
‘জাপানযাত্রী’র ভাবনায় নগর, পরিবেশ ও বাণিজ্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই মে, ১৮৬১ – ৭ই আগস্ট ১৯৪১) প্রয়াণ দিবসে প্রতিকথার পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও দর্শন সম্পর্কে প্রকাশ করা হল পাঁচটি প্রবন্ধ। লিখেছেন- আনোয়ারুল করীম, মুনীর উদ্দীন শামীম, রকিবুল হাসান, স্বপন পাল ও বাসন্তি সাহা।
ক.
সেপ্টেম্বর ২০১৯-এ শেক্সপিয়ারের বাড়িতে গিয়েছিলাম। দাপ্তরিক কাজের কারণেই। ওখানেই দেখা হয়েছিল এক তরুনীর সাথে। তিনি একজন পিএইচডি গবেষক। কাজ করছিলেন শেক্সপিয়রকে নিয়ে। পৃথিবীর নানা ভাষায় শেক্সপিয়ার চর্চা হয়। সেইসব নিয়েই তিনি গবেষণা করছিলেন। গবেষণার কারণেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়েও খোঁজখবর রাখেন। তাঁর সাথে বাংলা ভাষায় শেক্সপিয়ার চর্চা নিয়েই কথা হচ্ছিল। আলাপের মাঝখানে হঠাৎ করেই জানতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। সরাসরি প্রশ্ন করলেন, তোমাদের রবীন্দ্রনাথের কী অবস্থা। আমি কিছু না ভেবেই বলে উঠলাম, রবীন্দ্রনাথ তো ভীষণ তরুন হয়ে উঠছেন। দিন যত যাচ্ছে তার এ তারুন্য ততই বাড়ছে। ততই রবীন্দ্রনাথ জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। প্রিয়জনও হয়ে উঠছেন। প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। তিনি হেসে পাল্টা জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কি তোমাদের জাতীয়তাবোধের কারণে? বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার কারণেই? আমি বললাম না, সেটা একটা উপলক্ষ হলেও হতে পারে। কিন্তু সেটা বোধহয় মূল কারণ নয়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে না। বরং রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাজের নানা মাত্রিকতার কারণেই আবশ্যিক হয়ে আছেন। প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন। সে দিনের আলোচনা ঐটুকুই। তারপর আর এগোয় নি। আমরা শেক্সপিয়ারেই ফিরে গিয়েছিলাম। আলোচনা আবার শেক্সপিয়ারকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছিল। তবে আমি যে বলেছিলাম রবীন্দ্রনাথ আরও তরুন হয়ে উঠছেন, সে কথাটা আমার মনে থেকেই গেল।
সম্প্রতি আমি রবীন্দ্রনাথের ’জাপানযাত্রী’ পুনরায় পড়তে শুরু করেছি। পড়তে পড়তেই শেক্সপিয়ারের বাড়িতে সেই তরুনীর সাথে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত একটুখানি আলাপের কথা মনে পড়লো। আমার পাঠ যতই এগিয়ে যাচ্ছিল ততই সেই আলাপন সতেজ হতে থাকলো। মনে হচ্ছিল, আমি যে সেদিন দাবি করেছিলাম, কোনপ্রকার ভাবনা ছাড়াই, সেটি শুধু যথাযথ ছিল না, খুব দরকারও ছিল। রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদপ্রসূত আবেগ আর ভালোবাসার কারণেই নয়, একটা বৈশ্বিক জীবনদৃষ্টি ও দার্শনিকতার জন্যই প্রাসঙ্গিক ও জরুরি। জাপানযাত্রীর সাথে চলতেই চলতেই আমি আবিস্কার করতে থাকলাম রবীন্দ্রনাথের নগর ভাবনা, পরিবেশ ভাবনা, বাণিজ্য ভাবনা, কিছুটা উন্নয়ন ভাবনাও। বলে রাখা ভালো- রবীন্দ্রনাথ কোনো নগরতত্ত্ব, পরিবেশ ভাবনা কিংবা উন্নয়নতত্ত্ব তৈরির প্রয়াসে জাপানযাত্রী লিখেন নি। সে রকম তত্ত্ব খুঁজতে যাওয়াও ঠিক হবে না। বরং একজন কবি হিসেবে, শিল্পী হিসেবে এটি নিতান্তই তাঁর একান্ত অনুভবের প্রকাশ। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সেইসব অনুভবে রবীন্দ্রনাথের কবি মানসে যে সংবেদনশীল মানুষটি বসবাস করতেন, যে দার্শনিকতা রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়ে রাখতো, জাগিয়ে রাখতো, তার বহিপ্রকাশতো তার লেখায় অবশ্যই প্রতিফলিত হয়েছে। জাপানযাত্রার পথে ও জাপানে অবস্থানের সময় রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণনির্ভর ভাবনা যেভাবে আলোড়িত হয়েছিল, যেভাবে আপ্লুত হয়েছিলেন তিনি, যেরকম প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল তাঁর ভেতরে- সেগুলিই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের সেইসব ভাবনা থেকে যেগুলি নগর ও পরিবেশের সাথে যুক্ত, বাণিজ্য ভাবনার সাথে যুক্ত, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে, সেগুলি তুলে ধরার একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস থাকবে এ লেখায়। এখানে আরও উল্লেখ করা দরকার যে, রবীন্দ্রনাথের এ রকম ভাবনা তাঁর আরও নানা লেখায় ছড়িয়ে আছে। সেইসবের কিছু আমি পড়েছি। কিছু এখনও পড়া সম্ভব হয়নি। তবে এখানে আমার আলোচনা জাপানযাত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। পুরো লেখায় আমি জাপানযাত্রীর সাথেই থাকবার চেষ্টা করবো।
এটাও উল্লেখ করা দরকার যে, রবীন্দ্রনাথের ’জাপানযাত্রী’র অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রে। বৈশাখ-১২২৩- বৈশাখ ১৩২৪- এ সময়ের মধ্যে। সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর পরবর্তী সময়ে উন্নয়ন ভাবনা ও তত্ত্বে নানা চিন্তা যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। আমরা দেখতে পাবো যে, ’জাপানযাত্রী’র ভাবনায় সেইসব উন্নয়ন চিন্তার কিছু উপাদান আগেই নাড়া দিয়েছিল। বিশেষ করে গত শতকের আশির দশকে মানবিক ও টেকসই উন্নয়ন ধারণার যে বিকাশ, যেখানে পুজি আর মুনাফা নয়; মানুষ আর পরিবেশই উন্নয়ন দর্শন ও কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু, সে মানুষ আর পরিবেশের কথা প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষভাবে জাপানযাত্রীর ভাবনায়ও দেখতে পাই। তবে সাবধানতার জন্য টিকা হিসেবে বলে রাখতে চাই- এ রকম তথ্য হাজির করার উদ্দেশ্য এ নয় যে, রবীন্দ্রনাথকে এসব উন্নয়ন তত্ত্বের আদিভাবুক বলে চিহ্নিত করা, সে রকম অনুসিদ্ধান্ত টানা। বরং খুঁজে দেখলে এ রকম চিন্তা রবীন্দ্রনাথের আগেও পাওয়া অসম্ভব কিছু হবে না। তার চেয়ে বরং আমরা মনে রাখি যে, রবীন্দ্রনাথ যেহেতু প্রথমত কবি, আর কবি মাত্রই, খুব ব্যতিক্রম ছাড়া, মানবিক ও সংবেদশীল হয়ে থাকেন। এ সংবেদনশীলতার কারণেই একজন কবি চিন্তুা ও দার্শনিকতার দিক থেকে সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আগাগোড়া প্রেম, প্রার্থনা ও প্রকৃতির কবি। তাঁর সাহিত্যে বিশেষ করে গান ও কবিতায় প্রেম, প্রার্থনা ও প্রকৃতি এসেছে অঙ্গাঙ্গিভাবে, জড়াজড়ি করে। একটি অপরটির পরিপুরক হিসেবে। ফলে আজকের অর্থে ’পরিবেশবাদী’ না হয়েও, কিংবা পুজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সক্রিয় কোন বিপ্লবী না হয়েও রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় মানুষ ও পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা প্রকাশ পেয়েছে দারুনভাবে। ’জাপানযাত্রী’র সাথে চলতে চলতে আমরা রবীন্দ্রনাথের এ মানবিক সংবেদনশীলতার সাথে আরও একবার পরিচিত হতে বাধ্য হবো।
খ.
খুব প্রচলিতভাবে দিনকে আলোর প্রতীক, সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর রাতকে অন্ধকারের প্রতিক এবং নেতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রাত ও দিন দু’টিই জীবন ও জগতের অনিবার্য অংশ। নিরবিচ্ছিন্ন রাত যেমন কাঙ্ক্ষিত নয়, ঠিক তেমনি ক্রমাগত দিনও স্বাভাবিক নয়। দু’টির ভারসাম্যপূর্ণ উপস্থিতি জীবনের জন্যে তো বটে, যারা অন্যরকম ধ্যান আর উপলব্ধীর গভীরতায় নিমগ্ন হতে চান, তাদের জন্যও অনস্বিকার্য। কখনও কখনও রাত, রাতের অন্ধকারই বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এ অন্ধকারই তাকে প্রেম ও প্রকৃতির অন্যরকম অনুভূতির নিমগ্নতায় টানতে পারে। ধরে রাখতে পারে। ’জাপানযাত্রী’র একেবারে শুরুতেই রাতের অন্ধকারের এ অনাবিল গভীর সৌন্দর্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এক দুর্নিবার দুর্বলতা ও সে অন্ধকার উপভোগ করতে না পারার এক গভীর বেদনা আমরা দেখতে পাবো।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা ১৩২৩ সালের বৈশাখ মাসে (মে ১৯১৬) কলকাতা থেকে জাপান যাত্রা করেন। (পৃষ্ঠা-১৫১)। জাহাজ ছাড়তে দেরি হচ্ছিল। স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের মনে জেগে উঠেছিল রাতের অন্ধকারের হাত ধরে প্রকৃতি উপভোগের আকাঙ্খা। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়ে উঠেনি, উঠতে পারেনি অর্থনীতি ও উৎপাদনের প্রয়োজনে মানুষের জাগতিক আয়োজনের কারণে। বলার অপেক্ষা রাখে না তাতে প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়েছিলেন। সে বিরক্তিই কবি কার্যকারণসহ প্রকাশ করেন ’জাপানযাত্রা’র একেবারে শুরুতেই। কবি বলেন,
‘কোনো একটি কবিতায় প্রকাশ করেছিলুম যে, আমি নিশীতরাত্রির সভাকবি। আমার বরাবর এ কথাই মনে হয় যে, দিনের বেলাটা মর্তলোকের, আর রাত্রিবেলাটা সুরলোকের। …কিন্তু মানুষের কারখানা যখন আলো জ্বালিয়ে সেই রাত্রিকেও অধিকার করতে চায় তখন কেবল যে মানুষই ক্লিষ্ট হয় তা নয়, দেবতাকেও ক্লিষ্ট করে তোলে। …রাত্রির অখন্ড অন্ধকারকে মানুষ যখন নিজের আলো দিয়ে ফুটো করে দেয় তখন দেবতার অধিকারে সে হস্তক্ষেপ করে। সে যেন নিজের দখল অতিক্রম করে আলোকের খুঁড়ি গেড়ে দেবলোকে আপন সীমানা চিহ্নিত করতে চায়’ (পৃষ্ঠা-৩-৪)।
বুঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতোই অপরিবর্তিত রাখতে চান। প্রকৃতিকে কৃত্রিমতায় নয়; প্রকৃতির মতোই উপভোগ করতে চান। প্রকৃতির সৌন্দর্যে নিমগ্ন থাকতে চান। পুঁজি, পণ্য ও ভোগের উন্নয়ন মডেলে পরিবেশ সুশাসনের অভাব, পানি, নদী ও সমুদ্র দূষণ অন্যতম সমস্যা। আমরা আমাদের শৈশব, বেড়ে উঠায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ, নদী ও সমুদ্র-শাসনের অনেক কথা বইয়ে পড়েছি। শিক্ষকদের কাছে শুনেছি। সেই উন্নয়ন মডেলের হাত ধরেই পৃথিবীর জীববৈচিত্রময়তা আজ বিরাট হুমকির মুখোমুখি। তারপরও সমুদ্র-উপকূলে, নদী দখল করে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন থেমে নেই। অথচ একশো বছর আগেই আমরা রবীন্দ্রনাথকে জাপানযাত্রার প্রাক্কালে কলকাতার জাহাজঘাটে বসে সমুদ্রদূষণ নিয়ে বিচলিত হতে দেখি। বাণিজ্য আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে সমুদ্রের উপর মানুষের অত্যাচার নিয়ে কথা বলতে দেখি। কলকাতার জাহাজঘাটে রাতের অন্ধকার না পাবার প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন,
‘এমনি খারাপ লেগেছিল এডেনের বন্দরে। সেখানে মানুষের হাতে বন্দী হয়ে সমুদ্রও কলুষিত। জলের উপরে তেল ভাসছে, মানুষের আবর্জনাকে স্বয়ং সমুদ্রও বিলুপ্ত করতে পারছে না। সেই রাত্রে জাহাজের ডেকের উপর শুয়ে অসীম রাত্রিকেও যখন কলঙ্কিত দেখলুম তখন মনে হল, একদিন ইন্দ্রলোক দানবের আক্রমণে পীড়িত হয়ে ব্রহ্মার কাছে নালিশ জানিয়েছিলেন- আজ মানবের অত্যাচার থেকে দেবতাদের কোন রুদ্র রক্ষা করবেন?’ (পৃষ্টা-৪)।
রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ও প্রকৃতি সংবেদনশীলতা এতটাই প্রকট যে নদীর উপর পুল নির্মাণকেও তিনি নিতে পারেন না। তার কাছে সেটা অযাচিত মনে হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়। জাপানযাত্রায় হঠাৎ দেখতে পাওয়া রেঙ্গুন শহরের বর্ণণা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ উপমা হিসেবে গঙ্গার প্রসঙ্গ টানেন। বলেন, গঙ্গার পুলটা আসলে গঙ্গা নয়; সেটা গঙ্গার ফাঁসি (পৃষ্ঠা-১৯)। গঙ্গার উপর পুল নির্মাণে গঙ্গার স্বাভাবিক সৌন্দর্যে যে ভাটা পড়েছে, তার রূপপ্রবাহে যে অচলতা তৈরি হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের উপমায় সেটি গলার ফাঁস হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। অর্থটা খুবই স্পষ্ট। মানুষের গলায় ফাঁস দিলে প্রাণটা আর থাকে না। অবধারিতভাবে মৃত্যুর দিকে যেতে হয়। তেমনি গঙ্গার বুকের উপর পুলের বোঝা গঙ্গার প্রাণটাকেই যেন কেড়ে নিয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় প্রকৃতির অবস্থান একেবারে কেন্দ্রে। কোনোভাবেই প্রান্তে নয়। আর প্রান্তে নয় বলেই আমরা জাপানযাত্রী রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে আড়াল করে দেয় এমন যন্ত্রনির্ভর বাণিজ্য ও অর্থনতিক কর্মতৎপরতার বিষয়ে সোচ্চার হতে দেখি। অপর দিকে যে তৎপরতা প্রকৃতি ও পরিবেশকে শোষণ করে নয়, বিকৃত করে নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে খাপখাইয়ে নেয়- সে তৎপরতার গুনগান গাইতে দেখি। আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শুনতে পাই- সমুদ্রের পালতোলা নৌকাগুলি অন্যরকম সুন্দর। কারণ পালতোলা নৌকা জল ও বাতাসের সঙ্গে সন্ধি করে তার সৌন্দর্যটুকু নিজের করে নেয়। রবীন্দ্রনাথ আরেকটু এগিয়ে বলেন, যেখানে প্রকৃতির ছন্দে, লয়ে মানুষকে চলতে হয়েছে সেখানে মানুষের সৃষ্টি সুন্দর না হয়ে থাকতে পারে না। (পৃষ্ঠা-২৯)।
জাপানযাত্রী রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন, ’কল যেখানে নিজের জোরে প্রকৃতিকে উপেক্ষা করতে পারে সেইখানেই সেই ঔদ্ধত্যে মানুষের রচনা কুশ্রী হতে লজ্জামাত্র করে না। কলের জাহাজে পালের জাহাজের চেয়ে সুবিধা আছে, কিন্তু সৌন্দর্য নেই। জাহাজ যখন আস্তে আস্তে বন্দরে গা ঘেঁষে এল, যখন প্রকৃতির চেয়ে মানুষের দুশ্চেষ্টা বড় হয়ে দেখা দিল, কলের চিমনিগুলো প্রকৃতির বাঁকা ভঙ্গিমার উপর তার সোজা আঁড় কাটতে লাগল, তখন দেখতে পেলুম মানুষের রিপু জগতে কী কুশ্রীতাই সৃষ্টি করেছে। সমুদ্র তীরে তীরে, বন্দরে বন্দরে মানুষের লোভ কদর্য ভঙ্গিতে স্বর্গকে ব্যঙ্গ করছে- এমনি করেই নিজকে স্বর্গ থেকে নির্বাসিত করে দিচ্ছে’ (পৃষ্ঠা-২৯)। জাপানযাত্রীর এ বর্ণনা পড়তে পড়তে আমরা বুঝতে পারি, বুঝতে বাধ্য হই যে, রবীন্দ্রনাথের চোখে স্বর্গ আর প্রকৃতি সমার্থক। সুতরাং তাঁর ভেতরে প্রকৃতি নামক সে স্বর্গকে প্রতিরক্ষার তাগিদও প্রচন্ড।
কনজিউমারিজম বা ভোগবাদিতা আজকের পুঁজিবাদী উন্নয়ন দর্শনের অন্যতম সংকট। মুনাফার দেবতা যেখান মানুষ, প্রকৃতি-সব কিছুকেই তছনছ করে দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এ মুনাফাবাদিতা মানুষের ’রিপু’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যে ক্রমবর্ধমান রিপুর প্রভাবে মানুষ আসলে স্বর্গ (প্রকৃতি ও পরিবশে) থেকে নির্বাসিত হচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর উন্নয়নশীল দেশের প্রগতির প্যাকেজ হিসেবে যে আধুনিকায়ন উন্নয়ন মডেলের বিকাশ- তাতে নগর পক্ষপাত খুবই স্পষ্ট। উন্নয়নের নামে সুযোগ-সুবিধা যেমন সব নগরকেন্দ্রিক ঠিক তেমনি নগরায়নকে উন্নয়নের সমার্থক ও অন্যতম পূর্বশর্ত মনে করা হয়। যে কারণে প্রচলিত উন্নয়ন কৌশলে আরোপিত নগরায়নও হতে দেখি। উন্নয়ন কৌশল হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত শুনতে পাই- শহর যাবে গ্রামের কাছে। কিন্তু ’জাপানযাত্রী’র সাথে চলতে চলতে আমরা নগরায়নের যে ধারণা পাই, রবীন্দ্রনাথের যে নগর ভাবনার সাথে পরিচিত হই- সেটি কোনোভাবেই আরোপিত নগরায়ন নয়; স্বত:স্ফুর্ত নগরায়ন। যে নগর তৈরি হবে মানুষের মমতার দ্বারা। শুধু ব্যবসার উদ্দেশ্য নয়। জাহাজে যেতে যেতে রবীন্দ্রনাথ যে রেঙ্গুন শহরটিকে দেখেন, সে শহরটিকে তাঁর স্বত:স্ফুর্তভাবে গড়ে উঠা শহর মনে হয় না। আর মনে হয় না বলেই তিনি রেঙ্গুন শহরের বর্ণনা দেন এভাবে- ’ আসল কথা গঙ্গার পুলটা যেমন গঙ্গার নয়, বরঞ্চ সেটা গঙ্গার গলার ফাঁসি, রেঙ্গুন শহরটা তেমনি ব্রহ্মদেশের শহর নয়, ওটা যেন সমস্ত দেশের প্রতিবাদের মতো’ (পৃষ্ঠা-১৯)।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, আরোপিত সমরূপতা দিয়ে নয়, বরং নগরায়নকে হতে হবে স্থানীয় বৈচিত্রময়তা নিয়ে। স্থানীয় বৈচিত্রময়তা নিয়ে নগরায়ন হলে প্রতিটি শহরের একটি নিজস্ব জীবন থাকবে। তাতে প্রাণের ছোয়া থাকবে। রবীন্দ্রনাথ রেঙ্গুন শহরের মধ্যে সেই স্থানীয় বৈচিত্রময়তা খুজে পাননি বলেই মনের বেদনা নিয়ে বলেন-
’মনে হল, রেঙ্গুন ব্রহ্মদেশের ম্যাপে আছে কিন্তু দেশে নেই। অর্থাৎ এ শহর দেশের মাটি থেকে গাছের মতো ওঠেনি। এ শহর কালের স্রোতে ফেনার মতো ভেসেছে, সুতরাং এর পক্ষে এ জায়গাও যেমন অন্য জায়গাও তেমনি’ (পৃষ্টা-২০)।
আমরা দেখতে পাবো রবীন্দ্রনাথের যে নগরায়ন ভাবনা, তাতে তিনি বাণিজ্য ও মুনাফা নয়, মানুষের মমতা ও আনন্দের সম্মীলন দেখতে চান। প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের বিনষ্ট নয়, বরং সবগুলির সহবাস দেখতে চান। আর দেখতে চান বলেই জাপানযাত্রীকে আমরা বাণিজ্যনির্ভর নগরায়ন নিয়ে বিচলিত হতে দেখি, চিন্তিত হতে দেখি, সজাগ থাকতে দেখি। এ চিন্তা থেকে রবীন্দ্রনাথ বলেন-
‘বাণিজ্যলক্ষী নির্মম, তার পায়ের নীচে মানুষের মানস-সরোবরের সৌন্দর্যশতদল ফোটে না। মানুষের দিকে সে তাকায় না, সে কেবল দ্রব্যকে চায়; যন্ত্র তার বাহন। গঙ্গা দিয়ে যখন আমাদের জাহাজ আসছিল তখন বাণিজ্যশ্রীর নির্লজ্জ নির্দয়তা নদীর দুই ধারে দেখতে দেখতে এসেছি। … আমি মনে করি, আমার পরম সৌভাগ্য এই যে, কদর্যতার লৌহবন্যা যখন কলকাতার কাছাকাছি দুই তীরকে… গ্রাস করবার জন্য ছুটে আসছিল আমি তার আগেই জন্মেছি। তখনও গঙ্গার ঘাটগুলি গ্রামের স্নিগ্ধ বাহুর মতো গঙ্গাকে বুকের কাছে আপন করে ধরে রেখেছিল, কুঠির নৌকাগুলি তখনো সন্ধ্যাবেলায় তীরে তীরে ঘাটে ঘাটে ঘরের লোকগুলিকে ঘরে ফিরিয়ে আনত। এক দিকে দেশের হৃদয়ের ধারা, আর এক দিকে দেশের এ ই নদীর ধারা, এর মাঝখানে কোনো কঠিন কুৎসিত বিচ্ছেদ দাঁড়ায় নি’। (পৃষ্ঠা-২০-২১)।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন কলকাতা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে কুৎসিত হয়ে উঠেছে ব্যবসা ও মুনাফাবাদিতার কারণেই। যাকে তিনি বলেছেন, কালের করাল মূর্তির লোহার দাঁত ও নখ মেলে আক্রমণ। রবীন্দ্রনাথের এ বর্ণনা শুনতে শুনতে আমরা যেন ঢাকা শহরকে দেখতে পাই। আমরা যেন বাণিজ্যিক মূল্যবোধের কাছে মরতে থাকা বুড়িগঙ্গার ছবি দেখতে পাই। ঢাকা শহরের শরীরের শিরা-উপশিরার মতো থাকা মৃত খালগুলির কান্না শুনতে পাই।
পরিবেশ ও প্রকৃতি নির্ভর নগর ভাবনায় জাপানযাত্রীকে আমরা তাঁর শৈশবের কলকাতা শহরের জন্য নস্টালজিয়ায় ভূগতে দেখি। যেখানে তিনি কলকাতা মিউনিসিপালিটির আইনেরও সমালোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, এ আইন করাই হয়েছে যেন পুকুর, জলাশয়গুলি ভরাট করে ফেলার জন্য। অথচ একদা ঐ পুকুরগুলিই ছিল ঐ শহরের প্রাণ (পৃষ্ঠা-৫২)। আমরা রবীন্দ্রনাথের এ বর্ণণায় কলকাতার বদলে ঢাকর নাম বসিয়ে দিলে প্রকৃতপক্ষে ঢাকার অতীতকেই দেখতে পাবো। আমাদের মানবিক প্রাণ তখন ঢাকার জন্যই কাঁদতে থাকবে।
তার মানে কি রবীন্দ্রনাথ ব্যবসা-বাণিজ্যের, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিরোধী ছিলেন? মোটেই না। আমরা বরং জাপানযাত্রী পড়তে পড়তে জেনে যাবো যে, রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্যকে লক্ষীই ভাবতেন। তবে এ লক্ষী ঐশ্বর্যে নয়; তার সৌন্দর্যে। তিনি মনে করেন, বাণিজ্য যতদিন মানবিক ছিল, তার সাথে মুনষ্যত্বের সম্পর্ক ছিল ততদিন বাণিজ্য আসলেই লক্ষ্মী ছিল। আমরা এ পর্যায়ে এসে রবীন্দ্রনাথের কাছে মানবিক বাণিজ্যের কথা শুনতে পাই। এমন একটি উৎপাদন ব্যবস্থার কথা শুনতে পাই, যেখানে উৎপাদনের যন্ত্র ও হাতিয়ারের সাথে উৎপাদকের বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং ক্রমাগত সম্পর্ক বজায় থাকবে। যে বাণিজ্য ও উৎপাদন ব্যবস্থায় মানুষ উপলক্ষ নয়, উৎপাদনের যন্ত্র নয়, বরং মানুষের অবস্থান হবে তার কেন্দ্রে। মানুষই হবে উৎপাদনের লক্ষ্য।
জাপানযাত্রীর এ নগর ভাবনা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, রবীন্দ্রনাথ যখন দু’টি বিখ্যাত শহরের তুলনা হাজির করেন। একদিকে প্রাচীন ভেনিস। অপরদিকে আধুনিক ম্যানচেস্টার। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশিত আদর্শ নগর ম্যানচেস্টার নয়, প্রাচীন ভেনিস। তার কারণ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই শোনা যাক-
‘ভেনিস সৌন্দর্যে এবং ঐশ্বর্যে মানুষ আপনারই পরিচয় দিয়েছে, ম্যানচেস্টারে মানুষ সব দিকেই আপনাকে খর্ব করে কলের পরিচয় দিয়েছে। এই জন্য কল-বাহন বাণিজ্য যেখানেই গেছে সেখানে আপনার কালিমার কদর্যতায় নির্মমতায় একটা লোলুপতার মহামারী সমস্ত পৃথিবীতে বিস্তীর্ণ করে দিয়েছে’ (পৃষ্ঠা-২২)।
রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশিত শহর প্রকৃতিকে শোষণ করে নয়; প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করে গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, বাণিজ্যিক প্রবণতা মানুষকে প্রকাশ করে না। বরং প্রচ্ছন্ন করে। আর এ কারণেই আমরা তাঁকে সর্বগ্রাসী বাণিজ্য নিয়ে আতংকিত হতে দেখি। পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর তার অভিঘাত নিয়ে শংকিত হতে দেখি। জাপানযাত্রীর রবীন্দ্রনাথ এ সর্বগ্রাসী বাণিজ্যকে ’প্রথম যুগের দানব-জন্তুর’ সাথে তুলনা করেন। যে দানবজন্তুর লেজ দেখলেই আঁৎকে উঠতে হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তার গায়ের চামড়া স্থুল। তার থাবা যেখানে পড়ে সেখানে পৃথিবীর গায়ের কোমল সবুজ চামড়া উঠে গিয়ে একেবারে তার হাড় বেরিয়ে পড়ে। তারপর কেবলমাত্র তার এ বিপুল দেহটা রক্ষা করবার জন্য এত রাশি রাশি খাদ্য তার দরকার হয় যে, পৃথিবী ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন, সে যে কেবল থাবা থাবা জিনিস খায় তা নয়। সে মানুষ খায়, পুরুষ-স্ত্রী ছেলে কোনো কিছুই বিচার করে না। (পৃষ্ঠা-৫৪-৫৫)। তাঁর মতে, এ বাণিজ্যলক্ষীর মগজ কম। হৃদয় তার একেবারে নেই। মুনাফা, পুঁজি ও ভোগবাদনির্ভর বাণিজ্যিক ব্যবস্থার অভিঘাতের এ রকম সুক্ষ, তীর্যক কিন্তু বাস্তবসম্মত বর্ণনায় পাঠককে থমকে যেতে হয়। পৃথিবীর কথা ভাবতে হয়। ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করতে হয়।
আগেই বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ প্রধানত কবি। কবিরা কখনও আশাহত হন না। মানবিক কল্যাণ ও মুক্তির ধারণায় আশার আলো জ্বালিয়ে রাখা কবির অন্যতম কাজ। রবীন্দ্রনাথও প্রাণ, প্রতিবেশ ও পরিবেশ বিধ্বংশী বাণিজ্যের বিপরীতে পরিবেশ-প্রতিবেশ বান্ধব মানবিক বাণিজ্য ব্যবস্থার প্রত্যাশা জিইয়ে রাখেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই একদিন জেগে উঠবে। এ রকম কদর্যপনা মেনে নিবে না। এর বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবে। রবীন্দ্রনাথ বলেন-
‘বাণিজ্য দানবটা নিজের বিরুপতায়, নিজের প্রকান্ড ভাবের মধ্যে নিজের প্রাণদন্ড বহন করছে। একদিন আসছে যখন তার লোহার কঙ্ককালগুলোকে আমাদের যুগের স্তরের মধ্য থেকে আবিস্কার করে পুরাতত্তবিধরা এ সর্বভূক দানবটার অদ্ভুত বিষমতা নিয়ে বিশ্ময় প্রকাশ করবে’। (পৃষ্ঠা-৫৫)
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, রবীন্দ্রনাথ যে মুনাফানির্ভর বাণিজ্যকে দানবের সাথে তুলনা করেছেন সে দানবের কাছ থেকে মুক্তির জন্য শুধু কি প্রকৃতির প্রতিশোধের উপরই ভরসা করে থাকেন? সে রকম হলে জাপানযাত্রীর পাঠককে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু না, রবীন্দ্রনাথ আমাদের সেরকম হতাশ করেন না। কেননা একটু পরেই জাপানযাত্রীর মুখে শুনতে পাই-দানবিক বাণিজ্যের মানবিক হওয়ার আহ্বান। এমন একটি মানবিক বাণিজ্য, যা পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে না। যে বাণিজ্য আয়তনের চেয়ে নম্রতা ও সৌন্দর্যের প্রতি বেশি মনোযোগী হবে। যে বাণিজ্য কাউকে বঞ্চিত করে বড় হবে না। সবার সাথে সন্ধি করেই বড় হবে। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ এ দানবিক মুনাফাবাদিতার বিরুদ্ধে লড়বার আহ্বানও জানান। খুব জোরালোভাবে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, মুনাফার নেশায় উন্মত্ত হয়ে মানুষ নিজকে পণ রেখে আর কতদিন খেলা চালাবে? এ খেলা ভাঙতেই হবে। যে খেলায় মানুষ লাভ করবার লোভে নিজকে লোকসান করে চলছে, সে কখনই চলবে না (পৃষ্ঠা-৫৭)।
গ.
আবার ফেরা যাক শুরুর কথায়। শেক্সপিয়ারের বাড়িতে তরুন গবেষক জানতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের খবর কি? আমি বলেছিলাম রবীন্দ্রনাথ দিন দিন আরও তরুন হয়ে উঠছেন। আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। জাপানযাত্রীর নগরভাবনায়, পরিবেশ ভাবনায়, বাণিজ্য ভাবনায় প্রচলিত অর্থনীতি ও উন্নয়ন ব্যবস্থার যে সংকট চিত্রিত হয়েছে, সেটি আজ বৈশ্বিক সমস্যা। অতএব শুধু বাঙালি জাতিয়তাবাদের কারণে নয়, বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক। এবং অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
গত শতকের আশির দশকে যে মানবিক ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন ধারনার উদ্ভব ও বিকাশ, যার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্র ২০৩০ গ্রহণ করেছে, সে উন্নয়ন ভাবনায় মানুষ ও পরিবেশকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে। যে ভাবনার সাথে বহুবছর আগে জাপানযাত্রীর ভাবনার আমরা মিল পেয়ে যাই। তাঁর ভাবনায় টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক উন্নয়ন ধারণার উপাদানগুলির উপস্থিতি খুব জোরালোভাবে দেখতে পাই। সুতরাং শুধু সাহিত্যকর্মের জন্য নয়। সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবনার জন্যও রবীন্দ্রনাথ জরুরি। তবে এটাও বলা দরকার যে, আমরা যদি সত্যি সত্যি রবীন্দ্রচেতনার কথা বলি, রবীন্দ্রচেতনায় আস্থা রাখি, রবীন্দ্রনাথকে মনে রাখতে চাই, তবে চলমান আনুষ্ঠানিকতার বদলে উচিত হবে, আমাদের নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় রবীন্দ্রনাথের ভাবনাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা। এগুলি নিয়ে আলোচনা করা। বিতর্ক করা। এবং বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা। তবে সেটাই হবে রবীন্দ্র চেতনাকে গুরুত্বের সাথে ধারণের প্রমাণ। প্রত্যাশা করি, আমাদের নীতিপ্রণেতারা তার প্রমাণ রাখবেন।
তথ্য সূত্র: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাপানযাত্রী, বিশ্বভারতী, শ্রাবণ ১৪২২.