
কালো বরফের অন্তহীন যাত্রা
[বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম মাহমুদুল হক (ডিসেম্বর ১৬, ১৯৪১-জুলাই ২২, ২০০৮)। জীবন আমার বোন, অনুর পাঠশালা, নিরাপদ তন্দ্রা, কালো বরফ উপন্যাস এবং খেলাঘর ও প্রতিদিন একটি রুমাল এর মতো গল্পগ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের অসাধারণ শক্তিমত্তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বাংলা ভাষায় তিনি বিবেচিত হন অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক হিসেবে। মাহমুদুল হক মূলত মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে জটিল সমাজ বাস্তবতার মধ্যে মধ্যবিত্তের নানা টানাপোড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন তার যাদুকরী ভাষাশৈলীতে। আজ এই প্রখ্যাত কথাশিল্পীর প্রয়াণ দিবসে প্রতিকথার পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে মাহমুদুল হকের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে প্রকাশ করা হল চারটি মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ। লিখেছেন- কবি ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ, কথাসাহিত্যিক আবু হেনা মোস্তফা এনাম, গবেষক নূর সালমা খাতুন, ও প্রাবন্ধিক মনোজ দে। -সম্পাদক]
উপমহাদেশের হৃদয়ে স্থায়ী রক্তক্ষরণ দেশভাগ। দুই ধর্মের পুঁজিপতিদের নাছোড় স্বার্থ, রাজনীতিকদের ভুল চিন্তা ও সীমাহীন স্বার্থপরতা, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের ভাগ ও শাসন-শোষণ-আধিপত্য জারি রাখার নীতির ফল ১৯৪৭। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া থেকে ভারত-পাকিস্তান জন্মের যে যন্ত্রণা- সেখানে লাশের পর লাশের স্তূপ, অগ্নি-উৎসব, ধর্ষণ-নারী লুণ্ঠনের অযুত-নিযুত ঘটনা। মানুষ সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে দানব হয়ে ওঠার বীভৎস প্রতিযোগিতা। নিত্য চেনা-জানা মানুষের অচেনা হয়ে ওঠা। ভয়-বিভীষিকা-ত্রাসের রাজত্বে শিকড়ছিন্ন কোটি মানুষ। ঘর-বসতি-ভূমিহারা উদ্বাস্তুর কাফেলার পর কাফেলা। জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে হোলি খেলতে খেলতে অবশেষে একদিন অচেনা অন্য এক দেশে। ভিন্ন আরেক পরিবেশে। বেঁচে থাকার তাগিদে মানিয়ে নেওয়া। আর মেনে না নিতে পারার চির-দীর্ঘশ্বাস। পরিবর্তিত বাস্তবতা ও সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির জীবনকে মীমাংসা করতে না পারার টানাপোড়েন। সেখানে সংবেদনশীল ব্যক্তিমানুষ একেবারে প্রান্তিক বা ধসে পড়া ধরনের। মনোজগতে নিজেই এক নিজস্ব একা তিনি। বাস্তবতা, পরিপার্শ্ব, সমাজ, পরিবার, স্বজন থেকে অমোচনীয় এক বিচ্ছিন্নতার জগৎ। সেখানে তার অনুভূতি, চৈতন্য, সংবেদনা প্রথাগত মাপকাঠিতে পরিত্রাণহীন, বরফ শীতল।
একটা ভুল ও আত্মবিনাশী রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন উন্মূলিত-প্রান্তিক-নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠা মানুষের নাজাতহীন আত্মহাহাকারের বয়ান ‘কালো বরফ’। মাহমুদুল হকের মহাকাব্যিক উপন্যাস। মফঃস্বল শহরের একটি কলেজের একেবারে ছা-পোষা শিক্ষক আবদুল খালেকের জীবন-জার্নি। বহুরৈখিক এই যাত্রা শুধু আবদুল খালেকের মধ্যেই খাবি খায় না, তা-হয়ে ওঠে উপমহাদেশের দুর্ভাগ্যতাড়িত একেবারে সাধারণ মানুষের ওডেসি।
দেশভাগ উপমহাদেশের মানচিত্রকে শুধু পাল্টালো না, জনসাধারণের চেতনা-চৈতন্যে অন্তঃসলিলা নদীর মতো উপশমহীন যন্ত্রণা, বেদনা, ঘৃণা, রাগ, অক্ষমতা হয়ে রইল। এই হৃদয়-ছিন্ন-ভিন্নের দেশভাগ, এর অভিঘাত শিল্প, সাহিত্যিকদের মধ্যেও প্রবল বিষাদ হয়ে এল। কেউ কেউ হয়ে উঠলেন উদাসীন নির্লিপ্ত। সাহিত্যিক মাহমুদুল হক এ দুয়ের যুগলবন্দী। অন্তরঙ্গে প্রবল সংবেদনশীলতা ও বহিরঙ্গে নির্দয় নির্লিপ্ততার প্রকাশ ‘কালো বরফ’ উপন্যাস। কেন্দ্রীয় তিন চরিত্র আবদুল খালেক, তার স্ত্রী রেখা এবং নরহরি ডাক্তার। তাদেরকে ঘিরে, তাদের সত্তা-স্মৃতিজুড়ে আরও অসংখ্য চরিত্র আসে। সমান্তরালে দুই সময়ের গল্প এগিয়ে চলে। দুই দেশ, দুই বাস্তবতা। মাঝে রক্তাক্ত রেখার মতো দাঁড়িয়ে থাকে ১৯৪৭। শুধু হয়তো দাঁড়িয়ে থাকা নয়, একটা প্রচণ্ড অভিঘাতে যেন বিরামহীন কাঁপন। সেই অভিঘাতেই আবদুল খালেক, রেখা, ডাক্তারেরা বায়োস্কোপের ছবির মতো সরে সরে যায়। আবদুল খালেক যেখানে উন্মূলিত, রেখা আধা উন্মূলিত আর ডাক্তার উন্মূলিত হবার অপেক্ষায়। এইসব সমাজের তলানির মানুষগুলো, তাদের সাধারণ একেবারে নিত্যদিনের জীবন বয়ে চলে। কিন্তু কোথাও যেন ছন্দ নেই, তাল নেই, সুর নেই। সবকিছুর পরেও যেন এক মহাশূন্যতা। বরফ শীতল বাস্তবতা। তবে সাদা নয়। কালো। একেবারে গহীন কালো। কালো বরফ।
‘কালো বরফ’র শুরুর শুরুটা অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে। বর্তমান পশ্চিম বাংলার কোনো এক আধাগ্রাম আধা মফঃস্বল অঞ্চলের পটভূমিতে। আবদুল খালেকের বাল্যকালের স্মৃতির সূত্র পাঠকের সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই আখ্যান: ‘তখন আমার অভ্যেস ছিল বুড়ো আঙুল চোষার। কখনো পুকুর-ঘাটে, কখনো বারান্দার সিঁড়িতে, কখনো-বা জানালায় একা একা বসে কেবল আঙুল চুষতাম। আঙুলের নোনতা স্বাদ যে খুব ভালো লাগতো, ঠিক সে রকম কোনো ব্যাপার নয়। তখন ভালো লাগা বা মন্দ লাগা এসবের কোনো ঝক্কি ছিল না, যতটুকু মনে পড়ে; পৃথিবী যে গোল এ কথা শুনে কানমাথা রীতিমতো ঝাঁ ঝাঁ করতো। সে একটা গোলমেলে বিষম ব্যাপার। ভাবতাম আমরা তাহলে কোথায় আছি, কমলালেবুর তলার দিকে না উপরের দিকে; তলার দিকের মানুষদের তো টুপটাপ ঝরে পড়ার কথা।’

মাহমুদুল হক ‘কালো বরফ’-এ যে সমাজের নিচের তলার মানুষের গল্প বলবেন তার ইঙ্গিত শুরুতেই দিয়ে দেন। রাজা-রাজার যুদ্ধে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তলার দিকের সেসব মানুষ তো টুপটাপ ঝরে পরেই। আর সেসব মানুষের রক্তস্তূপের উপরে, কিংবা বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবানদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের উপরে রচিত হয় উপর দিককার মানুষের ইতিহাস। প্রচলিত ইতিহাসে সাধারণ মানুষ নগণ্য। তাদের ঝরে পড়াটাই নিয়তি। এই ফালতু, ফেলনা মানুষ নিয়েই কারবার করেছেন মাহমুদুল হক। প্রথম পরিচয়েই আমরা বুড়ো আঙুল চোষা এক শিশুকে দেখতে পাই, জগতের সাথে যার পরিচয়ের গণ্ডিটা ধীরে ধীরে বাড়ছে ভয়ের মধ্য দিয়ে। আমাদের চরপাশের খুব সাধারণ বিষয়। কিন্তু লেখক যখন সূত্রধরের মতো বারবার করে ভিন্ন ভিন্নভাবে আবদুল খালেকের শৈশব এবং বেড়ে ওঠার বর্ণনা দিতে গিয়ে ভয়ের বিষয়টা উঠাচ্ছেন- তখন বোঝাই যাচ্ছে তিনি পাঠককে অন্য কিছু বলতে চাইছেন। প্রথম চার পৃষ্ঠার মধ্যেই তিনবার ভয়ের প্রসঙ্গ এসেছে: ‘ভয়ে বুকের ভেতর গুবগুব করতো’/, ‘তখন আমার হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে যেতো ভয়ে, আমি হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিতাম’ /, ‘ভয়ে হাত-পা পড়ে যাবার জোগাড়’।
পুরো উপন্যাসজুড়ে এই ভয় পিছু ছাড়ে না। প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য ভয় যেখানে আছে, ভয় দেখানোর মানুষেরও নিশ্চয়ই কমতি নেই সেখানে। কিংবা ভয় সৃষ্টি করার বাস্তবতাও আছে অজস্র। আবদুল খালেক বোকাসোকা ও দুর্বল ব্যক্তিত্বের। হাবলু, হাবা গোছের, হাবা আর হেঁড়েমাথার বুড়ো আঙুল চোষা শিশুটির বেড়ে ওঠা জুড়েই এই ভয়ের রাজেত্বের দাপট। স্কুলে ভর্তি হবার আগে ভয়, ভয় ছেলেধরা বুড়োয়, ভয় পাকিস্তান হবার আগে, ভয় পাকিস্তান হয়ে গেলে।
কয়েকশ বছর ধরে উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করে আসছে। স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্য দিয়েই এই বসবাস। ধর্ম, সম্প্রদায়ের পরিচয় থেকে মানুষ পরিচয়টাই সেখানে বড়। এই স্বাভাবিকতায় প্রথম চিড় ধরল ঊনিশ শতকে এসে। দুই সম্প্রদায়ের মাঝের অর্থনৈতিক ব্যবধানকে পুঁজি করে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা বুনে দিল চির-অশান্তির বীজ। স্বার্থটা ছিল ইংরেজ শাসক আর সমাজের উঁচু তলার হিন্দু-মুসলিম সামন্ত, উঠতি বুর্জোয়া ও চাকরিজীবী মধ্যবিত্তদের। কিন্তু এ বিরোধটাকে সমাজের একেবারে নিচের তলার মানুষের মাঝেও পুঁতে দেয়া সম্ভব হলো। সময় যত এগুলো উপমহাদেশের সিংহভাগ মানুষের মানুষ পরিচয় থেকে ধর্ম পরিচয়টাই বড় ও একমাত্র হয়ে ওঠল। দুইশ বছরের শাসন-শোষণ চালানো ব্রিটিশরা শত্রু না হয়ে শত্রু হয়ে উঠল পাশের বাড়ির রাম বা রহিম। এর অনিবার্য পরিণতি হয়ে এল সাতচল্লিশ। সাতচল্লিশের আগের বছরগুলোতে দ্রুত বদলে যাচ্ছিল সমাজ। ভাঙছিল মানুষের শত-শত বছরের সংস্কৃতি-মূল্যবোধ। অধিকাংশ মানুষই যখন ভাঙনের চক্করে, তখন কেউ কেউ মেনে নিতে পারছিল না হঠাৎ বদলে যাওয়া সে সব বাস্তবতা। তারা আবার সমাজের বিচারে কেউ ছিটগ্রস্ত, কেউ অন্ধ আবার কেউ বা ফেঁটিবাধা পাগল। মাহমুদুল হক সেই সময়কার সেইসব অপ্রকৃতস্থ মানুষদের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেন বা মনে করিয়ে দিতে চান- তোমরা সবাই যা ভাবছ, যা করছ তা ঠিক নয়।

‘মাঝে মাঝে দূর সম্পর্কের এক নানা আসতেন আমাদের বাড়িতে। সবাই বলতো তার মাথায় নাকি ছিট। স্বদেশী আন্দোলনের সময় তিনি ইংরেজের চাকরি ছেড়ে বইয়ের ব্যবসা খুলেছিলেন। তবে সে ব্যবসা আর চলেনি। পরে ইস্কুলে মাস্টারি করতেন।’ সমাজের চোখে এই ছিটগ্রস্ত মানুষটাই তার পকেটে পালতেন লাল পিঁপড়া। সেগুলোর জন্য পকেটে খাবার রাখতেন সবসময়। কিন্তু পিঁপড়া তাকে কখনও কামড়ায় না। কেউ প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন : “কেন কামড়াবে? আমি তো ওদের কামড়াইনি! আল্লাতালার জীব, সব এক / ম-এ মুসলমান, ম-এ মুর্দফরাস, ম-এ মুচি- সব সমান।”
মনে রাখার প্রয়োজন লাল পিঁপড়া কিন্তু নিছক লাল পিঁপড়া নয়। সাম্প্রদায়িক বিরোধের দিনগুলোতে লাল পিঁপড়া ও কালো পিঁপড়া দুই সম্প্রদায়ের প্রতীক হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছে। এক সম্প্রদায় নিজেদেরকে কালো পিঁপড়া ভেবেছে, অন্য সম্প্রদায়কে লাল পিঁপড়া বলে মনে করেছে। লাল পিঁপড়ার এই জনমিথকে মাহমুদুল হক সাধারণ মানুষ হিসাবে তার প্রতিবাদের প্রতিপাদ্য করেন। এ পথে তিনি বেছে নেন অন্ধ এক মুসাফিরকে যিনি তার অন্তঃচোখে দৃশ্যমান পৃথিবীর বাস্তবতাকে দেখতে পান। তার কাছে হিন্দু-মুসলমান পরিচয় বড় নয়। বর্ণ বিভাজিত হিন্দু সমাজে যেখানে নিজ ধর্মের নিচু বর্ণেও মানুষের ঘরে খাওয়াটা পাপ হিসাবে বিবেচিত সেখানে সেই অন্ধ মুসাফির যে কিনা দিব্যজ্ঞানীর মতো বলতে পারেন, অন্নের কোনো জাত নেই।
‘আপনি হিন্দু না মুসলমান?’
‘আমি হিন্দু’
‘আমরা মুসলমান, আমাদের এখানে খাবেন?’
‘অন্নের কি কোনো জাত আছে মা?’
মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীনতার কথা মাহমুদুল হক পাগল হিসাবে বিবেচিত আরেকজনের মুখ থেকে বলিয়ে নেন: ‘যাঁহা ছোলাভাজা, তাঁহা সন্দেশ। সন্দেশ পেটে গিয়ে ছোলাভাজা হয়, ছোলাভাজা পেটে গিয়ে সন্দেশ হয়। মোসলমান মরে গিয়ে হিদু হয়, হিদু মরে গেলে গেলে মোসলমান হয়। পেট হচ্ছে চিতা, পেটই হচ্ছে কবর।’
ক্ষুধার কাছেই যে মানুষ অসহায় এবং সেখানে যে নিচের তলার মানুষেরা ধর্ম ভুলে পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়ায় তার অনবদ্য বর্ণনা দেন। আবদুল খালেকের মনি ভাইজান, যে কিনা ছেলেমানুষি খামখেয়ালিতে ছবির ঠাকুরমাকে ‘লুকিয়ে লুকিয়ে গরুর মাংস খাওয়া হয়’ বলে উত্যক্ত করে, সেই আবার কিনা নগেন স্যাকরা আর মাধুরীর অভাবের কথা বুঝতে পেরে বাড়ির উঠোনে আধুলি ফেলে আসে। নগেন স্যাকরার যখন মুমূর্ষু দশা, মাধুরীকে সবাই যখন সাহায্য না করে ফিরিয়ে দিয়েছে, সেই মনিই দৌড়ে গিয়ে মায়ের টাকা চুরি করে মাধুরীর হাতে তুলে দেয়। কিংবা একপ্রান্তে একা বাড়িতে থাকা বৃদ্ধা গিরিবালার জন্যও বুকফাটা দরদ তার। কেনারাম কাকার মেয়ের গর্ভাবস্থায় পেয়ারা খাবার ইচ্ছা হলে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে তার জন্য পেয়ারা নিয়ে আসে। কেনারাম কাকাদের মধ্যেও ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। মনি ভাইজানের ছেলেমানুষিতে যখন একদঙ্গল উত্তেজিত লোক তার শাস্তি চেয়ে জড়ো হয়েছিল, তখন সবার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে কেনারাম কাকাই তাকে রক্ষা করেছিল।
যে ঘটনায় এ উত্তেজনার সৃষ্টি সেটার বর্ণনা মাহমুদুল হক এভাবে দিয়েছে: “চটে যাবার ভান করে মনি ভাইজান বললে, ‘খোল ব্যাটা, প্যান্ট খোল। এই, কে আছিস, চাকু নিয়ে আয়, আজ ওর নুনু কাটবো, ওকে মুসলমান বানিয়ে ছাড়বো। বল আল্লাহ।”
ছোট সাধারণ ঘটনা। লেখক মাহমুদুল হক সাধারণ খুঁটিনাটি ঘটনার মধ্য দিয়ে একটা বদলে যাওয়া সমাজ বাস্তবতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। দেশ ভাঙাভাঙির বড়দের ব্যাপার ছোটদের মনস্তত্ত্বেও এসে হানা দেয়। যে শিশুদের জগৎ লেখকের ভাষায়, ‘সবকিছু ছিল থিতানো। কোথাও কোনো কোলাহল নেই, উপদ্রব নেই’। সেই না বোঝা জগতেই উপদ্রবের মতো হানা দেয় দ্বিজাতি তত্ত্বের বিভাজন। আরও অনেক কিছুর সঙ্গেই মাহমুদুল হক টালমাটাল সে সময়কার শিশুদের শৈশবের এই পরিবর্তনকে দেখেছেন। যা একেবারে শিশুতোষ নয়, কিন্তু অনিবার্যভাবেই এর প্রভাব শিশুদের উপর পড়েছে। মাহমুদুল হক ছোট ছোট ঘটনা আর দু-এক লাইনের ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে আগান। যেগুলো জোড়া দিলে একটা বড় সময় পরিসরকে ধরা যায়। একটা জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার বয়ান হয়ে ওঠে।
‘মনি ভাইজান তৈরি করতো তিন পালের জাহাজ। এক একটা জাহাজের এক একটা নাম থাকতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ। প্রিন্স অব ওয়েলস। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে থাকতো চালভাজা, প্রিন্স অব ওয়েলস-এ কলো পিঁপড়ে, সুড়সুড়ি পিঁপড়ে। কিছুদূর গিয়েই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় চাবচুব হয়ে জাহাজগুলো ডুবে যেত। মনি ভাইজান বলতো, ইংরেজদের দিন শেষ হয়ে আসছে।’
‘ছবি, তরু, তরু, রমা, রানুবেলা, শিবানী আরো অনেকে আসতো। রানিবুবুর ক্লাসের মেয়েরা। তারা চৌধুরীপাড়ার মেয়ে। কিন্তু দক্ষিণপাড়ার মানুষজনের ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়টা একটু বেশিই ছিল, তারা গা বাঁচিয়ে চলতো সবসময়। তারা আমাদের বলতো মোচোনমান।’
‘ক্যাঁ ক্যাঁ করে শালিক ডাকার পর পুঁটি বললে, দেখেছ দেখেছ, কি বজ্জাত! আমাকে নচ্ছার বলে গাল দিল। পাকিস্তান চায় বলে হিন্দু পাখিরা নাকি ওর ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে, শোনো কথা! তা আমার কি দোষ বলো? ওই শোন আবার কি বললে! বলছে, তোমার জাতভেয়েরা তো করেছে-।’
‘দ্রুত একটা পরিবর্তন ঘটছিল চারদিকে। সেসব আমরা কিছু বুঝতাম না। হিন্দু-মুসলমানদের দলাদলির কোনো ব্যাপার থেকে বালক সংঘ ভেঙে দুই টুকরো হয়েছিল। কাজীপাড়ার একটা দলের সঙ্গে তুমুল মারপিট হলো একবার। তখন চলাচল ছিল মার্টিন ট্রেনের। চলতো ঢিমেতালে। কাজীপাড়ার ছেলেরা চলন্ত মার্টিনে উঠে কোনোরকমে মাথা বাঁচায়। যাওয়ার সময় বলে যায়, এর হিসেব হবে। এক একটা করে লাশ পড়ে থাকবে মাটিতে।’
সামাজিক ভাঙনটা ঘটছিল দ্রুতলয়ে। চেনাজানা মানুষগুলো অচেনা হয়ে উঠছিল। ভারতবর্ষের কয়েক হাজার বছরের সভ্যতা, বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের যে মর্মবাণী, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা- সমস্ত কিছুতে আঘাত হানল সাম্প্রদায়িক ভাবনার বিষবৃক্ষ। ছড়িয়ে পড়তে লগল ঘৃণা, হিংসা। আক্রান্ত হতে থাকল সংখ্যায় যারা কম। তাদেরকে গ্রাস করল ভয়। অস্তিত্বহীনতার মাঝে পড়ল তারা।
‘চাঁপাডালির মোড়ে ছিল মসজিদ। কাজীপাড়া, ময়না আরো দূর দূর থেকেও অনেকে নামাজ পড়তে আসত সেখানে। বিশেষ করে ঈদেও দিন। সেবার হয়েছে কি, আমরা দল বেঁধে সকলে মসজিদে যাচ্ছি ঈদের নামাজ পড়তে, হঠাৎ একটা ঢিল এসে পড়ল। ঢিলটি পড়লো টিপু ভাইজানের পায়ে। পেছনে কে যেন চেঁচিয়ে বললে, দ্যাখ দ্যাখ মাথায় লেজওলা লেড়েরা কেমন কপাল ঠুকতে যাচ্ছে।
আব্বা বললে, কোনোদিকে খেয়াল করার দরকার নেই, হাঁটতে থাকো-/ তা আমরা সেইমতোই মাথা নিচু করে কোনোদিকে না তাকিয়ে মসজিদে গিয়েছিলাম।’
‘কি হে বালক, তোমাদের বাড়িতে শুনি কাজীপাড়ার মোচোনমানরা দেদার মিটিং করে? তোমার বাবা পাকিস্তান চায় নাকি?’
এরই মাঝে এলো ১৯৪৬ সালের নির্বাচন। পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিল এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ। পাকিস্তান কী, পাকিস্তান হলে কী হবে- এ সব প্রশ্নের তর্ক থাকলেও মীমাংসা ছিল না। লেখক সে বিষয়টিই স্মরণ করিয়ে দেন।
‘পাকিস্তান কি জানা ছিল না। বুঝতাম না এসব কিছুই। … কিছুদিন আগে কিসের যেন একটা ভোটাভুটি গেছে; সেই থেকে দেখতাম আমাদের পাড়া-প্রতিবেশীদের অনেকেই মনমরা, কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারি, কিন্তু কি তা বুঝি না।.. মাঝে মাঝে আমাদেও গ্রামের বাড়ির নিকট আত্মীয়-স্বজনরা এসে ফিসফাস করত ঠিকই, তখন সকলের মুখেই থাকতো দুশ্চিন্তার ঝুলকালি মাখা ময়লা ছাপ; আব্বা খুব গম্ভীর মুখে বলতেন দেখা যাক কি হয়?’
‘আমাদের বাইরের ঘরেও মাঝে মাঝে শুনতাম তুলকালাম চলছে। আব্বা, কেনারাম কাকা, দুর্গাদাস বাবু, নির্মল বাবু আরো অনেকেই খুবই শোরগোল তুলে তর্কাতর্কি করতো। আমাদের কানে আসত কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, জিন্না, জহরলাল, প্যাটেল, সব মনেও নেই।’
টাটা, ইস্পাহানি, কংগ্রেস, মুসলিম লীগের স্বার্থে দেশভাগ হলো। র্যাডক্লিফের পেন্সিলের খোঁচায় নির্ধারণ হলো ভারত-পাকিস্তানের সীমানা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিটা হলো ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার বাংলা ও পাঞ্জাবের। যে বিভেদ ঠেকানোর উছিলায় দুই দেশ- তার জন্ম প্রক্রিয়াতেই হিংসার চূড়ান্ততা। প্রশ্নের শেষ নেই, মীমাংসাও নেই কোনো।
‘এরপর হুট করে একদিন পাকিস্তান হয়ে গেল। কি হলো না হলো অতো বুঝতাম না, কেবল মনে আছে আমাদের বাড়িতে একটা অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এলো সেদিন। বাইরে রাস্তায় হুড়োহুড়ি রসগোল্লা ছোঁড়াছুঁড়ি বহু কিছু চলছিল, অথচ আমাদের কিছু করবার নেই, আব্বা বললে কেউ বাইরে যেও না, ঘরে থাক সবাই। তা আমরা ঘরেই থাকলাম। দু’একদিনের মধ্যেই বুঝলাম এমন একটা কিছু ঘটে গেছে, যাতে আমরা কেউই ভালো নেই, আমাদেও আর ভালো থাকা সম্ভব নয়, আমাদের পারিবারের সুখ-শান্তি চুরি হয়ে গেছে, আব্বাকে সবসময় দেখতাম থমথমে। মাঝে মাঝে মার সঙ্গে তর্ক হতো। আর অনেকের সঙ্গেই তর্ক হতো। শেষে সকলের অমতে আব্বা পাকিস্তানে চলে এলেন।’
‘আব্বা বলতো মাথা উঁচু করে চলতে পারাটাই বড় কথা। যেখানে মাথা উঁচু করে থাকতে পারব সেটাই দেশ। মা বলতো তাই বলে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে অজানা এক দেশে আমাদের থাকতে হবে। এটা কোনো কথা। আমি কোথাও যাব না।’
যে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য আবদুল খালেকের বাবা তার জন্মভিটা ছেড়ে অজানা দেশে পাড়ি জমান সেই দেশটাতে কী মথা উঁচু করে বাঁচতে পেরেছিলেন? ভিটেমাটি না ছাড়ার জন্য, ‘কোথাও যাব না’ বলে মায়ের যে আর্তি, পাঁজরছেড়া দীর্ঘশ্বাস- তার জীবনেই বা কী ঘটেছিল? এই দুই বিপরীত প্রশ্নের উত্তর অনেক বছর পর আবদুল খালেকে, রেখা আর নরহরি ডাক্তারের মধ্য দিয়ে পাওয়া যাবে। তবে সেটা অদ্ভূত রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হবার পরের পটভূমিকায় হওয়ার সম্ভাবনায় বেশি। ১৯৭৬ সালে ‘কালো বরফ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। আবদুল খালেক তখন মফঃস্বল একটি কলেজের শিক্ষক। রেখার সঙ্গে তার আট বছরের বৈবাহিক জীবন। লেখকের বর্ণনায় আবদুল খালেকের যে ছবি পাওয়া যায়, সেখান থেকে ধারণা করা যেতেই পারে তিনি মধ্যবয়সী। এ থেকেও মনে করা যেতে পারে লেখক ১৯৭১-পরবর্তী আরেকটা সংকটপূর্ণ সময়ের কথা বলেন। তবে এ সময়টা এর আগেও হতে পারে। তবে এ সময়কার রাজনৈতিক বাস্তবতার কোনো ইঙ্গিত বা সূত্র লেখক পরিষ্কার করেননি। কিন্তু অর্থনৈতিক বাস্তবতা- যেমন কালোবাজারির মাধ্যমে নব্যধনী তৈরি হওয়া, তাদের মানসিক সংস্কৃতি, ক্ষমতাকেন্দ্রিক সমাজ, জাল ভোট, খুনখারাবি- সেই সঙ্গে দুমূল্যের বাজার, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের দীর্ঘশ্বাসের হিসেবি জীবনের টুকরো টুকরো ছবি তিনি তুলে ধরেন।

আবদুল খালেক যে কলেজে পড়ান- দিন দিন সেখানকার শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। শিক্ষকদের বেতন বন্ধ হবার উপক্রম। শিক্ষার্থীরা একেবারে কম পাস করায় সরকারি বরাদ্দও বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। কলেজের সম্পত্তি স্থানীয় টাউটদের কাছে লিজ দেওয়া। স্থানীয় নব্য ধনী আছেন, কিন্তু তারা কলেজে টাকা দিতে নারাজ। অথচ মাদ্রাসায় কাড়িকাড়ি টাকা দিতে উদগ্রীব। এমন অনিশ্চিত জীবনের বাস্তবতা আবদুল খালেকের সামনে। এর উপর বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে হু-হু করে। ‘দুটি বেলা, তিনটি ট্যাংরাগোটা কয়েক পুরু খলশে বৈচা এলং টাটকিনি পিয়ালি আর পেনেরো বিশটার মতো পুঁটি, এই নিয়ে একভাগা মাছ’ আর একফালি মিষ্টি কুমড়া বা আধা কেজি বেগুন- দিনের পর দিন এভাবেই চলছে সংসারে আয় আর ব্যয়ের ইঁদুর-বেড়াল দৌড়। এ সংকট আবার সবার নয়। যারা এদিক-সেদিক নানা উপায় করে পয়সা কামাতে চান, তাদের জন্য অফুরান সুযোগ।
আবদুল খালেকের একমাত্র পিছুটান তার স্ত্রী রেখা আর সন্তান টুকু। নিজেকে নিয়ে নয়, তাদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়েই তার ভাবনা। কিন্তু মামার সংসারে বেড়ে ওঠা রেখার জীবনের বড় অংশই অপমান-গঞ্জনায় পূর্ণ। নয় বছরের দাম্পত্য জীবনে আবদুল খালেক তার কাছে বুঝে না ওঠা মানুষ। আবদুল খালেকের অর্থনৈতিক অপারগতায় ক্ষুব্ধ রেখা। তার সম্পর্কে রেখার মূল্যায়ন হচ্ছে: ‘দিনের পর দিন তো দেখছিই, কোনো ব্যাপারেই তোমার কোনো চাড় নেই!/ তোমার মতো মানুষদের চিরকাল এইভাবেই নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে হয়, ঘেন্না লাগে আমার।’
সামাজিক মাপকাঠিতে আবদুল খালেক নিতান্তই অক্ষম। সব মূল্যবোধ, সমস্ত অর্জন বিসর্জন দিয়ে পয়সা কামানোটাই যখন সমাজের একমাত্র লক্ষ্য, বাসনা হয়ে ওঠে সেখানে আবদুল খালেকদের মতো আঙুল চোষা হাবলু মানুষেরা, যাদের পা ভাঙা শালিক পাখির প্রতিও সীমাহীন দরদ, তারা যে কমলালেবুর মতো ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর তলের দিক থেকে টুপ করে খসে পড়ার মধ্যেই থাকবেন। এটাই স্বাভাবিক সত্য। দেশভাগের ভয়ানক দানবীয় বাস্তবতার মাঝে শেকড় উপড়ানো মানবীয় শিশু আবদুল খালেক তার দুঃসহ এই উন্মূলতাকে অনিবার্য নিয়তির মতো বহন করে চলেছেন বাকি জীবন ভর। এই ভেসে বেড়ানো জীবনের কোথাও শান্তি নেই, কোথাও স্থিরতা নেই। মহাশূন্যিয় নৈসঙ্গতা তার আলো-ছায়ার যুগলবন্দী হয়ে তার সাথে সাথে চলে।
এই অস্তিত্বহীনতা থেকে আবদুল খালেক আশ্রয় চান। মাতৃজঠরে শিশু যেমন হাত-হাঁটু মুড়ে দ-এর মতো চোখ বুজে নিরাপদ তন্দ্রার ঘোরে ডুবে যায়, আবদুল খালেক সে রকমই এক ঘুম চান। রেখার কোলে, রেখার স্তনের ওমে সেই নিরাপদ তন্দ্রার তালাস করেন তিনি। তাড়া করে বেড়ানো অস্তিত্বহীনতা তার ভেতরে অক্ষম ক্ষোভের জন্ম দেয়। রোজ রোজ চুনোমাছ কাটতে ও রাঁধতে অস্বীকার করায় অহম জেগে ওঠে ঠিকই তার ভেতর। রেখাকে সে বলে, ‘তুমি না পারলে আমি পারবো। দুপুরের পর শুধু একটা ডিগ্রির ক্লাস নিলেই চলবে। কেমন পটেটো চটকাই আজ দেখো…।’
আবার বেড়াতে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে রেখাকে পাঁজাকোল করে তুলে ঘাসের উপর ফেলে রেখার সঙ্গে যখন কর্কশ যৌনতায় মেতে ওঠে- তখনও অক্ষমতাজাত ক্ষোভের প্রকাশকেই জানা যায়। ‘পিঠে লাগেছে’ বলার পরও রেখাকে সে নির্মমভাবে বলে ওঠে ‘লাগুক’। কিন্তু আবদুল খালেক কী পুরোপুরি বোধশূন্য মানুষে রূপান্তরিত হতে পারে? মাহমুদুল হক কিন্তু সেটা বলেন না। গরগরে চণ্ড ও আত্মবিস্মৃত আবদুল খালেক তার গহীন উন্মত্ততার পাতাল থেকে বললে, ‘আমার মাধুরী, মাধুরানী-’
শৈশবের মাধুরীকে এতদিন বাদেও নিজের অস্তিত্বে বহন করেন আবদুল খালেক। গিরিবালাকেও বহন করেন। আত্মহত্যা করা মনি ভাইজান তার কান্নাভেজা অস্তিত্বের অংশ হয়ে থাকে। কেনারাম কাকা, পুঁটি, পুকুরের পুরানো কাতল মাছ, ঠ্যাংভাঙা শালিক, ছবি দিদি, গুলি খেয়ে মানুষের মতো কান্নারত শকুন, অর্চনা দিদিমনি- সবকিছুই তার ছিন্নমূল সত্তার একবারে গহীনের অংশ হয়ে লেগে থাকে। ১৯৪৭, দেশভাগ আবদুল খালেকের বুকে পেরেক ঠুকে ঠুকে ঠেসে ভরে দিয়েছে এইসব ঠাণ্ডা শীতল বরফ। আর ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে ওঠা রক্তস্রোত শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে। মাহমুদুল হক নির্মাণ করেন কালো বরফের সেই আখ্যান।
আখ্যানের শেষটাতে আবদুল খালেক আশ্রয় খোঁজেন। বর্তমানের রেখা, আর সত্তার গহীনে চাপা পড়া মাধুরীর কোলে। নিরাপদ এক ঘুম চান তিনি। মাহমুদুল হক হয়তো বলতে চান- ঢের হয়েছে, এবার অন্তত একটু নিরাপদে ঘুমাক আবদুল খালেক। একটু শান্তি-স্বস্তি নামুক তার জীবনে। এই আকাঙ্ক্ষা ১৯৭৬ সালের। তখন দেশভাগের পর ২৯ বছর পেরিয়ে গেছে। মাথা উঁচু করে বাঁচবে বলে যে পাকিস্তান হয়েছিল সেখানে মাথা আরও নিচু হয়েছে বলেই মানুষ সেটাও ভেঙে ফেলেছে। এখন বাংলাদেশ। সেখানেও আবদুল খালেক, নরহরি ডাক্তারেরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছে না। আবদুল খালেকদের জীবিকার অনিশ্চয়তা, নরহরিদের উন্মূলিত হয়ে যাওয়ার অনিশ্চয়তা। রেখাদের আবার সংসার ভাঙার অনিশ্চয়তা। এইসব মানুষদের চাওয়াটা সামান্য। নিরাপদ আশ্রয়। মেলে কী? ১৯৭৬ সালের পরও ৪২ বছর পেরিয়েছে। মীমাংসা হয়েছে কী এই সরল চাওয়ার।
‘রেখা হাত বুলিয়ে দিল আবদুল খালেকের মাথায়। আবদুল খালেক বললে, সেই বোধহয় প্রথম তার ছিঁড়ে গেল সবকিছুর, সে তার আর কখনো জোড়া লাগল না। আর কখনো জোড়া লাগবে না। মনি ভাইজান পারে নি, পারতে চায় নি। যদি পারবে, তবে ওভাবে মরতে গেল কেন। মার সামান্য একটা কথায় অতোগুলো ঘুমের বড়ি খেতে যাবে কেন, তা না হলে তুমি পারতে? ওই ছেড়া তার জুড়ে দিতে? স্টিমারে সারারাত আমরা দাঁড়িয়ে কাটিয়েছিলাম। সারাক্ষণ মনি ভাইজানের পামশ-সারাক্ষণ। এক একটা ঘাট আসে, তারপাশা, ভাগ্যকূল, ষাটনল, মনি ভাইজান হু-হু করে কাঁদতে থাকে। বলতে থাকে- তারপাশা তোকে আমি মরাব, ভাগ্যকূল তোকে আমি মরাব, নদী তোকে আমি মরাব, শেষ মারা আর শেষ হয় না কিছুতেই…’
রেখা বললে, থাক, তুমি চুপ করো, ঘুমোও, তুমি যে কী…’
আর কোনো কথা বললে না আবদুল খালেক। একসময় বোধ হয় তার তন্দ্রা এলো। ঘুমোবার আগে রোজ যা হয়, সে হাত-পা মুড়ে, হাঁটু দ করে টুকুর মতো এই এতটুকু হয়ে গেল সে। তারপর একসময় হাতড়ে হাতড়ে রেখার একটা পায়ের ওপর হাত রেখে সে বললে, আমাকে কোলে নাও মাধুরী…’
অলংকরণ- মারুফ ইসলাম