
গালিব কিংবা আসাদ ॥ পর্ব ১
করুণা করে আমাকে ডেকে নাও আবার
সময় নেই আবার ফেরার, আসাও হবে না
আমি মির্জা গালিব। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মর্ত্যলোক ত্যাগ করেছিলাম। ব্রিটিশ-ভারতে কতই-না ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছিল, সেই ক্ষতজীবনের কত কথাই-না ভ্রাতা ইউসুফকে বলেছি। একপত্রে লিখেছিলাম, ‘তোমাদের দ্বারপ্রান্তে চিরদিন থাকব না, অভিশপ্ত এই জীবন, তবে আমি পাথরবৎ নই। তবুও দুঃসময়ে কেন হৃদয় দমিত হয় না, আমিও তো মানুষ, পিয়ালা-এ-সাগর নই।’
একালে আমার বাস লন্ডনে। সেকালে ছিল আগ্রা কিংবা দিল্লি অথবা কলকাতায়। একাল-সেকাল নিয়ে তর্ক তো চিরকালের। কিন্তু কেমন করে চিহ্নিত করা যায় সেকাল কিংবা একাল? এক-একটা কালের আয়ু শেষ হলেই কি এক-এককালের যবনিকা পড়ে? যেমন পড়ে নাট্যমঞ্চে? না, যবনিকার অবকাশ নেই। অবিচ্ছিন্ন এই স্রোত। তবুও একাল-সেকাল বলে জীবনকে অভিহিত করা হয়। সমাজ, সমাজের রীতিতনীতি, মানুষের নিয়মকানুন, চলনবলন—ইত্যাদিই ধরে রাখে একাল ও সেকালের পার্থক্য। এসব নিয়ে কাল থাকে প্রবহমাণ। এই প্রবহমাণের মধ্যেই একাল-সেকাল স্তিমিত কিংবা নিস্তরঙ্গ হয়। মানুষ হয় কদাচিৎ লাঞ্ছিত, উপহসিত, বিরক্তভাজন হয়। হয়তো-বা প্রকৃতির প্রয়োজনেই এমনটা হয়। প্রকৃতি কৃপণ তাই মানুষকে বারবার জন্ম নিতে হয়। কখনো আসে ধারালো তলোয়ার হাতে, কখনো কলম নিয়ে। কেউ সফল সার্থক হয়, কেউ-বা অসফল ব্যর্থ হয়। তবুও প্রকৃতির কোনো ব্যর্থতা নেই। সেকালের আপাতব্যর্থতার গ্লানি হয়তো একালে শক্তিসাহস সঞ্চয় করে। সেই শক্তিসাহস সঞ্চয়ের আশায়ই একালে আমার লন্ডনে উদয় হওয়া। এই লন্ডনের পাতালস্টেশনের প্যাঁচানো নখে ইঁদুর গাঁথা পড়ে। বাদুড়ও বিদ্যুৎতারে ঠোকর দেয়। বিলাতি মানুষজনও কত ঝড়ঝাপটা নীরবে সহ্য করে চলে। এই ধরুণ ঐ-যে মেয়েটি… পশ্চিম প্রান্তটিকে লাল করে সূর্যটি যেখানে স্থির হয়ে আছে, সন্ধ্যা নামার অপেক্ষায়, ঠিক তারই নিচে, শহুরি কবুতরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে, তারই কথা বলছি। সে করুণবিহ্বলে, স্তব্ধভাবে, সূর্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার ভঙ্গি দেখে আপনারও হয়তো কেমন লাগছে, আমার কাছে মনে হচ্ছে, সে নিজের কাছেই যেন অপরিচিত। তারই একটু দূরে টেমস নদীটি আপন বেগে ছুটে চলেছে। তারই উভয় পাড় উত্তরাধুনিক যুগের যন্ত্রব্যস্ততায় মুখরিত। বাংলার নদীর মতো টেমস নদীটির আশপাশে কোনো পাটক্ষেত কিংবা বৈশাখি সুগন্ধ নেই।
তুমি হাজার বছর বেঁচে থাকো, আর
পঞ্চাশ সহস্র বছরের সমান হোক প্রতিটি বছর
একটি বইয়ের দোকানে পুরাতন একটি কাব্যসংকলনের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছি। আমার বন্ধু মীর তকির বইয়ের শেলফ থেকে ধুলো ঝাড়তে ব্যস্ত। দুজন ব্রিটিশ পুলিশ দোকানটি অতিক্রম করে গেল। আমি বই বন্ধ করে শূন্যদৃষ্টিতে সূর্যালোকে উজ্জ্বল রাস্তার দিকে তাকাই। হঠাৎ মীর তকিরের দৃষ্টিনিবদ্ধ হলো আমার ওপর। সে কোনো বিষয়ে অহেতুক আগ্রহ না দেখিয়ে জানতে চায়, ‘আজকাল তোমাকে বেশ দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে। আশা রাখো, সবই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কোনো আশাই সত্যে পরিণত হয় না। কোনো সত্যদৃশ্যই উন্মচিত হয় না।’
‘গতরাতেও তুমি কী ঠিকমতো ঘুমোয়নি?’
‘শেষপর্যন্ত মৃত্যুই অনিবার্য। তাহলে এখন কেন ঘুম নিয়ে ব্যস্ত হবো।’
মীর তকির প্রশংসার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ‘নতুন কবিতা মনে হচ্ছে, লিখে রাখো। তোমার এমন কত সৃষ্টি না লেখার জন্য নষ্ট হয়ে গেছে।’ আমার দিকে একটুকরো কাগজ এগিয়ে দিলো।
কাগজটি হাতে নিয়ে বলি, ‘মীর তকির আমার মনে হয় ভারতে চলে যাই। সেখানে জায়গা করে নিতে পারব।’
‘গালিব, তুমি এই ধারণা মনে পোষণ করো না। ভারতে সাংঘাতিক সংকট চলছে। হিন্দু-মুসলমান সংকট। সেখানে তোমার কবিতার মূল্যায়ন আর হবে না।’
‘কিন্তু আমি তো ভারতেরই।’
‘একথা সত্য যে তুমি আগ্রায় জন্মেছিলে। দিল্লিতে বড়ো হয়েছিলে। কিন্তু এখন আর সেই ভারত নেই। মুসলমানদের আর সেখানে সম্মান নেই।’
‘আমি এমন এক উদ্যানের বুলবুলি, যে উদ্যান এখনো তৈরি হয়নি।’
‘সেই উদ্যান কি কখনো তৈরি হবে?’
‘হবে, যেদিন ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান মিলে একটি দেশ হবে। তখন সেই উদ্যানে আমি নিজের জন্য একটি জায়গা খুঁজে অবশ্যি পাব। আমি ভারতবর্ষের কবি, কোনো খণ্ডিত দেশের নই।’
কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে এলো। ঠিক তখনই মৃদুমন্দ বিলাতি বাতাসে ভেসে এলো নারীকণ্ঠে একটি গজল, ‘পাথর তো নয় হৃদয়, কেন তা বেদনায় পূর্ণ হবে না।’
দোকানের বাইরে এসে গজলের উৎস সনাক্ত করার চেষ্টা করি। বিস্ময় প্রকাশ করে মীর তকির বলল, ‘এটা তোমার কবিতা, তাই না গালিব?’
‘হ্যাঁ। বিলাতে এই প্রথম, আমার কণ্ঠে নয়, একজন গায়িকার কণ্ঠে আমার কবিতা উচ্চারিত হতে শুনছি।’
‘ওর কাছে তোমার কবিতা পৌঁছল কেমন করে?’ মীর তকির প্রশ্নে বিস্ময় ভরপুর।
‘তাই তো! ব্যাপারটি আমাকেও অবাক করে দিচ্ছে।’
‘হায় আল্লাহ! মর্ত্যরে জিনিস কে নিয়ে গেছে বেহেশতে?’ ভাবাচ্ছন্ন হয়ে বলে ওঠে মীর তকির।
গজলের শেষ বাক্যটি আবৃত্তি করি, ‘বিগদ্ধ বিরক্ত গালিবের জন্য বেহেশত বসে থাকে না। হৃদয়কে কেন শুধু শুধু কাঁদাবে, কেন এত আফসোস।’
পাশের বাড়ি থেকে আসা গজলের সুর আমি ও আমার বন্ধুকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিচ্ছে।
হে ঈশ্বর জগৎ থেকে আমাকে মুছে ফেলছে কেন?
পৃথিবীর পৃষ্ঠার ওপর আমি বাড়তি হরফ তো নই।
সেকাল যেমন একালও তেমন দীর্ঘ হবে বলে মনে হচ্ছে। আমি ভাগ্যবান। ভাগ্যবান হওয়ার কারণও রয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন সৈনিক। যেকোনো দেশের জন্য সৈনিক হচ্ছে শক্তি। সেকালে সৈনিক পূর্বপুরুষরা ভারতবর্ষে এসেছিলেন ঘোড়ার পিঠে চেপে, সমরকন্দ থেকে। একালেও মনে হয় তা যেন চালচিত্র। সৈনিক পূর্বপুরুষদের সারাটি দিন কেটে যেত ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে। সৈনিক দ্বারা লড়াই করেই তো শক্তিরাষ্ট্রগুলো ক্ষমতা দখল করে। একালে যেমন চলে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্য নিজ সৈন্য দ্বারা পরদেশে তাণ্ডব। সৈনিকদের লড়াই ছাড়া শক্তিরাষ্ট্রের তেজ থাকে না। রাষ্ট্র চেনে রক্ত। তাই তার পথে বাধা সৃষ্টি হলে নিজ সৈনিক দ্বারা চলায় খুন আর লুঠতরাজ।
খুন ও লুঠতরাজ করতে করতে ক্লান্ত সুরায় মাতুয়ারা সৈনিকরা, রাত্রি যখন নিঃসীম আকাশের মতো শান্ত তখন, তাঁবু খাটিয়ে প্রজ্জ্বলিত আগুনে ঝলসাতে থাকে রক্তমাংস—লুঠ করে আনা নারীদের নিয়ে দেহ-উৎসব। বাজে গিটার কিংবা রবাব-দিলরুবা। পরিবেশিত হয় গান। গান ছাড়া তো আত্মার মুক্তি নেই। সংগীত ও দেহ-উৎসবে সৈনিকের গরম রক্ত শীতল হয়। একালেও সংগীত ও দেহ-উৎসবে গরম রক্ত শীতল হতে দেখেছি। সেকালে আমার সৈনিক ঠাকুরজানও মাঝেমধ্যে লুঠ করে আনা নারীর সঙ্গ, সুরা আর ক্ষমতার দম্ভ দেখাতেন। একালেও ঠাকুরজানকে নিয়ে আমার গর্বের কমতি নেই। তুরসম খাঁয়ের এক পুত্রসন্তান ছিলেন আমার ঠাকুরজান কুকান বেগ খাঁ। তার পুত্র আবদে-আল্লাহ বেগ খাঁ। ঠাকুরজান ও আব্বিজানের মাতৃভাষা ছিল সেলজুক-তুর্কি। যদিও তাদের মতো স্বহস্তে তলোয়ার ধারণ করিনি কোনোদিন, তবুও তাদের প্রতি আমার গর্ব চিরস্থায়ী। অন্যের প্রাণহনন আর নিজের প্রাণবিসর্জন ব্যতীত তাদের জীবনে আর-কিছুই ছিল না। ঠাকুরজান ও আব্বিজানের জীবন একালেও আমার কাছে স্বপ্নবৎ। তাই একালেও বলি, ‘দুজন গালিব রয়েছেন, একজন সেলজুক-তুর্কি, তিনি সম্রাটদের সঙ্গে মেলামেশা করেন; আর অন্যজন, আজ্ঞে, তার মাথায় অপমানের বোঝা।’ সেকালে কিংবা একালেও আমার স্বপ্নপুরুষদের সন্ধান পাইনি। নিয়তি ছিল ভিন্ন, পেয়েছি কাব্য। কাব্য ছাড়া তো মানুষের হৃদয় চেনা যায় না। এই কাব্যই আমার জীবনে বীজ বুনে। আনন্দবিষাদ, জীবনমৃত্যু, সৌন্দর্যপ্রকৃতি নিয়ে ভাবতে শুরু করি। কাব্যিক স্বরূপ প্রকাশিত হয়। শব্দের নিবিড়তা, উদ্ধৃতির সাবলীলতা আমার কাব্যে ভিড় জমায়। একালেও গালিবকাব্য আঁধার রাত্রি আলিঙ্গন করে ঊষাকে। অন্ধকার ঝুলে থাকে বাতাসে। মরা নদীতে ভেসে যায় তরুণি।
একজন পরাসি কবি বলেছিলেন, ‘আমি তো অন্যজন।’ সেই অন্যজনকে সঙ্গে নিয়েই একালে আমার উদয়, যদিও সেকালে জন্ম হয় আগ্রায়। আকিকা অনুষ্ঠানে ভাবুক লোক ও সৈনিক আবদে-আল্লাহ বেগ খাঁ বলেছিলেন, ‘আমি ভাগ্যবান পিতা।’ ঠাকুরজান কুকান খাঁ ও আব্বিজান আবদে-আল্লাহ বেগ খাঁ ভারতবর্ষের ভাষা বুঝতেন না। আকিকা অনুষ্ঠানেই আগ্রার গুণীজন বলেছিলেন, ‘আকাশ থেকে যেন একটি তারকা নেমে এসেছে আগ্রায়। তারকার জ্যোতিতে ভরিয়ে দেবে আগ্রার মানুষকে। এই শিশু আগ্রার মুখ উজ্জ্বল করবে।’ এসব কথা শুনলে কার-না জীবন ধন্য হয়। দ্বিধাদ্বন্দ্বে শিহরিত হয়ে চোখবিস্ফাড়িত করে একালেও সেকালের দিকে তাকিয়ে থাকি। পূর্বপুরুষের গর্বে রক্ত টগবগ করে। একালেও প্রথম গালিবকে দেখতে চাই, যার মোগল সম্রাটের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল। বিশ্বাস করুন, ব্যঙ্গ করছি না। আনন্দও লুটছি না।
চলবে…