
কুমড়াবড়ি
মালতীবালা ও সন্ধ্যারানী চরিতমালা।
পাড়াশাঁওলী গ্রাম। অর্ধেক হিন্দু অর্ধেক মুসলমানে ভরা। সুনিল সরকারের বউ মালতীবালা একটু লম্বাটে, পায়ের গোড়ালি ফাটল হলেও লম্বা শরীর নিয়ে সে প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে বেশ গর্বিত। হরেন কুমারের বউ সন্ধ্যারানীর গায়ের রং ফর্সা এবং বেশ জেদি, শরীরের গঠন অত লম্বা না হলেও রুপের গৌরবে অন্যদের সেখানে স্থান নেই। তবে ঝগড়াতে দুজন সমান সমান বলে ঝগড়াটা কোনোকালেই থামতে চায় না; তাদের পুরুষরাও ভয়ে থামাতে আসে না। মালতীবালা এবং সন্ধ্যারানী, দুজনের স্বামীই খেতখামারীতে চাষবাস ও গরুছাগল পেলে পুষে একতালা ইটের ছাদ তুলেছে; সোনালী ব্যাংকে এমডিএসও করেছে। পাশাপাশি ছাদ ঘেষে ছাদ হওয়াতে এপাশের দুষ্ট ছাগল ওপাশের ছাদের শুকাতে দেওয়া জিনিসপাতি অর্ধেক ভক্ষণ করে আর আর্ধেক নষ্ট করে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এ নিয়ে দু ছাদের স্ত্রীদের মাঝে প্রায়ই তুমুল ঝগড়াঝাটি চলতো। স্বামীরা মাঠ থেকে কোদাল হাতে দুপুরে উঠে এলে স্ত্রীদের কন্ঠে ঝগড়া শুনে স্তব্ধ হয়ে যেত এবং তারপর কন্দল খানিক থেমে গেলেও পরক্ষণেই আবার তা জেগে উঠতে চাইতো। কিছুদিন হলো ঝগড়াঝাটির কোনোরুপ শব্দ শোনা যাচ্ছে না; নতুন একটা উদ্যোগে মেতে উঠেছে স্ত্রীরা। কুমড়াবড়ি বানানোর উদ্যোগ। বুড়ানী বকরি বাড়িতে রেখে পুরুষদের দিয়ে দুষ্ট খাসিগুলো বিক্রি করেছে হাটে। সেই টাকা তারা খানিক কুমড়াবড়িতে বিনিয়োগ করেছে এবং খানিক ব্যাংকে ডিপোজিট করেছে। ছাগল বিক্রিতে কোন বাড়ির লোক কত পেল কান পেতে তাও শোনার চেষ্টায় থাকে তারা।
১.
আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভাসতে ভাসতে হঠাৎ ঐক্যবদ্ধরুপে বৃষ্টির ধারা হয়ে জমিনে নেমে আসে। বৃষ্টি যতো জোরে চেপে আসে, মালতীবালার মন ততোই খারাপ হয়ে ওঠে।
মালতীবালা আজ খুব সকাল সকাল উঠে নিজহাতে বানানো কুমড়াবড়ি ছাদের এক কোণে শুকাতে দিয়েছিল; মায়ের বাড়ী আসার সময় একবারও বড়িগুলো উঠানোর কথা মনে পড়েনি। ভাবনায় ভেসে ওঠে বড়িগুলোর করুণ চিত্র- বৃষ্টির ধারায় বড়িগুলো ভিজে ভিজে গলে গলে সাদা রঙের জলরুপে ছাদ বেয়ে নির্গত হচ্ছে মৃত্তিকার বুকে; সেই জল ধীরে ধীরে পুকুরে, ধানক্ষেতে, দীঘিতে, নদীতে এরপর গিয়ে পড়ছে- সমুদ্রে। তারপর সেই জলের আর কোনো হদিস নেই। মালতীবালার করার কিছুই ছিল না। মনে মনে বড়িগুলোর মায়া ত্যাগ করতে তার কীরুপ কষ্ট হচ্ছিল তা বুঝানোর মতো কাউকে পেল না। মা শুধু পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, বৃষ্টি এসে ভালোই হলো মা, দুদিন কিন্তু তোকে থাকতে হবে, তোর জন্য আলো চাল রেখেছিলাম পিঠা বানাবো বলে, দুজন মিলে ঢেঁকিতে আটা কুটতে পারবো আজ। মালতীবালার চোখভরা জলে ছলছল করলেও মায়ের কথায় মনে মনে তীব্র হেসে উঠলো।
তারপর!
২.
তার আগেই মালতীবালার প্রতিদ্বন্দ্বী সন্ধ্যারানী ছাদে উঠে যায়। আকাশে ভাসমান কালো মেঘের আনাগোনা লক্ষ্য করে বৃষ্টি চাপার সম্ভাবনায় নিজের কুমড়াবড়িগুলো তড়িৎগতিতে যথাস্থানে রেখে আবার ছাদে উঠে আসে এবং অহংকারী চোখে মালতীবালাদের ছাদের কুমড়াবড়িগুলোর দিকে এবার তাকিয়ে রয়; ঝগড়ী মালতীর কুমড়াবড়ি বৃষ্টির জলে নষ্ট হলে তার কী এসে যায়? এ বাড়ির সাথে তাদের বাড়ির চিরশত্রুতার কথা সন্ধ্যার তীব্ররুপে মনে পড়লে বুক তার হিংসায় জ্বলে ওঠে- তারা তো কখনোই ভালো চায়নি সন্ধ্যাদের, এমনকি মালতীর স্বামী সুনিল পর্যন্ত ঝগড়া করেছে সন্ধ্যার সাথে- মনে নেই বুঝি সন্ধ্যার?
আকাশ হতে বৃষ্টির তীব্র ফোটা উড়ে এসে সন্ধ্যার গালেমুখে পড়তে লাগলে হিংসামগ্ন হৃদয়ে চৈতন্য ফিরে। সন্ধ্যা জানে যে মালতী বাড়িতে নেই, থাকলে তার কিছু আলামত বোঝা যেত; সার্কাসের হাতির উপস্থিতিরও আগে তার ঘন্টার শব্দ কানে আসে। বড়ির উপর বৃষ্টির দুচারটে ফোটা পড়ছে দেখে সন্ধ্যারানী প্রথমে হিংসায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। পরে কী ভেবে রাগে আর ক্ষোভে গজগজ করতে করতে মালতীদের ছাদের অসহায় কুমড়াবড়ির দিকে হেঁটে গিয়ে কুমড়াবড়ির চাটাইটি হাতে তুলে নিল সন্ধ্যারানী।
৩.
বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে আকাশে রোদ উঠলে মালতীবালাও উদ্বিগ্ন হয় বাড়ী ফেরার জন্য। পাশের গ্রামেই তার মায়ের বাড়ী। মায়ের সাথে সেদিন রাত কেটে যাবার শত অনুরোধ উপেক্ষা করে বাড়ী চলে আসে মালতীবালা। বাড়ী ঢুকে সোজা ছাদের উপরে একবার উঠল মালতীবালা- বড়িগুলো ভিজে কতখানি গলে গেছে তাই কৌতূহলভরে দেখবে সে। উঠে দেখল ছাদের যেখানে বড়ির চাটাইটি রেখেছিল ঠিক সেখানেই বড়ি আছে- বড়ির কোথাও বৃষ্টি লেগে নেই, ঝড়ের আঘাত নেই- রোদে ঝলমল করছে কুমড়াবড়িগুলো। মন থেকে বড়ির আশা ত্যাগ করার পর আবার তা ফিরে পাওয়ায় মনটাও তার রোদের মতোই ঝলমলিয়ে উঠলো- সৃষ্টিকর্তার অসীম দয়ার প্রতি তার কৃতজ্ঞতার অন্ত রইলো না তখন।