
ডানায় রোদের গন্ধ
কলাভবনের চারতলায় উঠতে উঠতে কথাটা সে একবার আমাকে বলে। হয়তো মজা করে, ঠাট্টাচ্ছলে এসব বলে সে আমার নার্ভ টেস্ট করতে চায়। ক্লাসমেটরা এরকম মজা করে আনন্দ পায়- এসব আমার জানা থাকে বলে, আমার প্রতিক্রিয়া হয় শীতল, বা হয়ই না। এর আগেও এক দুজন একথা আমাকে বলে, বা আমিও বলি একে ওকে। এই অভ্যস্ততা বাহ্যত আমাকে নির্বিকার করে দেয়, বা প্রতিক্রিয়াহীন রাখে। কিন্তু অন্তর্গত অনুরণন আমার পক্ষে রোধ করা সম্ভব হয় না। প্রতিবারই বুকের ভেতর কিছু একটা খসে পড়ে বলে মনে হয়। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে সে যখন আমাকে কথাটা বলে, বুকের মধ্যে আবারও একটা কিছু খসে পড়া টের পাই। ভেতরটা মনে হয় ফাঁকা হয়ে যায়। তখন একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে যাবার মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিতে নিতে সিঁড়িতে তাকে পেছনে ফেলে উপরে উঠতে যাব সে আমার বাঁ হাত মুঠো করে ধরে। ও এমন করবে, ব্যাপারটার মধ্যে অনেক নতুনত্ব বা আকস্মিকতা থাকে, যা আমাকে সত্যিই ফেলে দিতে পারত। হয়তো আমি পতিত হই। যদিও সিঁড়িতে পড়ে যাওয়া থেকে সে-ই আমাকে রক্ষা করে। স্থির হয়ে ওর চোখে তাকাই। প্রথম ভুলটা আমার তখনই হয়। সে তার কুহক বিস্তার করে। ওই কুহকজালে বন্দি না হয়ে আমার আর উপায় থাকে না। যাকে ঠাট্টা ভেবে এড়াতে চাই, কিন্তু তার চোখ, মুখ আমাকে বিভ্রান্ত ও বিস্মিত করে। এই নির্লজ্জ ও স্পষ্ট অভিব্যক্তি আমাকে ভয়ের বিবর্তে ঠেলে দেয়। ভয়ে সিঁটিয়ে যেতে যেতে তাকে দেখি- অর্ধচন্দ্রের মতন করুণ কপাল আর মাথার উপর নুয়ে পড়া গুচ্ছ গুচ্ছ চুল; চেনা এই মেয়েটিকে আমার অচেনা লাগে। আমাকে! আমাকে!! এই মেয়ে আমাকে এ কথা কেমন করে বলে! তখন পুরো ব্যাপারটিকে আবারও মনে হয় ঠাট্টা। কিন্তু আমি তার কুহকে বন্দি হই। বুকআকাশে মেঘ ঝমঝম ডাকে। বৃষ্টির টাপুরটুপুর হয়। সে আমার হাত ধরে থাকে। তার পেকে যাওয়া সবরি কলা রঙের আঙুলের স্পর্শ আমাকে বিহ্বল করে। বিহ্বলতা ছড়িয়ে যায়- শিরায়, ধমনিতে। আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি। মনে হয়, তখন বিশাল একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে আমি একা অনন্তকাল দাঁড়িয়ে আছি। আর আমার খুব অভিমান হয়, বা রাগ হয়। তাকে কিছুই বলতে পারি না। যেন দুটো প্রশ্নাকুল চোখ বিপুল ব্যাকুলতা নিয়ে আমার কাছে একটা জবাব প্রার্থনা করে, বা একটু মৌনতা চায়। আমার হাত ধরে সিঁড়িতে পথ আগলে থাকা এই মেয়েকে তখন আমি কি বলি! সময়ক্ষেপণ হয়। তুমুল ইচ্ছে ও লোভ আমাকে পর্যুদস্ত করে। মনে হয়, এখুনি সময়, একবার সাহস করে বলে ফেললেই তো হয়। হয়তো আমার মৌনতা তাকে আশ্বস্ত করে না। বিভ্রান্ত মেয়েটি, হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জানতে চায়- কী হলো, কিছু বলো! টের পাই আমার পিপাসার তীব্রতা, এত তৃষ্ণা নিয়ে কি করে আমি তুচ্ছ জীবন বয়ে বয়ে একুশটা হিমেল শীত পার করে দিয়েছি! তখন আমার পরাজয় ঘটে। কিন্তু পরাজিত হতে হতে আমি ফিরে আসি, গলে পড়তে পড়তে কঠিন হই, হতে পারি। কেননা তখন দৃশ্যমান আমি’র সঙ্গে অন্তর্গত আমি’র দেখা হয়ে যায়। দুটো আমি’র এই সাক্ষাৎকারের খুব প্রয়োজন ছিল। যে জীবনটা আমার, সিনবাদের ভূতের মতো যে জীবন আমি যাপন করি, লোকে তাকে অভিশপ্ত বলে। এই দেবীর মতোন মেয়েটি তার খবর জানে না বলে, আমাকে কথার ভ্রান্তিতে ফেলে দেয়।
হায়, বিপন্ন মানুষ জীবন! তখন মনে হয়, এই স্বপ্নের শাদা বক আমার কাছে বামুন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াবার মতোই। দৃশ্যমান আমি’র সঙ্গে অন্তর্গত আমি’র সাক্ষাৎকারের ফলে আমার এই লাভ হয়, ইসমাত আরা খাতুনকে আমি বলতে পারি- ‘ইতি, তুমি একটা পাগল! তবু আমি তাকে বোঝাতে ব্যর্থ হই। একথা শুনে সে হাসে। হাসতে হাসতে বলে- ‘চল এখন ক্লাসে যাই। এসব নিয়ে পরে আরও অনেক কথা বলব, ঠিকাছে। আমরা চারতলার করিডোর পার হয়ে ক্লাসরুমে চলে আসি। ইতি তখনও আমার হাত ধরে থাকে। সহপাঠীরা ইঙ্গিতপূর্ণ তাকায়, বলে- কীরে তোদের হয়ে গেল? আমি বুঝি ওরা কী বলে। আমার অস্বস্তি হয়। ক্যাম্পাসের প্রেম সম্পর্কে প্রচল ধারণা আমারও জানা থাকে। ইতিকে তাই বলি- হাত ছাড়ো তো! তুমি আসলেই একটা পাগল। সে বলে- উহু আবারও ভুল করছ- ব্যাকরণটাও ভুলে গেলে তোমার কী হবে বলো তো! অনায়াস অবহেলায় আমার কথাই সে আমাকে ফিরিয়ে দেয়। বলে- তুমি একটা পাগল। মানে? মানে আবার কি? কোন মানে নেই- বলে, ইতি আমাকে ব্যাকরণ শেখায়- তুমি হলে পাগল আর আমি হলাম ঈ প্রত্যয় যোগে পাগল, মানে পাগলি, বুঝলে, বুদ্ধ কোথাকার। আমার ভয় ও বিভ্রান্তি তখন আর থাকে না। তবু কী কারণে, শোক নয় সন্তাপ নয়, বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে রাখা একদলা দুঃখ কান্না হয়ে উঠে আসতে চায়। এই কান্নার বর্ণমালা তখনও আমি শিখিনি।
ক্লাসে আমি পারসেনটেনস্ মিস করলাম। খুব অ্যাকাডেমিক কখনোই ছিলাম না, তবে এরকম আমার হবার কথা নয়। যখন ক্লাসে যাই, পারসেনটেনস্ মিস হবে এরকম উদাসীনতা আগে কখনো পেয়ে বসেনি। সেদিন, তখন আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, স্যারের লেকচারও আমি শুনছি না। বাহ্য জগৎ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেন বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ হয়ে গেছি। বুকের ভেতর, মাথার ভেতর অন্য কোন ধ্বনিই নেই, শুধু ইসমাত আরার কথাটিই দ্রিমিকি দ্রিমিকি ছাড়া। একটা সাধারণ কথার ভেতর এত শক্তি লুকিয়ে থাকে, এতদিন যা অজানা ছিল, তখন বুঝি। সকল রকম ভাবনা-চিন্তা, স্বপ্নের মধ্যে দেয়াল তুলে দিয়ে স্যারের লেকচার, ক্লাসভরতি ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি ছাপিয়ে আমার বুকের ভেতর ইসমাত আরা খাতুন ঢুকে পড়ে অবলীলায়। নিজেকে ফেরাতে পারি না। অথচ জানি কত অর্থহীন এসব আমার জন্য। ব্যাপক কামনার চেয়ে এখানে বড় হবে, মানুষ হিসেবে আমার অসম্পূর্ণতা। হয়তো মানুষ হতে পারার প্রাথমিক শর্তই আমাকে দিয়ে পূরণ হয় না। না হলে মানুষ আমাকে কেন অশুদ্ধতার সীল দিয়ে দেয়! অস্পৃশ্য, অশুচি বলে আমার কাছ থেকে গা বাঁচিয়ে চলে! সেসব অবহেলা করতে এতদিন আমার কোন হতাশা ছিল না- সেদিন ক্লাসে বসে আমাকে হতাশায় পায়। তখন ইতির কথাটাই আবার প্রণোদিত করতে পারত। হয়তো তা করেও, কিন্তু আমার সামনে রিয়ালিটি মূর্ত হয়ে দণ্ডায়মান হয়। আমি ফিরে আসি আমার নিজস্ব পৃথিবীতে।
ক্লাস শেষে ইতিকে এড়িয়ে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের বিশাল রাধাচূড়ার নীচে এসে দাঁড়াই। কিছু ফুল পড়ে থাকে, হলুদ হলুদ ফুল। কয়েকটি কুড়িয়ে নিই, তখন ধুলোর মেঘ বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস আসে। আমার হাতের মধ্যে রাধাচূড়া ফুল চ্যাপ্টা হয়ে যায়। আমি বাসে উঠবার প্রতীক্ষা করি।
যেখানে থাকি, কাঁটাখালির কল্লোল ছাত্রাবাসে- বাসে করে ক্যাম্পাসে আসি, ক্লাস করি, ফিরে যাই। এ ছিল আমার রুটিন। মাঝে মাঝে বিকেলবেলা ঘুরতে আসি ক্যাম্পাসে। বিকেলের ক্যাম্পাস অন্যরকম। প্রায় সারা বছরই মতিহারে ফুটে থাকে নানা রকম ফুল, এইসব ফুলের পটভূমিকায়, প্যারিস রোডে, কাজলায়, রোকেয়ায়, তাপসিতে, মন্নুজানে, চারুকলায় প্রেমিক জুটিরা উড়ে উড়ে বেড়ায়। এই দৃশ্যাবলি আমাকে প্রলুব্ধ করে। এসব উপেক্ষা করতে পারি না। সুযোগ পেয়ে ইসমাত আরা খাতুনও দ্বিধাগ্রস্ত টানাপোড়েনের ভেতর আমাকে টেনে নেয়। ইসমাত আরা খাতুন শুধু দ্বিধাগ্রস্ত করে আর প্রতিবন্ধক হয়ে সামনে দাঁড়ায় আমার অযোগ্যতা। এই অযোগ্যতার রূপটাকে আমি তখন বুঝতে পারি। ইসমাত আরা খাতুন সেসব নাই বা জানুক। যে বিশ্বাস নিয়ে সে আমাকে ভালোবাসার কথা বলে তা অটুট থাকুক। হয়তো তাতে আমার ভালোই লাগবে। এই স্বার্থপরতাটুকু আমি দেখাতে চাই। এই বিবর্ত থেকে রক্ষা পেতে চাই। আসলে কী চাই জানি না। ভাবি কিছুদিন ক্লাসই করব না। হয়তো নন-কলেজিয়েট হব, তবুও। তখন আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড কথাটিই যা সান্ত্বনা দেয়। চোখের সামনে থাকলে মুগ্ধতা আসতেই পারে, কিন্তু অনুপস্থিতিও একপ্রকার ওষুধ যা মুগ্ধতাকেও ম্লান করে দেয়। কলেজ জীবনে এই অভিজ্ঞতার স্মৃতি আমার আছে। কলেজ জীবনের কথা এলে, অনেকদিন পরে আবার ঊষাকে মনে পড়ে। ফ্রক পরা কিশোরীটি, পাখির পালকের মতন নরম, বালকবয়সে আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আমি ছিলাম তার প্রাইভেট টিউটর, মনে মনে দুরন্ত প্রেমিক। কিন্তু তখনও ভয় ও মানুষ হবার স্ট্রাগল আমাকে ট্যুইশনিটা ছাড়তে বাধ্য করে। ঊষার জন্য আমার কষ্ট হয়। অর্থের কষ্টও করতে হয়। আর এমন কিছু যন্ত্রণা মনের মধ্যে কাঁটা হয়ে থাকে, মাঝেমাঝে জানান দেয়। তবে অনেকদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে, এই যন্ত্রণা শুধু একটা আবেগের স্মৃতি হয়ে থাকে।
দুদিনের ক্লাস অনুপস্থিতি আমাকে ক্লান্ত করে ফেলে। মেসেই শুয়ে বসে থাকি, বই পড়ি, গান শুনি, স্যাটালাইট চ্যানেলে হিন্দি সিনেমা দেখি। কিন্তু কিছুতে স্বস্তি আসে না। কষ্ট যেন কচুরিপানা, দিনে দিনে বাড়তে থাকে। ইসমাত আরা খাতুন আমার কাছে যা চায়, আমারও মনের মধ্যে একই অনুভূতি কাজ করে। তবু আমি পারি না। আমি যা পারি না, ইতি তা সহজেই পারে। আমার আজকের দিন অনেক কঠিন।
একদিন ইতি আমার মেসবাড়ির চিলেকোঠার ঘরে উঠে আসে। একাই। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। এবং জড়িয়ে ধরে রাখে। তারপর হাঁটু মুড়ে আমার পায়ের কাছে বসে সেই কথাটি আবারও বলে। বলে যে- আমি তোমারই। যা আমাকে একেবারে ধ্বস্ত করে দেয়, জ্বলে যাই, জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাই, তাই এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। তাকে তখন কী বলে ফেরাই! ঊনিশটে ফাগুন/ কি তীব্র আগুন, মনের ছায়াবীথি বিরাণ করে দিল/- মনের ছায়াবীথির জন্যে একদিন যে স্বপ্ন ছিল, তা-ই যখন ভিক্ষেপ্রার্থী হয়ে আসে জোয়ারের গঙ্গাধারার মতো, তাকে বুক পেতে নেবার সাধ ও সাধ্যের জটিলতা পুনরায় আমাকে বিপর্যস্ত করে। ইচ্ছে হয় এই বিপুল তরুণীকে বলি- এসো আমার হাত ধর। কিন্তু আমি তাকে কিছুই বলতে পারি না। এমনকি দুঃখিত এই কথাটিও বলতে পারি না। আর ইসমাত আরা খাতুন কেবল কাঁদে, চোখ থেকে ঝরে পড়ে মুক্তোর মতো অশ্রুকণা। আমি একটি হাত তার হাতের উপর রাখি।
আমি ইসমাত আরার দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকি, ঝুঁকে পড়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না আমার। অথচ অযোগ্যতার গল্পটি তখনও আমার কাছে একটি অপঠিত উপন্যাস। মা ছাড়া এ গল্প আর কে জানে! ভাবি মায়ের কাছে যেতে হবে। মাকে বলতে হবে সবকিছু। তাকে বলতে হবে, যে লোকটা আমার কাছে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন, যে নামটা আমি সার্টিফিকেটে ব্যবহার করি, সে আসলে কে? একদিন লোকটার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেটা এমন এক প্রসঙ্গ, তুললে আমার মনে হয় মা কষ্ট পাবে। এতদিন পর্যন্ত কাহিনিটি এজন্যই জানি না আমি। বাবা! এইরকম শব্দে উচ্চারিত একটা লোক বাবা সবার থাকতে হয়, অনেকদিন পর্যন্ত সেটাই আমার জানা ছিল না। ভাবতাম, যেন মা-ই সব, জগৎ-সংসার, আনন্দ-বেদনা। তাছাড়া আমার কিছুই অপ্রাপ্তি ছিল না। পৃথিবী ছিল মাতৃছায়ায় বন্দি। মনে পড়ে, বিষণ্ন দুপুরবেলা, তখন দূরে তাকালে চোখের পাতার মতো প্রান্তর কাঁপে। একটা কাক আমাদের বাচ্চা নারকেল গাছে কা কা স্বরে মুখর করে, মা তখনও ফেরেনি স্কুল থেকে, সেদিন আমাদের কাজের বুয়া বানু খালা আমাকে বলে- অঃ বাবুসোনা বাপের জন্যে তোর পরান দাপায় না! সেই প্রথম বানু খালার মুখে বাপ কথাটি শুনি। শব্দটি আমার বুকের ভেতর এমন করে ছড়িয়ে পড়ে যেন বদ্ধ পুকুরে কেউ একটা ঢিল ছুঁড়ে দেয়। কৌতূহল জেগে ওঠে। বলি- বাপ কি খালা? আমার কথা শুনে সব জেনেও সে আশ্চর্য হয়। বিস্ময়ে বলে- অঃ আল্লাহ কস্ কি, বাপ চিনস্ না! তারপর স্বগতোক্তি করে- হ কেমুন কইরে চিনবি, তোর তো বাপের ঠিক নাই। তুই তো বেজম্মা।
বানু খালা দিয়ে সেই যে শুরু, এরপর এই স্ট্রাগলটা আমাকে করে যেতেই হয়, একা। পথঘাটের লোকজন এমনকি আমার স্কুলের বন্ধুরা পর্যন্ত এসব বলে। হয়তো আমি কোথাও যাচ্ছি, একজন আরেকজনকে আঙুল তুলে দেখায়- ঐ যে যায় মাস্টারনির জাইরা ছাওয়াল। বন্ধুরা এভাবে বললে প্রথমদিকে আমার খুব খারাপ লাগতো। ধীরে ধীরে সবকিছুই সহনীয় হয়ে আসে। মাকেও এজন্য কখনো প্রশ্নের মুখোমুখি করিনি। সেই বয়সেই কি করে যেন বুঝে গেছি, এসব বললে মাকে কষ্ট দেয়া হবে। মাকে আমি কখনো কষ্ট দিতে চাইনি। আমার জন্মের জন্যে দায়ী করে মাকে ঘেন্নাও করতে পারতাম। যে বাস্তবতায় আমি থাকি, সেটাই হয়তো স্বাভাবিকই হতো। তবু মাকে ঘেন্না করতে হবে এটা কিছুতে ভাবতে পারি না। বরং তাকে নিয়ে আমি একধরনের ব্যক্তিগত অহঙ্কারে ভুগি। এই গৌরব আমি হারাতে চাই না।
ব্যাগও ঠিক মতো গোছানো হয় না, তেমন এলোমেলোভাবে অনেকদিন পরে মায়ের কাছে আসি। মা একটু অবাক হয় আমাকে দেখে, হবারই কথা। এভাবে খবর না দিয়ে আসা সেই প্রথম। তাছাড়া আমার বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে তার উদ্বেগ বাড়ে। হয়তো ভাবে, আমার কোনো বড় ধরনের অসুখ হল কি না, বা ভাবে আমি কোনোভাবে বিপদগ্রস্ত। বলে- কী হয়েছে, কী হয়েছে বল তো! অসুখ করেছিল? আমি বলি- মা তুমি ভালো আছ তো!
মা মেয়েদের একটা স্কুলে পড়ায়। মা স্কুলে চলে গেলে, আমি সারাদিন বাড়িতে থাকি, বই পড়ি, গান শুনি, শুয়ে থাকি। একসময় মা ফেরে স্কুল থেকে, এসে রান্নাবান্না করে, আমি তার কাছে বসে গল্প করি, একটু সাহায্যও করি কখনও। কিন্তু যা বলতে চাই তা বলা হয় না। আমার দিনগুলো ভার হয়ে যায়। এক বিকেলে মাকে বলি- বেড়াতে যাবে মা! চল কোথাও বেড়িয়ে আসি একদিন। মা খুব খুশি হয়। খুশি হয়ে বলে- আমায় নিয়ে যাবি! তখন বুঝি, মা আসলে এতদিন কী বদ্ধ এবং একঘেঁয়ে জীবন যাপন করে!
তারপর আমরা একদিন বেড়াতে যাই। কোন নির্দিষ্ট জায়গায় নয়। কাশীনাথপুর যাই, সেখান থেকে নগরবাড়ি কিংবা শাহজাদপুর থেকে ঘুরে আসি। আমাদের সারাদিন ভালো কাটে। কিন্তু বাড়িতে ফিরে রাত আর কাটে না। রাতে আকাশে তারার ঝিকিমিকি। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছায়াপথ দৃশ্যমান হয়। আমি বাইরে এসে আকাশ দেখি, তারা দেখি, ছায়াপথ দেখি। আমার কিছু ভালো লাগে না। ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিই। আমি ঘুমোতে চাই। আমার ঘুম আসে না- হায় ঘুম! চোখ ভরে নামো তো, বুক ভরে শ্বাস নিই! আর ইসমাত আরা খাতুন কেবলই ফিরে ফিরে এসে অন্তর্গত কষ্টের কাছে নিয়ে যায়। অন্য ঘরে মা হয়তো ঘুমিয়ে যায়, বা ঘুমায় না। হয়তো ততদিনে মা সবকিছু সয়ে নেয়- তার প্রতিদিনের সংগ্রাম তাকে কঠিন করে ফেলে। আমি পারি না। আবার বাইরে এসে দাঁড়াই, কখন মা ওঠে এসে আমার গায়ে হাত রাখে। বলে- এখনও ঘুমোসনি কেন? তাকে বলি- মা আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। কেন কষ্ট পাই মা অনুমান করতে পারে। অনুমান করলেও সবটা তার কাছে পরিষ্কার হয় না। তখন তাকে ইতির কথা, তার কাঙালপনার কথা এবং তাকে নিয়ে আমি যে টানাপড়েন পার হই, সেসব বলি। মা নিষ্পৃহ থাকে। বুঝতে পারি তার নিষ্পৃহ না থেকে উপায় নেই। তাকে আমার জন্মের কথা জিজ্ঞেস করি। তখন আমি হয়তো কিছু উত্তেজিত হই, ভাষায় বা স্বরে কোন কোমলতা থাকে না। মা দুঃখিত হবে জেনেও আমি এরকম করি। আমার হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়। মা তখন আমাকে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বলে- জানি না সে কোথায় আছে। কিন্তু তুই আমাদের ভালোবাসার সন্তান।
ক্যাম্পাসে ফিরে এসে পালিয়ে বেড়াই। ক্লাসে ইতির সঙ্গে দেখা হয়। দূর থেকে তাকে দেখি। ক্লাস শেষ হলে দ্রুত হাওয়া হয়ে যাই। কিন্তু সে-ও সুযোগের অপেক্ষা করে। কী একটা উপন্যাস খুলে বসেছিলাম লাইব্রেরির রিডিং রুমে। ইতি আমাকে পাকড়াও করে টেনে নিয়ে যায় তপন চত্বরে বকুল গাছের বেদীতে। পাশেই ডীন কমপেক্সের কাজ হচ্ছে বলে পথটা নির্জন। বকুলের বেদীতে বসে ইতি আমার বাঁ হাত কোলের কাছ নিয়ে আলতো নেড়ে দিতে থাকে। একটা ভালোলাগা ছড়িয়ে যায় রোমকুপে। আবার ভয়েও সিঁটিয়ে যাই। তখন একঝাঁক শাদা বক উড়তে উড়তে রবীন্দ্র ভবন পার হয়ে বোটানিক্যালের দিকে চলে যায়। ইতি আমার হাতে চাপ দিয়ে বলে- পালিয়ে বেড়াও কেন হাঁদারাম। কেন পালিয়ে বেড়াই ইসমাত আরাকে আমি কীভাবে বলি! অথচ সেদিন সবই বলতে হয়। অবশেষে ইসমাত আরা খাতুন আমার কাছ থেকে শোনে, আমার পিতা কে তা আমি জানি না।
অনেকক্ষণ সব নীরব হয়ে থাকে। সব নীরব হয়ে থাকে। মুহূর্তে সব পাল্টে গেল। অনেকক্ষণ পর ইসমাত আরা খাতুন হাঁটতে হাঁটতে কলাভবন পেরিয়ে যায়। আর কখনো হয়তো সে আমাকে লাইব্রেরির রিডিং রুম থেকে পাকড়াও করে ভালবেসে বলবে না- পালিয়ে বেড়াও কেন হাঁদারাম! তুমুল রোদের ভেতর যখন সে হলের দিকে হেঁটে যায়, বাতাসে পাতলা ওড়নাটি ওড়ে। তখন কী ভাবে সে! সে কি তখনও আমাকে ভালবাসে? ভালবাসে না! ভালবাসা কি এত সহজে ফুরিয়ে যায়! ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আমি দ্বিতীয় ভুলটা করি।
২০০২