
কবি কুসুমকুমারী দাস : অচেনা তারার ঝিলিক
রাতের আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলে থাকে। সেই ভীড়ে দু’একটি তারার উজ্জ্বলতা বিদ্যুৎ চমকের মতো আমাদের চোখকে টেনে নিয়ে আবার কোটি তারার মেলায় মিশে যায়। কবি কুসুমকুমারী দাস বাংলা সাহিত্যের আকাশের তেমনি এক তারা। নগর কলকাতা একসময় বাংলা সাহিত্যের সব আলো নিজের দিকে টেনে নিয়েছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে প্রাদেশিক রাজধানী হবার সূত্র ধরে ঢাকা বাংলা সাহিত্যের আরেকটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সেটা হঠাৎ হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ত্রিশের দশকে এর গোড়াপত্তন হয়। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন কবি আবুল হোসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আব্দুল কাদির প্রমুখ। সেই বৈঠকে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র হিসাবে ১৯২৭ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ভিত্তিতে প্রকাশিত হয় ‘শিখা’ পত্রিকার ৫টি সংখ্যা। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের পুরোধা হিসাবে শিখা গোষ্ঠী ঢাকা কেন্দ্রীক সাহিত্য চর্চায় নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। এখনো ঢাকা আর কলকাতা বাংলাভাষী দুই প্রধান অঞ্চলের সাহিত্য চর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে আছে। এই কেন্দ্রের বাইরে থেকে সাহিত্যকাশে ঠাঁই পাওয়া এখনো দুরূহ হয়ে আছে। তারও বহু আগে ১৮৯৪ সালে কুসুমকুমারী দাস বরিশালে থেকে ‘দাদার চিঠি’ নামক কবিতা যখন ‘মুকুল’ পত্রিকায় ছাপেন, সেটাকে বিপ্লব বলা ছাড়া উপায় কি? কিন্তু প্রান্ত থেকে কেন্দ্রকে প্রভাবিত করার যে কাঠিন্য তা অতিক্রম করার সাধ্য ক’জনার হয়। শতাধিক বছরের দূরত্ব পাড়ি দিয়ে কবি কুসুমকুমারী দাস ধীরে ধীরে আপন মহিমায় প্রকাশিত হচ্ছেন। কবি জীবনানন্দের মা হিসাবে, কবি হিসাবেও।
কে এই কুসুমকুমারী?
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম চার দশকের বাংলা সাময়িকীগুলোতে যে ক’জন মহিলা কবির কবিতা প্রকাশিত হতো তাঁদের মধ্যে ছিলেন গিরিন্দ্র মোহিনী দাসী, কামিনী রায়, মানকুমারী বসু, কুসুমকুমারী দাস, প্রিয়ম্বদা দেবী প্রমুখ। কুসুমকুমারী ১২৮২ বঙ্গাব্দের ২১ পৌষ (১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ) তৎকালীন বাখরগঞ্জ জেলার প্রধান শহর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বরিশালের বিখ্যাত গ্রাম গৈলা’র সন্তান চন্দ্রনাথ দাস, মাতা ধনমণি দেবী। ব্রাহ্ম ধর্মমত গ্রহণ করায় গ্রামবাসীর বৈরিতার মুখে চন্দ্রনাথ গৈলা ছেড়ে বরিশালে চলে আসেন। চন্দ্রনাথের ছিল ১ পুত্র প্রিয়নাথ, ৩ কন্যা কুসুমকুমারী, সুকুমারী ও হেমন্তকুমারী। শৈশবেই মাতৃহারা হন। পিতা ও কাকার স্নেহে মানুষ হন। বরিশালে তখন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ছিল না। কুসুমকুমারী মাইনর স্কুলে পড়ালেখা শুরু করেন। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে বরিশালে মেয়েদের হাইস্কুল চালু হলে কুসুমকুমারী সেই স্কুলে ৪র্থ শ্রেণি (বর্তমানে যা ৭ম শ্রেণি) পর্যন্ত পড়েন। ছাত্রের অভাবে স্কুলটি উঠে গেলে তাঁকে কলকাতায় বেথুন স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রথম বছর কলকাতায় তিনি ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করেন। পরে বোর্ডিংয়ে চলে যান। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণিতে (বর্তমানে ১০ম শ্রেণি) পড়ার সময় সত্যানন্দ দাসের সাথে কুসুমকুমারীর বিয়ে হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর। বিয়ের পর একান্নবর্তী পরিবারের গুরুভার বহন করার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান। ব্রাহ্মসমাজের সামাজিক অনুষ্ঠানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। কুসুমকুমারী ৩ পুত্র-কন্যার জননী হয়েছিলেন- জীবনানন্দ (১৮৯৯), অশোকানন্দ (১৯০১) ও সুচরিতা (১৯১৫)। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের মতে, কুসুমকুমারীর ‘কবিতা মুকুল’ নামে একটি ছোটদের কবিতা সংকলন প্রকাশ করেন এম এম মজুমদার ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে। জীবনানন্দ দাশ এবং সুচরিতা দাশ বইটির নাম ‘কাব্য মুকুল’ উল্লেখ করেছেন। যোগেন্দ্রনাথ কুসুমকুমারী রচিত ‘পৌরাণিক আখ্যায়িকা’ নামে একটি গদ্যগ্রন্থের কথাও উল্লেখ করেছেন। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তাঁর সকল কবিতা মূলত ব্রহ্মবাদী, প্রবাসী ও মুকুল- এই তিনটি সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২২ নভেম্বর তাঁর স্বামী সত্যানন্দের মৃত্যুর পর তিনি বরিশাল থেকে কনিষ্ঠ পুত্র অশোকানন্দের কলকাতার বাসায় চলে যান। শেষ জীবন কলকাতায় কাটিয়ে ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে তিয়াত্তর বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অবহেলা অপরিচয়ের আবরণ
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের বেশি। বহু প্রতিভাবান সাহিত্যিকের মেধা আর বিচিত্র সব রচনাবলী সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যের উজ্জ্বল অংশে পরিণত হয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্য, ইসলামী সাহিত্য, ফারসি সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্যসহ বিশ্বের সমৃদ্ধ সব সাহিত্য থেকে রস সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্য পরিপুষ্ট হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতাগণ বাংলা সাহিত্যকে তিন যুগে বিভক্ত করেছেন। ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ (সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ) প্রাচীন যুগ, ১২০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্যযুগ এবং ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত আধুনিক যুগ। কবি কুসুমকুমারী দাস (১৮৭৫-১৯৪৮) এই যুগ বিভাগ অনুসারে আধুনিক কালের সাহিত্যিক। কিন্তু মূলধারার ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে কুসুমকুমারী দাসের নাম নেই বললেই চলে। ড. দিনেশ চন্দ্র সেন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে সীমাবদ্ধ ছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন। সঙ্গত কারণেই এঁদের বইতে কুসুমকুমারী দাসের কথা নেই। মূলধারার বইয়ের মধ্যে একমাত্র সুকুমার সেন কুসুমকুমারীর কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেখানে কুসুমকুমারীর জন্য বরাদ্ধ মাত্র একটি লাইন এবং তা-ও তাঁর বিখ্যাত পুত্র জীবনানন্দকে জড়িয়ে-
জীবনানন্দ দাসের মাতা কুসুমকুমারী দাসীর কবিতা একাধিক পত্রিকায় বাহির হইয়াছিল।
(বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, শেষ খণ্ড, ১৯৫৮, পৃ. ৮০)
আবার জীবনানন্দ দাশের কবিতা আলোচনাকালে তাঁর মাতার উল্লেখ করেছেন-
তাঁহার পিতামাতার প্রভাব তাঁহার জীবনের গতি অনেক অংশে নিয়ন্ত্রণ করিয়াছিল। মাতা কুসুমকুমারীর কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল। তাঁহার কয়েকটি কবিতা কলিকাতার বামাবোধিনী পত্রিকায় এবং বরিশালের “ব্রহ্মবাদী”তে বাহির হইয়াছিল। সাহিত্যপ্রীতি ও কবিতা রচনার প্রেরণা প্রথমত তিনি মায়ের কাছেই পাইয়াছিলেন।
(ঐ, পৃষ্ঠা. ৩২৮)
সুকুমার সেন তবু পুত্রের সাথে মাতার কবিতার উল্লেখ করেছেন। কোনো মূল্যায়নসূচক মন্তব্য করেননি। অন্য সব সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থ তাঁর কথা উল্লেখ করেনি। মাহবুবুল আলম রচিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, মুহম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান রচিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ (আধুনিক যুগ), ক্ষেত্রগুপ্ত রচিত ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, ভূদেব চৌধুরী রচিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা’, অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’, শহীদ ইকবাল রচিত ‘বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস’ এবং ‘বাংলাদেশের সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ ইত্যাদি গ্রন্থে নারী কবিদের মধ্যে কুসুমকুমারী দাসের সমসাময়িক স্বর্ণকুমারী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু, কামিনী রায় প্রমুখের কথা উল্লেখ করলেও কুসুমকুমারী দাসের নামই উল্লেখ করেননি।
যাঁরা বাংলা সাহিত্যে নারীদের অবদান নিয়ে আলাদা গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁরাও হয় কুসুমকুমারীর কথা বলেননি, না হয় অতি অল্প বলেছেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গসাহিত্যে নারী’ (বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ) পুস্তিকা কিংবা ‘বাংলা-সাহিত্যে বঙ্গ মহিলার দান’ প্রবন্ধে (বিশ্বভারতী পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ়, ১৩৫৭) কুসুমকুমারী দাসের উল্লেখ নেই। ব্রজেন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যসাধক চরিতমালা’তেও নেই কুসুমকুমারী। আরো বিস্ময়কর হলো, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রচিত ‘বঙ্গের মহিলা কবি’ গ্রন্থের ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণে কুসুমকুমারী দাসের নাম পর্যন্ত নেই। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে কুসুমকুমারীকে নিয়ে একটি অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি।
ড. মঞ্জুশ্রী সিংহ রচিত ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বঙ্গ মহিলা’ (২০০০) গ্রন্থে কুসুমকুমারী দাসের জন্য বরাদ্দ সব মিলে ১০টি লাইন (সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ মিলে)। পুরো বইটি ৪৩২ পৃষ্ঠার। কবি রচিত ‘আদর্শ ছেলে’, কবিতার বিখ্যাত প্রথম দুটি লাইনের পর লিখেছেন, ‘তাঁরও একটি পরিচয় আছে, সেটি হল তিনি বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের মা।’ এরপর তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী উল্লেখ করে শেষ লাইনে লিখেছেন, ‘কুসুমকুমারী অনেক ভগবদ্ভক্তি বিষয়ক কবিতা লিখেছেন।’ যত অল্পই হোক তবু তো এই বইতে কুসুমকুমারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কুসুমকুমারী দাস যে অপরিচয়ের আবরণের আড়ালে পড়ে গেছেন তার দুটি কারণ নির্দেশ করেছেন সুমিতা চক্রবর্তী, ‘তার প্রথম কারণ তাঁর কোনো প্রকাশিত কবিতা সংকলন পাঠকের হাতে এসে পৌঁছায়নি। দ্বিতীয় কারণ: তাঁর বসবাস ছিল পূর্ববঙ্গের বরিশালে। কলকাতা শহরের পাদপ্রদীপের আলোয় তিনি কখনই এসে দাঁড়াননি।’ প্রথম কারণটি যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি ভয়াবহ। কাউকে স্বীকৃতি পেতে হলে কলকাতা (কিংবা ঢাকার) মুখাপেক্ষী হতে হবে কেন? এই দুই নগরী বাইরে থেকে আসা কবিসাহিত্যিকদের জন্য যে দরজা এঁটে থাকে তা নিয়ে বিস্তর যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা আছে। মহাত্মা আহমদ ছফা এ নিয়ে প্রচুর লড়াই করেছেন। ঢাকায় ব্রাত্য হয়ে থাকা নড়াইলের শিল্পী এস.এম সুলতানের জন্যও তিনি একইভাবে লড়াই করে গেছেন। কলকাতায় না থাকার জন্য জীবনানন্দ দাশকেও কম মূল্য দিতে হয়নি। ঢাকা-কলকাতার বাইরে অবস্থান করে কবি জীবনানন্দ দাশ, হাসান আজিজুল হক আর কবি ওমর আলী ছাড়া পরিচিতি পাওয়া আর কারো নাম মনে করতে পারছি না। এই অচলায়তন অবশ্যই ভাঙ্গা দরকার। অন্যদিকে, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের মতে, ‘পত্রের আড়ালে যেমন সুরভী পুষ্পটি আপনাকে লুকাইয়া রাখে, কুসুমকুমারীও তেমনি আপনাকে কোনদিন জনসমাজে পরিচিত কবিরার জন্য উদ্যোগী হন নাই। সেজন্যই বাংলাদেশের সাহিত্য-সমাজে ইঁহার সম্বন্ধে কেহ বিশেষ কিছু জানেন না।’
পরিচয় : ব্যক্তি, মানস
কুসুমকুমারী দাসের কবিতাবলী যখন প্রকাশিত হচ্ছিল তখন সাময়িকীগুলোর পাঠকদের কাছে তিনি হয়তো পরিচিত ছিলেন। এর পরে কালেভদ্রে বিখ্যাত পুত্র জীবনানন্দ দাশের কারণে তাঁর মা হিসাবে আলোচিত ছিলেন। ব্যক্তি ও কবি কুসুমকুমারীকে নিয়ে প্রথম একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন সুমিতা চক্রবর্তী। সেটি ২৬ জুন ১৯৮২-তে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নতুন করে তাঁর কবিতাকে পাঠকের হাতে তুলে দেন লায়লা জামান। ‘অবসর’ প্রকাশনা সংস্থা ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে লায়লা জামান সম্পাদিত ‘কুসুমকুমারী দাসের কবিতা’ সংকলন প্রকাশ করে ঢাকার পাঠকদের হাতে তুলে দেন। এতে কবির ৪৯টি কবিতা স্থান পায়। চৌষট্টিটি কবিতা ও একটি প্রবন্ধের তালিকা এতে সংযুক্ত হয়। সেই ২০০১ খ্রিস্টাব্দেরই সেপ্টেম্বর মাসে ‘ভারবী’ প্রকাশনা, কলকাতা থেকে সুমিতা চক্রবর্তীর সম্পদনায় প্রকাশিত হয় ‘কুসুমকুমারী দাসের কবিতা’। কলকাতার পাঠকদের হাতে যাওয়া সে সংকলনে আছে পঁচাত্তরটি কবিতা (প্রকাশিত-অপ্রকাশিত) এবং কবির দিনলিপি। বইটির ভূমিকা অংশে কবির জীবন-কথা এবং কবিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সুমিতা চক্রবর্তী।
এর বাইরে কবির ব্যক্তিত্ব আর মানস-গঠন নিয়ে জানার মাধ্যম হচ্ছে তাঁর পুত্র, কন্যা আর পুত্রবধুর স্মৃতিকথা। জীবনানন্দ দাশ ৩টি প্রবন্ধে তাঁর মাতার সম্পর্কে লিখেছেন। এতে কবির মানস-গঠনের পাশাপাশি জীবনানন্দের মানস-গঠনে তাঁর ভূমিকা কী ছিল তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। ‘আমার কথা’ নামক প্রবন্ধে মা কুসুমকুমারীর কবিতা নিয়ে স্পষ্ট মত দিয়েছেন জীবনানন্দ, “মা অনেক কবিতা লিখেছেন। সেসব কবিতার সাদা ঝর্ঝরে শব্দ নিক্কন ও আশা অর্থসংগতি বরাবরই আমাকে প্রলুব্ধ করেছে, তবুও আমি প্রথম থেকেই অন্যপথ ধরে চলেছি।”
‘আমার মা বাবা’ প্রবন্ধে মা কুসুমকুমারীকে নিয়ে নানা তথ্য ও মতামত দিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। প্রথমেই পাচ্ছি দু’টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, “তিনি মাঝে মাঝে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখতেন মনে পড়ে। তখন আমি ইস্কুলে পড়তাম। তারপর কলেজে উঠেও আমি তাঁকে কোনো কোনো সময় তাঁর নিজ জীবন ও নানা বিষয় সম্পর্কে ধারনা ভাবনা লিখে রাখতে দেখেছি। সেসব লেখা কোথায় তিনি রেখে দিয়েছিলেন- কিংবা নিজেই ছিঁড়ে ফেলেছেন কিনা কিছুই জানিনা। তাঁর কয়েকটি অপ্রকাশিত কবিতা ছাড়া অন্য কোনো লেখা আমাদের কারো কাছে নেই।” দেখা যাচ্ছে, সংসার জীবনের প্রথম দিক থেকেই তিনি দিনলিপি লিখতেন। কারণ তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা ও ভাবনার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তাই সেগুলোকে হারিয়ে যেতে দিতে তিনি রাজী ছিলেন না। জীবনানন্দ স্কুলে ভর্তি হন ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে সরাসরি ৫ম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সালে মেট্রিক এবং ১৯১৭ সালে আই.এ পাশ করেন। দু’টিতেই তিনি প্রথম বিভাগ পান। তার মানে ১৯০৮ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত তিনি দিনলিপি লিখেছেন বলে জীবনানন্দ জানাচ্ছেন। সুমিতা চক্রবর্তী যে দিনলিপি ছেপেছেন তা ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ এর মধ্যে লেখা। এর আগের দিনলিপিতে কুসুমকুমারীর যে ভাবনাগুলো ছিল তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। জীবনানন্দের সাক্ষ্যও তাই।
নারীশিক্ষা, নারীদের কল্যাণে বিদ্যাসাগর ও বেথুন সাহেবের অবদান, প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সততা, বিচারনিষ্ঠা- এসব কথা জীবনানন্দকে তাঁর শৈশবকালেই বলেছেন কুসুমকুমারী। মা যে ছাত্রী হিসাবে ভালো ছিলেন সে কথাও জানিয়েছেন জীবনানন্দ। দেশী-বিদেশী সাহিত্য সম্পর্কে মায়ের জানার পরিধি কি ছিল সে নিয়ে জীবনানন্দ বলেন, ‘সাহিত্য পড়ায় ও আলোচনায় মাকে বিশেষ অংশ নিতে দেখেছি। দেশী বিদেশী কোনো কবি ও ঔপন্যাসিকের কোথায় কী ভালো, কী বিশেষ দিয়ে গেছেন তাঁরা- এ সবের প্রায় প্রথম পাঠ তাঁর কাছ থেকে শিখেছি।’ ওয়ার্ডওয়ার্থ, শেলি, ব্রাউনিঙের কবিতা তিনি মায়ের মুখেই শুনেছেন। সংসারের কাজের চাপে তিনি বেশী লিখতে পারেন নি বলে জীবনানন্দের আক্ষেপ ছিল। তিনি মনে করেন, ‘তিনি আরো লিখে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কিছু দিয়ে যেতে পারতেন মনে হয়।’ জীবনানন্দ জানাচ্ছেন, তাঁর মা খুব দ্রুত লিখতে পারতেন। ব্রহ্মবাদী’র সম্পাদকের চাহিদা পেয়ে রান্নাঘরে এক হাতে খুন্তি আর আরেক হাতে কলম নাড়তেন। তাঁর কালের পৃথিবীর জীবন-বেদের তাৎপর্য কুসুমকুমারী বুঝেছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের অভিভাষণে তার ছাপ বোঝা যেত বলে জীবনানন্দ উল্লেখ করেছেন। কুসুমকুমারীর কিছু কবিতা নিয়ে রামানন্দ বাবু ‘কাব্যমুকুল’ নামে বই বের করেছিলেন বলে জীবনানন্দও জানিয়েছেন।
‘আমার মা’ শীর্ষক প্রবন্ধে জীবনানন্দ কুসুমকুমারী দাসের সমগ্র জীবন তুলে ধরেছেন। কুসুমকুমারীর সংসারনিষ্ঠা, বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের হাল ধরে রেখে অবিশ্রান্ত কর্মযজ্ঞ, ন্যায়নিষ্ঠা, পরিবার ও সমাজের মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্য পালন, সংসারের স্বার্থে নিজের সাহিত্য সাধনা বিসর্জন দেয়া ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের পর তিনি অনুভব করেছেন তাঁর প্রকৃত শিক্ষার ভিত তৈরি করে দিয়েছেন তাঁর বাবা, মা এবং ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আচার্য জগদীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মায়ের সম্পর্কে জীবনানন্দের অনুভূতি ছিলো- “তাঁদের নানা বিজ্ঞানের ভূষণ ছিল না, কিন্তু মহত্তর মর্মজ্ঞান ছিল। তাঁদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, কিন্তু সকলের জন্য যতদূর সম্ভব হিতাকাঙ্ক্ষা ছিল।” মায়ের কবিতা সম্পর্কে জীবনানন্দ লিখেছেন, “মা-র কবিতায় আশ্চর্য প্রসাদগুণ। অনেক সময় বেশ ভালো কবিতা বা গদ্য রচনা করেছেন দেখতে পেতাম।… অনেক আগে, প্রথম জীবনে মা কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন। যেমন, ‘ছোটনদী দিনরাত বহে কুলকুল’ অথবা ‘দাদার চিঠি’ কিংবা ‘বিশাখার পরপারে হাসি মুখে রবি উঠে’। একটি শান্ত অর্থঘন, সুস্মিত ভোরের আলো, শিশির লেগে রয়েছে যেন এসব কবিতার শরীরে। সে-দেশ মায়েরই স্বকীয় ভাবনা- কল্পনার স্বীয় দেশ।” জীবনানন্দ চিত্তরঞ্জন দাসের ওপর লেখা কবিতাসহ পত্রিকা পাঠিয়েছিলেন মাকে। ফেরৎ ডাকে মায়ের জবাব, ‘চিত্তরঞ্জন সম্বন্ধে লিখেছ, ভালই করেছ, কিন্তু রামমোহনের ওপর লিখতে বলেছি তোমাকে, মহর্ষির ওপরেও।’ তাঁর মায়ের শুভবোধ, মানুষের মঙ্গলের জন্য অভাবনীয় প্রত্যাশার কথা বলেছেন জীবনানন্দ : “দেশ ও বিদেশের যেসব মহাপুরুষদের তালিকা দিয়েছিলেন তিনি আমাকে, অনেক অনুতর্ক বিতর্কের পর টের পেয়েছি সত্যিই তাঁরা মহৎ। যে কোন তুচ্ছ মানুষকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করতে বলেছিলেন। এখন বুঝেছি ঠিকই বলেছেন। যদিও মায়ের সেই নির্ধারিত পথে মন- পবনের মাঝির দল চলেছে যত বেশি, বাস্তব যত সেই অনুপাতে কিছুই হয়ে উঠছে না ব্যক্তির বা জাতির বা পৃথিবীর জীবনে। বিদ্বেষই বেশি, হিংসা কেটে যায় না, সংঘর্ষ নষ্ট করে ফেলতে চায় সব। রোঁলার মতো, টমাস মান, রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন, গান্ধিজির মতন একজন লোক তবু আশা করে বসে থাকেন। ইতিহাস চেনে তাঁদের। আমার মা-র মতন একজন মহিলাও আশা করে বসেছিলেন, বিশ্বাস করতেন।”
কুসুমকুমারী দাসের মানসগঠনের একটি পরিপূর্ণ চিত্র আমরা পেলাম জীবনানন্দের কাছে। কনিষ্ঠ পুত্র অশোকানন্দ জানাচ্ছেন তাঁর শিক্ষকসত্তার কথা, ‘ছোটবেলায় আমরা মায়ের কাছে লেখাপড়া শিখেছি। সে পাঠ খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়। খেলবার, বাগানে বেড়াবার, প্রজাপতির পিছনে দৌঁড়াবার, ঘুড়ি ওড়াবার প্রচুর অবকাশ ছিল। স্নেহের শাসন হয়তো ছিল কিন্তু আমরা কোনদিন প্রহার লাভ করিনি।’ যেই কালে গুরুমাত্র ছাত্রদের বেত্রাঘাত করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, সেই কালে স্নেহের শাসনের উপর ভর করে শিক্ষা দিয়েছেন কুসুমকুমারী। কতোটা আধুনিক ছিলেন তিনি। মায়ের গান আর বাবার উপনিষদের শ্লোক শুনে প্রত্যুষে ঘুম ভাঙ্গতো তাঁদের। মা কুসুমকুমারীই জীবনানন্দের প্রেরণা ছিলেন। অশোকানন্দের ভাষায়, ‘মাতা তাঁর প্রতিভাবান পুত্রের সম্বন্ধে অগাধ আশা পোষণ করতেন। সেই আশা সেই বিশ্বাস দাদার প্রথম যৌবনে প্রেরণা যুগিয়েছে, তাঁর নিজেরও দৃঢ়-বিশ্বাস লাভ করতে সাহায্য করেছে।’
জীবনানন্দ দাশের জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তুলতে মাতা কুসুমকুমারী কী অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছেন তার পরিচয় পাওয়া যায় জীবনানন্দের একমাত্র বোন সুচরিতা দাশের জবানীতে। শৈশবে জীবনানন্দ কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, বাঁচার আশা ছিল না। আর্থিক অনটন ও পরিবারের অনীহাকে অগ্রাহ্য করে কুসুমকুমারী শিশু জীবনানন্দকে নিয়ে লখনউ, আগ্রা, দিল্লীর বিভিন্ন স্বাস্থ্যনিবাসে থেকে, চিকিৎসা করে, শিশুপুত্রকে সুস্থ্য করে ঘরে ফিরেছিলেন। জীবনানন্দের কাব্যসাধনার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিলেন কুসুমকুমারী। সুচরিতার ভাষায়, ‘তাঁর জন্য মা একটি নিরিবিলি পরিবেশ, শান্ত মধুর আবহাওয়া রচনা করে দিতেন সর্বক্ষণ। যেন সেই ঘন একান্ততাকে খণ্ডিত করে না দেয় আমাদের বৃহৎ পরিবারের কোলাহল, কর্মব্যস্ততার কলরব, তার দিকে মা’র সজাগ দৃষ্টি ছিল প্রতিটি মুহূর্তের।’ মায়ের কাব্যচর্চা নিয়ে সুচরিতার মত হচ্ছে, “মা’র মধ্যে সহজ স্বাভাবিক কবিমানস স্ফতঃস্ফূর্ত হয়েছিল অথচ ছিল প্রায় অস্ফুট, কেবলমাত্র যা বাংলাদেশের শিশুদের অতি-পরিচিত :
ছোটনদী দিনরাত বহে কুলকুল,
পরপারে আমগাছে থাকে বুলবুল।
অথবা
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে।”
কুসুমকুমারী শাশুড়ী হিসেবেও ছিলেন অনন্য সাধারণ। পুত্রবধু লাবণ্য দাশের (জীবনানন্দের স্ত্রী) জবানীতে শোনা যাক, ‘আমি ছিলাম আমার শাশুড়ীর অতি আদরের। তিনি যে আমার নিজের মা নন, একথা আমি কোনদিনই ভাবতে পারিনি। তাই তিনি আমাকে রাগ করে কিছু বললে আমিও পাল্টা জবাব দিতাম। রাতে কথা কাটাকাটি হলেও পরদিন ভোরে দেখা যেত যে আমি উঠবার আগেই আমার জন্য চা ও খাবার হাতে তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।…শাশুড়ী নিজে আমার উপর রাগ করলেও যদি কখনো শুনতেন যে কবি (জীবনানন্দ) আমাকে কিছু বলছেন, তাহলে কিছুতেই ছেলেকে ছেড়ে কথা কইতেন না।’ এই স্নেহের জোরে পুত্রবধুও শাশুড়ীর প্রতি নজর রাখতেন। শ্বশুরের মাধ্যমে একবার নতুন শাড়ি আনিয়ে শাশুড়ীকে পরতে বাধ্য করেছিলেন লাবণ্য। তাঁর ভাষায়, ‘তিনি আমাকে খুব ভালোই চিনতেন। তাই আর ঘাটাতে সাহস না করে শাড়িখানা শেষ পর্যন্ত বাধ্য মেয়ের মত পরেই ফেললেন।’ শাশুড়ীর মানবিক গুণ, উদারতা কিছুই পুত্রবধুর চোখ এড়ায়নি, ‘আমার শাশুড়ী চিরদিন পরের দরকারটাই বড় করে দেখেছেন। নিজের কথা ভাববার সময় তাঁর কখনোই হত না। কতদিন দেখেছি তাঁর প্রায় নতুন শাড়িখানা নিঃস্ব কোন পরিবারের বউ অথবা মেয়েকে দিয়ে দিচ্ছেন। …তাঁকে যদি হাত খরচের জন্য দশটা টাকাও দেওয়া হত; তার আট টাকাই তিনি পরের জন্য খরচ করে ফেলতেন। তাঁর যে থাকল না এ নিয়ে কোনদিন সামান্য একটু দুঃখ প্রকাশ করতেও আমি শুনিনি।’
এসব রচনার মাধ্যমে কুসুমকুমারীর শিক্ষা, মানসগঠন, কর্তব্যনিষ্ঠা, সমাজ চেতনা, সমাজসেবা আর সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে একটি অন্তরঙ্গ চিত্র পাই।
কুসুমকুমারী দাসের কবিতা
কুসুমকুমারী দাসের কবিতাবলী ‘ব্রহ্মবাণী’, ‘মুকুল’ ও ‘প্রবাসী’- এ তিনটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত কুসুমকুমারীর কবিতা সংকলন ‘কবিতা-মুকুল’ ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। জীবনানন্দ দাশ এবং সুচরিতা দাশ বইটার নাম ‘কাব্য-মুকুল’ বলে উল্লেখ করেছেন। যোগেন্দ্রনাথ ‘পৌরাণিক আখ্যায়িকা’ নামক একটি গদ্যগ্রন্থেরও নাম করেছেন। কিন্তু কোন বই-ই এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এখন কুসুমকুমারী দাসের প্রকাশিত/ অপ্রকাশিত পঁচাত্তরটি কবিতাই শুধু পাওয়া যাচ্ছে সুমিতা চক্রবর্তী সম্পাদিত বইয়ে। কুসুমকুমারীর কবি পরিচয়ের এটাই এখন পর্যন্ত একমাত্র ভিত্তি।
কুসুমকুমারীর কবিতাকে বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-১. শিশুতোষ কবিতা, ২. শিক্ষা ও আদর্শমূলক কবিতা, ৩. ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ক কবিতা, ৪. দেশাত্মবোধক কবিতা, ৫. ঋতুভিত্তিক কবিতা।
যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত যথার্থই বলেছেন, “বাঙ্গলাদেশের প্রতিভাশালিনী মহিলা কবিদের মধ্যে কুসুমকুমারীরর নাম তেমন পরিচিত না হইলেও এমন বালক-বালিকা বা কিশোর-কিশোরী অল্পই দেখা যায় যাহারা তাঁহার লিখিত ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি পড়েন নাই। প্রায় প্রত্যেক শিশুপাঠ্য গ্রন্থেই তাঁহার এই কবিতাটি উদ্ধৃত হইয়া থাকে।
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে।
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন,
‘মানুষ’ হইতে হবে এই তার পণ।
কবির এই স্বপ্ন যে বৃথা যায় নাই তার প্রমাণ দিলেন কবির জ্যেষ্ঠপুত্র জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী লাবণ্য দাশ, ‘কম কথা বলে, কাজে বড় হয়ে পৃথিবীতে তাঁর মায়ের কবিতাকে স্বীকৃতি দিয়ে গেলেন কবি জীবনানন্দ।’
শিশুতোষ কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্মল আনন্দ। শিক্ষা বা আদর্শবাদের বোঝা সেগুলোর ওপর চাপানো নেই। যেমন ‘দাদার চিঠি’-
আয়রে মনা, ভূতো, বুলী আয়রে তাড়াতাড়ি
দাদার চিঠি এসেছে আজ, শুনাই তোদের পড়ি।
কিংবা ‘খোকার বিড়াল ছানা’-
সোনার ছেলে খোকা মণি, তিনটি বিড়াল তার
এক দণ্ড নাহি তাদের করবে চোখের আড়।
…
সোনামুখী, সোহাগিনী, চাঁদের কণা বলে
ডাকে খোকা ছানাগুলি যায় আদরে গলে।
শিশুতোষ কবিতাগুলোর ভাষা সরল। যুক্তাক্ষর প্রায় নেই বললেই চলে। সে জন্য ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শিশুদের জন্য বর্ণশিক্ষার যে বই লিখেছেন, তাতে কুসুমকুমারীর পদ্যাংশ যুক্ত করেছেন-
ছোটনদী দিনরাত বহে কুলকুল,
পরপারে আমগাছে থাকে বুলবুল।
শিক্ষা ও আদর্শমূলক কবিতাগুলোতে শিশু-কিশোরদের দেশপ্রেম, নৈতিকতা, কর্তব্যবোধ, মনুষ্যত্ব ও আত্মসম্মানবোধে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এই জাতীয় কবিতাগুলো মধ্যে ‘আদর্শ ছেলে’ সবচেয়ে বিখ্যাত। এছাড়া রয়েছে ‘মনুষ্যত্ব’, ‘মানুষকে’, ‘স্বাবলম্বী’, ‘কর্মনিষ্ঠা’, ‘কৃষক শিশু’ ইত্যাদি। ‘মনুষ্যত্ব’ কবিতায় কবির আহ্বান-
চাই শৌর্য চাই বীর্য, তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’ হবে এই পণ।
স্বাবলম্বী হবার সুফল সম্পর্কে কবির মত,
আপনার পায়ে দাঁড়াতে যে পারে
কোনও শক্তি নাই বাধিবে তাহারে।
ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ক কবিতার মধ্যে রয়েছে ‘দেবমাধুরী’, ‘বন্দনা’, ‘নিবেদন’, ‘অর্ঘ দান’, ‘দেব মন্দিরে’, ‘মাতৃমূর্তি’, ‘প্রেমমন্ত্র’, ‘প্রার্থনা’ ইত্যাদি। ব্রাহ্মধর্মমতের অনুসারিণী বিধায় কুসুমকুমারীর কবিতায় ঈশ্বরের কাছে সার্বিক আত্মনিবেদনই ফুটে উঠেছে। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর প্রার্থনা সহজ সরল ভাষায় উচ্চারিত-
আজ এ সময়ে এস তুমি এস
ব্যথাহারী ভগবান
ডেকেছি যখন আসিবে তখন
অভয় করিবে দান।
(সুদূরের ডাক)
উপনিষদের প্রভাবে কুসুমকুমারী ঈশ্বরকে বিঘ্নহরণকারী ও আনন্দ রূপে উপস্থাপন করেছেন-
সকল ব্যথা জুড়ায়ে দাও, তোমায় শুধু ডাকি
আনন্দময়রূপে তোমার ভুবন রাখ ঢাকি।
(প্রার্থনা)
ড. মঞ্জুশ্রী সিংহ কুসুমকুমারীর কবিতায় ভগবদ্ ভক্তির প্রাধান্যের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। সুমিত চক্রবর্তী ও যোগেন্দ্রেনাথ গুপ্তও এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
কুসুমকুমারীর দেশপ্রেম ও নিজ দেশের পরাধীনতার বিষয়ে অক্ষেপের বিষয়টি যতটা প্রবলভাবে তাঁর মানসকে প্রভাবিত করেছে সে তুলনায় দেশপ্রেমমূলক কবিতার সংখ্যা কম। যে ক’টি কবিতা আছে তাতে খুব বেশি উদ্দীপনাও চোখে পড়ে না-
বঙ্গের ছেলে-মেয়ে জাগো, জাগো, জাগো
পরের করুণা কেন শুধু মাগো-
আপনারে বলে নির্ভয় রাখ
হবে জয় নিশ্চয়
(উদ্বোধন)
শিশুতোষ ও শিক্ষামূলক কবিতার পর তিনি সবচেয়ে বেশি ঋতুভিত্তিক কবিতা লিখেছেন। এককভাবে সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন বাংলা নববর্ষ নিয়ে। যেমন ‘নতুন-বরণ’, ‘বর্ষ-আশা’, ‘নববর্ষ’, ‘বর্ষ কামনা’, ‘নূতন বরণ’, ‘নববর্ষের প্রতি’, ‘বর্ষ-কল্যাণ’ ইত্যাদি। এছাড়া বর্ষাকাল নিয়ে ‘বাদল ধারা’, বসন্তকাল নিয়ে ‘বসন্তে’ শীর্ষক কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতায় নতুন বছর নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে-
অতীত ভুলিয়া, হৃদয় গুলিয়া
গাইবো তোমারি জয়
রবে বারোমাস, আকাশ বাতাস
নূতন আলোকময়
(নূতন বরণ)
এস এস নববর্ষ নূতন শকতি
চারিদিকে হেরি আজ কল্যাণ মূরতি
(নববর্ষের প্রতি)
কুসুমকুমারী দাস তাঁর কবিতায় ভাষারীতি হিসাবে সাধু ভাষাকে গ্রহণ করেছেন। ছন্দ হিসাবে মূলত ব্যবহার করেছেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। পঙক্তি সাজাবার সময় প্রধানত পয়ার এবং ত্রিপদী ব্যবহার করেছেন। সহজবোধ্য শব্দ ব্যবহার করেছেন। শিশুতোষ কবিতাগুলোতে যথাদূর সম্ভব যুক্তাক্ষর এড়িয়ে চলেছেন।
সমাপনী
কুসুমকুমারী দাসের কবিতা নিয়ে অম্বুজ বসু বলেছেন, ‘…বাংলাদেশের মহিলা কবিদের মধ্যে কুসুমকুমারীর একটি বৈশিষ্ট্যসমুজ্জ্বল স্থান ছিল। সহজ ও স্বভাব কবিত্ব নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন।’ তবে কবি হিসাবে তাঁর অপূর্ণতাও অম্বুজ বসু মনে রেখেছেন- ‘যে মহৎ কবিতা তিনি লিখে যেতে পারতেন, যার আভাস আছে তাঁর কাব্যের শরীরে, তাই বোধহয় উত্তরাধিকারে পূর্ণ হয়েছিল পুত্রের লেখায়।’ তবে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত মনে করেন, ‘বঙ্গদেশে যে কয়জন শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে ইঁহাকেও স্থান দেওয়া যায়।’ সুমিতা চক্রবর্তীর মতে, ‘বলা নিষ্প্রেয়োজন, কুসুমকুমারী খুব বড় লেখিকা নন। কিন্তু স্ত্রী শিক্ষার প্রথম যুগে যে-মেয়েরা সারাজীবন সাহিত্যসাধনার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রেখেছিলেন- তিনি তাঁদেরই একজন। সাহিত্যরুচির একটি একান্ততা ছিল তাঁদের মধ্যে। নিজেদের জীবন ও সমাজ-পরিবেশ থেকে একটি আদর্শ তাঁরা ছেঁকে নিতেন এবং লেখায় তাকে রূপ দিতে চেষ্টা করতেন। …রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে, সমকালের নিরিখে তাঁর কবিতার মান আরো অনেকের মতোই ছিল। তাঁর কবিতায় বিশ শতকের প্রথমার্ধের শিক্ষিত, স্বচ্ছ, চিন্তাশীল এবং নিজস্ব জীবনবোধ-সম্পন্ন এক নারী-মানসের ও কবিপ্রাণের পরিচয় পাই। বলা বাহুল্য, তা-ও খুব কম প্রাপ্তি না।’
তাঁর মায়ের কবিতা সম্পর্কে জীবনানন্দের মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘…যে মহৎ কবিতা তিনি হয়তো লিখে যেতে পারতেন, তাঁর রচিত কাব্যের ভেতর অনেক জায়গায়ই তার আভাস আছে, কিন্তু কোনো জায়গায়ই সম্পূর্ণ সিদ্ধি নেই- মাঝে মাঝে কবিতার ভেতর দুচারটে বিচ্ছিন্ন ও আকস্মিক সিদ্ধিকে বাদ দিলে। …তাঁর কাব্যের … বিচারের ভার ভবিষ্যৎ সময়ের হাতে থাকবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে তাঁর কবিতা তাঁর নিজের জিনিস, অভিজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার এক পরিষ্কার প্রকাশ এত সোজা ও পরিষ্কার যে, আমার বোধ হয় অত্যুক্তির ভুল না করে বলতে পারা যায় যে, সেখানে বাংলা কাব্যের বিশেষ ইতিহাসের রূপ চোখে পড়ে বটে, কিন্তু অন্য কোন কবির ভাষা ও ভঙ্গি এসে প্রায়ই আঘাত করে না।’
এই সহজ সরল স্বাতন্ত্র্যই কুসুমকুমারী দাসের কবিতার সবচেয়ে বড় জোর। ‘আদর্শ ছেলে’ নামের বিখ্যাত কবিতা কিংবা জীবনানন্দ দাশের মতো বিখ্যাত কবির মাতৃত্ব- এই দুটিই তাঁর জন্য শেষ কথা নয়। তিনি নিজ স্বকীয়তা নিয়েই বাংলা সাহিত্যের একজন হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠা তারকা কবি।
তথ্যসূত্র :
১. সুমিতা চক্রবর্তী সম্পাদিত, কুসুমকুমারী দাসের কবিতা, ভারবি, কলকাতা, ২০১৪।
২. যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বঙ্গের মহিলা কবি, দে’জ পাবলিসিং, কলকাতা, ২০১৩।
৩. জীবনানন্দ রচনাবলী, ৪র্থ খণ্ড, ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০১৭
৪. লাবণ্য দাশ, মানুষ জীবনানন্দ, ভাষ্যচিত্র, ঢাকা,২০১২
৫. অশোকানন্দ দাশ, জীবনস্মৃতির ভূমিকা, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ১৯৯৮
৬. সুচরিতা দাশ, কাছের জীবনানন্দ, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ১৯৯৮
৭. অম্বুজ বসু, একটি নক্ষত্র আসে, পুস্তক বিপনী, ১৯৯৯
৮. ড. মঞ্জুশ্রী সিংহ, ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য ও সংস্কৃতির বঙ্গ মহিলা, কলকাতা, ২০০০
৯. বিভিন্ন লেখকের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থাবলী
১০. উইকিপিডিয়া