
তারাশঙ্করের গণদেবতা ও অরণ্য বহ্নি : বিষয় ও শিল্পলোক
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (২৩ জুলাই, ১৮৯৮—সেপ্টেম্বর ১৪, ১৯৭১) বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তিনি তাঁর সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, যা তাঁর সবচেয়ে বড় একটি গুণ। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তাঁর অনেক গল্প ও উপন্যাসের বিষয়। আরও আছে গ্রামীণ জীবনের ভাঙনের কথা, নগর জীবনের বিকাশের কথা।
তার সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পগ্রন্থ, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধের বই, ৪টি আত্মজীবনী, ২টি ভ্রমণ কাহিনী, ১টি কাব্যগ্রন্থ এবং ১টি প্রহসন লিখেছেন।
বাংলা ভাষার মহান এই কথাসাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবসে প্রতিকথার পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
জীবন ও শিল্পস্বরূপ
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যে একটি নাম। কবিতার মধ্যদিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে তার অনুপ্রবেশ হলেও পরবর্তী পর্যায়ে তিনি কথাসাহিত্যকেই শিল্পসাধনার মাধ্যম করেন। তাঁর উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য গ্রামীণ জনজীবন ও জাতিসত্তার গভীরের প্রোথিত চেতনার নবরূপায়ণ। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারা তার কথাসাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছে মানুষের চেতনালোকের শক্তি হিসেবে। আধুনিক প্রযুক্তি ও আভিজাত্যের তোড়ে পুরনোর সংস্কৃতির বিপন্নতার যে আশঙ্কা—তা চিত্রায়ণ দেখা যায় তার উপন্যাসে। তিনি রাঢ় আঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনই আঁকেন তার কথাসাহিত্যে। গবেষক তাঁকে বলেন :
তিনি সমাজবিজ্ঞানী কিংবা নৃতত্ত্ববিদ ছিলে না। কিন্ত তাঁর ছিল এক অন্তর্ভেদী সমাজদৃষ্টি ও জীবনদৃষ্টি। স্বকীয় এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তিনি তাঁর উপন্যাসে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষের স্বউৎস নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে রূপ দিতে সমর্থ হয়েছেন। আদিবাসী মানুষের জীবন নিয়ে রচিত তারাশঙ্করের উপন্যাসসমূহ আজ কেবল সাহিত্যেরই গৌরব নয়; জ্ঞানের আন্তঃশাখার, বিশেষত নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাসবিদ্যা ও ভূগোলশাস্ত্রের বিদ্যার্থী ও গবেষকদের কাছেও আকরগ্রন্থ মর্যাদায় ভূষিত। (মোঃ সেলিম ভুঞা ২০১০। তারাশঙ্করের উপন্যাস কৌম জীবনের রূপায়ণ। ঢাকা : বাংলা একাডেমি। পৃ-০১)
সাহিত্য-বৈশিষ্ট্য
‘ত্রিপত্র’ নামক কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যজগতে তাঁর আবির্ভাব। ‘ত্রিপত্র’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯২৬ সালে। তারাশঙ্করের ব্যক্তিমানসে ছিলো তুমুল কাব্যবোধ। বাংলা কথাসাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ ঘটেছিলো। মূলত কাব্যবোধ মানুষকে করে তুখোর অনুসন্ধানী। কেনো না কবি মাত্রই নতুনের পূজারী। এই নতুনত্বের কারণেই তাঁরা ব্যক্তি ও সমাজ ও ভৌগোলিক খণ্ডে খুঁজে ফেরেন মানবচরিত্রের রহস্য ও জাতিসত্তার উৎস। কথাটি বেশি পরিমাণে প্রযুক্ত তারাশঙ্করের ক্ষেত্রে। তিনি সারাটি জীবন তার শিল্পে মূলত মানব উৎস ও প্রাগৈতিহাসিক যুগের থেকে জীবনধারার স্বরূপ অনুপুঙ্খ ব্যবচ্ছেদ করার কাজে নিমগ্ন ছিলেন; সেই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ও সভ্যতার তোড়ে পুরনো সংস্কৃতি ও বিশ্বাস উৎপাটনে প্রক্রিয়াটিও চিত্রায়ণ করেছেন। জাতিসত্তার মৌলধারার রূপ অনুসন্ধানী শিল্পী বাংলা সাহিত্যে কম পরিমাণেই দেখা যায়। আর এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় :
প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ধরে তিনি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি বিভাগেই লিখেছেন অনেক। সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর জীবনের দ্বিতীয়ার্ধ ছিল সাফল্যের এক উল্লেখযোগ্য পর্ব। এই পর্বে তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সম্মান ও পুরস্কারেও তিনি সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর কথাসাহিত্যে একদিকে যেমন বাংলাদেশের জীবনযাত্রা সাহিত্যিক বাণী লাভ করেছে, অন্যদিকে তেমনি বাঙালি জীবনের পরিবর্তনমান কালসীমাও তাঁর সাহিত্যে চিহ্নিত হয়ে আছে। তবুও কথাকোবিদ তারাশঙ্করের সাহিত্য মূল্যায়নকালে তাঁর রচনায় যে সাধারণ সূত্রটি সবার আগে চোখে পড়ে, সে হলো দেশ, কাল, সমাজ ও দ্বন্দ্বময় রূপ ও সে সম্পর্কে তার সচেনতা। সমকালের সমস্যা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি যেমনই হোক না, সমকালের দিকে তিনি কখনই মুখ ফিরিয়ে থাকেন নি— সাহিত্যিক হিসেবে এখানেই তার গুরুত্ব। আর এ কারণে তার সাহিত্য একদিকে যেমন অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, অন্যদিকে তেমনি তাঁর জীবৎকালেই তাঁর সাহিত্যকৃতি সম্পর্কে আলোচনা ও গবেষণা শুরু হয়েছে। (সমরেন্দ্রনাথ মল্লিক ১৯৯১ । তারাশঙ্কর : জীবন ও সাহিত্য। কলকাতা : প্রতিভাস, পৃ-১৫)
তারাশঙ্করের লেখায় সাধারণত রাঢ়বঙ্গের কথাই বহুল পরিমাণে চিত্রিত। বিশেষ করে তার লেখায় পাওয়া যায় বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের সাঁওতাল, বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের কথা। ছোট বা বড় যে ধরনের মানুষই হোক না কেন, তারাশঙ্কর তাঁর সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, যা তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় গুণ। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তাঁর অনেক গল্প ও উপন্যাসের বিষয়। সেখানে আরও আছে গ্রাম জীবনের ভাঙনের কথা, নগর জীবনের বিকাশের কথা। তিনি জাতিসত্তার পরিচয় খুঁজতে ঐতিহ্যের গহীন গভীর স্তরে গমন করেছেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য; তাদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন রীতিনীতি; পারিবারিক স্থানিক সংস্কৃতি; তাদের ক্ষুধা-আশা; সংগ্রাম প্রতিবাদ; পুরনো বিশ্বাস; ধ্যান-ধারণা; প্রভৃতি বিশ্বস্তায় চিত্রিত হয়েছে তাঁর লেখায়। আধুনিক যন্ত্রজীবনের তোড়ে পুরনো ধ্যান-ধারণনা বিশ্বাস; ঐতিহ্যের অকাল মৃত্যু; তথাকথিত শিক্ষিত আভিজাত্যের অন্তঃসারশূন্যতা; মহাজন ও ভূমিস্বামীদের দৌরাত্ম্য; স্বৈরাচার শাসকের শোষণ-শাসন প্রভৃতি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন তাঁর উপন্যাসে। গবীর-দুঃখী মানুষের প্রতি তার ছিলো প্রবল টান। এই কারণে দেখা শিল্প রচনাই করেননি। নিজে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মি হিসেবে রাজপথে নেমেছেন। কারাভোগ করেছেন। অন্যায়; শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর যে প্রতিবাদ তা তাঁর কথাসাহিত্যে ঘুরেফিরে এসেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি মানব-রহস্য; মানবের বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই ও শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও জীবন নামক মহাকাব্যের আলেখ্যই তার শিল্পের প্রধান অনুষঙ্গ হয়েছে।
গণদেবতা
‘গণদেবতা’ উপন্যাসের উপন্যাসের কাহিনী গ্রাম জীবন থেকে নির্বাচিত হয়েছে। গ্রামীণ জীবনের নিস্তরঙ্গ পরিবেশে অধিবাসীরা পুরনো ধ্যান-ধারণা, রীতিনীতি; বিশ্বাস ও সংস্কার মেনেই জীবনযাপণ করে। আধুনিক অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে গ্রামীণ ভূম্বামী ও মহাজনদের অত্যাচার ও শোষণে তাদের জীবনে আসে বিপর্যয়ের ঘনঘটা— সেটাই এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছে। এই উপন্যাসের চরিত্ররা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীভুক্ত; চাষী ও গৃহস্থ। এই উপন্যাসে মূল্যায়নের গবেষকের মন্তব্য উল্লেখ করা যায় :
গণদেবতা (১৯৪২) উপন্যাসের পল্লীজীবনের আর একটা সমস্যাসঙ্কুল দিক্ উদ্ঘাটিত হইয়াছে। এখানে আধুনিক অবস্থা-পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রাম্যসমাজের প্রাচীন রীতি-নীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কথা আলোচিত হইয়াছে; গ্রাম্য পঞ্চায়েতের আত্মনিয়ন্ত্রণ-প্রচেষ্টা, সমাজশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়াস বর্তমান যুগের অনুপযোগী প্রতিবেশে কিরূপে প্রতিহত হইয়াছে তাহাই উপন্যাসের বর্ণনার বিষয় “(শ্রীকুমার (১৯৯২ : ৫৫৫)
উপন্যাসের আখানবিন্যাসে দেখা যায় কাহিনিতে চারটি বাঁক আাছে। বাঁক চারটি উপন্যাসের কাহিনিকে প্রভাবিত ও পল্লবিত করেছে। উপন্যাসের সৃজ্যমান চরিত্রগণ উপন্যাসের আখ্যানে নিজস্ব প্রতিনিধিত্ব অক্ষুণ্ন রেখেছে। সমাজবির্বতনের ধারায় উচ্চবিত্তরা অবক্ষয়ী স্রোতধারায় নিম্নগামী হয়েছে আবার নিম্নবিত্তরা অভিজাত বা উচ্চবিত্তে আসীন হয়েছে। অবস্থা রূপান্তরের ধারায় কেউ কেউ পুরনো মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরে আছে আবার কেউ যুগ পরিবর্তনের ধারায় নুতন নতুন চেতনা ও বিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়েছে। উপন্যাসে দেখা যায় জমিদার দ্বারিক চৌধুরী জমিদার পর্যায় থেকে চাষীতে আবার অনুরূপ বিক্রিয়া শ্রীহরি পাল চাষী থেকে জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। দেবুপণ্ডিত অতিরিক্ত মাত্রায় আদর্শবাদে এবং মহামহোপাধ্যায় শিবশেখরেশ্বর ব্রাহ্মণ্য ধান-ধারণায় পুরনো ভক্তি ও বিশ্বাসে অবিচল থেকেছে। গ্রামজীবনের পটভূমিতে উপন্যাসের চারটি বাঁকে উপন্যাসের আখ্যান পরিপুষ্টতা পেয়েছে।
উপন্যাসের আখ্যানে দেখা যায় গ্রামসমাজ শাসনের ভিত্তি ছিলো পুরনো রীতিনীতি বিশ্বাস ও ভক্তি। আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রযুগের প্রভাবে উৎপাদনমুখী সমাজব্যবস্থায় মানুষ যখন নিজের অধিকার ও স্বাতন্ত্র্য বুঝতে সক্ষম হলো; তখন দেখা গেলো একদিকে সামন্তপ্রভুদের পুরনো বিশ্বাসে যেমন ধস নেমেছে তেমনি নতুনকালের তোড়ে নবীন প্রতিনিধি তার নতুন চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছে। ধনতন্ত্রের তোড়ে নতুন সম্প্রদায় পুঁজিবাদী হয়ে উঠলেও সমাজব্যবস্থায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেনো না শিল্পবিপ্লবের ফলে নতুন যে ধনিক শ্রেণির উন্মেষ ঘটেছিলো তাদের আদর্শবাদ ও নীতিনৈতিকায় মানবকল্যাণমুখী হয়ে উঠতে পারেনি। এই কারণে ভূস্বামীদের অত্যাচারে বড় নাকাল হতে হয়েছে গৃহস্থ-চাষীদের। আবার নগরসভ্যতা গৃহস্থ চাষীদের জীবনে তো কোনো আশীর্বাদ বয়ে আনতে পারেনি বরং তাদের জীবনে নিয়ে এসেছে চরম দুর্ভোগ। ঔপন্যাসিক ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় উপন্যাসের পটভূমি ও কাহিনি নির্বাচনে গ্রামজীবনকে তুলে ধরেছেন। সেই নগরায়ণের কুফল দেখিয়েছে চাতুর্যময়তায়: প্রসঙ্গত দৃষ্টান্ত দেয়া যায় :
কারণ সামান্যই। সামান্য কারণেই গ্রামে একটা বিপর্যয় ঘটিয়া থাকে। এখানকার কামার অনিরুদ্ধ কর্মকার ও ছুতার গিরিশ সূত্রধর ওপারে বাজারে-শহরটায় গিয়া একটা করিয়া দোকান ফাঁদিয়াছে। খুব ভোরে উঠিয়া যায় ফেরে রাত্রি দশটায়। ফলে গ্রামের লোকের অসুবিধার আর শেষ নাই। এবার চাষের সময় কী নাকাটাই যে তাদের হইতে হইয়াছে, সে তাহারাই জানে। লাঙলের ফাল পাঁজানো গাড়ীর হাল বাঁধার জন্য চাষীদের অসুবিধার অন্ত ছিল না। গিরিশ ছুতারের বাড়িতে গ্রামের লোকের বাবলা কাঠের গুঁড়ি আজ স্তুপীকৃত হইয়া আছে সেই গত বছরের ফাল্গুন-চৈত্র হইতে। কিন্তু আজও তাহার নতুন লাঙল পাইল না। (তারাশঙ্কর ২০১৬ : ০৩ )
উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনায় বর্ণাত্মকরীতি পরিসৃত হয়েছে। বিশ্লেষণাত্মকরীতির কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। ঔপন্যাসিক বিবৃতমূলক গদ্যে সরলভঙ্গিতে উপন্যাসের আখ্যান বর্ণনা করেছেন।
কোনো উপন্যাসের শিল্পসার্থকতা নির্ভর করে চরিত্র-চিত্রায়ণের উপর। চরিত্রপ্রধান উপন্যাস না হলে উপন্যাসমাত্রই চরিত্রচিত্রায়ণে ঔপন্যাসিকের শিল্পকুশলতা পরিলক্ষিত হয়। কেনো না চরিত্রের হাত ধরেই উপন্যাসের উপন্যাসের কাহিনি বা আখ্যান অগ্রসর হয়। আখ্যানকে অগ্রবর্তী করে চরিত্র। চরিত্রের ভাষাতেই আখ্যান বর্ণিত হয়। এই কারণে দেখা যায় উপন্যাসের চিত্রিত চরিত্রগণ যখন শিল্পসম্মতভাবে চিত্রিত হয়; তখনই উপন্যাসের শিল্পসার্থকতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। ‘গণদেবতা’ উপন্যাসের অঙ্কিত চরিত্রগণ গ্রামীণ আবহে গড়ে ওঠা রক্তমাংসের মানুষ। তাদের যাপিত জীবন, ক্ষুধা-আশা ব্যথা-ব্যর্থতা, কাম-ক্রোধ ও বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই— এই সব নিয়ে উপন্যাসের সৃজ চরিত্র। উপন্যাসের চিত্রিত চরিত্ররা কেউ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে মহীয়ান আবার কেউ পরশ্রীকাতরতায় মূহ্যমান। গ্রামীণ বিরোধ ও দলাদলিময় বিরুদ্ধ পরিবেশেও যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তময় চরিত্র অনিরুদ্ধ কামার। তার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় :
বিরোধের উত্তেজনাপূর্ণ আবহাওয়ায় কয়েকটি লোক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অর্জন করিয়াছে। ইহাদের মধ্যে সর্বপ্রথম অনিরুদ্ধ কামার। তাহার মধ্যে বিদ্রোহের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ অনুকূল পবন-প্রবাহে সর্বগ্রাসী অনলশিখায় প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। এই আগুনে সে তাহার সাংসারিক স্বাচ্ছন্দ্য, দাম্পত্য-সুখ-শান্তি, সামাজিকতা, আত্মমর্যাদাজ্ঞান সমস্ত আহুতি দিয়াছে। শেষ সে একটা দুরন্ত, উন্মাদ ধ্বংসশক্তির বাহরে পরিণত হইয়াছে। স্বেচ্ছায় কারাবরণ তাহার নিঃশেষিত-প্রায় মনুষ্যত্বের শেষ চিহ্নরূপ তাহার ভবিষ্যাৎ আম্বাস বহন করে। ( শ্রীকুমার ১৯৯২ : ৫৫৭ )
উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র শ্রীহরিপাল। সে চাষী থেকে জমিদার শ্রেণিতে উন্নীত হয়। চাষী জীবন থেকে জমিদার শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার ফলে তার মনোজগতে মিথস্ক্রিয়ার জন্ম হইয়াছে। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তে রূপান্তরের ফলে মানসিকতা পরিবর্তন ঘটাতে পারে নাই। তার মনোজগতে বুনিয়াদী মনোভঙ্গিই অক্ষুণ্ন থেকেছে। “তাহার ইতর লম্পট, প্রভুত্বগর্বোদ্ধত চরিত্রে অতর্কিতভাবে মহত্বের বীজ অঙ্কুরিত হইয়াছে। তাহার শাসন সমাজের কল্যাণার্থী নেতৃত্ব-কামনার উপর প্রতিষ্ঠিত। সময় সময় এই সদ্যোজাগ্রত নীতিজ্ঞানকে অভিভূত করিয়া তাহার স্বভাবসিদ্ধ আদিম বর্বরতা অন্ধ রোষে গর্জন করিয়া উঠিয়াছে।” (পূর্বোক্ত)
উপন্যাসের দুর্গা মুচিনী চরিত্রায়ণে ঔপন্যাসিকের বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। রক্তমাংসের মানুষের যে কামনা-বাসনা থাকে; সেটা ভাঁড়ামি না করে লেখক নির্দ্বিধায় বলে যান। দুর্গা মুচিনী স্বৈরিণীবৃত্তিতে বিভোর। এজন্য তার মনে কোনো খেদ নেই। দুর্গার প্রতুৎপন্নমতিত্ব ও উদার মনোভঙ্গি, অপরের প্রতি সহানভূতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তার স্বৈরিণীবৃত্তির মতোন হীনবৈশিষ্ট্য ঢেকে দিয়েছে।
উপন্যাসের আরেকটি প্রধান ও উজ্জ্বল চরিত্র অনিরুদ্ধ কামারে স্ত্রী পদ্মা। নিঃসন্তান সে। তবু নিজের প্রতি তার কোনো অনুযোগ নেই। তার স্বামী অনিরুদ্ধ কামার দুর্গার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুললেও সেটা সে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয়। তবে দাম্পত্য প্রেমের চির ধরায় সে বিকারগ্রস্ত মানসিকতার কবলে পতিত হয়েছে। লেখক এই চরিত্র অঙ্কনে মনোসমীক্ষণের রীতিটি অনুসরণ করেছেন। তবে দোলাচল মানসিকতা থাকলেও ছিরুপালকে সে কখনো পাত্তা দেয়নি। তার সুঠিত সুডৌল দেহের দিকে যখন ছিরুপাল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তখন শাণিত দা’টি সে প্রদর্শন করে ছিরুকে হুঁশিয়ার করে দেয়। “তাহার বিকারগ্রস্ত মনে বিচিত্রতম বিকাশ রাজবন্দি যতীনের প্রতি তাহার অদ্ভূত মাতৃভাবের স্ফূরণ। যতীনের সহিত বয়সের তারতম্য ও পরিচয়ের স্বল্পকালীনত্ব বিবেচনা করিলে এই ভাবের অকৃত্রিমতার প্রতি সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। লেখকের জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্নবর্জনপ্রবণতার প্রমাণ, এইখানে পাওয়া যায়।” (পূর্বোক্ত)
দেবুপণ্ডিত চরিত্রটি স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক রীতিতে খাপ খায় না। তার চরিত্রটি অতিলৌকিক ধ্যান-ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। আচমকা তার চরিত্রে যে আদর্শবাদ প্রযুক্ত হয়েছে তাতে তা আতিশায্য বলে প্রমাণিত হয়। লোকাতীত পৌরাণিক বিশ্বাসই তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
‘গণদেবতা’ উপন্যাসে লেখক সাধুভঙ্গির সাবলীল গদ্য ব্যবহার করেছেন। তবে কাব্যগঠনে দেখা যায় দীর্ঘবাক্য গঠন অপেক্ষা খণ্ডবাক্যই বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে। ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিকোণে উপন্যাসে গল্প বর্ণিত হওয়ায় ভাষায় প্রসাদগুণসম্পন্নতা প্রকাশ পেয়েছে। লেখকের দৃষ্টিকোণের ভাষা সাধুভঙ্গির গদ্য তবে চরিত্রের মুখের ভাষা আঞ্চলিক আবহে প্রকাশিত। বিশেষ রাঢ় অঞ্চলের ব্যবহৃত আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার দেখা যায় উপন্যাসে। উপন্যাসে সংলাপধর্মী ভাষা প্রকাশিত হওয়ার উপন্যাসটি নাট্যগুণে গুণান্বিত। যেমন :
— আমার কাছে?
— হ্যাঁ, কথা আছে। আপনি ছাড়া আর বলবই বা কাকে?
— অসুবিধা না হয় তো এখুনি বলু না। আবার আসবেন কষ্ট করে। দেবু উৎকণ্ঠিত হইয়াই প্রশ্ন করিল।
যতিন বলিল— আমি বরং একটু এগিয়ে চলি
— না-না-না। বৃদ্ধ বলিলেন— বলা হয়েছে বলেই বলেছিলাম। বুড়ো আমার আবার লুকোবার কথা আছে নাকি? চৌধুরী হাসিয়া উঠিলেন— আপনি বোধ হয় শুনেছেন, পণ্ডিত?
— কী বলুন তো?
— গাজনের কথা?
— না কিছু শুনিনি তো?
— গাজনের ভক্তরা বলেছে এবার তারা শিব তুলবে না।
— শিব তুলবে না। কেন? (তারাশঙ্কর ২০১৬ : ১৪৩)
উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে সংলাপময় যে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে তার নাটকের ভাষা। এভাবে উপন্যাসের সর্বত্র দেখা যায় সংলাপধর্মীতা। আবার ঔপন্যাসিকের বর্ণনায় সমাসবদ্ধ শব্দ ব্যবহারে বিদ্যাসাগরীয় গদ্যেরও নমূনা আছে। যেমন :
চৈত্রের দ্বিপ্রহর। অলস বিশ্রামে যতীন দাওয়ায় তক্তপোশখানির ওপর শুইয়াছিল। চারিদিকে বেশ রৌদ্রদীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। উত্তপ্ত বাতাস এলোমেলো গতিতে বেশ জোরেই বহিতেছে। বড় বড় বট অশত্থ শিরিষ গাছগুলি কচি পাতায় ভরা; উত্তাপে কচি পাতাগুলি ম্লান হইয়া পড়িয়াছে। সেদিনের বৃষ্টির পর মাঠে এখনও হাল চলিতেছে। চাষীরা এতক্ষণে হাল-গরু লইয়া বাড়ি ফিরিতেছে। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজিয়া গিয়াছে, ঘর্মসিক্ত কালো চামড়া রৌদ্রের আভায় চক্-চক্ করিতেছে তৈলাক্ত লোহার পাতের মত; বাউড়ী-বামেনদের মেয়েরা গোবর, কাঠ-কুঠা সংগ্রহ করিয়া ফিরিতেছে। (তারাশঙ্কর ২০১৬ : ১৭৪ )
উল্লিখিত দৃষ্টান্তে ভাষায় আছে ওজস্বীয়তা। সাধুগদ্যের মধ্যে যে একটা রসঘন আবেশ ফুটে ওঠে সেটা বাক্যের ব্যঞ্জনায় পরিব্যপ্ত। আবার নিম্নবর্গের যে কাষ্ঠআহরণ সেটা বুঝিয়ে দিয়ে তৃণমূল মানুষের জীবনচিত্রও অঙ্কন না করে ছাড়েন নাই। এভাবে ‘গণদেবতা’ উপন্যাসের ভাষা ব্যবহারে তারাশঙ্কর মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন বলে দেখা যায়।
‘গণদেবতা’ উপন্যাসের বিষয় মূলত যন্ত্রযুগের প্রভাবে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন। যন্ত্রযুগের উৎপাদন ব্যবস্থায় গ্রাম্য সমাজে সভ্যতায় পালে হাওয়া লাগলে দেখা যায় গ্রাম্য মানুষের পুরনো পেশা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস ও সংস্কার বিপন্নতার মুখোমুখি হয়। ফলে যন্ত্রসভ্যতা আশীর্বাদ না হয়ে গ্রাম্য সমাজে অভিশাপ হিসেবেও দেখা যায়। নগরসভ্যতা মানুষের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি; মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি প্রভৃতিতে ভুলিয়ে দিয়ে মানুষকে যান্ত্রিক করে তোলে। ফলে সামাজিক ভাঙনের মাধ্যমে রূপান্তরের আলেখ্য সৃষ্টি হয় গ্রামীণ জীবনে। গ্রাম্য সমাজব্যবস্থায় ভূস্বামীগণ কীভাবে প্রান্তিক মানুষের শোষণ ও নিঃস্ব করে; গ্রামীণ নারীরা কীভাবে তাদের লালসার শিকার হয়; এবং প্রান্তিক এইসব প্রকৃত মানব-মানবীরা প্রতিকূল পরিবেশ ও প্রতিরেশ নিজকে নিরন্তর সংগ্রামে রক্ষা করে তারই ইতিবৃত্ত ‘গণদেবতা’ উপন্যাস। লেখকের মূল অভিপ্রায়: গ্রামীণ জীবনের প্রেক্ষাপটে যন্ত্রসভ্যতার প্রভাবে কীভাবে মানুষের পুরনো বিশ্বাস ও সংস্কার বিপন্ন হয়; সেই বিপন্নতায় নতুন ধনিক শ্রেণীর উত্থান ও পুরনো জমিদার এবং ভূস্বামী অবলুপ্তি প্রক্রিয়া রূপায়ণ; সমান্তরালে নিম্নবর্গ মানুষ যথা কামার-ছুতার প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামের আলেখ্য চিত্রায়ণ করা।
আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে বলা যায়, গ্রামীণ পটভূমিতে আখ্যানবিন্যাস, চরিত্রায়ণ, মনোমুগ্ধকর ভাষারীতি, বিষয়োপযোগী পরিবেশ অঙ্কন ও সর্বোজ্ঞদৃষ্টিকোণে লিখিত তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’ উপন্যাসটি একটি শিল্পসার্থক উপন্যাস।
অরণ্য-বহ্নি
‘অরণ্য-বহ্নি’ উপন্যাসের কাহিনী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবনধারার রূপায়ণ। ইংরেজ শাসক ও স্থানীয় জোতদার-জমিদার শ্রেণির শোষণ-বঞ্চনা থেকে পরিত্রাণের জন্য সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর লড়াকু আখ্যান। উপন্যাসে প্রধান চরিত্র সিধু ও কানু। তাদের ভূমিকাই ‘অরণ্য-বহ্নি’ উপন্যাসের কাহিনি জমাট বেঁধেছে। ইংরেজদের অত্যাচারে প্রতিবাদী হয় তারা। মানকী রুকনী-টুকনীদের উদ্ধার করার জন্য বিশু নিয়ে তিন পাহাড়ে ইংরেজ সাহেবের বাংলোতে হানা দেয়। রুকনী বাংলোঘরে সাহেবেকে খুন করে পালিয়ে আসে এবং পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়। সেখানে সিধু ও কানুর সঙ্গে দেয়া হয়। এদিকে ভৈরবীকে এক ঝড়ের রাতে ডেভিল বেউই ধর্ষণ করেছিল। সিধু একথা শুনে প্রতিবাদের তীব্র আগুন জ্বলে ওঠে। পরে তারা রাতের অন্ধকারে বাংলো আক্রমণ করে তিন সাহেবকে হত্যা করে। ইংরেজরা মরিয়া হয়ে ওঠে সাঁওতালদের নিধন করতে। সংগ্রামপুরের যুদ্ধে পরাজয় হয় সাঁওতালদের। আহত হয়ে ধরা পড়ে সিধু। ইংরেজ সরকার তার ফাঁসি দেয়। ক্ষোভে ও প্রতিবাদে নিজের অগ্নিতে আত্মাহুতি দেয়। এভাবেই সমাপ্ত হয় ‘অরণ্য-বহ্নি’র কাহিনি। উপন্যাসে অন্তে সাঁওতালদের পরাজয়ের কাহিনি সন্নিবেশিত হলেও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাদের লড়াকু মানসলোক সেই চিত্রিত করাই লেখকের অভীষ্ট। উপন্যাসের অন্তিমে ঔপন্যাসিকের চিত্রায়ণ :
সেই যজ্ঞের আগুনে রুকনী পুড়ে মরে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু সিধু আজও মুক্তি পায়নি, ইতিহাস ওকে মুক্তি দেয়নি। আজও সে বুকে হাত দিয়ে ছায়ার মিশে সেই ফাঁসি- যাওয়া গাছের মহুয়া গাছটায় ঠেস দিয়ে ভাবে। (অরণ্য-বহ্নি, পৃষ্ঠা-১৮৯)
ঔপন্যাসিক সাঁওতাল সম্প্রদায়ের জীবনই শুধু অঙ্কন করেননি— তাদের স্থানিক পরিচিতি ও ঐতিহাসিক ভিত্তিও নির্ণয় করেছেন। পিসির মা’র কাছে শোনা গল্পই তিনি উপন্যাসে চিত্রিত করেননি। ইতিহাস ঘেঁটে সাঁওতালদের জীবন ইতিহাস উদঘাটন করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য :
“আমার সঙ্গে একশো বারো বছর পিছনে চলুন।
১৮৫৪ সন। আজ ১৯৬৬ সাল। এখন একশো বারো বছর আগের কথা। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল।
তখন বাংলাদেশ বাংলা বিহার উড়িষ্যা তিন প্রদেশ একসঙ্গে। যে আমলের কথা বলছি, সে অঞ্চলে উত্তরে ভাগলপুর থেকে গঙ্গার পশ্চিমে তিন পাহাড় রাজমহল থেকে দক্ষিণে বীরভূম জেলায় ময়ূরাক্ষীর উত্তর এবং গোটা সাঁওতাল পরগণা এবং দেওঘর নিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা। আসুন সে আমলে এই অঞ্চলটায় একটু ঘুরে আসি।” (পৃষ্ঠা-৪৩)
ঔপন্যাসিকের ঐতিহাসিক পরিচিতির সঙ্গে উপন্যাসের কাহিনির যোগসূত্র সমান্তরাল। সেই সময় ও তৎকালীন সমাজবাস্ততার নিপুণ চিত্রায়ণ ঘটেছে এই উপন্যাসে। ইংরেজরা এদের মানুষ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে কীভাবে তাদের শাসনতন্ত্রে বুথ করে রেখেছিলো তাই ‘অরণ্য-বহ্নি’।
উন্যাসের প্রধান সিধু ও কানু। পার্শ্বচরিত্রের আছে মানকী রুকনী-টুকনী ও ভিম মাঝি প্রভৃতি। এদের মধ্য দিয়েই সাঁওতাল জীবনধারার রূপ-স্বরূপ প্রতিভাত হয়েছে। এরাই উপন্যাসের কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে ঔপন্যাসিকের পিসিমার কাছে শোনা গল্প তিনি চরিত্র সৃজন করেছেন। চরিত্রের নাম নির্মাণে ঔপন্যাসিক এই জীবনাধারার সঙ্গে সাদৃশ্য রেখেছেন। সিধু ও কানু বর্তমানে সাঁওতাল জীবনের সঙ্গে মানানসই। চরিত্রগুলো প্রতিবাদী হয়ে উজ্জীবিত। সাঁওতাল বিদ্রোহ পরবর্তীতে তেভাগা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ইংরেজ হটাও সংগ্রাম জোরালো হয়েছিল। অরণ্যচারী আদিম মানুষের অস্তিত্ব সংকট হলে তারা প্রতিশোধের আগুনে কতটুকু জ্বলতে পারে তা আমরা দেখতে পাই সিধু, কানু ও রুকনী চরিত্রে। ঔপন্যাসিকের নামকরণেও ‘অরণ্য-বহ্নি’ সেই প্রতিবাদের ভাষ্যকে ইঙ্গিত করে।
উপন্যাসটির প্রকৃতি নির্ণয়ে আলোকপাত করা যায়। একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের জীবনধারার রূপায়ণ আছে এই উপন্যাসে। সেদিক থেকে উপন্যাসটিকে আঞ্চলিক উপন্যাস বলা যায়। উপন্যাসে সৃজ্য চরিত্রের মুখের ভাষা বিশেষ অঞ্চলের সেদিক থেকেও উপন্যাসটিকে আঞ্চলিক উপন্যাস বলা যায়। বর্ণনারীতির দিক থেকে দেখা যায় ঔপন্যাসিকের দেশজ ভাষা ব্যবহৃত। উপন্যাসটির দৃষ্টিকোণ লেখকের নিজের। ঔপন্যাসিকের ভাষা ব্যবহারের দৃষ্টান্ত দেয়া যায় :
“ফাগুলাল হাত জোড় করে বলেছিল, আমরা বাবাঠাকুর সাঁওতালরা গো!
কিন্তু ফ্যালফ্যাল করে করি তাকিয়ে থেকে ভট্চাজ বলেছিলেন, হ্যাঁ তাই তো! তু তো সেই ফাগুলাল।
— হে বাবাঠাকুর, আমি ফাগুলাল।
ভট্চাজ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলেন— বলেছিলেন, শান্তকণ্ঠে— আয় আয় আয়। তা কী মনে করে রে? তু তো অনেক দিন আসিস নাই ফাগুলাল।
— হে বাবাঠাকুর, অ্যানেকদিন আসি নাই গ।
— ভালো আছিস? এত দলবল নিয়ে? কী রে ? ভূত প্রেত ভান ডাকিন কিছু নাকি?
— না গ তা লয়।
— তবে আমার আছে? ওই সবের জন্যেই তো লোকে আসে আমার কাছে।
— তার বাড়া গ বাবাঠাকুর। আমারদিগকে চুষে খেলেক, পিষে মেলেক, জাত লিলেক, জনম লিলেক, আমরা মরে গেলাম। ত একটো দরখাস লিখে দে।”
উল্লিখিত উদ্ধৃতি আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি প্রমিত ভাষায় দেখা যায়। তবে সাঁওতাল জীবন রূপায়ণের ঔপন্যাসিকে তাদের ভাষাটা আঞ্চলিক ও সাহেবদের ভাষা প্রমিত গদ্য ব্যবহার করেছেন।
উপন্যাসটির কাহিনি, চরিত্রায়ণ, ভাষা, পরিবেশ, দৃষ্টিকোণ ও জীবনদর্শন মিলে দেখা যায় বাংলা উপন্যাসশিল্পে ‘অরণ্য-বহ্নি’ বিশেষ সংযোজন। পরবর্তীকালে শওকত আলী, তাসাদ্দুক হোসেন, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন সাঁওতাল জীবনধারার উপন্যাস লিখেছেন। সেগুলোও সাহিত্য জগতে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। শওকত আলীর ‘নাঢ়াই’, ‘মাদারডাঙ্গার কথা’, রিজিয়া রহমানের ‘একাল চিরকাল’ ও তাসাদ্দুক হোসেনের ‘মহুয়ার দেশে’ ও সেলিনা হোসেনের ‘কাঁটা তারে প্রজাপতি’ ইত্যাদি।