
গালিব কিংবা আসাদ ॥ পর্ব ৩
বাসনার নিত্য নবরঙের দর্শক আমি, আমার
বাসনা পূর্ণ হবে কিনা, সেকথা অবান্তর।
রক্ত জমাট বেঁধে বুকের ভেতর এক-একটি প্রদীপ তৈরি করে। কত স্বপ্ন, কত স্মৃতি, কত ভাবনা- মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে যদি আমার জন্ম হতো, কিংবা জাহাঙ্গির বা শাহজাহানের সময়, তাহলে…। কিন্তু আমার জন্ম হলো বাহাদুর শাহের আমলে। সত্যিকার অর্থে বাহাদুর শাহ্ যদিও ছিলেন মোগল সম্রাট, তবুও মোগল সম্রাজ্য বলতে কিছু ছিল না। তিনি অবশ্য নিজেকে দাবি করতেন কবি হিসেবে, যদিও একবাক্য শের লিখতে জানতেন না। কী অন্যায়, কী অন্যায়! বাহাদুর শাহের সঙ্গে আমার মনে হলো নওয়াব জানেরও কোনো পার্থক্য নেই। দুজনই কবিতাপ্রেমিক, দুজনই মাহফিলের আয়োজক। নওয়াব জানের মাহফিলে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়েও আর যাওয়া হলো না। দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গুঁটিয়ে গুঁটিয়ে দেখতে থাকি। দর্পণে যেন ভেসে উঠল আব্বিজানের চেহারা। আব্বিজানের চেহারা মোবারক একালে আর মনে নেই, যদিও অনেকেই বলে, “আবদে-আল্লাহর চেহারার সঙ্গে গালিবের অনেক মিল রয়েছে।” দর্পণে নিজের মুখের প্রতিচ্ছবিতে আব্বিজানকে অনুসন্ধান করেছি, কিন্তু পাইনি। তার কোনো তসবির নেই। সেকালেও আম্মিজানের কাছে কোনো তসবির ছিল না। কেউ তার একটি তসবির আঁকেনি, কোনো দস্তানও রচিত হয়নি। একজন সৈনিকের দৈনন্দিন জীবনের ইতিহাস লেখার গরজ কি কারো ছিল না? তবে একটি তসবির অস্ফুটভাবে একালেও মনের পর্দায় ভেসে চলে… মার্বেল পাথরে বাঁধানো মেঝে, চিত্রবিচিত্র লতাপাতা আঁকা দেয়াল, আর্শি আলমারি সাজানো কালেমহলের একটি ঘর, মাঝখানে উঁচু পালঙ্কের ওপর ধপধপে বিছানায় রূপকথার রাজকন্যার মতোই বসা একজন রহস্যময়ী নারী- আমার আম্মিজান।
বিলাতের এই জীর্ণপুরাতন কক্ষে বসবাস করে অনেকবার ভেবেছি- আম্মিজানকে নিয়ে একটি দস্তান রচনা করা উচিত। কিন্তু হচ্ছে কোথায়! দস্তান রচনা করা সহজ কর্ম নয়। বিলাতের শ্রমিকরা যেমন দেহখাটুনি কাজ করে চলে, সেইভাবে লিখে যেতে হয় দস্তানা। সেই ক্ষমতা আমার নেই; যদিও অনেক শের কিংবা ঋতুত্ লিখতে পারি। আম্মিজানকে নিয়ে দস্তান লেখার জন্য কলম নিয়ে বসতে-না-বসতেই একপ্রকার ক্লান্তি আমাকে ঘিরে ফেলে। একটি শব্দও রচিত হয় না। চোখ ভরে ওঠে অশ্রুতে। মনে পড়ে যায়, এই দুনিয়ায় কোনো মহল ছিল না আম্মিজানের নিজস্ব। সংসারও না। তিনি শুধু অপেক্ষা করতেন, কখন আবদে-আল্লাহ বেগ খাঁ আসবেন। একদিন তিনি ঠিকই এলেন। মধ্যরাত্রি।
হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলতেই দেখি, এককোণে চৌকিতে বসে রয়েছেন আব্বিজান, আম্মিজানের দুইহাত ধরে। পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে তার তলোয়ার। বাইরে থেকে ভেসে আসছে হ্রেষাধ্বনি, ঝড়ের শব্দের মতো, একটানা। আব্বিজানের বুকে মাথা রাখেন আম্মিজান। আচমকা আব্বিজান বলে ওঠেন, “ভয়ের কিছু নেই, বিবিজান।” বৈচিত্রহীন গতানুগতিক ভাষায় আম্মিজান বলেন, “হযরত, আপনি কখন ও কীভাবে থাকেন জানতে পারি না। তাই…।” আম্মিজানের স্বরটা নিতান্তই কুণ্ঠিত, ভীত। আব্বিজানের চোখে যেন একটু কোমল স্নেহের ছায়া পড়ে; তবুও পদাতিক সৈন্যের মতোই আব্বিজান বলেন, “আমি অনেক দূরে থাকি, বিবিজান।” গম্ভীর ও অতিমাত্রায় দৃঢ়স্বরে আম্মিজান শুধান, “কোথায়?” একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন আব্বিজান। একমুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে বলেন, “যেখানে শুধু রক্তপাত আর রক্তের স্রোত সেখানে।” আব্বিজানের গলায় ক্লান্তির কুয়াশা। আম্মিজান বৃথা প্রতিবাদ করতে জানেন না, তাই জানতে চান, “আপনি আবার কবে আসবেন, হযরত?” আব্বিজানের মনে যেন উদয় হয়- পরিবারের মানসম্মান রক্ষার নীতি, নিয়ম, ধারা, অনুচ্ছেদ ইত্যাদি। তিনি চুপ করে থাকতে জানলেও অহেতুক তোয়াজ করতে জানেন না, তাই হয়তো বলেন, “জানি না। তবে একটা কথা জেনে রেখো, যদি কখনো মর্ত্যলোক ত্যাগ করি, তখন এই দুনিয়ায় আমার কবরের সন্ধান করো না, বিবিজান। তোমার দিলেই আমার সমাধি রচিত হবে।” আম্মিজানের কণ্ঠ দিয়ে শুধু একটি শব্দ প্রকাশ পায়, “হযরত।” আব্বিজানও সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, “বিবিজান।” তারপরই আম্মিজান নিজের ওপর অনেকটা আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে আশার আবদার প্রকাশ করেন, “কালেমহলে থাকতে আমার পছন্দ হয় না। এ তো আমার মহল নয়, আপনারও না। আমাদের নিজস্ব কি কোনো মহল হবে না, হযরত?” এই আবদারে মিষ্টত্ব ছিল, ছিল বৈকি আশা। কিন্তু আব্বিজান এই আবদারটি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “যদি আবার ফিরে আসি, তাহলে হবে।” তারপর আম্মিজানকে আরও কাছে টেনে নেন তিনি। আম্মিজানের প্রতি তৃষ্ণার্তদৃষ্টিতে তাকান। মনে হয় আকাশ যেন কালোমেঘে ঘনিয়ে উঠেছে। সকালে আম্মিজানের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। সারাদিন কালেমহলে কত কাজ তার। আমরা তিন ভাইবোন তার আশেপাশে ঘোরাফেরা করলেও তিনি চোখ তুলে তাকানোর ফুরসত পান না। ছোট্টি খানম অবশ্য রাত্রে আম্মিজানের কাছে থাকে। আমি ও ইউসুফ থাকি দিবানখানায়। কালেমহল কোনোদিনই আমাদের মহল ছিল না। সেখানে ঠিকই বাস করেছি, তবে সকলের থেকে আলাদা হয়ে। ইউসুফ হয়তো এজন্যই পাগল হয়ে যায়। ছোট্টি খানমও বেশিদিন বাঁচেনি। শুধু আমিই বেঁচে ছিলাম; তবে নরকের আগুন আমাকে কালো করে দেয়। এই নরকের আগুনে পুড়তে থাকলেও জীবনের সন্ধান পাইনি। দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিকই বুঝতে পারছি- একালেও জীবনের সন্ধানে দৌড়াচ্ছি। দৌড়াচ্ছি আম্মিজানকে নিয়ে একটা দস্তান রচনা করার জন্য। যদিও সৈনিক পূর্বপুরুষের ভাঙা তির দিয়ে তৈরি কলমই আমার তলোয়ার। কিন্তু এই তলোয়ার দিয়ে শুধুই শের কিংবা ঋতুত রচনা করা সম্ভব, দস্তান নয়; কারণ, অনাদি অনন্ত থেকে কবিতার বীজ বুকে নিয়েই এসেছি।
এই বিলাতে দেখেছি অনেকেই কবিতা রচনার চেষ্টা করছেন; কিন্তু কবিতা তো চেষ্টা করে লেখা যায় না। কবিতা যার কাছে আসে, সে-ই শুধু পারে- আর্তনাদ নয়- হৃদয়ের রক্ত দিয়েই লিখতে। কবিতা তো ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বক্তৃতা নয়, কিংবা মৃত্যুশয্যার শেষবাক্যটি। তাই তো একালেও রক্তমাখা কাগজে লিখে যাচ্ছি গালিবকাব্য। হাত অবশ হয়ে আসে, তবুও লিখে চলি। গালিবকাব্য মানুষের আশ্রয় স্থল। গর্ব নয়, বরং ক্ষত- ক্ষতের-পর-ক্ষতের কথাই লিখে চলি, “দর্পণ কিংবা তারকার দিকেই তাকালেই, সবকিছুতে তোমারই মুখ দেখতে পাই।” কত আশ্চর্যসব শব্দ, হৃদয়দ্বারে হানা দেয়। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে শব্দগুলোকে সাজাই। কারা যেন সহসা এসে অন্তরে কথা বলে ওঠে; চমকে উঠি। গর্ব করে বলতে পারি, নয় বছর বয়স থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করি আমি।
নাটাই থেকে ঘুড়ি গেল ছুটে, আকাশে এলোমেলোভাবে ভাসে।
বেঁধে যাবে সেকোনো মুহূর্তে বৃক্ষের মাথায়, নয়তো-বা মৃত্তিকায়।
জীবনসমুদ্রে দুটো জিনিসই- পতঙ্গবাজি আর সতরঞ্জবাজি- আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই দুটি খেলায় একাকী লড়াই করতে হয়, পাশে কেউ থাকে না, চোখও এক জায়গায় রাখা যায় না। পতঙ্গবাজির জন্য আকাশে আর সতরঙ্গবাজির জন্য সাদাকালো চৌখুপির মধ্যে চোখ না রাখলে পরাজয় অনিবার্য। সেকালের পতঙ্গবাজির দিনগুলো আজও মনে পড়ে। কালেমহলে থাকতে অপছন্দ হতো; আম্মিজানকে কতটুকুই-বা কাছে পেয়েছিলাম, তিনি ছাড়া আমার আপনজন কেউ ছিল না, কিন্তু তার জায়গা ছিল কালেমহলের অন্দরমহলে। তাই দিন-দুপুরে আগ্রার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। কালেমহলের পাশেই ছিল একটি সুবিশাল ছাদ। সেখান থেকে আমি ও বংশিধর ঘুড়ি উড়াতাম। ইউসুফ, কানহাইয়া লাল, রাজা বলওয়ান সিংহ-সহ অনেকেই যোগ দিতো। রাজা বলওয়ান সিংয়ের সঙ্গে প্রায়ই ঘুড়ির প্যাঁচে হেরে যেতাম। তখন মনে হতো, আরে সামনেই আগামী দিন, সেদিন বলওয়ান সিংকে হারাবই; প্রতিদিন কি হেরে যেতে পারি? রাতে বন্ধু বংশিধরের সঙ্গে দাবা খেলে কাটিয়ে দিতাম। সতরঞ্জবাজি আমাকে পতঙ্গবাজির চেয়েও অধীক টানত। এক-একটা চালে যখন বংশিধর গুঁটি কাটত, তখন আমার সেলজুক-তুর্কি রক্ত টগবগ করে উঠত। একদিন অবশ্য চৌসরজুয়া খেলাও ধরি। এইভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে অবশ্যি মীর আজম আলি মাদ্রাসায় পড়তে যেতে হতো। বাড়িতে এসে শেখ মুয়াজ্জামও পড়াতেন। সেইসব পড়াশোনা আমার ভালো লাগত না। একদিন আম্মিজান বলেন, “মাদ্রাসায় যাও ঠিকমতো?” সংক্ষিপ্ত উত্তর, “জি।” আম্মিজান জানতে চান, “ঠিকমতো লেখাপড়া করো।” সংক্ষিপ্ত উত্তর, “জি”। আম্মিজান বলেন, “মনে রেখো, এই কালেমহলে সারা জীবন থাকতে পারবে না।” সংক্ষিপ্ত উত্তর, “জি।” তিনি সস্নেহে বলেন, “একদিন তুমি নিজস্ব মহল নির্মাণ করবে। সেখানে আমি, ইউসুফ, ছোট্টি খানম থাকব।” মনে মনে বলি, দেহের গভীর ভাঁজ সন্ধান করে চলে মহল, আর হৃদয়-মগজ খুঁজে মরে কাব্য। আমার কোনোদিন নিজস্ব মহল হয়নি। নিজের দীনতা-হীনতার দিকে আঙুল তুলে বলি, মহল একটি মরীচিকা। কাব্যের আলোয় আলোকিত নয়। ছোঁয়া যায় না। মরুভূমিতে পাক খেয়ে মরে। আব্বিজানেরও কোনোদিন নিজস্ব মহল ছিল না। তিনি অলোয়ারেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। রাজা বখতওয়ার সিংয়ের রাজ্যে এক জমিদারের বিদ্রোহ দমন করার যুদ্ধে শত্রুর গুলিতে আব্বিজানের মৃত্যু হয়। দুঃসংবাদ অবশ্যি বাতাসের বেগে ধেয়ে আসে। মৃতদেহও একসময় এসে পৌঁছে। আব্বিজানের দেহে প্রাণ নেই; কিন্তু লাশের পাশে রাখা তার তলোয়ারে প্রাণ ঠিকই রয়েছে। সূর্যের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে। ঠাকুরজান হাউমাউ করে কাঁদছেন। আম্মিজান কাঁদছেন বিনিয়েবিনিয়ে। প্রতিবেশীরা তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। কেউ কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে এটা-সেটা বলে। ঠাকুরজান বিড়বিড় করে বলেন, “মির্জা, মির্জা, তুই পিতৃহারা হয়ে কীভাবে বড়ো হবি?” কিন্তু আমি ছিলাম ভীষণ চঞ্চল। তাই তার বিশ্বাস- আমি একদিন বিশাল কিছু হবো। একজন কবিও হয়তো-বা।
এই পুতুলের রাজ্যে রহস্যের কথা কি শুধাব?
মানুষ নেই, শুধু মনুষ্যাকৃতি অনেক রয়েছে।
আবার নওয়াব জানের দেখা পাই। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। আমাদের দেখা হওয়ার ঘটনাটি ইংরেজি চলচিত্রের চেয়েও অবাস্তব। বিচিত্র সুন্দর এক অবাস্তবের মতোই বাস্তব। নওয়াব জানকে লাল পোশাকে আগুন দেখাচ্ছে। সে কাছে এসে খানিকটা জেদের বশেই বলল, “মাহফিলে এলেন না কেন?”
“খুব রাগ হয়েছে বুঝি!”
“না, রাগ না।” একটি হাসি ঠোঁটের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে দেখা দিলো।
“তোমার হাসিটা কৃত্রিম।”
“হ্যাঁ, কৃত্রিমই তো হবে। আমি তো একজন শিল্পী।”
“শিল্পী?”
“আজ্ঞে একজন শিল্পী। সংগীত পরিবেশনেও অভিনয়ের প্রয়োজন পড়ে।”
“সংগীতই আমাকে খুন করে।”
“তাহলে মাহফিলে এলেন না কেন?”
“খুন হতে চাইনি, তাই হয়তো-বা।”
“আমার সঙ্গে কৌতুক করছেন?”
“না, অবশ্যি নয়।”
রাস্তায় জ্বলে উঠা বিদ্যুৎ-বাতির আলোয় নওয়াব জানের দীর্ঘ ছায়াটি পড়ে আমার পাশে। ছায়াটিকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পারি না। বাস্তব মূর্তিটাই তো আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসছে যেন। এত রূপ কোনো মেয়ের মধ্যে থাকতে পারে! দম আটকে আসতে চায়। এই অরূপা যেন এই পৃথিবীর কোনো মানবী নয়, অপ্সরা। মৃদু পায়ে আরও কয়েক পা এগিয়ে এলো সে। গভীর শ্বাস নিয়ে বুক ভরল। আমি বিহ্বল। রূপসির দুই চোখে যেন পারশিয়ান নীল। কী গভীর! কী বিশালত্ব যেন বন্দি হয়ে আছে এই জীবন্ত চোখদুটিতে। যেন প্রস্ফুটিত হচ্ছে দুটি ফুল। আমি হারিয়ে গেছি চোখদুটিতে। অস্থির সুবাতাস বয়ে যাচ্ছে আমার অন্তরে। বিস্ময় ছলাৎ করে ওঠে বুকের মাঝে। বিস্ময়ভরা কণ্ঠেই সে বলল, “এই বার সত্যি সত্যি বলুন কেন আসেননি।”
“অতিরিক্ত উত্তেজনা আমার অপছন্দ।”
“আপনি মাহফিলে এলে আমার ভালো লাগত।”
প্রশংসায় কে না খুশি হয়। আমিও হলাম। নওয়াব জানের চোখের ভাষাও আমি স্পষ্ট পড়তে সক্ষম হই। এই রাতটি সারাজীবন মনে থাকবে। বলে উঠি, “ভালোবাসা থাকুক-না তোমাকে ঘিরে, আমি না-হয় দূর থেকেই অভিভূত হই।”
অদ্ভুত অভিমানে যেন নওয়াব জানের চোখদুটি চিকচিক করে ওঠে জলে। এই জল ভালোবাসার। বলল, “তোমার কথায় এত বিরহ মেশানো কেন! দূর থেকে ভালোবাসা কেন! কাছে আসতে বাঁধা কোথায়?” তারপর আর কোনো কথা না বলেই রাস্তা ভাঙতে থাকে। তার চলন মনের মধ্যে গেঁথে যায়। কী অদ্ভুত তার চলনগতি। কী অদ্ভুত নির্জন পরিবেশ! যে রাস্তাটি গাড়ি ও পথিকের কারণে শুনশান থাকে, এই মুহূর্তে নির্জন গ্রহের একটি পথে পরিণত হয়েছে। দেখতে দেখতে নওয়াব জানের কাঁপা কাঁপা ছায়াটি বিলীন হয়ে গেল পিচঢালা রাস্তার পরতে পরতে। চারপাশ ঝাপসা আলো-অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকে। বিস্মিত হই। মনে ভয়ও পাই। তাকে কী ভুতে পেয়েছিল; না পেলে কী এভাবে চলে যেত। চোখ, মুখ কিংবা শিরার কম্পন শ্লথ হয়ে গেছে- এমনটা মনে হয়নি, বরং আগের চেয়ে সজীব ছিল। নির্মলসুন্দর। হয়তো সে ভেতরে ছিঁড়েভেঙে গিয়েছে, মাহফিলে আমার অনুপস্থিতে। কিন্তু একটু আগেও সৌন্দর্যপ্রকাশে তার কোনো কৃপর্ণতা ছিল না। কী অসাধারণ তার সৌন্দর্যপ্রকাশ। এতে প্রকাশিত হয় মানুষের সঙ্গে তার নিরাময় চূড়ান্ত সম্পর্কহীনতা। সে একা, সম্পূর্ণ একা, কারো সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই।
চলবে…