
জলকুয়া
গবেষকের গবেষণার বিষয় ‘বাংলাদেশের বধ্যভূমি : প্রেক্ষাপট ও পর্যালোচনা’। এ কাজ করতে দেশের কতো কতো জায়গায় যেতে হয় তাকে। কতো পথ ঘাট মাঠ তার সাথে কথা বলে, কতো কতো আকাশ আর উছলা জোছনা তার সাথে মিশে যায়; কতো নদী, খাল-বিল-দিঘি বুকে মাথা রাখে; কতো কথা, গান, গাঁথা, পালা, রূপকথার সাথে লেগে আছে মুক্তিযুদ্ধের কতো রহস্য, কতো কথা, ব্যথা ও দুঃখের প্রহর।
আজ তাকে যেতে হচ্ছে গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের কোনো এক গ্রামে, অবশ্য গ্রামে গ্রামে যাওয়া নতুন কিছু নয়; কিন্তু আজ তার মধ্যে খেলা করছে অন্য এক খেলা। কারণ, কিছুদিন আগে বাবার কাছ থেকে শুনেছে এ শ্রীপুরের কোনো এক গ্রামে বেড়ে উঠেছেন তার বাবা, এখানেই দম বন্ধ করে পড়ে আছে তাদের পৈতৃক ভিটা, স্নেহের গাছগাছালি, হৃদয়চেরা লাল মাটি ও ছায়াঘন অতীত।
সংগ্রামের সময় বড়ো মা ও ভাইদের হত্যা করে বাবাকে গ্রামের স্কুলের ক্যাম্পে আটক রাখে পাঞ্জাবিরা, কিন্তু তার সাহসী বাবা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসে, পালিয়ে আসার সময় পাঞ্জাবিরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে, কপালগুণে এ গুলি লাগে তাঁর বাম কানে, কান ছিঁড়ে পড়ে মাটিতে; আর এ ছেঁড়া কান ঢাকতেই লম্বা লম্বা চুল রাখতে হয় তাঁকে।
এসব কথা মনে হলে বাবার প্রতি এক ধরনের মায়া জন্ম নেয়। কখনো বা গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। এক হিসেবে বাবাকে মুক্তিযোদ্ধাও বলা যায়, তবে আজ বাবার জন্মভূমির প্রতি গভীর এক অনুরাগ আসে তার, মনে হয় এ বুঝি তারই গ্রাম, এ রাস্তা দিয়েই বুঝি তার পূর্বপুরুষেরা চলেছে, এখনো বুঝি রয়ে গেছে পায়ের ছাপ। এসব দেখে, ভেবে, হেসে খেলে পৌঁছে যায় সে, যে গ্রামের উদ্দেশ্যে এসেছে সে গ্রামে, গভীর এক আবেগ নিয়ে মমতা নিয়ে মাটির দিকে। কী পবিত্র এ মাটি! কী গভীর তার মমতা! গ্রামটি উঁচুনিচু টেক-টিলার মধ্যে গাছগাছালির ছায়ায় ঘুমিয়ে আছে যেন। লোকমুখে শোনা কথার বাস্তবতা নিরুপন করতে, গবেষণায় নতুন তথ্য তুলে আনতে, গল্পের প্লট খুঁজে পেতে ও বাবার স্মৃতিবিজড়িত মাটির গন্ধ নিতে তাকে এ গ্রামে থাকতে হবে কিছুদিন। তাই গ্রামের মেম্বারের সাথে তার সমস্ত কথা ও ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেছে ফোনে ফোনে। তার ইচ্ছে অনুযায়ী দিঘির দেউলে ঘর বানানো হয়েছে, দরকার হলে কোনো কোনো রাতে এ ঘরে থাকতে হবে তাকে।
এই ঘর দেখে ইতিহাস ও প্রকৃতির খুব কাছে যাবার অনুভূতি জাগে মনে, আজ রাতেই এ ঘরে থাকার ভূত চাপে মাথায়। এ রকম ভয়ংকর স্থানে রাতে থাকলে কী কী বিপদ হতে পারে তা বুঝিয়ে বলে মেম্বার; কিন্তু তাকে টলানো যায় না, যেন এ শীতের রাতে এ দিঘির দেউলের এক মায়া আছে, আছে এক অশশীরী আত্মার টান; এ মায়া ও অশরীরী আত্মা তাকে টানছে। সে শুনেছে এ দিঘিতে এখনো কোনো মানুষ নামে না; এখনো সন্ধ্যার পড়ে কেউ এ পথ দিয়ে যায় না। কারণ, এ দিঘির জলকূয়াতে শত শত মাথার খুলি জমা হয়ে আছে। কেউ দিঘির পানিতে নামলে পায়ের তলায় পড়ে মানুষের হাড়। নিশুতি রাতে নাকি এসব মাথার খুলি ও হাড় উপরে এসে নাচে অথবা কান্না করে অথবা হাসে। এ এক মিথ নাকি রহস্য নাকি মনের ভয় তা জানার আগ্রহ পেয়ে বসে তাকে। গবেষণায় বধ্যভূমি না বধ্যদিঘি না বধ্যজল লিখবে তা নিয়েও ভাবছে, ভাবতে ভাবতে অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও বাড়িতে যেতে চায় না সে, রাতের খাবার পর্যন্ত এখানে খেতে চায়।
মেম্বার বিরক্ত হয়ে চলে যায়, রেখে যায় তার চ্যালাকে। রাত বাড়তে থাকে, চার্জার লাইটের আলোতে দিঘির দেউলের খানিকটা দেখা যায়। খুব বেশি কুয়াশা নেই, তবে হিম হিম হাওয়া। সে আপন মনে ভাবে, ভেবেই চলে। মাথার খুলি বা হাড় বা ভূত-প্রেত কিছুই চোখে পড়ে না, রাত একটা বেজে গেলেও কোনো কান্নার শব্দ বা হাসির শব্দ বা নাচের শব্দ পাওয়া যায় না। তাই তার বুকের কোণে ব্যথা অনুভব হয়; না-পাওয়ার ব্যথা। আবার একটা ব্যঙ্গ হাসির রেখা ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকে। সময় কাটছে না যেন, সে ব্যাগ থেকে ট্যাবটা বের করে ফেইসবুকে একটা পোস্ট দেয়, এ পোস্টে তার পুরনো প্রেমিকা কমেন্ট করে, নতুন গল্পের জন্য প্লট খুঁজে বেড়াচ্ছো নাকি? এ কমেন্ট পড়ার সাথে সাথে তার উত্তেজনা বাড়ে। গল্প লিখতে হবে এ দিঘি নিয়ে, আজ রাতেই লিখতে হবে। পরে লিখবো বলে রেখে দিলে এ আবেগ বা গতি থাকবে না। এ দিঘির গল্প শুনতে চায় চ্যালার কাছে, চ্যালা অনেক কথা বলে, অনেক বেশি অদ্ভুত কথা, এসব কথার সাথে তার বাবার কথাও মিলে যায়, তার বাবাও দিঘি নিয়ে কতো গল্প শুনিয়েছে তাকে, চ্যালাকে আপন আপন লাগে, অথবা মনে হয় সে যেন তার বাবার সাথে বসে গল্প করছে, তারপরও সে চ্যালাকে বলে তার কয়েকটা পিন লাগবে। গল্পের মজে থাকা চ্যালা জানায় এতো রাতে পিন পাওয়া সম্ভব না, তবে এতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে গবেষক, পিন পাওয়া না গেলে কয়েকটা খেজুর কাঁটা নিয়ে আসতে বলে। রাত একটার পরে এ রকম ভয়ংকর স্থানে এ রকম শীতের রাতে গল্পের ঘোর নিয়ে খেজুর কাঁটা আনতে যায় চ্যালা আর অস্ফুট গলায় বলে, ‘শালা, বোকাচুদার বাচ্চা, এক্কেবারে পাগল জানি কুহানকার, যা কই সবই বিশ্বাস করে।’
এ সময়টা কাটতে চায় না, এই বুঝি প্লট হারিয়ে যাবে, এই বুঝি ভুলে যাবে সব; তবে কিছুক্ষণের মধ্যে চার-পাঁচটা খেজুর কাঁটা নিয়ে আসে চ্যালা। গবেষক সাথে সাথে দুইটা খেজুর কাঁটা দুই পায়ের গোড়ালির চামড়াতে সেলাইয়ের মতো করে ঢুকিয়ে দেয়, গ্রামের মায়েরা কাঁথা সেলাই করে যেভাবে, যেন সে তার পায়ের গোড়ালি সেলাই করছে। খুব দ্রুত পিনিক উঠে, বেশ পিনিক, লেখার সময় এ পিনিকটা দরকার হয়, ভাব আসে তর তর করে আর লিখতে বসে গল্প :
এই দিঘির আছে একটা কাহিনি, অনেক পুরনো কাহিনি, জীবনের সাথে তার ছিলো গভীর মিতালি। পথের পরতে পরতে বাতাসের ভাজে ভাজে আসমানের কোণায় কোণায় তার কথা লেপ্টে আছে, তার ছলছলা জলে সাঁতার কাটে কতো পরাণের কথা, কতো স্বপনের কথা, কতো সুখের কথা, কতো দুঃখের কথা, কতো ডরের কথা, কতো রহস্যের কথা। এই দিঘিতে চৈত্র মাসেও জল থাকতো পাতাল সমান, রোদের দিনেও জল থাকতো ঠান্ডা আর ঠান্ডা।
এই গল্পের মিডুরি ও তার ছোটভাই ফালাইন্না সারা দিন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করার পরে অথবা খেলা শেষ করার পরে লাফ দিতো জলে আর সাথে সাথে দিঘি তার বুকের মধ্যে তাদেরকে লুকিয়ে ফেলতো। জলের কণা তার ঠোঁট দিয়া চুষে নিতো তাদের ছোঁয়া, সারাদিন খ্যাতে-খামারে কাজ করার পরে মিডুরির বাবা ও তার বড়ো ভাই গোসল করতে নামলে তাদের ঘামের গন্ধ এক টানে পান করতো, জলের কণা তার চোখ দিয়া তাদের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত দেখতো। সারাদিন ঘরে-বাইরে কাজ করার পর মিডুরির মা ও তার বড়ো জা বাতির আযানের সময় দিঘিতে নামলে দিঘি তার হাত দিয়া তাদেরকে আদর করতো অথবা তাদের সমস্ত শরীরে জিহ্বা দিয়া চেটে নিতো, কিন্তু যেইদিন মান্দাইরা চলে গেলো এই দিঘির মালিকানা ফেলে সেইদিন থেকে এই দিঘির পানিতে গন্ধ আর গন্ধ; গন্ধে বমি আসে। অথচ এই দিঘিই ছিলো তাদের একমাত্র সম্বল। কী পরাণের দিঘি, কী সাধের দিঘি। ১৯০ বছর আগে এই দিঘি দখল করে নিয়েছিলো ওরা। নিজের বাপ-দাদার দেশে মিডুরিরা তাদের সুখ-শান্তি হারিয়েছিলো।
১৯০ বছর আগে মোজাই গাঙের ওইপাড় থেকে মান্দাইরা আসে, তারা দলবল নিয়া দিঘির দেউলে বসত গাড়ে। বসত গাড়ার জন্য দরকার জল, যেইখানে জল আছে সেইখানেই বসত আছে, জীবন আছে। চতুর মান্দাই তা ভালো করে বুঝতে পারে, মিডুরির বাপের সাথে হাত মিলিয়ে বসত গড়ে তুলে। এক দিন এক মেঘের রাতে মান্দাই আসে মিডুরির বাপের বাংলা ঘরে। তাদের আলোচনা শুনে মিডুরির মা কয়, ‘মিডুরির বাপ গো মিডুরির বাপ, এইডা তুমি কী করলা!’
নিজ গ্রামের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে মান্দাইকে দিঘির দেউলে বাড়ি করার সুযোগ করে দেয় মিডুরির বাপ। সে মনে করে মান্দাই তাকে দিঘি শাসন করতে সাহায্য করবে। কিন্তু হায়! কী হলো শেষে। এক দিন দুই দিন করে সময় যায়, অল্প সময়ের মধ্যে মান্দাইয়ের ক্ষমতা বাড়ে, একদিন দিঘির দেউলসহ দখল করে নেয় দিঘিটা। এতো চতুর মান্দাই, তার সাথে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের পারার কথা না। তবে মোল্লারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে, বিশেষ করে সিরাজ মোল্লা। বাতির শিসের মতন লাল টকটকে এই যুবক শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠে না; হয়তো দূরদর্শিতার অভাবে পেরে ওঠে না সে।
এইভাবে সমস্ত ক্ষমতা চলে যায় মান্দাইদের হাতে, চতুর মান্দাইরা ক্ষমতা দখল করার পরে সবার আগে মোল্লাদের দূর করে। এই দিঘির দেউলে মোল্লাদের কোনো স্থান হয় না, মান্দাই তার শেয়ালের বুদ্ধি দিয়া সমস্ত দেউলের নিয়ন্ত্রণ নেয়, চৈত্র মাসে বিল-টিল সব শুকিয়ে গেলে দলে দলে মানুষ আসে জলের জন্য, মান্দাই সেই জল সের দরে বিক্রি করে।
তারপর সময় যায় আর যায়। সিরাজ মোল্লার বংশধর, মজুমদারদের বংশধর সচেতন হয়ে ওঠে। পালের হাওয়া বদলাতে থাকে। এক সময় মান্দাইরা মোজাই গাঙের ওইপাড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। বাপ দাদার ভিটাতে চলে যাবার আগে সুদের উপর সুদ তার উপর কটকিনা সুদের ব্যবসা করে দিঘির জল শুকিয়ে সমস্ত মাছ নিয়া যায়।
১৯০ বছর ধরে দিঘিটা শাসন করার পরে মান্দাইরা চলে গেলে সবাই খুশি হয় এবং মোল্লা বাড়ির জিন্নত মোল্লা ভাবে এইবার দিঘিতে আরাম করে ফরজ গোসল করতে পারবে, আরাম করে পোলাপানের গু-মুত ধুতে পারবে, আরাম করে ডুব সাঁতার খেলতে পারবে। কিন্তু মান্দাইদের পরিত্যক্ত ঘর-বাড়ি থালা বাসন তোশক দখল করার জন্য মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়, গুপ্তহত্যা চলতে থাকে। আর কয়েক দিন পর পর দিঘিতে এক একটা লাশ ভেসে ওঠে।
মান্দাইরা চলে যাওয়ার আগে এই জমিভিটা মোল্লাদের কাছে বেচে কিছু, কিছু বেচে মজুমদারদের কাছে। মান্দাই যাওয়ার আগে এক নিশুতি রাতে জিন্নত মোল্লার কাছে গিয়ে বলে, ‘মোল্লা সাহেব, এই দিঘির জলকূয়াতে একটা কলসি রাখছিলাম, এই কলসিভরা স্বর্ণ, এই অসময়ে আমি তা খুইজ্যা পাইলাম না, আপনারে পছন্দ করি, আপনি সময় মতো উঠাইয়া নিয়েন, ও হ্যা, এই কথা যেন মজুমদাররা না জানে।’ এই কথা শোনার পরে জিন্নত মোল্লা মান্দাইয়ের প্রশংসা করে অনেক এবং অনেক আদর-আপ্যায়ন করে। কিন্তু এই রাতের শেষের দিকে মান্দাই যায় মজুমদারদের বাড়িতে, গান্ধার মজুমদারের বাংলা ঘরে তাদের আলোচনা শুরু হয়, মজুমদারের কানে কানে কয়, ‘মজুমদার সাহেব, এই দিঘির জলকূয়াতে একটা কলসি রাখছিলাম, এই কলসিভরা স্বর্ণ, এই অসময়ে আমি তা খুইজ্যা পাইলাম না, আপনারে পছন্দ করি, আপনি সময় মতন উঠাইয়া নিয়েন, ও হ্যাঁ, এই কথা যেন মোল্লারা না জানে।’
এই খবর জানার পরে মোল্লারা এবং মজুমদাররা উতলা হয়। নিশুতি রাতে মোল্লারা দিঘির জলকূয়াতে নামে। নিশুতি রাতে মজুমদাররা জলকূয়াতে নামে, কতো বার যে নামে তার হিসাব নাই। কিন্তু কোনো বারই জলকূয়ার সন্ধান পায় না তারা, দিঘির মাঝখানে কাদা আর কাদা, তবুও তারা দিঘির কাছাকাছি থাকে, দিঘিতে নামার জন্য সুযোগ খোঁজে, দখলদারিত্ব নিয়া হামলা ও হত্যা বাড়ে। প্রত্যেক দিন কোন না কোন মানুষ মারা যায়। দিঘিতে লাশ ভেসে উঠলেও এই লাশ শনাক্ত করার আগেই মাছে খেয়ে ফেলে অর্ধেকের চেয়ে বেশি। কয়েক দিনের মধ্যে পুরো লাশ উধাও হয়ে যায়।
মান্দাইয়ের হাত থেকে মোল্লা ও মজুমদারদের হাতে এই দিঘির মালিকানা আসলেও মানুষ আরাম পায় না, সবখানে মান্দাই মান্দাই গন্ধ। প্রত্যেক দিন জলের উপর ভাসে লাশ আর লাশ। গান্ধার মজুমদার মানুষের কাছে বলে বেড়ায়, ‘দশ টাকা দিয়া মান্দাইয়ের দিঘি কিইন্যা রাখছি।’ জিন্নত মোল্লা মানুষের কাছে বলে বেড়ায়, ‘দশ টাকা দিয়া মান্দাইয়ের দিঘি কিইন্যা রাখছি।’ পুব পাড়ার বঙ্গ রাখাল মানুষের কাছে বলে বেড়ায়, ‘আমি মান্দাইয়ের কাছ থেইকা এক পাকি জমি কিইন্যা রাখছি।’ মোল্লা বাড়ির জিন্নত মোল্লা মজুমদার বাড়ির গান্ধার মজুমদার ও পুব পাড়ার বঙ্গ রাখাল জমির কাগজ দেখায়। কিন্তু সব জমির দাগ একটাই। তারা প্রত্যেকে ভাবে দেউলসহ দিঘিটা দখল করবে। কিন্তু মান্দাইরা সরল মানুষ থাকলে ১৯০ বছর কিভাবে ভোগদখল করলো এই জমি-ভিটা-দিঘি? কিভাবে সুদের ব্যবসা করেছে কামাই করে কাড়ি কাড়ি টাকা? দুই চার গ্রামের মাতুব্বররা সালিশে বসলে প্রত্যেকে দিঘির মালিকানা চায়। দিঘির ভাগ ছাড়তে চায় না কেউ। তাই মাতুব্বরা দেউলসহ দিঘির মালিকানা তিন জনের নামে রেখে বাকি জমি ভাগ করে দেয়। রায় হয় এইভাবে, দিঘিটা তারা সবাই ব্যবহার করবে; গজার মাছগুলা তুলে তিন জনের টাকায় মাছের পোনা ছাড়া হবে; এই পোনা বড়ো হলে তারা তিন জনে সমান ভাগে ভাগ করে নিবে। কিন্তু এই রায় উল্টে যায়, তিন জনে ভাগ পাবার কথা থাকলেও মূলত ভাগ হয় দুই ভাগে। মজুমদারদের ও মোল্লাদের। জমির মাঝখান থেকে বড়ো অংশ পায় বড়ো বংশওয়ালা মজুমদাররা আর মাঝখানের আশেপাশের জমিগুলা পায় মোল্লারা ও বঙ্গ রাখালরা।
মোল্লারা ও রাখালরা এক সাথে ভাগাভাগি করে থাকতে থাকে। মজুমদারদের বাড়ির পশ্চিম পাশে মোল্লাদের বাড়ি আর পুব পাশে রাখালদের। রাখালদের বাড়ি এই দিঘির দেউলে, কিন্তু দিঘির দেউলে রাখালদের বাড়ি থাকলেও মোল্লারা দিঘির মাছ ধরে বেশি। দিঘি পাহারা দেওয়ার কাজ ও মাছগুলাকে কুঁড়া খাওয়ানোর কাজ করে বঙ্গ রাখালের পরিবার; কিন্তু মাছ ধরার সময় বড়ো মাছটা নিয়া যায় জিন্নত মোল্লার ছেলেরা। মাছ নিয়া ক্ষেতের লাউ নিয়া ক্ষেতের কচু নিয়া পাট নিয়া জিন্নত মোল্লার ছেলের সাথে রঙ্গ রাখালের ছেলের লেগে যায়। এক পর্যায়ে খুনোখুনি শুরু হয়। মোল্লারা রঙ্গ রাখালের পরিবারের ১৭ জনকে হত্যা করে দিঘিতে ফেলে। এইভাবে ৯ মাস যাবার পরে মজুমদাররা রাখালদের সাহায্য করে, তাদের চির শত্রু মোল্লারা শেষ পর্যন্ত লেজ গুটিয়ে চলে যায়।
বঙ্গ রাখালদের ৩০ জন মানুষ মারা যায়। জমি নিয়া মারামারি লেগে এতো মানুষ মারা যাবার ঘটনা এই দেশে নাই। ২৪ মাস পরে রাখালের জীবিত ছেলে এই দিঘির মালিকানা পায়; কিন্তু শুরু হয় নতুন জ্বালা-যন্ত্রণা। এই দিঘির জল দিয়া রাখালের ছেলের পরিবার গোসল করতে পারে না; ওজু করতে পারে না। কারণ, মান্দাইয়ের গায়ের গন্ধ কমে নাই, মজুমদারদের গায়ের গন্ধ কমে নাই, মোল্লাদের গায়ের গন্ধ কমে নাই; এই তিন গন্ধ মিলে কী যে এক অদ্ভুত গন্ধ দম বন্ধ করে দেয়।
এ পর্যন্ত লেখার পরে গবেষকের মনে হলো এভাবে সরলরৈখিক বর্ণনা করলে তার গল্প সুপাঠ্য হলেও কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে। তাই সে প্লটের মধ্যে ভাঙন নিয়ে আসার চিন্তা করে। তখন অন্ধকার আরো ঘন হয়, গাছগাছালিরা যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে, যেন এ নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। আবার লেখা শুরু করে :
এই দিঘির জলের অদ্ভুত এক মিশ্র গন্ধের কারণে বঙ্গ রাখালদের বংশধররা সমস্যায় পড়ে; কিন্তু এক সময় এই দিঘির বিরাট গৌরব ছিলো। এই দিঘির মাঝখানে যে জলকূয়া আছে তাতে বাস করতো এক মনসা। কিন্তু এই মনসার সন্তানরা কোনো দিন কাউকে ছোবল দিতো না। মানুষ ভাবতো এইসব সাপ সাপের মতন থাকলেও আসলে এইগুলা মনসার সন্তান। মান্দাইরা আসার অনেক আগে শনি-মঙ্গল বারে এই মনসারে দুধ কলা ভোগ দিতো মানুষ। কিন্তু এক সময় এই ভোগ দেওয়া কমতে থাকলো। গ্রামে আসলো মোল্লারা, আসলো মজুমদাররা, আসলো মান্দাইরা, আসলো বঙ্গ রাখালরা। কোন বংশই এই ভোগ দেওয়ার প্রচলন ঠিক রাখে নাই। তবু কেউ কেউ মাঝে মাঝে ভোগ দিতো তাদের বালামসিবত দূর করার জন্য। কারো বাড়ির বউ-ঝিরে জ্বিনে-ভূতে ধরলে অথবা মল্লির পোলাপানের মল্লি ছাড়াতে অথবা শনি-মঙ্গলের আছর ছাড়াতে ভোগ দেয়া হতো। এই ভোগ দেওয়ারও আছে নিয়মকানুন। প্রথমে কলা গাছ দিয়া একটা ভেলা বানানো হয়। তারপর লাল-নীল কাগজ দিয়া সেই ভেলার উপর ছাউনি দেওয়ার পরে সেই ছাউনি থেকে ফিতা টেনে ভেলার পাড়ে লাগিয়ে বাহারি রঙে সাজিয়ে কাগজের নিশান উড়ানো হয়। তার ভিতরে সবরি কলা, কালো গাইয়ের দুধ, কালো কবুতরের ভুনা, আতব চালের রুটি, জবা ফুল, শিউলি ফুল, কামিনী ফুল অথবা ঋতুভিত্তিক ফুল দেয়া হয়। কিন্তু এই ভেলাটা পানিতে ছাড়ার কাজ সবাই পারে না। তার জন্য দরকার সাহসী মানুষ। যে বউ-ঝির জন্য অথবা যে বাচ্চার জন্য এই ভোগ দেওয়া হয় তার বাপ অথবা তার স্বামীকে এই কাজটা করতে হয়। অনেক বছর আগে একবার মাইনউদ্দিনের মল্লির ছেলে রাসেলের জন্য এই ভোগ দেওয়া হলে তাকে এই কঠিন কাজটা করতে হয়। মাইনউদ্দিন বলে :
শনিবারে বেইল ডুবার সাথে সাথে ভোগের সবকিছু রেডি কইরা আমরা অপেক্ষা করি; আন্ধার নাইমা আসে; রাইত নিশুতি হইলে আমার হাত পাও ক্যামন করতে থাকে; আমার শরীলের সব লোম খাড়াইয়া যায়; রাসেলের মা না করে; কয় যাওয়ার দরকার নাই; রাসেল গ্যালে রাসেল পাওয়া যাইবো; কিন্তু তোমার কিছু হইলে আমার সবই যাইবো; এই ভোগ দেওয়ার দরকার নাই; লিল্লার কপালে এতো দুঃখ লেইখা রাখছিলো আল্লাহ্; ঘরের পিছে শব্দ হয়; ধুম ধুম শব্দ; ঝিঝি পোকা কান্দনের সুরে ডাকে; রাসেলের মা ডরে কাঁপতে থাকে; এইভাবে কাঁপতে কাঁপতে এক সময় রাইত আরো নিশুতি হইলে আমি চোখ বন্ধ কইরা গায়ের সব কাপড় খুইল্যা ফেলি; কলা গাছের ভেলাটা হাতে নিয়া বাইর হওয়ার সময় রাসেলের মা আমার হাতে মুঠি দিয়া ধরে; আমি তারে কই, ডরাইয়ো না; তুমি দুআ করো; ঘর থেইকা বাইর হওয়ার সাথে সাথে এক খাব্লা বাতাস জাবরাইয়া ধরে আমারে; মনে হয় আমার পিছে পিছে কিছু একটা হাঁটে; নারায়ণের তেঁতুল গাছের গোড়ায় আসার পরে তেঁতুল গাছের ডাইল ভাইঙ্গা পড়ে সামনে; আমি সেই ডাইলের ডাইন পাশ দিয়া যাই; শরীলের লোম সব খাড়াইয়া গ্যালেও দৌড়াইতে থাকি; সব গাছগাছালি আমারে যেন কইতাছে, যাইস না; যাইস না; ফিরে যা; ফিরে যা; ঘরে যা; ঘরে যা; তবু আল্লাহর নাম নিয়া আগাইতে থাকি; নিজের শরীল নিজেই দেখি না; আমি যে একটা মানুষ তা আমার মনে হয় না; মনে হয় আমি একটা ন্যাংটা আজর; মাথার মইধ্যে এই ভাব আসলে আমার সব ডর দূর হইয়া যায়; আমি বিড়বিড় কইরা কইতে থাকি, আয়; আয়; কে আইবি, আয়; এই কথা কইয়া দেই দৌড়; কবিরাজের শিখাইয়া দেওয়া মন্ত্রটা পড়তে থাকি; এইবার দেখি আমি দিঘির সামনে; উত্তরের ঘাটে বইসা পশ্চিমের দিকে মুখ কইরা জলে ভেলাটা ছাড়ার সাথে সাথে চলতে থাকে তা; দিঘির চাইর দিকে ঘুরতে থাকে; দিঘির জলে বিরাট ঘুরনি; এক সময় নামি দিঘিতে; নামার সাথে সাথে চাইর দিক থেইকা সাপ আসতে থাকে; আমি মন্ত্রটা পড়তে থাকি; কিন্তু সাপগুলা আমার শরীল থেকে আড়াই হাত দূরে থাকে; কাছে ঘেঁষতে পারে না; মন্ত্রটা পড়তে পড়তে দিঘির মাঝখানে যাই; এই মাঝখানেই জলকূয়া; ডুব দিয়া এই জলকূয়া থেইকা প্যাক আনার কথা মনে হওয়ার সাথে সাথে দম বন্ধ হইয়া যাইবার চায়; মন্ত্রটা পড়তে পড়তে ডুব দিলাম; ডুব দেওয়ার সাথে সাথে মনে মনে মন্ত্রটা কইতে পারছিলাম না; তারপরেও প্যাক খুঁজলাম; কই প্যাক নাইতো; আবার ডুব দিলাম আবার মন্ত্রটা মনে করতে পারলাম না; কিন্তু ডুব থেইকা উঠলে মনে করতে পারি; যে মন্ত্রটা আমার ঠোঁটের আগাতে ছিলো সে মন্ত্রটা ডুব দেওয়ার পরে মনে করতে পারি না; তিন বারের মাথায় না পারলে প্যাকের নাগাল পাওয়া যাইবো না; মন্ত্রটা পড়তে পড়তে আবারো ডুব দিলাম; ঠাণ্ডা জলের কারণে হাত পা কান ব্যথা করতে লাগলো; আমি পাতালের দিকে যাইতে থাকলাম; কই মন্ত্র মনে আসে না; পাতালের নিচ থেইকা মনে করার চেষ্টা করলাম; কিন্তু না মনে আসে না; মন্ত্র ছাড়াই জলকূয়ার প্যাক খুঁজতে থাকি; এক সময় প্যাকের সন্ধান পাই; হাতের মইধ্যে একটা কলসির মতন লাগে; আমি আরেকটু ভালো কইরা হাত বুলাইলে বুঝতে পারি এইটা একটা জলকলসি; জলকলসির ভিতরে হাত ঢুকাইতে পারি নাই; কিন্তু বুঝতে পারি জলকলসিটা কিছু একটা দিয়া ভরা; আমার দম শ্যাষ হয় হয়; আমি জলকলসিটা নিয়া জলে ভাসলাম; সাথে সাথে জলে ঘুরনি আর ঘুরনি; চাইর দিক থেইকা সাপ আসতে থাকে; মন্ত্রটা আর মনে পড়ে না; আমি হাতে জলকলসি নিয়া উঠতে পারি না; কোন রকম লেয়ুর দিয়া মাটিতে উঠি; দিঘির সমস্ত সাপ উপরে উঠতে থাকে; পিতলের জলকলসি নিয়া আমি দেই দৌড় আর আমার পিছে চিৎকার দিতে দিতে আসতে থাকে একটা তুফান; মাথার উপরের সমস্ত গাছগাছালি য্যানো আমার উপর পইড়া যাইবো; গাছগুলা য্যানো আমার দিকে চাইয়া রইছে; আমার দুই ঠ্যাঙের মাঝখান দিয়া একটা বিড়াল মিউ ডাক দিয়া বারি খায়; তবু আমি জলকলসিটা ছাড়ি না; এতো ওজন; তবু ধরেই থাকি; শ্যাষ পর্যন্ত কোন রকমে ঘরে ঢুকি।
মাইনউদ্দিন জলকূয়ার কাদা আনতে গেলেও জলকলসি পাওয়ার পরে কাদার কথা ভুলে যায়। কবিরাজের কথামতো এই জলকূয়া থেকে কাদা এনে রাসেলের কপালে লেপ দিতে পারলে রাসেলের শরীর আর ফ্যাকাশে হবে না। রাসেলের আগে এক এক করে তিন বোন এইভাবে তিন-চার মাস বাঁচার পরে মারা গেছে। রাসেলের শরীরও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, যেন তার মরার সময় হয়েছে; তাই নানি-দাদিরা কইতো, ‘রাসেল পেটে থাকার সময়ই চুষে রক্ত খাইয়া ফেলাইছে; এই মল্লি ছাড়াইতে হইলে দিঘিতে ভোগ দিতে হইবো।’ তাদের বিশ্বাস এই মল্লি ছাড়ানোর জন্যে যেইদিন মাইনউদ্দিন রাত তিনটার সময় ঘর থেকে বের হবে সেইদিন রাসেল সুস্থ হবে।
গবেষক এতোটুকু লিখতে লিখতে রাত দুইটা বাজিয়ে দেয়। মেম্বারের চ্যালার চোখেও ঘুম নেই, যেন তার সাথে চ্যালাও লিখছে। পশ্চিম দিকে কিসের যেন শব্দ; নাকি সে ভুল শুনছে। মনে হয় সাপের পিলপিল শব্দ, না, এসব কিছু না। একটা সিগারেট ধরায় সে, মনে হয় গল্পের ঘোর কাটেনি এখনো, সিগারেট টানতে টানতে একবার ফেইসবুকে ঢুঁ মারে। অনলাইনে এখনো ৫৫৬ জন। মানুষের ঘুম চুরি হয়ে গেছে যেন, তারপর সে নটিফিকেশনগুলো চেক করে আবার লিখতে বসে :
যখন মাইনউদ্দিন ঘর থেকে বের হয় তখন তার বউ রাহেলার জীবন যায় যায়, বউ রাহেলার মুখে শোনা যায় এইসব কথা :
রাসেলের বাপ ঘর থেইকা বাইর হওয়ার লগে লগে আমার হাতপাও কাঁপতে থাকে; আল্লাহ গো আল্লাহ; রাসেলের বাপ ঘর থেইকা বাইর হওয়ার পরেই ঘরের চালে ধইরা কী যে ঝাকানি; মনে কয় পুতের দরকার নাই; আগে নিজে বাঁইচ্যা লই; আল্লাহ্ আল্লাহ্ করি আর রাসেলের মুখের দিকে চাইয়া থাকি; দেখি পুত আমার রঙ বদলায়; এই লাল হইয়া যায় তো এই নীল হইয়া যায়; এইভাবে পুত আমার সাতরঙা হইয়া যায়; ওইদিকে ঘরের পিছে ঘোড়ার খুরের শব্দ হয়; রাসেলের বাপে যাওয়ার আগে কইয়া গ্যাছে যাই ঘটুক না কেন তুই কাউরে ডাক দেইস না; ডরাইস না; ডরাইতে না করলে যদি ডরানি না আসতো তাইলে মাগি মাইনষে পুরুষ মাইনষের কাজ করতে পারতো; রাসেলরে কুলে নিয়া বইসা আল্লাহ্-বিল্লাহ্ করি আর রাসেলের বাপের জন্য বইসা থাকি; আল্লাহ্ আমার পুত দরকার নাই; আমার স্বামীরে ফিরাইয়া আনো; ও মা; ঘরের চালে চাক্কা মারে কেডা জানি; আল্লাহ্গো আল্লাহ্ তুমি আমগরে রক্ষা করো; বাতির আগুন উড়াল মারতে চায়; হঠাৎ কইরা বাতিটা নিইভ্যা যায়; ডরে আমি কাপড় নষ্ট কইরা ফেলি; কাব্দা লাইগ্যা পইড়া থাকি বিছানার মইধ্যে; মনে হয় এক যুগ পরে রাসেলের বাপের ডাকে হুশ পাই; আমি কই, ও রাসেলের বাপ; আপনে ঠিক আছেন তো? রাসেলের বাপে শীতে থিরথির করে; কই, প্যাক পাইছেন? আমার এই কথা শোনার পরে তাইনের হুশ আসে, আমি প্যাক আনার জন্য গেছিলাম নাকি? দেখি তাইনের হাতে একটা পিতলের কলসি; রাসেলের বাপ; ও রাসেলের বাপ; আপনে এইডা কই পাইছেন? আপনে প্যাক না আইন্যা জলকলসি নিয়া আইছেন নাকি; শুনছি এই জলকলসির ভিতরে থাকে সাত রাজার ধন; সোনা, রূপা, মুক্তা; রাসেলের বাপে কয়, চুপ মাগি; একদম চুপ থাক; কাকপক্ষীও যেন টের না পায়; রাসেলের মা আমগর দিন বদলাইয়া যাইবো; আমরা চুপ মাইরা থাকলাম; রাসেলের শরীল আরো ফ্যাকাশে হইতে থাকলো; আমি মাগি সেই দিকে খেয়ালই রাখলাম না; আমি চিন্তা করি এই জলকলসির মুখ ক্যামনে খোলা যায়; এই জলকলসির ভিতরে শব্দ করে হিরা-মুক্তা; রাইতের বেলা টিনের চাল মটমট করে; ঘরের পিছে খটখট করে ঘোড়ার খুর; আমি তো ডরে মরি; রাসেলের বাপেরে কই; ও রাসেলের বাপ; বড়লোক হওয়ার দরকার নাই; আপনে এই জলকলসি রাইখ্যা আসেন; রাসেলের বাপে তো কথা শুনে না; আমিও জোর করি না; পাওয়া কি সবাই পায় নাকি? আমিও টিক মাইরা থাকলাম; কিন্তু এই জলকলসির মুখ খুলতে পারলাম না আমরা; কার কাছে যাই? কী করি? কিছুই বুঝতে পারলাম না; রাসেলের অবস্থা খারাপ হইতে থাকলো; ১৩ দিন পর পুত আমার মইরা গ্যালো; আমার বুকের মানিক মইরা যাইবার পরে আমার টনক নড়লো; আমার সাত রাজার ধন দরকার নাই; এই ধন সবার সয় না; রাসেলের বাপেরে কই; এই জলকলসি আপনে যেইখান থেকে আনছেন সেইখানে রাইখ্যা আসেন; তাইনে আমার কথা শুনতে চান না; রাসেল মইরা যাইবার সাত দিন পরে ঘরে পড়ে রাসেলের বাপ; জ্বরের চুটে হাত পাও কাঁপতে থাকে; নিশুতি রাইতে রাসেলের বাপ এইবার ধানের ডুলি থেইকা জলকলসিটা পাড়ে; কলসিটার ভিতরে কী জানি শো শো করতে থাকে; রাসেলের বাপ যেই দরজাটা খুইল্যা মাটিতে রাখে সেই চলতে থাকে; চ্যাল চ্যাল কইরা যাইতে থাকে দিঘির দিকে; আর সাথে সাথে রাসেলের বাপের জ্বর ছাড়ে; তার শরীল থেইকা যেন বোঝা নাইমা যায়।
এইটুকু লেখার পড়ে গবেষকের মনে হয় বাংলা সাহিত্যের নয় বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর একটা হবে তার এ গল্প। তখন দিঘির পানিতে টুপটুপ শব্দ হয়। রাত তিনটার সময় মানুষের শব্দ আসার কথা না, তবু শব্দ আসে, গা ছমছম করে, নাস্তিক গবেষক ঈশ্বরকে ভয় না পেলেও আজকের গল্পের আবহ ও এ আবহের কারণে তার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। পাশে চ্যালা বসে আছে, তবুও সে মনে জোর আনে, আবার লেখা শুরু করে, দিঘি নিয়ে আরো গল্প ফাঁদে :
রাসেলের মৃত্যুর অনেক বছর আগে একজন রাজকুমার ছিলো এই দিঘির কাছে। সেই সময় এই দিঘিতে জলডেকচি, জলকলসি, জলথালা, জলবাসন ভেসে উঠতো। মানুষ এইসব দিয়া তাদের মেজবানি করতো। কিন্তু রাজকুমার মরার পরে এই দিঘি থেকে জলডেকচি জলকলসি জলথালা জলবাসন পাওয়া যায় না। একদিন ঠিক দুপুর বেলা এক মায়ের এক ছেলে রাজকুমার যায় দিঘিতে গোসল করতে। যেই নামে সেই ডান পায়ের মধ্যে প্যাঁচ দিয়া ধরে একটা জিঞ্জির। রাজকুমার ওরে বাবা গো বলে এক খামচা দিয়া ওঠে দিঘি থেকে। পায়ের সাথে প্যাঁচানো জিঞ্জির নিয়াই বাড়ির দিকে দৌড় দেয়। জিঞ্জির আসতেই থাকে। দিঘি থেকে বাড়ি পর্যন্ত পিতলের জিঞ্জিরের খবর শুনে দুই চার গ্রামের মানুষ ভিড় করে। রাজকুমারের মা-বাপ জিঞ্জির ধরে টানে; কিন্তু জিঞ্জির আর শেষ হয় না। উত্তর বাড়ির ধর্মপাল কয়, এই জিঞ্জির টাইন্যা লাভ নাই রাজকুমারের মা; এই জিঞ্জির শ্যাষ হইতো না। তবু রাজকুমারের মা জিঞ্জির টানতে থাকে। সারাদিন জিঞ্জির টানার ফলে জিঞ্জিরের পাহাড় হয়ে যায়; কিন্তু রাত গভীর হতে না হতেই চ্যাল চ্যাল করে দিঘিতে নামতে থাকে এই জিঞ্জির। নামতে নামতে পুরোটা শেষ হয়ে যায়, এক সময় রাজকুমারের পায়ে পড়ে টান, তাকে টেনে টেনে নিয়া যায়। রাজকুমারের মা বাপ ঘুম থেকে উঠে ছেলের পায়ের সাথে প্যাঁচানো জিঞ্জির ধরে টান দেয়। টান দেওয়ার সাথে সাথে জিঞ্জিরের টান থেমে যায়। তার মা বাপ তাকে আবার ঘরে নিয়া যায়, আবার জিঞ্জিরটাকে পালঙ্কের সাথে বাঁধে। কিন্তু যতোই বাঁধা হোক না কেন পায়ের বাঁধন খোলা যায় না। কামার পাড়ার কামারেরাও এই জিঞ্জির কাটতে পারে না। একবার এক কামার আগুনে তাতানো ছেনি দিয়া এই জিঞ্জির কাটতে যায়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাটতে পারে না, ওইদিনই বাড়ি ফেরার পথে রক্ত বমি করে মারা যায় সে। এরপর থেকে কোন কামার জিঞ্জির কাটতে সাহস করে না।
এইভাবে উনচল্লিশতম রাত শেষ হলে রাজকুমারকে পাওয়া যায় না। জিঞ্জিরও নাই; রাজকুমারও নাই। পুরোহিতরা কয়, চল্লিশাডা কাটাতে পারলে জিঞ্জির ছাইড়া দিতো নিজে নিজে; আহারে রাজকুমার; এই জিঞ্জির চল্লিশ দিনের বেশি পানি ছাড়া থাকতে পারে না; একটা দিনের লাইগ্যা ছেরাডা মরলো।
রাজকুমারের পরিণতির কথা চিন্তা করে একটু বিশ্রাম নেয় গবেষক, মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, কতো কতো চিন্তা চলে আসে, সেই সাথে উত্তর থেকে হাওয়া আসে, ভার ভার হাওয়া। মনে হয় দিঘিতে চিকচিক করছে জিঞ্জির, এবার সাহস নিয়ে একটু কাছে যায়, দিঘির পাড়ে যায়, খুব পাড়ে। না, কোনো শব্দ নেই, কোনো জিঞ্জির নেই, কিন্তু ঘরে ফেরার জন্য ইউটার্ন নেয়ার সাথে সাথে দমকা হাওয়া আসে সামনে থেকে, গরম গরম হাওয়া, আরেকটু হলেই দিঘিতে পড়ে যেতো, বুকটা টিক টিক করতে থাকে। প্যারা নরমাল বিষয় নিয়ে গল্প-উপন্যাস পড়েছে, দেখেছে হরর মুভিও, কিন্তু এগুলো তার জীবনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি, তবে আজ কেমন জানি লাগছে। ঘরে ঢুকেই খেয়াল করে মেম্বারের চ্যালা উধাও, চ্যালা থাকলে হয়তো আরো গল্প শোনা যেতো, কখন গেলো? কিছুক্ষণ আগেও দিঘির গল্প করেছে ও, হয়তো খেজুর কাঁটা আনতে দিয়েছে অথবা ভয়ে পালিয়েছে।
আযানের সুর কানে আসে, ঘুম আসে তার, চোখ ভর্তি ঘুম। গল্পের পরেরটুকু পরের রাতে লিখবে বলে মনস্থির করে, ঘুম ঘুম ঠাণ্ডা নেমে আসে।
সকাল সকাল মেম্বার এসে হাজির হয়। গবেষক ডিস্টার্ব ফিল করলেও মেম্বারকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে সব। তার বাবার শ্রীপুর কতো সুন্দর ! এই দিঘিটাও কী সুন্দর ! দিঘির উত্তর ও দক্ষিণ পাশে ঘন জঙ্গল, চারপাশের জমি ও জঙ্গল দিঘি থেকে বেশ উঁচুতে, অনেকটা স্ট্যাডিয়ামের মতো। আর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে পায়ে চলার পথ গেছে দিঘির পাশ দিয়ে। মেম্বার বলে এ পথ দিয়ে সন্ধ্যার পরে কোন মানুষ যায় না। সে আরো বলে সংগ্রামের সময় দুই-তিন শত মানুষকে জবাই করে এ দিঘিতে ফেলা হয়েছে। এসব মানুষের মাথার খুলি এখনো দিঘির জলকূয়াতে জমে আছে। পানি মুখে নেয়া যায় না দুর্গন্ধে, এক সময় নাকি এ দিঘির পানি খেয়েই মানুষ তৃষ্ণা মেটাতো; কিন্তু এখন গরু-ছাগলেও এর পানি খায় না।
গবেষক খুঁটে খুঁটে সব দেখে, অনেক নোট নেয়, মানুষের সাথে কথা বলে। গল্পের বর্ণনা জীবন্ত হওয়া চাই, তার গবেষণা ব্যতিক্রমী হওয়া চাই। এ যে তার বাবার জন্মভূমি। তাছাড়া বাবা এখান থেকে না গেলে হয়তো এখানকার আলো বাতাসে বেড়ে ওঠতো সে। তাই সময় নিয়ে এ গ্রামের মুরুব্বিদের কাছে সংগ্রামের কথা জানতে চায়; এ দিঘির কথা জানতে চায়, এ দিঘির রহস্য জানতে চায়, আগে কোনো গবেষক বা কোনো সংস্থা বা কোনো কর্তৃপক্ষ এসেছে কি-না তাও জানতে চায়। অনেক গল্প, নোট আর অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রাতের ঘটনা মনে পড়লে নিজের উপর রাগ হয়; সে কতো সংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলো।
দুপুরের খাবারের পরে অনেক টাকাকড়ির বিনিময়েও কোনো মানুষ পাওয়া যায় না, যে মানুষ দিঘিতে নামতে পারবে, যে মানুষ একটা মাথার খুলি বা চোয়াল বা হাড় দেখাতে পারবে তাকে। মেম্বারও পারে না, মৃত্যু নিয়ে কেউ খেলতে চায় না। তাই গবেষক নিজেই নামে সিঁড়ি বেয়ে, শ্যাওলায় ছেয়ে আছে সব, মাথা নুয়ে দুই হাত দিয়ে পানি তুলে আনে নাকের দিকে; সবুজ সবুজ পানি। কিন্তু তা মুখে নেয়ার সাথে সাথে ওয়াক শব্দ করে ফেলে দেয়। এতো দুর্গন্ধ, বিচিত্র এই গন্ধ, মাথা ঝিম ঝিম করে, পরে, মেম্বারের সাথে বাড়ি ফিরে।
এভাবে সন্ধ্যা হয়ে যায়, গতরাতের মতো আবারো মেম্বারের চ্যালাকে নিয়ে সেই ঘরে ওঠে। লেপ তোশক সবই পড়ে আছে। খেজুর কাঁটা নিয়ে আসে চ্যালা, ও আরো গল্প বলে, আবারো গল্প লেখা শুরু হয় :
রাজকুমারের মৃত্যুর পরে তার মা পাগলের মতন হয়ে যায়, তার ছেলেকে জিঞ্জিরে ধরার আগে মাঝে মাঝে এই স্বপ্নটা দেখতো। সে বলে :
দেখি একটা সাপ; এই সাপ আমার পুতেরে প্যাঁচাইয়া ধরছে; আমার পুতেরে ছাড়ে না; মাঝে মাঝে দেখি একটা বেডিরে; তার সারা শরীলে সাপ আর সাপ; আমারে কয়, তুই আমার থালা চুরি করছস; আমি তোর কলিজার টুকরা চুরি করবো; আমি ডরে কাঁপি; রাম রাম, আমার কান্দন দেইখা বেডি হাসে; হাসতে হাসতে হঠাৎ কইরা থাইম্যা যায়; আর আমার দিকে চোখ রাঙ্গাইয়া চায়; সরমের কথা কী কইতাম; একবার মেজবানির সময় দিঘির কাছে ডেক ডেকচি চাইছিলো রাজকুমারের বাপে; কালি আন্ধারের সময় গিয়া কইছিলো, হরি কৃষ্ণ হরি বল; হোক তোমার জয়, তোমার দরবারে আর্জি আমার; মেজবানির জন্য ডেকচি লাগবো তোমার; পরের দিন শেষ রাইতে সাতটা ভাতের ডেক, সাতটা সানের ডেক, সাতশ থালি-বাসুন দিঘির দেইলে সারি সারি কইরা বইসা থাকে; রাজকুমারের বাপে আমারে নিয়া এই ডেক-ডেকচি, থালি-বাসুন বাড়িতে আনে; মেজবানির পরে থালি-বাসুন গোনার সময় একটা থালি কম পড়ে; রাজকুমারের বাপের তো মাথায় বাঁশ পড়ে; আমি মাগিও হায় হায় করি; সারা রাইত খুঁজার পরেও পাওয়া যায় না; নিশুতি রাইতে এই ডেকডেকচি নিয়া দিঘির দেইলে সারি সারি কইরা সাজাই; কিন্তু একটা ডেকডেকচিও দিঘিতে নামে না; রাজকুমারের বাপের মাথা খারাপ হইয়া যায়; দিঘির জল আমার দিকে চাইয়া রইছে; আমি তো ডরে মরি; রাজকুমারের বাপেরে কাইন্দা কাইন্দা কই, একটা থালি আমি গোবরের টালে ঢুকাইয়া রাখছি; এই কথা শুনার পরে রাজকুমারের বাপে আমারে ছাইড়া দিবার চায়; আমি মাগি কাইন্দা কাইন্দা মরি; পরে এই থালি গোবরের টালেরতে বাইর কইরা ছাই দিয়া ধুইয়া আনি; তারপরেও দিঘিতে নামে না; আমি কাইন্দা কাইন্দা ক্ষমা চাইছি কতো; আমি একটা খাড়া মাগি; খাড়া মাগি না হইলে এমন কাম কেউ করে নাকি? সারা রাইত কাইন্দা ক্ষমা চাওয়ার পরে শেষ রাইতে সবগুলা এক সাথে দিঘিতে নামে; এই ঘটনার পরে আমি এই বেডিরে খোয়াবে দেখি; দেখি সাপ আইসা আমার রাজকুমাররে প্যাঁচাইয়া ধরছে।
এই ঘটনার পরে এই দিঘি থেকে ডেকডেকচি পাওয়া যায় না; হাজার বার করে হরি কৃষ্ণ হরি বল; হোক তোমার জয়; তোমার দরবারে আর্জি আমার; মেজবানির জন্য ডেকচি লাগবো তোমার আর্জি জানালেও কোন ডেকডেকচি দিঘির দেউলে ওঠে বসে থাকে না।
এ পর্যন্ত লেখার পরে বমি বমি লাগে গবেষকের, মাথা ঝিম ঝিম করে। পায়ের গোড়ালিতে থাকা খেজুর কাঁটা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে যেন। না, কাঁটা খুলে ফেলা দরকার। মেম্বারের চ্যালা বলে, ‘স্যার কোন সমস্যা?’ ‘না, বমি বমি লাগছে।’ ‘খাড়ান স্যার, দেখতাছি।’ চ্যালা চলে যায়।
এই দিঘি, পরিবেশ, চ্যালার গল্প সব কেমন উলটপালট হয়ে যাচ্ছে, নাকি তার মগজে কোনো এক দিঘির গল্প গেঁথে ছিল, অথবা বাবার কাছে শোনা লোককথা বা রূপকথার অভিজ্ঞতায় হয়তো গল্পগুলো আসছে। স্বপ্ন, কল্পনা ও বাস্তব একাকার হয়ে যাচ্ছে যেন, যেন সে এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে।
রাত বাড়তে থাকে, উত্তর থেকে হাওয়া আসে, চুপি চুপি হাওয়া। বমি বমি ভাব কমে, আবার লেখা দরকার। কিন্তু তার জন্য পিনিক দরকার, খেজুর কাঁটা গোড়ালিতে না ঢুকালে পিনিক আসে না। খেজুর কাঁটার মাথা তো ভেঙে গেছে, আরো কাঁটা লাগবে, ওই দিকে চ্যালাও আসছে না। বমি বমি ভাব দূর করার জন্য লেবু পাতা আনার কথা বলে গিয়েছিলো। বিশ-পঁচিশ মিনিট হয়ে গেলেও আসে না ও। এতো রাতে মেম্বারকে ফোন দেয়া ঠিক হবে না। চ্যালার নাম্বারও জানে না সে, কেন যে নিয়ে রাখেনি। অস্থির লাগে, নানান প্রশ্ন জাগে মনে। পানিতে মিশ্র গন্ধ কেন? মাথার খুলি ওঠে আসে কেন? সময় কাটে না, সে গতকালের পত্রিকাটা বের করে। শিল্প-সাহিত্য পাতায় একটা গল্প দেখা যাচ্ছে, অচেনা এক লেখকের। তার মতো নামকরা গল্পকারের এসব অচেনা লেখকের গল্প পড়ার সময় নেই। তবে চ্যালা আসার আগ পর্যন্ত পড়া যেতে পারে। সে মাঝখান থেকে পড়া শুরু করে :
জমির মোল্লা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এগারো জনকে জবাই করে এই দিঘিতে ফেলে। এই এগারো জনের মধ্যে আছে যাত্রা দলের নবাব সিরাজদৌল্লা ও তার দুই ছেলে যাত্রাদলের আপন-দুলাল।
প্রতি বছর শীতের সময় তিন দিন ধরে যাত্রা হওয়ার রেওয়াজ আছে এই গ্রামে। ভিটিপাড়া কে এইচ কে উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক প্রথম দিন সিরাজদ্দৌল্লার পাঠ নেয়। দ্বিতীয় দিন তার দুই ছেলে আপন-দুলালের পাঠ নেয়। তাই এই পরিবারের মানুষদের খুব খাতির করে মানুষ।
সংগ্রামের সময় যাত্রা নামানোর অবন্থা থাকে না। তাই সিরাজদৌল্লা ও তার ছেলেদের মন খারাপ হয়। সেই সময় জমির মোল্লা তার দুই ছেলে আসিফ মোল্লা ও হাসিব মোল্লাকে সাথে নিয়া মুক্তিদের খোঁজ নেয়, ইস্কুল ঘরে বিহারিগর ক্যাম্পে যায়। একদিন অন্ধকার রাতে টিপ টিপ করে মেঘ নামে। চারদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার। এই অন্ধকার রাতে সিরাজদৌল্লাহ আপন-দুলালকে বুকে জড়িয়ে ধরে। পাশের ঘরে তাদের মা বেঘোরে ঘুমায়। তারা তাদের মাকে এক বার দেখে। আপন মায়ের কাছে যেতে চাইলে দুলাল বাধা দেয়। মা এতো সুন্দর ঘুম ঘুমাতে পারে তা জানা ছিল না। মা টের পেলে আর রক্ষা নাই, বাবা তাগাদা দেয়, বাবার মুখ শক্ত; কিন্তু মায়ের মুখ কতো নরম। এই অন্ধকার রাতে আলো ছাড়া পথ চলা কঠিন, তবু তারা চলে ত্রিমোহিনীর দিকে। ত্রিমোহিনীর ওই পাড়ে আছে মুক্তিদের ক্যাম্প, কয়দিন আগেই আপন-দুলালদের বাড়িতে তিন দিন থেকে গেলো মুক্তিযোদ্ধা আফসার উদ্দিন, এই আফসার উদ্দিনের কাছেই যাচ্ছে তারা।
এইরকম অন্ধকার মেঘের রাতে আপন-দুলাল পথ খুঁজে পায় না। এতো প্যাঁচমোচড়ার রাস্তা দিয়া তের-চৌদ্দ বছরের দুইটা কিশোর হাত ধরাধরি করে আগায়। তাদের নিশানা একটাই। ত্রিমোহিনীর ওই পাড়, কিন্তু শেষ রাতে আপন-দুলালের ডাকে দরজা খুলে বের হয় সিরাজদৌল্লাহ। জমির মোল্লা আপন-দুলালকে পিঠমোড়া করে বেঁধে নিয়া আসছে। সিরাজদৌল্লাহ থ বনে যায়, এতো রাতে কিভাবে ধরা পড়লো তার ছেলেরা? জমির মোল্লার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে পাশের বাড়ির ল্যাংড়া আনারুল। আনারুল জমির মোল্লার সাথে কেন? এই আনারুল তো দিনে-রাতে তার বাড়িতে পড়ে থাকে। এখনো পেটে পারা দিলে মুখ দিয়া এই বাড়ির ভাত বের হবে। ততোক্ষণে আপন-দুলালের মা জেগে ওঠে। হুড়মুড়িয়ে ওঠে আসে। এতো সুন্দর মেঘের রাতে ছেলেদের পিঠমোড়া বাঁধা অবস্থায় দেখে বোবা হয়ে যায় সে; অল্প সময়ের ব্যবধানে তার চেতন ফিরে আসে, বিলাপ করতে করতে আপন-দুলালের কাছে যেতে থাকে। কিন্তু তার আগেই আনারুল ধরে ফেলে তাকে। সিরাজদৌল্লা আর ঠিক থাকতে পারে না। তার হাতের কাছে আছে একটা কোদাল, সেই কোদাল দিয়া আনারুলের মাথায় এক ঘা বসিয়ে দেয়। তড়পাতে তড়পাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে আনারুল মারা যায় আর সাথে সাথে তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে জমির মোল্লার লোকেরা। পরের দিন সকালে পাড়ায় পাড়ায় ঘোষণা দেওয়া হয় খুনী ইস্কুল মাস্টার ও তার দুই ছেলের বিচার করা হবে। পরের দিন মানুষ দলা হয়, তিন বাপছেলেকে পিঠমোড়া করে বেঁধে হাজির করা হয়। আপন-দুলালের মাকেও বেঁধে রাখা হয় কাঁঠাল গাছের সাথে, মানুষের বুক টিকটিক করে, কেউ কেউ ভয়ে কাপড় নষ্ট করে ফেলতে চায়।
এ পর্যন্ত পড়ার পড়ে গবেষকের মাথা ব্যথা ওঠে। বমি বমি ভাব বাড়ে। কিন্তু চ্যালা আসে না, তবুও সে পড়ায় মনোযোগ দেয় :
খেজুর গাছ কাটার জন্য যে কাইচ্চা দা বানানো হয় সেই দা দিয়া প্রথমে আপনকে জবাই করা হয়। জমির মোল্লা নিজ হাতে এই কাজ করে। এই দৃশ্য দেখে সিরাজদৌল্লাহ চুপ করে থাকে; তার চোখ দিয়া রক্তের ফোঁটা যেন পড়ে। এতো ক্রোধ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এবার দুলালের পালা। ছেলেটা কাঁপতে থাকে। নিজের চোখের সামনে নিজের ভাইকে জবাই করার দৃশ্য দেখে কিংবা নিজের মৃত্যুর দৃশ্য কল্পনা করে ছটফট করে হতভাগা। হায় আল্লাহ্, মৃত্যুর স্বাদ বুঝি এতো কঠিন। কোরবানির পশুর মতন তাকে শুয়ে দেওয়া হয়। জমির মোল্লা আল্লাহু একবার বলে দুলালের গলায় কাইচ্চা দা চালায়। ফিনকি দিয়া রক্ত বের হয়। জমির মোল্লার চোখ-মুখ লেপ্টে যায়। এই দৃশ্য দেখেও সিরাজদৌল্লাহ চুপ করে থাকে। তার এইরকম নির্লিপ্ত আচরণ দেখে জমির মোল্লার রাগ ওঠে। সে কতো মজার দৃশ্য চিন্তা করেছে মনে মনে। চিন্তা করেছে সিরাজদৌল্লা তার পায়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তার কাছে জীবন ভিক্ষা চাইবে। কই, কিছুই তো হলো না। শুয়োরের মতন দাঁড়িয়ে থাকলো। শালার জেদ কম না। অজ্ঞান-টজ্ঞান তো দূরের কথা ওর মাথাটা পর্যন্ত ঘুরলো না।
সিরাজদৌল্লাহ হয়তো এতো সাহসী না; হয়তো এতো পাষাণও না, কিন্তু মরণ যেইখানে নিশ্চিত সেইখানে বীরের মরণই শ্রেয়। তাই শেষ কামড়টা দিতে চায় সে। এইবার সে সাপের মতন ফুঁপাতে থাকে, এক লাফে গিয়া পড়ে জমির মোল্লার ঘাড়ে, বাম কানের মধ্যে এইরকম কামড় দেয় যে শেষ পর্যন্ত পুরো কান তার মুখে চলে আসে। সাথে সাথে বিরাট এক হুংকার দিয়া জমির মোল্লার লোকদের মধ্যে একজন এক কোপ দেয় তার পিঠে। এই কোপ কিছুটা লাগলেও দৌড় দেয় সে, সাথে সাথে জমির মোল্লার লোকেরা ধাওয়া করে তাকে। কিন্তু যে মৃত্যুর ভয়ে দৌড়ায় তার সাথে এই লোকেরা পেরে ওঠে না। চোখের পলকে গজারিগড়ে ঢুকে পড়ে, তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কানের ব্যথায় অস্থির জমির মোল্লা আপন-দুলালের মাকে জবাই করে মেজাজ ঠাণ্ডা করে, শেষে তিন মা ছেলেকে বস্তায় ভরে দিঘিতে ফেলা হয়। সিরাজদৌল্লাকে খুঁজে বের করার জন্য লোক লাগিয়ে রাখে। কয়েক দিনের মধ্যে সিরাজদৌল্লা ধরা পড়ে। রক্তের দাগ দেখে তাকে খুঁজে বের করা হয়।
গবেষক আবার থামে, তার গল্পই পড়ছে যেন, বাবার কথা মনে পড়ছে, ৯১ বছর বয়স তার বাবার, তার বাবারও বাম কান নেই। খুব অস্থির লাগে, গল্পের সাথে দিঘিটারও কতো মিল। চ্যালার বাচ্চা চ্যালা আসে না তখনো। না, শেষটুকু পড়তে হবে। আবার পড়া শুরু করে :
২৩ শে জুন, বুধবার সকালে বাবা মার সামনে আপন-দুলালকে জবাই করে জমির মোল্লা ভাষণ দিয়েছিলো, আল্লাহর রাস্তায় কাফেরদের কোরবানি দিলাম; এই গেরামে এই রকম কাফেরের কোন জায়গা নাই। সিরাজদৌল্লা ধরা পড়ার পরেও এইরকম ঘোষণা দেয়া হয় এবং তিন দিন যাবত কাঁঠাল গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয় তাকে। সিদ্ধান্ত হয় ২রা জুলাই, শক্রবার বাদ জুম্মা তাকে জবাই করা হবে। মানুষ আবারো দলা হয়, সবার সামনে তাকে জবাই করে দুই মণ বস্তার মধ্যে লাশ ভরে দিঘিতে ফেলা হয়।
এ পর্যন্ত পড়ার পরে তার পিপাসা লাগে; এই শীতেও গরম গরম লাগে। কান গরম হয়ে যায়, বাম কানে হাত দিয়ে দেখে তার কান ঠিক আছে কি-না। তার মনে হতে থাকে তার আগেই এ দিঘির গল্প লিখে ফেলেছে অন্য কেউ। কিন্তু অন্য মন বলে, না, এ দিঘি আর গল্পের দিঘির মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। পানি খেয়ে আবারো পড়তে থাকে গবেষক :
তার কয়েক দিন পরে দেশ স্বাধীন হয়। গ্রামে গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসে। এই গ্রামেও আসে। কতো কিছু করতে হবে। অস্ত্র জমা দেয়া লাগবে। অবশ্য তার আগে একটা বিরাট কাজ করতে হবে। জমির মোল্লা ও তার চার সহকারীকে খুঁজে বের করা দরকার।
চার সহকারী ধরা পড়লেও জমির মোল্লা ধরা পড়ে না। সহকারীদের কাছ থেকে জানা যায়, ১৬ই ডিসেম্বর রাতে বোরকা পরে পালিয়ে গেছে জমির মোল্লা। গ্রাম ছেড়ে কোথায় গেছে তা কেউ বলতে পারে না।
গবেষক এবার দ্বিধায় পড়ে, আবারো তার বাবার কথা মনে পড়ে। তারাও মোল্লা বংশের সন্তান। সে আর ভাবতে পারে না। না, গল্পের জমির মোল্লার সাথে তার বাবা জমির মোল্লার কোন যোগসূত্র নেই। তার বাবাতো মুক্তিযোদ্ধা। এবার উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। চার্জার লাইটের চার্জ শেষ হয়ে আসে, অন্ধকার নেমে আসে ঘরে, শেষটুকু জানার জন্য দ্রুত পড়তে থাকে :
কিছুক্ষণের মধ্যে তার চার সহকারীকে লত দিয়া বেঁধে দিঘিতে ফেলা হয়। এই দৃশ্য দেখার জন্য জুম্মার নামাজের পরে দলে দলে মানুষ আসে। মুরুব্বিরা না করে, কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশের যুবকরা ছোটে ঘোড়ার গতিতে। এতো এতো যুবক এই গ্রাম থেকে যুদ্ধে গেছে তা জানা ছিল না কারো। একটা যুবকও বাদ নাই, যুদ্ধের সময় যে ছেলেটাকে ঘর থেকে বের হতে দেখা যায় নাই সেও এগিয়ে আসে। এই সুযোগ হাতছাড়া করার মতন বোকা না তারা। কিন্তু এই ঘটনায় দিঘির পানি কিছুক্ষণের জন্য দুর্গন্ধমুক্ত হয় মাত্র।
এ বাক্য পড়ার সাথে সাথে তার মাথায় রক্ত ওঠে, কী করবে বুঝে ওঠতে পারে না, দম বন্ধ হয়ে আসে। না, এ হতে পারে না। দারুণ অস্থিরতা ধরে ফেলে তাকে, দিঘির খুব কাছে যায় সে। চার্জারের শেষ আলোতে শেষ বারের মতো ভালো করে পরীক্ষা করে সব। এ দিঘি আর গল্পের দিঘির মিল-অমিল খুঁজে। এবার কোনো অমিল খুঁজে পায় না সে, তার মনে হয় দিঘির পানিতে হাজার হাজার সাপ কিলবিল করছে, পানির উপর নৃত্য করছে। এ অন্ধকারের মধ্যেও শত শত মাথার খুলি উপরে ওঠে আসছে যেন, মনে হচ্ছে তার বাবাকে দেখা যাচ্ছে দিঘির পানিতে, কালো কালো সাপ তার বৃদ্ধ বাবার বাম কান খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। সে শক্তি সঞ্চয় করে সমস্ত হেলোসিনেশন কিংবা ইলুয়েশনকে ঝেটিয়ে বিদায় করার উদ্যোগ নেয়; তবু মনে হয় দিঘির পানি বাড়ছে, খুব দ্রুত বাড়ছে। সে বুকের বাম পাশে তীব্র ব্যথা অনুভব করে, নড়তে পারে না, এক বিন্দুও না। তখন জীবনের সমস্ত স্মৃতি ও বিস্মৃতিরা আসে, আসে বাম কান ছাড়া বাবার মুখ।
পরের দিন সকালে মেম্বার এসে দেখে দিঘির হাঁটু পানিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে গবেষক।