
তামিল মেয়ের চোখে পরাজিত সমুদ্রবিলাস
তামিল মেয়ের চোখে পরাজিত সমুদ্রবিলাস
অতপর পানের নেশা আমাকে টেনে নিয়ে যায় মেরিনা সমুদ্রসৈকত. . . !
পেছনে পড়ে থাকে কোলাহলমগ্ন চেন্নাই শিল্প-নগর
চিকিৎসাভারাক্রান্ত ডাক্তারখানা আর রোগশোকজাত কষ্টের দাবানল।
মুগ্ধতার তান্ডবে আমি ডুবে ডুবে মরি বঙ্গপোসাগরের জলে
গিলে গিলে খাই মহাসামুদ্রিক আয়োজন।
আমার উপভোগের বারান্দায়
ছুটোছুটি করে লুটোপুটি খায় রাশিরাশি সুন্দর—
উলঙ্গ জলতরঙ্গে নাচে বাতাসের যৌবন
আকাশ ও জলের বেলাজ অভিসার
সমুদ্র-জলযৌনিতে বালির ঠোকাঠুকি
বালিয়াড়ির আনন্দ-পতন
মেঘদের স্নানক্রিয়া
ডুবে যাবার অপেক্ষাক্লান্ত সুর্যের বৈকালিক কাপড় বদলানো
আর সেইসব মানুষেরা—
যারা শরীরে জেগে ওঠা উষ্ণতা সমুদ্র-জলপ্রবাহে ভিজিয়ে
সেই বিকালে লিখছিল নিজস্ব ছোটগল্প—
প্রেমানন্দ অথবা বিরহকথন।
এ রকম কিছু ছোটগল্প একদা আমারও ছিল বলেই
আমি সুখস্মৃতির গর্তমুখে আঙুল ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করি
অপেক্ষা করি স্মৃতিময় সুখরসস্রোতের।
ধুলোমাটিমাখা মুখের এক তামিল কিশোরী—
এখন যার ইশকুলের বই নিয়ে পড়ার টেবিলে থাকবার কথা
কিংবা মা-দাদী-নানীর কোলে রূপকথার গল্প শুনবার কথা
ইশারা ভাষায় তার দারিদ্র্য-অভিধান খুলে বসলে—
আমার মহানান্দনিক সমুদ্রনেশা ওর চোখের সমুদ্রেই ডুবে যায়।
আমি তামিল মেয়ের কম্পপান চোখের তারায়
দেখতে পাই ডাসক্যাপিটালের পৃষ্ঠা খুলে বসে আছেন স্বয়ং কার্ল মার্কস
বোধের ক্ষরাক্রান্ত কালের মানুষদের প্রতি টিপ্পনী কাটছে
ডাসক্যাপিটালের কালো কালো হরফগুলি
ততক্ষণে রাষ্ট্রীয় ভূগোলের বেলুন ফুটে একাকার হয়ে যায়—
মেরিনা সমুদ্র সৈকত, পতেঙ্গা, কুয়াকাটা, কক্সবাজার—
যেখানে প্রতিদিন ধুলোমাটিমাখা অগণিত শিশুর ভবিষ্যত রক্তাক্ত হয়
বিশ্বায়িত সভ্যাচারের ধারালো নখে।
আমি আর আলাদা করতে পারি না
মেয়েটি কি তামিল নাকি বাংলাদেশী?
একদিন সমুদ্র হবো
হঠাৎ সমুদ্র হবো
এক বিকাল হিমছড়ি মেখে বসাবো গোধুলী-ঘ্রাণের মেলা
পাহাড়ের কোলঘেঁষে মাথার সিঁথির মতোন পথ, অবিরাম ছুটে চলা ভুলে
জিরিয়ে নিবো বৈকালিক সৌরভে, চোখের সমুদ্রতল হতে ভেসে উঠবে
আস্ত নীল তিমি, ধ্যান ভাঙাবে
জলভেজা কবিতার
সমুদ্রপৃষ্ঠে খোলস খুলে হাঁটতে থাকবে ঢেউজাত গল্পেরা
টুপ করে রাত্রি নেমে চেটে খাবে পৃথিবীর ক্লান্তি।
তার আগে দীর্ঘ কথা হবে সূর্যের সাথে
জলজ-আলাপনে ডানা মেলবে যুগল পাখি
বিরামহীন ঢংয়ে বেজে উঠবে রঙের বাঁশী।
হঠাৎ একদিন সমুদ্র হবো!!
বাতুর ভলকানো
এখানে অসীম নিস্তব্ধতায় উপচে পড়ে মায়াবী সুন্দর! আকাশ হতে ভেঙ্গে পড়ে অবিরাম রঙের দোয়াত। খিলখিল করে হাসে রঙধনু সাজে। অপেক্ষার আগুনে পোড়ে হাতে ধরা বৈকালিক পানপাত্র। চোখ জোড়া-অপলক! স্থির! যেন ভুলে গেছে নিজস্ব নাচের মুদ্রা, সেই কবে, ইহিহাসেরও আগে। আমিও ভুলে থাকি জীবনের তাবৎ অস্থিরতার খতিয়ান। উপভোগের গেলাস হাতে ক্লান্তিহীন, পান করি নিঃশব্দের কোলাহল!!
একটি আলোকচিত্রের ময়নাতদন্ত
মেয়েটি তাকিয়ে ছিল নিঃসীম অজানায়
তার মুখে কোনো কথা ছিল না
হাসি ছিল না, কান্না ছিল না
কেবল তার হলুদাভ চোখ দু’টি জ্বলছিল
তার চোখ যেন আমাদের দূরারোগ্য রাজনৈতিক জন্ডিসের
পুঞ্জিভূত গোডাউনের উপমা!
না, মেয়েটিকে আমি কখনও সামনা সামনি দেখিনি
তবে তার একটি ছবি ছাপা হয়েছিল খবরের কাগজে—
যে রাতে গোটা শহর জুবুথুবু শীতে লেপের নিচে কাত হয়ে উম খুঁজছিল
যুগলবন্দি জীবন হাতড়াচ্ছিল পরস্পরের নাভিতল
ঠিক সেই রাতে মেয়েটিকে বসে থাকতে হয়েছিল খোলা আকাশের নিচে!
এক ঘরহীন মেয়ের দীর্ঘশ্বাসের ঝড়ে সামিয়ানা হয়ে গোটা শহরের উপর উড়ছিল
গভীর অমাবস্যা!
যদিও সেই রাতে নগরীর অলি-গলিতে আলোকসজ্জ্বার কমতি ছিল না
ঘোর অন্ধকার রাতে মেয়েটির সামনে পড়ে ছিল কালো কালো ছাইয়ের স্তুপ
পোড়া ঘর, বিছানাপত্র, থালাবাসন, ইলেক্ট্রিক ফ্যান
টয়লেটের বদনা, পোড়ামানুষের খুলি, শিশুর হাত, ঘরের টিন. . . . .!
মেয়েটি ক্রমাগত নিঃশব্দে আওড়াচ্ছিল অন্ধকারের নামতা!
তার নিস্তরঙ্গ নিস্তব্ধতায় জমা পড়েছিল অগণিত ক্রোধের বারুদ, সামান্য ঘষাতেই
জ্বলে উঠতে পারতো, পুড়ে যেতে পারতো উচ্চপদস্থ কেরাণীদের বহুতল প্রাসাদ!
যেখানে প্রতিদিন লালফিতার ঘষাঘষিতে তৈরি হয়
জনদুর্ভোগের মহাপরিকল্পনা।
মেয়েটির চোখের ভেতরে জেগে উঠেছিল বুড়িগঙ্গার কালাপানির ঢেউ
ওখানে ক্রমাগত সাঁতার কাটছলি বিবর্ণ কষ্টেরা
আর তার চোখ
হলুদাভ চোখ যেন ক্রমশ হয়ে উঠেছিল
এক দূরারোগ্য রাষ্ট্রিয় জন্ডিসের পুঞ্জিভূত গোডাউনের উপমা!
মেয়েটি তখনও তাকিয়ে ছিল
নির্বাক-নিস্তব্ধতায়
আর তার সামনে কেবল পুড়ে ছাই হয়ে দিগন্তে ডানা ওড়াবার
হাতছানি খিল খিল করে হাসছিল।
জল ও বৃক্ষ
বৃক্ষরাও নতজানু হয়
জলজ গল্পের কাছে
ছায়া হয়ে ডুবে থাকে জলের অন্তরে
বুঝি খুঁজে ফেরে সুখ-অসুখের নিজস্ব উপাখ্যান!
হয়তো বা বৃক্ষদেরও দু:খ থাকে
হয়তো বা বৃক্ষদেরও সুখ থাকে
হয়তো বা বৃক্ষদেরও প্রেম থাকে
হয়তো বা বৃক্ষদেরও বিরহ থাকে
জলজ গল্পে কি লেখা থাকে সেইসব সুখ, দু:খ, প্রেম-বিরহের খতিয়ান?
ভোরের বাতাস নাচে, জলের কাঁপনে কাঁপে বৃক্ষছায়া
ভোরের কাক এসে জড়ো হয়,
চোখ রাখে জলের গভীরে-যেখানে বৃক্ষরা ধ্যানে থাকে অনাদি কাল।
অভিসারে এসে ভোরের কাকও বুঝি খুঁজে
একটা জলজ গল্প
জল ও বৃক্ষের চিরায়ত কবিতা!