
গালিব কিংবা আসাদ ॥ পর্ব ৪
প্রেমই অন্ধকারে রচনা করে জ্যোতি
প্রেম না থাকলে প্রকাশ সম্ভব হতো না
গতরাত নওয়াব জানের কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ ঘুমে ভারী হয়ে আসে। সকালে পাটগাছের মতো দুমড়েমুচড়ে শরীর কাঁপিয়ে জাগ্রত হই। মাথার ভেতর কেঁপে কেঁপে ওঠে স্মৃতি। স্মৃতি নিয়ে প্যাঁচাল পারতে ইচ্ছে নেই, তবুও তো…। আমার মতো দুরন্ত ছেলেকে সামলাতে ব্যস্ত থাকতেন ঠাকুরজান। আগ্রার চারদিকে তিনি শব্দ তুলতেন, “আসাদ। আসাদ। আমার বিজয়ী গালিব কোথায়? এদিকে এসো।” তীব্রকণ্ঠে প্রকাশ করতে থাকেন, “আসাদ, আসাদ।” এক পিতৃহীন সন্তানের খেয়াল তাকে রাখতেই হয়। তিনি সবসময় চিন্তা করেন, ভীষণ অশান্তির এই সময়ে পিতৃহীন ছেলেটা আবার কোন অপথে চলে যায়, কিংবা যেতেই কতক্ষণ। যখন সন্ধান পান আমার, তখন তাকে প্রশ্ন করতে করতে বিরক্ত করতে থাকি। উত্তর ঠিকমতো কিংবা মনঃপুত না হলে ছুটে বেরিয়ে পড়ি আবার রাস্তায়। সঙ্গে সঙ্গেই ঠাকুরজান পিছু নিতেন, “আসাদ, আসাদ। এদিকে এসো।” দ্বিতীয় বার যখন তার আহ্বানে সারা দিতাম, তখন তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতাম, “আপনাকে বাঘে তাড়া করবে ঠাকুরজান, আমাকে এভাবে ডাকলে। আপনি কি বাঘকে ভয় পান না?” ঠাকুরজান বলতেন, “ভীষণ ভয় পাই। বাঘের হালুম ডাক শুনলে আমার বুক কেঁপে ওঠে। অন্তরটা শুকিয়ে যায়।” সেকালে বাঘের হালুমের গল্প শুনেই আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেত, কিন্তু একালে বাঘের হালুম ডাক নয়, বরং মানুষ নামের বন্যশুয়োরদের নিশ্চুপ হালুম ডাকই আমাকে ভীতু করে তোলে। ভাবি, আমার পূর্বপুরুষের তলোয়ার দিয়ে এসব বন্যশুয়োরকে কী হত্যা করতে পারি না? অবশ্যি পারি। আমার রক্তে তো রয়েছে বিশ্বশ্রেষ্ঠ সেলজুক-তুর্কির তেজ, তাদের শ্রেষ্ঠত্ব পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল। আমি সমরকান্দের এক বীর জাতির বংশধর, উত্তরাধিকারীর সূত্রে পেয়েছি তলোয়ার, ভূসম্পত্তি নয়, তা পায় কন্যাসন্তান। কিন্তু তলোয়ার উন্মুক্ত হয় না, হয় কলম। ঘুড়ির মতো আকাশে উড়তে থাকে কল্পনা। চোখে স্থান করে নেয় যমুনাতীরের তাজমহল। হৃদয়ে জমে ওঠে কবিতা। টেমসের তীরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখি। দেখি গৃহহীন মানুষদের ভিড়। আগ্রার মতো এখানেও ভিখারির অভাব নেই। আগ্রাকে কখনো ভুলতে পারিনি। আমার নিঃসঙ্গ জীবনে আগ্রা অনেক দিয়েছে। আগ্রা আমার আত্মা। আগ্রার স্মৃতি হৃদয়ে অম্লান থাকবে, মণিমুক্তোর মতো। যে অনাস্বাদিত ভালোবাসা আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে ক্ষতবিক্ষত করে, তার মূলকেন্দ্র আগ্রাই। এই আগ্রাকে ত্যাগ করি যখন নবাব আহমদ বখশ খাঁয়ের ভ্রাতাষ্কন্যা উমরাও বেগমের সঙ্গে আমার নিকাহ হয় তখন। বিবাহসূত্রেই আমাকে দিল্লি আসতে হয়। স্বর্গপুরী নয়, শ্বশুরবাড়িতে আমার জায়গা হয় দিবানখানায়, আর উমারও বেগমের মহলসরায়। উমারও বেগম অবশ্য নিজের কথাই বেশি ভাবে। পিতার অর্থে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চায়। অর্থ দিয়ে যে একটি মানুষ কিনে ফেলা যায়, তা উমারও বেগমকে না দেখলে আমার বোধগম্য হতো না। তৃপ্তি তার একটি বিষয়েই- অর্থ। আর এই অর্থের সেখানে অভাব সেখানে সে কোনোদিনও যাবে না। যায়োনি কোনোদিন আগ্রায়। পিতার অর্থের নেশায়ই সে দিল্লিতে বিলাসী জীবনযাপন করে। ফলে তার স্বামীর ভূমিকা হয়ে ওঠে এক অক্ষম পুরুষের। ফলে আমি একটি দাসের জীবন বয়ে বেড়াই। বয়ে বেড়াই একটি অক্ষম পুরুষের জীবন। আমার মতো একজন অক্ষম পুরুষের প্রতি উমারও বেগমের রাগ বা অভিমান হয় না, চলেও না। তার মতে কেউ কেউ তো অক্ষম পুরুষ থাকতে হয়। আর আমি মানসম্মান ধুলোয় লেপটে থাকা রাস্তার পিচের সঙ্গে না মেশানোর জন্য গাছের গুঁড়ির মতো মাটি আঁকড়ে জীবন চালাতে থাকি।
শ্বশুরবাড়ির হাঁকডাকের মানুষ ছিল কাল্লু। দিবানখানায় সে আমার জন্য দুই বেলার খাবার এনে দেয়। কখনো পরোটা, কাবাব কিংবা ভুনা মাংস আর দারু। তাছাড়া ছিল ঘুম আর ঘুম। একটি কবিতাও মাথায় আসে না। কী করে আসবে? আমি তো তখন পচে যাচ্ছি, সারা শরীরে দুর্গন্ধ, পচে যাওয়ার গন্ধ। একদিন এই দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে মহলসরায় এসে উপস্থিত হই। উমরাও বেগম নামাজ-তসবি নিয়ে পড়ে থাকে; তার কাছে আমি থাকা, না-থাকা একইকথা। তার সঙ্গে তেমন কথাবার্তাও হয় না। দুটি মানুষ এতটা বছর কাটিয়ে দিলো, কিন্তু তাদের মধ্যে তেমন কোনো কথাবার্তাই হলো না, কেউ কাউকে জানতেও পারল না। এরই নাম কী বিবাহিত জীবন!
মহলসরায় এসে দেখি উমরাও বেগম তখন কাল্লুর মা মাদারির বিবিকে খুব গম্ভীর হয়ে কীসব বলছে। বাইরে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করি। উমরাও বেগম বলতে থাকে, বিখ্যাত কবি রজব জং। তিনি ভালোবাসার কবি। শুনেছি তাঁর চার-চারজন বিবি রয়েছে। প্রথম স্ত্রী জোহরা ঘরবাড়ি নিয়েই ব্যস্ত। দ্বিতীয় স্ত্রী আয়শা রান্নাঘরের দায়িত্বে। তৃতীয় স্ত্রী বিন্দা, রজব জংয়ের পঁচিশ বছরের ছোটো, স্বামীর লুঙ্গি-গামছা-তেল-সাবান নিয়ে কাটে তার বেশিরভাগ সময়। চতুর্থ স্ত্রী বুশরা, রজব জংয়ের পঁয়ত্রিশ বছরের ছোটো, মুখ বেশি চলে। কিন্তু প্রত্যেকের প্রতি ঠিকমতো নজর দেওয়া সত্তর বছর বয়সের রজব জংয়ের ক্ষমতা নেই। পালা করে সকল বিবির কাছে গেলে প্রত্যেকই বঞ্চিত থাকেন। নবিজির মতো সমদৃষ্টি কজনের থাকে? উমরাও বেগম থামতেই গলাখাশি দিয়ে ঘুরে প্রবেশ করি। মাদারির বিবি সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। উমরাও বেগম এগিয়ে এসে বলে, “বলুন মির্জাসাহেব।”
“সবাইকে সমান অধিকার দেওয়া যায় কি বেগম?” হেসে জিজ্ঞেস করি।
“নবিজি ছাড়া আর কেউই পারবেন না। কিন্তু আপনি হঠাৎ এখানে? কোনো ফরমায়েস থাকলে কাল্লুকে বলতে পারতেন।”
“ফরমায়েস? আমি কি তোমার কাছে শুধু ফরমায়েস প্রেরণকারী ব্যক্তি? মনে করে দেখো তো, কখনোই কী আমি ফরমায়েস পাঠিয়েছি বেগম?”
“তাহলে, আমার মহলে এলেন কেন?”
“মানুষের গভীর অনুভূতিগুলো বুঝতে শেখো বেগম। মানুষের কষ্টগুলো জানার চেষ্টা করো। যেদিন মানুষের গভীর অনুভূতিগুলো, মানুষের কষ্টগুলো বুঝবে, সেদিন মানুষকেও পাশে পাবে তুমি।
“এসব কথা আপনাকে কে শেখাল মির্জাসাহেব?”
“এক সময় আমি গভীর অনুভূতিগুলোর চাষাবাদ করে এসেছি। কবিতাই আমাকে অনুভূতি শেখিয়েছিল। আজ আমারই ভুলের জন্য অনুভূতিগুলো আত্মহত্যা করেছে।” তারপর তার হাত চেপে ধরে বলি, “আমার শরীরের গন্ধ একবার শুঁকে দেখবে বেগম?”
“ইয়া আল্লাহ! আপনি এ কী বলছেন মির্জাসাহেব?”
উমরাও বেগম অনেকক্ষণ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে এই প্রথমবারের মতো অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। নত ও নিশ্চুপ থাকার কারণটি কল্পনাজগৎ হাতড়িয়ে কিংবা সাঁতার কেটেও উদ্ধার করতে পারি না। শুধু মনে পড়ে একটি কথাই- প্রেম যেখানে অগভীর, নিশ্চুপ থাকা সেখানে আবশ্যকই। হঠাৎ ধোঁয়ার কুণ্ডলির মতো কণ্ঠস্বরে উমরাও বেগম বলে, “আপনার কী হয়েছে মির্জাসাহেব?”
“বেগম তুমি কি আমার শরীরের দুর্গন্ধ পাচ্ছ না?”
“দুর্গন্ধ?”
“এই যে আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তবুও কী দুর্গন্ধ পাচ্ছ না?”
আমার কথা সম্ভবত উমরাও বেগমকে আনন্দ দেয়। প্রতিমা-বিসর্জনের আনন্দ যেন। এই আনন্দে আত্মহারা হয়েই হয়তো, অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধায়, “মির্জাসাহেব!”
“আমার শরীরে সবসময় দুর্গন্ধ থাকে। পচা রক্তমাংসের দুর্গন্ধ।”
“ইয়া আল্লাহ! কী হয়েছে আপনার মির্জাসাহেব? কী হয়েছে? দুঃস্বপ্ন দেখেছেন নাকি?”
হেসে বলি, “দুঃস্বপ্ন? আমি তো নিজেই একটা দুঃস্বপ্ন।”
আমার কথার গভীরে যতই আবেগ থাকুক না কেন, উমরাও বেগমের বিশ্বাস- স্ত্রী কিছুতেই স্বামীকে ভালোবাসার কথাটি প্রকাশ করতে নেই। তাই তার মুখে আবারও প্রকাশ পায়, “মির্জাসাহেব!”
“বলো।”
“আল্লার কাছে প্রার্থনা করুন।”
“আল্লাহর কাছে তো প্রতিদিনই প্রার্থনা করি, বেগম।”
“কী প্রার্থনা করেন?”
“আমার ওপর তিনি বেজার কেন?” আমার কথাটি উমরাও বেগমের মনে বৃহৎ অনুরণন তোলে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারি- মর্ত্যলোকের প্রতিটি সত্যতার মতোই প্রতিটি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও এক-একটি অমীমাংসিত ধ্বংসস্তূপ। আমার ব্যক্তিত্বই আমাকে উমরাও বেগম থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। নিজেরই অজান্তে আমার ঠোঁট বলে ওঠে, “হায় খোদা, এ তো স্বর্গ নয়। তাই তো পুষ্পে থাকে পচা কীট সমেত মধু।”
“মির্জাসাহেব আমাকে কী কিছু বলছেন?”
উমরাও বেগমের মন খুবই অদ্ভুত। মনে যেন তার অপ্রেমের তৃষ্ণা; ইটপাথরের জঞ্জাল।
তার মন খুবই বিচিত্র। এখানে আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আশঙ্কাও ঘুরে বেড়ায়। আকাঙ্ক্ষাগুলো রং ও রূপ বদলালেও আশঙ্কাগুলো মনের গভীরে অভিশপ্ত বসতি স্থাপন করেছে।
উমরাও বেগম আসলে প্রেমিককে ভয় পায়। প্রেমিকরূপী স্বামীটিকে। সে দ্বিধায় ভোগে। আষ্টেপৃষ্ঠে এক মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে। তাই স্বামীর পুঁজির আভাবে তার আফসোস হয়। খানিকটা মোহ, কিছুটা ভুল, বাকিটা আশঙ্কার রূপান্তর পাথার।
হঠাৎ উমরাও বেগম বলে ওঠে, “চলুন মির্জাসাহেব, আপনাকে দিবাখানায় রেখে আসি।”
আমি যেন উমরাও বেগমের কাছে একটি তুচ্ছ বস্তু। পথের ধারে মূল্যবান ভেবে ভুল কুড়িয়ে পাওয়া এক নগণ্য পাথর। তবুও মনে অহেতুক প্রশ্ন জাগে, “কেন?”
উমরাও বেগম নিথর-নিশ্চুপ। প্রাণহীন অক্ষরের স্তূপ। আমরা একে-অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। বুঝতে পারি, উমরাও বেগমের বরফভাঙার সাধ্য আমার নেই। তার চোখে বিষাদের তরজমা চলছে। বুকের মধ্যে কেমন যেন অস্তিত্বহীন অস্তিত্বটি জানান দেয়। একাকিত্বের পাপ। উমরাও জান কাঁদে। দুইগাল ভিজে যায়। কিন্তু আমার ভিজে গাল দেখলেই কারবালার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দেখতে পাই, কাসেমের মৃত্যুর পর সখিনার সারা শরীর কেমন অশ্রুসমুদ্রে ভেসে যাচ্ছিল।
দিবানখানার ভাঙাচোরা চারপায়ায় যখন মনকে শান্ত রাখতে পারি না তখন জীবন কাটে দিল্লির অলিগলি ঘুরে বেড়িয়ে। কখনো বাজার, কখনো-বা নদীর তীর অথবা জামা মসজিদ কিংবা লালকেল্লা। কিন্তু আগ্রার যমুনার তীর, তাজমহল কিংবা অসীম আকাশ এখানে ধরা দেয় না। দিল্লিকে মনে হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আবাস। এক ভয়ংকর কারাগার। পায়ে বেড়ি পরিয়ে আমাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। রক্তসম্পর্ক, পরিবারপরিজন ছেড়ে পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় কাটিয়ে দেই, দিল্লির এই দিবানখানার ভাঙাচোরা চারপায়ায় শুয়ে শুয়ে।
চলবে…