরের যে কোন অধিবাসীকে জিজ্ঞেস করলেই, সে জিকির করার মতো এক দমে বলে যেতে পারবে: কোন চেয়ারম্যানের আমলে কত বস্তা গম তাদের জন্য এসেছিল, এবং কয় কেজি তাদের মধ্যে বিতরণ হয়েছিল; কোন চেয়ারম্যান শুধু তার বাড়ির সামনের রাস্তায় মাটি ফেলে পাহাড়ের মতো উঁচু করে তুলেছিল, যেখানে কল্যাণপুরের বড় রাস্তায় এখনো একটু বৃষ্টিতেই পানি উঠে যায়; কোন মেম্বার টাকা খেয়ে কার তালগাছ আরেকজনের বলে রায় দিয়েছিল কোন সালিশে —এমনি হাজারো নালিশ যা মুখ ফুটে বলার মতো মাথা তাদের ঘাড়ের উপর একটাই আছে বিবেচনায় বলার সাহস পায়নি সারাজীবন। এখন ছক্কা মেরে তাদের পোষ্টার ফাটিয়ে ঝাল তোলার একটা অবাধ সুযোগ এসে যাওয়ায় ক্রিকেট খেলাটির প্রায়োগিক দিকটি এলাকার চিন্তিত বৃদ্ধদের চিন্তা দূর করে দেয় অবশেষে। তারাও ক্রিকেটের ভক্ত হয়ে পড়ে সহসা। অচিরেই খেলোয়াড়রা স্কুলের মাঠ ছেড়ে সারা এলাকায় যত পোষ্টার আছে সেসব ‘ছক্কা মেরে মেরে’ ফাটাতে শুরু করে, এবং এক পর্যায়ে যখন সব পোস্টার ফাটানো হয়ে যায়, তখন তারা ভীষণ মুষড়ে পড়ে।
তাদের মনে হয়: হায় হায় রে! ফাটানোর জন্য পোষ্টার পামু কই এখন?
এলাকার ছেলেপুলেদের এমন মুষড়ে পড়ায় গ্রামের মুরুব্বীরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা ছেলেপুলেদের সান্তনা দেয়, চিন্তা কইরো না, বেশি দেরি নাই, আবার নির্বাচন আইব, দিন যত যাইব গাল ফোলা প্রার্থীর সংখ্যাও বাড়ব, চরিত্র আরো পবিত্র হইতে থাকব, পোষ্টারও অনেক বাড়ব। দেখবা তখন ফাটাইতে আরো মজা পাইবা। খালি ছক্কা মারবা আর পোষ্টার ফাটাইবা। তোমরা খালি ছক্কা মারার অভ্যাসটা চালাইয়া যাও। দিন তো সবে শুরু, সামনে আরো দিন আসতেছে।
এবং ছেলেপুলেদের মনে অতিরিক্ত উৎসাহ জোগানোর জন্য মুরুব্বীরা ভাঙা গলায় এ গানটাও শুনিয়ে দেয়: এই দিন, দিন না, আরো দিন আছে, এই দিনেরে নিবা তোমরা সেদিনেরও কাছে, এ এ এ…
অবশ্য শেষের ঐ ‘এ এ এ’ টানটা গাইতে পারে না তারা। দমে কুলায় না। তার আগেই খক্ খক্ কাশি এসে গলার সুর আটকে দেয়।
মুরুব্বীদের এসব কথায় ছেলেপুলেরা প্রথম-প্রথম খুব একটা আমলে নেয় না। তারা জানে, তাদেরকে ভুলিয়ে রাখার জন্য মুরুব্বীরা এমন কত কথাই না বলে। তবু, একটা ক্ষীণ আশাতেই তার ছক্কা মারার অভ্যাসটা চালিয়ে যাচ্ছিল।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কল্যাণপুরের মুরুব্বীরা মিথ্যে আশ্বাস দেন নাই।
সেই নির্বাচনের পাঁচ মাস পর আরেকটা, সোয়া বছর বাদে আরেকটা, বছর দেড়েক বাদে আরেকটা—মোটকথা একটার পর একটা নির্বাচন শুরু হয়। একটা প্যাঁচ লাগে, তা খুলতে একটা নির্বাচন হয়, তখন পুরনো প্যাঁচ খোলার আগেই আরেকটা প্যাঁচ লেগে যায়, তা খুলতে কয়দিন পর আরেকটা নির্বাচন শুরু হয়। জাতীয়, উপ, অন্তবর্তী নির্বাচনের সাথে পাল্লা দিয়ে দলের সংখ্যা বাড়ে। দল বাড়লে মার্কা বাড়ে। মার্কার অনুপাতে প্রার্থী বাড়ে, এর এসব প্রার্থীদের চেহারার নূরে আকাশে বাতাসে ‘বেদিশা-বেদিশা’ ভাব প্রকট হয়ে উঠে। তাদের গাল ও ভূঁড়ি ক্রমশঃ স্ফীত হতে দেখা যায়, সাথে সাথে তাদের চরিত্রও পবিত্রতর হয়ে উঠতে থাকে।
এভাবে নির্বাচন বাড়ে, মার্কা বাড়ে, প্রার্থী বাড়ে, পোষ্টারের সাইজ বাড়ে, পোষ্টারের সংখ্যা বাড়ে, আর সংখ্যা বাড়লে বেশি ফাটানোর সুযোগ পাওয়া যায়, বেশি ফাটালে বেশি মজা পাওয়া যায়।
ঠিক এমন মধুর সময়ের ও সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল কল্যাণপুরের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা। তারাও মনের সুখে ছক্কা মেরে মেরে যাবতীয় প্রার্থীর চেহারা ও তাদের চরিত্রের সার্টিফিকেটধারী পোষ্টারগুলোকে ‘ভ্যাটকাইয়া’ দিয়ে ধুনে তুলা তুলা করে দিতে থাকে। কল্যাণপুরের আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়াতে থাকে পোষ্টারের কংকাল।
উপসংহার:
সেই থেকে কল্যাণপুরে পোষ্টার লাগানোর ব্যাপারে ভোটে দাঁড়ানো প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা দিতে শুরু করে। তারা উদাস হয়ে বলে, ‘থাক, পোষ্টার লাগানোর কাম নাইকা। এ এলাকায় এমনিই ভোট হইব।’ এসময় তাদের চোখ যুগপৎ নির্ঘুম, ফোলা ফোলা ও লাল লাল দেখা যায়। কেননা, দেখা গেছে, ভোটে দাঁড়ানোর দিন থেকেই তাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। একটু ঝিমুনি আসলেই ‘ফটাস, ফটাস, ফটাস’ শব্দে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে তার ফোলা গালে হাত বোলায়, এবং অর্ন্তগত চরিত্রের গায়ে মন বোলায়, এবং হাত ও মন বোলাতে বোলাতে দুঃস্বপ্ন দেখার আতংক নিয়ে জেগে বসে থাকে।
এভাবেই টি২০ খেলার আসল মজা যে ধুমধাড়াক্কা ছক্কা পিটানোয়, তাতে হাত পাকানোর একটি ঐতিহ্য প্রজন্ম পরম্পরায় চলে আসছিল কল্যাণপুরের ইতিহাসে। এবং সেটার প্রচলন হয়েছিল এ যুগের টি২০ খেলাটি উদ্ভব হওয়ার বহু আগে থেকেই।
বলাবাহুল্য, এতদিন পরে সুযোগ পাওয়া মাত্র কল্যাণপুরের দুই কৃতি সন্তান তাদের এলাকার ঐতিহ্য দেশবাসীর কাছে ‘সপাটে’ তুলে ধরার মোক্ষম উপলক্ষ্যটি বিন্দুমাত্র হাতছাড়া করেনি।
পাদটীকা:
কল্যাণপুরের এই গূঢ় ইতিহাসটি বর্তমান কাহিনীকার কর্তৃক প্রকাশিত হয়ে পড়লে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সরেজমিনে কল্যাণপুর পরিদর্শনে যান। সেখানে তারা নানা বয়সী লোকজনের সাথে কথা বলে এই প্রতিবেদনেরই প্রতিধ্বনি শুনতে পান। ঢাকায় ফিরে এসে এই পরিদর্শক টিমটি একটি দীর্ঘ আবেদনপত্র পেশ করেন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (নিক) বরাবর। আবেদনপত্রে গত কিছু বছর যাবত কম সংখ্যক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হওয়াটাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নয়নের পথে ‘একটি অশনিসংকেত, বিপুল বাধা ও চরম হুমকিস্বরূপ’ উল্লেখ করা হয়। উক্ত আবেদনপত্রটির কিছু অংশ নিচে উদ্ধৃত হলো :
“… এতএব মহোদয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক উন্নয়নে—বিশেষত, অন্যান্য দেশের তুলনায় টি২০ এর মতো ধুমধাড়াক্কা খেলায় আমাদের অনগ্রসরতা ও অদক্ষতা বিবেচনা করে, এবং এতে লক্ষ্যণীয়মাত্রায় উন্নয়নকল্পে—সারাদেশ জুড়ে আরো শত শত দলের অংশগ্রহণে জাতীয়, উপ, মধ্যবর্তী, অন্তবর্তী ইত্যাদি সব ধরনের নির্বাচনের পুনঃ পুনঃ আয়োজন করা হোক। এবং এসব নির্বাচনে ভূঁড়িওয়ালা, গালফোলা, খোদার খাসীটাইপ প্রার্থীদেরকে মনোনয়ন দেয়া হোক, যাতে কল্যাণপুরের উদ্যোমী জনগণের মতো সারাদেশের জনগন চার-ছক্কা প্র্যাকটিসের অবাধ সুযোগ পায়। কেননা, আমাদের কৌতূহলের মুখে কল্যাণপুরবাসী জানিয়েছে, এ জাতীয় প্রার্থীদের গাল ও চরিত্র লক্ষ্য করে ছক্কা হাঁকাতে তারা অতিশয় উৎসাহিত বোধ করে, এবং তারা আশা প্রকাশ করেছে যে, অন্য এলাকার লোকজনও এতে একবার মজা পেয়ে গেলে তাদেরও উৎসাহে বিন্দুমাত্র ঘাটতি হবে না। এমত বিবেচনায় আমরা নিশ্চিত যে, এর প্রভাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আন্তজার্তিক মানের ধুমধাড়াক্কা ব্যাটসম্যান বেরিয়ে এসে টি২০ খেলায় আমাদের ক্রিকেটকে, তথা দেশের সম্মানকে জগৎবাসীর কাছে…”
বি. দ্র: হাতের কাছে স্মারক লিপিটির কোন কপি না থাকাতে উপরের উদ্ধৃতিটি স্মৃতি হতে লেখা হলো, তাই বাক্যগুলোতে কিছু শব্দ এলোমেলো হতে পারে, এজন্য এই কাহিনীকার আন্তরিকভাবে দুঃখিত।