
কবিতা এক মোহিনী-রহস্যের আরাধনা
প্রতিকথা’র এবারের আয়োজন এ সময়ের ১২জন কবির কবিতাভাবনা। কবিতা কী, কবিতার কাঠামো ও স্বর, শব্দের নান্দনিক প্রয়োগ; কবিতার এমন নানান বৈচিত্র নিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও চিন্তার আলোকে রচনা করেছেন তাঁরা কবিতাভাবনা। এর সাথে রয়েছে তাঁদের স্বনির্বাচিত পাঁচটি করে কবিতা। প্রথম পর্বে প্রকাশিত হল ছয়জন কবির কবিতাভাবনা এবং কবিতা।
১.
অন্তরের তেপান্তরে কোনো এক মোহিনীর রূপ আবাহনে সম্মোহিত কবি-কলমের যে না-বাস্তব শব্দ-বাক্যের এক রহস্য রচনা পাঠক পাঠ করতে করতে সেই আশ্চর্য মোহিনীর না-বাস্তব উপস্থিতি অনুভব করে কবির চেতনায় লীন হতে পারে তাই কবিতা। এই বাক্যে কি কবিতা রহস্যের সামান্যটুকুও বলা হলো? প্লেটো-এরস্টিটল থেকে শুরু করে ওয়ার্ডসওয়ার্থ-কোলরিজ-আরনল্ড-এলিয়ট হয়ে আজ পর্যন্ত কবিতা সমালোচক তাঁদের চিন্তা ও বিশ্লেষণে ধরতে চেষ্টা করেছেন কবিতার সংজ্ঞা। কিন্তু আজ পর্যন্ত কি কবিতার সঠিক সংজ্ঞায় মানুষ পৌঁছাতে পেরেছে? ’Poets are masters of us ordinary men, in knowledge of mind, because they drink at streams which we have not yet made accessible to science.’ ’Everywhere I go I find that a poet has been there before me.’ কথাগুলো বলেছেন বিংশ শতাব্দীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী মনঃবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ফ্রয়েড তাঁর তত্ত্বে মানুষের মনোজগতের অবচেতন দিকটি আবিষ্কার করেছেন ঠিকই, কিন্তু তিনিও কবিতা নিয়ে পরিষ্কার কিছু বলতে পারেননি। কবিতাতত্ত্বের অজস্র উদাহরণ দিয়ে দেখানো সম্ভব যে কোনো তাত্ত্বিকই পূর্ণাঙ্গ নন। এমন কি আমরা বহু তাত্ত্বিকের নিজের মধ্যেই স্ববিরোধিতা দেখতে পাব। স্বাভাবিক অর্থে তাঁরা কিন্তু ভুল বলেননি। আসলে কবিতা এমন এক রহস্যময় শিল্প যে এক একজনের কাছে এক এক রকমভাবে আবির্ভূত হয়, যাকে কখনোই পূর্ণাঙ্গভাবে কেউ দেখতে পায় না। অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার মতো কবিতা কারো কাছে ’Spontaneous overflow of powerful feelings’ আবার কারো কাছে, ‘Poetry is not turning loose of emotion, but an escape from emotion’। এখন বলেন, আপনি কোন দলে যাবেন? কবিতা কি শুধুই উপচে পড়া আবেগের প্রকাশ না কি আবেগকে সংযত করে তাত্ত্বিক মিশ্রণের অবকাশ? উপরোক্ত দুটি উদাহরণ দুই সময়ের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় কবির উপলব্ধি। যাঁরা তাদের কবিতা এবং কবিতা তত্ত্বের কারণে পৃথিবীব্যাপী নন্দিত হয়েছেন, হচ্ছেন। কিন্তু দুজনকে আপনি এক সাথে গ্রহণ করতে পারনে না। এই যে উপভোগ্য নান্দনিক বিরোধিতা সংঘটিত হচ্ছে, এর কারণ কবি বা তাত্ত্বিকরা নন। আসলে কবিতা তাদের কাছে ভিন্নরূপে ধরা দিয়ে দুজনকে দুরকম অভিজ্ঞতা দিয়েছে। তাঁরা তাদের অনুভব-উপলব্ধির প্রতি যথেষ্ট আস্থাশীল থেকেও কবিতার একটি পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দিতে পারেননি। অথচ তাঁরা এমনসব কবিতা লিখে গেছেন যা অমর হয়ে আছে পাঠক হৃদয় থেকে হৃদয়ে, যাকে আমরা সার্বজনীন বলে থাকি, ঠিক তেমন। কবিতা এমনই মোহিনী; তার যে কতো রূপ কতো কলা তা কোনো একজন মানুষের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব কিনা, এটা নিয়ে আমার গভীর সংশয় রয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর আর এক বিখ্যাত আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘Poetry is when an emotion has found its thought and the thought has found words.’ উত্তারাধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে কবিতা এতো সরলভাবে সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ আছে কিনা জানি না, কিন্তু আমার কাছে ফ্রস্টের উল্লেখিত সংজ্ঞাটি ভালো লাগে। যদিও কবিতা বিশ্লেষণে এই সংজ্ঞা টিকবে না বলেই বোধ করি। কারণ উদ্ঘাটনের হেতু আমি উদাহরণ হিসেবে মনে করবো ব্যক্তিগত চিঠি। কিংবা বর্তমান দূরালাপের বার্তা কিংবা নানাবিধ ম্যাসেঞ্জারের চ্যাটিং সংলাপ। সেখানে কি ফ্রস্টের কবিতার সংজ্ঞাটি প্রযোজ্য নয়? আবেগের প্রকাশ করলেই তা কি নান্দনিক স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়? আদৌ হয় না। সম্ভবত এটা বোঝাতে গিয়েই ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর কোনো এক সমালোচনায় অনেক কবিদের কবিতাকে স্রেফ প্রলাপ বা বিলাপ বলেছেন; কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তিনি নারাজ ছিলেন। কারণ, নান্দনিক বা শিল্পমানে না পৌঁছাতে পারলে কোনো শব্দরূপ কবিতা হতে পারে না। কিন্তু এখানেও বিরোধী দল রয়েছে। যেমন, প্রতিকবিতার জনক নিকানোর পাররা বলেছেন, ‘A poem should improve on the blank page.’ তাহলে সাদা পৃষ্ঠায় যা লেখা হবে তাই কি কবিতা? সমকালীন আমেরিকান একজন কবি ও সমালোচক জেন হার্শফিল্ড বলেছেন, ‘Poetry’s work is the clarification and magnification of being.’ কবিতা পরিষ্কার করে নাকি মানুষের অনুভূতিকে রহস্য দিকে ধাবিত করে, তাও প্রশ্ন হতে পারে।
উপরে অনেক মহান কবি-সমালোচকদের কিছু কথা উদ্ধৃতি টেনে তার বিপক্ষে প্রশ্ন করে আমি মূলতঃ যা বলতে চেয়েছি তাহলো, কবিতার পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা বলে আসলে কিছু নাই। এজন্যই হয়তো সৃষ্টির আদি থেকে আজ এই সুপার প্রযুক্তির উত্তারাধুনিক যুগে এসেও কবিতার আবেদন একটুও ফুরোয়নি। যা পাওয়া হয়ে যায় তা ধীরে ধীরে মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়, কিন্তু যা কিছু অধরা তা সব সময় আবেদনময়ী। এই সত্যের স্থায়ীত্ব দিতেই কবিতা কাউকেই হয়তো পূর্ণাঙ্গভাবে ধরা দেয় না। রহস্য মোহিনী হয়ে তেপান্তরে রূপের আংশিক ঝলক দেখিয়ে মুগ্ধ ঘোরে কবিকে নিজের ঘর থেকে টেনে বের করে পথে নামায়, মানুষের কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দেখায় জীবনের বিচিত্র গতিবিধি, কর্মযজ্ঞ, পূজা ও প্রার্থনা এবং সুন্দরের আরাধনা।
২.
উপরে ফ্রয়েডের উদ্ধৃতিতে জানতে পারলাম যে কবি সাধারণ বিষয়কে দেখেন কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো নয়। তিনি এই সব সাধারণ প্রেম-কাম-প্রাত্যহিকতা-তৈজস-আসবাব-তেল-নুন-গাড়ি-বাড়ি-আত্মিয়-পরিজন-সন্তান-সমাজ-রাষ্ট্র-প্রযুক্তি ইত্যাদির মধ্যে দেখেন মানবিক উৎকর্ষ-অবক্ষয়-আনন্দ-বেদনার অনুভূতি। তিনি সুদক্ষ জহুরি বা ডুবুরির মতো অজস্র অনুষঙ্গের মধ্য থেকে তুলে আনেন আসল রত্ন, হৃদয়ের অলঙ্কার। ফ্রয়েডের এই তত্ত্বের সমার্থনেই হয়তো কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ ‘কেউ কেউ কবি’ বলে আসলে তিনি কাদের বুঝিয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তর সহজে দেওয়া সম্ভব হবে না। বাংলা কবিতার অন্যতম সফল কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছন্দে ছন্দে কবি’র স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘কে কবি—কবে কে মোরে? ঘটকালি করি,/ শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন,’ সেজন কবি। তাঁর কাছে শব্দবন্ধে অনুভূতি প্রকাশ করেন যেইজন তিনি কবি। এ-কথাটি যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে বুঝতে পারবো জীবনানন্দ দাশের সাথে তাঁর চিন্তা সাংঘর্ষিক দিক। একজন কবিকে দেখছেন উচ্চকিত আসনে আসীন, অন্যজন কবিকে কেবল লেখকের ভূমিকায় দেখেছেন। তাহলে দলিল লেখকও কি কবি? কবি হয়তো এভাবে বলেননি। কারণ, দলিল লেখক বা সচিব-কেরানি-মুহুরি কিছু কাঠামোবদ্ধ শব্দ ব্যবহার করেন এবং মুখস্ত বিদ্যায় ব্যবহারিক ব্যাকরণ অনুকরণ করেন, অনুসরণ করেন ক্ষমতাসীনদের হুকুম। কিন্তু কবি তাঁর প্রতিটি কবিতায় পুরনো শব্দকে নতুন রূপদান করেন, অনুভূতির নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করেন, স্বমহিমায় আরোহণ করেন স্রষ্টার আসনে। যেখানে হয়তো দার্শনিক-বিজ্ঞানী অনেক বিশ্লেষণ-নিরীক্ষার মাধ্যমে পৌঁছাতে পারেন না, সেখানে কবি তাঁর ভাব-কল্পনার ডানায় ভর করে পৌঁছে যান আনন্দ মনে। সে ক্ষেত্রে মধ্যযুগের বাংলা কবিতায়, বিশেষ করে মঙ্গলকাব্য ধারায় যে একই ‘মনসামঙ্গল’ বা ‘চণ্ডিমঙ্গলে’র একাধিক কবি আমরা পাই, সবাই কি কবি? প্রশ্নটা অবান্তর নয় এবং এর উত্তরও এখানে আশা করছি না। ‘…the poet, he nothing affirmeth, and therefore never lieth.‘ কথাটি বলেছেন ফিলিপ সিডনি। এর মাধ্যমে কবিদের বিরুদ্ধে যে নান্দনিক মিথ্যাচারের অভিযোগ আনায়ন করা হয় তাকে তিনি খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। কথাটাকে সমর্থন করার নানান কারণ আপনি খুঁজে পাবেন। কারণ, কবিতা লিখতে এসে আপনাকেও হয়তো শুনতে হয়েছে, ‘আপনার কবিতা বুঝি না’ ধরনের কথা। পাঠক হিসেবে আপনিও হয়তো ভাবেন বা বলেন যে এইসব কবিতা আমি বুঝি না। বিষয়টি আমাদের সমাজের সাধারণ ঘটনা। কিন্তু কবিতা কি আসলে আপনাকে কিছু বুঝানোর দায়িত্ব নিয়েছে কোনো দার্শনিক বা অধ্যাপকের মতো? না কি কবিতা আপনাকে বলবে কোনো সংবাদ বা বর্ণনাত্মক গল্প? আসলে কবিতা তো কোনো সংবাদ, গল্প, দর্শন বা এমন কোনো বিষয় নয় যা আপনি বুঝবেন। কবিতা হল অনুভূতির নান্দনিক বা শিল্পসম্মত উপস্থাপনা যেখানে আপনি আশা করতে পারেন হৃদয়ের অনুভব। এক্ষেত্রে আপনি হয়তো বলতে পারেন, ‘আমি অনুভব করতে পারি না’। তবুও দায় কিন্তু কবির নয়। কারণ, কবি তাঁর ভাব-কল্পনায় রচনা করেছেন যে অনুভূতির শব্দরূপ তা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে, কেননা, প্রত্যেক মানুষের জীবনাভিজ্ঞতা আলাদা এবং বোধির বিকাশও স্বতন্ত্র। ফলে ভিন্নতা আসবে আবার কিছু কবিতা সার্বজনীন স্তর ভেদ করে যাবে, তখন হয়তো সকলের মনোজগতে বিচরণ করবে সে কবিতা। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তো সার্বজনীন বলে কিছু থাকে না, ব্যতিক্রম কিছু না কিছু খুঁজে পাওয়া যাবেই। তাহলে, ‘শবদে শবদে বিয়া’ দিলেই কি কবি বলা যাবে না কি ‘কেউ কেউ কবি’ হবেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এরিস্টটলের শরনাপন্ন হওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘Poetry demands a man with special gift for it, or else one with a touch of madness in him.’ তিনি কোনো বিশেষ ওহিপ্রাপ্ত মানুষকে কবি হিসেবে ভেবেছেন, কিন্তু তাঁর সময়ে নবী-অবতারদের যুগ ছিলো না বোধহয়। তিনি যদি বর্তমান বিশেষ বাণীপ্রাপ্তদের অনুসারীদের অবস্থা দেখতেন বা আসমানী বাণীর ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখতে পারতেন এবং কবিতার কারিগরি দিকের উন্নতি বা অবনতির বিষয়টি বিবেচনা করতেন তাহলে তাঁর দর্শন কোন দিকে যেত সেটা জানার আগ্রহ আমার মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। তাই আমরা তাঁর উল্লেখিত বাক্যের দ্বিতীয় অংশকে বিবেচনা করে দেখতে পারি যেখানে তিনি বলেছেন, কবি এমন এক ব্যক্তি যার মধ্যে পাগলামি থাকবে। এটা কতোটা সত্য? তছাড়া, বাউল বা ফকিরি মতবাদে যে পাগলামির কথা আমরা জানি বা আশেপাশে দেখে থাকি, তাদের পাগলামির কতোটুকু কবিত্ব এবং কতোটুকু উন্মাদনা সে বিষয়টি কি পরিষ্কার? এরিস্টটল হয়তো মামুলি উন্মাদনার কথা বিবেচনা করেননি, কারণ তিনি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করেননি, বরং তিনি শিল্পরুচির উন্নত মানুষের কথা মনে রেখে কথাগুলো বলেছেন বলে এখানে সাধারণের মানস বিকৃতির কথা না এনে আমরা শুধু ভাব-পাগলামিকে বিবেচনা করবো। এই তত্ত্বের ভক্তগণ অনেক। কারণ, কবি মানেই সাধারণের মনে যে ছবি ভেসে ওঠে সেটা এমনি কোনো পাগলের। কিন্তু বিংশ শতাব্দী থেকে পৃথিবীখ্যাত কবিদের দিকে মনোযোগ দিলে আমরা দেখব, পোশাক বা আচরণে তাঁরা বেশিরভাগই এরিস্টটলের ভাবধারাকে গ্রহণ করেননি। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবিদের বেশিরভাগকে দেখব এক একজন নিপাট ভদ্রলোক, অন্তত সামাজিক মানদণ্ডে তাঁদের মধ্যে তেমন কোনো সীমাবদ্ধতা পাওয়া যাবে না। তাঁদের সাংসারিক জীবনেও অনেকে ছিলেন সফল সন্তান, ভাই, বোন, স্বামী, পিতা ইত্যাদি। বিপরীতে বাউলদের গূঢ় সাধনার ক্ষেত্রে আমরা দেখব বেশিরভাগই নিজেদের মানুষ-পরিজন ছেড়ে দূর কোনো গোপন স্থানে আত্ম-সাধনায় নিয়োজিত থেকেছেন। এমনকি বেশিরভাগই সেখানে তাঁর গুরুকে অনুকরণ ও অনুসরণ করেন। ফলে সৃষ্টিশীলতা সেখানে খুব একটা প্রযোজ্য নয়। কারণ, বাউল বা বৌদ্ধিক দর্শনে মরার আগে মরার যে কথা বলা হয়, তা কবির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ, কোনো মরা মানুষের পক্ষে নতুন কোনো অনুভূতি রচনা করা সম্ভব নয়। আর নতুন অনুভূতি রচনা না করে লিখলে বা গাইলে তা তো কেবল অনুকরণ মাত্র, বড়োজোর নৈতিক উপদেশ বাণী হতে পারে; ভক্তের দারুণ ভক্তিতে মৃত গুরুকে সিজদা দিতে দিতে আয়ু ক্ষয় করার তরিকা মাত্র। প্রার্থনা-সিজদা-ভক্তির মধ্যে আত্মতৃপ্তি আসতে পারে, কিন্তু কোনো সৃষ্টিশীল বিষয় হতে পারে না। বাংলাদেশের কিছু মহান বাউলদের কথা যদি বিবেচনা করি, যেমন ফকির লালন সাঁই, হাসন রাজা, তাহলে দেখবো তাঁরা আত্মসাধনের মার্গ অতিক্রম করতে করতে লিখেছেন, সুরারোপ করেছেন কবিতায়। এমন মহান কবিদের আমরা একটি দলে ফেলে দেই। আমি মনে করি বাউল বলে তাঁদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। তাঁরাও কবি এবং অনেকে তো আমাদের চেনা জানা কবিদের থেকেও শক্তিশালী।
তাহলে কবি কে? সকলে নিশ্চয়ই কবি নয়। বেশিরভাগ মানুষ অনুকরণের জাগতিক স্বভাব মঞ্চের অভিনেতা। সেই সব অনুকার কুশিলব বাদ দিলে কিছু মহান স্রষ্টা আমরা পাবো যাঁরা ‘শবদে শবদে বিয়া’ দিয়ে নতুন অনুভব সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠক হৃদয়ে অমরতা লাভ করেছেন। হাজার বছরের পরিক্রমায় যাঁরা প্রত্যহ আন্দোলিত করেন মানুষের জীবনাচার, তিনিই কবি। তিনি প্রাচীন-মধ্যযুগীয় চেতনা, আধুনিক-উত্তারাধুনিক কিংবা মহাজাগতিক বোধিচর্চার মাধ্যমে মরণের বিরুদ্ধাচারণ করে অমর হবার বাসনা পোষণ করে সৃষ্টি করে চলেন এক একটি নান্দনিক কবিতা যা পরবর্তীতে পাঠক হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করবে। কবি ও কবিতার এই শক্তি বুঝেই প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের কোনো স্থান রাখেননি। কারণ, তিনি জানতেন কবিরাই পারেন নতুন সৃষ্টির পথ সুগম করতে, আর নতুন সৃষ্টি হলে কোনো আদর্শই টিকে থাকতে পারে না। এই সংশয় থেকেই প্লেটো কবিদের জন্য কোনো স্থান তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে না রাখলেও তিনি কবিতা ও কবি সম্পর্কে নিজের যে চিন্তাগুলো প্রকাশ করে গেছেন তা আজো আমাদের জন্য প্রেরণাদায়ক এবং যা আমাদের ভাবনার খোরাক যোগায়। তিনি বলেছেন, ‘The product of all arts are kind of poetry and their craftsmen are all poets.‘ ‘At the touch of love everyone becomes a poet.‘ ‘Poetry comes nearer to vital truth than history.‘ আমি এখানে প্লেটোর তিনটি উদ্ধৃতি পরপর দিলাম। এটা পড়লে সহজেই বোঝা যায় যে প্লেটো নিজেও একজন কবি ও কবিতার সমঝদার, হয়তো রচয়িতাও ছিলেন। কিন্তু আদর্শ রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে তিনি পূর্বোক্ত কাজটি করেছেন। এমনকি পরবর্তী অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যেসব তত্ত্ব দিয়েছেন সেখানে কবিদের স্থান আসলে রাখেন নাই। কারণ ওই এক, কবিরা সৃষ্টিশীল। তাঁদের কাছে কোনো স্ট্যাবলিশমেন্ট বা প্রতিষ্ঠাপন মেনে চলা সম্ভব নয়। এটাই শিল্পের মূল বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়ে ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার নিজের কবি অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘It always seems to me that I should feel well in the place where I am not.‘ সত্যি, কবি কোনো প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ডে আবদ্ধ থাকেন না। তিনি এমন দিগন্ত উন্মোচন করতে ভালোবাসেন বা জন কিটস এর ভাষায় বলা যায় ‘…with the viewless wings of poesy…‘ তে ভর করে সমস্ত জাগতিক বিষয়বস্তুর বাইরে অবস্থান করেন এবং মানবজাতিকে উপহার দেন নতুন নতুন সৃষ্টি।
৩.
আমি বেড়ে উঠেছি দক্ষিণবাংলার এক নদী বিধৌত প্রান্তিক জগোষ্ঠির মধ্যে। যেখানে আবহমান বাংলা প্রকৃতি ও সারল্য একে অপরের পরিপূরক এবং জীবন যেখানে অপার বিস্তৃত প্রকৃতির কোলে লীন। নদী-বন-বনানী-প্রান্তর-ফসলি মাঠ-মাছ ধরা-কৃষি-ধর্মাচার-পার্বন-মেলা-হাট ইত্যাদি প্রপঞ্চ আমার শৈশব থেকে কৈশোর-প্রাক যৌবনের সাথে মিশে গেছে শরীরে রক্ত ধারার মতো। এরপর যখন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হলাম অর্থাৎ নিজের এলাকা ছেড়ে দূরে থাকতে শুরু করলাম, তখন থেকে আমার শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোর স্মৃতি আমার মধ্যে তাড়না শুরু করলো। আমার প্রকৃতির সাথে অবাদ প্রেম মানুষের মাঝে খুঁজতে গিয়ে ধাক্কা খেতে শুরু করলাম। কিছুতেই মানুষে আর খুঁজে পাইনি সেই টান। যৌবনের প্রারম্ভে এমন পোড়খাওয়া দিনগুলো আমাকে ভাবতে বাধ্য করতো, ভীষণভাবে আশাহত, হৃদয়াহত করতো মানুষের বিশ্বাসহীনতা, স্বার্থপরতা। অনেকটা এই পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে তখন থেকেই অতীত স্মৃতির টানে লিখতাম রোমান্টিক ধারার কবিতা। তারপর আস্তে আস্তে সাহিত্য পাঠের মধ্যে আবিষ্কার করতে থাকলাম নতুন নতুন দিগন্ত, লেখার নতুন ক্ষেত্র ও সম্ভাবনা। এভাবে শুরু হল কবিতা লেখার যাত্রা।
কিন্তু তখনো কি জানতাম এতোসব তথ্য ও তত্ত্ব! শিল্প-সাহিত্য তথা কবিতার নানাবিধ কারিগরির মধ্যে পড়ে প্রথমে অসহায় বোধ হত। কেউ হয়তো একটা রচনা নিয়ে উচ্চকিত প্রশংসা করছে, আবার সেই লেখাটিকেই কেউ বাতিল করে দিচ্ছে। এ ছিল অসহনীয় যন্ত্রণা। ফলে পুনরায় নিজেকে আবিষ্কার করতে হতো। এ প্রক্রিয়া এখনো চলমান আছে। আজ আমি বুঝতে পারি যে সমালোচক তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে কবিতাটি দেখছেন বা পাঠক তাঁর হৃদয়গণ্ডিতে কবিতা পেতে চাইছেন। কিন্তু আমি আমার আবিষ্কার ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে কবিতা লিখছি। সুতরাং একটা ফারাক কারো কারো ক্ষেত্রে থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তখন প্রশ্ন আসে শিল্পমানের। এর উত্তর খোঁজার জন্য আমিও কিছু তত্ত্ব-সালোচনা পাঠ করেছি, নিজের চিন্তায় ধরার চেষ্টা করেছি কবিতা কারিগরি। এখনকার যে সামান্য জ্ঞান আমার জমা হয়েছে তা থেকে এই প্রক্রিয়া বা অনুশীলনের ব্যাপারে এতোটুকু শুধু বলা যায় যে এটা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনাভিজ্ঞতা ভিন্ন। তাই, এ নিয়ে ভবিতব্য করা বা এর নীতিমালা ঠিক করা সম্ভব নয়। কেবলি আবহমান ধারায় বয়ে যাওয়া এবং প্রতিদিন নিজেকে হারিয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া আর কি-ইবা করার থাকতে পারে!
অনেকে এই প্রক্রিয়াটিকে নিরীক্ষা বলে থাকেন। সেটাও ভালো দিক। কিন্তু কবিতাবোধের নিরীক্ষা হয় না বলে আমার ধারণা। বোধের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ লাভের সাধনা হতে পারে। তবে নিরীক্ষা হতে পারে ফর্ম বা আঙ্গিকের। কোনো নারী যেমন তাঁর শরীরকে নানাবিধ অলঙ্কারে সাজান, এক এক পার্বনে এক একভাবে নিজেকে সাজিয়ে উপস্থাপন করেন তাঁর প্রিয় মানুষটির কাছে, প্রকৃতি যেমন এক এক ঋতুতে এক এক সাজে হাজির হয় আমাদের সামনে, তেমনি কবিও তাঁর কবিতাকে নানা আঙ্গিক ও অলঙ্কারে সাজিয়ে উপস্থাপন করেন পাঠকের সামনে। বিংশশতাব্দীর আরেক প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠির ভাষ্য, ‘the way it is made and its purely visual aspects–rather than its narrative content or its relationship to the visible world.‘ তাঁরা মনে করেন, কবিতার বিষয়-ভাবের চেয়ে ফর্ম অনেক বড়ো ব্যাপার। যা আজো কবি ও শিল্পীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে আছে। মধ্যযুগে একই পয়ারে রচিত হয়েছে হাজার হাজার কাব্য, কিন্তু বর্তমানে তা ভীষণভাবে দোষের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমরা নানাবিধ টানাপোড়েনে পড়ে গেছি। কোন ফর্মে লিখব? প্রতিদিন বা প্রতি কাব্যে কি নতুন ফর্ম আবিষ্কার করা সম্ভবপর হয়? এমন নিরীক্ষার ঘেরাটোপে পড়ে আমাদের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে নাকি কবিতা পোশাকে চাপা পড়ে হাসফাঁস করছে, ভেবে দেখার সময় সম্ভবত এসেছে। আমাদের নারীরা এখন নিজেদের সাজাতে গিয়ে নিজের আসল চেহারা পাল্টে ফেলছে। একটা সেলফি তোলার লোভে হাজার টাকা খরচ করে নিজেকে রঙের পুতুলে রূপ দিচ্ছে অবলীলায়। তেমনি আমাদের কবি ও লেখকগণ নিজের ফর্মে এতো বেশি নিরীক্ষা করছেন যে সেই ফর্মের মধ্যে আদৌ কবিতা আছে কিনা, সে খেয়ালা তাঁরা রাখতে পারছেন না বা রাখছেন না। কবিতার এই ডিলেমা বা উভয়সংকট কালের একজন কবিতাকর্মী হিসেবে আমার কী করা উচিৎ বা উচিৎ নয় এসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে আমি বুঝতে পেরেছি যে তত্ত্ব বা সমালোচনা জেনে বুঝে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ হয় না। আগে সৃষ্টি পরে সমালোচনা, এমন ভাবধারায় আপাতত আস্থা রাখি।
৪.
সর্বোপরি বলতে হয়, ওই রহস্যময়ী, যাঁকে অন্তরের প্রান্তরে আবছায়ার মধ্যে যতোটুকু পাওয়া যায় তারই শব্দরূপ কবিতা। প্রকৃতির নানা সজ্জার মতো সেই কবিতাকে ছন্দ-অলঙ্করে সাজানোর মাধ্যমে উপস্থাপনের চেষ্টাটুকু কবিতার অনুষঙ্গ মাত্র। কবি তাঁর জীবনাভিজ্ঞতায় যা কিছু লাভ করেন, বা বলা যায় তাঁর হৃদয়ে যেসব বিষয়-বাস্তব-প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ তাঁর হৃদয়কে আন্দোলিত করে এবং তার ভিত্তিতে তিনি যে ‘শবদে শবদে বিয়া’ দেন তাই কবিতা। কিন্তু কবির লেখা অজস্র কবিতার মধ্যে কটা বা মানুষ মনে রাখে? আর যদি মানুষ মনে না রাখে তা কি আসলেই কবিতা? আমি একজন অনভিজ্ঞ সামান্য মানুষ বলে আজো তাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা পর্যন্তই আমার দৌড়, তাত্ত্বিক জিজ্ঞাসার উত্তর প্রদান করার মতো যথেষ্ট জ্ঞান বা প্রজ্ঞা আমার নাই। সুতরাং এ বিষয় আর ভুলভাল বক্তব্য না দিয়ে লেখাটার ইতি টানছি। তাঁর আগে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তাহলো, স্বার্থক কবিতা বিষয়ে। আমার মনে হয়, কবিতা তখনই স্বার্থক হয়ে ওঠে যখন তা পাঠক হৃদয়কে আলোড়িত করে, তাদের ভাবনায় আন্দোলন সৃষ্টি করে কিন্তু কোনো তত্ত্ব বা তথ্য প্রদান করে না, কোনো গল্প বলে না, শুধুই হৃদয়বৃত্তির আন্দোলন। তাই, কবিতা শিল্প নির্ভর হলেও, স্বার্থক কবিতা পাঠক নির্ভর। এ সম্পর্কে কবি ডিলান টমাস বলেছেন, ‘A god poem helps to change the shape and significance of the universe, helps to extend everyone’s knowledge of himself and the world around him.‘ বর্তমান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কালে কবিতা তাঁর দুঃসময় পার করছে নিঃসন্দেহে। তবে এটাও সাময়িক ব্যাপার। কবিতার যাত্রা থেকে এমন অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছে, তাই বলে কোনো কালে কবিগণ থেমে থাকেননি। আমরা যেসব অন্ধকার যুগ ইতিহাসে পাই, সেখানেও রচিত হয়েছে অনেক কবিতা। হয়তো সমকালে তার সমাদর হয়নি। কিন্তু আমরা এও জানি পরবর্তীতে স্বার্থক কবিতার সমঝদারের অভাব ঘটেনি। ফলশ্রুতিতে, আমি ব্যক্তিগতভাবে কবিতার সংকট বোধ করলেও কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন নই। কারণ, পাঠকের গোপন হৃদয়ে কবিতা লালিত হয়, তা সব সময় খালি চোখে বা প্রযুক্তির প্রয়োগে দেখা বা বোঝা সম্ভব নাও হতে পারে। লেখাটি শেষ করছি কবিদের শত্রু হিসেবে পরিগণিত মহামতি প্লেটোর উদ্ধৃতি দিয়ে, তিনি বলেছেন, ‘Every heart sings a song, incomplete, until another heart whispers back.’ সুতরাং বলা যায়, কবিতা-স্বার্থকতার মানদণ্ড সমাকাল বা সমালোকদের বিশ্লেষণ নয়, বরং কবিতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত ওই পাঠক-হৃদয়।
মাহমুদ মিটুলের পাঁচটি কবিতা
আজ বরং যাই
আমি বরং আজ যাই।
অন্য কোনো দিন
আসবো পোশাকে চড়ে
বাহুবল রথে।
এখানে দারুণ ভিড়।
গোলচত্বরে এসে মিশেছে
সুদীর্ঘ সমাজ সারি,
হই হই গীতে
বিপরীত দাবি-দাওয়া।
ব্যস্ত, বেজায় ব্যস্ত বাজার।
আমি বরং পরে আসি।
পিপীলিকা পথঘাট,
কফিমগ, চায়ের চামচ,
শড়ির শোরুম আর
মাংসের দোকান
ক্লান্ত হলে,
কিছুটা ক্লান্ত হয়ে
যখন নামবে নিরব
মনের খোলনচলে
জমবে অবসন্ন অবসর,
তখন তিমির ডাক
ভীতি বিবসনা,
আসবো আড়াল করে
ভূতের ভেলকি বাজি,
গিলে নেবো এক শ্বাসে
কোকের বোতল।
স্টেশন, টার্মিনাল,
লোকাল সার্ভিস,
অনলাইন অফলাইন জট
কমলে কিছুটা,
কাউকাউ কড়াকাড়ি
বারোয়ারি মেজবান
ক্লান্ত হলে,
কিছুটা ক্লান্ত হয়ে
নামলে ঝিঁঝির রব
বিরাণ বাতাসে দম নিতে
আসবো হৃদয়ে চড়ে
মনোবল রথে-
আজ, আমি বরং যাই।
মৃদু আঁচে জ্বলে
নদীর নিনাদ কানে
বাজে-তরঙ্গালয়ে
ছুটিয়ে ঢেউয়ের তুবরি,
তুখোর সাঁতার কাটছে
যৌবন। তীরচারি ঝাউবন
বিহ্বল বাতাসে হেলেদুলে
খেলছে ফুলটোকা।
বকুল, হেনা, শিমুল,
পলাশের মায়ামুখ ছেনে
লাবণ্য নির্যাসে
বিকেলটাকে পান ক’রে,
সেঁজুতি সন্ধ্যার
হোতা খালকূলে
কাঁশবনে জ্বালিয়ে জোনাকি,
দৈব-দীক্ষালয়ে নাচের তালিম নেয়।
পৌষের পিছু নেয়,
চুপিচুপি হৈমন্তী হাওয়ায়
শোনে শিখামন্ত্র,
মৃদু আঁচে জ্বালিয়ে আবেগ
ধীরে ধীরে মোরব্বা বানায়।
দুঃখের বাতুল বায়ু উড়িয়ে
আউলা বিলে বিভোর মালসায়
খোঁজে সম্ভাবনার কবিরাজী।
মৃদু আঁচে জ্বলে
তরকারি,
চুপিচুপি হৈম হাওয়া
লবণ চেখে দেখে-
ঝিরিঝিরি বরষায়
কদমের বনে
চুরি হয়েছে রোজকার বাঁশরী।
মনোসংযোগ
বরং ওদেরকে শোনো।
সর্বাঙ্গীন কবিরাজী মজমা,
মুশায়রায় খুঁজে নাও
আতর-লোবান সুখ, গিজগিজ
চাটনি তেঁতুল, লোলে ভাসা
এভিনিউ, স্টেডিয়াম।
দেখবে ধাতুর বিজ্ঞাপন।
আধখোলা পিঠভাঁজে
ধনুকের শিল্পকলা
খুঁজতে খুঁজতে চলে যাবে
লাতিন আমাজনে;
উলঙ্গ নিসর্গে নামতে নামতে
তোমাকে ধাক্কা দিয়ে
জাগিয়ে তুলবে, ‘লাগান, ভাই’,
অকস্মাৎ বিহ্বল তুমি
লাগাতে থাকবে এলোপাথারি
সারা গায়ে ভ্যাসলিন।
তোমার পেটে কৃমি-নাশক
দাওয়াই হয়ে উঠবে
আসমানী দৈবপ্রশ্ন
‘হালাল তো?’
তুমি পাকস্থলি ঘেটে
পিত্তরস যাচাই করতে করতে
পৌঁছে যাবে ওষুধের দোকানে,
হাতে নিয়ে গ্যাসের পিল
হা-করে গিলবে
গিলগমেশের হাঁপানি,
এদিন সেদিক ছুটে
তোমার জীবন হয়ে উঠবে
চমৎকার দৌড়মুখর।
আমরসের টসটসে ফোটা
ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে,
চিবুক ছুঁই ছুঁই তুমি
ধীরে নামতে থাকবে
গন্ডদেশ বেয়ে,
ধীরে বুকের খাঁজে
মুদে আসবে চোখ,
নেমে যাবে
নাভীমুখে চিকচিকে
ঘামের বিন্দুতে বুঁদ হয়ে
আহ্-আহ্- অতিবরে
বিভোর উল্লাসে তুমি
চাটতে চাটতে
পরিষ্কার করবে
খায়েসের কলতানি।
ওদেরকেই শোনো বরং।
ওই যে আকাশলীন
দৃশ্যান্তরে গাইছে
বকমারা কলের গুণগান
পরিযায়ী পাখি;
সেখানে মনোযোগ ঢেলে
তুমি বরং পাখি হয়ে
বাকুম বাকুম নাচনে
মাতিয়ে কলাই ক্ষেত
তুমি পোষা মন
বিকেল রঙের আরশে
কাঁকাতুয়া কলরব শেষ হলে
ফিরে আসো,
ফিরে, ফিরে আসো
আমদানী বিছানায়,
সুখ-স্বপ্ন-ঘুমে
পেয়ে যাবে
আরো কিছু ঝিমুনি আরাম,
আরো এক গৃহদাস
শিৎকার মজমায়
খিস্তি-খেয়াল রতি,
মনকলা বায়োস্কপ।
কর্ম খালি নাই
কাজ নাই।
করোনা উত্তর কালে ক্লান্ত বিছানায়
শুয়ে ভাবছি আগামী।
রাত্রি শেষে নামবে আবার
দিনের দংশন,
আহারে বিহার তাড়া;
কর্মহীন দুর্ভাবনা বুনে
রাঁধি একাকিত্ব, খাই আয়ু খেসারত।
কাজ নাই, নিরলস
খয়রাতি বোলচালে যাপক জীবন,
প্রতিদিন বয়কট, বাছাই ছাঁটাই;
ডালপালা শীত ছুঁই
হলুদ অপেক্ষা বাড়ে, পাতা ঝরে,
বাড়ে বেহায়া জগত দাবি;
প্রতীক্ষা জারিত পাল
বেদম বাজিতে দোলে অহেতুক প্রাণ।
কাজ নাই।
ক্লান্ত পৃথিবীর ভারবাহী দেহধারী
জীব, জীবনের ঘুরপাকে
বাসন আলাপে দিন,
বিছানা ক্ষোভের শোকগাথা সুর করে
গেয়ে, পারাপারে খুঁটে খাই,
নিরামিষ তিন বেলা, আয়ু হাহুতাশ।
খেয়ালের খতিয়ান
আমাকে খুঁজবে তুমি ভুলের ভাঙন
কূলে দিশেহারা প্রাণে, জানি;
কাজল কান্না সুখে হাতরে
স্যুটকেস, পিসি’র ফোল্ডার,
স্মৃতিমগ্ন দক্ষিণ জানালা ধরে
শুনবে বাতাসে স্বর অবিরত
আবাহন, আউলা উদাস সুর,
হট্টিটি পাখির অবিরাম আর্তনাদ।
ইউটিউবে বাজবে পুরনো গান,
লাটিমের ঘূর্ণীতে মগজের
আধাপাকা নিউরনে নড়ে উঠবে
প্রাণ, সুদূর বিরামপুরে ভাব
স্ক্রলবারে হৃদয় মথিত ওঠানামা,
ঘুরপথে কুড়োবে ঝরা অবসাদ।
বাসনে বাজবে গীত, রান্নাবাটি
খেলার খেয়ালে কেটে যাবে
বেজায় দুপুর, বিষাদ বিকেল খুলে
পড়বে মনের ভুলে গায়েবি
গীতাঞ্জলি, আওয়াজে ভারী হলে
মন, হেলেদুলে বেলকনি টবে
গাছের কানে বলবে বিরাণ
স্মৃতি, পাতাছেঁড়া দিনলিপি,
না-খুশি না-ব্যথার ঝিনুকমালা।
অথচ আমার দিন, দূরে খেসারত
খামারে বেগার জিকির তুলে
বেগানা জামিনে ঠেলে দণ্ড লাঙল
চর্যা রোপন করি আগামীর বেদনা;
প্রতিদিন অশ্রু সেঁচে লালন করি
দুঃখের বাদামী চোখে নদী বয়
তরতর ডিঙা পালে রঙ মেখে
মুখশের পাইকারি বাজারে
নিজেকে বেচিকিনি প্রতিদিন।
পড়ে থাকে দূরালাপ দূরবীণ-
আমরা তুমুল তুফান তুলে
অন্তর্জালে তখন সমসত্ব দ্রবণে
পান করি বন্ধ্যা অবসর;
অনলাইন রেসিপি গুণে রাঁধি
স্মৃতির আবছা তরকারি,
ফালি ফালি কেটে বেদনা মূল
রসনা বিলাসে খাই হাওয়াই মিঠাই।
বেলা পড়ে আসবে, সায়াহ্নে শীতল
আলেখ্য পেতে শুয়ে বসে
কাটে না ক্ষণ, কন কন হীম বায়ু
নিঝুম কটাক্ষ ঢেলে জ্বালাবে জালিম
বরফ কণা, হারানো হারমোনিকা
ফণা তুলে দংশন-ছোবলে
জাগাবে জীবনের যাবতীয় শোক,
লুকানো জিজ্ঞাসু চোখ
রাঙা দৃষ্টি মেলে তাকাবে ভীষণ,
ভয় ভয় পরিতাপ জেঁকে বসে
শোনাবে সজল তিতিক্ষা কাহিনি।
আমাকে খুঁজবে না, খুঁজবে কি ভুলে?
সমস্ত সান্ত্বনা ভরে ঝিমন্ত ঝোলায়
ঝাপসা চোখ পাথুরে মণি দেখবে না
ননির খনি, লবণের কারবার,
নিভু নিভু চুলায় আর হবে না রান্না
সখের শালুন, রকমারি রেসিপি স্বাদ,
মধুর গান বাগানে ফুলের রেনু,
পোকামাকড় খাবে শুধু হৃদয়ের লাশ-
আমরা নিথর প্রাণ অবসন্ন মনে
জাবর কাটবো ভুলে বিগত বেদনা,
ফুটফুটে হাসি খেতে সেল্ফি তুলে
ফুটে থাকবো সেদিন অন্তর্জালে
অজান্তে ছায়াচিত্র এক প্রেমকামহীন।