
গালিব কিংবা আসাদ ॥ পর্ব ৭
সুরাপাত্রের গায়ে নানাবর্ণের চিত্র ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাও তুমি;
বিস্ময়ে উদভ্রান্ত চোখের দর্পণে আমি তা ধরে রাখি।
নওয়াব জানের কাছ থেকে প্রচুর শরাব খেয়েছি। সরাইখানা থেকে বেরিয়ে আর বাড়িতে ফিরতে পারিনি। সিঁড়ির পাশেই লেপটে পড়ি। কে যেন একসময় আমাকে অন্ধকার থেকে টেনে তোলে। দেখি শুধু দুটি চোখ, সুরমারেখা আর চিকন ভুরু।
“জনাব।” শীতের রাতের হাওয়ার মতো এক কণ্ঠস্বর আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি শুধু চোখদুটির দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই চোখের ভেতর কত যে পাখি উড়ছে, যেন শিল্পী তুলিতে আঁকা বেহেস্ত।
“জনাব।”
“কে তুমি?”
“বাড়িতে নিয়ে যাব?”
“বাড়ি?” হেসে উঠি।
সে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “ঠিকানা দিন। আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“কেন?”
“আপনি এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকবেন, জনাব?”
তার হাত চেপে ধরি। কী উত্তাপ! তার হাতে মুখ রাখি। তার হাতের মাংস চুষতে থাকি। গভীর কৃষ্ণবর্ণের সে। সে এত কৃষবর্ণের বলেই হয়তো অন্ধকারে তাকে উজ্জ্বল দেখায়। তার মধ্যে আমি নওয়াব জানকে খুঁজতে থাকি। তাকে বুকে আঁকড়ে ধরতে না পারলে স্বস্তি নেই। এই প্রথম একজন নারীর শরীরের ভেজা মাটির গন্ধ পাই। বৃষ্টির পর গাছের গোড়া থেকে যেমন গন্ধ বেরোয় ঠিক সেইরকম। ভেজা পৃথিবীর আদিম গন্ধ। এই গন্ধেই মাতোয়ারা হয়ে যাই। সে সামান্যই এক দেবদাসী। তারই ঘরেই আমার আশ্রয় হয়। কৃষ্ণবর্ণ মুনিরার মুখ লাল হয়ে ওঠে।
“মুনিরা।”
“হ্যাঁ।”
“আমাকে তুমি কোথায় পেলে?”
মুনিরা হেসে বলে, “রাস্তায়।”
“রাস্তায়?”
“হ্যাঁ।”
“কোথায় সেই রাস্তা?”
মুনিরা হাসে। নিজের বুকে হাত রেখে বলে, “সরাইখানার পাশে, জনাব।”
সরাইখানা- এভাবে তো কখনো কেউ আমাকে বলেনি। শুধু মুনিরাই বলতে পারল। দেনাপাওনার সম্পর্ক না থাকলেও তাকে বুকের ভেতর টেনে নিই। সজল, কালো একখণ্ড মেঘ যেন জড়িয়ে আছি। নওয়াব জান ছিল আমার জীবনের একটি রৌদ্র, আর মুনিরা ঘনঘোর বর্ষা, একটানা বৃষ্টি পড়েই চলে। কত যে নতুন পাতা গজায় আমার শরীরে। একসময় শুধু তার দুটি চোখই দেখতে পাই। হরিণীর মতো দুরন্ত, কিন্তু স্থির সেই চোখদুটি। স্থির হয়ে যেত। হরিণী যেন দৌড়তে দৌড়তে থমকে দাঁড়ায়। চারপাশে ছিঃ ছিঃ পড়ে যায়। তুমি মির্জা গালিব। সরাইখানায় তুমি যেতে পার। মাহফিলে রাতও কাটাতে পার। কিন্তু একজন দেবদাসীর ঘরে তুমি কেন থাকবে? নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাচ্ছ তুমি? আমাকে নিয়ে যতই নোংরা কথার ফোয়ারা উঠুক, আমি পাত্তা দিইনি।
পূর্বপুরুষদের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইনি ঠিকই, কিন্তু আমার জীবনটা তো একটা যুদ্ধক্ষেত্রই। এখানে লড়াই আমাকে একাই লড়তে হয়। গুলি মারো লোকের কথার। বিছানায় মুনিরাকে পেলে তো আমি সব অপমান ভুলে যাই। মুনিরা ভুলিয়ে দেয়। আমিও ওকে আঁকড়ে রাখি। সন্ধ্যার পর আর কেউ থাকে না, তখন মুনিরাকে নিজের মতো করে পেতে চাই।
কিন্তু একদিন মুনিরার বাড়িতে কিছু লোক হামলা চালাল, ওকে মারধোর করল, জিনিসপত্র ভাঙচুর করল। কেন জানেন? আমাকে যেন ওর ঘরে আর থাকতে না দেয়। তবু আমি গেলাম না। মুনিরা আমার দুহাত চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলে, জনাব আপনি চলে যান।
“কী করবে? ওরা আমাকেও মারবে?”
“আপনার বদনাম হোক, আমি আর চাই না।”
“তুমিও চাও না, আমি আর এখানে থাকি?”
সে আমার মুখ তার বুকের নিরালায় টেনে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, “আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, আপনি আমার জান, জনাব।”
একদিন সন্ধ্যায় মুনিরার ঘরে বোতল খুলে বসেছি, সে কাছে এসে আমার হাত চেপে ধরল। বলল, এসব খাবেন না জনাব।
“কেন?”
“আপনার শরীরের ক্ষতি হবে।”
“না খেলে আমি লিখতেই পারি না।”
“লেখার জন্য শরাব খেতে হয় বুঝি?”
“তা নয়।”
“তবে ছেড়ে দিন।”
“ঠিক আছে। আজকের দিনটা তো খেতে দাও।”
“না, আর একদিনও নয়।”
“আজ খুব আনন্দের দিন মুনিরা।”
“কেন?”
“তোমাকে প্রথম কাছে পাওয়ার এক সপ্তাহ হলো।”
“তাহলে শরাব লাগবে কেন?”
“লাগবে, লাগবে।” আমি তার কোমর জড়িয়ে বলি, “না হলে বিছানায় তুমি আসল গালিবকে কী করে পাবে?”
মুনিরাকে ছাড়া আমি ও তো বেঁচে থাকার কথা ভাবতে পারি না। পতঙ্গ যেমন আগুনের দিকে উড়ে যায়, আমিও সেভাবেই মুনিরার কাছে এগিয়ে যাই। ওই সৌন্দর্যকে বাদ দিয়ে তো আমার জীবন অসম্পূর্ণ। আমার মনের ভাবটা এমন যে, ওকে কেউ আমার কাছ থেকে চুরি করে নিতে পারবে না। ওকে নিয়ে বাগানেও বেড়াতে যাই না আমি, মনে হয়, প্রতিবেশীও ওকে দেখলে নিজের রূপ ভুলে ওর কাছেই ছুটে আসবে। মুনিরার গভীরে আমি যত প্রবেশ করি ততই মনে হয়, ওকে সম্পূর্ণ করে পাইনি। মনে হয়, ওর সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলন আমার ভাগ্যে নেই। অপেক্ষায়ই কাটিয়ে দিতে হবে সারাটি জীবন। জীবনে একবার ভালোবাসতে পেরেছি আমি। কবিদের মধ্যে ফিরদৌসি, পিরদের মধ্যে হাসান বাসরি আর প্রেমিকদের মধ্যে মজনু- জগতের তিন ফুল। মজনুর মতো ভালোবাসতে না পারলে তাকে আমি মহব্বত বলি না। আমি ভেবেছি, কিন্তু মজনুর মতো ভালোবাসতে পারিনি। সে বড়ো কঠিন পথ। নিজেকে ভুলে যাওয়ার সাধনা কজন করতে পারে? আমিও পারিনি। তাই চলে এলাম নিজের বাড়িতে।
প্রথমে খুবই অভিমান হয়, মুনিরার কাছে যাওয়া আসা কমিয়ে দেই। আস্তে আস্তে একদিন অভিমানর মুছে গেল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে সেও মুছে যেতে থাকল। মোঘল রক্ত বড় নিষ্ঠুর, আমার শরীরেও তো সেই রক্ত ছিল। এই রক্ত যাকে ভালোবাসে, তাকেই হত্যা করে। মুনিরাকে আমিই হত্যা করেছি। ওকে ভুলে আমি তো আবার জীবনের নতুন পথে মেতে যাই। কিন্তু মুনিরা তো নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল আমার ভেতর, তার সামনে তো নতুন কোনো পথ খুলে যায়নি। অথবা একবার যাকে ভালবাসে, সেই ভালবাসার পিঞ্জর থেকে বেরিরয়ে আসতে পারে না, শুকিয়ে মরে গেলেও সেই খাঁচাতেই নিজেকে আটকে রাখে। একসময় ভাবি, ওর জগৎটা বড্ড ছোটো। কাউকে ভালবেসে সে ধরে রাখতে পারে না। সে তো আসলে এক সাধনার পথ। নিজেকে হারিয়ে অন্যের কাছে বিলীন হওয়ার সাধনা। পুরুষকে এই সাধনার জীবন প্রকৃতি দেয়নি। আমরা পতঙ্গের মতো, আর নারী দীপশিখার মতো, নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আলোর জন্ম দেয়। একদিন খবর পেলাম মুনিরা চলে গেছে। মলিন দিনগুলো আরও মলিনতনর হলো। সে ছিল আমার জীবনাকাশে একটা নক্ষত্র, সেই নক্ষত্র চলে যাওয়ায় আমার আঙিনার আলোও নিভে গেল। এখন আমার জন্য অপ্রেমের পথ।
হৃদয় আবার অশান্ত
সে খুঁজছে এক আততায়ীকে।
নওয়াব জানের বাড়ি যাওয়া হয়নি কিছুদিন। আজ একটি নতুন শাল নিয়ে তার বাড়ির সিঁড়ি ভাঙতে থাকি। দরজায় কয়েকবার কড়া নেড়েও কোনো উত্তর এলো না। অবশেষে হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটি খুলে গেল। ঘরের ভেতর পা রাখতেই বোঝা গেল, বাড়িটি নগ্ন করে ফেলা হয়েছে। একেবারে সাজসজ্জাহীন। কয়েকটি কেদারা ছড়ানোছিটানো। আয়নার ওপর আমারই কবিতার দুটি পুঙ্ক্তি লেখা, “তোমার কাছ থেকে সে চলে গেছে আসাদ, মিলন না হলেও অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাই থাকুক।” আমি নিঃশব্দে নিচে নেমে আসি। মীর তকিরের বইয়ের দোকানে এসে উপস্থিত হই। তাকে জিজ্ঞেস করি, “নওয়াব জান কোথায়?”
“তুমি এই কয়েকদিন কোথায় ছিলে? একটিবারের জন্যও আমার দোকানে এলে না।”
“সেকথা পড়ে হবে। এখন বলো নওয়াব জান কি বাড়ি পাল্টিয়েছে?”
“প্রেমের ঝড়ে সে নিত্যদিনের কাজকর্মে অবহেলা করছিল। তাই তার মালিক তার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। নওয়াব জান তার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলে মালিক তার ওপর প্রতিশোধ নেয়।”
“প্রতিশোধ!” আমার কণ্ঠে অধৈর্য ফুটে ওঠে। “তুমি চুপ করে আছ কেন?”
মীর তকির আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে, “পৌরুষ এক ভয়ংকর জিনিস, ভাইজানেরা সে যখন জেগে ওঠে। এই দুনিয়াটাকেই ভেঙে চুরে ফেলতে চায়। কেন? কেন? পৌরুষ একটা কাচের পুতুল, আছাড় মারলেই ভেঙে যায়। তাই সামান্য আঘাতেই সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মালিকের পৌরুষে আঘাত পরতেই নওয়াব জানকে সে খুন করে। খুন। খুনের কিছুক্ষণ আগেও নওয়াব জান তোমাকে স্মরণ করতে এখানে এসেছিল। অপূর্ণ ভালোবাসা তার শূন্যতাকে আরও গভীর করেছিল। সে তো জানেনি, ইশকের কাছেই একদিন ঘুমোতে যেতে হবে তাকে।”
নওয়াব জান, কার কাছে আমি আর বেদনার কথা বলব, আমার মৃত্যু যদি একবার হতো তাহলে এতো সমস্যা ছিল না। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দেই তো মরে গিয়েছিল আসাদ কিংবা গালিব, কিন্তু এখন…। ইতিহাসের পৃষ্ঠার ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি, যদিও জানি, পৃথিবী একটুকরো কাগজের মতো, একফোটা বৃষ্টিতে দ্রবীভূত হয়।”
সন্ধ্যা গভীরের দিকে এগিয়ে চলে। অনেক আগেই পাখিরা নিজের আলয়ে ফিরে এসেছে।
তখন বিলাতি মানুষ ব্যস্ততায় আত্মনিমগ্ন।
তখন বিলাতি বাতাস অনতিপ্রসন্ন।
তখন বিলাতি শৃঙ্খলা অনবচ্ছিন্ন।
কিন্তু নওয়াব জান… সেও মানুষ? আসলে কিরকম মানুষ? এই প্রশ্নটি অবান্তর হলেও এটিই জীবনজিজ্ঞাসার মূলকথা। তাই তো একবার বলেছিলাম, “হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে মুছে ফেলতে চাও কেন? আমি এমন এক অক্ষর, যা জীবনকাব্যে লেখা যায় না।”
বাহ কী চমৎকার কথা! মির্জা গালিব ছাড়া কারও পক্ষে এমন কথা লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু এমন ভাবনা কেন আমার মনে আসে? এর কি কোনো সূত্র রয়েছে? নাকি একান্তই আমার ভাবনা? যদিও জানি, দিল্লিবাসের শেষজীবনে ঋণের বোঝা কিংবা আজ বিলাতে একটি মেয়ের খুন হওয়ার ঘটনাটি- সবকিছুকেই অর্থহীন করে দেয় আমার কাছে। তবুও মৃত্যু ও ঈশ্বরের কথাই বারবার ব্যক্ত করি। একটি কথা অবশ্যি অনাস্বীকার্য যে, সমগ্র দেশকালই আমার কাছে ঋণী; আমার কাব্য কূপে কিংবা নদীতে আবদ্ধ নয়, মহাসমুদ্রই তার সংগমস্থল। গালিবকাব্যে যমুনাও মোহাবিষ্ট। যুমনার কালোজলের তালে তালে ও তাজমহলের ছায়াতলেই জন্মেছিল আমার কবিতা। এবার হবে টেমসের নোংরা জলে ও টাওয়ার-অফ-লন্ডনের করুণকাহিনির ছায়াতলে। নদী আর স্মৃতিসৌধই আমার প্রেম, অভিমান, ভালোবাসা। সেকালে যমুনা ছিল আমার প্রেমিকা। সেই প্রেমিকাকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল। তার কথা বুঝেছি, সাধারণ মানুষ অবশ্য বোঝেনি। আমার প্রেমিকার শোভা দেখেছি, মানুষ দেখেনি। এবার টেমস হবে আমার একালের প্রেমিকা। ফলে গালিবকাব্য বেঁচে থাকবে আরও শতাব্দীর-পর-শতাব্দী ধরে।
বিলাতবাসের একালের জীবনে যে ঘটনাটির সাক্ষী হয়ে রইলাম আমি, একরকম ঘটনা দিল্লিতেও দেখেছি। তাই তো ঈশ্বরকে আহ্বান করে বলেছিলাম, “ঈশ্বর তুমি করুণা করে আমাকে মর্ত্যলোক থেকে তুলে নিয়ে যাও।” এরকম করুণকাহিনি আর সহ্য করতে পারি না। এরকম ঘটনা দেখে দিল্লির জীবনে কাব্যজগৎ পরিত্যাগ করি; শুধু সুরার পিয়ালা-এ-সাগরে নিমজ্জিত ছিলাম। তখন অবশ্য ঈশ্বর ব্যতীত আর কার কাছেই বা আহ্বান জানাতে পারতাম? দিল্লিবাসের জীবন ছিল প্রায় ক্ষুধার্ত ও রোগভুক্ত। এ-ই ছিল নিয়তি? কিন্তু একালে, বিলাতি মেয়েটির করুণকাহিনিটি আবার মগজে ঝড় তুলতে থাকে।
দূরে ফেলে দাও কামিনী তুমি
রূপমহিমা আর মত্তযৌবন
কৌশল করো যতনে এবার
কামুকহৃদয় করতে হরণ।
সমাপ্ত