
গল্প সম্পর্কে যে তিন-চারটে কথা আমি জানি
প্রতিকথা’র এবারের আয়োজন এই সময়ের ১০ জন কথাসাহিত্যিকের গল্পভাবনা। কেন তাঁরা গল্প লেখেন, গল্প লিখে আসলে কী হয়, গল্প কেমন হওয়া উচিত, বাংলা গল্প কতদূর অগ্রসর হল, গল্প নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি, এমন নানা বিষয় নিয়ে ব্যাক্ত করেছেন প্রত্যেকে তাঁদের নিজস্ব ভাবনা। গল্পভাবনার সঙ্গে রয়েছে একটি করে গল্প।
পড়ুন সৈকত আরেফিনের গল্পভাবনা ও গল্প।
খুব পুরনো কয়েকটি প্রশ্ন। নিতান্ত নিরীহ। নিরীহই, কিন্তু অবিনীত। কারণ এতে মুখোমুখি দাঁড় করাবার একধরনের ঔদ্ধত্য আছে। যেন, এত কাজ থাকতে এই অকাজ কেন করেন! লেখা কাজ না অকাজ?—এই প্রশ্নে ভোট হলে অবশ্য অকাজ জয়ী হবে। একথা সবাই জানে—যাঁরা লেখেন, তাঁরাও। তবুও লেখকেরা কেন লিখে যান! কেন না লিখে থাকতে পারেন না সে এক আশ্চর্য মনোগহনরহস্যময়তা!
বড় বড় লেখকদেরও এ প্রশ্নে আমরা কখনো থমকে যেতে দেখেছি। তাঁদের হেসে ওড়ানো উত্তর কিংবা কখনো একটা যুতসই জবাব তৈরির আয়াসসাধ্য প্রয়াসও দেখেছি। যদিও তাঁদের হেসে ওড়ানোর স্বতঃস্ফূর্ততা আমাদের আনন্দ দিয়েছে। তাঁদের যুতসই জবাব ভাবিয়েছে কখনোবা। তবুও কী একটা আকাঙ্ক্ষা থেকে গেছে! মনে হয়েছে কী যেন পাইনি, কী যেন আছে, আরও কিছু বাকি আছে জানার। জানার এই অনপনেয় আকাঙ্ক্ষা সম্ভবত ধারাবাহিক। ধারাবাহিক অন্ধকারের মতো। লেখকরা এই প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন, এটাও ধারাবাহিক—কেন লেখেন? কৌতূহলের এ এক অদ্ভুত সমাপতন!
প্রথম কথা
আমি কেন গল্প লিখি? নিজেকে একা করে এই প্রশ্নটি করলাম। আসলেই তো, কেন লিখি! আমার তো লেখার কথা নয়। আমার তো সম্ভ্রান্ত সাংস্কৃতিক বংশগৌরব নেই। দাদা শুনেছি মৌসুমী ফলের ব্যবসা করতেন। বাবা ছিলেন কৃষক। অবশ্য গণি মিয়ার মতো। ভূমিহীন। মা বা মায়ের দিকের কেউ বিদ্যাদিগ্গজ ছিলেন, কবি ছিলেন, গল্প লিখতেন, গান করতেন, নাচ করতেন, তবলা বাজাতেন—এরকম ইতিহাসও নেই। মানে কোনোরকম সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পারিবারিক ঐতিহ্যবিযুক্ত আমার উৎস। আমার তো বড় জোর মাঠের কৃষক হবার কথা। তবু যেকোনোভাবেই গল্প লেখার দুর্ঘটে জড়িয়েছি আমি। কেন জড়ালাম! কে আমাকে বাধ্য করলো! নাকি কেউ বাধ্য করলেই লেখা যায়! আমার শিক্ষক অসীম কুমার দাস, আটের দশকে যিনি লিখেছিলেন ঝঞ্ঝা ও পুনরুত্থান-এর কবিতাগ্রন্থ— একবার বলেছিলেন, লেখা বস্তুত নাযিল হয়, প্রত্যাদেশের মতো। কথাটা মনে ধরেছিল আমার। সবাই তাই লিখতে পারে না। নাযিল না হলে লিখবে কী করে! যাহোক, সেটা ভিন্ন আলাপ। কিন্তু আমি কেন লিখি—সন্তর্পণে নিজের কাছেই দাঁড় করালাম নিজেকে। মহামতি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাটি মনে হলো, ‘লেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে যে সব কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলি জানাবার জন্য আমি লিখি।’ ঠিক আছে, তিনি এটা বলতেই পারেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম সেই প্রমাণও দেবে। বলবার তাঁর অনেককিছুই ছিল। কিন্তু, আমার কী বলার আছে, যা লেখা ছাড়া বলা যায় না! বা কী এমন বলেছি যা লেখা ছাড়া বলাই যেত না! এটা ঠিক, লেখার মধ্য দিয়ে যা বলেছি, না লিখলে সে কথাগুলো কাউকে বলাও হত না। মানিকেরই আরেকটা কথা আছে, ‘জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ পাইয়ে দেওয়ার তাগিদে আমি লিখি। আমি যা জেনেছি এ জগতে কেউ তা জানে না (জল পড়ে পাতা নড়ে জানা নয়)। কিন্তু সকলের সঙ্গে আমার জানার এক শব্দার্থক ব্যাপক সমভিত্তি আছে। তাকে আশ্রয় করে আমার খানিকটা উপলব্ধি অন্যকে দান করি।’ শেষ লাইনটায় এসে আমার ঈষৎ হাসি পেয়ে গেল। উপেক্ষার হাসি না, বিস্ময়বোধের হাসি। প্রজ্ঞার কী স্পর্ধা ছিল মানিকের! তাই তিনি অক্লেশে ‘দান করি’ বলতে পারেন। আমি অতটা দৃঢ় ধীমান নই। বরং নিজেই আমি প্রদেয় হয়ে থাকি। যদি কেউ গ্রহণ করে, কৃতার্থ হই। লিখিও বোধ হয় এ কারণেই—কেউ আমাকে গ্রহণ করবে। গৃহীত হবার মুহূর্তটি আমি উদযাপন করতে চাই। সঙ্গোপনে।
প্রশ্নটা যদিও কেবল লেখা নিয়ে ছিল না। ছিল গল্প লেখা নিয়ে। তবুও আমার ক্ষেত্রে এ প্রশ্নের কোনো রকমফের নেই। কারণ এখন পর্যন্ত লেখা মানেই আমার কাছে গল্প লেখা। হয়তো আমি আরও অনেককিছু লিখতে চাই। অনেক কিছু মানে কিছু কবিতা কিংবা কয়েকটি উপন্যাস। কিন্তু সেটা এখনও হয়ে ওঠেনি সেভাবে। গল্পই লিখেছি কয়েকটা। ফলে, যা বললাম, আপাতত এ প্রশ্নের এই আমার উত্তর।
দ্বিতীয় কথা
গল্প লিখে কী হয়? আসলেই তো, কী হয় এসব লিখে! আমি অবশ্য এসব নিয়ে ভাবিনি কখনো। প্রয়োজনই মনে করিনি। গল্প লিখে আমার কী হয়, তাতো ইতোমধ্যে বলেছি,—আনন্দ হয়। যখন লিখি না—গলায় বিঁধে যাওয়া মাছের কাঁটার মতো একটা বর্ধিষ্ণু অস্বস্তি মাথার মধ্যে কুটকুট করে। যা-ই করি, ঘুরে বেড়াই, খাই, ঘুমাই, একটু পড়ি, গান শুনি—একটা ঝিঁঝিঁ পোকার মনোটোনাস সুর কানে বাজতে থাকে। কোথাও, কিছুতেই ভালো লাগে না। যখন লিখি, আমার আনন্দবেদনাকে শব্দে বেঁধে ফেলতে পারি, একঘেঁয়েমি কেটে যায়। তখন মনে হয়, এই তো শান্তি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। হু হু করে হাওয়া আসে। হাওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনে হয়, আমার ওজন কমতে শুরু করেছে। কমতে কমতে আমি ওজনহীন হয়ে যাই। তেতালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি ভাসি। ভাসতে থাকি। অথবা তখন আমি যেন একটা পাখি। উড়ে বেড়ানোর অনুভূতি হয়। আমার অক্ষিগোলকের মধ্যে তখন পুরো শহর।
কিন্তু আমি জানি, গল্প লিখে কী হয়—এটা এত সরল প্রশ্ন নয়। এর আরও বহুমাত্রিক দ্যোতনা আছে। সেটা যেমন সাহিত্যের দিক থেকে, পাঠকের দিক থেকে এমনকি সমাজরাষ্ট্রের দিক থেকেও। প্রথমত, সাহিত্যের দিক থেকে গল্পের অবস্থান বিচারের প্রশ্ন আসতে পারে। সেটা নিঃসন্দেহে একটা ব্যাপকতর বিবেচনা ও অনুসন্ধানের বিষয়। গল্প নিশ্চয়ই সাহিত্যশিল্পেরই অনেকটা;—এ সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। আমি বরং প্রশ্নটাকে সহজ করে নিতে চাই। সহজ নয়, সঙ্কুচিত করে নিজের কথা বলা যায়। আমার গল্পে সাহিত্যের কী ক্ষতিবৃদ্ধি হয়—এমন প্রশ্নের দুধরনের জবাব হয়, একটি উদ্ধত একটি বিনত। আমি উদ্ধত হতে পছন্দ করি না। কিন্তু বিনত জবাবটাও আসলে নিরর্থক। মানে, যদি বলি, না, আমার গল্পে সাহিত্যের কিছুই আসে যায় না, সেটিও ঠিক জবাব হবে না। গল্প থেকে আমার নিশ্চয়ই একটা এসপেক্টেশন আছে। আমি বাংলা সাহিত্যের সেরা গল্পগুলোই লিখতে চাই। তা-ই মনে করেই লিখি। তবে মনে করা আর লিখে ফেলতে পারার বাস্তবতা নিয়ে আমার ধারণা আছে। তাই বলি, এ প্রশ্নের জবাব বরং সময়ের হাতেই তোলা থাক।
আর পাঠকের কথা আমি কী বলব! সে তো পাঠকই বলবে! কারণ আমার মনে হয়, কেবল লেখকই নয়, পাঠকও সার্বভৌম। কিন্তু স্মৃতি রুমানা এবং দু-একজন পরিচিত বন্ধুস্বজন ছাড়া আর কেউ আমার গল্প পড়েছে এমন কোনো খবর আমার কাছে নেই। বন্ধুরা তো মুখ ফুটে প্রকাশ্যে দুর্নাম করতে পারে না। তারা প্রশংসা করে ভাসিয়ে দেয়। প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে! আমারও লাগে। কিন্তু আমি যেভাবে গল্পকে বুঝি এবং যেভাবে লিখতে চাই সেখানে বন্ধুদের অতিপ্রশংসায় ভেসে যাওয়ার লোক আমি না। আমার কাছে গল্পের কোনো শ্রেণিবিভাগ নেই—ছোট নেই, বড় নেই, অণু নেই। আমার কাছে গল্প গল্পই। একটু বুঝিয়ে বলা যাক। মানে আমরা গল্পকে সাধারণত যে যে ভাগে ভাগ করে থাকি—যেমন ছোটগল্প, বড়গল্প, অণুগল্প, এক বাক্যের গল্প, দশ শব্দের গল্প, ছয় শব্দের গল্প প্রভৃতি। আমি এসব বিভাজনকে অস্বীকার করি।
কারণ আমি মানুষ নির্বিশেষে সবার জীবনকে সমভিত্তিতে দেখতে চাই। দরিদ্র মানুষের দুঃখের বা আনন্দের চেয়ে ধনী মানুষের দুঃখ বা আনন্দ আমার কাছে আলাদা নয়। আমি ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা’য় বিশ্বাসী নই। ফলে জীবনকে একটি বাড়ির প্রতীকে ভাবতে আমার ভালো লাগে। উপন্যাস বা গল্প দুয়ের জন্যই একটি বাড়ি দরকার। বাড়ি যেমন জীবনের প্রতীক তেমনি ঘটনা ও চরিত্রসমূহের যোগসূত্র ও সমন্বয়ক। বাড়ি একটি পরিপূর্ণ বসবাসের জায়গা। বাড়ির সদস্যদের প্রয়োজনমত ঘর থাকে সেখানে। ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুম, গেস্ট রুম, কিচেন রুম, ডাস্ট রুম, বেড রুম, বারান্দা, ব্যালকনি ইত্যাদি। একটা সমগ্র জীবনের প্রতিরূপ। বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা, বিবিধ অভিজ্ঞতার মিশেলে গড়ে ওঠে জীবন। সাহিত্যে একটা জীবনের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা ও বিবিধ অনুভূতির মিথস্ক্রিয়ায় তৈরি হয় উপন্যাস। বাড়ি আমার কাছে তাই উপন্যাসের উপমা। একটি বাড়িতে একইসঙ্গে বাস করে অনেক মানুষ—যারা একে অপরের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু প্রত্যেকে তারা আলাদা মানুষ। তাদের জীবনের চাওয়া-পাওয়া আলাদা। বেদনা ও আনন্দ আলাদা। অনেক মানুষের বিচিত্র জীবনের সমগ্রতা রূপায়িত হয় উপন্যাসে। কিন্তু গল্প এই বাড়ির মাত্র একটি ঘরের বা একজন মানুষের জীবনায়ন। সেই একটি ঘর বা একজন মানুষ হতে পারে ছোট বা বড়; নারী বা পুরুষ। ঘরের বা কক্ষের বিভিন্ন নাম হতে পারে, যেমন, খাবার-ঘর, আঁকার ঘর, অতিথি-ঘর, রান্নাঘর শোবার ঘর। ঘরগুলোও কোনোটা ছোট বা বড় হতে পারে। আরও অনেককিছুতে একটি ঘরের সঙ্গে অন্য আরেকটি ঘরের পৃথগত্ব থাকতে পারে। যা-ই থাকুক, যেরকমই হোক, সেগুলোকে আমি ঘর নামেই ডাকতে চাই। গল্পের ক্ষেত্রেও তা-ই, —ছোট হোক, বড় হোক, অণু হোক, দশ শব্দের হোক, ছয় শব্দের হোক সেগুলো আমার কাছে তাই গল্পই। আকারপ্রকার নিয়ে একদম ভাবিত নই আমি। যে কয়েকটা গল্প লিখেছি, ওরকম ভেবেই। নির্দিষ্ট করে, অণুগল্প লিখতে চাইনি, বড় গল্পও লিখতে চাইনি। লিখতে লিখতে একসময় মনে হয়েছে এখানেই শেষ। শেষ করে দিয়েছি। প্রকৃতি নিয়ে ভাবিনি।
কিন্তু সাহিত্যশিল্প তথা গল্পের প্রভাব সমাজরাষ্ট্রে কীভাবে পড়ে, তা রীতিমত গবেষণার বিষয়। শিক্ষিত পড়ুয়া শ্রেণির মধ্যে এসবের একটা প্রভাব নিশ্চয়ই আছে। তবে তা যে সবসময় ইতিবাচক হবে তাও নয়। যেধরনের প্রভাবই পড়ুক না কেন, সমূহ সমাজরাষ্ট্রে তা একসময় অনুভূত হতে পারে। এটা অনেকটা চুঁইয়ে জল পড়ে দিন শেষে গ্লাস পরিপূর্ণ হবার মতো। তাতে যখন পিপাসা তখন জল না পাবার পরিস্থিতি তৈরি করে। তবে গল্পের প্রভাব সমাজরাষ্ট্রে পড়বেই—এটা একটা ধারণামাত্র। কেননা, কখনো বা প্রায়ই উল্টোটাই হয়। সেইটেই বোধ হয় নিয়ম। বিদ্যমান সমাজরাষ্ট্রই বরং সাহিত্যকে প্রভাবিত করে।
তৃতীয় কথা
কিন্তু গল্প কেমন হওয়া উচিত—এই প্রশ্নে আমি বিভ্রান্ত। প্রথমত, গল্পের কোনো বস্তু-অবয়ব নেই, দ্বিতীয়ত, গল্পে কী লেখা হবে তার কোনো প্রবিধান নেই। তাই গল্প আগে কেমন ছিল, এখন কেমন আছে, এই ধারণাই যখন অস্পষ্ট-চিহ্নিত, তখন বলা কঠিন, গল্প কেমন হলে ভালো হয়। তবে, সবই যেহেতু পরিবর্তনশীল, শিল্পও এক অর্থে সৃষ্টি, পরিবর্তন ও সীমাহনীতারই মুখপত্র—গল্পও যে পরিবর্তনশীলতার ভেতর দিয়ে যাবে এতে সন্দেহ নেই। গল্পবস্তু ও গল্পহীনতার শৈলী রপ্ত করতে করতে গল্প এক নতুনতর কাঠামো ও বিন্যাস পরিগ্রহ করবে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি কোনো প্রত্যাশা করি না। কেননা, আমার মনে হয়, বর্তমানের ও ভবিষ্যতের গল্পকাররা গল্পসৃষ্টির মগ্ন অভীপ্সায় আমার আকাঙ্ক্ষাকেও ছাপিয়ে যাবেন।
বাংলা গল্প কতদূর এগোলো? এ তো জানা কথাই, শিল্পবিচারের সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। গল্পের এগিয়ে যাওয়া কিংবা পিছিয়ে থাকার তত্ত্ব তাই ভীষণ গোলমেলে। তাছাড়া ব্যক্তিমতের ওপর তা নির্ভরও করে না। কিন্তু বাংলা গল্প পিছিয়ে আছে বা ক্রমে পিছিয়ে যাচ্ছে ভেবে হতাশ হবার কিছু নেই। আবার অতিআশাবাদী হয়ে এটা ভাবারও কিছু নেই—বাংলা গল্পই পৃথিবীর সেরা।
অনেক পথ এসেছি। তবুও গন্তব্য দূরে। শিল্পে পথের শেষ নেই। ঠাকুরের কাছে ফিরি বরং—
পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!
এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে।
ঢেউ ওঠে পড়ে কাঁদার, সম্মুখে ঘন আঁধার,
পার আছে গো পার আছে—পার আছে কোন্ দেশে।
গল্প : কী ফুল ঝরিল
যুবকদের শহরে যাওয়া যাক।
শান্ত শহরটি শীতে কাঁপে। মনোগ্রাহী শহরে মনোটোনাস শীত। জবুথবু শহরে, সন্ধ্যায় গলায় মাফলার জড়িয়ে যুবকেরা বাইরে বেরোয়। ঘরের উষ্ণতা ছেড়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনজন যুবক একে একে এসে দাঁড়ায় কাজলা মোড়ে—কয়েসের টি-স্টলের সামনে। এখান থেকে তারা সাহেববাজার যাবে। জিরো পয়েন্ট নেমে যুবকেরা মালোপাড়ায় চলে যেতে পারে আবার বড় মসজিদের পাশ দিয়ে হেঁটে পদ্মার পাড়ে রিভারভিউ রেস্তরাঁয় গিয়ে গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে শীত উপভোগ করলেও কারো কিছু বলার নেই। এ শহরে কেউ কাউকে কিছু বলে না।
সাহেববাজার যেতে যুবকদের বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সরণি পার হতে হয়। অটোবাইকের চালক যখন বাজার, বর্ণালি, লক্ষ্মীপুর বলে চেঁচিয়ে যাত্রী খোঁজে, যুবকেরা দেখে বিলবোর্ডে সুন্দরী মডেলের মুখ কুয়াশায় ভিজে গেছে। শীতের শহরে স্বল্পবসনা মডেলের কুয়াশার শিশিরে আর্দ্র নরমশরীর তাদের বরং উত্তাপ দেয়। কয়েসের টি-স্টলেও কখনো তারা উত্তাপ পেতে পারে। কিন্তু কয়েসের বানানো চা, চা-সমেত আড্ডা তাদের ভেতরে জমানো বরফ উষ্ণতায় উড়িয়ে দিতে পারে না। কাচের কাপে চুমুক দিয়ে কয়েসকে ডেকে যুবকেরা বলে, ‘পানি কি রোদে গরম করা না কি কয়েস?’ চাদরে ঢাকা শরীর থেকে মুখ বের করে কয়েস হাসে। কয়েসের হাসিতে শীতে কাতর শহরের মালিন্য একটুও কমে না। মলিন এই শহরের প্রতি যুবকদিগের ভালোবাসাও হয়তো কমে না।
১
একদিন অনেকদিন আগে, খুব বন্যা হয়েছিলো—সে বছর বন্যায় দেশটাই যেন একটা নদী বা সমুদ্র, তখন হেমন্তের ধানখেতের মতো দিগন্তে অবতরণশীল আকাশের পাশে শুয়ে থাকা নদী পদ্মার শহরে অভিষেক হয়েছিলো তাদের। দূর দূর গ্রাম থেকে, মফঃস্বল শহর থেকে তারা এসেছিল। কেউ বাসে এসেছিল, কেউ বা ট্রেনে। বাসস্ট্যান্ডে বা রেলস্টেশনে কেউ তাদের স্বাগত জানায়নি ঠিকই, কিন্তু সেদিনই ভবিতব্য স্থির হয়ে গিয়েছিল—এই শহরে যুবকেরা অনেকদিন থেকে যাবে। যুবকেরা মনে করতে পারে, ক্যাম্পাসের প্যারিস রোডই তাদের প্রথম রোমান্টিক করেছিল। ঊর্ধ্বমুখী গগনশিরিষের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে গাছের পাতার ফাঁক গলে ঝকঝকে রোদ এসে তাদের শরীর ছুঁয়েছিল। তখন ত্বকের গোপন কোষে নিভৃতে ঘুমোনো গভীর অসুখে আক্রান্ত হয়েছিল তারা।
প্যারিস রোডে কোরাস গানে গলা মেলান সেইসব দিনে তরুণেরা নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যাকবেঞ্চে দাঁড়ানো মেয়েটি তাদের শিহরিত করে। তিনজন গ্রাম্য তরুণ প্রথমত মেয়েটির গলার স্বরে, দ্বিতীয়ত তার বলার ভঙ্গিতে বিস্ময়ে অভিভূত হয়। তখন শ্রেণিকক্ষে সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্তটিতে সদ্য বালকোত্তীর্ণ তরুণেরা টের পায় ত্বকের নিচে লুকিয়ে থাকা গভীর অসুখ। শিক্ষকের কী একটা প্রশ্নে শ্রেণিকক্ষে যখন অপারগ-নীরবতা নেমে আসে, নিতান্ত অনিচ্ছায় দাঁড়ায় মেয়েটি। আগে কখনো দাঁড়ায়নি। স্পষ্ট নাগরিক উচ্চারণে এমনভাবে উত্তর দেয় সে, যেন এ আর এমন কী প্রশ্ন! চোখেমুখে একরাশ বিস্ময় আর টইটুম্বুর আনন্দ নিয়ে সেই প্রথম তরুণেরা একসঙ্গে একজন তরুণীর দিকে নির্লজ্জভাবে তাকায়। অনিন্দ্য সুন্দর মেয়েটি, চেহারাজুড়ে দ্বিধাহীন সরলতা, সটান তাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তখনও তরুণেরা ভবিষ্যতে যে নামটি সারাজীবন বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াবে—সেই নামটি জানে না।
প্রথম ‘সুন্দর’ দেখার সম্মোহনে তরুণেরা বিচলিত। কী করবে ভেবে পায় না। তাদের ক্লাস করা তখন মেয়েটির ক্লাস করা না করার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। যেদিন সে ক্লাসে আসে না, ছেলেগুলো পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে যায় লিটনের টি-স্টলে। টি-স্টলের পুরনো বেঞ্চে পা দুলিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে অপেক্ষা করে। অপেক্ষার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা হেঁটে বেড়ায় প্যারিস রোডে, শহীদ মিনারে, পার্কে। চারুকলার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি ভদ্রা হয়ে স্টেশনে পৌঁছে গেছে—স্তব্ধ বিকেলে নির্জন সেই রেলরাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তিনটে বোকা ছেলে একেকজন দার্শনিক হয়ে যায়। তারা ভাবে—অকপট, আকর্ষণীয় মেয়েটি যেন মাটির বুকে শুয়ে থাকা রেলরাস্তার অপরপ্রান্ত। কোনোদিনই তারা তার নাগাল পাবে না।
দূর থেকে তাকালে দু-প্রান্তের ব্যবধান চোখে পড়ে না। সমান্তরাল রেলরাস্তাও একটি সরলরেখায় মিলে যায়। তিনজন তরুণের গোপন আত্মসমর্পণ অন্য কেউ বোঝে না। তারা নিজেরাও কি শুনতে পায় পত্র-পতনের মর্মরধ্বনি বা তাদের বুকের একতারায় বেজে যাওয়া করুণ বেহাগ! মগ্ন দিনগুলোতে তখন একদিন অক্টোবরের আসন্ন শীতের নরম গন্ধে ভরপুর মধ্যাহ্নবেলা আসে। শহীদুল্লাহ কলাভবনের চারতলায় ক্লাসমেট আঞ্জুমান তাদের পথ আগলায়। স্বাস্থ্যবতী মেয়েটি বলে, ‘জানো, আজ আমার জন্মদিন। তোমরা কি আমার সঙ্গে ক্যাফেটারিয়ায় যাবে? এবারের জন্মদিনটা আমি তোমাদের সঙ্গে সেলিব্রেট করতে চাই’। সেই মেয়েটি, পরে যে একসময় তরুণদের প্রিয় আঞ্জুপা হয়ে উঠবে—তার স্বরে আন্তরিক ব্যাকুলতা, ‘যাবে তোমরা!’
তরুণেরা আঞ্জুমানের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তাদের মনে পড়ে, তারাও জন্মেছিলো একদিন। কোনো এক শীতের রাতে বা বৃষ্টিদুপুরে বা গোধূলি-সন্ধ্যায় কোনো আঁতুরঘরে। কবে সে দিন কে জানে! এখন সার্টিফিকেটের বার্থডেট ভুলে যাওয়া তরুণেরা তাদের ‘ভবিষ্যতের আঞ্জুপা’র কথায় কী করবে ভেবে পায় না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় এই মুহূর্তটিকে অবশ্য পরবর্তী জীবনে তারা বারবার মনে করবে। তবে তারা তখনই জানত না, তাদের জীবনে যে আরও অসংখ্য বিহ্বল মুহূর্ত তৈরি হবার সেই সূচনা। তরুণেরা তখন সম্মোহিতের মতো আঞ্জুমানের পেছনে হাঁটতে শুরু করে। শহীদুল্লাহ কলাভবনের চারতলা থেকে নেমে প্যারিস রোড ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ক্যাফেটারিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের সম্মোহন তখনও কাটে না বরং তারা একটি স্থায়ী সম্মোহনের দিকে এগিয়ে যায়।
যেতে যেতে আঞ্জুমান বলে, ‘কই তোমরা তো আমাকে শুভেচ্ছা জানালে না! উইশ কর আমাকে, উইশ কর।’ আঞ্জুমান তিনটি ছেলেকে মুহূর্তে পড়ে ফেলে। তাদের চোখেমুখে লেপ্টে থাকা সারল্য যেন গ্রামীণ প্রকৃতি। তাদের মন যেন টলটলে জলের দীঘি। দীঘির জলে তাদের মনের ছায়া পড়ে। স্পষ্ট বোঝা যায় তাদের মন। শুভেচ্ছা চেয়ে নেবার আহ্লাদিপনা করতে আঞ্জুমানের তাই সমস্যা হয় না। তরুণেরা সুর করে বলে, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ আঞ্জু।’ কিন্তু তখনও তাদের স্বরে জড়তা, দ্বিধাতুর বিহ্বলতা চোখেমুখে। আঞ্জুমান ঠিকই উচ্ছ্বসিত হয়। সে হাসে, কলকল করে কথা বলে। ওর আনন্দময় হাসি তরুণদের বিস্মিত করে দেয়, ‘জন্মদিন কি ঈদের দিনের মতো আনন্দের!’
ক্যাফেটারিয়ায় আরও বিস্ময় তাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল। আঞ্জুমানের জন্মদিনের অক্টোবরে গভীর অসুখে আক্রান্ত তিনজন সরলতরুণ একসঙ্গে হোঁচট খায়। তরুণদের বুকের বাঁপাশে ব্যথার মতো বাস করে যে মেয়েটি, ক্যাফেটারিয়ার ছোট কেবিনঘরে একটা পরীর মতো সে বসেছিলো। ঘরে ঢুকেই তিনজন একেবারে হা হয়ে যায়। অস্ফুটে তিনজনই বলে, ‘প্রিয়লেখা!’
২
মার্চের দিনগুলো এমন ফুরফুরে—বাতাসে দূরবর্তী নদীর গন্ধ লেগে থাকে। দূরে, যেন শৈশবের পাশে বসে কেউ বাঁশি বাজায়। অমিয় সেই সুরের সামান্য আভাস ভেসে আসে বাতাসে। তার কিছুটা শোনা যায়, কিছুটা শোনা যায় না। গাছের সবুজ পাতারা ঝরতে শুরু করে। পুরো ক্যাম্পাসটি একটা পাতার গালিচা হয়ে যায়। কিন্তু নিষ্পত্র বৃক্ষের নিচে তরুণেরা কোথাও ছায়া খুঁজে পায় না। রোদ অবলীলায় সর্বত্র ঢুকে পড়ে। ছায়াময় ক্যাম্পাসে রোদের নির্লজ্জ অনুপ্রবেশও তরুণদের নিবৃত্ত করতে পারে না। প্রিয়লেখার সঙ্গে পরিচয়ের পরবর্তী মার্চে তারা উন্মাতাল হয়ে যায়। নাতিশীতোষ্ণ সেই বসন্তকালে প্রিয়লেখা একদিন তরুণদের আড্ডার মাঝখানে এসে বসে। বলে, ‘হেই, তোদের সাথে বসতে পারি!’ এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তরুণেরা অবাক হতেও ভুলে যায়। প্রিয়লেখাই তখন কথা বলার সুযোগ করে দেয়, ‘একটা সিগ্রেট দে তো, টানি।‘ তিনজনই ভাবে, আমরা তো সিগারেট খাই না, নিতান্ত বিড়িটিড়িই যা ভরসা। সিগারেট খেতে পারলেও বিড়ি কি আর ও খেতে পারবে! আড়ষ্ট তরুণেরা একটি আজিজ বিড়ি প্রিয়লেখার হাতে ধরিয়ে দেয়। প্রিয়লেখা তাদের গা ঘেঁষে বসে কমদামি বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে হাসে। আর তিন সরলপ্রেমিক এত কাছাকাছি বসে সেই প্রথম বিড়ির উৎকট গন্ধ ছাপিয়ে প্রিয়লেখার গায়ের মাতাল গন্ধে শিহরিত হয়।
শিহরণের সেই শুরু। প্রিয়লেখা হয়তো কিছু না বুঝেই ক্রমে তাদের ক্রমাগত শিহরিত করে যায়। সকালদুপুরসন্ধ্যা সে থাকে তরুণদের সঙ্গে। শহিদ মিনারে, পার্কে, টিএসসিসিতে, ইবলিসে, সাবাস বাংলাদেশে, জুবেরি মাঠে প্রিয়লেখার সঙ্গে তিনটি ছেলে সারাক্ষণ লেপ্টে থাকে। ক্লাসেও এক বেঞ্চে চারজন বসে। মতিহারের বিশাল ভূগোলে চার ভবঘুরে চষে বেড়ায়। প্রকৃতির সন্তানেরা সবুজের গায়ে গায়ে হাঁটে। ক্যাম্পাসের প্রতিটি ঘাস যেন তাদের পায়ের গন্ধ জানে। চারটি ছেলেমেয়ে পায়ের ছাপ এঁকে দেয় মতিহারের প্রতিটি রাস্তায়।
তারপর তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। বা হয়তো ক্লান্তি নয়, অন্য কোনো গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে তরুণেরা একটি বাই সাইকেল কিনে ফেলে। প্রিয়লেখাকে সাইকেলের সামনে রডে বসিয়ে তারা হয়তো ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াতে চায়। প্রিয়লেখাকে জোর করতে হয় না। তারও ভালো লাগে সাইকেলে ঘুরতে। তাই তিনজনের কাউকে সে না করে না। যখন যার সঙ্গে চড়ে, অকারণেই তার কোমড় জড়িয়ে ধরে। আদুরে ভাবভঙ্গি দেখায়। প্রিয়লেখার শরীরের স্পর্শে তরুণদের সাইকেল চালাতে সমস্যা হয়। তখন তারা হয়তো আবার হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে তারা বুঝতে পারে, সাইকেল নয়, প্রিয়লেখার সঙ্গই সব। সাইকেলটিকে আর দেখা যায় না। প্রিয়লেখা জিজ্ঞেস করে, ‘সাইকেল কই রে?’ তারা বলে, ‘সাইকেল নষ্ট হয়ে গেছে।‘ একথা শুনে প্রিয়লেখা মুচকি হাসে। ওর হাসিতে তরুণেরা বিভ্রান্ত হয়। বিপর্যস্ত বোধ করে। প্রিয়লেখা বলে, ‘ঠিক আছে, হারিয়েছে ভালোই হয়েছে। তোদের সাইকেলে চড়তে চড়তে আমার পাছা ভারী হয়ে গেছে।’ চারজন আবার হাঁটে। হেঁটে হেঁটে এখানে ওখানে যায়, ক্যাম্পাস মুখস্থ করে। নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বেড়ায়। ঘুরতে ঘুরতে তরুণেরা যেদিন রোকেয়া হলের পেছনের বনটি আবিষ্কার করে, প্রিয়লেখার সেদিন অসুখ করেছিল। বনের ভেতরটা গভীর আর ঘন। গাছের পাতা আর লতায় জড়ানো অপূর্ব প্রকৃতি। তরুণেরা ভাবে—আহা! এত সুন্দর বন প্রিয়লেখা দেখতে পেলো না! সেরে উঠলে প্রিয়লেখাকে নিয়ে তারা আসবে এ বনে।
প্রিয়লেখার অসুখ সারতে দেরি হয়। তিনজন তরুণ অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করতে করতে বনের কথাই ভুলে যায় তারা। প্রিয়লেখার সেরে ওঠার প্রার্থনাই তাদেরকে অন্য সবকিছু ভুলিয়ে দেয় হয়তো। তরুণদের আকুল আকাঙ্ক্ষায় আর ডাক্তারের ওষুধের গুণে প্রিয়লেখা একদিন সেরে ওঠে। তখন তাদের আবার মনে পড়ে বনে যাবার কথা। কিন্তু প্রিয়লেখাকে বলবে কিনা ভেবে পায় না। তরুণেরা নিজেদের গোপন কামনায় দ্বিধাগ্রস্ত হয়। মনের সারল্য হারিয়ে তারা প্রিয়লেখাকে একাকী বনে নিয়ে যেতে ভয় পায়। তবে প্রিয়লেখা ভয় পায় না। তরুণদের মুখ দেখে সে-ই বুঝে ফেলে গোপন কোনো কথা আছে, ‘কী রে কী লুকোচ্ছিস আমার আমার কাছে? বল তো তোরা! না বললে মার খাবি।’ তারপর এক ছুটির দিনের দুপুরে চারটি ছেলেমেয়ে গভীর একটা বনে ঢুকে যায়। কয়েকটি শেয়াল শুধু কান খাড়া দেখে, তিনটি ছেলে একটি মেয়ের সঙ্গে প্রকৃতির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
অজানা বৃক্ষরাজি, ঘাস, লতা, পাতায় চারপাশ ঢেকে আছে। প্রকৃতির মুগ্ধ জাতকেরা প্রাণভরে ঘ্রাণ নেয় সেই নীরব নিসর্গের অপরিমেয় গন্ধের। একটা শেয়াল খুব কাছ দিয়ে হেঁটে যায়। মাথা উঁচু করে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকায়। চারজন যুবক-যুবতির মনে তখন নতুন একটা পৃথিবী আবিষ্কারের আনন্দ। আজীবন পাহাড়ে বাস কেউ সমতলে এলে যেমন বিস্ময়ে অভিভূত হবে তেমন উচ্ছ্বাসে বনের মধ্যে তারা চিৎকার করে। এত সবুজ! এত সবুজ! তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে।
বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে বেতের কাঁটায় ছেলেদের জামা আটকে যায়। কাঁটা থেকে জামা ছাড়িয়ে নিতে নিতে তরুণদের মনে হয়, এই কাঁটায় প্রিয়লেখার ওড়নাও আটকাতে পারত। কিন্তু আটকায় তাদের জামা। তখন তাদের মনে হয়, প্রিয়লেখার জন্য ওড়না একটা বাহুল্য। কাঁটায় আটকে যাওয়া জামা ছাড়িয়ে নিতে নিতে তারা দেখে, বেতের পাতার ফাঁকে ঝুলে আছে থোকা থোকা বেথুল। বেথুল মানে বেতফল। তরুণেরা কয়েক থোকা বেথুল তুলে প্রিয়লেখাকে দেয়। বলে, ‘এই নাও বেতফল। ছোটবেলায় আমরা বলতাম বেথুল।’ গোলাকার বা কখনো একটু লম্বাটে, ছোট কষযুক্ত টকমিষ্টি এই ফল কখনো দেখেনি প্রিয়লেখা। জীবনানন্দের কবিতা পড়েও বোঝেনি। ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে! তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে’ পড়ে বেতের ফলের সঙ্গে প্রেয়সীর ম্লান চোখের উপমা মেলাতে পারেনি। হাতের মধ্যে এক থোকা বেথুল নিয়ে সে চুপ হয়ে বসে থাকে। কত কী মনে হয় তার! কার চোখ এমন নিবিড় ম্লান ছিলো! চিলের কান্নার সুরে জীবনানন্দ কার কান্নার ঘায়ে বেদনাহত হয়ে লিখেছিলেন এমন কবিতা!
বেথুল তুলতে তরুণদের হাত ছড়ে যায়, রক্তপাতও হয় একটু। ছেলেরা সেই রক্তের দিকে তাকিয়েও দেখে না। প্রিয়লেখার জন্য তারা আরও অনেককিছু করতে পারে। প্রিয়লেখার মুখে একটুখানি হাসির ঝিলিক জেগে উঠলে তরুণদের কাছে রক্ত-বিসর্জনও তুচ্ছ হয়ে যায়। প্রিয়লেখাও জানে সে কথা। কিন্তু আজ এই সামান্য বেথুল প্রিয়লেখাকে কতটা আনন্দিত করল তরুণেরা সেটা বুঝতে পারে না। দ্বিধা আর অজানা শিহরণে গোপনে কাঁপতে থাকা তরুণেরা চুপচাপ প্রিয়লেখার পেছন পেছন হাঁটে। রোকেয়া হলের পেছনে ঘন নিসর্গের পটভূমিকায় তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়া সূর্য। গাছের পাতার ফাঁক গলে আলো এসে পড়ছে প্রিয়লেখার মুখে। একটা সরলরেখার মতো আলো এসে যুবতি মুখটাকে আরও উজ্জ্বল করে দিয়েছে। কী সুন্দরই না লাগছে ওকে! হাতের আঙুল তুলে তিনজনকে ডাকে সে। থোকা থেকে একটা বেথুলের খোসা ছাড়িয়ে মুখে দিতে দিতে যুবকদেরকে যুবতি মেয়েটি বলে, ‘নে, আজ তোরা আমায় চুমু খা। দেখি, সবচেয়ে কে ভাল পারিস চুমু খেতে। খবরদার আর কিছু না, কেবল চুমু। নে, এই মুখ পেতে দিয়েছি।’
৩
সেই বিকেলটি নিশ্চয়ই অপার্থিব ছিল। অনেককাল পরে সেই বিকেলের কথা ভাবে যুবকেরা। কাজলায় কয়েসের চা-স্টলে হালকা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে তরুণেরা সেই বিকেলে ফিরে যায়। তারা অনুভব করে, সেই জনহীন প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রিয়লেখা তাদেরকে নতুন একটি গ্রহে নিয়ে গিয়েছিল। সত্যি কি ঘটেছিল তেমনটা! নাকি তারা যৌথ স্বপ্নে সেই পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করেছিল! তরুণেরা শিহরণে বাকশূন্য মুগ্ধতায় ডুবে গিয়েছিল সেদিন। কয়েসের টি-স্টলে চা খেতে খেতে অনেককাল পরেও সেই স্তব্ধতা ফিরে আসে। যুবকেরা বিমূঢ় হয়ে একে অপরকে দেখে।
সেদিন বন থেকে ফিরে যে যার রুমে ফিরেছিল। ফেরার পথে তরুণেরা ছিল চুপচাপ। প্রিয়লেখা একাই কথা বলে যাচ্ছিল। তবু নৈঃশব্দ চেপে বসেছিল পথে। তারপর প্রিয়লেখার পথ শেষ হয়ে গিয়েছিল মন্নুজানের গেইটে। আর তরুণেরা নীরবে বিনোদপুরের মেসে ফেরে। কিন্তু তারপরই তারা একেবারে হাওয়া হয়ে যায়। নতুন গ্রহের ফেরে তাদের ওপর যেন অমানিশা নেমে আসে! দৃশ্যপটে তারা নেই। অথচ কেউ জানে না তরুণেরা কোথায় গেছে। ক্লাসমেটরাও না। ক্লাসমেটদের কেউ কেউ হয়তো অভ্যাসবসেই একে অপরকে জিজ্ঞেস করে, ‘দোস্ত, ওই তিনটা কই গেছে রে? বাউণ্ডুলে তিনটারেও দেখি না, প্রিয়লেখারেও দেখি না। কই গেছে ওরা? সবাই পালাইছে নাকি!’ পালানোর কানাঘুঁষা ছড়িয়ে পড়ার আগেই একদিন তরুণেরা ক্লাসে ফিরে আসে। কিন্তু এতদিন তারা কোথায় ছিল, আসেনি কেন, অসুখ করেছিল কিনা—সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তরুণেরা এসব প্রশ্নের জবাব সযত্নে এড়িয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলে তারা উদাসভাবে তাকিয়ে থাকে। কাজের অজুহাতে অন্যদিকে চলে যায়। তবু শিহরণের স্তব্ধতা সম্ভবত নিঃশেষিত হয় না। ক্রমাগত আকাঙ্ক্ষার বারুদ জমা হয়। বোকাটে তিনটি তরুণ গোপনে আরও পুরুষ হয়ে ওঠে। কামনার আগুনে পুড়ে যায় তাদের যাবতীয় সারল্য। সুতীব্র পবিত্রতা ভুলে যায়। নিজেদের নাম পর্যন্ত মনে করতে পারে না। কল্লোল ছাত্রনিকেতনের দোতলার একটা ঘরে শুয়ে তারা মহাসড়কে ছুটন্ত গাড়ি দেখে। পথচলতি মানুষ দেখে। হুড খোলা রিকশায় তরুণীরা হাসতে হাসতে চলে যায়। বৃষ্টি আসে। জানালা খোলা পেয়ে বৃষ্টি তাদের ভেজায়। বৃষ্টির পরশে কখন যে ঘুমিয়ে যায়, তারা টেরও পায় না। উঠে দেখে বিকেল হয়ে গেছে। চারপাশে নরম রোদের আলো। মহাসড়কে ছুটন্ত গাড়ি, মানুষের ব্যস্ত চলাফেরা, রিকশার বেলের টুংটাং। আনন্দে উচ্ছল তরুণীরা দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। ততক্ষণে তরুণেরা ভুলে যায় সেদিন দুপুরে বৃষ্টি হয়েছিল।
এ শহরে বৃষ্টি খুব একটা হয় না। কালেভদ্রে দু-এক পশলা যা হয় তাতে ধুলোও মরে না। ধুলোর শহরে প্রচণ্ড বিক্রমে গরম আসে। শীতে প্রবল শীত। গ্রীষ্মে সূর্য যেন অনেকখানি নিচে নেমে আসে। উত্তাপে পড়ে যায় শহরের বৃক্ষ। যুবকেরা ঘেমে নেয়ে ওঠে। ধুলো-ঘামে পর্যুদস্ত তরুণেরা ঘরে ফিরে বাথরুমে যায়। শাওয়ার ছেড়ে ভিজতে ভিজতে তারা শীতকালের প্রতীক্ষা করে। সন্ধ্যায় তারা ঘরের বাইরে আসে। কাজলার মোড়ে, কয়েসের টি-স্টলে বসে চা খায়। কয়েসের সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা করে। তারপর সাহেববাজার যাবার জন্য তিনজন যুবক অটোবাইকে উঠে বসে। বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সরণি পার হয়ে তারা কোনোদিন সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে গিয়ে নামে। কোনোদিন পদ্মাপাড়ে গিয়ে নৌকায় ওঠে। কোনোদিন রিভারভিউ রেস্তরাঁয় বসে কফি বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খায়। মালোপাড়ায় আবু হাশেমের আস্তানায় গিয়ে কোনো কোনোদিন তারা কেরু এন্ড কোম্পানির দু-এক পেগ জিনও মেরে দিতে পারে। তারপর ফেরার পথে কেউ কিঞ্চিৎ মাতলামিও করে ফেলতে পারে। তবু কোনো সমস্যা নেই। এ শহরে কেউ কাউকে কিছু বলে না।
কোনো কোনোদিন অবশ্য সাহেববাজারে, লক্ষ্মীপুরে বা পদ্মাপাড়ের ভিড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। যুবকেরা সেদিন কাজলাতেই কয়েসের টি-স্টলে বসে রোদে গরম করার মতো ঈষদুষ্ণ পানি দিয়ে বানানো চা খেয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে। একের পর এক সিগারেট খায়। টি-স্টলের অপরিসর ঘরে ধোঁয়ায় ভরে যায়। ঘরের দেয়ালে ভুল বানানে লেখা, ‘এইখানে রাজনইতিক আলাপ নিষেদ’। যুবকেরা এই নিষেধাজ্ঞা অজান্তেই মেনে চলে। কারণ তারা একসঙ্গে বসলেই পুরনো দিনের স্মৃতিই ফিরে আসে। প্রিয়লেখা যেদিন তিনজন অনাঘ্রাত তরুণকে চুমুর প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়ে তাদের সুপ্ত কামনাকে উসকে দেয়, কিন্তু প্রতিযোগিতার ফলাফল প্রকাশ করে না, সেদিন তরুণেরা যুগপৎ আনন্দ ও হতাশার দোদুল্যমান অনুভূতি নিয়ে মেসবাড়িতে ফিরে যায়। নিদারুণ অনিশ্চয়তায় তাদের রাতের ঘুম দেরিতে আসে। তারা ভেবেছিলো পরদিন প্রতিযোগিতার ফল জানতে পারবে। কিন্তু একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তেও প্রিয়লেখা কারো কাছে মুখ খোলে না। ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। প্রিয়লেখার সেই হাসি তিনজনকেই বিভ্রান্ত করেছিল হয়তো। কেননা সেদিন মেসে ফিরে তিনজনই নিজেকে বিজয়ী দাবি করে। এক পর্যায়ে তিনজন বন্ধু বন্ধুতা ভুলে শারীরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। রক্তাক্ত সংঘর্ষ শেষে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। তখন একে অপরের গলা জড়িয়ে কাঁদে। তখন সেই কান্না তরুণদের উপলব্ধির নতুন একটি স্তরে পৌঁছে দেয়। তারা শপথ করে, যা-ই ঘটুক নিজেদের মধ্যে আর কখনো মারামারি নয়। তারা তিনজনে একসঙ্গে প্রিয়লেখাকে ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা করে।
কিন্তু আক্রান্ত জায়গাগুলো ফুলে যায় ঠিকই। তারা একসঙ্গে বিনোদপুর বাজারের মানিক ফার্মেসি থেকে মলম আর ট্যাবলেট কিনে আনে। ওষুধে ব্যথা কমে, তবে কেটে যাওয়া জায়গাগুলো সহজে শুকোয় না। তরুণেরা রুমে শুয়ে সুমনের গান শুনতে শুনতে নিজেরাও গলা ছেড়ে গায়, ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই, তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই, শেষপর্যন্ত আমি তোমাকে চাই…।‘ তখন ক্যাম্পাসে, ক্লাসে তাদের অনুপস্থিতিজনিত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ক্লাসমেটদের কেউ কেউ অভ্যাসবশেই একে অপরকে জিজ্ঞেস করে, ‘দোস্ত, ওই তিনটা কই গেছে রে? বাউণ্ডুলে তিনটারেও দেখি না, প্রিয়লেখারেও দেখি না। কই গেছে ওরা? সবাই পালাইছে নাকি!’
কয়েসের টি-স্টলে ছোট একটা ফ্যান আছে। কিন্তু সে ফ্যানের বাতাসে গরম যায় না। যুবকেরা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘামে। আর নিজেদের মারামারির কথা মনে করে হাসে। হাসতে হাসতে বিষণ্ন হয়। কেটে যাওয়া জায়গাগুলোর দাগ জন্মদাগের মতো স্থায়ী হয়ে গেছে। তখন একে অপরকে দেখায় সেই দাগ, ‘দ্যাখ এইখানে কেটেছিলো আমার। দ্যাখ, এখনো দাগ আছে।‘ দাগগুলোতে আদর করে হাত বুলায়। ‘শালা যা মারছিলি আমাকে! সারা গা ব্যথা হয়ে গেছিল।’ কয়েসের টি-স্টলে এভাবে রাত বাড়ে। আবহাওয়া ক্রমে আরও ঠাণ্ডা হয়ে আসে। স্টলে লোকজন ফাঁকা হয়ে যায়। যুবকেরা তখনও ভেবে পায় না—প্রিয়লেখা মূলত কী চেয়েছিল! তাদের মনে পড়ে, একদিন ভদ্রা পার্কের পুকুরঘাটে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে প্রিয়লেখা বলেছিল, ‘তোরা খুব ভাল রে। কিন্তু তোরা একা একা যেন অসম্পূর্ণ। যখন আলাদা করে তোদের ভাবি, কাছে পাই, আমার ভালো লাগে। তবে পুরোটা ভালো লাগে না। অতৃপ্তি হয়। যখন তোদের একত্রে ভাবি, একসঙ্গে আমার পাশে এসে বসিস, তখন বেশি ভালো লাগে। তৃপ্তি হয়। জানিস, তখন নিজেকেও আমার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। তোদের কাউকে আমি হারাতে চাই না, কাউকে না। আমি কী করি বল তো!’
অনেকদিন পরে কাজলায়, খালি চায়ের কাপে সিগারেটের ছাইয়ে ভরিয়ে ফেলতে ফেলতে যুবকেরা প্রিয়লেখার কথাগুলো মনে করে হাসে। আর তখন তারা তিনজন একটা যৌথ উপলব্ধিতে পৌঁছায়—প্রিয়লেখা ছিল অদ্ভুত! তিনটে অতি সাধারণ গ্রামীণ ছেলেকে নিয়ে প্রিয়লেখার এই সংকট ছিল অভিনব। এমনটা হবে সে কখনো কল্পনাই করেনি। শুরুতে যেটা ছিল স্রেফ খেলা, একটি কৈশোরিক সম্পর্কের ঊর্ণাজাল বোনার মতন আনন্দ, সেটা কবে একটা মনের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা হয়ে দৃঢ় হয়েছে সে বুঝতেই পারেনি। কিন্তু সে জানে তিনজন পুরুষকে একই সঙ্গে ভালোবাসার ব্যাপারটি স্বাভাবিক নয়। তবুও, সব বুঝেও প্রিয়লেখা এই তিনটি খুব আটপৌরে ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে একা থাকতে চায় না। তখন, পরিস্থিতির ঘেরাটোপে তরুণদের সঙ্গে সম্পর্কের অস্বাভাবিকতা তাকে জীবনের নতুন মোড়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। গ্রীষ্মের ছুটিতে রংপুরের বাড়িতে ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে যা আগে হয়নি, সেরকম অদ্ভুত অনভূতি হয়। বাড়িতে এলে আগে শৈশবের বন্ধুদের সঙ্গই ভালো লাগত তার। বন্ধুদের সঙ্গে নদীর পাড়ে বেড়াতে যেত। এবারের গ্রীষ্মের ছুটিতে এসে বন্ধুদের এড়িয়ে যায়। তিস্তার রেলব্রিজটার কাছে গিয়ে রেলগাড়ির প্রতীক্ষায় দাঁড়ায় না। কীসের যেন অভাব বোধ করে সে। কী যেন নেই কী যেন নেই—মনে হয় তার। রৌদ্রতপ্ত দিনে মায়ের সঙ্গে টেলিভিশনে কোনো একটি পুরনো দিনের সিনেমা দেখতে দেখতে তার মনে হয়—সে প্রেমে পড়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে তিনজনের প্রেমে পড়ার এই কথা সে মাকেও বলতে পারে না। সে বোঝে, তার এ প্রেম কেউ মানবে না। সব বুঝেও প্রিয়লেখা ভেতরে ভেতরে অধৈর্যে অস্থির হয়ে ওঠে। তরুণদের ছাড়া একেকটা দিন তার কাছে দীর্ঘ বছরের অপেক্ষা হয়ে আসে।
৪
কয়েসের টি-স্টলে বসে যুবকেরা স্মৃতিচারণ করে। গ্রীষ্মের সেই ছুটিতে তখনও ক্যাম্পাস খোলে নাই। তরুণেরাও ফিরেছে যার যার বাড়ি থেকে। কিন্তু ক্লাসে যাওয়া নেই। প্রিয়লেখা নেই। মেসবাড়ির দোতলার ঘরে শুয়ে তারা গান শোনে। রেডিয়ো কলোনির মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলে। গান শুনতে শুনতে বা চার বা ছয় মারার ফাঁকে ফাঁকে তাদের মনে প্রিয়লেখা উঁকি দেয়। প্রিয়লেখার মুখ কতদিন দেখেনি তারা! যুবকদের স্পষ্ট মনে পড়ে, প্রিয়লেখার অনুপস্থিতির বেদনা বয়ে বেড়ানোর সেই ছুটির এক দুপুরে হঠাৎ-ই অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এসেছিলো। দেশে তখন সবে মোবাইল ফোন এসেছে। ফোন সেন্টারে গিয়ে কথা বলা যায়। ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন খুব কম। বড়লোক মামার সূত্রে তরুণদের একজন একটা মোবাইল ফোনের মালিক হয়েছিলো। সিমেন্স কোম্পানির সেই নীল ফোনসেট দুপুরের চিকচিক করা রোদের ভেতর টিং টিং করে বেজে উঠেছিলো। অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ফোনটি মুহূর্তে তরুণদের পৃথিবী বদলে দেয়। ফোনে কথা বলে যে লোকটি সে ছিল বাংলাদেশ পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর। একজন পুলিশের সঙ্গে তরুণদের সেই প্রথম কথা বলা।
কয়েসের টি-স্টলের ঈষদুষ্ণ চা উষ্ণতা হারায়। কথা বলতে বলতে যুবকদের গলা ধরে আসে। মায়ের সঙ্গে বসে টেলিভিশনে পুরনো দিনের সিনেমা দেখতে দেখতে যেদিন বুঝতে পারে সে প্রেমে পড়েছে—সেদিনই ক্যাম্পাসে ফিরতে চেয়েছিল প্রিয়লেখা। কিন্তু নানারকম বাস্তব কারণে ইচ্ছে থাকলেও সেদিন ফেরা হয় না। তিনটি চিঠি লিখে ছোট ভাইকে দিয়েছিলো পোস্ট করার জন্য। তার ঠিক তিনদিন পর প্রিয়লেখা বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। ব্যাগ গুছিয়ে মাকে বলে, ‘যাই মা’। হয়তো ‘যাই’ কথাটি খুব দুর্ভাগ্যজনক। ফলে, ফেরার বাসটি রাস্তা দেখেশুনে, অপরাপর বাস, ট্রাক, মানুষজন এড়িয়ে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। বিপরীতগামী আরেকটি ট্রাক ঢুকে যায় বাসটির বুকের ভেতর। বাংলাদেশ পুলিশের ঐ অচেনা অফিসারটি তরুণদের ফোন করে বলে, ‘মেয়েটি আহত, তার ব্যাগের ভেতর থাকা নোটবুকে এই নম্বরটি পাওয়া গেছে, আমরা আপাতত মেয়েটিকে স্থানীয় হাসপাতালে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। আপনারা দ্রুত এসে ব্যবস্থা নিন। না হলে তাকে বাঁচানো কঠিন হবে।’ যুবকেরা কয়েসকে আরেকবার চা দিতে বলে। পুলিশের ফোনকলের স্মৃতি মনে করে দুঃখে কেঁপে ওঠে। সেই ফোনকলটি তাদের জন্য কী দুঃসংবাদই না নিয়ে এসেছিলো! পত্র-পত্রিকায় কত এ্যাকসিডেন্টের খবর তারা পড়ে, টেলিভিশনেও দুর্ঘটনায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়ি দেখে। কোনোদিন সেসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তরুণেরা জীবনে প্রথমবার নতুন এক অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। হাসপাতাল, ওষুধ, অপারেশন, মৃত্যুর গন্ধে ছেলেরা বোঝে জীবন ফুলশয্যা নয়। তারা অনুভব করে জীবন এক বহতা নদী—টাইম এন্ড টাইড ওয়েইট ফর নান। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে প্রিয়লেখাকে ট্রান্সফার করা হয় ঢাকার একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে। তরুণেরা তখন কয়েকটা এমন দিন কাটায়, কখন রাত কখন দিন সেই স্মৃতিও তারা হারিয়ে ফেলে।
তবুও সব ব্যর্থ হয়ে যায়। হাসপাতালে প্রিয়লেখা আর চোখ মেলে দেখে না। প্রিয়জনেরা তার জন্য কী আকুল প্রতীক্ষায় আছে—সেসব দেখার জন্য সে আর তাকায় না। সিনেমা-নাটকে যেমনটা দেখা যায়, ভাবলেশহীন গলায় ডাক্তার যেভাবে বহুশ্রুত ইংরেজি শব্দটি বলে, যার বাংলা অর্থ দুঃখিত। প্রিয়লেখার অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাক্তার একই শব্দ উচ্চারণ করে।
৫
যুবকেরা জানতো না এই মনোটোনাস শহরে তারা এত দীর্ঘদিন থেকে যাবে। প্রিয়লেখার সঙ্গে এই শহরে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। তারা ছিল তখন নিতান্ত কুঁড়ি, অস্ফুট ফুল। প্রিয়লেখা দিনের পর দিন জল ঢেলে সে কুঁড়ি ফুটিয়েছিলো। এই শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়াত সে। নিঃশ্বাস নিতো এই শহরের। তাই চাইলেও তরুণেরা এ শহর ছেড়ে যেতে পারে না। জীবন যদিও জীবনের নিয়মেই চলে। তরুণদেরও বয়স বাড়ে। একসময় বিয়ে করে সংসারী হয়। চাকরি করে, অবসরে আড্ডা দেয়। বুকের ভেতর শূন্যতা জুড়ে তবু অশরীরি প্রিয়লেখা বাস করে। প্রিয়লেখা যেভাবে চেয়েছিলো তেমনটা হয় না। তার আগেই সে স্মৃতি হয়ে যায়। কিন্তু যাপিত জীবনে নিজেদের গভীর মনে ডুব দিয়ে যুবকেরা বোঝে, প্রিয়লেখার চাওয়া মিথ্যে হয়নি।
টি-স্টলের আড্ডায় তিন নম্বর চা আর সিগারেট শেষ হতে হতে যুবকদের মনে পড়ে, ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তার যখন গম্ভীরভাবে নির্মম সত্যটি উচ্চারণ করেছিল, হাসপাতালের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে হু হু করে কেঁদেছিল তারা। তারপর সবকিছু হারিয়ে যুবকেরা ফিরেছিল নিজেদের শহরে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও শূন্য হয়ে। নিজেদের মেসবাড়ি কল্লোল ছাত্রনিকেতনের দোতলার ঘরে ঢুকে তিনজনই একটি করে হলুদ খামের চিঠি পেয়েছিল। গোটা গোটা অক্ষরে তাদের নাম-ঠিকানা লেখা। হাতের লেখাটি তাদের চেনা। চেনা হস্তাক্ষর ভিজেছিলো তাদের চোখের জলে। চিঠি ছিল আলাদা আলাদা। মাত্র এক লাইনের চিঠি। কিন্তু প্রতিটি শব্দ তরুণেরা সারাজীবন ব্যথার মত লালন করে।
গোটা গোটা অনবদ্য অক্ষরে প্রিয়লেখা লিখেছিলো, ‘তোকে ভালোবাসি, তোর কাছে আসছি।’