
জীবন আমার বোন : একটি অস্তিত্ববাদি উপন্যাস
[বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম মাহমুদুল হক (ডিসেম্বর ১৬, ১৯৪১-জুলাই ২২, ২০০৮)। জীবন আমার বোন, অনুর পাঠশালা, নিরাপদ তন্দ্রা, কালো বরফ উপন্যাস এবং খেলাঘর ও প্রতিদিন একটি রুমাল এর মতো গল্পগ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের অসাধারণ শক্তিমত্তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বাংলা ভাষায় তিনি বিবেচিত হন অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক হিসেবে। মাহমুদুল হক মূলত মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে জটিল সমাজ বাস্তবতার মধ্যে মধ্যবিত্তের নানা টানাপোড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন তার যাদুকরী ভাষাশৈলীতে। আজ এই প্রখ্যাত কথাশিল্পীর প্রয়াণ দিবসে প্রতিকথার পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে মাহমুদুল হকের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে প্রকাশ করা হল চারটি মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ। লিখেছেন- কবি ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ, কথাসাহিত্যিক আবু হেনা মোস্তফা এনাম, গবেষক নূর সালমা খাতুন, ও প্রাবন্ধিক মনোজ দে। -সম্পাদক]
কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক (১৯৪০-২০০৮) এমন এক সময় মারা গেলেন- যখন বাংলা উপন্যাসের ঠিক দেড়শততম বর্ষপূর্তি চলছে। তবে বর্ষপূর্তি বললে উৎসবের যে আমেজ তৈরি হয়; বাস্তবে তার রঙ লেগেছে বলে মনে হয় না। তবু ফুল না ফুটলেও যে বসন্ত তা অস্বীকার করবার জো নেই। অন্তত শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতিরে হলেও জানেন, আজ থেকে দেড়শত বছর আগে ১৮৫৮ সালে প্যারীচাদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামে যে গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, তা-ই আজকের উপন্যাসের পিতৃপুরুষ (অবশ্য নারীবাদীরা একে ঠাকুমাও বলতে পারেন)।
উপন্যাসের পরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি, বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্কিমচিন্তা ও ঋজুভাষা বাংলাভাষার পাঠককে প্রভূত আনন্দ ও বিতর্ক দান করেছিলেন। বাংলা উপন্যাসের তিনি যে সাহিত্য সম্রাটের খেতাব অর্জন করেছিলেন, আজ দেড়শত বছরের মধ্যে অবিতর্কিত কেউ তা কেড়ে নিতে সক্ষম হননি। তবে মুকুটধারী সম্রাট তাঁর খেতাব নিয়ে পড়ে থাকলেও বাংলা উপন্যাসের রাজপুত্ররা এত দূর-দূরান্তের জানা-অজানা রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন, যার সম্পর্কের ঠিকুজি খোঁজা রীতিমত দুরূহ বটে। বঙ্কিম, মীর মশাররফ, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরে বাংলা উপন্যাস বাস্তবিক অর্থেই এতসব অন্ধি-সন্ধি আবিষ্কার করেছে- যার কানাগলিতে আটকে যাওয়া পাঠকের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। এই জটিল সম্পর্কের ঠিকুজি খোঁজার চেয়ে আমরা সরাসরি মাহমুদুল হকে উপন্যাসে প্রবেশ করতে পারি।
আসলে মাহমুদুল হকের উপন্যাস নিয়ে এ লেখাটি আরো তিন দশক আগে লিখলেও তেমন ইতরবিশেষ হতো বলে মনে হয় না। কারণ মাহমুদুল হকের যা কিছু করার তা সেই তিন দশক আগেই শেষ করেছিলেন। ১৯৮২ সালের পরে তিনি তেমন কিছু লেখেননি বলেই এখন পর্যন্ত প্রমাণিত। শক্তিমান লেখেকদের ডুব মারা, চুপমারা কিংবা অল্প বয়সে পটলতোলা একটি চিরাচরিত ঘটনা। তাদের জন্য পাঠকের দরদের সীমা থাকে না। বলা হয়ে থাকে, সাহিত্যে তাদের দেবার ক্ষমতা ছিল অনেক। তিনি সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে পারতেন। কিন্তু তিনি যা দিলেন, তার ব্যাপারে সবাই মুখ ফিরিয়ে থাকেন। মাহমুদুল হকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাহমুদুল হকও লিখিছেন খুব কম সময় ধরে। তার লেখক জীবন ছিল সর্বোচ্চ বছর দশেকের। গ্রন্থগুলো ছিল খুব কৃষকায়। সব মিলে পাঁচশত পৃষ্ঠার একটি মাঝারি সাইজের উপন্যাসের সমান তার সমগ্র রচনা। উপন্যাসের বিশাল জগতে তার এই স্বল্পসংখ্যক কাজ কিভাবে প্রাতিস্বিক হয়ে থাকবে এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হতে পারে। তবু এ কথা তো ঠিক, স্বাধীন বাংলাদেশ পর্বে মাহমুদুল হক বাংলা উপন্যাসে এক অমোচনীয় নাম। হাজারো কাজের ফাঁকে কয়েকটি বাংলা উপন্যাস যেমন ঘুরেফিরে সামনে চলে আসে; কথা সাহিত্যের আলোচনায় মাহমুদুল হকের উপস্থিতিও অনিবার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু কেন যে অনিবার্য আজকের উপন্যাস পাঠক তার খোঁজ রাখেন অল্পই। রাখার দরকারও ঠিক পড়ে না। কারণ উপন্যাসের এই ক্ষয়িষ্ণুকালে পাঠকের সে প্রয়োজনীয়তাও আজ বড় হয়ে দেখা দেয় না।

আমার মনে হয়, উপন্যাসের এই ক্ষয়িষ্ণুতার কথা মাহমুদুল হক ধরতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, বয়স হলেই সবকিছু বুনিয়াদি হয়ে যায় না। বরং দীর্ঘ বয়স বুনিয়াদ উপড়ে দিতে বেশি সহায়ক হয়ে থাকে। তাই এমন শ্লাঘা করার কারণ নেই যে দেড়শত বছরের বাংলা উপন্যাস এখন বড় বেশি শক্ত মাটির ওপর পোক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডালপালা এমন বিস্তার লাভ করেছে, ছোট-বড় ভাষার পাখি ইচ্ছে করলেই এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসতে পারে। বরং আমাদের ভেবে নেয়ার সময় এসেছে, যে প্রয়োজনে উপন্যাসে জন্ম হয়েছিল সে প্রয়োজন আজও আছে কিনা। নাকি সাহিত্যের এই মাধ্যমটির পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। মানুষের গল্প শোনার আগ্রহ আজ চোখের ওপর ভর করেছে।
সবাই একথা জানে, ইংরেজের শিক্ষা ও সহবতে বাংলা উপন্যাসের জন্ম ও যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাংলা উপন্যাসকে ধারণ করেছিল উপনিবেশ আমলের নবসৃষ্ট গদ্যভাষা। ভাষাকে বাদ দিলে থাকে লেখকের গল্প বলার কৌশল। আর এসব কৌশলের মধ্যে লেখক সব সময় সমকালীন তথ্য ও রাজনীতিকে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। আর যার ফলে তা সমকালীন উপাদানের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। গল্প বলা এবং গল্প শোনার অভ্যাস এবং দক্ষতা মানুষের আদিকালের। কিন্তু ভাষা ও রাজনীতির সঙ্গে এর কৌশলও পরিবর্তন হতে বাধ্য। ঊনিশ শতকের আগে কয়েক শত বছর ধরে মানুষ শুনে এসেছে মঙ্গলকবিতা, পদ্মাপুরাণ-বেহুলার ভাসান, গোরক্ষনাথ, লাইলিমজনু-শিরিফরহাদ প্রণয়োপাখ্যান। শত শত বছর ধরে কবিরা একই কাহিনী মনের মাধুরী মিশিয়ে ভাষা অলঙ্কারে সৃষ্টি করেছেন। আর এসব কাহিনী ছিল দৃশ্য ও শ্রুত। দর্শক ও শ্রোতার মনরঞ্জনের দিকে দৃষ্টি রেখে কবিরা অনবরত এসব সৃষ্টি করে চলেছিলেন। কিন্তু শত শত বছর ধরে কবিরা এর পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারেনি। মুকুন্দরামের মধ্যে যতই ঔপন্যাসিকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি থাক না কেন; আলাওল যতই পণ্ডিত হোন না কেন, ভারতচন্দ্রের উইট এবং রসবোধও আঙ্গিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখতে পারেনি। উপন্যাস আধুনিক গদ্য ভাষার সন্তান। আর এই গদ্য ভাষা পড়তে হয় নিজে নিজে। কারো সঙ্গে ভাগ করে গদ্যভাষা পঠনের রেওয়াজ চালু হয়নি। তাই গদ্য স্বার্থপর, একমুখী ও ভিতরগামী। নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা- ইনডিভিজুয়ালিস্ট-ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী। আত্মমেহনে তার সুখ। বাংলা ভাষার ঔপন্যাসিকরা দীর্ঘদিন ধরে পাঠকের সে সুখ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু আজ ঔপন্যাসিকরা বুঝতে পেরেছেন সে দিন বিগত। তাই আজ আর কেউ উপন্যাস লিখছেন না। অন্তত সত্যিকারের উপন্যাস রচনায় যাদের ক্ষমতা ছিল তারাও আজ বসে বসে টেলিভিশনের জন্য স্ক্রিপ্ট রচনা করছেন। টেলিভিশনের স্ক্রিপ্ট রচনা আর উপন্যাস লেখা নিঃসন্দেহে সাহিত্যের একই শাখার কাজ নয়। হয়তো পরিণামে উভয়ই আনন্দ তৈরি করতে চায়। কিন্তু মাধ্যম ভিন্ন। যখন কোনো উপন্যাসের নাট্য কিংবা দৃশ্যরূপ দেয়া হয়। তখন কোনোভাবেই তা আর উপন্যাস থাকে না। তখন তা হয়ে যায় দৃশ্যনাট্য, যা ভিন্ন আঙ্গিকে লিখিত হয়।
এ কথা হলপ করে বলা যায়, আশির দশকের পর থেকে উপন্যাস তার আগের আসন হারিয়েছে। হারিয়েছে এই জন্য নয় যে ভালো উপন্যাস লিখিত হচ্ছে না। কারণ যে সব ভোক্তার কথা বিবেচনা করে উপন্যাস লিখিত হতো তার অবসান হয়েছে। এরপরেও যারা উপন্যাস লিখে চলেছেন তারা দুঃসাহসী। তারা পাঠককে থোড়াই কেয়ার করেন। যে স্বাতন্ত্র্যবাদী মানসিকতা থেকে উপন্যাসের সূত্রপাত হয়েছিল, এখনো সে সব সাহসী লেখকরা, তাদের স্বাতন্ত্র্য ধরার জন্য, কালের সমবায়ী মানসিকতা ধরার জন্য এ মাধ্যম আঁকড়ে আছেন- তাঁরা নমস্য। তাদের উপন্যাস পাঠক পড়ল কিনা, তাঁদের নাম কেউ জানল কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর। মাহমুদুল হকের ক্ষেত্রেও তাই। কয়েক মাস আগে শহীদুল জহির মারা গেলেন, তাঁর জন্যও তাই। সত্যিই তার বন্ধুরা জানতেন না তিনি লিখতেন। অনেকেই জানতেন তিনি ভালো লেখেন। কিন্তু সে ভালোটা কি তা পড়ে দেখার সময় তাদের হয়নি। উপন্যাসপাঠকের কাছে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে; ভালো লেখা জটিল হয়; ভালো লেখা তাল আঁটির মতো শক্ত। ভাষার আবরণ ছিন্ন করতে না পারলে শাঁসের স্পর্শ পাওয়া যায় না। তবুও তারাই কালের আত্মা। আকাশ মিডিয়ার সর্বগ্রাসী বিস্মৃতমান যুগে তারাই মূলত কালের ইতিহাসকার। এ দেশকে জানতে হলে, এখানকার মানুষের সরল-জটিল-কূটিল মানসিকতা জানতে হলে, এ সময়কে ধরতে হলে, এসব ইতিহাসকারের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। মিডিয়ার সর্বগ্রাসী আগ্রাসন, উপগ্রহের আগ্রাসন আজ আমাদের যন্ত্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। এই দানবের আগ্রাসন থেকে আমাদের বাঁচতে হবে। আজ এবং আগামী দিনের মানব চিন্তাকে রক্ষা করতে হবে। একটি জাতির ভাষার পক্ষ থেকে কবি, ঔপন্যাসিক, কথা সাহিত্যিক এ কাজটি করতে পারেন। তাদের রচনায় এমন কৌশল রপ্ত হবে, তাদের চিন্তায় এমন মৌলিকতা আনতে হবে, টেলিমাধ্যম যেন তা ধরতে না পারে। টেলিমাধ্যম যেন তা বাতাসের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে না পারে। টেলিমাধ্যম বড় ক্ষণজীবী, বড় ভঙ্গুর। মানুষের দেহের মতো নশ্বর। টেলিমাধ্যম মানুষের আত্মাকে ধরতে পারে না। মানুষের আত্মা থাকে কবিতায়, উপন্যাসে, দর্শনগ্রন্থে।
মাহমুদুল হকের ইন্তেকালের পরে, এক চিত্র নির্মাতা সাক্ষাৎ দিয়েছেন। তার কাহিনী নিয়ে চমৎকার চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়। গুল। মাহমুদুল হকের কাহিনী ধারণ করে এমন ক্যামেরা কোথায়? মাহমুদুল হকের ভাষা ধারণ করে এমন দৃশ্য কোথায়? চলচিত্রকার দেখেন কেবল একটি কাহিনী। কিভাবে শুরু ও শেষ। কিভাবে ক্লাইমেক্স এবং সাবলাইম। কিন্তু একজন কথাশিল্পী দেখেন, একটি কথা আরেকটি কথাকে কিভাবে আলিঙ্গন করলো; একটি শব্দ কিভাবে অন্য শব্দের মধ্যে প্রবিষ্ট হলো। ভাষা কিভাবে কবিতা হয়; সত্যিকারের কথাশিল্পী তা জানেন। এই শিল্পের সম্রাট বঙ্কিমবাবু দেড়শত বছর আগেই সে কথা বলে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয় সত্যিকারের ভালো কবিতা কেবল উৎকৃষ্টে গদ্যেই লেখা সম্ভব। মাহমুদুল হক সেই সম্ভব করেছিলেন। মাহমুদুল হক উপন্যাস লিখলেও ছিলেন কবি। ভাষাকে ভাষার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গের পর প্রসঙ্গে পরিবর্তন করে দিয়েছেলেন। অদৃশ্যের মধ্যে দৃশ্যকে ধারণ করেছিলেন। এমন রূপক বাকপ্রতিম উপমা উৎপ্রেক্ষা কবিতাতেও সব সময় মেলে না। মাহমুদুল হক তার ভাষায় সে মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। ভাষার রাজরাণী ও চাকরানীকে একই ঘাটে পানি খাইয়েছিলেন। শ্লীল এবং অশ্লীলের পার্থক্য ঘুচিয়ে দেয়ার ক্ষমতা তার ছিল। যে যাই বলুক না কেন, তার জগৎ ছিল কল্পনার জগৎ। তার বুলি ছিল বানানো। তার অসংখ্য স্লাং ব্যবহারে অনেকেই সংহতি প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু কার সঙ্গে সংহতি? অনু যে সাবঅলটার্ন পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সেটিও তার বানানো জগৎ। কাফকার মতো মেটাফোরের জগৎ তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তার কাছে বাস্তবতা বলে কিছু নেই। তার কাছে সব স্বপ্ন। ‘স্বপ্নে ভিতরে আমরা জন্মাই, স্বপ্নের ভিতরে আমরা চিৎকার করে উঠি, ঝনঝন ভেঙে যায় সব কাচ, তির তির করে কেঁপে ওঠে দুধের সর, কৌমার্যের পাতলা পর্দা। স্বপ্নের ভিতরে আমরা স্তন্য পান করি, স্বপ্নের ভিতরে আমরা শিল কুড়াই, স্বপ্নের ভেতরে আমরা বকুল ফুলের মালা গাঁথি, স্বপ্নের ভিতরে অঞ্জু পুকুরে পড়ে যায়, স্বপ্নে ভিতর মঞ্জু তাকে ধরতে যায়, স্বপ্নের ভিতর নীলা ভাবী কাঁচের চুরির শোকেচ হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতর রাজীব ভাই বৈদুর্য-বিদ্রুম হাতড়ায়, স্বপ্নের ভিতর ফিয়াট ঝড় হয়ে ওড়ে, স্বপ্নের ভিতর বেলী ব্লাউজ ছিঁড়ে ফ্যালে, স্বপ্নের ভিতর মোদিল্লিয়ানি রঙ ছুড়ে দেয়, স্বপ্নের ভিতর অর্ধেন্দু মুখ পুড়িয়ে ফ্যালে, স্বপ্নের ভিতরে মতিয়ুর শালিক হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে প্রীতি বিষ গলায় ঢালে, স্বপ্নের ভিতর হাইপোস্টাইল হল ভেঙে পড়ে, স্বপ্নের ভিতরে পার্থেনন গমগম করে বাজে, স্বপ্নের ভিতরে পাপ পুণ্য হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে আত্তিলা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে, স্বপ্নের ভিতরে অন্ধকার হড়াম করে ওঠে, স্বপ্নের ভিতরে দেখতে দেখতে আমরা আরেক স্বপ্ন হয়ে যাই।’ এসবই খোকা ওরফে, বটু ভাই ওরফে মাহমুদুল হকের ভাবনা। এমন একটা স্বপ্নময় জগৎ তাঁর ‘জীবন আমার বোন।’

মাহমুদুল হক হয়তো স্বীকার করতে চাননি কিংবা তার একটি প্রশ্ন থেকেই গেছে তার এই স্বল্পকায় গ্রন্থটি কিভাবে অন্যগুলোকে ছাড়িয়ে গেল? যদিও তার কোনো রচনাই স্ফীত হতে পারেনি। যদিও তার উপন্যাসগুলো উপন্যাস হয়েছে কিনা; চরিত্রগুলো ঠিক মতো বিকশিত হয়েছে কিনা; ডিটেলসে তার পারদর্শী ছিল কিনা; ঔপন্যাসিকের স্থৈর্য্য তিনি রক্ষা করতে পেরেছেন কিনা- এসব বিতর্ক এড়াতে গেলে বিশ্বসাহিত্যের ক্ষীণকায়া সব তীক্ষ্ণধী উপন্যাস এনে দাঁড় করাতে হয়। বলতে হয় আউটসাইডারের কথা, বলতে হয় ওল্ডম্যান অফ দ্য সীর কথা; আবার কপালকুণ্ডলা-বামুনের মেয়েকেও বাদ রাখা যায় না।
জনস্বীকৃতির কাছে পরাস্ত মেনে তার ‘জীবন আমার বোন’ নিয়ে একটু বিস্তৃত আলোচনা করতে চাই। পাঠক প্রায় ধরেই নিয়েছেন এ গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা। লেখক এ উপন্যাসে যে সময়কাল ফুটিয়ে তুলেছেন তাতে পাঠকের এ সিদ্ধান্ত অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। আমার তো মনে হয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কর্তৃত্ববাদী চেতনার কাছে এমন একটি উপন্যাসকে মুক্তযুদ্ধের উপন্যাস বলে চিহ্নিত করা রীতিমত ঝুঁকির কারণ। খোকার মতো একজন শিশ্নোদরপরায়ন নায়ক কিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিনিধিত্ব দিতে পারে। এমন কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে যে নায়কের জীবন উৎসর্গিত হয়নি; কেবল শারীরিক দুর্বলতার বশে যে নায়ক নীলাভাবীর কাছে পরাস্ত হয়, যে নায়ক সময়ের দাবি জেনেও রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যে নায়ক নারীদের মাংসের পিণ্ড ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না, যে নায়ক দেশকে পুত্রখাগী মনে করে তাকে কিভাবে প্রচলিত ডিসকোর্সের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলা চলে। আর যে নায়ক দেশ নয় মুক্তিযুদ্ধ নয় কেবল তার বোনের জন্য বেঁচে থাকতে চায়- বোন মানে তার জীবন। কেবল জীবনের জন্য তার বাঁচা। খুব কায়দা করে এই মেটাফোরটি তিনি লাগিয়েছেন। নাম দিয়েছেন, জীবন; জীবনের নাম বোন; বোনের নাম রঞ্জু। সহোদরা। একই মায়ের উদর থেকে বেরিয়েছিল শরীর ও জীবন। জীবন মানে বোন- জী+বোন= জীবন। এক্স এবং ওয়াই। রঞ্জু নামে যে সহোদরার সঙ্গে খোকার কথোপোকথন; সে বোন না হলেই বা কি?
মাহমুদুল হক রক্তপাতের বিরুদ্ধে তার এ উপন্যাসে এক শুদ্ধোদনের পুত্র। এমনকি দেশের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন খোকা। ‘যে দেশ রক্ত দাও রক্ত দাও বলে দুশো বছর ধরে চিৎকার করে চলেছে আমাদের কেউ নয় সে, দেশ মাতৃকা তুই নস! যে দেশ কেবল জন্মান্ধ রাক্ষসপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে লক্ষ লক্ষ দরিদ্রকে তোড়ের মুখে ভাসিয়ে নিয়ে যায়.. তাকে বিশ্বাস নেই, দেশ মাতৃকা তুই নস!’
তাহলে কিসের জোরে উপন্যাসটি দাঁড়িয়েছে? কারণ সঠিকভাবে এ উপন্যাসকে, এ উপন্যাসের নায়ককে বুঝতে না পারলে, যে কোনো তরল ঔপন্যাসিক এ ধরনের রচনায় প্রলুব্ধ হতে পারেন। আমার মনে হয়, উপন্যাসটি দাঁড়িয়ে আছে তার সততার জন্য, সরল সত্যের জন্য, নির্ভেজাল উপলব্ধির জন্য, ভণ্ডামির বিরোধিতার জন্য, নায়কের প্রচণ্ড অস্তিত্ববাদিতার জন্য। এমন অস্তিত্ববাদি উপন্যাস; এমন সত্যবাদি উপন্যাস মুক্তিযুদ্ধকালের ঘটনা নিয়ে একটিও লেখা হয়নি। আলবেয়ার কাম্যু তার আউটসাইডারের নায়কের ব্যাপারে ঠিক একই কথা বলেছিলেন। এমন কি ছিল তার নায়কের মধ্যে, এমন কোন মহৎ ঘটনার জন্য তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। কিছুই না। কেবল ঈশ্বরে তার অবিশ্বাস- এটা তো কোনো মহৎ ঘটনা হতে পারে না। কাম্যু তাই আফটারওয়ার্ডে লিখেছিলেন- ‘আমার নায়কের ঈশ্বর অবিশ্বাসে পাঠক যেন প্রলুব্ধ না হয়। কারণ এটি উপন্যাসের মূল বিষয় নয়। বরং যিশুখ্রীষ্ট যে উপলব্ধিগত সত্যের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, আমার নায়কও তেমন সত্যের জন্য প্রাণ দিয়েছে। অর্থাৎ তার জীবন তাকে যেভাবে পরিচালিত করেছে, যে সত্যে তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে সেভাবেই সে চলেছে। সে যা অনুভব করেনি, যে সত্য তাকে তাড়িত করেনি তাকে স্বীকার করে নেয়া তার কাছে ভণ্ডামি মনে হয়েছে। আর এই ভণ্ডামি করতে পারেনি বলে, মিথ্যা বলতে পারেনি বলে তাকে মিথ্যার পৃথিবীতে হত্যা হতে হলো।’

খোকা পালাতে চায়নি; খোকা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়নি। কিন্তু তাকে তাড়িত করেছে তার জীবন; তার বোন- তার বেঁচে থাকার আনন্দ। একাত্তরের কালরাত্রির প্রচণ্ড নৃশংসতার মাঝে, রাজীব ভাইয়ের গুলি খাওয়া লাশের সঙ্গে; জীবনের চেয়েও দীর্ঘ দুই রাত্রির সঙ্গে কাটাতে হয়েছিল। যে বোনকে তিনি আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলেন। সে বোনকে, সে জীবনকে তিনি বাঁচাতে পারেননি। অবশেষে খোকা ঠিকই বুঝেছিলেন, ‘একা বেঁচে থাকার অধিকার তার বিষণ্ন দেশ কিছুতেই দিতে পারে না রঞ্জুকে’- তার জীবনকে। এই উপলব্ধির দ্বারা একই সঙ্গে আমরা তার উপন্যাসে ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অস্তিত্বের সাক্ষাৎ পাই। মানুষ একা বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু কারো পক্ষে একা বাঁচা সম্ভব নয়। তাই যুথবদ্ধ জীবনের মধ্যেই মানুষের অস্তিত্বের মুক্তি। মাহমুদুল হক শেষপর্যন্ত তার উপন্যাসে যুথবদ্ধ জীবনের জয়গান ঘোষণা করেছেন। কিন্তু খোকা সেই জীবনের কেউ নয়। খোকা ‘কাঁদো নদী কাঁদো’র মুহম্মদ মুস্তফা- যে নিজে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু একা কেউ বাঁচতে পারে না। মুহম্মদ মুস্তফাও পারেনি।
মাহমুদুল হকের ‘অনুর পাঠশালা’য় প্রাথমিক উপাদানের মধ্যে পথের পাঁচালীর উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু বিভূতিভূষণের স্থৈর্য্য তার ছিল না। বেশি সময় ধরে কোনো কিছু গড়ে তোলা তার চরিত্রবিরোধী। তবু তার ছিল পাঠকের উত্তেজনাকে টানটান করে তোলার ক্ষমতা। সরুদাসীর মতো একটি প্রক্ষিপ্ত চরিত্র। একটি ডোম্বী চামারিনী চরিত্রকে তিনি এ উপন্যাসের কেন্দ্রে উপস্থাপন করে এক কিশোরকে আবর্তিত করেছেন। এ উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্র কিশোর। কিন্তু এ উপন্যাসের কাহিনী ও ডায়ালগ প্রাপ্তবয়স্ক। এ ধারণাটি বাংলা উপন্যাসে নতুন। এ উপন্যাসে এক নিস্পৃহ ভঙ্গিতে স্বপ্ন জগৎ গড়ে তুলেছেন। অনুর পাঠশালা না বলে গল্পটিকে রানুর প্রথম পাঠ বললেই ভালো হয়। এখানে রানু- সরুদাসী; এখানে অনু তার অপর নাম। ‘কালো বরফ’ উপন্যাসটিও শিশু কৈশোরের স্মৃতিকাতরতায় ভরা। সাতচল্লিশের ভারত বিভাগের পটভূমিকায় রচিত। অদ্ভুত স্মৃতিকাতরতায় ভরা। জীবন থেকে নেয়া। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের সময় বটু ভাইদের চলে আসতে হয়েছিল ভারত ছেড়ে। দেশ মানে স্মৃতি; প্রতিবেশের যাদের নিয়ে বেড়ে ওঠা। মানুষের স্মৃতি অনেক বড়। তাই তার দেশও বড়। চেনা পরিবেশ থেকে যে উন্মূল হয় তার কোনো দেশ থাকে না। তার দেশ থাকে হৃদয়ের গভীরে, স্মৃতিতে, বেদনায়। ‘মাঝে মাঝে দু’একজন জিগ্যেস করে, হ্যারে তোর বাবা পাকিস্তানে গেল কেন রে, তোর বাবা নাকি ভালো লোক নয়? এ সব শুনে মন খারাপ হয়ে যায় ভীষণ, ইচ্ছে করে না কারো সঙ্গে মিশি, কারো সঙ্গে কথা বলি। আমি যে মুসলমান, ধীরে ধীরে তা বুঝতে পারার জন্যও কষ্ট হয়, নিজেকে অপরাধী মনে হয়।’ পৃথিবীর সব অভিবাসী লেখকদের স্মৃতি একই রকম। একই বেদনার সন্তান তারা। রশীদ করীমের ‘উত্তম পুরুষ’ও এ বোধ নিয়ে লেখা হয়।
মাহমুদুল হক ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ উপন্যাসে হিরন নামের এক গ্রাম্য বালিকার ভেসে বেড়ানো কাহিনী বলেন। যে তার প্রেমিকের হাত ধরে একদিন অজানায় পাড়ি জমিয়েছিল। ভালোবাসা পেতে চেয়েছিল। বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। বলেছিল জীবন আমার নয়নের মণি। এখানেও অস্তিত্বের সংগ্রাম। তবু তার কষ্ট সরুদাসীর মতো অনিবার্য।
মাহমুদুল হক মূলত রূপদক্ষ শিল্পী। ভাষার যাদুকর। শ্লীল-অশ্লীল আঞ্চলিক কুকনি- সব তার হাতে পড়ে একাকার হয়ে যায়। তবু ভাষার কাঠামো গঠনে তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো পরিশুদ্ধবাদী। তার বিষয় যা-ই হোক না কেন, ভাষার কাঠামো হওয়া চায় ঋজু ক্লাসিক। তিনি চিন্তার অনুগামী ভাষা তৈরি করে নিতে পেরেছেন। ছোট-বড় বাক্য গঠনের সমান দক্ষতা, ভাষার মধ্যে নাটকীয়তা সৃষ্টি করা। বহুমুখী শব্দ ব্যবহারে ভাষার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে তোলার প্রতি তার ছিল সমান আগ্রহ। তাছাড়া ভাষার শক্তি নিহিত থাকে তার বাগধারার মধ্যে। যে বাগধারা মাহমুদুল হক অবলীলায় ব্যবহার করতে পেরেছেন। তাঁর গদ্য থেকে দুএকটি উদাহরণ দেয়া যাক:
১. ‘বাংলাদেশ, তুমি শুয়ে আছ অর্ধেন্দু দস্তিদার হয়ে, থেকে থেকে কাতরাচ্ছ, বোমা বিস্ফোরণে নিদারুণ ক্ষত-বিক্ষত তোমার মুখ; তোমার মুখ পুড়ে গেছে। বাংলাদেশ, তুমি মরে গেছ প্রীতিলতার মতো বিষপান করে। বাংলাদেশ তুমি বুলেটবিদ্ধ আনোয়ারা, কোলের শিশুকে স্তন দিতে চাও? বাংলাদেশ তুমি রাক্ষসী, একটা শালিকের মতো শিকার করেছ মতিয়ুরকে। বাংলাদেশ তুমি কারফিউ, গভীররাতে যার বস্ত্র হরণ করতে গিয়ে মারা পড়েছি আমরা।’
২. ‘লুলু চৌধুরীর পাছাটা ঠিক যেন আধমুনে ধামা, একটা চোস্ত খাজুরাহো, লুলু চৌধুরীর নদগড়ে পাছা দুলিয়ে হাঁটা, ঢুলঢুলি চাহনি আর ফিক করে হাসা দিয়ে গোটা আদমজি জুটমিলটাই কেনা যায়… লুলু চৌধুরীর শাড়ি পরার স্টাইলটা মারাত্মক, মনে হয় আর দেড় সেকেন্ডের ভেতর গা থেকে সব আবরণ ঝরঝর করে খুলে পড়ে যাবে,’ হামেশাই মওলা রহমান নুরুদ্দিনের মুখ থেকে এসব মন্তব্য শোনা যায়।’
৩. ‘ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে গলা বের করে সরুদাসী চিৎকার জুড়লো, ‘মর মর, মাথায় বাজ পড়ে মর! তুই আমার- তুই আমার মুড়োঝাটা! গয়েরখেকো, খ্যাংরা মারি তোর মুখে!’
নিজস্ব ভাষা নির্মাণ, কল্পনা করার শক্তি, শিল্পীসুলভ নিস্পৃহতা, যে কোনো চরিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়ার ক্ষমতা মাহমুদুল হককে বাংলা উপন্যাসে একটি স্থায়ী আসন নিশ্চিত করেছে।
অলংকরণ- মারুফ ইসলাম