
চিমামান্দার নারীবাদী ঘোষণাপত্র, নারীস্বাধীনতা এবং কতিপয় আলাপ
কিছু দিন আগে খুলনা শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সরকারি অফিসের গাড়িতে ঘুরছিলাম। কথা প্রসঙ্গে চালক বলল এই গাড়িটা সাধারণত ঢাকা থেকে আসা অফিসারদের ডিউটি করে। কয়েকদিন আগে এক মহিলা মন্ত্রী এই গাড়িতে চড়েছিলেন। তো ঐ মন্ত্রী মহোদয়ের সম্পর্কে চালকের মন্তব্যটা এমন, ‘একজন মেয়েমানুষ হিসেবে যতটা ভালো হওয়ার কথা এই মন্ত্রী তার চেয়ে অনেক ভালো।’ লক্ষ করার বিষয় এই চালকের মন্তব্যটা। সে সমাজেরই একজন। তার ভাবনা একান্ত তার কিন্তু সেখানে সমাজের একটা ভূমিকা রয়েছে। সে ভাবতে শিখেছে বা তাকে শেখানো হয়েছে নারীর নির্দিষ্ট কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিংবা নারী এমন হয়। কিংবা নারীকে এমন হতে হবে। তার মানে বিষয়টা জেন্ডার সংক্রান্ত। ম্যারি উলসন্টোন ক্রাফট, বেগম রোকেয়াসহ অনেকেই একটা কথা বলেছেন নারী যদি বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচর্যায় এগিয়ে যায় অর্থাৎ সামাজিক অবস্থান দৃঢ় হয় তবে সেক্ষেত্রে নারীসংক্রান্ত ধারণার হয়তো কিছু পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে একজন মন্ত্রীকেও ঐ একই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সমাজের তৈরি করে দেওয়া মাপকাঠিতে তার ভালো-মন্দ বিচার চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে সমাজকে এই দায়িত্বটা কে দিয়েছে? মানে নারী কেমন হবে সেটা নির্ণয়ের মাপকাঠি তৈরি কিংবা বিচার করার? এক্ষেত্রে বিষয়টা হয়তো এমন নিজেদের প্রয়োজনে সত্য তৈরি করে নেওয়ার মতো। বারবার কেন নারীকেন্দ্রিক ইস্যগুলোতে সমাজ এতটা পেছনে থাকবে? একটি সমাজ বা দেশ কতটা এগিয়েছে তা তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, শিক্ষাসংক্রান্ত অগ্রগতি, সাংস্কৃতিক চর্চা দেখে পরিমাপ করা হয় সম্ভবত। তবে নারীসংক্রান্ত ইস্যুতে দেশটির চিন্তাভাবনা একটা বড় রকমের মাপকাঠি হতে পারে। কেননা পোশাকি আধুনিকতা আর সমৃদ্ধি সব চাপা পড়ে যায় নারীবিষয়ক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আদিমতার প্রকাশে। বিষয়টি জরুরি। সময়টা কূপমণ্ডূকতা থেকে বের হয়ে আসার জন্য, চিন্তায় মুক্তির এবং সবদিক থেকে স্বাধীন অনুভবের। পৃথিবীতে ৫২ শতাংশ নারী। সুতরাং দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য আর দেরি করা ঠিক হবে না।
জীবন থেকে, বাস্তবতা থেকে নিজের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে কথা বলেছেন নাইজেরিয়ান নারীবাদী চিমামান্দা এনগোজি আদিচি (জ. ১৯৭৭)। চিমামান্দা নাইজেরিয়ায় বেড়ে ওঠেন। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিলেন। উনিশ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে যান পড়ালেখার জন্য। ২০০১ সালে ইস্টার্ন কানেটিকাট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Summa cum laude সম্মানসহ স্নাতক হন। হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৩ সালে সৃজনশীল লেখায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। চিমামান্দার লেখা উপন্যাস হচ্ছে পার্পল হিবিসকাস, হাফ অব আ ইয়োলো সান, দ্যা থিং অ্যারাউন্ড ইয়োর নেক, আমেরিকানা। এগুলো পাঠকসমাদৃত এবং বহু ভাষায় অনূদিতও। চিমামান্দার ছোট দুটি বইয়ের সংকলন আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত (WE SHOULD All BE FEMINISTS) এবং একটি নারীবাদী ঘোষণাপত্র (A FEMENIST MANIFESTO IN FIFTEEN SUGGESTIONS). শিমিন মুশশারাত এই শিরোনামে অনুবাদ করেছেন। এছড়া বীথি সপ্তর্ষি অনুবাদ করেছেন নারীবাদী প্রস্তাবনা শিরোনামে।
চিমামান্দা তাঁর এই লেখায় যে প্রশ্নগুলোর অবতারণা করছেন সেগুলো আমাদেরও। তিনি বলছেন :
আমার পার্পল হিবিসকাস উপন্যাসের প্রচারণার সময় এক সাংবাদিক আমাকে জানান, লোকে বলছে উপন্যাসটি নারীবাদী। তারপর দুঃখিত ভঙ্গিতে বলেন, আমার প্রতি তাঁর উপদেশ, আমি যেন কখনোই নিজেকে নারীবাদী দাবি না করি। স্বামী না পেয়ে যেসব মেয়ে অসুখী, তারাই নারীবাদী। . . . তারপর এক নাইরেজিয়ান নরাী শিক্ষাবিদ আমাকে বলেন, নারীবাদ আমাদের সংস্কৃতি নয়; আমি পশ্চিমা বই পড়ে নিজেকে নারীবাদী বলি। যেহেতু নারীবাদ আফ্রিকান নয়, আমি এবার ঠিক করলাম আমি নিজেকে একজন সুখী আফ্রিকান নারীবাদী বলব। তারপর এক প্রিয় বন্ধু বলল, আমি নারীবাদী মানে আমি পুরুষদের ঘৃণা করি। এবার সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি হলাম একজন সুখী আফ্রিকান নারীবাদী, যে পুরুষদের ঘৃণা করে না।
সমাজের বৈষম্য নিয়ে কথা বলতে গেলে কোনো তকমা লাগানো হয় না। লাগালেও সেটা নেতিবাচক অর্থে নয়। কিন্তু নারীকে নিয়ে কথা বলতে গেলে সমাজ একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। এটা আফ্রিকান সমাজে নয় শুধু কমবেশি সব সমাজেই। আমি বাংলাদেশের অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোকজনকে নারীবাদ শব্দটিকে তাচ্ছিল্য অর্থে কখনো বা ব্যঙ্গাত্মক অর্থে ব্যবহার এমনকি উচ্চারণটা পর্যন্ত করতে দেখেছি। চিমামান্দা তাঁর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশক্তি এবং সহানুভূতিশীল মন দিয়ে সমাজকে বিশ্লেষণের যে চেষ্টা করেছেন তার প্রাসঙ্গিকতা অনেক। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও আমরা এ বিষয়ে অর্থাৎ নারীসংক্রান্ত বিষয়ে আদিম অন্ধকারকেই মনে পোষণ করি। চিমামান্দার একটি বক্তৃতার পরিমার্জিত সংস্করণ আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত বইটি। এই বইয়ে-
সংস্কৃতিগতভাবে যুগ যুগ ধরে অনুশীলিত নারীবৈষম্য, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার ওপর পুরুষতন্ত্রের ক্ষতিকর প্রভাব, নাইজেরিয়া এবং বিশ্বব্যাপী নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত বস্তাপচা যুক্তিগুলোর অসাড়তা তিনি পাঠক-শ্রোতার কাছ পৌঁছে দেন তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনার মধ্য দিয়ে।
চিমামান্দা চৌদ্দ বছর বয়সে বন্ধু ওকুলোমার কাছ থেকে প্রথম শোনে সে নারীবাদী। পরে অভিধানে এর অর্থ দেখে। তার মানে দাঁড়ায় সহজাতভাবে চিমামান্দা তাঁর চিন্তার ক্ষেত্রে সচেতন ছিলেন অর্থাৎ নারীকে নিয়ে তাঁর ভাবনার জায়গাটা স্বচ্ছ ছিল। স্কুলে শুধু মেয়ে বলে পরীক্ষায় ভালো করেও ক্লাসমনিটর হতে পারেননি চিমামান্দা। এমন গল্প কেবল চিমামান্দার নেই অনেক নারীরই আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১২ সালের নির্বাচনের সময় লিলি লেডবেটার আইনের প্রসঙ্গ ওঠে। এই আইনের বিষয়টা হলো, ‘যুক্তরাষ্ট্রের একজন নারী এবং একজন পুরুষ একই কাজ করেন, দুজনের যোগ্যতাও এক, কিন্তু পুরুষ কর্মীকে বেশি বেতন দেওয়া হয়, কারণ তিনি একজন পুরুষ।’ বিষয়টি ভাবতে অবাক লাগে। আমাদের দেশেও এই বৈষম্য আছে। শ্রমজীবী মানুষদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি। আর শিক্ষিত সমাজে কিছুটা রেখেঢেকে এই বৈষম্য করা হয়। বড় বড় অফিসে কাজের ভাগ রয়েছে। নারীকর্মীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো পান না। ডেকোরেশন, আপ্যায়ন, সংবর্ধনা, অনুষ্ঠান সঞ্চালনার মতো কাজ তাদের ভাগে আসে। আর অনুষ্ঠানের গঠন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ক্রয়সংক্রান্ত ব্যাপারের মতো কাজগুলো পুরুষকর্মীরা করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপারগুলো হয়ে আসছে। চিমামান্দা বলছেন ছোট ছোট বৈষম্যগুলো একটা সময় স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়ে যায়। লোকের মাথার তখন এগুলো ঢুকে যায়। ছেলেরা যেকোনো বিল পরিশোধ করবে মেয়েরা নয় কিংবা ভারি কাজ ছেলেরা করবে এমন রেওয়াজও প্রচলিত আছে। এরকম ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে দিয়ে পুরুষতন্ত্র একদিকে নিজের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে নেয়।
আক্ষরিকভাবেই পুরুষেরা পৃথিবীতে রাজত্ব করেন। এটা এক হাজার বছর আগের ঘটনা হলে মানা যেত। তখন মানুষ এমন এক জগতে বাস করত, যেখানে টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল গায়ের জোর। তাই দৈহিকভাবে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী, তিনিই নেতৃত্ব দিতেন। আর সাধারণভাবে পুরুষরা দৈহিকভাবে বেশি শক্তিশালী। (অবশ্যই এর অনেক ব্যতিক্রম রয়েছে।) আমাদের আজকের পৃথিবীর সঙ্গে সেই পৃথিবীর আকাশ-পাতাল ফারাক। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাটা এখন তার নয় যার গায়ের জোর সবচেয়ে বেশি। বরং যিনি বেশি বুদ্ধিমান, জ্ঞানী, উদ্ভাবনী শক্তি যাঁর প্রখর, যিনি সৃষ্টিশীল, তিনিই নেতৃত্ব দেওয়ার উপযোগী। আর এসব গুণের জন্য কোনো হরমোন নেই। নারী-পুরুষ উভয়েই সমান বুদ্ধিমান, উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন, সৃষ্টিশীল হতে পারেন। আমাদের বির্বতন ঘটেছে। কিন্তু লিঙ্গ নিয়ে আমাদের ধারণাগুলো খুব একটা বিবর্তিত হয়নি।
আসলেই তাই। সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশ হোক আর আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ হোক। আমরা স্বামী-স্ত্রী বাংলাদেশি সিভিল সার্ভিসে কর্মরত। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির এক আত্মিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করে কত টাকা বেতন পাই। উত্তরে বলি আমার স্বামীর সমপরিমাণই বেতন পাই। এটা শুনে সেই আত্মিয়া বিস্মিত হয়ে যায়। আমাদের চাকরির ব্যাপারটা তার জানা নেই এটা ঠিক। এটা তার অজ্ঞতা কিন্তু তার বিস্ময়ের কারণ অন্য জায়গায় নিহিত। একজন নারী একজন পুরুষের সমান আয় করছে- এটা মেনে নিতে তার কষ্ট হয়েছে। চিমামান্দাও এসব ছোট ছোট অভিজ্ঞতাগুলোকে সামনে এনেছেন। প্রতিদিনের যাপিত জীবনে যে সংকটগুলো তৈরি হয় সেগুলোই সমাজকে নারীকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পিছিয়ে রাখছে। এসব বিষয়ে তিনি ফোকাস করেছেন। অফিসগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা অন্য কারণে প্রশংসিত হন, কাজের দক্ষতার জন্য নয়। এটা আমেরিকান সমাজেও সত্য, আমাদের সমাজেও। অন্যের পছন্দের পাত্রী হওয়ার জন্য প্রতিটি নারীকে জন্ম থেকে শিক্ষা দেওয়া হয়। এটা তার ব্যক্তিত্ব বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার যোগ্যতা প্রমাণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ নারীর মেধাকে মুল্যায়ন করার কোনো আন্তর্তাগিদ অনুভব করে না। আমি উচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষ মানে পুরুষ মানুষকে বলতে শুনেছি নারীরা আড্ডা দিতে জানে না। অর্থাৎ তাদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ, তারা বিকশিত অর্থাৎ খোলামেলা নয়। এমন সিদ্ধান্তে সমাজ আসে কী করে? আমার মাথায় আসে না। নারীকে বিকশিত হওয়ার জন্য সমাজ কতটা প্রশস্ত পথ তৈরি করে দিয়েছে? এই বিচার করার কেউ নেই। নারীর চারপাশে ব্যারিকেড তৈরি করার জন্য সমাজ সবসময় প্রস্তুত। তারপর তার বিকাশ নিয়ে নেতিবাচক কথা বলে। উপরে থুতু ছিটালে সেটা যে গায়েই এসে পড়ে এটা সমাজ ভুলে যায়।
চিমামান্দা আমেরিকান কর্মজীবী নারীদের বেশ কয়েকটা প্রসঙ্গ টেনেছেন। দেখিয়েছেন স্পষ্টভাষী হওয়ার চেষ্টা না করে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হয়েও নারীরা সব অসম্মান মেনে নিয়েছে। চোখের পানি ফেলেছে কিন্তু সম্মান আদায়ের জন্য সোচ্চার হয়নি। কেননা তারা চাইনি সমাজ তাদের আক্রমণাত্মক ভাবুক। নারীর কথা বলাকে কখনোই ইতিবাচক ভাবে দেখা হয় না। সেটা নারী বা পুরুষ যার চোখেই হোক না কেন। নারীরাও এ ব্যাপারে পুরুষের মানসিকতা পোষণ করে। নারীদের পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও প্রত্যেক সমাজ নিজ নিজ মতামত উপস্থাপন করে র্নিদ্বিধায়। এক্ষেত্রে নারীটির মতামতকে খুব বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় না। চিমামান্দা প্রথমবার স্নাতকোত্তর স্কুলে লেখালেখির ক্লাসে পড়াতে যাওয়ার সময় চিন্তিত ছিলেন। কারণ, তাঁর কথা থেকেই শোনা যাক :
আমি দুশ্চিন্তা করছিলাম কী পরে ক্লাসে যাব, সেটা নিয়ে। আমি চাচ্ছিলাম আমাকে শিক্ষার্থীরা গুরুত্ব দিক।
আমি জানতাম যেহেতু আমি নারী সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমাকে আমার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমাকে দেখতে যদি খুব বেশি নারীসুলভ লাগে, তাহলে আমার কোনো গুরুত্ব থাকবে না। আমি খুব চাচ্ছিলাম আমার চকচকে লিপগ্লস আর মেয়েলি স্কার্ট পরতে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম সেগুলো পরব না। শেষ পর্যন্ত আমি পরেছিলাম খুব ভাবগম্ভীর, খুব পুরুষোচিত আর খুব কদর্য একটা সুট।
একটি দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বেশভূষার ক্ষেত্রে পুরুষদের আমরা প্রথমেই আদর্শ বা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিই। আমাদের মধ্যে অনেকে ভাবেন, কোনো নারী দেখতে যত কম নারীসুলভ, সে তত বেশি গুরুত্ব পাবে। ব্যবসায়িক কোনো মিটিংয়ে যাওয়ার আগে কোনো পুরুষ চিন্তা করেন না পোশাকের ওপর ভিত্তি করে তাঁর গুরুত্ব নির্ধারণ করা হবে কি না। কিন্তু একজন নারী সেটা নিয়ে ভাবেন।
নারী ভাবেন কেননা সমাজ তাকে ভাবতে বাধ্য করে। সবসময় কোনো না কোনো পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক সমাজেই নারীকে যেতে হয়। তার বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ সমাজকে খুব বেশি খুশি করে এমন ভাবার সুযোগ এখনও তৈরি হয়নি। অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়াকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। ‘আমি একজন নাইজেরীয় নারীকে চিনি, সে তার বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যাতে যে পুরুষটি তাকে বিয়ে করতে চাইবে, সে তাকে দেখে ভয় না পায়।’ চিমামান্দার দেখার ও পর্যবেক্ষণের শক্তি মুগ্ধ হওয়ার মতো। সমাজের ছোট ছোট অনুষঙ্গগুলো থেকে বৈষম্যের এক সর্বজনগ্রাহ্য রূপ তিনি তুলে ধরেন। সঙ্গে এটাও বলেন পুরুষের লালন-পালনেও সমাজ অমানবিকতা দেখায়। অযথা দায়িত্বের বোঝা আর কাঠিন্যের ভার তার ওপর তুলে দেয়। চিমামান্দার চিন্তার ক্ষেত্র বিস্তৃত এবং সূক্ষ্ম। এক উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি জীবনকে দেখেন। এই চিন্তাটা আমাদের জন্য খুবই কার্যকর। এভাবে ভাবতে পারলে পুরুষবিদ্বেষ নয় নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাটা অনেকটা সাবলীল হয়ে যাবে। তিনি সমাজের অন্ধ সংস্কারে আলো ফেলেছেন। বলেন :
আমরা মেয়েদের শেখাই নিজেকে সংকুচিত করতে, নিজেকে তুচ্ছ করে রাখতে। আমরা মেয়েদের বলি, ‘তোমার উচ্চাভিলাষ থাকতে পারে, কিন্তু খুব বেশি নয়। তোমার লক্ষ্য হওয়া উচিত সাফল্য কিন্তু অতি মাত্রায় সফল হওয়া যাবে না। কারণ, সেটা পুরুষের জন্য হুমকির ব্যাপার। যদি কোনো পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় তুমি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হও তবে ভান করো তুমি তা নও, বিশেষ করে জনসমক্ষে, না হলে তাকে পৌরুষহীন প্রমাণ করা হয়।’
চিমামান্দার মতো আমাদেরও প্রশ্ন একজন নারীর সাফল্য কেন একজন পুরুষকে ভীত করবে? এই জীবনযাপন কি তাহলে একটা রেইস? পুরুষতন্ত্র এমন করে ভাবছে নাকি মানুষেরা এভাবে ভেবে কোনো এক অজ্ঞাত, বীভৎস সুখ অনুভব করছে? আমাদের চিন্তার জট খোলার সময় এসেছে। নারী-পুরুষের বৈষম্য রোধে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির বদল। সময়কে নিয়ে ভাবতে হবে। এখন লড়াইটা বুদ্ধির আর মেধার। এর বিকাশ সমাজকে এগিয়ে নেবে। তাই সংস্কারমুক্ত হওয়াটা জরুরি। জরুরি আরেকটু উদার হওয়া।
পৃথিবীর সব জায়গায় লিঙ্গ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আজ আমি সবাইকে অনুরোধ করব ভিন্ন একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে এবং সেটা নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করতে। সেটা হবে আরও ন্যায়সংগত একটা পৃথিবী। এমন একটা পৃথিবী, যেখানে পুরুষেরা আরও সুখী হবে, নারীরাও হবে আরও সুখী আর দুপক্ষই নিজেদের কাছে বিশুদ্ধতর হবে। শুরুটা করব এভাবে :
আমরা আমাদের কন্যাদের ভিন্নভাবে বড় করব। আর অবশ্যই আমাদের পুত্রদেরও বড় করতে হবে ভিন্নভাবে।
চিমামান্দা এই চিন্তাটা সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এখানেই দেশের সীমানা অতিক্রম করে তিনি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন। তাঁর চিন্তা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সব জায়গার জন্যই প্রাসঙ্গিক। আমাদের সময় এসেছে আচরিত বিশ্বাস আর প্রথাকে নিয়ে ভাববার। সময়ের সাথে সাথে অনেককিছুর বদল ঘটে। নারীকেন্দ্রিক বিষয়গুলোরও বদল ঘটতে বাধ্য। সঙ্গে অবশ্যই পুরুষকেন্দ্রিক বিষয়গুলোতেও পরিবর্তন আনাটা জরুরি। আধুনিক সভ্যতাগর্বী মানুষরা যদি নিজেদের ব্যাপারগুলোকেই উল্টেপাল্টে না দেখতে শিখল তাহলে প্রযুক্তির আলো কতটা আলোকিত করতে পারবে? ব্যক্তিমানুষকে মনের অন্ধকার দূর করতে হবে তবেই না আধুনিক হওয়ার গৌরবে পুলকিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
চিমামান্দা তাঁর প্রিয়বন্ধু ইজাওয়েলেকে পনেরোটা পরামর্শ দেন। যেগুলো এক অর্থে নারীবাদী ঘোষণাপত্র। ইজাওয়েলে জানতে চেয়েছিল তার সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকন্যা চিজালাম অ্যাডাওরাকে কীভাবে নারীবাদী হিসেবে বড় করে তুলবে। বিষয়টি প্রতীকী। হয়তো সে জানতে চেয়েছিল একজন মানুষের জন্ম থেকে অর্থাৎ শুরু থেকে কেমন চিন্তাভাবনার সাথে বেড়ে ওঠা উচিত। এটা নারীবাদী ঘোষণা শুধু নয় বরং বলা যায় জীবন সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা এখানে রয়েছে। এগুলো হলো :
পরামর্শ ১ :
‘একজন পরিপূর্ণ মানুষ হও।’ এই বোধটা সবার মধ্যে থাকাটা জরুরি। এর প্রতিষ্ঠা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
পরামর্শ ২ :
‘কাজগুলো একসঙ্গে করো।’ কাজের বিভাজন মানুষ তৈরি করেছে। যা সম্পর্ককে জটিল করে ফেলেছে। জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গগুলোতে যদি বিভেদ সৃষ্টি না করা হয় অর্থাৎ শ্রেণিকরণ না করা হয় তাহলে সবকিছু সহজ ও সাবলীল হয়ে উঠবে।
পরামর্শ ৩ :
‘. . . লিঙ্গের ভূমিকা নিছক ছাইপাঁশ।’ মানবসন্তান জন্মের পর থেকে জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হয়। তাদের বেড়ে ওঠা, খেলনা নির্বাচন তথা খেলা করার প্রক্রিয়া এবং উপকরণেও ছেলে বা মেয়ে ব্যাপারটা কাজ করে। চিমামান্দা বলছেন :
লিঙ্গভূমিকা আমাদের ভেতর এত গভীরভাবে প্রোথিত যে আমাদের আন্তরিক বাসনা, আমাদের চাহিদা, আমাদের আনন্দ বিদীর্ণ হলেও আমরা সেগুলো মেনে চলি। এগুলো বিস্তৃত হওয়া খুব কঠিন, আর ঠিক সে জন্যই চিজালামকে এই ধারণাগুলো বর্জন করতে শেখানো অপরিহার্য। লিঙ্গভূমিকা আত্মস্থ করার পরিবর্তে ওকে আত্মনির্ভরশীলতা শেখাও।
বস্তুত, এই শিক্ষা সকলের জন্য অপরিহার্য। লিঙ্গকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বের হয়ে এসে ‘মানুষ’ নামক ধারণার চর্চা জরুরি।
পরামর্শ ৪ :
আমি যাকে ‘লঘু নারীবাদ’ বলি, সেটার বিপদ সর্ম্পকে সচেতন থেকো। এর ভিত্তি হলো শর্ত সাপেক্ষে মেয়েদের সমতা নিশ্চিত করা। এটাকে পুরোপুরি বর্জন করো। একটা ফাঁপা আর তেলবাজ আর দেউলিয়া ধারণা এটা। নারীবাদী হওয়া অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার মতো। হয় তুমি সেটা, নতুবা নও। হয় তুমি নারী-পুরুষের পূর্ণ সমতায় বিশ্বাসী নয়তো তুমি অবিশ্বাসী।
চিমামান্দার এই পরামর্শ একটু কঠোর শোনালেও এর বাস্তবভিত্তিও রয়েছে। মেনে নেওয়ার ধারণাটা কেবল মেয়েদের দেওয়া হয়। ফলে এই বৈষম্যটা শেকড় গেঁড়ে বসে। এবং সুবিধাভোগী পুরুষতন্ত্র একে পুঁজি করে নিজেদের রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আসলে এই পরামর্শের মধ্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। যা অবশ্যই প্রত্যেকটি মানুষের মৌলিক অধিকার।
পরামর্শ ৫ :
‘চিজালামকে পড়তে শেখাও। বই ভালোবাসতে শেখাও।’ বই মানে শিক্ষা যা মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে। দৃষ্টিকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বচ্ছ এবং সুদূরপ্রসারী করে।
পরামর্শ ৬ :
‘ওকে ভাষাকে প্রশ্ন করতে শেখাও। ভাষা আমাদের বৈষম্য, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের কুসংস্কারের আধার।’ যুগ যুগ ধরে চলে আসা আচরিত জীবনবোধ, প্রথা সবসময় ঠিক এমনটা ভাবার সুযোগ কম। আবার সবক্ষেত্রে নারীরা ঠিক এটা ঠিক নাও হতে পারে। চিমামান্দার উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষত্ব এখানেই। তিনি একটা নিরপেক্ষ জায়গা থেকে সবকিছু বিশ্লেষণ করতে অনুপ্রাণিত করেন।
পরামর্শ ৭ :
‘কখনো বিয়ে নিয়ে এমনভাবে কথা বলবে না যেন এটি একটি অর্জন।’ বিয়ের মতো সামাজিক চুক্তির আওতায় এসে মেয়েদের নিজেদের নামটাও হারিয়ে ফেলতে হয়। আমেরিকার ফাস্ট লেডি নিজের নামের ‘রডহ্যাম’ অংশটা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ তাঁর স্বামীর ভোটাররা এটা পছন্দ করছিল না। চিমামান্দা নিজেও বিয়ের পর পদবি পরিবর্তন না করায় ঝামেলায় পড়ে। এ বিষয়গুলো একটা প্রথার মতো। যা ভাঙার সময় এসেছে। পুরুষতন্ত্র তার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য এই ক্ষেত্রগুলো তৈরি করে রেখেছে। চিমামান্দা উপদেশ দিয়েছেন- বিয়ের পর নারী ও পুরুষ উভয়েই নতুন উপাধি গ্রহণ করুক। মন্দ হবে না ব্যাপারটা।
পরামর্শ ৮ :
‘ওকে অন্যের পছন্দ হওয়ার ধারণা বর্জন করতে শেখাও।’ আসলে আমাদের সমাজে এই ধারণাটা কেবল মেয়েদেরই শেখানো হয়। এতে মেয়েদের মানসিক বিকাশে অনেক বাধা পড়ে, আত্মসম্মানের প্রশ্নে সমঝোতা করতে হয়। ‘লোক’ তথা ‘সমাজ’ নামক একটা বির্মূত ধারণার কাছ নিজেকে বন্দি করে ফেলে কৃত্রিমতার সাথে জীবনযাপন করতে হয়। এটা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
পরামর্শ ৯ :
‘চিজালামের মধ্যে স্বকীয়তার একটা চেতনা তৈরি করো।’ স্বকীয়তা বলতে আত্মনির্ভশীল, মানবিক এবং নিজের প্রতি আস্থাবান এবং সহানুভুতিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার কথা বলা হয়েছে।
পরামর্শ ১০ :
‘তার সঙ্গে তার আত্মপ্রকাশ নিয়ে কীভাবে আলোচনা করবে, সেটা নিয়ে সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত নাও।’ শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার কথা বলা হয়েছে। খেলাধুলা থেকে সাজগোজ সববিষয়ে এক উদারনৈতিক মনোভাবের সাথে বেড়ে উঠলেই সামগ্রিক বিকাশ সম্ভব।
পরামর্শ ১১ :
‘আমাদের সংস্কৃতিতে সামাজিক নিয়মকানুন ব্যাখ্যা করতে জীববিজ্ঞানকে যে রকম নির্বাচিতভাবে ব্যবহার করা হয় তাকে সেটা প্রশ্ন করতে শেখাও।’ এখানে চিমামান্দা মানুষের তৈরি সামাজিক রীতির ন্যায্যতাকে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে না নিতে তথা এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শিখতে বলছেন। কেননা মানুষের তৈরি এসব রীতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাতেই পারে।
পরামর্শ ১২ :
‘তার সঙ্গে যৌনতা নিয়ে কথা বলো এবং তাড়াতাড়িই শুরু করো।’ এই শিক্ষাটা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই জরুরি। সাধারণত মেয়েদের এ ব্যাপারে অবদমন, গোপনীয়তা এসব শিক্ষা দেওয়া হয় এবং এটা মেয়েদের জন্য লজ্জার বিষয় এ ধরনের ভ্রান্ত শিক্ষাও প্রচলিত আছে। ভাবতে অবাক লাগে প্রথম বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্ব এমন সব ক্ষেত্রে চিন্তাগত দিক থেকে খুব একটা দূরে অবস্থান করে না।
পরামর্শ ১৩ :
‘প্রেম ঘটবে, কাজেই তৈরি থেকো।’ প্রেম ভালোবাসা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এগুলো ঘটবে কিন্তু এমন যেন না হয় ভালো স্বামী আকাঙ্ক্ষা করাটা মেয়েদের একমাত্র কাজ হয়। এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা প্রত্যেক নারীর জন্য জরুরি। অন্য একটি প্রসঙ্গে চিমামান্দা বলেন :
নারীবাদের একজন লঘু সমর্থক একবার আমাকে বলেছিল, আমাদের সমাজ আশা করে পুরুষেরা বিয়ের প্রস্তাব করবে। এটা প্রমাণ করে ক্ষমতা নারীদের হাতে। কারণ শুধু একজন নারী হ্যাঁ বললেই বিয়ে হতে পারে। সত্যটা হলো, যে প্রস্তাব করবে ক্ষমতাটা তার হাতে। হ্যাঁ বা না বলতে পারার আগে তোমাকে প্রস্তাব পেতে হবে। আমি সত্যি চিজালামের জন্য এমন একটি পৃথিবী কামনা করি, যেখানে যে কেউ প্রস্তাব করতে পারবে, যেখানে সম্পর্কগুলো এত আরামদায়ক, এত আনন্দপূর্ণ যে বিয়ে হবে কি হবে না, এটা আলোচনার বিষয় না হয়ে আলোচনার বিষয় হবে একটি আনন্দপূর্ণ যাত্রা।
পরামর্শ ১৪ :
ওকে শোষণ নিয়ে শেখানোর সময় শোষিতদের সন্ত না বানিয়ে ফেলার ব্যাপারে সচেতন থাকবে। সন্ত হওয়া মর্যাদা পাওয়ার পূর্বশর্ত নয়। . . . মাঝে মাঝে লিঙ্গ নিয়ে আলোচনার সময় সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে নারীরা পুরুষদের চেয়ে নৈতিকভাবে উন্নততর। তারা সেটা নয়। নারীরা পুরুষদের মতোই মানুষ। নারীর ভালো দিক নারীর মন্দ দিকের মতোই স্বাভাবিক।
চিমামান্দার চিন্তার বিশেষত্ব এখানেই যে তিনি তাঁর সিদ্ধান্তগুলো বিস্তৃত পরিসরে তুলে ধরেন। একটা নিরপেক্ষ জায়গা থেকে সমাজকে বীক্ষণ করার তাঁর প্রয়াসটি প্রশংসাযোগ্য।
পরামর্শ ১৫ :
‘ওকে বৈচিত্র নিয়ে শেখাও।’ কোনো এক সিদ্ধান্তে বা বিষয়ে অনড় থাকাটা জীবনের জন্য, সমাজের জন্য, প্রগতির জন্য বাধা। ভিন্ন ভিন্ন মতের মধ্য থেকে নিজ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজের পথচলাকে মসৃণ করার ব্যাপারটা সবার মধ্যে থাকা উচিত। এবং প্রত্যেকের নিজের জীবন স্বাধীনভাবে গড়ে তোলার অধিকার আছে।
আমরা শুরুতেই বলেছিলাম চিমামান্দার নারীবাদী ঘোষণাপত্র আসলে সামগ্রিক বিবেচনায় মানুষের জীবন কেমন হওয়া উচিত সেদিকটাকেই নির্দেশ করে। তিনি নারী-পুরুষ উভয়ের বেড়ে ওঠার একটা স্বাধীন, স্বতন্ত্র, মানবিক পরিবেশের কথা বলেছেন। শিশুকাল থেকে যদি মানবসন্তান উদারনৈতিক আবহে বেড়ে ওঠে তাহলে কূপণ্ডূকতা তাকে আর স্পর্শ করবে না। জীবন ব্যাপক, বিস্তৃত, সুন্দর। এর বাঁকে বাঁকে চমৎকারিত্ব এবং বিস্ময় অপেক্ষা করছে। মানুষ সৃষ্টির সবচেয়ে বুদ্ধীদীপ্ত প্রাণী। তাই জীবনের পথকে সহজ, সাবলীল এবং সুন্দর করার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। খণ্ডিত চিন্তা, সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস আর আচরিত প্রথার গৎবাঁধা করিডোর পেরিয়ে আসতে হবে তাকে। দৃষ্টিকে দিগন্তের মতো প্রসারিত করতে হবে। মানবতাকে আদর্শ করে জীবনের জন্য জীবনের পথে মনে আকাশের বিস্তৃতি নিয়ে হাঁটতে হবে। অপূর্ব আবেগময় আর অযুত সম্ভাবনার জীবনকে ভালোবাসতে পারাটাই মূল কথা।