
কবি কুসুমকুমারী দাশ
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন,
‘মানুষ হইতে হবে’ এই তার পণ।
বিপদ অসিলে কাছে হও আগুয়ান
নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ?
হাত পা সবারই আছে, মিছে কেন ভয়?
চেতনা রয়েছে যার, সে কি পড়ে রয়?
সে ছেলে কে চায় বল, কথায় কথায়
আসে যার চোখে জল, মাথা ঘুরে যায়,
মনে প্রাণে খাট সবে, শক্তি কর দান,
তোমরা মানুষ হলে দেশের কল্যাণ।
এই জনপ্রিয় কবিতাটি রচনা করেছেন কবি কুসুমকুমারী দাশ। কবিতার নাম ‘আদর্শ ছেলে’। একটি ছেলের কেমন গুণাবলী থাকলে তাকে আদর্শ ছেলে বলা যায় তা অতি চমৎকার করে কবিতার ছন্দে বর্ণনা করেছেন। ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই কবিতাই বুঝিয়ে দেয় যে কুসুমকুমারী দেবী অত্যন্ত সাহসী মানুষ ছিলেন। প্রায় দেড় শত বছর আগে একটি অনগ্রসর জাতিকে পথ দেখিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিকভাবে মানুষ করার জন্য। সেইসাথে ছোট ছেলেটিকেও নির্দেশনা প্রদান করেছেন আদর্শ ছেলে হতে হলে কোন পথে চলতে হবে।
কুসুমকুমারী দাশের জন্ম ১৮৭৫ সালে (২১ শে পৌষ ১২৮২ বঙ্গাব্দে) বরিশাল শহরে একটি শিক্ষানুরাগী পরিবারে। তাঁর পিতা চন্দ্রনাথ দাশ ও মাতা ধনমানি। মূলত তাঁর পিতার পৈতৃক বাড়ি ছিল গৈলা গ্রামে। তিনি ছিলেন একজন উদারপন্থী ব্যক্তি। ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় গ্রামবাসীদের বিরোধিতার রোষে পড়ে পৈতৃকভিটা ছেড়ে বরিশালে চলে আসতে হয়েছে তাঁকে। চন্দ্রনাথ দাশ নিজেও কবিতা লিখতেন এবং সমাজ কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কুসুমকুমারী দাশ ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন। রামানন্দ চট্রোপাধ্যায় শিশুদের জন্য যে চিত্রসহ বর্ণশিক্ষার বই লিখেছিলেন, তার প্রথম ভাগে কুসুমকুমারী যুক্তাক্ষরবিহীন ছোট ছোট পদ্যাংশ লিখেছেন। তিনি মনোমোহন চক্রবর্তীর অনুরোধে ‘ব্রাহ্মবাদী’ পত্রিকায় লিখেছেন। তাঁর কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রবাসী’ ও ‘মুকুল’ পত্রিকায়। ১৮৯৬ সালে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘কাব্য মুকুল’ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে ধর্ম, নীতিবোধ ও দেশাত্মবোধ।
বরিশালে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের হাইস্কুলে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি পড়েন। এরপর ছাত্রীর অভাবে স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে কুসুমকুমারীকে তাঁর বাবা কলকাতায় রামানন্দ চট্রোপাধ্যায়ের বাড়িতে রেখে বেথুন স্কুলে ভর্তি করেন। প্রবেশিকা শ্রেণীতে পড়ার সময়েই ১৮৯৪ সালে তাঁর বিয়ে হয় বরিশালের ব্রজমোহন ইনিস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক সত্যানন্দ দাসের সঙ্গে। তাঁরই অনুপ্রেরণায় কুসুমকুমারী সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যান। বরিশালে ব্রাহ্মসমাজের সভা-উৎসব-অনুষ্ঠানে কুসুমকুমারী যোগদান করতেন। তিনি ১৩১৯ থেকে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই, বরিশাল ছাত্র সংঘের সপ্তাহকাল ধরে মাঘোৎসবে মহিলা দিবসের উপাসনায় আচার্যের দ্বায়িত্ব পালন করেন। যতই বয়স বাড়তে লাগলো তিনি সাথে সাথে এমন একটি স্বাভাবিক মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন শুধু মহিলাদেরই নয়, ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সভাতেও আধ্যাত্মিক নেতার দ্বায়িত্ব নিয়েছেন। বরিশাল মহিলা সভার (Barishal Women Society) সম্পাদক ছিলেন এবং পরে তিনি সভাপতিও নির্বাচিত হন। কুসুমকুমারী বরিশালে বিভিন্ন মহিলাকে স্বাবলম্বী হয়ে মাথা উচু করে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছেন। তার ‘দৈনন্দিন দিনলিপি’ নামে একটি ডায়েরিও প্রকাশিত হয়। ‘নারীত্বের আদর্শ’ নামে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগীতায় কুসুমকুমারী স্বর্ণ পদকে ভূষিত হন।
কুসুমকুমারী জন্মসূত্রেই লেখার ক্ষমতা পেয়েছিলেন। বাবার অনুপ্রেরনায় ধীরে ধীরে তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। তিনি যে শুধু একজন কবি ছিলেন তা নয়। তিনি ছিলেন বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী। তার মধ্যে একটি নেতৃত্বের গুণাবলী ছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ ছিলেন তাঁর বড় ছেলে। তাঁর ছেলেও তার মতই জন্মসূত্রে লেখার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন। জীবনানন্দ দাশ এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দাশ বরিশাল শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি বেথুন স্কুলে পড়েছিলেন। খুব সম্ভব ফার্স্ট ক্লাশ অবধি পড়েছিলেন, তারপর বিয়ে হয়ে যায়। তিনি অনায়াসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় খুব ভাল করতে পারতেন, এ বিষয়ে সন্তানদের চেয়ে তার বেশি শক্তি ছিল মনে হচ্ছে।’ কুসুমকুমারী অন্যান্য সন্তানদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশের পর অশোকান্দ দাশ এবং সুচরিতা দাশ। এদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ খুব নাম করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে অন্যতম প্রধান এবং জনপ্রিয় কবি হিসাবে জীবনানন্দ দাশ স্বীকৃতি পেয়েছেন।
কুসুমকুমারী দাশ নানা কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছিলেন, তাই সম্ভবত তিনি খুব বেশি লিখে যাননি। তাঁর লেখার মধ্যে রয়েছে- কাব্যকুমারী, পৌরাণিক আখ্যায়িকা, কুসুমকুমারী দাশের কবিতা এবং দৈনন্দিন দিনলিপি। একথা অনস্বীকার্য যে তিনি যতটুকু রেখে গেছেন তাতে তাঁর প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন সুস্পষ্টভাবেই। তাঁর কবিতায় বার বার এসেছে ধর্ম, নীতিবোধ, দেশাত্মবোধ। তাঁর লেখা পড়লেই লেখার মুন্সিয়ানা সহজেই ধরা পড়ে। ১৯৪৮ সালে কলকাতার রাসবিহারী এভিনিউতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
গুণী এই কবির কথা বাংলা সাহিত্য থেকে যেন হারিয়ে না যায় সে চেষ্টা আমাদের করা উচিত। কারণ যে সময় তিনি লেখালেখি ও কাব্যচর্চা করেছেন সে সময় আমাদের এই সমাজ ছিল অনেক পিছিয়ে এবং মেয়েদের বাইরে এসে কাজ করা ছিল কঠিন কাজ।