
গুয়ান্তানামো : বিষণ্ন জীবনের আখ্যান
‘নন্দনতত্ত্ব আসলে সূক্ষ্ম ত্বকের মতো, যা বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করে। নন্দনতত্ত্ব এক অন্তিম উদাহরণ, মুক্তির উপায়, এমন এক গতিশীল যন্ত্র সৃষ্ট বস্তুসমূহ মানুষকে রক্ষা করে সেই সব শক্তির হাত থেকে যেগুলির ওপর তার আর নিয়ন্ত্রণ নেই।’ কথাগুলো ফ্রেডেরিকা ফ্রিডা ডেকার ব্র্যানডেইস-এর। তেরেজিন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয় এবং ১৯৪৪ সালের ৯ অক্টোবর মেরে ফেলা হয়। ফ্রিডাকে আউশভিৎস গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়। আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরিও এমনি এক বন্দি জীবনের কথা। যা আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দলিলে রূপান্তরিত হয়েছে। সে হিসেবে ফ্রিডা ডেকার বা পাভেল ফ্রিডম্যানদের গল্প কম লোকে জানে। ফ্রিডা মৃত্যুর আগে তার সহযোগী রায়াকে সাড়ে চার হাজার তেরেজিন ক্যাম্পের বন্দিদের আঁকা পেইন্টিং দিয়ে যায়। তিনি ক্যাম্পে বন্দিদের ছবি আঁকা শেখাতেন গোপনে। কারাগারের জীবন তথা স্মৃতিকথা, কবিতা আর সাক্ষাৎকার নিয়ে অনুবাদ গ্রন্থ লিখেছেন স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত। বইয়ের নাম গুয়ান্তানামো। পোয়েমস ফ্রম গুয়ান্তানামো, দ্য ডিটেনিজ স্পিক বইটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই কাজটি করেন তিনি। এখানে দুটি স্মৃতিকথা, দুটি সাক্ষাৎকার আর গুয়ান্তানামোর বন্দিদের লেখা ২৩টির মতো কবিতার অনুবাদ রয়েছে। আছে বিস্তৃত একটি ভূমিকা। অনুবাদক আজকের আমেরিকার গুয়ান্তানামোর সঙ্গে ভারতের একটা সম্পর্ক খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন। সেখানে ইন্ডিয়া নামে একটি ব্লক আছে যা খুব বেশি শাস্তির যোগ্য কয়েদিদের জন্য। এর কারণ অর্থাৎ নামকরণ-এর কারণ অনুবাদক খুঁজে পাননি।
আমরা সবসময় যুদ্ধের আবহের মধ্যে থাকি। জীবনের আরেকটি মানে লড়াই। কিন্তু লড়াইটা যখন অন্যের চাপিয়ে দেওয়া হয় তখন তা দুর্বিষহ ব্যাপারে পরিণত হয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস মানে তো যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস। দুদুটো বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা সয়ে এই পৃথিবী শ্বাস নেওয়ার আয়োজন করছে যখন তখন আর এক অনির্দেশ্য লড়াইয়ে মেরুকরণ হতে চলেছে অদৃশ্যভাবে। বলছিলাম ২০০১ সালে আমেরিকার টুইনটাওয়ার হামলার কথা। পৃথিবীর তথাকথিত আধুনিক এই ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটি এক ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় শুরু করে। বিশ্বাস করতে কষ্ট লাগে আধুনিকতা মানে আমরা যখন মানবতাবাদের কথা বুঝি তখন আমেরিকা সন্ত্রাসের নামে সভ্য সমাজ গুয়ান্তানামো বানায় এই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে। যেখানে অপহরণ করে আনা হয় শুধু সন্দেহের বশে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানদের। চালানো হয় বিচার বহির্ভূত অত্যাচার। শারীরিক আর মানসিক নির্যাতনে পঙ্গু করে দেওয়া হয় ছেলে বুড়ো সকল কয়েদিদের। অথচ এদের বেশির ভাগই জানে না নিজের অপরাধ বিষয়ে। মানুষ সব শোনে, দেখে কিন্তু ভাবে না। বন্দিরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বিনা বিচারে, বিনা অপরাধে আটকে থাকে গুয়ান্তানামোতে। এ যেন হিটলারের নব্য সংস্করণ, তার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আধুনিক সংস্করণ। আধুনিক কি বলা যায় আট বাই ছয় ফুট-এর ঘরকে যেখানে তিন পা-ও একসঙ্গে একজন মানুষের পক্ষে হাঁটা সম্ভব নয়। কোথায় মানবাধিকার? কোথায় জেনেভা কনভেনশন? সব ঢাকা পড়ে যায় ক্ষমতা আর পশুপ্রবৃত্তির কাছে।
সামি আলহাজ স্মৃতি কথা লেখেন ‘গুয়ান্তানামোর দিনগুলি’ নামে। সাংবাদিক সামি আল জাজিরায় কাজ করতেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যার পাঠ নিতে ভারতে পাঁচ বছর ছিলেন। সুদানের এই মানুষটিকে কান্দাহারে সাংবাদিকতার কাজে পাঠানো হয়। তালিবানদের দুরবস্থা নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। পাকিস্তান থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মনে করা হতো তিনি লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এসবের কিছুই জানতেন না। তাঁকে একসময় গুয়ান্তানামোয় আনা হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। তিনি বলেন :
নিদ্রাহীন করে রাখা মানসিক অত্যাচারের সবচেয়ে কার্যকর এক উপায়, একবার আমাকে পর-পর সাত দিন, ঘুমাতে দেওয়া হয়নি। তারপর একটা সময় এল, জিজ্ঞাসাবাদের একটি পর্ব চুকে গেল। একজন পুরুষ ও একজন মহিলা কারারক্ষী আমার সামনে যৌন সংগম করেছিল।
কী বীভৎসভাবে অত্যাচার চালানো হয় গুয়ান্তানামোতে! আমাদের ভাবতে অবাক লাগে- এসব ঘটনা আজকের দিনে ঘটছে। ৩৪৫ নম্বর এই কয়েদি সামি আলহাজ অনশন করে দীর্ঘসময়। পরে সে এপ্রিল, ২০০৮-এ ছাড়া পায়।
আরেকটি স্মৃতিকথা আছে ডায়েরি : গুয়ান্তানামো নামে মহম্মদ এল গোরানির লেখা। চাড বংশোদ্ভূত এই গোরানি পাকিস্তানে গিয়েছিল ইংরেজি আর কম্পিউটার শিখতে। কিন্তু ৯/১১-এর পর তাকে আটক করা হায়। তার বয়স অনেক কম ছিল। তাকে শেখানো হয় আমেরিকার লোকজনের জিজ্ঞাসাবাদে যেন বলে সে আল কায়দার লোক- এদের সঙ্গে আফগনিস্তানে এসেছে। মিথ্যা না বলার জন্য তাকে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। সে লাদেনের নামই জানতো না অথচ তাকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। মহম্মদ বলে :
আমেরিকার অসংখ্য সিনেমা দেখেছি, সেখানে কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে সে সবসময় বলত, ‘আমার অধিকার আছে একজন আইনজীবীর সাহায্য নেওয়ার।’ কর্তৃপক্ষের লোকটি হেসে উঠেছিল, ‘না, গুয়ান্তানামোতে তা হয় না, তোমার এখানে তেমন কোন অধিকার নেই।’
এসব দেখেও বিশ্ববিবেক চুপ করে থাকে কেন? মানুষের পৃথিবীতে এ কেমন অবিচার? গুয়ান্তানামোর বন্দিদের কথা পড়তে গিয়ে এমন প্রশ্নে আর আক্ষেপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। বিচারের বাণী এখানে নীরব নিভৃতে কাঁদে। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে কারারুদ্ধ হয় মহামদ এল গোরানি। দীর্ঘ সাত বছর কারাভোগের পর ২০০৯ সালে মুক্তি পায়। এই অনুবাদ গ্রন্থ লেখার সময় অবশ্য গুয়ান্তানামায় অ্যারেস্টকৃত ৭৮০ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে কোনো দোষ খুঁজে না পাওয়ায় মুক্তি দেওযা হয়। তবে এর মধ্যে কয়েকজন আত্মহত্যা করে।
এই গ্রন্থে দুটি সাক্ষাৎকার আছে। ‘সারা বিশ্বের কাছে গুয়ান্তানামো অবিচারের চূড়ান্ত প্রতীক’ শিরোনামের এই সাক্ষাৎকারটি মোয়াজ্জেম বেগ-এর। তিনি ব্রিটিশ নাগরিক। তাকে পাকিস্তান থেকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি অবশ্য গ্রেফতার না বলে এটাকে অপহরণ বলতে চায়। ২০০৫ সালে মুক্তি পেয়ে সে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘কেইজ প্রিজনার্স’ গড়ে তোলে। যা ‘কেইজ’ নামে সমধিক পরিচিত। এখান থেকে গুয়ান্তানামোয় আটক বন্দিদের ওপর সকল অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করা হয়। মোয়াজ্জেম বেগ বলে এখানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এসে আত্মহত্যার পদ্ধতি বাতলে দিত। তার দেখানো পথে চারজন মারা গিয়েছিল। কী সাংঘাতিক! মানব ইতিহাসে এমন কলঙ্কজনক কাজ আধুনিক যুগে ভাবাই যায় না। কিন্তু আমরা যা ভাবি বা ভাবতে পারি তার চেয়ে বাস্তবতা অনেক কঠিন, করুণ’ বীভৎস। গুয়ান্তানামো তা প্রমাণ করেছে। যুগে যুগে কালে এমন পশুশক্তির উদ্ভাসন ঘটেছে এই পৃথিবীর আলো-হাওয়ায়। বিবিসিকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে মোয়াজ্জেম বেগ বলে তিন বছর নির্জন কারাবাসের পর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে কিংবা পথ চলতে কতটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অনেকে কাজ খুঁজে পেত না। এই কারাবাসের কারণে কেউ কাজ দিতে চাইত না। মানসিক সংকটের মধ্যে পড়ে অনেকে তীব্র বেদনাময় জীবন কাটিয়েছে ছাড়া পাওয়ার পরও। গুয়ান্তানামো নিয়ে তার ভাবনা ফুটে ওঠে এভাবে :
গুয়ান্তানামো, আমি আগেও বলেছি, পৃথিবীর মধ্যে জঘন্যতম কারাগার না-হলেও, একটি চিহ্নিত কারাগার। আমি এটা বলব যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকেই এর জন্য একমাত্র দায়ী করা যেতে পারে। যখন তারা এটা করে এবং ধারাবাহিকভাবে করে যায়, তারা ভালো ভাবে জানে যে তারা কী করছে, সুতরাং এটা আর পরিবর্তিত হওয়ার নয়। গুয়ান্তানামো উপসাগর অবিচারের চূড়ান্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে সারা বিশ্বের কাছে, শুধু মুসলমানদের কাছেই নয়, বিশ্বজুড়ে সকল মানুষের কাছে। এক বিশেষ শব্দবন্ধ পশ্চিমের সর্বত্র ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদেরা টেলিভিশনে আসেন এবং বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে আমরা ব্রিটেনের ‘গুয়ান্তানামো-করণ’ চাই না। সুতরাং এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে অবিচারের এক প্রতীক।
আরেকটি সাক্ষাৎকার দেয় মোয়াত আল আলবি। এর শিরোনাম ‘আমরা জীবন ভালোবাসি, মানুষ এবং যাবতীয় স-ব কিছু ভালোবাসি।’ এই ব্যক্তি বন্দিজীবনের অত্যাচার থেকে বাঁচতে শিল্পের আশ্রয় নেন। তিনি যৎসামান্য জিনিস দিয়ে বিভিন্ন শিল্প-সামগ্রী বানাতেন। তিনি একটি জাহাজের মডেল বানান। তিনি মানুষদের তাঁদের সম্পর্কে নেতিবাচক না ভাবতে অনুরোধ করেন। বলেন :
আমি চাই সকলে এটা ভাবুন যে আমরা কোন নেতিবাচক মানুষ নই, আমাদের চিন্তাবাবনাও নেতিবাচক নয়। আমরা সুন্দর কিছু জিনিস বানাচ্ছি। আমরা জীবন ভালোবাসি, মানুষ এবং যাবতীয় সব কিছু ভালোবাসি। আমরা চরমপন্থী নই। যে-কোন সুন্দর জিনিসের প্রতি আমাদের কোন ঘৃণা নেই। আমি চাই সকল মানুষ এই ভাবে ভাবুন আমাদের সম্পর্কে।
কারাগার থেকে মুক্তির অর্থাৎ মানসিক মুক্তির জন্য মোয়াত আল আলবি শিল্পের সৌন্দর্যময় রাজ্যে নিজেকে অবগাহন করাতেন। কৌশলটা বেশ। কিন্তু একজন নিরপরাধ মানুষকে কেন বেঁচে থারার জন্য এভাবে প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে বা হয়? এমন প্রশ্ন মনকে বিষণ্ন করে। তাদের সমাজ, পরিবার, পারিপার্শ্বিকতা থেকে একটা ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই। জীবনের গল্পটাকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলা হয়েছে। শক্তিধর যারা তারাই সবকিছুর নিয়ামক। তাহলে আমরা কোন সময়ে বাস করছি? পেশী শক্তির দাপটের বিষয়টা প্রাচীনকালের। এত শিক্ষা, অর্জন এসব দিয়ে কী নির্মাণ হয়েছে? সভ্যতা কি এগিয়েছে না পিছিয়েছে? গুয়ান্তানামো পড়তে গিয়ে বারবার এমনসব প্রশ্নের মুখোমুখি হবে পাঠক। এই বইটি বা এর চরিত্ররা মানুষের মনের সেই কোমল স্তরে আঁচড় কেটে ফেলতে সক্ষম যেখানে বেদনার জন্ম হয়। এক অদ্ভুত বিষাদে মন ভরে ওঠে!
গুয়ান্তানামো-গ্রন্থে যে কবিতাগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে সেগুলো পাঠেও এক ধরনে নিঃসাড় অনুভবের জন্ম হয়। কোথাও যেন তার ছিঁড়ে গেছে, সবকিছু এলোমেলো লাগে। এই মানুষগুলো মানে বন্দিরা কাপে কবিতা লিখত যেগুলো পরে সরিয়ে নেওয়া হতো। ওদের কাগজ-কলম দেওয়া হয় কিন্তু কবিতার মধ্যে ‘কোডেড মেসেজ’ আছে এমন ভয়ে বেশিরভাগ কবিতায় সরিয়ে ফেলা হতো- এসব তথ্য অনুবাদক আমাদের দেন। ‘কারাগারে লেখা কবিতা’ শিরোনামের অংশে মোট ১৬ জনের বেশকিছু কবিতা রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই এখানে এসে কবিতা লেখায় হাত দেন। বেশিরভাগ কবিতায় বন্দিজীবনের অত্যাচার আর এর থেকে মুক্তির প্রার্থনার কথা রয়েছে। রয়েছে এক আকাশসমান অসহায়তার কথা। তারপরেও কেউ কেউ আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে মনের গহিনে। কোনো কবিতায় খুব সাদামাটাভাবে নিজেদের কথা বলা হয়েছে। যেমন:
বছরের পর বছর, আমাদের কারাগারে বন্দি রেখেছে, অভিযোগহীন,
কারণ আমরা মুসলমান
পৃথিবীর সবাই কোথায় অত্যাচারের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার জন্য?
দুঃখ ও দাহ থেকে রক্ষা করার জন্য কোথায় সবাই?
কোথায় দুনিয়া এই অনশনকারীদের রক্ষা করার জন্য?
অথচ আমরা তৃপ্ত, সুবিচার ও অধিকারের জমির ওপরে,
সর্বশক্তিমানের পূজা করে চলেছি।
এই দ্বীপভূমির ওপর আমাদের সংক্ষিপ্ত নীতিকথাটি হল, সালাম।
(আদনান ফারহান আব্দুল লতিফ : ‘অনশনের কবিতা’)
কিংবা-
আব্বা, এটি এক অন্যায়ের কারাগার।
এখানের পাপাচার পাহাড়ের চোখে জল আনে।
আমি কোন অপরাধ করিনি, কোন অপরাধের জন্য দোষীও নই
আমার তীক্ষ্ণ নখগুলি আছে,
তবুও এক মোটাসোটা বেড়ার মতো বিক্রি হয়ে গেলাম
(আব্দুল্লা থানি ফারিস আল আনাজি : ‘আমার আব্বুকে’)
ক্ষোভ, হতাশা ঝরে পড়েছে এসব কবিদের লেখায়। জীবনের গল্প যাদের হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে বসেছে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কেবল আঁধারকেই দেখায় তারাও বেঁচে থাকার অতীব আগ্রহে কিছুকে আঁকড়ে ধরে। নিজেদের জীবনের কঠিন মুহূর্তকে ভুলে থাকার চেষ্টায় নিজেকে ব্যাপৃত করে লেখালেখির জগতে। কিন্তু সেখানেও বিধি-নিষেধের বেড়া তাদের অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে থাকে। তখন তারা সর্বশক্তিমান স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ করে। অনেক কবিতায় তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গাটা লক্ষ করা যায়। যেমন :
তাকাও, মহাবিশ্বের মুখখানি অন্ধকারাচ্ছন্ন,
যেন আলোগুলি পর্দা দিয়ে ঢেকে আছে।
‘সহনশীল এবং উদ্যমী হও,’ আল্লা এমনই বলেছেন
সহনশীলতা থেকে গতিশীল নদীর জন্ম হয়।
আল্লার দোহাই, সহনশীল এবং উদ্যমী হয়ে ওঠো।
ন্যায় পরায়ণদের জন্য ঈশ্বরের আশ্বাসবাক্যের অপেক্ষা করো।
(এমাদ আবদুল্লা হাসান : ‘সত্যবাদিতা’)
অসহায় মনুষের আর্তনাদে বিষণ্ন এসব কবিতা। কাপে লেখা একটা কবিতা এমন :
এ কেমন বসন্ত,
কোন ফুল ফুটে নেই,
বাতাস এক নিঃস্বতার গন্ধে ভরে আছে?
(শেখ আব্দুর রহিম মুসলিম দোস্ত)
হতাশা আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ঝরে পড়ে প্রেয়সীর জন্য। জীবনের আলুলায়িত ক্ষণে প্রিয় নারীকে নিয়ে ভাবে বন্দি তৌফিক বিহানি এভাবে :
প্রিয়া আমার, ভুলে যাও সকল অতীত
হাঁটবে বলে এগিয়ে যাও
একটি নতুন রাস্তায়, অন্য একটি রাস্তায়
পিছনে তাকাবে না, গতকালের দিকে উদ্বিগ্ন হবে না আমার কথা ভেবে।
কাকে ফেলে যাচ্ছ তুমি, ভাবার দরকার নেই
তোমার যেখানে ইচ্ছে চলে যাও
পিছনে তাকিওনা।
(তৌফিক বিহানি : ‘প্রেয়সী আমার’)
এখানে গুয়ান্তানামোর বন্দিদের আঁকা বেশকিছু ছবি সন্নিবেশিত হয়েছে। মহম্মদ আনসি, খালিদ কাশিম, আহমেদ রব্বানিসহ কয়েকজনের আঁকা ছবি জায়গা পেয়েছে। ছবিগুলোতে বন্দিত্ব ও দ্রোহ চেতনার প্রকাশ স্পষ্ট।
এই অনুবাদ গ্রন্থের শুরুতে শুভেন্দু দাশগুপ্তের ‘ভূমিকার মতন’ অংশে অনক বিষয় এসেছে। তিনিও কারাবন্দিদের লেখা নিয়ে সম্পাদনা গ্রন্থ রচনা করেন। অনুবাদক স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্তও তাঁর গুয়ান্তানামো গ্রন্থের ভূমিকায় অনেক তথ্য দেন আমাদের। তাঁর লেখার প্রেরণা, কারাগারের সাহিত্য কিংবা ফ্রিডা বা পাভেল ফ্রিডম্যানদের কাহিনি। এগুলো আমাদের নতুন করে নতুন কিছু নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। জীবনের অনেক অনভিপ্রেত দিককে মেনে নেওয়ার সাহস যোগায়। তাঁর অনুবাদের ভাষা সহজ, সরল, প্রাঞ্জল। তাঁর নির্মেদ গদ্য আমাদের সুখকর পাঠের অনুভবে জড়িয়ে রাখে। তাঁর ভাষার মধ্যে একটা খরস্রোতা নদীর তীক্ষèতা আছে, আছে সকাল বেলার স্নিগ্ধতা কিংবা শীতের দুপুরের নরম, কোমল রোদের সতেজতা। এই অনাড়ম্বর আয়োজনটি পাঠককে মুগ্ধ না করে পারে না। কিন্তু মুগ্ধভার সঙ্গে আরেকটি বিষয় পাঠককে মোটিভেট করে। সেটি হলো এর মধ্যে বহমান এক চাপা দীর্ঘশ্বাস, বিষণ্নতার এক আবহ, বিষাদের এক গীতি। মানুষের পৃথিবীতে মানুষের তথা মানবতার এই চরম বিপর্যয় আমাদের অনুভবের স্তরে ধক্কা দেয়। কোথাও যেন ভাঙ্গনের সুর ধ্বনিত হয়। একটা দম বন্ধ করা অনুভূতি চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। মন থেকে কিছুতেই এই অসহায় মানুষগুলোকে সরানো যায় না। ভোলা যায় না তাদের এমন মর্মন্তুদ পরিবেশে বেঁচে থাকার গল্পকে । কীভাবে জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি সমগ্র পৃথিবী থেকে অপহরণ করে ঐ আট বাই ছয় ফুটের জানালাহীন ঘরে বছরের পর বছর বিনা অপরাধে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয় তাদের- ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। এবং অবাক লাগে এটা ভেবে আরও যে ঘটনাটা এই একুশ শতকে পৃথিবীর তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রের দ্বারা ঘটছে। অথচ বিশ্ববিবেক নিশ্চুপ। মানুষ হয়ে মানুষের অপমানের দ্রষ্টা আমরা সকলে।
এক সন্ত্রাসী হামলা কীভাবে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে তা দেখেছে বিশ্ব। কিন্ত তার ফলে ক্রমান্বয়ে কিছু নিরপরাধ মানুষের ওপরে বৈরিতার আচরণ এটাও- তো ঠিক নয়। হিংসা দিয়ে কখনো কি হিংসার মুলোৎপাটন সম্ভব? একথা আমি আপনি বুঝলেও যাদের বোঝার তারা বোঝে না। নাকি বুঝতে চায় না? গভীরে আরও কোনো সত্য লুকিয়ে নেই তো? খুব সাদা চোখে, সরল বিশ্বাসে যা আমরা দেখছি না বা ভাবছি না এমন কিছু নেই তো? কোথাও সন্ত্রাস দমনের নামে সন্ত্রাসের চাষাবাদ হচ্ছে না তো? মুখোশের আড়ালে যে গল্প থাকে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে বেশিরভাগ মানুষ চায় না। কেননা জীবনের জটিলতায় মানুষ এত বিপন্ন আর কাতর যে খুব সূক্ষ্মভাবে কারও গভীর বিনাশী পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে চায় না। আমরা এমন বহুবিধ আভাসে কেমন এলোমেলো হয়ে যাই, মাথার মধ্যে সবটা তালগোল পাকিয়ে যায়। স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত তাঁর গুয়ান্তানামো-তে এমন অনেক জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছেন পাঠকের মনে। এখানেই তাঁর সার্থকতা। আর শেষ পর্যন্ত গুয়ান্তানামো হয়ে দাঁড়িয়েছে মানব সভ্যতার চরম অপমানের গল্প। মানবতাবাদের প্রতি অন্যায়ের এক বিষাদময় জীবনের আখ্যান।
গুয়ান্তানামো বইটি প্রকাশ করেছে : বইপত্তর (কলকাতা)