
জীবনানন্দের মৃত্যু হেমন্তেই কেন?
ইংরেজি ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর—অর্থাৎ যেদিন জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হয়, সেদিন বাংলা তারিখ ছিলো ৫ কার্তিক ১৩৬১। মানে হেমন্তকাল। যে হেমন্ত ঋতুর প্রতি তাঁর দারুণ পক্ষপাত সর্বজনবিদিত। মৃত্যুর অনেক আগে লিখেছিলেন:
হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন-পথের পাতার মতো,
তুমিও তখন আমার বুকের পরে শুয়ে রবে।
তিনি কি জানতেন যে এই হেমন্তেরই কোনো এক রাতে পথের পাতার মতো তিনি ঝরে যাবেন?
আবদুল মান্নান সৈয়দ (রচনাবলি, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬) মনে করেন, জীবনানন্দের কবিতার মূল ঋতু হেমন্ত—যা রিক্ততা ও বিনষ্টির প্রতীক। তবে দুয়েকবার হেমন্তকে তিনি পূর্ণতার রূপেও অঙ্কন করেছেন।
জীবনানন্দকে অনেক সময় হেমন্তের কবি বলে বিভ্রম হয়। বাংলা সাহিত্যের আর কোনো কবি হেমন্ত ঋতুর প্রতি এতটা অনুরক্ত বা মোহাবিষ্ট ছিলেন না। প্রশ্ন হলো, হেমন্তের প্রতি তার এই বিশেষ পক্ষপাতের বিশেষ কোনো কারণ আছে কি? আর সেই হেমন্তের এক রাতেই কী করে তার মৃত্যু হলো—সেই রহস্যও কি কোনোদিন জানা যাবে? একটি কবিতায় একইরকম ভাষ্য পাই:
যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;
যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে।
এখানেও কার্তিকের নীল কুয়াশায় নিজের ঝরে যাওয়ার শঙ্কা অথবা সম্ভাবনা এবং তা-ই হয়েছে। তিনি যখন চোখ বুজেছেন, তখন বাংলার ফসলের ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে ধানও ঝরে যায়। যেন প্রকৃতি তার এক প্রিয়জনের বেদনায় আর্দ্র; ব্যথিত!
অর্থাৎ হেমন্ত মানেই যেন মৃত্যুর গন্ধ আর নিজেকে তুলনা করছেন পাতার সঙ্গে। যিনি নিজেকে ফসলের সাথে তুলনা করে লিখেছেন: ‘একদিন পৃথিবীর পথে আমি ফলিয়াছি।’ অন্যত্র লিখেছেন: ‘নক্ষত্রের পানে যেতে যেতে, পথ ভুলে বারবার পৃথিবীর খেতে, জন্মিতেছি আমি এক সবুজ ফসল।’ আরও লিখেছেন: ‘ঘাসের বুকের থেকে কবে আমি পেয়েছি যে আমার শরীর, তাই রোদ ভালো লাগে।’ যে মানুষটি মৃত্যুর পরে পৃথিবীতে ফিরে আসতে চেয়েছেন কমলালেবু কিংবা শঙ্খচিল শালিখ হয়ে। অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম না করলে, না ভাবলে বা নিজেকে প্রকৃতির সন্তান মনে না করলে এমনটি লেখা যায় না। শুধু ও চাঁদ তুমি সুন্দর কিংবা নদী ও প্রকৃতির বর্ণনা দেয়াই নয়, বরং নিজেকে সেই নদীজলপ্রকৃতির সন্তান মনে করতে পেরেছেন বলেই হয়তো ফসলের ঋতু হেমন্তের প্রতি তার এতো গভীর টান।
জীবনানন্দ কেন হেমন্তকে ভালোবাসতেন তার একটা জবাব মেলে ‘শতাব্দী’ কবিতায়:
হেমন্ত খুব স্থির
সপ্রতিভ ব্যাপ্ত হিরণ-গভীর সময় বলে
ইতিহাসের করুণ কঠিন ছায়াপাতের দিনে
উন্নতি প্রেম কাম্য মনে হলে
হৃদয়কে ঠিক শীত সাহসিক হেমন্তলোক ভাবি।
তিনি যে অঘ্রাণকে ভালোবাসতেন, সে কথা স্পষ্টতই জানান দিচ্ছেন ‘অঘ্রাণ’ কবিতায়:
আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি—বিকেলের এই রঙ—রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম—ঢালু মাঠ—বিবর্ণ বাদামি পাখি—হলুদ বিচালি।
কার্তিককে ভালোবাসার কথাও জানাচ্ছেন:
ভালোবাসিয়াছি আমি রাঙারোদ ক্ষান্ত কার্তিকের মাঠে—ঘাসের আঁচলে
ফড়িঙের মতো আমি বেড়ায়েছি।
এই বাংলায় যখন হেমন্ত আসে, তখন কী হয়? বলছেন:
হেমন্ত আসিয়া গেছে; চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;
ঘুঘুর পালক যেন ঝ’রে গেছে—শালিকের নেই আর দেরি।
অর্থাৎ ফসলের মতো প্রকৃতির পাখিদের জীবনের পরিবর্তন তথা একটা পূর্ণতা আসে এই হেমন্তে। আরেকটি কবিতায় লিখেছেন:
যখন হেমন্ত আসে গৌড় বাংলায়
কার্তিকের অপরাহ্নে হিজলের পাতা সাদা উঠানের গায়
ঝ’রে পড়ে, পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চলে যায় হাঁস।
প্রকৃতিতে যখন হেমন্ত আসে; যখন চিলের সোনালি ডানা খয়েরি হয়; ঘুঘুর পালক ঝরে যায়; শালিকের শরীরেও পরিবর্তন আসে; হিজলের পাতা সাদা উঠানের গায়ে ঝরে পড়ে; পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে হাঁস চলে যায়—তখন জীবনানন্দের জীবনে কী ঘটে? লিখছেন, বাংলায় যখন কার্তিকের এইসব ঘটনা ঘটে, তখন তিনি ঘাসের বুকের পরে শুয়ে থাকেন। যে করবীর ঘাসে ঘাসে নরম ব্যাকুল হয়ে ঝরে পড়ে দুধ। নিজেকে এই যে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারা; ঋতু, ফসল ও প্রাণিদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে একটা অভিন্ন সত্ত্বা দাঁড় করানো—তা জীবনানন্দেই সম্ভব।
২.
ষড়ঋতুর বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস মিলে হেমন্ত—যার ভেতরেই হিম শব্দটি আমরা পাই। মানে হিমের ঋতু শীতের আগমনী হচ্ছে এই হেমন্ত যা জীবনানন্দের রূপসী বাংলায় মূলত ফসলের ঋতু হিসেবেই পরিচিত। তাঁর ভাষায়:
প্রথম ফসল গেছে ঘরে
হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে
শুধু শিশিরের জল।
প্রথম ফসল ঘরে আসার পরে কী হবে? বলছেন:
মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে—
শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।
এই নাচ ও উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হেমন্ত; বাংলার কৃষকের স্বপ্ন। ফসলের আকাঙ্ক্ষা।
হেমন্তের ধান ওঠে ফলে
দুই পা ছড়ায়ে বসে এইখানে পৃথিবীর কোলে।
অর্থাৎ ধান উঠে গেছে, এইবার পৃথিবীর কোলে পা ছড়িয়ে বসে মন খুলে আড্ডা দাও। কৃষিনির্ভর বাংলায় হেমন্ত আসলে কৃষকের ঋতু। যখন ফসল ঘরে ওঠে তখন কৃষকের আনন্দ। তখন দুই পা ছড়িয়ে বসার সময়।
একসময় বাংলায় ‘মরা কার্তিক’ বলে একটা বিষয় ছিল। অর্থাৎ যে সময়ে মানুষের ঘরে ঘরে অভাব। সেই মরা কার্তিকের পরেই আসতো নবান্ন বা নতুন অন্ন বা নতুন ধানের উৎসব। যদিও সেই মরা কার্তিক এখন এই বাংলায় অতীত। কৃষিবিপ্লবের কল্যাণে কার্তিক এখন আর মরা নয়। বরং এখন সারা বছরই বাংলার কৃষকের ঘরে অন্ন থাকে।
আহ্লাদের অবসাদে ভ’রে আসে আমার শরীর,
চারিদিকে ছায়া-রোদ-খুদ-কুঁড়ো-কার্তিকের ভিড়।
মানুষের জীবনে যখন অভাব নেই, তখন আহ্লাদ করতে বাধা নেই। অবসাদও আসতে পারে। ফসলকে তিনি নারীর স্তনের সঙ্গে তুলনা করে লিখলেন:
চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল।
এই কার্তিক-অগ্রহায়ণে বাংলার মাঠে মাঠে ফসলের যে পূর্ণতা; শিশিরের সৌন্দর্য, তা দেখে চোখের ক্ষুধা মিটে যায়। ধানভানা নারীদের শরীরের ঘ্রাণ চারিপাশে।
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে, হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রুপশালি-ধানভানা রুপসীর
শরীরের ঘ্রাণ।
কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ পুড়ে যাবে। ফলন্ত ধানের গন্ধে-রঙে তার- স্বাদে সকলের দেহ ভরে যাবে।
৩.
হেমন্তের প্রতি জীবনানন্দের পক্ষপাতের বিশেষ কারণ বোধ হয় এই যে, হেমন্তের আবহাওয়া চমৎকার। অনেকে হেমন্তকে ভ্রমণের ঋতুও বলেন। অর্থাৎ যখন মন ঘরে থাকতে চায় না। আমরা জানি, রাস্তায়-অলিতে-গলিতে মাইলের পর মাইল হাঁটার নেশা ছিলো জীবনানন্দের। বিশেষ করে যখন বরিশালে থাকতেন, তখন একা অথবা অনেক সময় ছোট ভাই অশোকানন্দকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বহু দূর চলে যেতেন। কখনো জোছনারাতে দুই ভাই বরিশাল শহরের লাকুটিয়া সড়ক ধরে চলে যেতেন শহর ছেড়ে অনেক দূরে। সেই হাঁটাহাটির জন্য বেশ উপযোগী এই হেমন্তকাল। সন্ধ্যার পরে মফস্বল শহরে হেমন্তকালে যে একটা ঠান্ডা আবহ তৈরি হয়, সেটি জীবনানন্দের মতো একজন প্রকৃতিঅন্তঃপ্রাণ মানুষকে যে কাবু করবে—সেটিই তো স্বাভাবিক। যিনি লিখতে পারেন: ‘বঁইচির বনে আমি জোনাকির রূপ দেখে হয়েছি কাতর।’ জোনাকির রূপ দেখে কাতর হওয়া মানুষ যে হেমন্তেও কাতর হবেন, তাতে আর সন্দেহ কী!
হেমন্তের প্রতি জীবনানন্দের পক্ষপাত স্পষ্টত দুটি ক্ষেত্রে: ১. ফসল এবং ২. মৃত্যু। বিপরীতমুখী দুটি বিষয়কে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ ফসল ঘরে তোলা যেমন খেতের একটি পরিণতি, অর্থাৎ ফসল তোলার পরে মাঠ যেমন শূন্য পড়ে থাকে; তেমনি জীবনেরও চূড়ান্ত পরিণতি মৃত্যু। ফলে হেমন্তকে তিনি যেমন ফসলের একটি চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে দেখেছেন, তেমনি মৃত্যুকেও। যে কারণে যখনই হেমন্তের কথা বলেছেন, সেখানে অনিবার্যভাবেই যেন এসেছে মৃত্যুর কথা। যখন মৃত্যুর কথা বলেছেন, সেখানে এসেছে হেমন্ত। ‘অঘ্রাণ প্রান্তরে’ কবিতায় লিখলেন:
অঘ্রাণ এসেছে আর পৃথিবীর বনে;
সে সবের ঢের আগে আমাদে দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু।
হেমন্ত এখানে শরীর ও মনের বয়সের প্রতীক। যেমন অন্যত্র লিখেছেন:
শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন!
হেমন্ত আসেনি মাঠে ,-হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন!
কাছাকাছি কথা পাচ্ছি ‘জীবন’ কবিতায়:
বনের পাতার মতো কুয়াশায় হলুদ না হ’তে
হেমন্ত আসার আগে হিম হয়ে পড়ে গেছি ঝ’রে।
প্রেমের কথা বলতে গিয়েও তিনি টেনেছেন এই হেমন্তকে।
আবার কুড়ি বছর পরে তার সাথে দেখা হয় যদি
আবার বছর কুড়ি পরে
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে—
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে
তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয়, শর কাশ হোগলায় মাঠের ভিতরে।
যে হেমন্তে মরে গেছেন, সেই হেমন্তেই ফিরে আসার প্রার্থনা:
আবার পাবো কি আমি ফিরে
এই দেহ!—এ মাটির নিঃসাড় শিশিরে
রক্তের তাপ ঢেলে আমি
আসিব কি নামি!
হেমন্তের রৌদ্রের মতন
ফসলের স্তন
আঙুলে নিঙাড়ি
এক খেত ছাড়ি
অন্য খেতে চলবো কি ভেসে
এ সবুজ দেশে
আর একবার!