
ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো : বিষণ্ন বাস্তবতার জীবনালেখ্য
আবু হেনা মোস্তফা এনাম (১৯৭২)-এর প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র উপন্যাস ‘ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো’ (২০১৪) আমাদের ভিন্ন এক জীবনের গল্প বলে। যে বাস্তবতায় নিত্য বসবাস তাকে চেনায় অন্য এক আদলে। তিনি যেন জীবন্ত মানুষের এপিটাফ আঁকেন অক্ষরের বিন্যাসে। না, গল্পভূক পাঠকের খোরাক জোগাতে কলম ধরেন না এই লেখক। তবে ভাবুক পাঠকের মনোজগতে ঝড় তুলতে সক্ষম একথা হলফ করে বলা যায়। একজন তাহের ওসমানের বয়ানে ভিন্ন এক ডিসকোর্স নির্মাণ করেন লেখক। ‘ইনস্যানিটি’, ‘ধূলি ও ঝড়’, ‘ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো’, ‘খুন হয়ে যাওয়া প্রজাপতি’ এমন সব শিরোনামে আখ্যান বিভক্ত। তাহের ওসমান বেসরকারি স্কুল শিক্ষক, একটা টিউশনি করে, কবিতা লেখে, ‘প্রথম আলো’য় বুকরিভিউ লিখে পয়সা নেয় না, দেশি-বিদেশি সাহিত্যের জগতে পড়ুয়া ওসমানের স্বচ্ছন্দ বিচরণ, নীলক্ষেতে পুরোনো বইয়ের দোকানে নিত্য তার যাতায়াত, মঞ্চ নাটকের দর্শক এবং দর্শক চারপাশের আর এসবের সাথে সে একজন অটিস্টিক কন্যার বাবা। স্ত্রী ফাহমিদা আবার সন্তানসম্ভবা। ওদিকে কন্যা মৌমি সদ্য ঋতুমতী হয়েছে। তাহের ওসমান ডায়াবেটিক রোগী। সে হাঁটতে ভালোবাসে। সে হাঁটে আর দেখে। লেখকের বয়ানকৌশল এমন যে তাহের ওসমান একা হাঁটে না পাঠককেও সাথে নেয়। প্রতিটি ডিটেইল এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় চারপাশ জীবন্ত হয়ে ওঠে। অনেকটা পেইন্টিং এর মতো। যেখানে অনেক রং এর সমাবেশ। রংগুলো ইনডিভিজুয়াল হয়তো কোনো মানে ধরে না কিন্তু একসাথে অনিবার্য এর ব্যবহার। এখানেও ব্যাপারটা তেমন।
রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর, বাসার চিলেকোঠার না খেতে পাওয়া বৃদ্ধটি যার মৃত্যু ঘটে আখ্যানে, ফুলার রোডে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স্ক অধ্যাপক, গৃহপরিচারিকা মিনার মা, বিভিন্ন ধরনের ফেরিওয়ালারা, পুরোনো বই আর তার দোকানি মোস্তফা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, আবুর ক্যান্টিন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং তাঁর পা কেটে ফেলা, শহীদ কাদরী, মাহমুদুল হক, ক্রস ফায়ার, কেভিন কার্টার যে দক্ষিণ সুদানের দুর্ভিক্ষপীড়িত মৃতপ্রায় শিশু আর শকুনের ফোটোগ্রাফি করে পুলিৎজার পুরস্কার জিতে নেওয়ার দুই মাস পর মানসিক পীড়নে আত্মহত্যা করে, প্রফেসর ইউনুস আর তার ক্ষুদ্র ঋণ, আলব্যেয়ার কাম্যুর ‘মিথ অব সিসিফাস’, ‘আউটসাইডার’, ‘দ্য প্লেগ’, গায়ত্রী স্পিভাক, আরজ আলী মাতুব্বর, ‘হাঙ্গার’, ‘মার্ডার ইন ক্যাথিড্রাল’, হোসে সারামাগো, শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্টিফেন হকিংয়ের ‘নো লাইফ আফটার ডেথ’ থিউরি, বোদলেয়ার আর তাঁর ‘লে ফ্ল্যর দু মাল’, র্যাঁবো, চ্যাপলিন, মি. বিন, হিলারি গ্রাম, দ্বিজেনদার ‘শ্যামলী নিসর্গ’, আইনস্টাইন, প্লাতো আর তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রচিন্তা, আলিয়ঁস ফ্রঁসেসে ফ্রিল্যান্স ফোটোগ্রাফাদের এক্সিবিশন, ম্যাজিক মাউন্টেনের পৃষ্ঠা জুড়ে মৌমির আঁকা চিত্রগুচ্ছ, সোমেন চন্দ, ‘ডেথ অব এ সেলসম্যান’, সেক্সুয়ালিটি এ্যান্ড অটিজম জাতীয় বই, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ‘মেটামরফোসিস’ এর গ্রেগর সামসা—এসব ছড়ানো ছিটানো অবজেক্ট যা উপন্যাসের বিন্যাসে অনিবার্য রোল প্লে করেছে। মূল আখ্যানের অপরিহার্য অনুষঙ্গ এরা। এসব তাহের ওসমানের চেতনাজুড়ে বিরাজ করে। এক বাস্তবতার ভেতর থেকে সে আরেক বাস্তবতার ভেতর ঢুকে পড়ে অতি সন্তর্পণে। এবং পাঠকের মগজে সেই আরেক বাস্তবতা জাল বিস্তার করে বসে। তখন সবকিছু ইলিউশান মনে হয়। জীবন-মৃত্যুর হিসেবটাও গড়মিলের হয়ে যায়। লেখক বিশ্বাস করেন কেউ বাঁচে না বাঁচিয়ে রাখা হয়। কথাটা আমরাও মানি। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এক একটা খাঁচা তৈরি করে দেয় আর খাঁচার সামনে এতে বসবাসের নিয়মাবলি লেখা থাকে সাদা কালিতে। অনেকটা ফুকো কথিত কারাগারে চলে আমাদের নিত্য বসবাস। কেননা, আমাদের শোওয়ার জায়গাতেও আলো ফেলে পারিপার্শ্বিকতা। আখ্যানের শেষপ্রান্তে এসে তাহের ওসমানের ভাবনা :
না; চূড়ান্ত বলে কিছু নেই, সবই নশ্বর, সমস্তই অকল্পনীয় মেটামরফোসিস! চূড়ান্ত শব্দটি অত্যন্ত এ্যাবসার্ড। আশ্চর্য এ্যাবসার্ড পৃথিবীতে সে বাস করছে; তার কোনো গন্তব্য নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই; এমনকি কল্পনা নেই; . . . বেঁচে থাকাই এই মুহূর্তে জীবনের সঙ্গে প্রচণ্ড হিপোক্রেসি মনে হলো। ভেতরে ভেতরে ভয়ানক পর্যুদস্ত পরিত্রাণহীন সম্মোহিত ও মুমূর্ষু পরিস্থিতি থেকে মুক্তির আকুতি তাহেরকে বিভোর করে তুললো।
(পৃ. ন. ৮৪)
তাহের ওসমানের এই অনিকেত ভাবনা কিংবা জটিল আত্মোপলব্ধি আমাদের মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’ এর আব্দুল খালেক, ‘জীবন আমার বোন’ এর খোকা, ‘মেটামরফোসিস’-এর গ্রেগর সামসা, ‘আউটসাইডার’ এর সালামানোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরাও ভাবতে থাকি পরিত্রাণহীনতার কথা। এক অনিঃশেষ বিষাদখিন্ন পথে চলে বিরামহীন যাত্রা। মানুষের পৃথিবীতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত মানুষ তাও আবার মানুষের কারণেই। তাহের ওসমান আর রাস্তার ভ্যাগ্রান্ট কুকুরের কথোপকথন। কুকুর বলে :
—সবাই এত অশালীন আর নিষিদ্ধ পল্লির ভাষায় কথা বলে, ঘুম আসে না, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়!
—কাদের কথা বলছো তুমি? কোনো প্রোটাগনিস্ট?
—না, না, মর্গের মাতাল ডোম থেকে শুরু করে সিপাই-শান্ত্রি-মন্ত্রী-রাজা-উজীর-নাজির সকলেই চিৎকার করছে। এত অশ্লীল চিৎকারে ক্ষুধা মন্দা হয়, ক্ষুধার বোধ শূন্য হয়ে যায়। তাছাড়া চারদিকে ছড়ানো ছিটানো সারি সারি মৃতদেহ, লাশের কোটর থেকে উদগত বীভৎস চোখ, মাংস ক্ষয়ে যাওয়া তোবড়ানো গাল ভেদ করে উৎপাটিত দাঁত, রক্তাক্ত করোটি, বিস্ফারিত অণ্ডকোষ, আগুনে ঝলসানো যোনি। বাবা-মা সন্তানকে কেটে টুকরো টুকরো করছে নিদারুণ উন্মত্ত আক্রোশে, সন্তানও বাবা-মার বুকে ছুরি বেঁধাচ্ছে নির্দ্বিধায়। ক্রসফায়ার, রোড এ্যাক্সিডেন্ট, বেডরুমে হৃৎপিণ্ড বরাবর ছুরি চালিয়ে খুন অথবা হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে মানুষ। চোরছ্যাঁচ্চড়, ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, শিল্পী, আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, কেউই বাদ যাচ্ছে না; পুরো রাষ্ট্রই খুনোখুনির প্রেতান্ধ মৃত্যুলোক।
(পৃ. ন. ৩০)
এই কথোপকথনের ধরন অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ এর ‘বিড়াল’ প্রবন্ধের কথা মনে করায়। যাহোক, এখানে পথের কুকুরের চারপাশের বাস্তবতা নিয়ে যে চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কোথায় চলেছি আমরা। এমন শুশ্রূষাহীন জীবনের রেখাচিত্র ‘ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো’।
দিনের আলোয় সত্য খুঁড়ে খুঁড়ে আরেক সত্যের সুড়ঙ্গ নির্মাণ করেন লেখক তাহের ওসমানকে দিয়ে। তাহের ওসমানের পথ চলার বর্ণনায় যেভাবে ডিটেইল উঠে আসে তাতে আমরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শহীদুল জহিরের ছায়া দেখতে পাই। যেমন :
গ্রিন রোডে ফার্নিচারের শোভা দেখতে দেখতে মান্নান সৈয়দের আকাশমুখী কুটির পার হয়। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে মেঘের পুঞ্জ পুঞ্জ কালিমা।
. . .
অদৃশ্য কেউ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবলো, আলিয়ঁস ফ্রঁসেস ঘুরে যাবে। যানজট উপচে পড়ছে মিরপুর রোডে। পায়ের তলায় ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাতিরপুল, কাঁটাবন এনিম্যাল ফার্ম। ফর্সা পায়ের যুবতি একটা লোমশ কুকুর বুকে আঁকড়ে হাঁটছে। একবার ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করবে—হাই ম্যাম, আপনার কুত্তাটি কী ম্যাসটিফ প্রজাতির? বিগ স্প্ল্যাশ? দেড় মিলিয়ন ডলার! নিজের মনের লুব্ধ রসিকতায় নিজেই হাসলো। কনকর্ড টাওয়ারে নতুন বইয়ের দোকানগুলো জনশূন্য। বারান্দায় দু-একজন বসে গুলতানি করছে। বিপুল জনসংখ্যার দেশে বর্ষা শরৎ হেমন্তের বইমেলা জনপ্রিয় করে তুলবার স্বপ্নে সদ্য গড়ে ওঠা বইপাড়ায় রবিশঙ্করের সেতার কোথাও মৃদু কান্না হয়ে উড়ছে।
(পৃ. ন. ১৩)
অর্থনৈতিক অসম বিন্যাসের সমাজবাস্তবতার সাথে সাথে ব্যক্তিজীবনের চেতনাগত সঙ্কটও জায়গা পায় আখ্যানে। যেমন : তরুণীর ছাব্বিশ টুকরো লাশের তথ্য বা শ্রদ্ধাঞ্জলি শব্দটিতে ল বর্ণে দির্ঘইকার দেওয়ার প্রবণতা নিয়ে লেখকের ক্ষোভ আসলে চেতনার অন্ধকারে ঘা দেবার জন্যই তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ক্ষুদ্রঋণ যেমন দারিদ্র্য নিরসনে প্রশ্নবিদ্ধ তেমন আরও অনেক বিষয়কেই সামনে এনেছেন লেখক। সমকালমনস্কতা আর গভীরতলসঞ্চারী ভাবনায় উদ্দিপ্ত উপন্যাসিকের শিল্পিমানস। তিনি আখ্যানের বয়ানেও সেই গভীরভাবের পরিচয় দিয়েছেন। একজন কথা বলতে না পারা অটিস্টিক কন্যার বাবা তাহের ওসমান সমাজের সকল স্তরেই অটিজমের ছায়া দেখতে পায়। আসলে আমরা কতটা সচেতন? আমাদের সবকটা ইন্দ্রিয় কী সচল? আমরা প্রতিনিয়ত আত্মসমর্পণ, আত্মনিগ্রহ আর আত্মনির্বাসনের প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার অসুস্থ লড়াইয়ে মত্ত। তাই মৌমি যখন ছবি আঁকে কিংবা কাপড়ে সুই-সুতোয় ফুল তুলে তখন তাকেই বেশি স্বাভাবিক মনে হয় আমাদের।
উপন্যাসিক আবু হেনা মোস্তফা এনাম এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকগুলো গল্পকে একীভূত করে বিশাল ক্যানভাসে ভিন্ন বাস্তবতার আখ্যানের আভাস দেন। বিচিত্র বোধে তাড়িত তাহের ওসমান, কথা বলতে না পারা অথচ ছবি আঁকা বা সুই-সুতোর কাজে পারদর্শী মৌমি, মুমূর্ষু ক্ষুধার্ত বৃদ্ধটি, রাস্তার ভ্যাগ্রান্ট কুকুর, মাহমুদ ভাই যে স্বপ্নের শহরে (আমেরিকা) ট্যাক্সিচালকের কাজ ছেড়ে দেশে ফিরে এসে নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হন এবং ‘মেনে নিতে না পারার রোগ রক্তের মধ্যে হাতছানি দিতে থাকলে একদিন অকস্মাৎ পত্রিকার আঁধার বর্ণমালা হয়ে গেলেন. . .”(পৃ. ন. ৩৫)। এরা সবাই আপাত ভিন্ন হলেও কোনো না কোনো ভাবে একসূত্রে বাঁধা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টুকরোগুলো বৃহৎ কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। আর এখানেই এই আখ্যানটির বিশেষত্ব। এই বিশেষত্বটা অনেকসময় পাঠকের মনোবেদনার কারণও হতে পারে। কেননা, এতগুলো ডিটেইলকে মনে রেখে এক পূর্ণাঙ্গ চিত্ররূপ কল্পনায় আঁকতে গেলে যথেষ্ট মনোযোগের প্রয়োজন। জীবনের চরম সত্যকে এড়িয়ে গিয়ে সহজ সুখে গা ভাসাতে ভালোবাসা মানুষের আরেক ধর্ম। এখানে তার কোন আয়োজন নেই। এমন এক বাস্তবতার বয়ান এটি যা আমাদের চেতনাকে ঘা দিবে, রক্তাক্ত করবে বোধকে আর অনেকগুলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিবে মনের মধ্যে। জীবনের সারসত্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে পাঠককে। তাই এই পাঠে আসার আগে পাঠকেরও বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে বৈকি।
সমাজ আর ব্যক্তির জটিল মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের প্রয়াসে লেখকের ভাষায় কাঠিন্য এসেছে। অল্প বা কম ব্যবহৃত শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। আবার একই শব্দের বার বার ব্যবহার অনুপ্রাসের পাশাপাশি যে ধ্বনিদ্যোতনার জন্ম দেয় তা বেশ ব্যঞ্জনাময় আবহেরও সৃষ্টি করে। এই প্রবণতাটি লেখকের নান্দনিকতা বোধের বিশেষ প্রকাশক। আর এসবের সাথে লেখকের বর্ণনার ভাষায় পরাবাস্তব ভাবনার প্রকাশও রয়েছে। যেমন :
উড়তে উড়তে একটা মৃত প্রজাপতি হয়ে বিছানায় পড়ে রইলো মৌমি। বেগুনি আকাশ নেমে এলো বিছানায়, রূপালি আকাশ নেমে এলো বিছানায়, সোনালি আকাশ বিছানায় নেমে এলো, খয়েরি আকাশ নেমে এলো…। সে মরে গিয়ে দেখলো তার মুঠোর ভেতর শুকনো মাছের চোখ জ্বলে উঠছে, কানকো ফুলে লাল ফুলকা অক্সিজেন টেনে নিচ্ছে। বিছানাটা ছোট্ট নীল নদী হয়ে গেল, মাছগুলো জলের নীল প্রহেলিকায় খেলছে। মাথার উপর প্রজাপতির ঝাঁক নেমেছে। লাল প্রজাপতি, সবুজ প্রজাপতি, নীল প্রজাপতি, হলুদ প্রজাপতি, সাদা প্রজাপতি…। মৌমি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় মাছ আর প্রজাপতির ঝাঁক।
(পৃ. ন. ৬৯-৭০)
উপন্যাসটি শুরু হয় শহীদ কাদরীর কবিতা দিয়ে।
জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে—
সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগরে দিল যেন
দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নীচে, সন্ত্রস্ত শহরে
নিমজ্জিত সবকিছু, রুদ্ধচক্ষু সেই ব্ল্যাক-আউটের আঁধারে।
(পৃ. ন. ০৭)
আসলে ‘রুদ্ধচক্ষু সেই ব্ল্যাক-আউটের আঁধারে‘ ঢাকা পড়ে যাই আমরা সকলে। তাই তাহের ওসমানের মতো আমাদের সকলের ’মাথার মধ্যে শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই—’। আর ’ব্যাখ্যাহীন ঘোরের উদাসীনতা’ পেয়ে বসে ভীষণভাবে। এবং ক্লান্তি পর্যুদস্ত করে ফেলে বলে চৈতন্যজুড়ে বিরাজ করে এক পরাবাস্তব জগৎ। চিত্রকর্মের মতোই রং-এর বিন্যাসে সজ্জিত সেই আলো-আঁধারির জগৎ। সেই জগতে বাস্তবতার আড়ালে ওঁত পেতে থাকা আরেক বিষণ্ন বাস্তবতার জীবনালেখ্য আবু হেনা মোস্তফা এনাম-এর উপন্যাস ‘ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো’।