
জীবন আনন্দ খোঁজে : তবুও ‘অদ্ভুত আঁধার’
জীবন সম্পর্কে যে-কোনো বক্তব্যকেই আমি যৌক্তিক, প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় মনে করি। কারণ, জীবন কী তা যেমন আমার কাছে অস্পষ্ট, তেমনি জীবন কী নয় সে সম্পর্কেও আমি স্পষ্ট কিংবা স্থির সিদ্ধান্তের নিকটবর্তী হতে পারিনি। আমার আনন্দও এই অস্পষ্টতা ও ব্যর্থতার ধারায় স্নাত। জীবননির্ভর অনিশ্চয়তা ও আনন্দ-আশ্রয়ী দ্বিধাদ্বন্দ্ব আমার মধ্যে যে ঘোর তৈরি করে, তার প্রভাবে আমার ‘হাত ফসকে যায় ঘোড়ার লাগাম’। ফলে অপরিণামদর্শী, অমিতভাষী ও অমিতব্যয়ী হয়ে উঠি আমি। নানা মুণির নানা মতের সরণি বেয়ে আমি নানা মনের নানা পথে পৌঁছাতে চাই। অন্যভাবে বলা যায়, আমার কোথাও যাওয়া হয় না শেষ পর্যন্ত। এই না যাওয়ার ভালো নাম কারো ভাষায় গন্তব্যহীনতা হতেই পারে, কিন্তু এ-বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতেই রাজি নই। আমার চলতে ভালো লাগে। চলতে চলতে পথ আমাকে কোন দিগন্তে ঠেলে দেবে তা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার আগ্রহ আমার নেই।
নীরব পথিক আমি নই। বলতেও ভালো লাগে আমার। আড্ডায় আমি কান্তিহীন কথাকার, বক্তৃতায় আমিও দিগ্বিজয়ী বখতিয়ার খলজি, আলোচনায় আমি অনেক বেশি অনিয়ন্ত্রিত। ফলে আমাকে জড়িয়ে ধরার লোক সীমিত হলেও এড়িয়ে চলার মিছিল ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে। যৌক্তিক কারণেই এমনটি ঘটে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ, কী বলি তা আমার কাছেই অনেক সময় অস্পষ্ট। আর তা অন্যের কাছে পরিষ্কার করে তোলা কিংবা তাদের বোধযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব নিতেই আমি নারাজ। ফলে আমার কথা কেউ যদি বুঝতে চান, তাহলে তা নিজ দায়িত্বে বুঝে নিতে হবে। এতে হতাশ হওয়ার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না, বরং সুবিধে অনেক। আমি নিজেও অন্যের বক্তব্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারি না। আমি আমার মতো করে অন্যের মত ও মন্তব্য, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন, অবস্থান ও অভিজ্ঞান থেকে আমার জন্য প্রয়োজনীয় কিংবা প্রাসঙ্গিক অংশ নিঙ্ড়ে নিতে ভালোবাসি। এই বিবেচনা শিল্পসাহিত্যের রসাস্বাদনের ক্ষেত্রেও নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করি আমি। ফলে এই লেখা পড়ে জীবনানন্দের নিঃসংশয় ভক্ত, নিবিড় পাঠক ও নিরাবেগ গবেষকবৃন্দ আমার ওপর যার-পর-নাই ক্ষুব্ধ হবেন- এই প্রস্তুতি নিয়েই আমি কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি।
আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু, যিনি আমার সৃজনশীল রচনার অসারতা এবং বিশ্লেষণধর্মী গদ্যের গলদ সম্পর্কে বরাবরই নিশ্চিত থাকেন এবং আমিও তাঁর হাতে নাজেহাল হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই নির্বিচারে লিখে যাই, তিনি প্রায়ই রসিকতা করে বলেন, জীবন ও আনন্দ সম্পর্কে যার ধারণা স্বচ্ছ নয়, তিনি জীবনানন্দের দুশমন, তাঁর সমগ্র রচনা, বিশেষ করে কবিতা তাকে অভিশাপ দেবে। আমার এই সজ্জন বন্ধুর বক্তব্য দৃশ্যত হেসে উড়িয়ে দিই আমি, কিন্তু আমার ভেতরে ভেতরে কাজ করে অন্য ভাবনা, অন্যরকম এক অনুরণন। এ তো সহজ সাধারণ কথা নয়! এই মন্তব্যের মর্মে যে গভীরতর দর্শন নিহিত, তার ওপর ভিত্তি করেই জীবনানন্দের একটি কবিতার ওপর আলোকপাত করতে চাই। জীবন ও দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে ছাত্রজীবনে শ্রেণিকক্ষে অনেক কথা শুনেছি। এখন শিক্ষকতা করতে গিয়ে না বুঝেই অনেক কথা অন্যদের শোনাই এবং তারাও আমার মতো বোঝার ভান করে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। আমি নিশ্চিত যে, এই লেখায়ও বন্ধুর মন্তব্য-উৎসারিত সেই দর্শনের বিন্দুবিসর্গ ধরা পড়বে না। তাই লেখার শিরোনামে বেঁধে দিলাম জীবন ও আনন্দের গাঁটছড়া। এই দুইয়ের সম্পর্কের ফাঁটল দিয়ে আমি জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার এক‘ কবিতাটির ভেতর-বাহির দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব। জীবন, আনন্দ কিংবা জীবনানন্দ সম্পর্কিত আড্ডায়-আলোচনায়-গবেষণায় বহুল চর্চিত, উদ্ধৃত ও বিশ্লেষিত এই কবিতাটি আরেকবার পাঠ করা যাক :
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এই পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
(অদ্ভুত আঁধার এক : জীবনানন্দ দাশ)
এই কবিতার পাঠোদ্ধার কোনো কাব্যবোদ্ধা বা শিল্পসমালোচকের মুখাপেক্ষী নয়। অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন বাঙালি পাঠকের কাছে খুব সহজ-সরল-স্পষ্ট করেই নিজেকে হাজির করেছেন জীবনানন্দ। যা বলতে চেয়েছেন কবি, তার পুরোটাই কবিতার শরীরে উন্মুক্ত। ফলে আরামপ্রিয় পাঠকের কাছে এই কবিতা অঢেল প্রশংসা আদায় করে নেয়। যে কবিতা পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের সমর্থন অর্জন করে, সেই কবিতাকে ভালো কবিতা বা উৎকৃষ্ট কবিতা বলতে চান অনেকেই। সত্য এই যে, কবিতাটি পাঠকের বিবেককে যতোটা নাড়া দেয় হৃদয়কে ততোটা নয়। কবিতার পাঠকের কাছে আমরা যে সৃজনশীলতা ও কল্পনাপ্রতিভার বিচ্ছুরণ প্রত্যাশা করি, এই কবিতার ক্ষেত্রে তা প্রাসঙ্গিক নয়। সমাজ-স্বকালনিষ্ঠার স্বাক্ষর এতে তীব্র হলেও হৃদয় ও রসের সংরাগে উদ্দীপ্ত হওয়ার মতো উজ্জ্বল কোনো অনুষঙ্গ কবিতার মর্মে গেঁথে নেই। অথচ ভালো কবিতা তো হৃদয়ের কাছেই তার প্রয়াস ও প্রত্যাশার ডালপালা বিস্তার করতে চায়। এ-বিষয়ে অন্য অবসরে বিস্তৃত আলোচনা করা যাবে। আপাতত এটুকু বলা যায়, যে জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার অননুকরণীয় অধীশ্বর হিসেবে সেকাল-একালের ভক্ত-পাঠক-সমালোচকের হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রাখেন, এই কবিতায় সেই জীবনানন্দ অনুপস্থিত। এ-জাতীয় বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্যে ঠাঁসা কবিতা তিনি খুব বেশি লিখেছেন বলে আমার মনে হয় না।
এমন এক নির্মম বাস্তবতার বিষ নিঙ্ড়ে নির্মিত হয়েছে এই কবিতা, যা কবির যাপিতজীবনের দুঃস্থ-ধূসর-দুঃসহ অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। প্রতিদিনের পরিচিত পৃথিবী এবং চেনাজানা মানুষগুলোর মর্মে তিনি আলো ফেলেছেন। জীবন সম্পর্কে উচ্চতর কোনো আশাবাদ তাঁর কবিতার মূলসুর নয়। কিন্তু জীবনকে ধারণ, যাপন ও উদযাপনের একটা নিজস্ব ব্যাকরণ তিনি প্রণয়ন করতে চেয়েছেন। এ-কাজে তাঁর সাফল্যও ঈর্ষণীয়। কিন্তু ভাষা যেমন ব্যাকরণের বিধিবদ্ধ পথ থেকে বাইরে এসে নিজের যৌবনকে অনুভবসম্ভব ও দৃশ্যমান করে তোলে, তেমনি জীবনও বিশেষ বিধানের আনুগত্য স্বীকার করতে চায় না। এই কবিতায় জীবনানন্দ হেঁটেছেন তাঁর চেনা পথের বাইরে, বলেছেন অন্যরকম কিছু কথা, এঁকেছেন সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি ছবি, যে কথা ও ছবি তাঁর ইচ্ছের প্রতিনিধিত্ব করে না। মানুষ সম্পর্কে যে দার্শনিক বোধ, বিশ্বাস ও আজন্মলালিত সংস্কার তাঁকে বাঁচতে শিখিয়েছে, সেই বোধ-বিশ্বাস-সংস্কারের মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তিনি তাঁর পাঠকের দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছেন।
অতৃপ্তি-অপ্রাপ্তি-অচরিতার্থতা কিংবা হতাশা-দীর্ঘশ্বাস-দুঃস্বপ্নের কথা তো কবিতায় কম বলেননি জীবনানন্দ। মানুষের নিষ্প্রাণতা-নিষ্ঠুরতা-নির্মমতার কথাও তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে। ভালোবেসে, ঘৃণা করে, অবহেলা করে তিনি শুধু মেয়েমানুষকেই দেখেননি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাঁর শিল্পকর্মে প্রবৃত্তির শেকড়সমেত মুদ্রিত হয়েছে। সমুদয় মানবস্বভাবের অন্ধকারকে তিনি সারাজীবনই নানা অবয়ব ও রূপকল্পে হাজির করেছেন কবিতায়। কিন্তু এমন হতাশ-বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত তো কখনো মনে হয়নি তাঁকে। আলো ও অন্ধকার- যেখানেই তিনি গিয়েছেন, সক্রিয় থেকেছে তাঁর বোধের জগৎ। সেই বোধ তাঁকে ক্লান্ত করলেও কখনোই জীবনের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণায় ভেঙে পড়েননি কবি। জীবনানন্দ লিখেছেন-
মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।
(মানুষের মৃত্যু হলে : শ্রেষ্ঠ কবিতা)
এই কথা জানিয়েছেন যে কবি, হঠাৎ তিনি এ কোন্ মানববর্জিত, মানবতাবিঘ্নিত, বিকলাঙ্গ বিশ্বের সামনে এসে দাঁড়ালেন? এই কবিতায় এমন কেউ কি অবশিষ্ট আছেন যিনি ভবিষ্যতের মানুষের কাছে ‘চেতনার পরিমাপ নিতে’ যাবেন? এই কবিতায় বিধৃত জীবনানন্দকে তো আগে কখনো দেখেনি তাঁর পাঠককূল। তাই বিস্ময়ের চোখ মেলে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় ক্ষণকাল। ঘোর কেটে যাওয়ার পর হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই স্পর্শ তো কোনো সদর্থক শিহরনে উদ্দীপিত-উদ্বেলিত-উদ্ভাসিত করে না। তবুও নিজের চোখ-কান-প্রাণের ওপর আস্থা রাখতে হয়, এবং বলতেই হয়- হ্যাঁ, ইনি সেই জীবনানন্দই বটে। বাস্তবের চাপে প্রায় পুরোটাই বদলে যাওয়া সেই চিরচেনা স্বজন, ‘অদ্ভুত আঁধারে’ মজ্জমান কবি জীবনানন্দ দাশ।
অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে জন্ম নেওয়া কবি নজরুলের ললাটে আমরা বিদ্রোহী কবির তিলক পরিয়ে দিয়েছি। তাঁর বিদ্রোহ যে সকল কালেই প্রাসঙ্গিক, তার নজির কবি নিজেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় রেখে গেছেন- ‘আমি সেই দিন হবো শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না’, ইত্যাদি। জীবনানন্দের স্বভাব নজরুলের এ-জাতীয় উচ্চারণের অনুগামী নয়। কিন্তু ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় জীবনানন্দ যে অন্ধকারের কথা বলেছেন, সেই অন্ধকার তো যুগে যুগে ঘনীভূত রূপে, নতুন অর্থে ও অবয়বে আবির্ভূত হচ্ছে। তাই এই কবিতা প্রতি দিনের বাস্তবতাকে অস্থি-মজ্জায় ধারণ করে নতুনভাবে জন্ম নিচ্ছে। এতো অন্ধকার এর আগের কোন্ যুগের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে? জীবনানন্দ জানতেন তাঁর ভবিষ্যতকে, প্রত্যেক কবিকেই জানতে হয় অনাগত কালের গর্ভে সুপ্তলীন সত্য ও সুন্দরকে, স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে, প্রয়াস ও প্রত্যাশাকে। কবি কি কেবল ভবিষ্যতের সদর্থক বিশ্বেরই স্বপ্নদ্রষ্টা? তিনি কি আসন্ন অন্ধকার ও অন্ধ-কারার দুঃখ-দীর্ঘশ্বাস অনুধাবন করেন না? করেন বৈ কি। কিন্তু কবিতায় আমরা একজন জীবনবাদী কবিকে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে আলোর দিকে ধাবিত দেখতে চাই। দুঃখ ও দীর্ঘশ্বাসের বুক চিড়ে তিনি সুখ ও স্বস্তির মণিমুক্তা সংগ্রহ করছেন- এরকম দেখতে ভালোবাসি। কিন্তু যে ‘নাবিক হাল ভেঙে হারিয়েছে দিশা’, তার মনে কি মৃত্যুর অমানিশা বাসা বাঁধে না? এই কবিতা বোধকরি সেই গভীর অমানিশা থেকেই উৎসারিত।
বলছিলাম, এই কবিতা প্রতিদিনের বিরূপ বাস্তবতার দ্যোতক হিসেবে আমাদের বিবেকের দরোজায় দণ্ডায়মান। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতাটি তার শরীরে ধারণ করছে স্বকালসম্পৃক্ত নানা অনুষঙ্গ ও অলঙ্কার। তাই সকল কালের সাপেক্ষেই এটি একটি সদ্যোজাত কবিতার স্নেহ-সম্মোহন-স্বীকৃতি নিয়ে উপস্থিত হয়। এই কবিতার একজন সমমনা প্রতিবেশি আছেন, নাম ‘এক অন্ধকার থেকে’, যেখানে অন্ধকারের সঙ্গে আলোর সহাবস্থানের কথা বলেছেন জীবনানন্দ-
এক অন্ধকার থেকে এসে
অন্য এক আঁধারের দিকে
মুখ ফেরাবার আগে-
কয়েক মুহূর্ত কথা কাজ চিন্তা রয়েছে এ জীবনের
দেখেছি সূর্যের আলো, নিয়নবাতির বিচ্ছুরণ,
অন্ধকার অজন্মা প্রান্তর, মৃত, অর্ধমৃত নগর বন্দর,
শোকাবহ আলো শব্দ শেল,
কান্তিহীন ক্রেন এরিয়েল,
(‘এক অন্ধকার থেকে’)
এখানে আলোর চেয়ে অন্ধকার, অন্তত নেতিবাচক চেতনার দাপটই অধিকতর মনে হয়। কিন্তু অন্ধকারের কাছে মানুষের জীবন পরাস্ত হবে না- এইরকম একটি প্রত্যয় কবিতাটির মর্মে নিহিত আছে। বিশেষ করে কবি যখন বলেন, ‘মনে হয় যেন মানুষের মন তবু কোথাকার/কালো দুই বালুতীর ভেদ করে ফেলে/চলেছে নদীর মতো- /চারিদিকে জনতার সকাতর কোলাহল- /ঘর বাড়ি সাঁকো।’, তখন তো আশায় বুক বাঁধতেই ইচ্ছে করে। যে জীবন ‘জ্ঞানপাপ মুছে ফেলে হতে চায় জ্ঞানবৃক্ষের মত’ সেখানে অন্ধকার থাকলেও ‘নির্দোষ আলো’র দিকে দৃষ্টি ফেরাতে ভালো লাগে। সচল নদী, জন-কোলাহল, ‘পাখি ও মানুষের করুণ পায়ের চিহ্ন’ তো সুস্থ-সুন্দর-স্বাভাবিক জীবনের প্রতি কবির অবিচল আস্থার কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই কবিতায় অন্ধকারে অন্ধকার ঘঁষে আলো জ্বালাবার মতো দীর্ঘ তপস্যার প্রতি কবির পক্ষপাত স্পষ্ট। এখানে জীবনানন্দ দাশ ‘লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ভেলা’ নন, বরং জীবনের তীরে এসে মানব হৃদয়ের ‘ভুবনমোহন আসনখানি’ অধিকার করতে চেয়েছেন। আধুনিক কবিতায় ‘ব্যক্তের মধ্যে অব্যক্ত ও অনির্বচনীয়কে ধারণ’ করার কথা উল্লেখ করে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘এই আলো-আঁধারকে আমরা আধুনিককালের কবিতার প্রধান গুণ বলে জেনেছি- এটিই আসল, এটাই সব- এই গুণটি থাকলে কবির হাতে কবিতা শেষ হলেও পাঠকের পক্ষে তা নিঃশেষ হয় না।’ বুদ্ধদেবের এই জানা-শোনার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। আমি নিজেও মনে করি, কবিতা কেবল কবির হৃদয় ও মস্তিষ্কেই তার জন্মপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে না, তাকে পাঠকের হৃদয়েও বারবার বিচিত্র উপায় ও অবয়বে জন্ম নিতে হয়। আমার এই দাবি সকল কবিতাই মেটাতে পারবে তা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু কবিতা পাঠ করার সময় এই প্রত্যাশা আমার মধ্যে সক্রিয় থাকে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতা আমাকে সৃজনশীল হয়ে ওঠার প্রস্তাব, পরামর্শ কিংবা প্রণোদনা দেয় না, বরং বিবেকবান হয়ে উঠতে বলে। আমার দাবি নিশ্চয়ই এই নয় যে, বিবেকের প্রয়োজন এ-কালে ফুরিয়ে গেছে। জাগ্রত বিবেকের যে খরা চলছে বিশ্বময়, এই কবিতা তো সেই নির্মম বিশ্বেরই মানচিত্র বা চালচিত্র আঁকতে চেয়েছে। বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে রেখে কিংবা কোনো প্রভাবশালী মহাজনের কাছে বন্ধক রেখে যারা এই পৃথিবীকে বিষাক্ত করে তুলছে, জীবনানন্দের অন্ত্র তাদের দিকেই তাক করা। এই কবিতার জন্মকাল কিংবা জন্মরহস্য নিশ্চিত হওয়া সম্ভব কি-না জানি না, কিন্তু একটি বিষয়ে কোনো অনিশ্চয়তার ধোঁয়াশা নেই যে, এই কবিতার শরীরে এখনো আঁতুড় ঘরের গন্ধ লেগে আছে।
সেই কবে জীবনানন্দের কবিতার প্রেমে পড়েছি তা আর আজ স্পষ্ট করে মনে করতে পারি না। এই প্রেমে পড়ার সঙ্গে জীবনানন্দের প্রেমের কবিতার সম্পর্কই নিবিড়। বিশেষ করে প্রেমের সার্থকতার আনন্দ কিংবা ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস তখন জীবনানন্দের সাহায্য ছাড়া উপভোগ্য হয়ে উঠতো না। অবশ্য প্রেমের কবিতা সম্পর্কে আমার ধারণা তখনো পরিষ্কার হয়নি। এখনো যে তা খুব স্বচ্ছ তা দাবি করবো না। কিন্তু এই নিবন্ধে আলোচিত কবিতাটির সঙ্গে পরিচয়সূত্রে আমার ব্যক্তিগত ঋণ স্বীকারের দায় আছে। এই কবিতাটি নিজের মতো করে অনেকবার পড়েছি, কিন্তু এই কবিতার অন্তর্গত অদ্ভুত আঁধারকে যিনি আমার মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন তিনি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, বিশিষ্ট ভাবুক ও বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। ২০০৩-এর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিলে ভর্তি হওয়ার কথা ভাবছি। পরিচয় দেওয়ার মতো উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু ছিল না তখন। তবু তিনি সাদরে তাঁর অফিসকক্ষে আমাকে ডেকে নিয়ে ধর্ম-রাজনীতি-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলেছিলেন। আমি একটু-আধটু লেখার চেষ্টা করি শুনে তিনি খুব খুশি হয়ে আমার প্রিয় কবির নাম জানতে চাওয়ায় জীবনানন্দের নাম বলেছিলাম আমি। তারপর আলাপ-প্রসঙ্গে এই কবিতাটি মুখস্ত শুনিয়েছিলেন স্যার। পরবর্তী সময়ে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত ঘনিষ্টতা ও পড়াশোনার সুবাদে জানতে পেরেছি, এই কবিতাটি তাঁর আলোচনা ও লেখালেখির কারণেই বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। আবুল কাসেম ফজলুল হক আধুনিকতা ও জীবনানন্দের জীবনোৎকণ্ঠা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ঢাকায় ১৯৬০-এর দশকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আতঙ্ককালে- উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ঠিক আগে- আমি এই কবিতাটিকে নিজের লেখায় বারবার উদ্ধৃত করে ও নানা জায়গায় পুনর্মুদ্রণ করে জনমনে সংগ্রামী স্পৃহা জাগাতে চেষ্টা করেছি, এবং দেখেছি- কবিতাটি পড়ে মানুষ অত্যাচারী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়েছে।’ এই কবিতা পড়ে সংগ্রামী মানুষের ক্ষুব্ধ হওয়ারই কথা। ‘যাদের গভীর আস্থা আছে মানুষের প্রতি’, কিংবা ‘এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়/মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা’, তারা তো ক্ষুব্ধ না হয়ে পারে না। এই কবিতা মানবচরিত্রের যে পৈশাচিক দিকটিকে ধারণ করে আছে, তার চেয়ে অধিকতর হিংস্র ছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের সমুদয় কর্মকাণ্ড। একাত্তরে এদেশে যে গণতহ্যার উৎসব করেছে মানুষের মুখোশধারী পশ্চিমা পশুর দল, আর এদেশীয় সুবিধাবাদী-দালালচক্রের দুর্মর দাপট- পাকিস্তান নামক ‘পৃথিবী অচল ছিল যাদের সুপরামর্শ ছাড়া’- তাদের নির্মমতাকে স্পর্শ করতে পারেন, স্পষ্টত কবিতায় ধারণ করতে পারেন, এমন কবি কি কোনোদিন জন্মগ্রহণ করবেন এই বাংলাদেশে?
দেড় যুগেরও অধিককাল এই কবিতাটি আমার মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে। প্রথম শ্রবণে আমি বিস্মিত না হয়ে বিমর্ষ হয়েছিলাম। এতোদিন পরেও যখনই ভাবি বা পাঠ করি, আমার মধ্যে বেড়ে ওঠে গভীর থেকে গভীরতর এক হতাশা। আবুল কাসেম ফজলুল হক এই কবিতার পুরোটাকে দুঃখের নদীতে ডুবিয়ে রাখতে নারাজ। তিনি লিখেছেন, “আমি দেখেছি, জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতাটিকেও দুঃখবাদের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।” তিনি আরো লিখেছেন, ‘এই কবিতার মাধ্যমে জীবনানন্দ তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন মানবরূপী রাক্ষস-দৈত্য-দানব-জন্তু-জানোয়ারদের পৈশাচিক-পাশবিক-জান্তব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে।’ তাঁর এই শেষোক্ত উচ্চারণের সঙ্গে আমি কিছুতেই একমত হতে পারি না। কবি দুঃসময়ের প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছেন ঠিকই, কিন্তু প্রতিবাদ জানিয়েছেন বলে মনে হয় না। আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, কবিতাটিকে নির্জলা দুঃখের দৃষ্টান্ত হিসেবে পাঠ না করার মতো ইতিবাচক জীবনবোধের দ্যোতক কোনো অনুষঙ্গ এতে নেই। সরাসরি তো নয়ই, ইঙ্গিতেও কবি সদর্থক জীবনসত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে বলেননি। এই কবিতায় প্রতিবাদের চেয়ে সমর্পণের দিকেই অধিকতর ঝুঁকে আছেন কবি। নইলে তিনি জীবনসংরাগী কিংবা শিল্পসংগ্রামী মানুষগুলোর উদ্দেশে কিছুতেই লিখতেন না, ‘শকুন আর শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়’। এই কবিতায় ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত আমি অন্তত খুঁজে পাই না। আবুল কাসেম ফজলুল একজন আশাবাদী মানুষ। প্রাত্যহিক বাস্তবতার নোংরা জল তাকে স্পর্শ করে না, কারণ সেখানে তিনি সম্ভাবনার পদ্ম ফোটাতে চান। সেই আশাবাদ ও সম্ভাবনার স্নিগ্ধতা দিয়ে তিনি জীবনানন্দের হতাশার ধুলো-মলিনতা নিজ দায়িত্বে ধুয়ে নিয়েই কবিতাটিকে পাঠকের উদ্দেশে পরিবেশন করতে চেয়েছেন। তাঁর এই অভিপ্রায়ের অর্থ আমি বুঝি বলেই তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বরং বেড়েই যায়।
জীবনানন্দ দাশকে আমি প্রবল আশাবাদী, বিশেষ রাজনীতিপুষ্ট সংগ্রামশীল কবি হিসেবে পাঠ করতে অভ্যস্ত নই। বাংলা কবিতার বিবিধ ধারা-উপধারা এবং নানা পর্যায়ের বিচিত্র গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আমার যেটুকু জানাশোনা, তার ওপর ভরসা করেই আমি এ-ব্যাপারে সতর্ক থাকতে চাই। এর অন্যথা হলে আমি আমার জীবনানন্দকে হারিয়ে ফেলবো এবং আমার বিশ্বাস, আমার মতো আরো অনেক জীবনানন্দ-ভক্তের হতাশা-দুঃখ-দুঃসময়ের নদী তাতে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। জীবনানন্দ যা, তার জন্যই তিনি বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাসের এক বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে যুগে যুগে নন্দিত হবেন এবং প্রতি যুগের পাঠকই তাদের অভিজ্ঞতার উষ্ণতা দিয়ে নতুন এক জীবনানন্দকে সৃষ্টি করে নেবেন। ব্যক্তি জীবনানন্দের সঙ্গে তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তার পাঠ মিলিয়ে নিতে গিয়ে তাকে একান্ত আত্মমগ্ন, ব্যক্তিগত কিংবা বিবরবাসী সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে দেখার যে সংস্কৃতি চালু আছে, আমার বিশ্বাস, তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মের নিবিড় পাঠে যে কোনো সাহিত্যরসিকের দৃষ্টিই সেই সংস্কৃতিকে সন্দেহের চোখে দেখতে শিখবে।
ব্যক্তিগত জীবনে, বিশেষ করে পরিবারে তিনি সন্ত্রস্ত প্রেমিকের মতোই পলাতক, পীড়িত কিংবা পরাস্ত ছিলেন, কিন্তু পাঠকের কাছে তাঁর সাহস ও শৌর্যের পরিচয় তিনি নানাভাবে দিয়েছেন। ঘরোয়া অতৃপ্তি-অপ্রাপ্তি ও পারিবারিক অসুখবিসুখকে তিনি সার্থকভাবে শিল্পের দর্পণে দেখে নিয়েছেন। কবিতা ও জীবনকে একই জিনিষেরই দুইরকম উৎসারণ ভেবেছেন তিনি। জীবনকে অনেকভাবে যাপন কিংবা উদ্যাপন করা যায় বলেই বিচিত্র জীবনের মতোই অনেক রকম কবিতার কথা তিনিই আমাদের শুনিয়েছেন। বোধ ও উপলব্ধির গভীরতলশায়ী নোংরামির নাড়িনক্ষত্র ও প্রবৃত্তির বিচিত্র গতিবিধিকে তিনি শব্দবন্দি করেছেন। প্রেম ও অপ্রেমের চালচিত্র তিনি এঁকেছেন। ভালোবাসার উল্টোপিঠে ঘুমিয়ে থাকা ঘৃণার আঙুল তিনি ছুঁয়ে দেখেছেন, টুকরো টুকরো জীবনের সংযোগসেতু নির্মাণের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জীবনকে তিনি কেবল কবিতার ভাষায় অঙ্কনই করেন নি, কবিতার মতো করেই নেড়েচেড়ে দেখতে চেয়েছেন। যে কবিতার ঘাড়ে চেপে আমি জীবনানন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করছি, সেই কবিতার শৈল্পিক সমৃদ্ধি কিংবা সংহতি বিষয়ে আমি উচ্চতর ধারণা পোষণ করতে সম্মত নই। কিন্তু জীবনসত্যের একজন নির্মম ও আপসহীন রূপকার হিসেবে কবিকে এবং স্বকালসম্পৃক্তির এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে কবিতাটিকে আমি গুরুত্বপূর্ণই মনে করি।
জীবনানন্দের কবিতা থেকে আমার প্রিয় পঙ্ক্তিসমূহ সংকলিত হলে তাতে অন্য জীবনানন্দ-ভক্তেরও সমর্থন মিলবে আশা করি। তাঁর এমন অনেক পঙ্ক্তি স্মৃতি থেকেই উদ্ধার করা যাবে, যেগুলো আমাদের চিত্ত ও চিন্তায়, জীবনানন্দের ভাষায়, ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়’। সেগুলোর কোনো অবসাদ নেই, নেই বিশ্রামেরও অবসর। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় জীবনানন্দ যে নষ্ট সময়ের কথা বলেছেন, কালিক প্রভাবে তা তো অধিকতর নষ্টের দিকেই ধাবমান। সাতটি তারার তিমির কাব্যের ‘অনুসূর্যের গান‘ কবিতায় কবিকে বলতে দেখি, ‘আজকের সমাজ/সকলের কাছ থেকে চেয়েছে কি নিরন্তর/তিমিরবিদারী অনুসূর্যের কাজ।’ কবির প্রশ্নের মধ্যেই ইতিবাচক উত্তরের ইঙ্গিত আছে। অর্থাৎ, অন্ধকারবিনাশী শক্তির প্রতি কবির আস্থা তখনো উবে যায়নি। একইভাবে ‘তিমিরহননের গান’ কবিতায় কবি লিখেছেন-
তিমিরহননে তবু অগ্রসর হ’য়ে
আমরা কি তিমিরবিলাসী?
আমরা তো তিমিরবিনাশী
হ’তে চাই।
আমরা তো তিমিরবিনাশী।
(তিমিরহননের গান : সাতটি তারার তিমির)
এই আশাবাদের একবিন্দু আলোও তো উঁকি দিচ্ছে না ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতার কোনো প্রান্ত থেকে। এই আঁধার কি কবিকে এতো বেশি ক্লান্ত করে ফেলেছে যে, রাত্রির অন্ধকার ঠেলে ভোরের আলোর দিকে হাত বাড়ানোর সমস্ত শক্তি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন? অন্ধকার যখন নিয়তির মতো নির্মম হয়ে ওঠে, অক্টোপাসের মতো আকড়ে ধরে মানুষের মন ও মজ্জা, তখন চক্ষুষ্মানরাও অন্ধের মতো হাতড়ে বেড়ায় বেঁচে থাকার সামান্য, সংকীর্ণ, একান্ত ব্যক্তিগত কোনো গৃহ। তখন অন্ধের চোখে ফুটে ওঠে ভয়াবহ আগুনের দীপ্তি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি যে রবীন্দ্রনাথের প্রণতি ছিল সংশয়াতীত, ‘মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতীকারহীন পরাভব’ দেখে যিনি স্রষ্টার কাছেই শেষ আশ্রয় খুঁজেছেন বারবার, তাঁকেও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এক অবিশ্বাসী ভূখণ্ডের উদ্ভ্রান্ত বাসিন্দা হতে দেখি। চরম হতাশায় নিমগ্ন কবি সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে বলেন-
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী!
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
(তোমার সৃষ্টির পথ : রবীন্দ্রনাথ)
ভগবানের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই যে অবিশ্বাসের বাণীবর্ষণ, তার মূলে নিশ্চয়ই ‘মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতীকারহীন পরাভব’ দায়ী। ভগবান কিংবা মানুষ- কারো ওপরই জীবনানন্দের আস্থা কখনো প্রবল ছিল বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথের মতো করে তিনি কখনোই বলেননি, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’, বরং এই পাপের পঙ্কিলে বারবার আটকে গেছে জীবনানন্দের পা। কেবল পা-ই নয়, কখনো কখনো তাঁকে এই অবিশ্বাসের নোংরা নর্দমায় আকণ্ঠ নিমগ্ন হতে দেখি।
জীবনানন্দ বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য-রাজনীতির ইতিহাস নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন। মানবসভ্যতার নানা পর্যায়ে মানুষের রক্তে কীভাবে রঞ্জিত হয়েছে শাসক-শোষকের হাত, তা অনুধাবন করেছেন কবি। মেহনতি মানুষের হাড়ের ওপর যুগে যুগে নির্মিত হয়েছে আকাশচুম্বী অট্টালিকা। এমন কি পরাক্রমশালী সম্রাট তাঁর প্রণয়ীর স্মৃতিচিহ্ন অনাগত কালের মানুষের হৃদয়ে অম্লান-অক্ষয় করতে গিয়েও হরণ করেছেন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের প্রাণ। জীবনানন্দ লিখেছেন- আমি তবু বলি :
এখন যে-ক’টা দিন বেঁচে আছি সূর্যে-সূর্যে চলি,
দেখা যাক পৃথিবীর ঘাস
সৃষ্টির বিষের বিন্দু আর
নিষ্পেষিত মনুষ্যতার
আঁধারের থেকে আনে কী ক’রে যে মহা-নীলাকাশ,
দেখা যাক- ভাবা যাক-
ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি
ভেদ করে শোনা যায় শুশ্রুষার মতো শত শত
শত জলঝর্নার গান।
(হে হৃদয় : বেলা অবেলা কালবেলা)
এই শ্রশ্রুষার মতো গান শুনেই জীবনানন্দ আবার মানুষ ও জীবনের প্রতি আস্থা ফিরে পেয়েছেন। মাথা উচু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন কবি, বলেছেন, ‘এসো মানুষ, আবার দেখা যাক/সময় দেশ ও সন্ততিদের কী লাভ হতে পারে।’ তিনি দেখেছেন, ‘ইতিহাসের সমস্ত রাত মিশে গিয়ে একটি রাত্রি আজ পৃথিবীর তীরে’। পৃথিবীর নিকটবর্তী এই একটি রাত্রির বুকে যে ব্যথার মোচড় আমরা টের পাই, তা তো ভোরের প্রত্যাশাকেই মূর্ত করে তোলে। তাই তিনি বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন, উজ্জ্বল আশার দিকে অন্তর প্রসারিত করে বলেন, ‘কেমন আশার মতো মনে হয় রোদের পৃথিবী।’ এই রোদের পৃথিবীতে, এই মাটি-জল-যন্ত্রণার পৃথিবীতে কবির আগমন যে ব্যর্থ হয়নি, তা তো তিনি নিজেই আমাদের জানিয়েছেন-
মাটি- পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হতো অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়-
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
(সুচেতনা : শ্রেষ্ঠ কবিতা)
শিশির স্পর্শ করে যে কবি সমুজ্জ্বল ভোরের উজ্জ্বল আলোয় স্নাত হতে চান, ‘শাশ্বত রাত্রির বুকে’ যিনি অনন্ত সূর্যোদয়ের কথা বলেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় সেই কবি মানুষ ও মনুষ্যত্বের মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক পরিণতিতেও ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো আলো কিংবা ইঙ্গিত ছড়িয়ে দেননি তাঁর স্বকালের কোনো সাহসী মানুষের বুকে। কেন দেননি- এই প্রশ্নের উত্তর এই কবিতায় নেই, হয়তো আছে জীবনানন্দের জীবনীতে, কবিতাজন্মের সেই মোক্ষম মুহূর্তের মর্মে ও মজ্জায়।
‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতার জীবনানন্দ দাশ কেন শকুন ও শেয়ালের খাদ্যে পরিণত করতে চাইলেন তাঁর সমুদয় শক্তি ও সম্ভাবনাকে? কেন প্রত্যাশিত আগামির দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বললেন না তাঁর কালের মহৎ, মানবিক, সংগ্রামশীল মানুষগুলোকে? মানুষের প্রতি যাদের গভীর আস্থা আছে বলে উল্লেখ করেছেন কবি, সেই আস্থার গভীরদেশেও কি তবে পচন দেখেছেন তিনি? ‘মহৎ সত্য বা রীতি কিংবা শিল্প অথবা সাধনা’ জীবনানন্দের ভাষায় ‘যাদের কাছে স্বাভাবিক’ বলে মনে হয়েছে, সেখানেও কি অস্বাভাবিক অসুখবিসুখ লক্ষ করেছেন কবি? একালের রাজনীতিবিদ-সমাজকর্মী-আইনজীবী-শিল্পী-সহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীর রক্তে ও স্নায়ুতে যখন ‘সচেতন অপরাধ’ বাসা বাঁধতে দেখি, তখন এই প্রশ্নগুলো আমার মাথার ভেতরে কেবলই ঘুরপাক খায়, ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়’। কিছুতেই এড়াতে পারি না আমি।