
খলিল দারোগার হাঁচি
‘হাঁচির সাথে ভুল করে প্রাণ বেরিয়ে গেছে খলিল দারোগার বা হাঁচির সাথে খলিল দারোগা ভুল করে জীবাণু বের করার পরিবর্তে জীবন বের করে দিয়েছে’ একথা বা এ ধরনের কথা খলিল দারোগার অফিসের এক কন্সটেবলের মুখ থেকে প্রথম বেরয়। বেরিয়ে গিয়ে সাথে সাথে মানুষের কানে কানে ঢুকে গেল আর সাথে সাথে চোখ আর মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল। কান দিয়ে ঢুকে চোখ দিয়ে যখন বের হচ্ছিল তখন চোখগুলো মানুষের একটু বিস্ফোরিত হচ্ছিল। এ থেকেই বোঝা গেল শ্রবণীত কথার অর্ধাংশ লোকটির চোখ দিয়ে বের হলো এবং মুখ দিয়ে যখন প্রায় শব্দ বের হলো ‘ও’ তখন বোঝা গেল কথার বাকি অর্ধাংশ মুখ দিয়ে বের হয়ে এলো।
‘হাঁচির সাথে ভুল করে প্রাণ বের করে দিয়েছে খলিল দারোগা।’ এই কথাটি বা এরকম কথাটি মানুষের কান দিয়ে ঢুকে দুভাগ হয়ে শ্রবণীত মানুষের চোখ আর মুখ দিয়ে দুভাগ বের হয়ে গেলে বাতাসের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কথাগুলোকে জোড় দিয়ে দিয়ে বাতাসকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছিল। খলিল দারোগা নিজের ব্যাপারে ভুল করার লোক না, তারপরেও হাঁচি দিতে গিয়ে হাঁচির সাথে প্রাণটাকেই বের করে দিবে এমন কথা শুনে সকলেই আশ্চর্য হয়।
আমি যখন কথাটা শুনি তখন আমি হলদার পাড়ার যে প্রৌঢ়া মহিলা প্রতিদিন রণার দোকানের সামনে কলা বেচে তার থেকে কলা কেনার জন্য গেছিলাম আর পূর্বের লোকটির কলা কেনা শেষ হলে আমি কলাওয়ালির দিকে আর তার কলার দিকে তাকানোর সময় খেয়াল করি, সে নিচ দিকে অর্থাৎ কলার ডালির দিকে তাকিয়ে কলাতে উপরোক্ত কথা অর্থাৎ ‘হাঁচির সাথে ভুল করে খলিল দারোগা জীবন বের করে দিয়েছে’ এই কথাটি বা এরকম কথা সমস্ত কলার গায়ে লাগাচ্ছে। এমন কি আমার সাথে কলার দরদাম করা এবং কলা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দেবার সময়ও তাই করছিল। সে কী কথা কলার গায়ে লাগাচ্ছে, তা বুঝতে পারছিলাম না তাই কলাওয়ালিকে বললাম- ‘এভাবে কলার গায়ে কথা না লাগিয়ে আমাকে বলত বাপু, ব্যাপারটা কি?’ তখন প্রৌঢ়া চমকে আমার দিকে তাকায়। সে যে কলার গায়ে কথা লাগাচ্ছে সেটা যে আমি দেখে ফেলেছি বা বুঝে ফেলেছি তা সে বুঝতে পারেনি। সে মনে করেছিল, বিষয়টা আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু যখন বুঝতে পারল তখনই সে চমকে উঠল। আমার ঐ কথা বলা আর তার ফলে তার চমকানোর সময়, একটা মুহূর্তের দৃশ্য এমন হলো- আমার ব্যাগটা হা হয়ে আছে কলা ভেতরে নেবার জন্য, কলাসহ তার হাতটি স্থির হয়ে আছে হা হওয়া ব্যাগের ঠিক হায়ের উপর আর আমার কথা শুনে তার মুখ হা হয়ে গেছে আর সে হা মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ব্যাগের হা আর তার মুখের হা আর মাঝখানে কলার ছড়িসহ তার স্থির হাত। এমন মুহূর্তটি শেষ হলে সে নড়েচড়ে ওঠে, কলার গা হতে তার মাখানো কথাটি উঠিয়ে নেয় আর আমাকে বলে- ‘শুনলাম হাঁচির সাথে খলিল দারোগা ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে, খলিল দারোগার খোসা পড়ে আছে থানার যে ঘরে সে বসে সে ঘরে।’ কথাটি আমার কান দিয়ে ঢুকার সাথে সাথে দুভাগ হয়ে চোখ আর মুখ দিয়ে বের হয়ে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু আমি তা হতে দিই না।
বাড়ি ফিরে যায় আর আমার স্ত্রীর হাতে বাজারের ব্যাগটি দিই। আমার বউয়ের হাতটি চুরি করে ছুঁয়ে দিই যাতে মনে হতে পারে, আমি ছুঁয়ে দিয়েছি অনিচ্ছাকৃতভাবে। নতুন প্রেমিক তার প্রেমিকার হাত বা শরীরের যে কোনো অংশ এভাবে ছুঁয়ে দেয়। আমার বউ চমকে যায় এই জাতীয় ছোঁয়াতে এবং আমার দিকে অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকায়। আমি তার হাতটা ছুঁয়েছিলাম প্রেমিক হবার জন্য নয়, হয়ত আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমি বেঁচে আছি।
পড়ার ঘর থেকে আমাদের বড় ছেলে টেন পড়ুয়া বাসেদুর বেরিয়ে আসে আর তার মায়ের হাতের ব্যাগ থেকে কলার ছড়ি থেকে একটা কলা ছিঁড়ে নিয়ে ছুলে ফেলে এবং একটা কামড় দিয়ে গিলে ফেলার সময় কথা বলে উঠে। কলা তার ভেতরে ঢুকছে আর একটা কথা তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। কলা ঢোকার আর কথা বের হবার পথ একটায়। দাঁত আর জিহ্বা-তালুর চাপে গলিত কলা আর বেরিয়ে আসা কথার মধ্যে দেখা হয় বা ধাক্কাধাক্কি হয় বা কলা আর কথার মধ্যে কিছু আলাপ হয় বা পথ দেওয়া দেওয়ি নিয়ে বচসা হয় বলে বাসেদুরের কথা আমি বুঝতে পারি না। আমি তাকে বলি- ‘কলা আগে গিলে নে, তারপর বল কী বলছিস?’ সুতরাং গলার মাঝপথে কলা জয়ী হয় এবং সে প্রবেশ করে আগে আর কথাটি এবার বেরিয়ে আসে পরে- ‘বাবা, খলিল দারোগা হাঁচি দিতে গিয়ে ভুল করে নাকি জীবন দিয়ে দিয়েছে?’ ছেলের মুখ থেকে কথাটি বেরিয়ে এলে আমি আশ্চর্য হই এবং সন্দেহ হয় কলাওয়ালি কলার গা থেকে তার মাখানো কথা ভাল করে ছাড়িয়ে নেয়নি বা সব কলা থেকে ছাড়িয়ে নেয়নি। আমার রাগ হয় তার উপর। কলা মুখে দেবার সাথে সাথে খলিল দারোগার কথাটি ছেলের ভেতর ক্রিয়া করে উঠেছে। আমি আবার বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে বাজারের উদ্দেশ্যে কলাওয়ালিকে ধরার জন্য।
পথে দেখা হয় জামকুটি গ্রামের সোলেমানের সাথে। সে একটা রেডিও বাজাতে বাজাতে বাজার থেকে ফিরছিল। তার রেডিওটা একটা হিন্দি গান বলছিল আর সোলেমনের মনসহ মাথা ছোট ছোট করে তাল নিচ্ছিল। দেখা হতেই সে আমাকে বলে- ‘দাদা হিন্দিগানের মজাই আলাদা।’ আমি বলি- ‘বাদ দাও এসব, একটা কথা আছে, তুমি রেডিওটা বন্ধ করে দাও।’ সে বলে- ‘দাদা, এখন গান গাইছে যে ভদ্রলোক তিনি মস্ত মাপের শিল্পী। রেডিও বন্ধ করলে সে কিভাবে গান করবে আর রেডিও বন্ধ করে যদি তোমার কথা শুনি তবে গান গাইবার জন্য আবার এতক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হবে। বা সেই মস্ত মাপের শিল্পীটা অপমানিত বোধ করবে। অবশ্য তারা বড় মনের মানুষ অপমানিত বোধ করবেন না। না, করলেও আমার তো একটা হুঁশ আছে, এত বড় মাপের মানুষের গান থামিয়ে দেব মুখের উপর, এটা একটা বেয়াদবি হবে। দেখছেন না, কেমন করে মরে যাবার পরেও সুন্দর গান গাইছে, মানুষকে আনন্দ দিচ্ছে। মানুষ আনন্দ পাচ্ছে।’ আমি তার রেডিওর গানের দিকে মনোযোগ দিই। রেডিওতে শচীন দেব বর্ম্মন গান করছেন। সত্যিই তো, বর্ম্মন কর্তা বড় মাপের মানুষ। তিনি গান গাইছেন। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া বড়ই বেয়াদবির মত হবে। আমি তার পথ ছেড়ে দিলে শচীন কর্তা গান গাইতে এগুতে লাগল আর পূর্বের মত সোলেমন মাথা দোলাতে লাগল।
আমি আবার হাঁটতে লাগলাম বাজারের দিকে। আমার উদ্দেশ্য তেমন কিছু না। কলাওয়ালীকে বলা যে, সে কেন কলার গায়ে ‘খলিল দারোগার প্রাণ তার হাঁচির সাথে বেরিয়ে গেছে’ কথাটা লাগিয়ে দিয়েছে। আমার চলার গতি ধীর কারণ জোরে হাঁটতে গেলে পায়ের হাঁটুর কাছটায় আর নিচটায় বেশ ব্যথা হয়। কিন্তু আমার মনে চলার গতি বেশ জোরে। প্রথম যখন খলিল দারোগা সম্পর্কিত এ বাক্যটা আমি শুনি তখন কিন্তু অন্য কিছু শুনেছিলাম। কারণ, আমার কানেরও বেশ সমস্যা আছে। কোনো কোনো কথা অল্পতে শুনতে পাই না। আমি শুনেছিলাম- ‘খলিল দারোগার হাসির সাথে প্রাণ বেরিয়ে গেছে।’ খলিল দারোগার হাসি সত্যিই ছিলো খুব ভয়ঙ্কর টাইপের। তার হাসির শব্দে অনেক নীরিহ মানুষের পিলে ফেটে প্রাণ বেরিয়ে গেছে। তার হাসির ভয়ঙ্কর ঝংকার আমি দেখেছি। কিন্তু সত্যিকার ভয়ঙ্কর লোকের সামনে তার হাসি কোনো কাজ দিত না, উল্টো তার বাঘহাসি বিলাইহাসি নয় ইঁদুরহাসিতে পরিণত হত। এম.পি’র খাস গুণ্ডার হাসি শুনে খলিল দারোগা পোশাক নষ্ট করে ফেলেছিল থানার মধ্যেই একদিন। একদিন আমি দোকানের হিসাব নিকাশ সেরে সাইকেল নিয়ে ফিরছিলাম। রাত একটু বেশিই হয়ে গেছিল। খলিল দারোগা থামাল পথে। ‘এই এত রাতে কোথায়, কি, কেন?’ আমি বলেছিলাম- আমি একটা দোকানে সেলসের কাজ করি, হিসাব সেরে ফিরতে ধীর হয়ে গেছে।’ শুনল না কিছু। ধরে নিয়ে গেল। কানের উপর থাপ্পড় মারল কষে। কান আমার ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। থানায় নিয়ে মারল। তখন থেকেই হাঁটুর ব্যথাটা, তখন থেকেই কানে কম শোনাটা। পরদিন ভোরে আমার দোকানের মালিক আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে না গেলে অবস্থা কি হত কে জানে। সুতরাং আমি ভেবেছিলাম খলিল দারোগার প্রাণ বুঝি তার হাসির সাথে বেরিয়ে গেছে। তার হাসি এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে যদি খলিল দারোগা নিজেই নিরীহ মনে কোনো একবার শুনে ফেলে নিশ্চিত পিলে ফেটে মারা যাবে। যাহোক, পরে যার কাছে শুনেছিলাম সে দ্বিতীয়বার জোরের স্বরে বলেছিল- হাসির সাথে নয়, হাঁচির সাথে খলিল দারোগার প্রাণ বেরিয়ে গেছে।
কলাওয়ালীর কাছে পৌঁছে গিয়ে বললাম- ‘তুমি কলার সাথে খলিল দারোগার সংবাদ কেন লাগিয়ে দিয়েছিলে, আমার ছেলে কলা গিলতে গিয়ে মারা যেতে বসেছিল’। কলাওয়ালী বলল- বাবু কিছু মনে নেবেন না, আপনার উপর খলিল দারোগা যে অত্যাচার করেছিল তা আমি ভুলতে পারিনি। সে অনেক নিরীহ লোকের ব্যাপারেই এমনটা ছিল। আমি তাদের কলাতেই শুধু কথাটা লাগিয়ে দিয়েছি যারা খলিল দারোগার হাতে অহেতুক লাঞ্ছিত হয়েছে। যাতে করে সকলে তার হাঁচি অপঘাতে মৃত্যু শুনে প্রীত হতে পারে। আমি কিছু আর না বলে আবার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরি।
খলিল দারোগা মারা যাবার চল্লিশ দিন পর তার স্ত্রী সন্তানেরা পিকনিকের জন্য মুক্ত, সুন্দর কোনো জায়গাতে বেরিয়ে পড়ে। এ কথাটাও ঐ কলাওয়ালী আমার কলার গায়ে লাগিয়ে দিয়েছিল।