
খেলাঘর : বিচ্ছিন্ন জীবনের আখ্যান
[বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম মাহমুদুল হক (ডিসেম্বর ১৬, ১৯৪১-জুলাই ২২, ২০০৮)। জীবন আমার বোন, অনুর পাঠশালা, নিরাপদ তন্দ্রা, কালো বরফ উপন্যাস এবং খেলাঘর ও প্রতিদিন একটি রুমাল এর মতো গল্পগ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের অসাধারণ শক্তিমত্তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বাংলা ভাষায় তিনি বিবেচিত হন অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক হিসেবে। মাহমুদুল হক মূলত মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে জটিল সমাজ বাস্তবতার মধ্যে মধ্যবিত্তের নানা টানাপোড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন তার যাদুকরী ভাষাশৈলীতে। আজ এই প্রখ্যাত কথাশিল্পীর প্রয়াণ দিবসে প্রতিকথার পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে মাহমুদুল হকের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে প্রকাশ করা হল চারটি মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ। লিখেছেন- কবি ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ, কথাসাহিত্যিক আবু হেনা মোস্তফা এনাম, গবেষক নূর সালমা খাতুন, ও প্রাবন্ধিক মনোজ দে। -সম্পাদক]
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মাহমুদুল হক (১৯৪১-২০০৮) একটি বিশিষ্ট নাম। এই জনপদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, সামাজিক জীবন ও আবহমান সংস্কৃতি-চেতনাকে অঙ্গীকৃত করে ষাটের দশকের বাংলা সাহিত্যে সাড়ম্বরে আত্মপ্রকাশ করেন মাহমুদুল হক। ১৯৫৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত লেখকজীবনে কখনও স্বল্প কখনও দীর্ঘ বিরতি দিয়ে নিয়মিতভাবে লিখে যান তিনি। কবিতা, সনেট, শিশুসাহিত্য রচনা করলেও নিবিড় মনোযোগ দেন গল্প আর উপন্যাস রচনায়। একটি কিশোর উপন্যাসসহ নয়টি উপন্যাসের স্রষ্টা মাহমুদুল হক।
তাঁর উপন্যাস নিছক কাহিনীর উপস্থাপনা নয়, তিনি বেছে নেন চরিত্রের ভেতরের অন্তর্কথনকে অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক হৃদয়বৃত্তির উদ্ভাসন ঘটান লেখায়। জীবন সম্পর্কে মাহমুদুল হকের ঘোষণা, ‘জীবন অনেক বিরাট ব্যাপার, বিশাল তার অবয়ব। কিন্তু একটা স্টেজে এসে প্রত্যেক মানুষই আবিষ্কার করে সে ব্যর্থ।’ [হোসনে আরা কামালী] এরকম দার্শনিকবোধে সিক্ত মাহমুদুল হক মনে করেন জীবনের খণ্ডিত রিপুগুলো এসেছে তাঁর উপন্যাসে এবং জীবনের বড় ঢেউয়ের চেয়ে ছোট ঢেউগুলোকে তুলে ধরেছেন লেখায়। [লতিফ সিদ্দিকী] এক নিস্পৃহ নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ’৪৭-এর দেশবিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের জটিল জীবনকে রূপায়িত করেন মাহমুদুল হক। তিনি সমাজ-সময়-সমকাল-দেশ-রাজনীতি সবকিছুকেই লেখার বিষয়বস্তু করেন। এতে ভিন্নতা নেই বললেই চলে। তবে ভিন্নতা রয়েছে অন্যখানে, সেটা হলো দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি জীবনকে দেখেন সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে, গভীর অনুসন্ধানী মন নিয়ে। আর লেখায় ফুটিয়ে তোলেন ব্যক্তির মনোজগতের রহস্যময়তা, হৃদয়ের টানাপোড়েন, সমাজের অনেক অনভিপ্রেত সত্যকে। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ (১৯৭২), ‘খেলাঘর’ (১৯৭৮), ‘অশরীরী’ (১৯৭৯) এই তিনটি উপন্যাসে উঠে এসেছে।
মাহমুদুল হকের ক্ষীণকায় উপন্যাস ‘খেলাঘর’। এই উপন্যাসে প্রতিটি অধ্যায়ের কাহিনীর সাথে সঙ্গতি রেখে নামকরণ করা হয়েছে। প্রায় সরলরৈখিক আখ্যানের এই ক্ষীণকায় উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা হলেও মুক্তিযুদ্ধ এখানে কেন্দ্রীয় বিষয় নয়। বরং মুক্তিযুদ্ধ একজন নারীর জীবনে যে ভয়াবহ ছায়া ফেলে- এটাই আখ্যানে প্রাধান্য পেয়েছে।

এই উপন্যাসে প্রতিটি অধ্যায়ের কাহিনীর সাথে সঙ্গতি রেখে নামকরণ করা হয়েছে। খেলাঘর-এর আখ্যানভাগ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের। রেহানা ওরফে ঝুমি ওরফে আন্না ওরফে গাব্বু ওরফে টেঁপি ওরফে লতা নাম্নী মেয়েটি ঢাকা ছেড়ে ইছাপুরা গ্রামে আসে আরো কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে। সেখান থেকে মিঠুসারের আদিনাথের ভিটেয় উঠে চাচাতো ভাই টুনুর বন্ধু বেসরকারি কলেজের শিক্ষক ইয়াকুবের সাথে। গ্রামীণ প্রকৃতি তার সমস্ত উদারতা, চপলতা, স্নিগ্ধতা আর মায়া নিয়ে ঘিরে রাখে বহু বছরের পুরনো আদিনাথের ভিটে। সেখানেই স্বপ্নের খেলাঘর গড়ে তোলে রেহানা, ইয়াকুবের সঙ্গে। প্রকৃতির অকৃত্রিম স্নিগ্ধতায় যখন তাদের খেলাঘর ভালোবাসার স্পর্শ পেতে শুরু করে ঠিক তখন আচমকা এক ঝড় এসে শেকড়সমেত তা উপড়ে ফেলে। বিষণ্ন রেহানা একবারও ভেঙে যাওয়া খেলাঘরের দিকে পিছু ফেরেনি। কিন্তু একরাশ কষ্ট নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে যায় ইয়াকুব। তার হৃদয়ে মাঝরাত্রির ঘন অন্ধকার নেমে আসে, সাথে সাথে পাঠকের হৃদয়েও। আদিনাথের ভিটেয় একা ইয়াকুব দেখে ‘সারা বারান্দায় আন্নার পায়ের ছাপ। ইচ্ছে হয় ওর ওপর গাল পেতে শুয়ে থাকি। সবকিছু ফাঁকা মনে হয়। ঝোড়ো বাতাস শূন্য কোঠায় হাহাকার করে। মনে হয় প্রতিটি গাছ সজল চোখে বিধ্বস্ত বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে।’
বাড়িটা বিধ্বস্ত হয়, খেলাঘর ভেঙে যায়, উপন্যাসের শেষের দিকে টুনু জানায় রেহানা স্বদেশভূমিকে দান করেছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ঢাকায় এক হোস্টেলে থেকে পড়তো রেহানা, লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে পাকবাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর কোনো এক ভোরবেলায় রাস্তা থেকে তুলে রেহানাকে কেউ হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। সেখান থেকে চাচাতো ভাই টুনু এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সাহায্যে তাকে উদ্ধার করে। এই দুর্ঘটনার পর থেকে রেহানা বারবার ফিরে যায় অতীতে, অর্থাৎ তার শৈশবে। ইয়াকুব কিংবা পাঠক কেউই অনর্গল কথা বলে যাওয়া মেয়েটিকে দেখে বোঝে না সে ভেতরে ভেতরে কতটা বিধ্বস্ত। বারবার নস্টালজিয়ায় ভোগে রেহানা। নিজের ডাক নাম, খেলার সাথীরা তার কথায় উঠে আসে :
“দাদাভাই ডাকতো ঝুমি, দিদামণি ডাকতো আন্না, মামা ডাকতো গাব্বু, স্কুলের মেয়েরা ডাকতো টেঁপি, সখী পাতিয়েছিলাম একজনের সঙ্গে, সে নাম দিয়েছিল লতা। আমি তার নাম দিয়েছিলাম পাতা। দু’জনকে একসঙ্গে দেখলে কেউ কেউ ছড়া কেটে বলতো, লতাপাতা যায়, ফিরে ফিরে চায়। পাতাটা ছিল ভারি মুখ ফোঁড়, ও বলতো লতাপাতা যায়, গরু পিছে ধায়। . . . আমাদের ক্লাসের একটি ছেলের নাম ছিল বাবু। বাবুদের বাড়িতে ছিল ফলশা গাছ। আমি আর পাতা বাবুর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলাম, যা ভালোবাসতাম ফলশা!”
রেহানার শৈশবের অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে দাদাভাই আর দিদামণি। বাবা-মা নেই। টুনুর কথায় জানা যায় সে বংশের একমাত্র মেয়ে। যখন ও কোলের, মা অন্যের সাথে ঘর বাঁধে আর লজ্জায় বাবা আত্মহত্যা করে। দাদা-দাদির কাছে মানুষ। তাই তার অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দাদাভাই আর দিদামণি তাদের সমস্ত কোমলতা নিয়ে হাজির :
“ফুলের সময় রোজ আমি দাদাভাইকে মালা গেঁথে পরাতাম। দাদাভাই গলা বাড়িয়ে দিয়ে বলতো, দে দে, যত দিবি তত পাবি, . . . ফুলের মালা দিলে ফুলের মালা পাবি, জীবন ফুলের মতো হবে, ঝলমল করবে, হাসিখুশি থাকবে, সুগন্ধে ভুরভুর করবে; . . .।”

দাদাভাইয়ের আশীর্বাদ রেহানার জীবনে পুরোটা ফলে না। ফুলের মতো তার জীবন হয়। কিন্তু ঝলমল করতে পারেনি, হাসিখুশি থাকতে পারেনি, সুগন্ধও ভুরভুর করেনি। বরং তার জীবন হয় অন্তঃসারশূন্য, অর্থহীন, গন্ধহীন শুকনো ফুলের মতো, বোঁটায় লেগে আছে কিন্তু ঝরে পড়ার অপেক্ষায়। বিষণ্ন দেশ তার কাছ থেকে সমস্ত সুগন্ধ, হাসি আর আলো ছিনিয়ে নেয়। যুদ্ধাক্রান্ত এই নারী নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেয় আপাতভাবে। কিন্তু তার চেতনাতেও একটা যুদ্ধ-বিরোধী বোধ কাজ করে। ইয়াকুবকে সে বলে, ‘আসল ঝগড়া দেখলে ও-কথা তুলতে না, ঝগড়া কাকে বলে জানো-ই না। গোলা-বন্দুক-বারুদ ছাড়া আবার ঝগড়া চলে নাকি; আর তো সব ঝগড়া-ঝগড়া খেলা!’ ঝগড়ার নামে যুদ্ধের কথাই আসলে বলে। কেননা ঝগড়ার ভয়াবহতা তাকে প্রায় ধ্বংসের কাছে নিয়ে যায়। মানুষ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কখনো সাহসী হয়ে ওঠে কখনো বা নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেয়। রেহানা দ্বিতীয় কাজটা করে। এর প্রকাশ ঘটে তার শুয়ে পড়ার ভঙ্গিতে। যেমন : ‘প্রথমে পা লম্বা করে শুলেও দেখতে-না-দেখতে এক সময় দীনদুঃখীর মতো কেমন যেন দলামোচড়া হয়ে যায়; অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে।’ কিন্তু যুদ্ধের বীভৎসতাও তার চেতনায় আছে। কবিরাজবাড়িতে সে যখন আশ্রয় নিয়েছিলো ঢাকা থেকে ফিরে, তখনকার একটা ঘটনা সে ইয়াকুবকে শোনায়। ‘কি বিচ্ছিরি বিড়ালগুলো, কালকে করেছে কি একটা টুনটুনি পাখি ধরে বাতাবিলেবু-গাছতলায় বসে দিব্যি আয়েস করে তাকে জ্যান্ত ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খেলো, মাগো।’ তাই চেতনায় সক্রিয় এই নারী মাহমুদুল হকের অন্য চরিত্রের মতো কমবেশি নস্টালজিয়ায় ভোগে। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব এই নারী বিমুগ্ধ শৈশবের স্বপ্নময় দিনগুলোতে ডুবে থাকতে চায়। মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি করে রচনা যেহেতু ‘খেলাঘর’, তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসে তবে যুদ্ধের ভয়াবহতা বর্ণনার দিকে লেখকের আগ্রহ কম। টুনুর চিঠি এবং কথায়, মুকুলের বাস্তব অভিজ্ঞতায় যুদ্ধের খণ্ডচিত্র দেখানো হয়। যেমন :
“কাউলকা তালতলা ঘাটের ক্যাম্পডারে অক্করে মেছমার কইরা দিয়া গ্যাছে ভূতেরা। সব কয়টারে অক্করে ছিদ্রি ছিদ্রি কইরা দিয়া গ্যাছে’ হাত-পা নেড়ে প্রবল উৎসাহে মুকুল কথার খৈ ফোটাতে থাকে, ‘বাহিরঘাটার দিক থিকা আয়া অক্করে তুলকালাম কাণ্ড বাজায়া গ্যাছে ভূতেরা, রাজাকার-ফাজাকার মিলিশিয়া-ফিলিশিয়া ব্যাক ফিনিশ!”
ইয়াকুব কিন্তু এই সংকটকালেও নিস্পৃহ। নিজের ছেঁড়াখোঁড়া জীবন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সে বাইরের পৃথিবীর আগুনঝরানো ঘটনা তাকে ছুঁয়ে গেলেও মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারে না। কিন্তু একটা রয়ে যায় তারপরেও। রেহানার দুর্ঘটনার বিবরণ টুনুর কাছে শুনে ইয়াকুবের ভাবনা এরকম, ‘সবকিছু তেতো হয়ে যায়। মনে হলো এই মুহূর্তে টুনু করাচি পুলিশের চেয়েও খারাপ।’ এই অন্তর্দহনও কম নয়। আর বেশি কিছুর প্রয়োজনও পড়ে না একটা চরিত্রের মনোজগতের হদিশ পাওয়ার জন্য। মুকুলের কাছে সশস্ত্র সংগ্রামের বাস্তব বর্ণনা শুনে উপন্যাসের শেষ বাক্যটিতে ইয়াকুব বলে, ‘দেখছি সবকিছুই।’ সময়টাই তেমন, ইচ্ছে করলেও চোখ বন্ধ করে থাকা যায় না। যুদ্ধ কোনো না কোনোভাবে সবাইকে আক্রমণ করে। এর ধ্বংসের স্পর্শ কাউকে না ছুঁয়ে যায় না। মাহমুদুল হক সেটাই দেখাতে চান। তিনি ইঙ্গিতময় উপস্থাপনায় মুক্তিযুদ্ধকে গেঁথে দেন নর-নারীর জীবনে। তাইতো রেহানার দেয়া ঝগড়ার ব্যাখ্যার মধ্যে যুদ্ধ আসে নান্দনিকভাবে। এভাবেই মাহমুদুল হক ইতিহাস, সময়কে একসূত্রে রেখে শিল্প তৈরি করেন। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কিছু সাহসী তরুণের জীবনপণ করার প্রসঙ্গ যেমন আসে ঠিক তেমনি সেসব মানুষের কথাও আসে যারা একটু তফাতে থেকে সবকিছু দেখে, গল্প করে উত্তপ্ত আগুনের। কিন্তু আঁচ লাগতেই নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। ইয়াকুবের আত্মসমালোচনাতে উঠে আসে, ‘এই আমার মতো হাত-পা-গোটানো উদ্যমহীন কাতর মানুষজনের সংখ্যাই তো বেশি।’ হ্যাঁ, যুদ্ধের সময় সবসময় একটা শ্রেণি সকলের নিরাপত্তার জন্য সাহসী হয়ে ওঠে যেমন ঠিক তেমন এর বিপরীত ঘটনাও ঘটে। মাহমুদুল হকের জহুরির চোখে কোনোকিছুই বাদ যায় না, শেকড়সমেত উঠে আসে। মুক্তিযুদ্ধ তার সব ভয়াবহতা আর সংকট নিয়ে হাজির হলেও মাহমুদুল হক শেষ পর্যন্ত নিস্পৃহ ব্যক্তিহৃদয়ের রক্তক্ষরণকেই বহু তাৎপর্যে উপস্থাপন করেন। এই আখ্যানের প্রাণ রেহানার সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত কথাবার্তা। কিন্তু শেষে এসে যখন পাঠক তার অপ্রকৃতিস্থতার খবর জানে তখন গল্পের মোড়ই পাল্টে যায়। গল্পের বিবর্তন মাহমুদুল হকের শিল্প নির্মাণের অন্যতম কৌশল। তাই পাঠক মনোযোগী না হলে সেই বিবর্তনের সাথে সাথে এগুতে এবং মাহমুদুল হকের বিশেষত্বকে আস্বাদন করতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত মাহমুদুল হকের ‘খেলাঘর’ পড়ে পাঠক হৃদয়ে অনুরণিত হয় এক অসঙ্কোচ, অপাপবিদ্ধা নারীর দেশকে সব দিয়ে, নিঃস্ব হয়ে, শৈশবের আশ্রয়ে নিজেকে সঁপে দেয়ার চেষ্টার নিঃশব্দ লড়াই। রেহানা ফিরে যায় টুনুর সাথে- ইয়াকুব বা স্বপ্নের খেলাঘরকে একবারও পিছু না দেখে। আসলে সে ভুলে যেতে চায় দুর্ঘটনাকে। কেননা, এই অপাপবিদ্ধা নারী চলেছে আগামীর আরেকটি স্বপ্নের খেলাঘর গড়তে যদি তার প্রিয় স্বদেশ সে সুযোগ তাকে দেয়।

‘খেলাঘর’ একটি সরলরৈখিক উপন্যাস। এই আখ্যানের বিবরণদাতা উত্তম পুরুষ। লেখক নিজে নবম অধ্যায়ে দুইবার সরাসরি পাঠকের সামনে উপস্থিত হন। কাহিনী উপস্থাপনায় সক্রিয় বিবরণরীতি এবং ফ্লাশব্যাক পদ্ধতি দুটোই ব্যবহার করা হয়। কাহিনী বর্ণনায় নাট্যানুগ পদ্ধতিরই প্রয়োগ আছে। কাহিনীর প্রারম্ভ বিকাশ এবং ক্লাইম্যাক্স ও পরিসমাপ্তি রয়েছে। রেহানা আর ইয়াকুবের একসাথে আদিনাথের ভিটেতে খেলাঘর পাতে। তারপর তাদের মধ্যে একটা সম্পর্কের সূত্রপাতের পরপরই রেহানার দুর্ঘটনার সংবাদ এবং খেলাঘর ভেঙে তার চলে যাওয়া আরেক গন্তব্যে। এই আখ্যানে সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি উপস্থাপিত হয় যদিও লেখকের অভীষ্ট লক্ষ্য রেহানার চরিত্রের বিকাশ বা তার সঙ্গে যুদ্ধের সম্পৃক্ততার বিষয়টিকে দেখানো। আখ্যানভাগ একরৈখিক হলেও বারবার রেহানার শৈশবের বিবরণ উপস্থাপন করা হয় এবং এর সাথে তার বর্তমান জীবন একই সমান্তরালে সংযুক্ত হয়। আখ্যানের তৃতীয় অধ্যায়ে প্রায় চার পৃষ্ঠা জুড়ে রেহানা ক্রমাগত শৈশবের কথা বলে যায়, যার সাথে ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ উপন্যাসের হিরনের মিল রয়েছে। অন্যদিকে রেহানার স্বতঃস্ফূর্ততা, কথার তুবড়ি ছোটানো ‘অনুর পাঠশালা’ উপন্যাসের সরুদাসীকে মনে করিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি করে লেখা হলেও উপন্যাসটি আসলে ব্যক্তিমানুষের জীবনাবেগকেই ছুঁয়ে যায়। এবং মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তির সহজ সরল প্রাণবন্ত জীবনকে কীভাবে বিষময় করে সেটা দেখানোই লেখকের উদ্দেশ্য। আখ্যানভাগ প্রলম্বিত হয়নি। ঠাসবুনোটে বাঁধা একটা গল্প নাটকীয় সংলাপের মধ্য দিয়ে ছবির মতো অঙ্কিত হয়। এই উপন্যাসের মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা বিষয়ের পাশাপাশি গ্রামীণ নিবিড় নিস্তরঙ্গ এবং স্নিগ্ধ কোলাহলমুক্ত একটা জীবনকে তার ভিন্নধর্মী আবেগসহ প্রকাশভঙ্গিতে আলাদাভাবে উপস্থাপনে বেশ দক্ষতার প্রকাশ ঘটে। রেহানার সংলাপে যে সাবলীলতা, স্বতঃস্ফূর্ততা, জীবনের যে সাড়ম্বর উপস্থিতি তা বাংলা সাহিত্যে অনন্যসাধারণ। এই উপন্যাসটি অনেক সমালোচকের কাছেই বেশ সুখপাঠ্য এবং প্রিয় অভিধা পায় শুধু এর মন ছুঁয়ে যাওয়া গদ্যভাষার জন্য। তবে এই উপন্যাসের দুএকটা চরিত্র, নৌকা ভ্রমণ, মাঝির প্রসঙ্গ- এসব আগের উপন্যাসগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়। আর ইয়াকুব চরিত্রের মনোগঠনে খোকা চরিত্রের ছায়াও পরিলক্ষিত হয়। তবে রেহানা বা আন্না বা ঝুমি স্বতন্ত্র এবং একক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
এই উপন্যাসে মাহমুদুল হক-
ইয়াকুব ও রেহানার দুদিনের খেলাঘর রচনা করেছেন। প্রায় অবিশ্বাস্য বাস্তবতা দিয়ে, নিয়তি-কঠিন সারল্যে, মুক্তিযুদ্ধের বাইরে ক্ষণিকের শান্তিদ্বীপে ঢাকার আঞ্চলিক জাদুকরী সরল ভাষার কথোপকথন দিয়ে। প্রকৃতির গভীর গভীর বাড়ির ভেতরে সকল আয়োজন ও আবহ শেষ পর্যন্ত আমাদের মায়াজালের বন্দিশিবিরে আচ্ছন্ন করে রাখে। যুদ্ধের ভেতরে যুদ্ধবিরোধী চেতনায় আন্দোলিত অথচ সুস্থির চরিত্র আন্না। [বিপ্রদাশ বড়ুয়া]
আর এই যুদ্ধবিরোধী চেতনার মধ্যেই লেখকের জীবনদর্শনও নিহিত থাকে। উপন্যাসের শেষে বা আখ্যানে আগের উপন্যাসের মতোই তেমন কোনো রহস্যময়তা নেই। উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখিত হলেও এখানে ঘটনার চেয়ে ব্যক্তিচরিত্রের বিকাশেই লেখকের মনোযোগ নিহিত। মুক্তিযুদ্ধকে এক ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয় এখানে। যা শুধু লেখকের স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ বা শিল্প ভাবনার সফল প্রয়াস নয় তার পাশাপাশি ইতিহাসকে সাহিত্যে তুলে ধরার এই প্রকরণশৈলী সমগ্র বাংলা সাহিত্যে এক ভিন্নধর্মী মর্যাদার দাবি রাখতে পারে অনায়াসেই।
পেশায় স্বর্ণ-ব্যবসায়ী মাহমুদুল দক্ষ জহুরির মতো নিখুঁতভাবে গড়ে তোলেন তাঁর উপন্যাসের কাঠামোকে। আর তাঁর গভীর জীবনবোধ, ব্যক্তি, সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতিকে দেখার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বিশিষ্ট বাগবৈদগ্ধ্যের মাধ্যমে বাস্তবের পুনর্নির্মাণ হয় উপন্যাসে অসাধারণভাবে। তাঁর লেখা নিয়ে জনৈক সমালোচকের মন্তব্য :
‘মাহমুদুল হক তাঁর আখ্যানভাগের মাধ্যমে পাঠককে আমন্ত্রণ জানান তাঁর পাত্রপাত্রীর অভিজ্ঞতার চেয়েও গভীরতর কোনো অভিজ্ঞতায় অংশগ্রহণ করতে। তাঁর মানব-মানবীরা আমাদের মধ্যে এমন এক অনুভূতি সঞ্চারিত করে যা অংশত শারীরিক এবং অধিকাংশটুকু উপলব্ধির সারাৎসার, যেখানে নিজের দিকে চেয়ে তাকানোর ফুরসত মেলে। শুধু তাই নয় সমস্ত পরিকল্পনার মধ্যে শব্দ ও সঙ্গীতের এমন একটি অনুরণন সর্বদাই উপভোগ করা যায় যেখানে বিটোফেনের সিম্ফনিগুলোর মতো সকল অনৈক্যের মুখ ফেরানো থাকে ঐক্য ও সংহতির দিকে। মাহমুদুল হকের আখ্যান-পরিকল্পনায় এই ঐক্য ও সংহতি এবং সমগ্রতার আস্বাদ বাংলা কথাসাহিত্যে নতুন এক পরিপ্রেক্ষিতের সম্ভাবনা নির্দেশ করে। এবং সেই জগৎ আমাদের চিরপরিচিত হয়েও অচেনা এক রহস্যজালে, অব্যাখ্যাত এক মমত্ববোধে এবং মধুর এক নৈঃসঙ্গ্যের যন্ত্রণার সীমা-পরিসীমায় আমাদের পৌঁছে দেয়।’ [সরকার আবদুল মান্নান]
সমালোচকের এই বিশ্লেষণের সাথে আমরাও এক মত। মাহমুদুল হক যেখানে তাঁর লেখা শেষ করেন সেখান থেকে পাঠকের আরেক নতুন ভুবনে যাত্রা শুরু হয়। কারণ তাঁর আখ্যান রহস্যময়তাকে ধারণ করে এবং চরিত্রের মনের গহীনে আলো ফেলে এক দুর্জ্ঞেয় জগতের উন্মোচন করে। তাই পাঠকের বোধের জায়গাটাতে অনুরণন তোলে স্বাভাবিকভাবেই। তাঁর শিল্পজগতে প্রস্তুতি নিয়েই প্রবেশ করতে হয় পাঠককে, কেননা মনোযোগ শতভাগ না থাকলে তিনি কী বলেন আর কীভাবে বলেন এই দুটো দিককে একসাথে ধারণ করা কঠিন হয়ে যায়। আর একসাথে ধারণ করতে না পারলে রসভঙ্গ ঘটার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। মাহমুদুল হকের আপাত বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ বিষণ্ন এবং স্মৃতিকাতর চরিত্রগুলোর সাথে পাঠকও কোনো-না-কোনোভাবে জড়িয়ে পড়ে। আর তখন তৈরি হয়ে যায় লেখার সাথে পাঠকের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আর মাহমুদুল এই সম্পর্ক তৈরির কৌশলটা খুব ভালোভাবেই জানেন। তাঁর অসাধারণ গদ্যশৈলী আর গভীর, সূক্ষ্ম জীবন ও সমাজবীক্ষণ এই সম্পর্ক তৈরির মৌল সূত্র।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি :
- হোসনে আরা কামালী, ‘মাহমুদুল হকের উপন্যাস : জীবনোপলদ্ধির সত্য উদ্ঘাটন’ (এম.এ. থিসিস, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৬)
- লতিফ সিদ্দিকী গৃহীত সাক্ষাৎকার, ‘যে ভাষা নিয়ে আমরা খেলছি আজ তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে একটি রক্তস্নাত রাষ্ট্র’, লতিফ সিদ্দিকী সম্পা., রোদ্দুর, ১ম সংখ্যা (নভেম্বর ১৯৯২), সংকলিত, আহমাদ মোস্তফা কামাল সম্পা., হিরণ্ময় কথকতা মাহমুদুল হক স্মরণে, ঢাকা, শুদ্ধস্বর, ২০১৩।
- বিপ্রদাশ বড়ুয়া, ‘খেলাঘর আন্না প্রকৃতি মাহমুদুল হক’, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক ও আবু হেনা মোস্তফা এনাম সম্পা., আলোছায়ার যুগলবন্দি মাহমুদুল হক স্মরণে, ঢাকা, সাহিত্য প্রকাশ, ২০১০।
- সরকার আবদুল মান্নান, ‘মাহমুদুল হকের উপন্যাস : আখ্যান-ভাবনা’, আলোছায়ার যুগলবন্দি মাহমুদুল হক স্মরণে, প্রাগুক্ত।
অলংকরণ- মারুফ ইসলাম