
জাত
আসবার কালে কী জাত ছিলে, এসে তুমি কী জাত নিলে
কী জাত হবা যাবার কালে, সেকথা ভেবে বলো না
— লালন ফকির
১.
হাটে এসেছিলো শমিত। তেমন কিছু বাজার নয়। সপ্তাহান্তে এই সামান্য তেল-মশলা আর কেরোসিন। সাথে ঠাম্মাও এসেছেন। তার আসার কারণ নিজের হাতে বেছে আলো তামাক কেনা। পানের সাথে সাদাপাতা খাওয়া তার অভ্যাস। আর এই একটি ব্যাপারে ঠাম্মা খুব খুঁতখুঁতে। শমিতের উপরে তিনি ভরসা করতে পারেন না।
বাজার থেকে বেরিয়ে খালপাড়ের রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে রওনা হয় তারা। রাস্তাটা গেছে ঋষিপাড়ার মধ্য দিয়ে। গ্রামের মূল অংশ থেকে বেশ দূরে খালপাড়ে এই ঋষিপাড়া। চর্মকার সম্প্রদায়ের বেশ কয়েক ঘর মানুষ বাস করে এখানে। রাস্তার দু’পাশে ছাপড়া বাড়িঘর।
পাড়াটা আগে শুধু খালপাড়ের দিকে ছিলো। ইদানীং এপাড়ার কয়েকজন রাস্তার উল্টোপাড়ে অর্থাৎ বিলের দিকেও ঘর তুলেছে। ফলে এখন রাস্তাটা ঋষিপাড়ার মাঝ দিয়ে। রাস্তার উপর বিভিন্ন জিনিস শুকাতে দেয়া। কাপড় থেকে মরিচ পর্যন্ত। বেত, বাঁশের ফালি এসব তো আছেই। ঠাম্মা খুব সাবধানী হয়ে হাঁটেন। ঋষিপাড়ার কোন মানুষ বা তাদের কোন জিনিসের সাথে তার যেন কোন প্রকার স্পর্শ না হয়। সাবধানে হাঁটছিলো শমিতও। এরই মধ্যে সে হঠাৎ আবিষ্কার করে তার এক পা পড়েছে রাস্তার ধারে শুকাতে দেয়া চামড়ার উপরে। মরা গরু থেকে চামড়া ছাড়িয়ে এনে লবণ মেখে শুকাতে দিয়েছে কেউ। তার উপরে পা পড়েছে শমিতের। সে আর্তনাদ করে ওঠে, ‘ঠাম্মা’। ঠাম্মা পেছন ফিরে শমিতকে আবিষ্কার করে কাঁদো কাঁদো অবস্থায়। এক পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাম্মা বললেন, “ও ভগবান! ওহানি যাইয়ে মরলি ক্যানো? সর সর সরে দাঁড়া।” তবু ভাল যে বাজারের ব্যাগটা ছিলো ঠাম্মার হাতে। তা না হলে ওটা ফেলে দিতে হতো। ঋষিবাড়ির ছোঁয়া লেগেছে। কাঁচা চামড়ার ছোঁয়া লেগেছে। ঋষিপাড়াটা ছাড়িয়ে এসে ঠাম্মা খালপাড়ে নিয়ে শমিতের মাথায় জল ছিটিয়ে দেয়। এই জল ছিড়ছিড়ি দেয়া কতকটা গঙ্গাজলের স্পর্শে পবিত্র হওয়ার মতো। বাড়িতে গিয়ে স্নানও করতে হবে ঠাণ্ডার মধ্যে।
২.
ঘরে খাবার নেই; একটা বাচ্চা মেয়ে সারাদিন না খেয়ে ছিলো। তাকে স্কুলে না আসার কারণ জিজ্ঞেস করে ফেলেছেন বলে বেশ বিব্রত বোধ করেন শিক্ষক সামাদ সাহেব। তিনি কিছুক্ষণ মাথাটা নিচু করে থাকেন। তারপর শুধু বলেন, “বয় (বসে পড়) ।”
তিনি জানেন, এই মেয়েটি সংগ্রাম করছে সমাজের সবচেয়ে শক্ত কিছু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ আর লিঙ্গভেদ। তার মধ্য দিয়েও মেয়েটি লেখাপড়া করছে। হয়তো থেমে যাবে কোথাও গিয়ে। কিন্তু যতদূর যেতে পারে থামার আগে, সেটুকুতে সহায়তা করতে চান সামাদ সাহেব। তবে তিনি নিশ্চিত, এই তিনটি বাধার যে কোন একটিও যদি একটু দুর্বল হয়, এ মেয়ে দাঁড়াবেই। মেয়েটি ঋষিপাড়ার শিবের মেয়ে।
এমনিতে ওপাড়ার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার তেমন চল নেই। দু’একটা ছেলে স্কুলে আসে। পেছনের বেঞ্চিতে বসে। একা একা। কেউ খুব মেশে না ওদের সাথে; ওরাও একলা থাকে। আসে যায়। এভাবে ক্লাস টু বা থ্রি পর্যন্ত পড়ে। তারপর পারিবারিক বৃত্তি। ঝুড়ি-খালুই-ধামা বোনা। মরা গরু-ছাগলের চামড়া ছাড়ানো। এসব। শিক্ষকসহ অন্যরা এটাকেই স্বাভাবিক মনে করে।
কিন্তু রীতা পড়ছে। সবার অবজ্ঞা আর ঘৃণার মধ্যেও সে এখন ক্লাস সেভেনে। ঋষিপাড়ার জন্য এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। প্রথম দিকে পাড়ার প্রায় সবাই বাধা দিয়েছিলো। বিয়েথা’ দিতে হবে। মেয়েকে লেখাপড়া শেখালে বিয়ে দেবে কার সাথে! কিন্তু রীতা যখন ক্লাস ফাইভ থেকে ফার্স্ট হয়ে সিক্সে উঠলো তখন পরিস্থিতিটা বদলালো। বাজারে এই খবর শুনে পাড়ার তরুণদের সর্দার বিষ্টু অর্থাৎ বিষ্ণুপদ এসে পাড়ায় জানিয়ে দিলো, রীতার পড়াশুনো নিয়ে কেউ যেন আর কোন আজেবাজে কথা না বলে। মুরব্বিরা খুশি মনে না হলেও মেনে নিলেন এই কথা। বিষ্ণুর চৌদ্দ পুরুষে কোনদিন কেউ লেখাপড়া শেখেনি। সারাজীবন তারা অবহেলা, অনাদর আর অসম্মানের জীবন যাপন করেছে। নেমতন্ন বাড়িতে খেতে গেলে উঠোনের শেষ মাথায় গোয়ালের ধারে বসতে হয়েছে। কোন বাড়িতে জল খেতে পারেনি। সেই পাড়ায় একটা মেয়ে হাইস্কুলে পড়ছে। ভাল রেজাল্ট করছে এটা সবার জন্য গর্বের।
রীতার বাবা শিবে অর্থাৎ শিবপদ থানা সদরে এক অফিসের নাইট গার্ড। সেখান থেকেই সে জানে লেখাপড়ার মর্ম কী। তার তিন ছেলেমেয়েকেই সে ভর্তি করিয়েছিলো স্কুলে। অভাব-অনটনের সংসারে ছেলেদেরকে প্রাইমারি পেরোনোর আগেই কাজে নেমে পড়তে হয়েছে। রীতা পড়ছে শুধু। প্রচণ্ড সংগ্রাম করে। খালুই বোনার সিজনে সকাল থেকে খালুই বুনে বা বাঁশ থেকে চটা তুলে তারপর খাওয়ার সময় থাকলে খেয়ে অথবা কোনো কোনোদিন না খেয়ে স্কুলে ছুটেছে সে। তার স্কুল কামাই খুব অস্বাভাবিক ঘটনা। সে একা আসে স্কুলে, একা যায়। প্রয়োজনে সহপাঠীরা কথা বলে কিন্তু তার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে এটা সে খেয়াল করেছে। টিফিনে খাবার ঘরে সে খেতে বসলে আর কেউ খাবে না। তাই সবার খাওয়ার শেষে তাকে একা বসতে হয়।
শুধু শমিত কখনো সখনো হেসে কথা বলে তার সাথে। এই ছেলেটি ছাড়া আর কেউ যেচে তার সাথে কথা বলে না। তাই সে মনে করে শমিত তার বন্ধু। ছেলেটি লেখাপড়ায় ভাল। দু’জনে পড়ালেখা নিয়ে কথা বলে। শমিতই একমাত্র যে তার বই-খাতা রীতাকে ধরতে দেয়। অন্যরা দূর থেকে দেখায়। এই কথা শমিতের ভাই শান্ত একদিন ঠাম্মাকে বলে দেয়। ঠাম্মা গোঁ ধরেন, এই ছেলেকে বামুন ডেকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। শমিত যুক্তি দেয়, ঋষিপাড়ার লোকের বোনা কুলায় যদি চাল ঝাড়া যায়, ধামায় যদি পুজোর চিড়া-মুড়ি রাখা যায়, তাহলে তার সাথে মিশলে দোষ কোথায়। এ নিয়ে বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে যায়। ঠাম্মা কাশী চলে যাবার হুমকি পর্যন্ত দেন।
৩.
খালিশপুর এলাকার রেলগেটের পাশে খ্রিষ্টান পাড়া। এরা সবাই নব্য খ্রিষ্টান। কিছু মিশনারি প্রতিষ্ঠান খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করছে। মূলত সমাজের নিম্নবর্গের লোকজনই তাদের টার্গেট। তাদের মধ্যে আছে আদিবাসীরা, আছে নিম্নবর্ণের মানুষ, আছে দরিদ্র মানুষ। এই এলাকায় ধর্মান্তরকরণটা মূলত: নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে খ্রিষ্টান হওয়া। ধর্মান্তরকৃত মানুষেরা হঠাৎ দেখছে, এমন একটা কমিউনিটির তারা সদস্য হয়েছে যেখানে কেউ তাদেরকে ঘৃণা করছে না। তারা এমন এক ঈশ্বরের কাছে সমবেত হয়েছে যার কাছে বর্ণভেদ প্রথা নেই। সবাই সমান। এই ডিগিনিটিই তাদের টেনেছে নতুন ধর্মের দিকে। খালিশপুর এলাকার এই পাড়াটির বাসিন্দারাও সেভাবেই খ্রিষ্টান হয়েছিলেন। এমনই শোনা যায়। সেখানে গলির মুখে চায়ের দোকানে সকাল থেকে বসে আছে নিতাই গোমেজ। পাড়ার মাতব্বর টাইপের। ডেভিডের মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা বলতে লোকজন আসবে আজ। ডেভিড বেঁচে নেই। তার হয়ে মহল্লার মুরুব্বি হিসেবে অতিথি রিসিভ করার দায়িত্ব পড়েছে নিতাইয়ের।
ডেভিড জীবনে তেমন কিছু করতে পারেনি। যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সে খ্রিষ্টান হয়, সেই প্রতিষ্ঠানেই সে একটা চাকরি পায়। দারোয়ানের চাকরি। সেই কাজই সে করেছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তার মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, ভালো চাকরি পাবে এ ছিলো ভাবনার অতীত। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে। কমিউনিটির সাপোর্ট আর ডেভিডের বোনের আন্তরিকতায়। তার এই বোনটিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো। তারা যখন নিম্নবর্ণের হিন্দু ছিলো তখন শত বাধার মধ্যেও সে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছিলো। তারপর তারা চলে আসে এখানে। নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। তার বোনটি ম্যাট্রিক পাশ করে। এনজিওর স্কুলে মাস্টারি করতে শুরু করে। সে’ই তার ভাইঝিকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। পড়িয়েছে। ময়মনসিংহে পড়তে পাঠিয়েছে। এখন অন্য ধর্মে যে এ্যালিসের বিয়ে হচ্ছে সে-ও তার মত আছে বলে।
এ্যালিসের বিয়ে হচ্ছে ঢাকায়, তার এক সহপাঠীর সাথে। দু’জনেই ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। এ্যালিস ওখানে জয়েন করবে এটা নিশ্চিত। শাশ্বত অলরেডি জয়েন করেছে। ওরা দু’জনেই সব ঠিক করেছে। ছেলের মা-বাবা এ্যালিসকে দেখেছে। একবার ময়মনসিংহ থেকে খুলনায় যাওয়ার পথে ঢাকাতে শাশ্বতদের বাসায় গিয়েছিলো সে।
বিয়ে নিয়ে শাশ্বতদের বাড়িতে বাড়তি আগ্রহ নেই; আবার অমতও নেই। ছেলের প্রস্তাব ছিলো এরকম, “মা, এ্যালিসকে তোমার কেমন লাগে?” মা তখন রাঁধছে; চুলার উপর কড়াইয়ের দিকে নজর। “কোন এ্যালিস?” “ওই যে আমাদের বাসায় আসলো সেবার। তুমি বললে কালো মেয়ে এত সুন্দর কখনো দেখোনি।” “কেমন লাগবে. . . ভাল।” চুলার কড়াই থেকে হঠাৎ চোখ ফিরায় সে ছেলের দিকে … “কী ব্যাপার একথা বলছিস কেন?” “তোমার ছেলের বউ হলে কেমন লাগবে?” “ওই খ্রিষ্টান মেয়ে?” মা চলে গিয়েছিলো রান্না ঘর থেকে। দশ পনেরো মিনিট পরে যখন বেরোয় বেডরুম থেকে, তখন তার চোখ দু’টো লাল, ফোলা।
দু’দিন কাটলো। বাড়িতে থমথমে অবস্থা। যাবার দিন সকালে ব্যাগ হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে মাকে প্রশ্ন করে, “মা বাবাকে বলেছিলে?” -“কী?” -“এ্যালিসের কথা?”- “কইছি, উনি কয়ছেন ঐসব হবে না।” আর কোন কথা হয় না। শাশ্বত ময়মনসিংহ চলে যায়। কথাটা যেভাবে সান্ত্বনা বলেছেন আসলে তেমন নয়। সেদিন ঘরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি তার স্বামীকে ফোন করেছিলেন। “তুমি বাসায় আসো।” “কেন কী হইছে।” “আসো, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।” তিনি ফোন কেটে দেন। অফিস থেকে অতি কষ্টে হাফ-ডে ছুটি নিয়ে শমিত বাসায় আসে। এসে দেখে সান্তনা না খেয়ে বসে আছে, চোখমুখ ফোলা। কারণ কী হতে পারে ভেবে পান না শমিত। পরে সব জেনে বলেন, “দ্যাখো, আজকাল এসব মেনে নিতি হয়। ওরা লেখাপড়া শেখেছে। আমাগে কথা শোনবে?” এই শেষ কথাটা হলো মোক্ষম। ছেলে যদি কথা না শোনে তাদের কিছু করার নেই। ছেলে বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখে চাকরি করছে। বাধা দিলে বাধা মানবে না। সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনা। ছেলেকে হারানোর চেয়ে তার বিয়ে মেনে নেওয়া সহজ। “আমি কিন্তু খ্রিষ্টান ছেমড়ির হাতে খাবো না। ও আমার রান্নাঘরে যাবে না।” কতকগুলো অযৌক্তিক কথা ছাড়া ছাড়া বলে যায় সান্ত্বনা। তার অসহায়ত্বকে প্রকাশ করে।
ক’দিন যেতে না যেতে বিষয়টা কতকটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। শাশ্বতর বাবা মা দু’জনেই মেনে নেন, আজকাল এরকম হয়। ছেলে যদি বিদেশে গিয়ে মেমসাহেব বিয়ে করতো, তখন? সময়ের চাহিদা হিসেবে তারা ছেলের সাথে অন্য ধর্মের মেয়ের বিয়ে মেনে নেন। কাউকে আর অখুশি মনে হয় না। বরং সান্ত্বনা একদিন হবু বৌমার সাথে ফোন করে কথাও বলেন।
কয়েকদিন পরে ছেলে ফোন করে বাবাকে, “বাবা তোমরা একটু যাবে না? এ্যালিসের বাড়ির সবাই কী মনে করবে।” বাবা যাবে। মেয়ে দেখা নয়, কথাবার্তা বলারও কিছু নেই। বস্তুত: ছেলের বাড়িতে যে অমত নেই, মেয়ের বাড়িতে সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান দিতেই যাওয়া। ছেলে জানিয়ে দিলো, এ্যালিস এক সপ্তাহের জন্যে বাড়ি যাচ্ছে। অর্থাৎ বাবা যেন আগামী শুক্রবারে খুলনায় যায়। অগত্যা দুজন বন্ধু, সিমোন আর তপনকে, নিয়ে তিনি চললেন খুলনা। একজন খ্রিষ্টান বন্ধু থাকলে ভাল। কখন কী রীতিনীতির ব্যাপার আসে। সে বলতে পারবে। সিমোনকে তাই নেয়া।
৪.
“কই, এসেছে শাশ্বত-র বাবা?” বাইরে থেকে একটা ক্ষীণ কণ্ঠ শোনা গেল। উত্তরে এ্যালিসকে বলতে শোনা গেল, “ও পিসি, তুমি তো ভিজে গেছো একেবারে!” শমিত দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখে আকাশি রঙের শাড়ি পরা মধ্যবয়সী এক ভদ্রমহিলা। প্রায় ভেজা। ছাতা বন্ধ করে দাওয়ার উপর রাখছে। তারপর ঘরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চাল বেয়ে নেমে আসা বৃষ্টির পানিতে পা এগিয়ে দিয়ে পা ধুচ্ছে। পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে তার মাথার কাঁচাপাকা চুল। একদৃষ্টে তো চেয়ে থাকা যায় না। সে চোখ সরিয়ে নেয়। তা না হলে ভালই লাগছিলো এই পা ধোওয়া দেখতে। এদের বাড়ির মত তাদের স্কুলেও ছিলো টালির চাল। বৃষ্টির দিনে সিঁড়িতে দাড়িয়ে চালের টালি বেয়ে নেমে আসা পানিতে পা এগিয়ে দিয়ে ধোয়া ছিলো নিত্যকার ব্যাপার। সিঁড়িতে জায়গা পাওয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কিও করতে হতো কখনো কখনো। রীতা শুধু একা একা পা ধুতো। কেউ তার সাথে ঠেলাঠেলি করতে যেত না। সবার শেষে সে যেত। সেই সময় যেত শমিত। এরকমই একদিনে রীতা পড়ে যাচ্ছিল সিঁড়ি থেকে। শমিত তার হাত ধরে ফেলে। দুজনেই অপ্রস্তুত হয়। প্রথমবার। তারপর ঐ হাত সে অনেকবার ধরেছিলো।
“তা আপনাগে বাসা না বাড়ি কোথায় ঢাকায়?” প্রশ্ন করে নিতাই। আরো দু’একজন মুরব্বিকে নিয়ে অতিথিদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে সে। শমিত বলে, “না বাড়ি না, বাসা। মিরপুরে থাকি।” “ছেলে-মেয়ে কী আপনার?” “একটাই ছেলে।” “ওরও তো একটাই মেয়ে। মেয়েডা বড় ভালো। আমাগে মহল্লায় ওরম মেয়ে আর হয়নি। ডেভিডের কপাল খারাপ দেহে যাতি পারলো না।” তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে সিমোন আর নিতাই আলোচনা শুরু করে খুলনাতে মিশনারি কার্যক্রম, খ্রিষ্টানদের অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে। শমিতের আগ্রহ ছিলো না সেসব আলাপে।
কথার মধ্যে ঘরে ঢোকে রীতা। “নমষ্কার”। প্রতি নমষ্কারের জন্য হাত তোলে শমিত। “নমো” বলে থেমে যায়। গলা দিয়ে আর কথা বেরোয় না। একটা নীল শাড়ি পরে সামনে দাঁড়ানো রীতা। ভেজা চুল পিঠের উপরে। বৃষ্টিস্নাত চোখমুখ। দু’জনের চোখ আটকে যায় দু’জনের চোখে। অনেক বছর পরে হলেও চিনতে কষ্ট হয় না কারো। নিতাই পরিচয় করিয়ে দেয়, “আমাদের মাস্টার দিদি। এ্যালিসের পিসি। ওই মানুষ করেছে। ওর হাতেই এখানকার সব ছেলে-মেয়ে মানুষ। এই যে বাপ-মরা মেয়েটা আজকে এতো বড় হলো, সে কিন্তু ওর জন্যি। . ..” নিতাই বলে যায়। শমিত শোনে না। শমিতের সঙ্গীরা দু’একবার ছোটখাটো কথা বলে। রীতার সাথে কুশল বিনিময় করে। শমিত মাথা নিচু করে বসে থাকে। “আপনারা কথা বলেন” বলে রীতা উঠে যায়। নিতাই বলে, “যাও, এ্যালিসরি আসতি বলো। কথাটথা বলুক।”
এ্যালিস আসে। কথা বলে হবু শ্বশুর আর তার বন্ধুদের সাথে। সিমোন প্রশ্ন করে, “তা মা, তুমি শমিত বাবুর ছেলেকে চেনো কতদিন ধরে?” “আমরা একসাথে পড়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে।” “তা তোমরা কি বিদেশ চলে যাবা নাকি দেশে থাকবা। চিন্তা-ভাবনা কী?” এসব কথা হয়। এ্যালিস সলজ্জ অংশগ্রহণ করে আলোচনায়।
ঠাণ্ডা লেগে গেছে বলে রীতা গিয়ে পাশের ঘরে শুয়ে পড়েছিলো। চোখ ভরে জল আসছে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তার আপাত রাশভারী ব্যক্তিত্বের সাথে আজকের এই মুহূর্তটি যায় না কিছুতেই। অনেক দিন পরে তার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সুখদাড়ার হাটের কথা, সেই কাঞ্চননগর স্কুলের কথা, সামাদ স্যারের কথা। পায়ে হাঁটার পথের কথা। ঋষিপাড়ায় তাদের ছোট্ট ঘরের কথা। একদিন সেই ঘর তাদের ছাড়তে হয়। গ্রামের লোকজন আক্রমণ করে ঋষিপাড়া। লাঠিসোটা নিয়ে। সন্ধ্যার পরে আগুন ধরিয়ে দেবে তারা ঋষিপাড়ায়। বাজারে সবাই জড়ো হচ্ছে শুনে তারাও জড়ো হয় পাড়ার সামনের রাস্তায়। মুরব্বিদেরকে নিয়ে বিষ্ণু সামনে এগিয়ে আসে। আক্রমণকারীদের সাথে তাদের ঠিক কী কথা হয় তা রীতা জানেনি কোন দিন। কিন্তু সিদ্ধান্ত তাদেরকে জানানো হয়। রীতাদের চলে যেতে হবে এ গ্রাম ছেড়ে। সময় তিন দিন। তিনদিনের সময় বাড়িয়ে পরে এক সপ্তাহ করা হয়। ছয় দিনের দিন তারা গ্রাম ছাড়ে। অপরাধ, রীতার হাত ধরেছিলো শমিত। তাই উচ্চবর্ণের ছেলেকে ফুসলানোর দায়ে রীতাকে পরিবারসমেত গ্রাম ছাড়তে হবে।
শমিতদের বাড়িতে মাঝে মধ্যে রীতা যেত। ঠাম্মা মারা যাবার পর থেকে বাড়ির রক্ষণশীলতা কিছুটা কমেছিলো। শমিতের বাবা-মা এটাকে নিজেদের মহত্ব হিসেবেই ধরে নিতো যে তাদের বাড়িতে রীতার আসাকে তারা বারণ করেনি। কিন্ত সেদিন শমিতের মা দেখে, শমিত রীতার হাত ধরেছে। টেবিলের দু’পাশে দু’জন বসা। কিন্তু টেবিলের উপরে তাদের পরস্পরের হাত ধরা। শমিতের মা চিৎকার দেন, “হারামজাদি, মুচির বিটি. .. ” ইত্যাদি। সবকিছু মনে নেই রীতার। ঘটনার আকস্মিকতায় এবং আক্রমণের তেজে সে কিছুক্ষণ কী করবে ভেবে পায় না। অনেক কথার মধ্যে তার মনে আছে, “ওরে আমার ছাওয়াল রে, মুচির মাইয়ে নিয়ে আসলি ঘরে? . . .ওরে সুবল মুচির রক্ত ঘরে আনে তুললি। হে ভগবান।” তিনি কপালে করাঘাত করতে লাগলেন আর যত খারাপ কথা ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষদের সম্পর্কে বলা যায় তা বলতে লাগলেন। এবং এও বললেন যে এই কারণেই ছোটলোককে লাই দিতে নেই। তার ভুল হয়েছিলো ছেলেকে আগেই না সামলানো। সুবল মুচি এই ঋষিপাড়াটির পত্তন করেছিলেন। অনেক বছর আগে যশোরের দিক থেকে এসে তিনি এখানে, গ্রামের শেষ মাথায় খালপাড়ে, বসতি গড়েছিলেন। তাই গালি দিতে ঋষি পাড়ার সবাইকে ‘সুবল মুচির রক্ত’ বলে থাকে অন্যরা।
যশোরের রাজারহাট হচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে কাঁচা চামড়ার সবচেয়ে বড় বাজার। দশ পনেরো জেলার ঋষি সম্প্রদায়ের সব মানুষ চামড়া নিয়ে এখানে আসে হাটবারে। তেমনই হাট ছিলো সেদিন। সুভাষ চামড়া নিয়ে এসেছিলো। গ্রাম ছাড়তে হবে তিনদিনের মধ্যে। এর মধ্যে তার বোন বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না। এসব ভেবে মন খারাপ করে বসে থাকার অবস্থা তাদের না। চামড়া বেঁচতে হাটে যেতেই হবে। এই হাটে স্বগোত্রীয়দের কাছে অনেকবার সুভাষ শুনেছে কোনসব সংস্থা নাকি লোকজনকে “খ্রিষ্টান বানাচ্ছে”। তাদের সম্প্রদায়ের অনেকেই খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। সেখানে জাতপাত নেই। সবাই সমান। সে খুব আগ্রহ করেনি। ধর্মত্যাগ সে করতে চায়নি কখনোই। তা ধর্ম তাকে যেভাবেই রাখুক না কেন।
এবার সে খোঁজ নেয়। পেয়েও যায় একটা সূত্র। ফিরতি পথে সে খুলনায় এসে এরকম একটা সংস্থার অফিসে যায়। রাতটা সেখানে থেকে পরদিন ফেরে গ্রামে। বাড়ি গিয়ে রীতাকে সে বলে, “চল্। এ ধর্মেই আর থাকপো না। মানুষরি মানুষ মনে করে না। কেন থাকপো?” তার বাবা ‘আহা’ করে উঠেছিলো। কিন্তু ছেলের সাথে গ্রাম ছেড়েছিলো। তারপর তাদের ধর্ম বদলে যায়, নাম বদলে যায়, ঠিকানা বদলে যায়।
৫.
অতিথিরা চলে যাবে। এ্যালিস ডাকতে এসেছে রীতাকে। এতক্ষণে শক্তি সঞ্চয় করে ওঠে সে। গলির মোড় পর্যন্ত অতিথিদেরকে এগিয়ে দেয়া সৌজন্য। অন্যদের সাথে সেও হাঁটতে থাকে। রীতাকে দেখে শমিতের পাও যেন শ্লথ হয়ে আসে। একটু পিছনে পড়ে সে। দু’জন পাশাপাশি হাঁটছে। কোন কথা নেই কয়েক মুহূর্ত। তারপর, আর কেউ শুনতে না পারে মত করে, রীতা শমিতকে বলে, “সেই সুবল মুচির রক্ত। . . . ধর্ম পাল্টে ফেলিছি। নাম পাল্টে ফেলিছি। রক্ত তো পাল্টাতি পারিনি। . . . তোমার ঘরেই যাচ্চে. . .।” শমিতের মুখে কথা আসে না। তারও মনে হয়, সেই একই তো রক্ত, একই তো মানুষ . . . সেদিন তো ধর্মও এক ছিলো. . .। কিছু বলতে যায় সে …