
গালিব কিংবা আসাদ ॥ পর্ব ৫
অন্যজনের সঙ্গে প্রেমের কথা তুমি তো জানো
সে সম্বন্ধে আমাকে প্রশ্ন করলে এমন কী পাপ হতো।
শুক্রবার রাত্রিতে বিলাতের কামসিক্ত মানুষের আবেগ বেড়ে যায়। নির্জন-নিবিড় সিঁড়ি খোঁজে, কোণা খোঁজে, আঁধার খোঁজে। নিজেকে মেলে ধরে বলতে চায়- সে কী চায়, কীভাবে চায়। একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে শিখিয়ে দিতে চায়- চুমু খাওয়ার খুঁটিনাটি কলাকৌশল। ঠোঁটে ঠোঁট রাখে বলতে চায়- ঠিক তোমার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। এমন একটি রাতেই নওয়াব জানের মাহফিলে এসে উপস্থিত হই। হিম ঘরের শীত থেকে অগ্নিকুণ্ডের আরামদায়ক উষ্ণতায় এসে নিজেকে ভালোই লাগছে। একজন তানপুরোয় সুর দিচ্ছে। হ্যাঁ, রীতিমতো ভিড়, আর ঘরটাও প্রকাণ্ড, যদিও নওয়াব জান অন্যরকম বলেছিল। চারদিকে নতুন মুখ, দেয়ালে সোনালি ফ্রেমে শস্তা বিলাতি চিত্র, দরজার ধারে জুতোর জঙ্গল। তবলা বাদক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কসরত করছে; তারই তালে কেউ দেখাচ্ছে নৃত্য। নওয়াব জান গাইছে গান। সংগীত ও নৃত্যের ফাঁকে ফাঁকে সুললিত কণ্ঠে শায়েরি পরিবেশন সমস্ত আয়োজনকে দিচ্ছে ভিন্নমাত্রা। দলবল নিয়ে মশগুল নওয়াব জান। প্রফুল্ল মনে হচ্ছে অতিথিবৃন্দকে। এটাই জীবন! দুঃখ নেই, কষ্ট নেই; হাসি-আনন্দে ভরপুর সকলের মন। সত্যি, ভীষণ পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে আজ আমাকে। সুস্বাদু খাবার ও শরীর চাঙ্গা করা পানীয় পরিবেশন করছে আপ্যায়নকারীরা। ব্যস্তসমস্তভাবে চাহিদা পূরণ করছে ওরা সম্মানিত অথিতিদের। অতিথিরা গোল হয়ে বসে আছে। বিনোদন-বিচিত্রা থেকে হঠাৎ নওয়াব জান বলে উঠল, “আদাব মির্জাসাহেব। আমরা আপনারই অপেক্ষা করছি। আমার মেহেদি মাখা হাতটিও আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিবর্ণ হয়ে গেছে। এই দেখুন।” সরু চোখে তাকিয়ে আছে নওয়াব জান আমার দিকে। তার প্রসারিত হাতের দিকে তাকিয়ে বলি, “জীবনে মৃত্যুভয় তো এক অব্যাহত ব্যাপার, মুছে যাওয়ার আগে বিবর্ণ হবেই তার চেহারা।”
“চমৎকার। আপনার কবিতার প্রতিটি শব্দ আমার বাসনা পূর্ণ করে।”
“একটি বাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য পুরো জীবনেরই প্রয়োজন।”
“আল্লাহ আমার প্রতিটি আকাঙ্ক্ষাই পূরণ করেন। এখন আমি নিশ্চিত যে, তিনি আমার শেষ ইচ্ছেটিও পূরণ করবেন।”
“শেষ ইচ্ছেটা কি?”
“একদিন এই বিলাতেই আপনি প্রধান কবি হয়ে উঠবেন।”
“তা না হলে কী আর গালিবের খ্যাতি থাকে। এমন কেউ কী আছে যে গালিবের নাম জানে না।”
“চমৎকার! অতি চমৎকার।” স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শ্রোতৃমণ্ডলী প্রশংসায় উচ্ছৃসিত।
“এখন আপনি আসন গ্রহণ করুন।” নওয়াব জান তার ডানপাশের একটি শূন্য আসন দেখিয়ে দিলো। আসন নিতেই সে আলাপ শুরু করে। আলাপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সারেঙ্গিবাদক আঙুলের আঘাতে সুর সৃষ্টি করতে থাকে। আলাপের সঙ্গে রাগ ও ভাবের সংমিশ্রণে চমৎকার পরিবেশ তৈরি হলো। আলাপ শেষে একটি শায়েরি পরিবেশন করে, “প্রেম নয়, স্বীয় ভাগ্যে আছে কেবলই উন্মাদনা; এই ভাগ্য হোক-না তোমার সুরাপাত্র। আমি তো নিজের শত্রু হতে পারি না, যদি অন্য কেউ তোমাকে চায় তাহলেই-বা কী! তোমার জন্য স্বীয় প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না, প্রেম না হোক, ঝামেলাই হয়েই থাকি তোমার কাছে।” তারপর পরম আবেগে গুণগুণ করতে থাকে, “কাউকে হৃদয় দেওয়ার পর, আফসোস করে কী লাভ! হৃদয়ই যদি তোমার সঙ্গে না থাকে, মুখে বিলাপ কেন?”
নওয়াব জানের শায়েরির সুর নিচু। মনে হয়, আমার প্রতি তার অদ্ভুত আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে। অপূর্ণ প্রেমের বেদনা প্রকাশ পাচ্ছে তার কণ্ঠে। সারেঙ্গিতেও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিষাদের সুর। সমগ্র মাহফিল পরিপূর্ণ হলো এই সুরে। শায়েরি এগিয়ে গেল দ্বিতীয় স্তবকে, “অপেক্ষা করাই যদি হয় তোমার পরীক্ষা, তাহলে যন্ত্রণা কাকে বলে। আমার প্রেমের প্রতি আনুগত্য হলে আমার পরীক্ষা কেন নেবে?” গজলের মৃদুসুর আমার কাঁধ স্পর্শ করল। গজলকে জীবন্ত করে তুলতে নওয়াব জানের ঠোঁট কম্পিত হয়। চোখ নিচু করে। প্রসবের যন্ত্রণা যেন তার চোখে। সারেঙ্গিতে নিঃসঙ্গতার সুর বাজতে থাকে। অতঃপর নওয়াব জানের কণ্ঠে পরিবেশিত হলো, “দেহই যখন পুড়ে গেছে তখন হৃদয়ও নিশ্চয় ভস্মীভূত। ছাই দিয়ে এখন তুমি কী করবে ভাবছ?” মধুর কণ্ঠে গাওয়া গজলের সুর আমাকে মাতিয়ে রাখে। বিশ্বজয়ের হাসি যেন লেপটে আছে নওয়াব জানের মুখে। এই হাসিটি মাটির পৃথিবীতে কেমন যেন বেমানান। প্রেম, আনুগত্য, বিশ্বস্ততা, সমার্পণ- সবই যেন প্রকাশ পাচ্ছে তার হাসিতে। সে সুন্দরী সন্দেহ নেই, গুণেরও কিছু কমতি নেই, সেটাও বুঝতে পারছি।
আকাঙ্ক্ষা থেকে সরাব না হাত, বাসনা আমার পরিপুষ্ট না হলে;
হয় পাবে প্রাণ বধূর নাগাল, নয়তো-বা যাবে দেহ ছেড়ে চলে।
রাত পেরিয়ে আরেকটি সকাল এলো। রৌদ্রকরোজ্জ্বল চমৎকার দিন। বহুদিন পর অলিন্দে এসে দাঁড়াই। অনেক দূরের পথ পেরিয়ে ছুটে আসছে মাতাল বাতাস। হাহাকার তুলছে চারপাশে। ঠিক তখনই শুনতে পাই, কে যেন বেহালা বাজাচ্ছে। বেহালার সুরে বিস্ময়-আবেশে চোখ বোজে আসতে চাইল। চারপ্রকার দুঃখ যেন লুকিয়ে আছে বেহালার চারটি তারে, আত্মপ্রকাশ করছে ছড়ের এক-একটি নিপুণ টানে। বেহালা বাদকের বিষাদময় হৃদয়ের অতল থেকেই যেন উঠে আসছে চারপ্রকার দুঃখ। পাশের বৃক্ষশাখারাও যেন সহমর্মিতা প্রকাশ করছে বাদকের যাতনায়। মাথা ঝুঁকিয়ে বিষাদী সুরের সন্ধান করতে থাকি। কে বাজায় এমন করে হৃদয় নিংড়ানো সুর? কিছুক্ষণ শুনি সুরেলা সেই বিলাপ। মনে হয়, বাদক খুবই নিঃসঙ্গ। কৌতূহলী দৃষ্টিতে খুঁজে চলি বাজনার উৎসটিকে। ওই তো লোকটা। অলিন্দের নিচে, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে একমনে বাজিয়ে চলেছে বেহালা। লোকটার একটি সংগীতপ্রিয় মন আছে। বড়ো ভালো বাজাচ্ছে। সুর বড্ড করুণ। মনে পড়ে গেল ইউসুফের কথা। সেও চমৎকার বেহালা বাজাত। রাস্তা দিয়ে বেহালা বাজাতে বাজাতে একটি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় একটি মহলের জানলায়। কে ছিল সেই জানলায়? যে-ই ছিল তারই মুখ সে দেখতে পেল। শিকারির মতো দুটি চোখ যেন তাকিয়ে ছিল তার দিকে। দরিয়া-এ-ইশকে ডুবে মরার জন্যই সে ওই চোখদুটির দিকে তাকিয়ে ছিল। সে পাথরবৎ দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়। বেহালাও থেমে যায়। কিন্তু জানালার মানুষটি তাকে তোয়াক্কাও করেনি, বরং ওড়নায় মুখ ঢেকে জানালা থেকে হারিয়ে যায়। কিন্তু ইউসুফ তো দিওয়ানা-বেতাব, “মরলে আমার কবরটা খুড়ে দেখো তুমি, অন্তরে রয়ে গেছে আগুন, কাফনও ধোয়ায় ধোয়াকার।”
সেই দিন থেকে ইউসুফ পাথরবৎ মূর্তির মতোই সেই রাস্তায় গিয়ে অপেক্ষা করে। জানলার দিকে তাকায়। কখন আবার সেই পূর্ণিমার চাঁদের উদয় হবে। লোকজন ইউসুফের দিকে অবাক হয়ে তাকায়, ভাবে- ছোকরাটি নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার কষ্টও পায়। ইউসুফকে জিজ্ঞেস করে, কী কারণে এমন পাথরবৎ হয়ে আছে? ইউসুফ কথা বলে না, শুধু জানলার দিকে আঙুল তুলে দেখায়। একদিন মানুষ রহস্যটা বুঝতে পারল- এই ছোকরা তো বিলকিসের জন্য দিওয়ানা হয়ে গেছে। জানালার মেয়েটির নামই ছিল বিলকিস। বিলকিসের বাপ-ভাইরা প্রথমে ভাবল, এই ছোকরাকে নিকেশ করে দিতে হবে; পরে মনে হলো, খুনের দায়ে ধরা পড়লে তাদের মহলে কাক-চিলও এসে বসবে না। তাই রটিয়ে দিলো, ইউসুফ পাগল। কেউ পাগল হয়ে গেছে, কথাটা রটিয়ে দেওয়ার জন্য সময় নেয় না। দাউদাউ আগুনের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একজন মানুষের জীবনকে নরক করে দেওয়ার জন্য এর চেয়ে উত্তম উপায় আর নেই। ও পাগল, বেশ, তাহলে তাকে আটকে ফেলো। কিন্তু ইউসুফ বলে, “আমার হাজার দুশমন যদি আটে মতলব আমাকে মারার জন্য; তবুও আমি ভয় করি না, যদি কাছে থাকে বন্ধু আমার। মিলবেই সান্নিধ্য তোমার- বাঁচাচ্ছে এই আশ্বাস আমাকে; তুমি কাছে নেই, অহরহ তাই দেখাচ্ছে ভয়বিনাশ। সত্যিকারের ভালোবাসা মৃত্যুভীতি দূর করে, শুধু রেখে যায় হুহু শূন্যতা।” প্রেমে পড়লে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ কথাও ভুলে যায়। কাজেই সাময়িক সময়ের জন্য যে অন্ধ হয়ে যাওয়া, সেটাই বোধ হয় প্রেম।
বিলকিসের বাপ-ভাইরা তখন ঠিক করে, নদীর অন্য পারে তার আত্মীয়ের বাড়িতে তাকে রেখে আসাই সঠিক হবে। গোপনে পালকিতে চাপিয়ে দেওয়া হলো বিলকিসকে, সঙ্গে এক বৃদ্ধ দাসী। ইউসুফ যেন আশিকের গন্ধ পেয়ে যায়। সে পালকির সঙ্গে দৌড়াতে থাকে। আর চিৎকার করে বলতে থাকে, “রহমা করো মেরি জান, একবার মুঝসে বাত করো।” বিলকিস কোনো কথা বলেনি, কিন্তু দাসীর মন উত্থালপাথার করে ওঠে। পালকি থেকে মুখ বের করে সে বলে, “আরও কিছুদিন অপেক্ষা করো। আমার বেটির সঙ্গে তোমার দেখা হবেই।” পালকি নদীর ঘাটে গিয়ে পৌঁছল। বিলকিস নৌকোয় উঠে। ইউসুফ নৌকার দিকে তাকিয়ে ঘাটেই বসে থাকে। নৌকা যখন ঘাট ছেড়ে কিছুটা অগ্রসর হয়, তখন বিলকিসের একপাটি চটি নদীতে ছুড়ে দিয়ে ইউসুফকে চেচিয়ে বলে দাসী, “আমার বেটিকে সত্যিই ভালোবাসলে চটিটা ফিরিয়ে এনে দাও।” দাসী সত্যিই চেয়েছিল, ইউসুফ আর বিলকিসের যেন মিলন হয়। কিন্তু সে জানত না ইউসুফ সাঁতার জানে না। ইউসুফ কিন্তু জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর জল খেতে খেতে তলিয়ে যায়। বিলকিস নৌকায় দাঁড়িয়ে ইউসুফের মৃত্যু দেখে। বিলকিস কোনো কথা বলতে পারেনি। হয়তো তার মন বলে গোপনে চিৎকার করতে থাকে, “বাহার তো এসে গেছে, ফুলও ফুটেছে গাছে গাছে, তবুও হে ঈশ্বর আমার প্রিয়কে কেন এভাবে কেড়ে নিলে?”
চলবে…