
গাঙ্গুলীবাবু
খাঁটি জীবনরসের অনুষ্ঠান আম-মানুষকে কত বেশি মাতিয়ে তুলতে পারে, তা প্রথম প্রথম ভাবতেই পারিনি অথচ পর্যায়ক্রমে সেটাই সত্যি হয়ে উঠল। ছেলে এম.এ-তে প্রথম শ্রেণি পেলে বিশেষ অনুভূতি যেমন বাপকে গ্রাস করে, সাহিত্য সম্মেলন নিয়ে আম-মানুষের কৌতূহল সেই পর্যায়ের। পরের মাসে প্রথম সপ্তাহে জয়পালপুর টাউনহলে রবিবার ও সোমবার বাংলাদেশ, আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্য-সম্মেলনের প্রস্তুতি জোর কদমে চলছে। তাই নিয়েই আম-মানুষের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এমনিই।
আগে কখনো এ আধাশহরে এত বড়ো সাহিত্য-সম্মেলন হয়নি। তাই কী খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে এত বেশি উদ্দীপনা? নাকি এই সুযোগে তারাও জীবনের উচ্চ কৌলিণ্যকে স্পর্শ করতে চাচ্ছে? যেটাই সত্যি হোক, আম-মানুষের মানসিক হিল্লোল গনগনে আগুনের মতো।
রতন সাহা, পেশায় অটোচালক, সেও কম বেশি উত্তেজিত সম্মেলনের তাৎক্ষণিক অনুসঙ্গ নিয়ে। হুজুগে রতন মনে মনে নতুন খুশিতে মেতে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। কবিতায় মনের রঙতুলি কীভাবে প্রকাশ পায় তা সে জানে না। সাহিত্যের সংরাগ কোন পথে বিশ্বজাগতিক হয়ে ওঠে, সেই হিসেব তার জানা নেই। তার পরেও বেশ বুঝতে পারছে সে, এ সম্মেলন সফল হলে জয়পালপুর আধাশহরের নাম বড়ো বড়ো খবরের কাগজে শিরোনাম হয়ে উঠে আসবে। কোথাও গেলে পরিচয় দেওয়ার মতো একটা যোগসূত্র সব সময় কাছে থাকবে। সেভাবেই চতুর্থ শ্রেণিতে উঠতে গিয়ে তিনবারের ফেল্টু রতনের মধ্যে আসন্ন সম্মেলনের অনুভূতি ও ব্যক্তিগত একগুঁয়েমি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
রতন এলাকায় সবার কাছে জংলী রতন নামেই পরিচিত। পিছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস রয়ে গেছে। রাত বিরেতের দুর্যোগে মানুষের দায়ে কখনো না বলেনি সে।
কত দিতে হবে রতন?
দরাদরি করে আপনাদেরকে ছোটো করতে পারবুনি বাপু।
একটা সংখ্যা তো বলতে হবে?
এ নিয়ে কারুর সঙ্গে কোনোদিন নিজের মুখে কিছু বলিনি। যা ভালো বুঝবেন দেবেন।
জংলী রতন এমনিই মানবিক।
শনিবারের বিকেলে আকাশ জুড়ে মেঘরোদের লুকোচুরি খেলা। একবার সূর্য সামনে আসছে তো পরক্ষণে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। জয়পালপুর থানার মোড়ে দাঁড়িয়ে জংলী রতন সেই দৃশ্য দেখেও চোখ ঘুরিয়ে নিল। তার দরকার প্যাসেঞ্জার সংগ্রহ, হলে দিন ভালো চলবে, না হলে টানাটানির বহর বাড়বে। দৈনন্দিন এ হিসেব রতনের মুখস্থ হয়ে গেছে। জরুরী প্রয়োজনে একজন প্যাসেঞ্জার হন্তদন্ত হয়ে অটোতে উঠে বললেন, কখন ছাড়বে ভাই?
উত্তর না দিয়ে রতন প্যাসেঞ্জারকে উদ্দেশ্য করে বলল, সামনে যে লোকটা পূবমুখো হয়ে হাঁটছে, ওঁকে চেনেন?
পরিচয় না থাকলে চিনব কী করে?
উনিই সাহিত্যসম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক।
কোন সম্মেলনের কথা বলছ?
একগাল হেসে জংলী রতনের সগর্ব উত্তর, তাহলে এখনও খোঁজখবর নিতে পারেননি? শোনেননি জয়পালপুরের টাউনহলে সাহিত্য সম্মেলনের কথা?
এ ধরনের সম্মেলন যেখানে সেখানে হচ্ছে!
কথাটা গায়ে লাগল জংলী রতনের। একটু থমকে থেকে নীল আকাশের দিকে একবার চোখ রেখে বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, বেশ বললেন মাইরি, তা করেন কী শুনি?
গোচরণ হাইস্কুলে শিক্ষকতা করি।
রতন হেসে কুটি কুটি। প্যাসেঞ্জার হতবাক। আগে কখনো শিক্ষকতার প্রসঙ্গ শুনে কাউকে এভাবে হাসতে দেখেননি। বেশ রুষ্ট হয়ে বললেন, অমন হাসছ যে?
‘গোচরণ’ নামে হাসি পেল।
মানে?
জংলী রতন আবার ফিক করে হেসে দিল।
এমন বোকার মতো হেসো না তো।
গো মানে গরু। চরণ মানে পা। কোনো জায়গার নাম গরুর পা হয় নাকি? তাই হাসি পেল।
শুধু নামের জন্য এত তাচ্ছিল্য?
ধান শিক্ষকের হাতে প্রচন্ড পেঁদানি খেয়ে শেষ পর্যন্ত স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল রতন। তারপর দীর্ঘ বছর ভবঘুরে বেকার জীবন। শেষ পর্যন্ত অটোচালক হিসেবে নিজেকে অনেকখানি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। নানা মানুষের অনুসঙ্গে থাকতে থাকতে কথার মারপ্যাঁচেও যথেষ্ট ঘোড়েল হয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
শিক্ষক প্যাসেঞ্জার তা মর্মে মর্মে বুঝলেন বলেই রাশ টেনে ধরেও তা আর ছেড়ে দিতে পারলেন না। জংলী রতন প্রসঙ্গ পাল্টে দিতে চেয়ে বলল, আপনাকে আরেকটা খবর দিতে ভুলে গিয়েছি। অনুষ্ঠানের সভাপতির সঙ্গে রয়েছেন ভবেশ গাঙ্গুলীর মতো পোড়খাওয়া সাংবাদিক। উনিই অনুষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক। খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ, পোষাকে ধোপদুরস্থ, কথায় যাদুকর, মুখে রামকৃষ্ণের হাসি। সম্পাদক হিসেবে একাই বারো আনা কাজ সামলে দিচ্ছেন। কী কী সারছেন, সেই ফিরিস্তি শুনবেন? স্মারক পত্রিকায় কোন্ কোন্ লেখা ছাপা হবে; তা ঠিক করার দায়িত্ব গাঙ্গুলীবাবুর উপর। কার কার লেখা থাকবে, তাও ঠিক করবেন গাঙ্গুলীবাবু। কোন্ কোন্ বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিলে স্মারক পত্রিকার মান বাড়বে, সভাপতি নিজেই উদ্যোগী হয়ে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন শ্রী গাঙ্গুলীর উপর। মাইরি বলছি, এনার্জি আছে লোকটার, একবার দায়িত্ব পেলে সারাক্ষণ লেগে থাকতে পারেন। একটু সঙ্গ পেলে আপনারও মনে হবে সম্মেলনকে সার্থক করে তুলতে সভাপতির চেয়ে গাঙ্গুলীবাবু অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করছেন।
জংলীর কথা শুনে শিক্ষক প্যাসেঞ্জার দুটি বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলেন। সাহিত্য সম্মেলনের গরিমার সঙ্গে রতন জয়পালপুরের গর্বকে মিশিয়ে দেখতে শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে রতনের ব্যক্তিগত ইচ্ছা, সম্মেলনের চমৎকারিত্ব এবং জয়পালপুরের একটানা ঐতিহ্য একবিন্দুতে মিশে গেছে। রাস্তায় থাকার সূত্রে কথার গুলতানিতে রতনের শ্রেষ্ঠত্ব বেড়েছে। কিন্তু তা কী তার উচ্চ শিক্ষার নিরিখে? নাকি….। প্রসঙ্গটা শিক্ষক প্যাসেঞ্জারের মধ্যে চরকির মতো ঘুরছে কিন্তু সামাজিক সংকোচের কারণে তা কিছুতেই প্রকাশ করতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত চেপে রাখাও সম্ভব হল না। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে বললেন, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভায়া?
সাহিত্য সম্মেলন নিয়ে তো?
কতদূর পড়াশোনা করেছ?
যেন মৌচাকে ঢিল পড়ল। যেন হঠাৎ করে মধু-আসক্ত মৌমাছিদের জীবনে ছত্রভঙ্গ অবস্থান তৈরি হয়ে গেছে। জংলীর মুখ ফ্যাকাশে হতে হতে শুকনো তুলসিপাতা হয়ে উঠল। শিক্ষক প্যাসেঞ্জার দিব্যি বুঝতে পারলেন, ভবেশ গাঙ্গুলীর প্রতি একান্ত দুর্বলতার কারণে জংলী রতন নিজের উদ্যোগে আসন্ন সাহিত্য সম্মেলনকে এত বেশি মদত দিতে পারছে।
॥ ২ ॥
নির্দিষ্ট দিনে এলাকার মানুষের মধ্যে অভিনব অনুভূতির বিস্তার শুরু হয়েছে। গতকাল জনাত্রিশের প্রতিনিধি দল এসেছে বাংলাদেশ থেকে। সকলকে টাউনহলের পাশে ‘পবিত্র আবাসনে’ রাখা হয়েছে। অনুষ্ঠানের দিনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তাঁরাই। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি প্রিয় বহু স্থানীয় মানুষ এসে ভিড় করেছেন টাউনহলে।
জংলী রতন সকাল থেকে লেগে পড়েছে ভবেশ গাঙ্গুলীর সঙ্গে। তার সমস্ত সুখের বিস্তার গাঙ্গুলীদার সাফল্যে। জংলীর বিনীত অনুরোধ, কী কী করতে হবে বলুন। ভাবখানা এমনিই, অটো চালানো বন্ধ করে লেগে পড়তে হয়েছে যখন, তখন ভবেশদার সম্মান বাড়াতে যা যা প্রয়োজন সবকিছু করতে হবে তাকে।
সন্ধের পরে টাউনহল জুড়ে অপূর্ব আলোর রোশনাই। আয়োজনের মাধুর্য আর চমৎকারিত্ব উপস্থিত সকলের মধ্যে। ভবেশ গাঙ্গুলীর মধ্যে জয়লাভের আগাম অনুভূতির রিদম বাড়ছে তালে তালে। সুন্দর ফর্সা মুখে স্মিত হাসি। অনুষ্ঠানের সভাপতি ইতিমধ্যে অনেকের কাছে বলেছেন, ভবেশ ছিল বলেই এভাবে সমুন্নতি লাভ করা সম্ভব হল। অনুষ্ঠানের দিনে সকলে বুঝতে পারল কেন শিক্ষক সভাপতি এভাবে আগাম মন্তব্য করেছেন। কেবল একটা কাজ তখনও বাকি রয়ে গেছে। ট্রেন বিভ্রাটের কারণে বারুইপুর থেকে স্মারক পত্রিকাগুলো এসে পৌঁছায় নি। অবশ্য প্রেসের মালিক ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন, ডেলিভারির লোক ট্রেনে উঠে বসেছে। যেতে যতক্ষণ লাগে। ভবেশ গাঙ্গুলী মনে মনে খুব ছটফট করছেন। আরও মিনিট কুড়ি লাগল।
গবেশ গাঙ্গুলী, হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। হলভর্তি লোক। পিক আওয়ার্স চলছে। উপযুক্ত সময়। স্মারক পত্রিকা হাতে পেলে সকলের মধ্যে অন্য ইমেজ তৈরি হবে। জংলী রতনকে ডেকে বললেন, ব্যাগটা নিয়ে আমার সঙ্গে আয়।
জংলী সদর্থক মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। ভবেশ গাঙ্গুলী বেজায় খুশি। হলঘরে ঢুকতে ঢুকতে রতনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখছিস, প্রেসের মালিক কী ওজনদার মানুষ। কত সুন্দর ব্যাগে পত্রিকাগুলো পাঠিয়েছেন দ্যাখ্। কী শক্তপোক্ত, দেখতেও বেশ।
জংলী মাথা নেড়ে নিজের সম্মতি জানালো। গাঙ্গুলীর সব কথায় সে শুধু ইয়েস বলতে শিখেছে।
দ্রুত তালে শ্রোতা দর্শকদের হাতে হাতে স্মারক পত্রিকা তুলে দিচ্ছেন ভবেশ গাঙ্গুলী। বলতে বলতে এগিয়ে চলেছেন, প্রথম প্রবন্ধটা আমার নিজেরই লেখা। জব্বর কলমে জয়পালপুরকে তুলে ধরতে পেরেছি। পত্রিকা সাজানোর সব দায়িত্ব নিজেই পালন করেছি। কাইন্ডলি প্রথম প্রবন্ধটা পড়ে দেখবেন। তাহলে জয়পালপুর সম্পর্কে সব তথ্য পেয়ে যাবেন। গাঙ্গুলী যেন হিন্দী সিনেমার মেগাস্টার। জয়পালপুর টাউনের ক্যারিস্মা তুলে ধরার ক্ষেত্রে একম অদ্বিতীয়ম। কলেজ জীবন থেকে সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে পড়ে আছেন। সেসবের সোনার ফসল এখন তাঁর হাতের মুঠোয়।
একম অদ্বিতীয়ম শব্দ দুটো বাস্তবিক অর্থে তাঁর ক্ষেত্রে খুব প্রযোজ্য। কী পারেন না তিনি। বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী। ভালো কবিতা লিখতে পারেন। আবৃত্তির জন্য যে গলা তৈরি করেছেন তা উপভোগ করার মতো। বড়ো আবৃত্তির অনুষ্ঠান হলেই ভবেশ গাঙ্গুলীর ডাক পড়ে। বক্তৃতা দেওয়ার জন্য যত্রতত্র যেতে হয়। বহু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন। সাংবাদিক হওয়ার সূত্রে স্থানীয় কাগজে তাঁর নামে অনেক রিপোর্ট বের হয়েছে। জয়পালপুর আধা শহরে বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, সামাজিক অনুষ্ঠানে গাঙ্গুলীবাবুর উপস্থিতি বিশেষ সম্মানের। নিজে যা পান, অন্যদের কাছে সেই পাওনা হাতে গরম তেলেভাজার মতো।
এসবের পরেও ভবেশ গাঙ্গুলীর জীবনে একটা খেদ থেকে গেছে। তা ঘুণপোকার মতো প্রতি মুহূর্তে কুরে কুরে খেয়ে চলেছে। একলা থাকলে মাঝে মাঝে মনের সেই খেদ দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয়ে আসে। হতাশার ছ্যাকা থেকে কিছুতেই নিজেকে রক্ষা করতে পারেন না। প্রশ্ন একটাই। এত চেষ্টার পরেও কেন যে নিজের সংসারটাকে অনটনের খানাডোবা থেকে টেনে তুলতে পারলেন না, সেই উত্তর জানা নেই তাঁর। সরস্বতীর সব বর জুটেছে তাঁর কপালে কিন্তু কিছুতেই লক্ষ্মীর বরপুত্র হতে পারলেন না। বড়ো টানাটানিতে সংসার চলে। এদিক সেদিক করে সংসার চালাতে গিয়ে নিজেকে ব্যর্থ নায়ক বলে মনে হয়। জংলী রতনের পাল্লায় পড়ে মাঝেমধ্যে রঙিন জল খেয়ে যে খরচ বাড়ে, তা সামাল দিতে ভীষণ বেগ পেতে হয়। তাঁর জীবনটা যেন চৌবাচ্চার অঙ্ক মেলানোর মতো। বাহির থেকে যত জল ঢোকে তার চেয়ে অনেক বেশি তলার ফুটো দিয়ে বের হয়ে যায়।
সম্মেলনের পরের দিন বারুইপুর ডাটা কম্পোজ থেকে ফোন এল সভাপতির কাছে, স্যার, স্মারক-পত্রিকাগুলো যে ব্যাগে পাঠানো হয়েছিল, সেটা অন্য খরিদ্দারের। গতকাল তিনি এসেছিলেন ব্যাগটা নিয়ে যেতে। বেশ অপ্রস্তুত হতে হয়েছে।
সভাপতি বিলম্ব না করে আমাকে ফোন করে বললেন, আপনিও তো ভবেশের সঙ্গে স্মারক পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে জড়িয়ে ছিলেন, ব্যাগ-ফেরতের প্রসঙ্গটা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বাস্তব করে তুলুন।
বাধ্য হয়ে পরের দিন ভবেশ গাঙ্গুলীকে ফোন করলুম।
হ্যাঁ বলুন।
ব্যাগটা আপনার কাছে রয়ে গেছে।
কীভাবে ফেরত পাঠানো যায় সেটাই বলুন।
আপনি তো রোজ সকালে গঞ্জের বাজারে আসেন, আমিও যাই। আমাকে দিলে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারব।
মাস্টারি বিদ্যের জোরে পথটা বেশ তো বাতলে দিতে পারলেন।
ভাবছি, মোহিতের কাছে মুখ দেখানোর মতো অবস্থান তৈরি হল গাঙ্গুলীবাবুর বদান্যতায়, দুপয়সা বাঁচানোর জন্যে তাঁকে অনেক ফন্দিফিকির করতে হয়। রোজ সকালে আটটার পরে বাজারে আসেন। ওই সময়ে প্রথম পছন্দের জিনিসপত্র বিক্রিবাটার পরে দ্বিতীয় পছন্দের কাঁচা মাল পড়ে থাকে দোকানে দোকানে। সেদিনের মতো বেচাকেনা শেষ করতে দোকানদারকে একটু বেশি উদার হতেই হয়। সেই সুযোগটুকু নিতে পারেন ভবেশ গাঙ্গুলী।
পরের দিন বাজারে গিয়েই প্রথম খোঁজ নিলুম ভোল্টের দোকানে। গাঙ্গুলীবাবু রোজ ওই দোকানে বসে চা খান, কিছুক্ষণ গপ্প করেন; কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলুম, ভবেশবাবু আসেন নি। মাছপট্টিতে পচার দোকানে গিয়ে শুনলুম, সেখানেও আসেন নি। কী ব্যাপার? নিজের কেনাকাটা সেরে বাড়িতে ফিরতে বাধ্য হলুম। সন্ধের পরে প্রেস থেকে আবার ফোন এল।
হ্যাঁ বলো মোহিত।
ব্যাগটা পাঠানোর সুব্যবস্থা হল কী?
আশা করছি, কাল সকালে হাতে পাব।
তাহলে কী বিকেলে কাউকে পাঠাবো?
এভাবে লজ্জা দিও না মোহিত।
ডাটা কম্পোজ থেকে আর প্রশ্নবান ভেসে এল না। পরের দিন গঞ্জের বাজারে গিয়ে আবার খোঁজ নিলুম কিন্তু কেউ- । তাহলে কী ভবেশবাবু ক’দিনের জন্যে দূরের কোনো আত্মীয় বাড়িতে গিয়েছেন? সেদিনের মতো মোহিতের কথা রাখাও সম্ভব হল না। ব্যর্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে এলুম। পরের দিন বিশেষ দরকারে রথতলা থেকে ফেরার পথে দেখলুম, থানার মোড়ে জংলী রতন অটোর পাশে দাঁড়িয়ে। ছেলেটার সঙ্গে গাঙ্গুলীবাবুর হালায়গোলায় মিল। শুনেছি, দুজনে এক গ্লাসের শরিক। জংলীকে বললুম, টানা ক’দিন বাজারে এসে গাঙ্গুলীবাবুকে দেখতে পেলুম না, কী ব্যাপার বল্তো?
দামী লোক, কোনো বিশেষ কাজে জড়িয়ে পড়তে পারেন। কিছু বলতে হবে নাকি?
একটা শুকনো সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছি রে।
একটু বলবেন?
ডাটা কম্পোজের মোহিত একটা শক্তপোক্ত ব্যাগে স্মারকপত্রিকাগুলো পাঠিয়েছিল। সেটাই ফেরত পাবার জন্যে বার বার ফোন করছেন।
ও, ওই ব্যাগটার কথা বলছেন তো?
যে ব্যাগে পত্রিকাগুলো এসেছিল।
ভারি সুন্দর দেখতে।
তুই জানলি কী করে?
পত্রিকা বিলির সময় আমি সঙ্গে ছিলুম। গাঙ্গুলীদা বলছিলেন, মোহিতের নজর আছে বলেই এত শক্তপোক্ত সুন্দর ব্যাগে পত্রিকাগুলো পাঠাতে পারল। ব্যাগটার সামনে বড়ো বড়ো করে লেখা- সজ্জন রেডিমেট সেন্টার, কোন্নগর, বীরভূম।
ঠিক ধরেছিস তুই। তাহলে কী একটু মনে করিয়ে দিতে পারবি?
স্যার, ভিড়ভাট্টার মধ্যে অন্য কেউ ব্যাগটা নিয়ে সরে পড়েনি তো?
তা হতে পারে।
অবশ্য পাওয়া গেলে নির্দিষ্ট ঠিকানা বলে দিলে ব্যাগটা আমিই পৌঁছে দিতে পারব। সপ্তাহে দু’তিনবার বারুইপুরে যেতে হয়।
স্টেশনে নেমে আসমা হোটেলের পাশে পূবের গলি পার হয়ে রাণু ইলেকট্রিক দোকানের ঠিক বিপরীত দিকে ঝুলছে ডাটা কম্পোজের বড়ো সাইনবোর্ড। তারপর কয়েক পা সামনে গেলেই- ।
একেবারে জব্বর ম্যাপ এঁকে দিলেন তো স্যার।
জংলী খুব একগুঁয়ে। কথা দিলে রাখতে জানে। সম্মেলনের দিন অটো চালানো বন্ধ করে যেভাবে সারাদিন লেগে ছিল। কোনো কোনো জীবনে অচেনা অজানা কৌতূহল মাছরাঙা পাখির মতো জলের ভিতরের সম্পদ অণ্বেষণে ব্যস্ত থাকে। রতন ছেলেটা তেমনি। গাঙ্গুলীবিাবুর সঙ্গে মেলামেশা সূত্রে ওর সামাজিক বোধ ক্রমে গভীরতর হয়ে উঠছে।
বাড়িতে ফিরে এসে দেখলুম, ডাটা কম্পোজ থেকে একটা চিঠি এসেছে স্পিড পোষ্টে। মোহিত লিখেছে, বাধ্য হয়ে ওই খরিদ্দারকে একটা নতুন ব্যাগ কিনে দিতে চেয়েছিলুম কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই রাজি হলেন না, তাঁর একান্ত বিনীত অনুরোধ, দু’একদিনের মধ্যে নিজের ব্যাগটা ফেরত পেতে চান।
মনটা শুধু বিগড়ে গেল না, প্রচণ্ড অসন্তুষ্ট হয়েছি ভবেশ গাঙ্গুলীর উপর। পরের দিন বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রেতা পচাকে বললুম, হ্যাঁরে, গাঙ্গুলীবাবু কী আর বাজারে আসেন না?
এখন ছটার মধ্যে চলে আসেন। Standard বেড়েছে বলেই প্রথম সকালে মাথা মাথা মাছ শাক-সবজি কিনে বাড়িতে ফিরে যান।
কী বলছিস রে তুই?
আপনি নিজেকে গাঙ্গুলীবাবুর সঙ্গে তুলনা করছেন নাকি? ভুলে যাবেন না, ভবেশদা সময় পাল্টে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে দিতে পেরেছেন যা আপনি পারেন নি।
এসব কী বলছিস?
যা সত্যি তাই বললুম।
একটা ধন্দ মনের ভিতরে ওঠানামা করছে। ভাবলুম, পচার কথা সত্যি কিনা তা জানা যাবে পরের দিন সকালে। জংলী রতনের কথা বার বার মনে পড়তে লাগল। ও তো এভাবে ভুল বলতে পারে না? অবশ্য এমনও হতে পারে, ব্যস্ত মানুষ গাঙ্গুলীবাবু ব্যাগের মতো তুচ্ছ প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছেন। ক’দিন আগে আমাকে শুনিয়েছিলেন, পরের মাসে কাকদ্বীপে জেলা সাংবাদিক সম্মেলন রয়েছে। তাঁকে বিশেষ ভূমিকা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। হয়তো তা নিয়েই লেগে পড়েছেন। কাজপাগল মানুষ হলে যা হয় আর কী।
পরের দিন সকালে উঠে ভাবছি, ছ’টার সময় বাজারে গেলে পচার কথার সত্যিটুকু বুঝতে পারব। পূব আকাশে লালমুখো সূর্যের উঁকি, আমি ব্যস্ত হয়ে বাজারের দিকে হাঁটছি। হাতঘড়িতে ছ’টা বেজে পঁচিশ মিনিট। সবজি বাজার ঘুরে প্রয়োজন মতো কেনাকাটা সেরে ফেললুম। একবার মনে হলো, পচা গাঙ্গুলীবাবুর অনুরক্ত হয়ে আমাকে সামনাসামনি যা বলল, তা না বললেই ভালো করত।
আরেকটা ইমেজ মুখ ভার করা আকাশের মতো চক্কর মারছে আমার মধ্যে। মনে মনে ভাবছি, টাটকা বেগুন কিনতে ভুলে যাইনি তো? উচ্চে কিনেছি কী? উচ্চে খেলে নাকি শরীরে blood sugar নিয়ন্ত্রণে থাকে। গাঙ্গুলীবাবু সর্বপ্রথম সেকথা আমাকে শুনিয়েছিলেন।
পূবের গলি পার হয়ে পশ্চিমের গলিতে এসে পড়েছি। সূর্যের রূপোলি আলোয় মাছপট্টির সরু গলি দুচোখের সামনে ভাসছে। গলির পশ্চিমে সারি সারি মাছদোকান। ভিড়ে ঠাসা সরু পথ। সোমবার বলেই চাকুরেদারদের সংখ্যা তুলনায় বেশি। নিয়ে গেলে রান্না। খেয়ে অফিসে যাওয়া। আরও কয়েক পা সামনে গিয়ে দেখলুম, পচা ব্যস্ত হয়ে ওজন করা মাছ খরিদ্দারদের ব্যাগে পর পর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটার ব্যবহার ভালো। আবার একটা ব্যাগ পচার সামনে নেমে এল, আমার অনুভূতিতে বিদ্যুতের চমক। মনে পড়ল জংলী রতনের কথা। অনুষ্ঠানের ব্যস্ততার মধ্যে অন্য কেউ ব্যাগটা হাতিয়ে নিতে পারে। তার পরেও পচার সামনে মেলে ধরা ব্যাগ থেকে কিছুতেই দুচোখ সরাতে পারলুম না। ওই তো উপরে লেখা ‘সজ্জন রেডিমেট সেন্টার, কোন্নগর, বীরভূম’। একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলুম, রতন ঠিক কথাই বলেছিল। ভিড়বাট্টার সুযোগ নিয়ে কেউ ব্যাগটা হাতিয়ে নিয়ে সরে পড়েছিল। সেই সূ্ক্ষ্ম প্রশ্নে দুলতে বাধ্য হচ্ছি। তাহলে সাহিত্য সম্মেলনে এমন লোক এসে ভিড় করতে পারে? সাহিত্যের মূল সুর তাদের উপর এতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি?
ভিড় ঠেলে আরেকটু সামনে গিয়ে মনে হল, দুচোখের সামনে ভূত দেখছি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আবার ভাবলুম, ভুল দেখছি না তো? ব্যাগটা ধরে আছেন যে ভদ্রলোক, তাঁর মুখের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে ফিরে আসছি। সৌজন্যবোধ রাখতে মুখ ঘুরিয়ে চাপাস্বরে শুধু বললুম, ভালো আছেন তো?
চমকে উঠলেন ভদ্রলোক। লজ্জাতুর হয়ে দ্রুত পায়ে সামনে চলতে শুরু করলেন।
সময় পাল্টে সকাল ছ’টার মধ্যে বাজারে ঢোকার জাগতিক বোধ আমার মধ্যে ঢুকতে লাগল তির তির করে।