
জলপাই দিঘি
—একেকটা দিঘির ভেতরে লুকিয়ে থাকে আস্ত একটা পুকুর।
দিঘি আর পুকুর নিয়ে খই ভাজো বিতর্ক চলছিল। তাতে একদম জল ঢেলে দিল মৃদুলা। নভেম্বরের না শীত না গরম একটা দিনে মানচিত্রের উত্তর কোনার জনপদ চষে বেড়ানোতে আজকের মত বিরতি টানার দিকে রয়েছে ওরা। ওরা মানে মামা, মামি, মামাতো ভাই। মৃদুলা অফিস আর ফেইসবুক থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামে এসেছে। সমতল চা বাগান, লিচু বাগান ঘুরেটুরে ওরা এখন চলেছে ভিতরগড়। কোনো এক রাজা-মহারাজার দিঘি নাকি দেখার মতো। পথে ছুটতে থাকা মাইক্রোবাসে চলছে কথার কাটাকুটি খেলা; সব দিঘিই পুকুর কিন্তু সব পুকুর দিঘি নয়। ওতেই কাব্য করে ইতি টেনে দিল মৃদুলা।
—এই ভিতরগড় আর কত ভেতরে গো?
আলো নামার খানিক আগে আগেই পৌঁছানো যাবে। তবে খুব বেশি সময় থাকা যাবে না। ফেরার তাড়া রয়েছে। মামা আগেভাগে সবাইকে জানিয়ে রাখলেন।
মৃদুলা গাড়িতে গা এলিয়ে বাইরে চোখে মেলে রেখেছে। পড়ন্ত বিকেল। ধানক্ষেত। কাঁটাতার। সব সর সর করে সরে যাচ্ছে। মামাতো ভাই দুটো রয়েছে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে। কতদিন বাদে ওরা বোনকে পেয়েছে। পড়াশোনা শিকেতে ঝুলিয়ে সারাক্ষণ মৃদুলার পিছু পিছু। যেন ঈদ-পুজো-নববর্ষ সব একেবারে হাতে পেয়েছে ওরা।
ওরা দুজন মৃদুলার ক্যামেরা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। খানিক বাদে বাদে বাইরে ছবি তুলছে। ভিডিও করছে। মৃদুলা দেখলো ব্যাটারি চার্জ টিম টিম করছে। দিঘির ওখানে তো কিছু ছবি আর ভিডিও করতে হবে। কয়েকবার ক্যামেরাটা চালাতে মানা করেও লাভ হলো না। কোন ফাঁকে দুই পাজিতে মিলে মৃদুলার হাত থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ক্যামেরাটা। ওদের পরাস্ত করতে মৃদুলা শেষে দারুণ দর্শন কপচালো। বললো, সব ছবি তুলতে হয় না ক্যামেরাতে। কিছু ছবি চোখে দেখে মনে তুলে রেখে দিতে হয়, বুঝলি তোরা? দর্শন পথ্য কাজে দিল। দুই ভাই বোনের কথা গিলেছে। ক্যামেরা হাতে রেখেছে ঠিকই। কিন্তু ছবি আর তুলছে না।
মাইক্রোবাসের দরজা খুলতেই সবাই ধুপধাপ নেমে পড়ল। মৃদুলার পা দুটো টনটন করছে। এ থেকে মুক্তির একটাই উপায়; জলচিকিৎসা। নদীতে পা ডুবিয়ে রাখতে হবে। এ একেবারে অব্যর্থ স্পা।
সূর্য তখনও ঝুলে রয়েছে আকাশে। দিঘির আরেক প্রান্তে। জায়গাটা কেমন স্থির বলে মনে হলো মৃদুলার। তবে দিঘির ঘাট দেখে চনমনে হলো মন। পাড়ে একটা জলপাই গাছ আছে। তালদিঘি দেখেছিল। জলপাই দিঘি দেখলো এই প্রথম।
মামাতো ভাই দুটোকে বললো, চল পা ধুয়ে আসি।
মহারাজা পৃথু দিঘির কোমর জলে দাঁড়িয়ে। তার ঠিক সাত হাত পেছনে মহারানি, সন্তান, তার পেছনে রাজরক্তের স্বজনেরা। এদের দুপাশে দাঁড়িয়ে রাজ্যসভার খাস লোকেরা। পেছনে ভৃত্যদের সারি উঠে গেছে ডাঙ্গাতে। সবাইকে নিয়ে মুক্তি যজ্ঞ পালন করছেন মহারাজা। তার রাজত্বে আজকে হানা পড়েছে। রাজত্ব হারানো যায়। তবে কৌলিন্য নয়। মহারাজা পৃথু কারো নাগালের হতে রাজি নন। তাই নিজের এই দিঘিতেই আত্মাহুতি। সঙ্গে রাজ পরিবার আর রাজ পরিষদ।
জলের অতলে অন্য এক রাজ্য গড়বেন মহারাজা। সঙ্গে নিচ্ছেন কোষাগারের রত্নভাণ্ডারও। মহারাজা পৃথু একটু একটু করে মাঝ দিঘিতে এগুচ্ছেন। তাকে অনুসরণ করছে রাজ পরিবার। রাজ পরিষদ। তারা দুহাতে রত্ন ঢেলে দিচ্ছে চারপাশে। দিঘির ঘাটে মুক্তোর গড়াগড়ি। জলে ভাসছে সোনা। তলিয়ে যাচ্ছে অতলে।
মহারাজার দিঘির ঘাট দেখতে লোকজন আসা লেগেই থাকে। চুরমুরমাখাওয়ালা দুহাত বিশ্রাম দেওয়ার সময়ই পায় না। পাশেই জলপাই আচার নিয়ে বসে এক বুড়ো। আস্ত আস্ত সিদ্ধ জলপাই মশলা-তেলে মাখানো। এমন রসগোল্লার মত বড় জলপাই মৃদুলা কখনও দেখেনি।
ওরা সবাই একটা একটা করে জলপাই আচার নিল। চারকোনা করে কাগজটা এমন করে কাটা তাতে একটা করে জলপাই আঁটে। মুখে দিতে মোমের মত গলে যাচ্ছে জলপাই। কি অদ্ভুত স্বাদ। কাগজে ছাপার কালি শুদ্ধ চেটেপুটে খেল মৃদুলা। ওকে দেখে ওর ভাই দুটোও তাই করলো।
তারপর পা চালানো দিঘির দিকে। পেছন থেকে বুড়োটা ডাক দিল।
—আপামনি, একটু সাবধানে…।
মৃদুলা খেয়াল করেনি কথাটা। ও ততক্ষণে দিঘির জলে ভেজা মাটিতে জুতো খুলে দাঁড়িয়েছে। দিঘির জলে মাখামাখি ডাঙ্গাতে এদিক-সেদিক ছিটিয়ে রয়েছে গাছ থেকে পড়া জলপাই। মৃদুলার মনে হয় জলে মুক্তো ছড়িয়ে আছে।
গোড়ালি ডুবে যায় জলে নেমে শীতল অনুভূতি উপভোগ করলো মৃদুলা। জলে প্রায় ডুবুডুবু চওড়া কাঠের পাটাতন বিছানো রয়েছে। ওটায় চড়তে গেল সে। কিন্তু পা হড়কে গেল। সামলে নিয়ে এক পা এক পা করে আবারও উঠতে গেলে আবারও পিছলে গেল। তৃতীয় বারও তাই ঘটল। একটু জেদ চাপলো মৃদুলার। দু’ভাই ওর দুহাত ধরে ঠেকিয়ে রাখলো, তারপর ভারসাম্য এলো। এক পা পাটাতনে রেখে এক পা ধুয়ে নিল। আবার আরেক পা। ভীষণ শান্তি লাগছে ওর। উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে পাটাতন থেকে নামল। আবার পিছলে গেল। সামলালো ঠিক এবারও।
জলপাই আচার বেচা বুড়োর সামনে কয়েকজনের জমিয়ে গল্প করে চলছে। আচার শেষ যদিও। মামা-মামিও ওখানে দেখে মৃদুলারা এসে যোগ দিল। আস্ত জলপাই আচার আর নেই দেখে হতাশ।
মামি তাড়া দিয়ে বললো, চল চল। ফিরতে হবে। এখানে থাকাটা ঠিক না আর।
কেন? মৃদুলার সঙ্গে সঙ্গে ওর দুই ভাইও বলে উঠলো।
—আরে যা শুনলাম ওই বুড়োর কাছে, এখানে যে মহারাজা ছিলেন তার নাকি এখানে দিঘির তলে পাতালপুরি। বিরাট রাজ্য। আর ওরা নাকি এখানে অপরিচিত কেউ এসে জলে নামলে টেনে নিয়ে যায় পাতালপুরিতে। একবার যদি না পারে, তবে ওরাই নাকি আবার তাকে ডেকে আনে…।
গাড়ির দিকে পা চালাতে চালাতে মৃদুলা আর একবার পেছন ফিরে তাকায়। জলপাই গাছের নীচ দিয়ে দিঘির আরেক প্রান্তে আধেক ডুবে যাওয়া সূর্যটাকে দেখে।জলপাই গাছের তলে দিঘির জলে আধো ডুবে থাকা কাঠের পাটাতনটা তখনও দেখা যাচ্ছে। একটা জলপাই গাছ থেকে ঝরে জলে পড়তে দেখলো ও। আনমনে বললো, আমাকে আরেকবার আসতে হবে… দিঘির জল বড্ড শীতল।