
করুনা নয় করোনা
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পশ্চিমে কাঁটাসুর যাবার পথে হাতের বায়ে ময়ূর ভিলা। এর ঢাল বেয়ে নেমে গেলে লতিফ রিয়েল এস্টেট। হাউজিং এর নাম গালভরা হলেও খুব সাজানো গোছানো এলাকা নয়। বেড়িবাধের ঢালের নিচে উন্মুক্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পাশেই ঘনবসতি গণমানুষের বাস। অনেক মানুষ তাদের নানা পেশা, নানা আয়োজন। এরকম ঘনবসতির পাশে একটা পুরনো দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় দুই রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাটে রওশন-রহমত দম্পতির বসবাস।
তাদের দুই মেয়ে নিয়ে টানাপেড়োনের সংসারে চাকচিক্য না থাকলেও স্বস্তির অভাব কখনও ছিল না। কিন্তু দুই হাজার বিশ সালের এপ্রিল মাসের লকডাউন অস্বস্তি নিয়ে এলো তাদের জীবনে। একদিন সকালে রওশন মাছ কাটছিল এমন সময় তার ছোট মেয়ে মাকে ডাক দেয়—মা মা তোমারে আনু খালা ফোন করছে ধরো। মোবাইল নিয়ে রান্নাঘরে আসে বৃষ্টি। রওশন আরা মাছকাটা বটিটা একপাশে সরিয়ে রেখে মেয়ের কথার জবাব দেয়—তোর খালায় ফোন করছে ধইরা কথাবার্তা ক, দেহোসনা আমার হাত ময়লা।
—তোমার হাত ধোয়া লাগতো না তুমি কথা কও। বৃষ্টি মায়ের কানের পাশে মোবাইল ফোনটা ধরে। মাছের কান ফেলে দিতে দিতে ছোট বোনের কথা শোনে রওশন আরা রসু। অন্যপ্রান্ত থেকে আনুর কথা ভেসে আসে—বড়বুজি চারিদিকে বিপদ কি করবা কিছু ভাবছো? তোমার চাকরি নাই, দুলাভাই এর একলার আর কেমনে চলবা? ট্যাকা পয়সা ঠিক মতো রাইখ্যো, মাইয়াগোরে কইয়ো, আজেবাজে খরচ না করতে। আনুর একটানা বলা কথাগুলো রওশনের কাছে ফেরিওয়ালার ডাকের মতো একঘেয়ে মনে হয়। একথা সেকথার পর সে উত্তর দেয়—শোন আনু, আমি অহন মাছ কাটতাছি। তোর লগে পরে কথা কমু, অহন রাইখ্যা দে। বৃষ্টি মায়ের কান থেকে মোবাইল সেটটা সরিয়ে নিয়ে চলে যায়। রসু মাছ কাটায় মন দেয়। মায়ের কথা থেকে খালার কথার কিছুটা আন্দাজ করে বৃষ্টি।
পাশের ঘর থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরের দরোজার কাছে আসে বৃষ্টির বাবা রহমত— কিরে তোর খালায় কি কয়?
—তুমি মায়েরে জিগাও, বৃষ্টি বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নবোধক হাসি ছুড়ে দিয়ে নিজের ঘরে যায়।
রওশন বোনের কথা মনের স্টোরে রেখে দিয়ে মাছ কাটতে থাকে। রহমত রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে—কি ব্যাপার আমার শালী কি কয়? শালীর খবর শোনার ব্যাপারে স্বামীর উৎসৌক্য রওশনের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। তাই খানিকটা ঝাঁঝালো স্বরে জবাব দেয়—শালীর খবর জানোনের এত হাউস ক্যান? পঞ্চাশোর্ধ্ব রহমত ডাইনিং স্পেসে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খায়। এরপর হাসিমুখে বলে—আমার শালীগো খবর আমি জানলে তোমার এত জ্বলে ক্যান?
রওশন মাছকাটা শেষ করে ধুয়ে লবণ-হলুদ দিয়ে মেখে ঢেকে রেখে উত্তর দেয় তোমার শালীগো খবর তুমি একশো বার জানবার পারো, মোবাইলে কথা কও। আমারে জিগাও ক্যান?
স্ত্রীর কথায় রহমত হাসে।—বিপদ-আপদের দিনে মানুষই মাইনষের খোঁজ খবর নেয়, ওরা তো আমার বড়কুটুম।
রুমের ভেতর থেকে দুই মেয়ে বাবা-মায়ের কথা শুনতে পায়। দুই রুমের ফ্ল্যাটে কোন কিছুই আড়াল থাকে না। রান্নাঘরের কথাবার্তায় রওশন-রহমত দম্পতির বড় মেয়ে বর্ষা গোসল সেরে চুল মুছতে মুছতে বের হয়। ছোট বোন বৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করে—কিরে কি হইছে? মায়ে ক্ষেপছে ক্যান?
বিছানার উপর থেকে বইপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে বৃষ্টি উত্তর দেয়—আনু খালায় মায়েরে ফোন করছিলো, মায়ে খালার লগে কি কথা কইলো হেইডা আব্বায় জানবার চায়।
বর্ষা অবাক হয়—তো এই নিয়া মার সমস্যা কি?
—বোজোস না খালাগো কথা নিয়া আব্বায় মশকরা করে, আর মায়ে চেইত্যা যায়। বৃষ্টি হেসে উত্তর দেয়।
রওশন আরা বোনদের ছোটবেলা থেকে আদর যত্ন করে বড় করেছে, অনেক বড়ভাইও যা করে না। তাই বোনদের ব্যাপারে সে কারও সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। এই ব্যাপারটা অন্য কেউ না বুঝলেও রওশনের বড় মেয়ে খুব ভাল করে বোঝে। তাই খালাদের অনেক ছোটবড় আচরণে মা কষ্ট পেলে সেই মায়ের পাশে থাকে। এবারও তাই পরিস্থিতি বোঝার জন্য বর্ষা মায়ের সামনে এস দাঁড়ায়—মা তুমি পাকের ঘরে কি করো? রহমত রান্নাঘরের সামনে থেকে ততক্ষণে বারান্দায় চলে গেছে, রওশন চুলার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ের প্রশ্নে ইতস্ততভাবে উত্তর দেয়—রান্নাঘরে আর কি করি! পাগলী মাইয়া, রান্নবাড়া করতে অইবো না, কাটাকাটি করতাছি।
বর্ষা মায়ের কন্ঠস্বরে বেদনার আভাস পায়। মাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে—মা তোমারে কইছি না লকডাউনের সময় প্রতিদিন আমি পাক করুম, তুমি বিশ্রাম নিবা। আমি গোসলে গেছি আর তুমি পাকের ঘরে আইছো।
মায়ের মুখে আলো খেলা করে, তাই দেখে আশ্বস্ত বোধ করে বর্ষা—যাক মেঘ কেটে গেছে। রান্নার তোরজোর শুরু করে অষ্টাদশী বর্ষা, গুনগুন করে গান গায়—আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি…।
মেয়ের গলার গুনগুনানি শুনে রওশনের মনের জমে থাকা বোনের প্রতি বিরক্তি, স্বামীর প্রতি অভিমান খানিকটা ফিকে হয়ে হাওয়ায় মিলায়। মনে মনে ভাবে-মাইয়াগো মনে সুখ থাকলে কোন মায়ের না ভাল লাগে! রান্নাঘর থেকে বেড়োনোর সময় রওশন মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে—বর্ষা মাছগুলারে ভাল কইরা ভাজিস হেরপর আলু বেগুন দিয়া রান্দিস। আর হ্যাঁ ধইন্নাপাতাও দিস।
বাারান্দায় শুকাতে দেয়া কাপড়চোপড় আনতে গিয়ে রওশন দেখে, রহমত বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। স্ত্রীর উপস্থিতি টের পেয়ে বলে—দেখো রসু কি সুন্দর মরিচ ধরছে।
—হ বর্ষায় লাগাইছিলো, কয়দিন আগে। রওশন তারে ঝুলিয়ে রাখা কাপড় তোলার ফাঁকে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে—চা খাইবা? কইরা দিমু? রহমত মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায়।
রওশন চলে গেলে রহমত নিজের মনে ভাবে—রওশনের মনটা আসলেই নরম স্বামীর সাথে দু-একটা কড়া কথা কইছে কি কয় নাই; তাতেই আবার দেখতে আসছে। রান্নাঘর থেকে মাছ ভাজার আওয়াজ আসে। রহমতের বুকের মধ্যে কোথাও যেন ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে উঠে। রওশনের জন্য এক ধরনের মায়া অনুভব করে। বিশ/বাইশ বছর বয়সী রওশন চোখের সামনে চলে আসে তার।
রওশন হোসনা পিঠাপিঠি দুইবোন। হোসনা ফর্সা রং দেখতেও সুশ্রী, রওশনের সাদামাটা চেহারা শ্যামলা রং। দুই বোন একসঙ্গে চাকরি করতো। রহমত একটা প্রেসে কাজ করতো। মাঝে মাঝে দুই বোনকে দেখতো। রওশনের চেহারায় একটা আত্মপ্রত্যয়ীভাব ছিল, যা রহমতের ভাল লেগে যায়। বন্ধু হারুনের মাধ্যমে রওশনকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় রহমত। রওশন হ্যাঁ বা না কিছু না বলে রহমতকে সরাসরি দেখা করতে বলে। যেন বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো রহমতের জন্য।
পল্টনের এক রেস্তোরায় রহমতের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রওশন বলেছিল—হারুন ভাইয়ের কাছ থাইক্যা সব শুনছি। অহন আমি যা যা কই মন দিয়া শোনেন। রওশন বলছিল তাদের পারিবারিক অবস্থা, বাবা সামান্য দোকান চালায়, চার বোন, ভাই নাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। রহমতকে চুপচাপ শুনতে দেখে রওশন আবার জিজ্ঞেস করেছিল—আপনি কি কিছু শুনছেন?
—হ্যাঁ শুনছিতো। আসলে রহমত মন দিয়ে শুনছিলো না, অন্যকিছু ভাবছিলো। সাদা জমিনের উপর গোলাপী ফুল আঁকা কামিজের ফুল, রেস্তোরার লোকজন, রওশনের কথার গুনগুনানি, সবকিছু ছাপিয়ে মায়াবী মেয়েটাকে কাছে পাবার জন্য মনের মধ্যে তোলপার চলছিলো। সেই মুহুর্তে মনে হচ্ছিল, মেয়েটাকে বাদ দিয়ে তার জীবন কেমন যেন স্বাদগন্ধহীন! তাই রওশনের শেষ কথাটায় নড়েচড়ে ভাবনা থেকে বাস্তবে আসে রহমত।
—আপনি হোসনারে বিয়ে করতে পারেন। আমার আপত্তি নাই।
নড়েচড়ে বসে রহমত।—আমি আপনাকে মানে তোমারে বিয়া করতে চাই। রওশন চুপ হয়ে যায়। মাথা নিচু করে থাকে কিছুক্ষণ।
সিগারেটে শেষটান দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপন মনে হাসে রহমত।
২
গোসলে গিয়ে বালতিতে ভেজানো কাপড় কাচে রওশন। মনের মধ্যে কত রকম কাচাকাচি যে চলে তার কোন হদিশ নাই। আপন মনে বলে—কি এক বিপদ আইলো দুইন্যায়। মানুষের কাজকর্ম নাই, অফিস আদালত বন্ধ, গাড়িঘোড়া সব বন্ধ, অসুখ হইলে, কেউ মইরা গেলে মানুষ মানুষরে দেখতে যাইতে পারবো না—এর চেয়ে খারাপ আর কি হইতে পারে। দরজায় আওয়াজ হয়। কোন রকমে দরজা খোলে রওশন।—মা মনু খালায় ফোন দিছে। ছোট মেয়ে বৃষ্টি জানায়।
শুকনা গামছা দিয়ে মোবাইলটা হাতে নেয় রওশন—কেমন আছিস মনু? মনুর কন্ঠ ঝাঁঝালো শোনায়—বুজি ফোন ধরো না কেন? আনু বুজির লগে কথা কইলাম হে কইলো তুমি মাছ কাটো। তোমার মাইয়ারা একটু মাছও কাটবার পারে না। একথা সেকথার পর রওশন বলে—মনু আমি গোসলখানায় ঢুকছি, তোর লগে পরে কথা কমু।
দরজা বন্ধ করে আস্তে আস্তে পানি ঢালে রওশন। পানির স্পর্শ মাথার চুলে কোমল পরশ বুলিয়ে যায় কিন্তু মগজের ভেতরের শিরা উপশিরায় যে উত্তাপ উত্তেজনা তাকে শান্ত করার ক্ষমতা পানির নেই!
দুপুরে খাওয়ার পর মেয়েরা গল্প গুজব করছে রহমত নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এই ফাঁকে রওশন দুই বোনের সঙ্গে মোবাইলে কথা সারে। রওশন বোনদের হিসাব- নিকেশ স্বামী ও মেয়েদের থেকে আড়াল করতে চায়।
আনোয়ারা ফোন ধরেই বলতে থাকে—বুজি তোমার মাইয়াগো দিয়া সংসারের কাজকাম করাও নাকি নিজেই সব করো? রওশন খানিকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে—কেন রে আনু তোর এমন মনে হয় ক্যান? আনু জবাব দেয়—মনুর লগে কতা কইলাম হে কইলো তুমি কাপড়-চোপড় ধোও, আমি ফোন করলাম তুমি মাছ কাটো হ্যারলাইগা জিগাইলাম। রওশন বোনের মনের কথা বুঝে বলে—মাইয়ারা ডাঙ্গর হইলে কাম না কইরা থাকতে পারবো! আর মাইয়া ক্যান পোলারাও ডাঙ্গর হইলে কাম ছাড়া থাকতে পারে না।
—শোন বড়বুজি ওইসব কতা থাউক। যে করোনা আইছে কোনদিন যাইবো তার ঠিক ঠিকানা নাই! ডাক্তাররা কওয়া বলা করছে টিকামিকা আইতে দেরী আছে, এদিকে তোমার অবস্থা তো আমি জানি হুনলাম দুলাভাইর চাকুরীও এইমাস থাইক্যা নাই তাই তোমার বোনজামাই এর লগে কওয়া বলা করছিলাম তোমরা কেমনে চলবা? আনুর কথার মাঝে রওশন ঢুকে পড়ে—ম্যালা ভাইবা ফালাইছোস অখন আমি কইকি, নিজে সাবধানে চলিস, পোলাটারে আর ওর বাপেরে দেইখ্যা রাখিস। আর আমাগো টাকা পয়সার সমস্যার একটা একটা সমাধান হইবো ভালা থাকিস।
রওশন ভিন্ন চিন্তা না করে ছোটবোনকে ফোন দেয়—কেমন আছোস বুনি?
—বড়বুজি আমরা তো আছি একরকম তোমারে নিয়াই তো চিন্তা করি তোমার চাকরি নাই, দুলাভাইয়ের কাজ কামের কি অবস্থা? আনু বুজি কইলো হের হাত খালি। তোমার বোনজামাই দ্যাশ থাইক্যা চাউল আনছিলো; তাই তোমারে আধামণ পাঠাইতে চাই কিছু উপকার তো হইবো নাকি কও…! ছোট্ট বাচ্চাটার যত্ন নেয়া নিজের শরীরের যত্ন নেয়ার কথা বলে ছোট বোনের সাথে কথা শেষ করে রওশন। বোনদের সাথে কথাবলা শেষ হলেও রওশনের নিজের মনে বলা কথা অফুরান, শেষ হতে চায় না। বোনদের কথায় লকডাউনকালীন অনিশ্চয়তা এবং কোভিডের তাণ্ডবতার পাশাপাশি রওশনের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে ভয়ের ছায়া দেখতে পায় রওশন। ভারাক্রান্ত মন অতীতের সুখ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
চোখের সামনে তিন বোন খেলা করে। কখনও কানামাছি কখনও চোরপুলিশ, কখনোবা বৌচি। রওশনদের মা রান্নায় ব্যস্ত, রওশন কাটাকুটিতে। রান্না থেকে চোখ সরিয়ে ডাক দে—আনু মনু হোসনা তোরা এদিকে আয়। রওশন মাকে বলে—ক্যান ডাকো মা। আমারে কও, ওরা ছোটমানুষ খেলতাছে, খেলুক। তারপর ওরা বড় হলো, পড়ালেখা শিখলো, চাকরি-সংসার-সন্তান কত কি? রওশনের হাতের মোবাইলটা বেজে উঠে। এবার হোসনার মেয়ে ভাগ্নী রওনকের ফোন—খালা, খালাগো কেমন আছো? হোসনা নেই আজ কয়েক বছর, মা হারা মেয়েটার আকুতি রওশনকে নাড়া দেয়—মারে আমি ভাল আছি। তুমি কেমুন আছো? একথা সেকথার পর ভাগ্নী তার খালাকে বলে—খালা চারিদিকে বিপদ আমি তোমারে কিছু টাকা বিকাশ করতে চাই। আনোয়ারা মনোয়ার কথায় বিরক্ত হলেও ভাগ্নীর কথায় রওশন হাসতে থাকে। —খালা তুমি হাসতাছো ক্যান! আমি অন্যায্য কিছু কইছি? মায়ে বাইচ্যা থাকলে তোমারে সাহায্য করতো না। হাসি থামিয়ে উত্তর দেয়—মাইয়া আমার তুমি কেনো ট্যাকা পাঠাইবা না, দুইন্যা জোড়া বিপদ পরলে আমার দেওররা আছে, তোমার খালারা আছে; একটা ব্যবস্থা হইবো।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে স্বামী ও মেয়েদের সাথে নিয়ে একসঙ্গে আলোচনায় বসে রওশন। রহমত ভাবলেশহীনভাবে খাটের কোনায় বসে, সেদিকে তাকিয়ে বর্ষা বলে—আব্বা তোমার কি শরীর খারাপ?
—নারে মা, আমি ঠিক আছি।
রওশন স্বামীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রহমতের মানসিক অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করে। বাইশ বছর ধরে সংসার করছে রহমতের সঙ্গে। শৈশবে বাবা হারিয়ে একা একাই নিজে বেঁচেছে; মা ভাইদের বাঁচিয়েছে, পরবর্তীতে বিয়ের পর শালী এবং শাশুড়িকে কম বেশি সহযোগিতা করেছে। এখন জীবনের পড়ন্ত বেলায় নিজের মেয়েদের বড় করবার সময় বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। তিজনকে চুপচাপ দেখে রহমত অবাক হয়—কিরে বেবাকতেই চুপচাপ কেন? কি রওশন তুমি কি কইতে চাইলা কও।
নড়ে চড়ে বসে রওশন—কইছিলাম কি তুমি তো গতমাসের বেতন পাইবা, পরের মাসে কি হয় কে জানে। আমার কাছে অল্প কিছু ট্যাকা আছে, মাইয়াগো টিউশুনির বাসা থাইক্যা বিকাশ করছে। আমরা কষ্ট কইরা ২/১ মাস চলবার পারুম।
বর্ষা হঠাৎ বলে—মা খালারা ফোন করছিলো হ্যারা কি আমাগো সাহায্য করবার চায়। সবার তো ট্যাকার অভাব নাই।
রহমত বিরক্তভাবে উত্তর দেয়—মা আত্মীয় স্বজন থাকলে একজন আরেকজনের খোঁজ নেয়, তাই বইলা সাহায্য করার কথা আসে ক্যামনে?
রওশন বর্ষার দিকে তাকাতেই মেয়ে আর কোন কথা বাড়ায় না। ছোট মেয়ে রহমতের হাত ধরে—আব্বা আমরা চাইর জন একলগে সাঁতরামু, তুমি কোন চিন্তা কইরো না। খাতা-কলম নিয়ে রওশন মেয়েদের হিসাব করতে বলে। তিনমাস অন্তত ডালভাত সব্জী খেয়ে বাসা ভাড়া এক মাসেরটা দিয়ে বেঁচে থাকার একটা আশুকর্মসূচী ঠিক করে রওশন-রহমত দম্পতি। একটা আপাত নিশ্চতায় হাই তুলে রওশন।—এখন তোরা ঘুমাইতে যা। দুনিয়া জোড়া বিপদ। মাানুষের কাজ-কাম বন্ধ, তাই কোন রকমে বাঁচা লাগবো; তোরা ঠিক থাকলে আমাগো চিন্তা নাই।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় রওশনের। আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় রওশন। বেলী ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ, রাতের নিঃস্তব্ধতা রওশনের বুক থেকে সাংসারিক অনিঃশ্চয়তা বোনদের হিসাব-নিকাশ সব অভিমান ফিকে হয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। বিয়ের পরের সুখী দাম্প্যত্যের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।
খুব দ্রুত ঘটেছিল সবকিছু। নিজের বিয়ের পর রহমতের ঘটকালীতেই হোসনে আরার বিয়ে হয় হেলালের সঙ্গে। দুই বোনের বিয়ে, বাবার মৃত্যু, এরপর দুই বোন মাকে নিয়ে একত্রে বসবাস। সবকিছু সম্ভব হয়েছিল রহমতের আন্তরিকতার কারণে…। রওশনের শাশুড়ি এবং দেবররাও কেউ মন্দ কিছু বলেননি। দুই মেয়ে নিয়ে সবমিলিয়ে স্বচ্ছন্দে কেটে গেছে দিনগুলো।
দুহাত ভরে বাজার করতো রহমত। হোসনে আরা হেলাল বেড়াতে এলে তো কথাই ছিল না। মাঝে মধ্যে রওশনের মা জামাইকে বলতো—বাবা এত ট্যাকা খরচা করনের কি দরকার? রহমত হেসে উত্তর দিত—মা দুইদিনের দুনিয়া খাও দাও ফুর্তি করো। মেয়ে জামাইয়ের কথায় মা সন্তুষ্ট হতে পারতেন না। মায়ের কাছে সব সন্তানই সমান। তাই তিনি রওশনকে বলতেন—জামাইয়ের হাত লম্বা, তুই একটু জমা করিস; নিজের মাইয়্যাগো চিন্তা করিস।
—মা আনু আর মনু নিজের পায়ে দাঁড়াইলে আর কোন চিন্তা নাই। সংসারে যারা বড় তাদের কি অত হিসাব করলে চলে! রওশন জবাব দিত।
রওশনের মা ছোট দুই মেয়ের বিয়ে চাকরি সন্তান সবকিছু দেখেই চোখ বুজেছেন। বোনদের প্রতিষ্ঠায় রওশনও পরিতৃপ্ত বোনদের প্রতিষ্ঠায় আনোয়ারা নামী-দামী ডায়াগোনাস্টিক সেন্টারে মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করে অন্যদিকে মনোয়ারা সরকারী নার্স। ওরা বিয়েও করেছে নিজেদের পছন্দে। আজ রওশন অন্যকিছু ভাবছে। সে নিজে বোনদের মানুষ করেছে চাল-ডাল টাকা পয়সার আশায় নয়। একান্ত ঠেকে গেলে বোনদের কাছে বড়জোর ধার নিতে পারে এর বেশি কিছু নয়। তাহলে বোনদের মনে সংশয় কেন? তারা কি ভয় পাচ্ছে? করোনার এই সময়ে শুধু নয়, রওশন কখনই কারো কাছে করুণা প্রত্যাশা করেনি। তবে একই জঠরে জন্ম নেয়া বোনদের বাড়তি উৎকন্ঠার কারণ কি? এর উত্তর রওশনের কাছে অজানা মনে হয়।
কোভিড-১৯ সরল প্রশ্নগুলোকে জটিল করে তুলেছে।