
কুসুমকুমার
কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে? আসো, নিয়ে যাও। আমাকে ভাঙো, ছড়াও। এই এলাম। আমাকে নাও, আমার সবটুকু নাও, আমার ডানা, উড়াল, স্বপ্ন, সৌন্দর্য, কাম সবটুকু। আমাকে ডুবিয়ে ফেলো। আমাকে এক নিমেষে শুষে নাও… সপ্তকে বাঁধা পড়ে আছে রাত, হেমবতী আজ খুলবে প্রভাত। হেমবতী নেই মরে গেছে গতকাল রাতে; নেই হৈমন্তী হিম, কাদম্বরী অথবা কপালকুণ্ডলা—কোনো কাপালিকের হাতে অথবা নদী এসে নিয়েছে তাদের, তাহাদের। লীন হবে ভুল রাত্রি এলোচুল, কেতকীবনে সব পুষ্প আকুল। না, কেতকীবনে এখন বন্ধ্যাকাল। সে আর সে, তারা আর তারা নেই। তোমাকে আমি একদিনও কষ্ট দেবো না আর—তোমাকে আমি চিরদিন কষ্ট দেবো। তুমি ভালো থেকো; তুমি ভালো থেকো না। তুমি তো তার জানো না কিছুই, জানবে না কোনোদিন—তোমাকে দেখতে মন করে, তোমায় খুব দেখতে মন করে। তুমি এসো, উড়ে এসো লুসিফেরিন রোদ, ঝলসে দাও এই চোখের বিবর।
সে ছিলো দিগ্বিদিক চোখের এক স্বপ্নকান্ত গাছ। পরিশ্রান্ত স্মৃতির মায়ায় জেগে থাকা হলুদরং ইদানীং রাধাচূড়ায় জাগে। সে বলেছিলো রাধাচূড়া চেনে না। হলুদকে সে সূর্য নামে ডাকে। অস্ত যাচ্ছে ভোরের ডাকে একটি সূর্য— সে আলোতেই সেজন জন্ম নেয়—পুনর্বার আলোকে অস্বীকার করে। রাত্রির দুই প্রান্তে দুই সূর্যপ্রহরী রূপবতী হয়ে দোলে, তবু সে ভোলে না। যদিও হলুদকে অস্বীকার করার পথ নেই— আঁধারকে সে সাজায় চারিধারে। একজন জানে, সেই-ই জানে। আর কেউই নয়। যেটার শুরু থাকে তার শেষও থাকে। থাকে নাকি? পথ অন্ধকার, সমস্ত। সে স্বপ্নকান্ত গাছ বলে একটি শাখা তার কেঁপেছিলো কোনোদিন একটি অচেনা পাখির পদভারে। পাখির গায়ের রং হলুদ। কম্পমান শাখাটি তবে জেনেছিলো ভর সন্ধ্যায়—আলোতে আলোকিত হওয়া যায় না, আলোকিত হতে হয় অন্ধকারে।
সে তাকে দেয়ালে আয়নার ভিতর ঝুলতে দেখতে পারে না। সে উদগ্রীব অন্ধকার চোখে অন্য একটি দৃষ্টিপাত গ্রহণ করে। কখনো সে সান্ধ্যভোজের জন্যে আকাশের নীল রান্না করে রক্তের সঙ্গে। পাখি সেই সন্ধ্যাটিকে খুঁটে খায়। বিছানাপত্র হাঁটে আনুভূমিক, যার সঙ্গে মাঠ, তার ব্যাপক দৃষ্টি একটি খোলা মশারির কঙ্কাল পর্যবেক্ষণ করে, তাদের চোখ আর চেহারার সঙ্গে একত্র করে। সে একটি জানলা পর্যন্ত যায় এবং এর সঙ্গে একটি রৈখিক বিলয় বানায়। একটি তার আঙুলের মধ্যদিয়ে চলে, একটি ভাঙা থাকে, একটি কেটে ফেলার মধ্যে চলে। রাত্রির আর্দ্রতা অস্বচ্ছ ডোবা অথবা জলাশয়ের দিকে কাউকে রূপান্তরিত করে মাছ কিংবা মাছরাঙায়— যেখানে রক্ত কেবল একটি হাত; সেই সন্ধ্যাটি দাগ দেখায়, যেখানে কাঁচভাঙা ঘুম—যেনো বালিকার জন্মদাগ। রাত্রি ভেঙে বাড়িতে কখন সে ফিরে এসেছিলো! প্রথমকে সে স্মরণ করেনি কিন্তু মার্বেল আর সর্বোচ্চ রুটির স্বাদ তার মনে পড়ে। সে প্রদীপ হিশেবে একটি আধখাওয়া পেয়ারা গ্রহণ করে জ্বালায়। তার বিছানাবাতির পায়ে তৈরি করে প্যারাফিন সময়—রতিরং শুনশান দীর্ঘ শূন্যতা।
এনেছি শজারুর কাঁটা বনময় ঘুরে। মাঝখানে একটি শয্যা পেতেছি ঘরের—আকণ্ঠ কণ্টকময়। শুবে? শুবে না জানি। পৃথিবীর অনিশ্চিত বিষাদ আড়ম্বর বৈশাখে। উড্ডীন ঝরাপাতা বন্দীপাতাদের পাশ ছুঁয়ে উড়ে যায়— ওইখানে সকল আনন্দ ভীষণ ম্লান। কেনো আগুনের রূপ উপহাস করে ঝড়কে। তুমি ফিররে না জানি। শজারুর দুঃখ বুঝবে যেদিন— ফেরার পথ সকলি বন্ধ। শব্দের নিজস্ব ভাষা পুড়ে গেছে বৃষ্টিপাতে। তুমি তবু বৃষ্টির ভাষা জানো না কিছু। তবে কেনো এমন ব্যাঘাত ভুলে পড়ে থাকো? এখন শূন্যতার রং ধূসর, প্রিয়তম ধূলিকণা শূন্যতারই যমজ। কে তবে কান্নার ভাই? সকল সুন্দর ওইখানে হয়ে আছে ছাই। শব্দের খোঁজে একাকী প্রহর খুঁজেছি পথ। একটি মেঠোপথ ঢেকে গেছে ঘাসে। আমি আবারও সিঁথি কেটেছি ওই মাঠের বুকে। আমার রক্তে ছিলো সিঁদুর। তবু সপ্তপদী আগুন জ্বলেনি।
কুসুমকুমার আমি অচলচোখে চেয়ে থাকি পাথর দিগন্তে, আর পায়ে হাজার বছরের শিকড়। আমার চোখ পাখি হয়ে যায়— খাঁচার পাখি। ভুলের তেরো নম্বর সুতাটাকে বের করে দেখি পায়ের তলায় মরুচারী ঝড়। আমি তলা থেকে বেরিয়ে আসি, চূড়ায় উঠে সাজিয়ে দিই গন্ধবহ পরমায়ুর ঝাড়।
অলংকরণ- নির্ঝর নৈঃশব্দ্য