
কবিতা : উজ্জীবনের পরিভাষা—চেতন, অবচেতন
জীবন হচ্ছে যাপনের, মৃত্যু উদযাপনের। আর জীবনের মাঝে উদযাপনের মহিমা দেবার জন্যেই মানুষ কবিতা লিখে বলে আমার ধারণা। তাহলে কবিতা কি মৃত্যু সংলগ্ন? তা নয়, কবিতা হচ্ছে বেদনাজাত। মৃত্যু যার প্রতীক-পরিণাম। জীবনের মাঝে উজ্জীবনের পরিভাষায় কথা বলে কবিতা। বিষয়টি পরিষ্কার করতে একজন নব বধূর কথা ভাবি যার বিয়ে হলো গতকাল। সারারাত বাসর যাপন করে ভোরে স্নান সেরে পতির মঙ্গল কামনায় সে প্রার্থনা করলো। যাপিত রাত্রির শেষে বাসরকে উদযাপন করলো সে প্রার্থনায়। এই প্রার্থনা আসলে তার মানস পতির জন্যে যাকে সে পরমভাবে চায়। উদযাপনও সেরকম পরমভাবে যাপন। বেদনায় উজ্জীবিত হই বলেই এই উদযাপনের অনুষঙ্গ একদা প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে আমাদের জীবনে। বাল্মীকির জীবনেও হয়েছিল। ব্যাধের বাণে যে-পাখিটি মরে গিয়েছিলো তার বেদনায় উজ্জীবিত হয়েই সেই মৃত্যুকে উদযাপন করলেন বাল্মীকি। ‘পক্ষি শোকে এক শ্লোক নিঃসরিল মুখে’- অর্থাৎ লিখলেন শ্লোক। জন্ম হলো কবিতার। প্রার্থনার প্রসঙ্গটি কেবলই উদাহরণ হিসেবে আনা। কিন্তু কবিতার সঙ্গে কবির ‘মানস জগৎ’ দারুণভাবে জড়িত। যার অবস্থান নির্জ্ঞানে বা অবচেতনায়। রামায়ন যেমন বলে:
শোক হৈতে শ্লোকের হইল উপাদান।
‘মা নিষাদ’ বলিয়া তাহার উপাখ্যান।
চারি পদ ছন্দ মুনি লিখিলেন পাতে।
আপনি লিখিয়া মূল না পারে বুঝিতে।
এই-যে ‘বুঝিতে’ না পারা তার কারণ হলো নির্জ্ঞান বা অবচেতনায় সংঘটিত হয়েছিল সেই ছন্দ। যেমন আমরা কথা বলতে বলতে গালে হাত রাখি, মাথা চুলকাই বা অন্যান্য অঙ্গ ভঙ্গি সচেতন প্রয়াস ছাড়াই করে থাকি। কিন্তু সর্বোতভাবে ঘোর লাগা অবচেতনার কবিতা বলতে আমরা যা বুঝি তার আনুষ্ঠানিক পদচারণা স্যুরিয়ালিস্টিক আন্দোলনের সময় থেকে। আর কবিতার কোনো আন্দোলনের একচ্ছত্র প্রভাব সুদীর্ঘকাল টিকে থাকে না। প্রচল ঐতিহ্য এসে দানা বাঁধে ভিন্ন ভিন্ন বাঁকে। তাকেই আমরা স্বকীয়তা বলে চিহ্নিত করি। খুঁজে পাই মহৎ কবিকেও। আবার রামায়ন মহাভারতই নয় যে-কোনো ক্লাসিক বা ধ্রুপদি ধারার কাব্যেই ছন্দ ও শৈলীর অলঙ্ঘ্য নিয়ম মানার ব্যাপার থাকে। আর নিয়ম তো রপ্ত করার ব্যাপার, অবচেতনার সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক হচ্ছে স্বতঃস্ফুর্ততার সঙ্গে। যেমন আমরা কম্পিউটারের কী-বোর্ডে আঙুল চালাতে চালাতে এক সময় স্বতস্ফুর্ত হয়ে উঠি। তখন অক্ষরে চোখ না রেখেও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আমরা লিখে যেতে পারি। তাই কবিতার ক্ষেত্রে অবচেতনার ভূমিকা বড়ো সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ, প্রাচীন বিষয় নয়। বরং কোনো কোনো সময় অবচেতনাও আরোপিত হয়ে থাকে। মাদক দ্রব্য সেবনের মধ্য দিয়ে ঘোর তৈরী করে সেই অবচেতনায় পৌঁছুতে চান কবিরা। অনেক আধুনিক কবির মধ্যে এই মাদক সেবনের বিষয়টি ছিল। রোমান্টিক কবি কোলরিজ আফিম সেবন করে তার ‘কুবলা খান’ কবিতাটি লিখেছেন বলে আমরা জানি। আর মাঝখানে সেবনজাত স্বপ্নের ছেদ পড়েছিল বলে শেষটায় কবিতাটি আর সঙ্গতি রক্ষা করেনি। তবু কবিতাটি মহৎ বলে স্বীকৃত। এই বিরল স্বীকৃতিকে মনে রেখেও এ কথা বলতেই হবে যে, রপ্ত করার পরিবর্তে আরোপিত প্রক্রিয়ায় অবচেতনাকে স্ফুর্ত করে তোলা একটি কষ্টার্জিত ব্যাপার। কবির পক্ষে সেই অবচেতনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখাও কঠিন। তাই কবিতার জন্য প্রয়োজন চেতনায় নিমগ্ন থাকা। অর্থাৎ পরম চেতন থাকা। বহুরৈখিক অভিমুখ থেকে সরিয়ে চেতনাকে একমুখী করা। একাগ্রতার অর্থে যাকে আমরা বলতে পারি অভিনিবেশ। ম্যাকবেথ যখন বলেন:
Out, out, brief candle!
Life’s but a walking shadow; a poor player
That struts and frets his hour upon the stage,
And then is heard no more: it is a tale
Told by an idiot, full of sound and fury,
Signifying nothing.
তখন আমরা পাই walking shadow বা চলিষ্ণু ছায়ার সঙ্গে জীবনের সাদৃশ্য নির্মাণ। অর্থাৎ জীবনের নিরর্থকতার বোধ। এই বোধ বিয়োগাত্মক। তাই বেদনা জাগায়। কিন্তু জীবনের পরম চেতনা না থাকলে বোধের এই জায়গায় পৌঁছা শেক্সপীয়ারের পক্ষে সম্ভব ছিল? চলিষ্ণু ছায়ার চিত্রকল্প আর নিরর্থকতার বোধ একাকার হয়ে গেলো, কিন্তু দার্শনিক প্রজ্ঞা কোথাও রূঢ়ভাবে কটমট করে উঠল না। কাব্যের স্বতস্ফুর্ততায় প্রাঞ্জল হয়ে উঠল। কিন্তু কেন? কারণ অবচেতনা নয়, বরং শেক্সপীয়ার জীবন চৈতন্যের ভিতর দিয়েই সেই ভাষা এবং শৈলী রপ্ত করেছিলেন। আরও অনেক অনেক বছর আগে সফোক্লিস তার কলোনাসে অদিপাস নাটকে প্রায় একই রকম নঞর্থক বোধে কিছুটা চিত্রকল্পময় হয়ে উঠেছিলেন। তার সেই বোধ ছিলো সামান্য আবেগরহিত:
Fair Aigeus’ son, only to gods in heaven
Comes no old age nor death of anything:
All else is turmoiled by our master Time.
The earth’s strength fades and manhood’s glory fades,
Fair dies, and unfaith blossoms like a flower.
And who shall find in the open streets of men
Or secret places of his own heart’s love
One wind blow true for ever?
এই দুই মহারথিকে উপস্থাপনের উদ্দেশ্য হলো কালের পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ। অতীতের মহাজন, কিন্তু কিছুতেই প্রাচীন নয়। বরং চিরকালীন।
অবেচেতনাকে অস্বীকার করে পরাবাস্তব কবিতার মাহাত্ম্যকে খাটো করতে চাই না আমি। বরং বলতে চাই উদ্দেশ্যকে মুখ্য ধরলে একমাত্র পরাবাস্তব কবিতাতেই অবচেতনা তার মৌল ভিত্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাষা, শৈলী এবং বিষয়ের ভিন্নতা দিয়ে যা বিশ্ব কবিতাকে প্রোজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্যে উন্নীত করেছে। অন্যথায় আত্ম নিমগ্নতার অর্থে পরম চেতনা বলে যে-নির্জ্ঞান ইঙ্গিত করেছি আমি সেটি ভিন্নতর কিছু, যা অন্তর্নিহিত কিন্তু কাব্য প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক দাবি। সেই দাবি মিটলেই কেবল রপ্ত করার বিষয়ে কবিমন অনুপ্রাণিত বোধ করেন। যেমন নারদ মুনির কাছে রামায়ন লিখার অনুপ্রেরণা নিয়েছেন বাল্মীকি। কেননা নির্জ্ঞানে শ্লোক উচ্চারণ করে প্রাথমিক দাবি তিনি আগেই মিটিয়েছেন। এখানেই একজন কবি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য।
জীবনানন্দের পর বাংলা কবিতায় অবচেতনার রহস্য নির্মাণে শিখরস্পর্শী সফলতা কেউ দেখাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। শক্তি চট্টোপাধ্যায় চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সমূল স্বকীয়তায় পৌঁছানোর আগেই তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ‘রুপালি স্নান’সহ আরও অনেক কবিতায় জীবনানন্দীয় অবচেতনার রহস্যকে সফলতার সঙ্গে আভাসিত রেখেছেন শামসুর রাহমান। কিন্তু অবচেতন রহস্যের শিল্পরূপ তার কবিতার মৌল উদ্দীপনা নয়, এ কথা আমরা সকলেই জানি। ‘চাঁদের খুলির মধ্যে পাওয়া এক-মুঠো সোনার ছাই’ হাতে নিয়ে ‘সোনার বন্যার মতো গলগল করে’ ‘অমিতাভ আকাঙ্ক্ষার কথা’ বলতে চেয়েছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। কিন্তু চেতনার স্বাভাবিকতাকে আড়াল করে ভৌতিক বাস্তবের দিকে ভাষাকে আরও বেশি আদিভৌতিক করে দিলে যে-থ্রিলার তৈরী হয়, তার জন্য অবচেতনার চেয়ে চেতন প্রক্রিয়া বেশি জরুরী বলে মনে করি। তার জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ এবং অপরাপর পরাবাস্তব কবিতাগুলো নিরীক্ষা করলে এর সত্যতা বেরিয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু পঞ্চাশের কবিতার হাত ধরে ষাট এবং সত্তর অবধি বাংলা কবিতা-যে পাঠকসম্পৃক্ত ছিল, ছিল জনপ্রিয়তায় ভাস্বর, এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই। জনপ্রিয়তা কাব্যের নান্দনিক সফলতার পরাকাষ্ঠা নয়, কিন্তু পাঠক বিচ্ছিন্ন দুরূহ দূরত্ব নির্মাণই যে শিল্প সাফল্যের চাবিকাঠি এ কথা হলফ করে বলতে পারে না কেউ। আত্ম-সঙ্কটের সরল বিবৃতি এবং জৈবনিক বাস্তবতার স্বীকারোক্তি সাবলীল বর্নণায় উঠে এসেছিল বলে হয়তো সেসব কবিতা জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু ট্র্যাডিশনাল ধারায় লিখলেও আল মাহমুদের যে শিল্প স্বাতন্ত্র্য তার সফলতাকে কে অস্বীকার করে? বিনয় মজুমদারের কবিতার অবিশ্বাস্য সরলতা তার কবিতাকে বরং উচ্চাঙ্গে অধিষ্ঠিত করেছে, যেখানে গাণিতিক বা বৈজ্ঞানিক সত্যও সাবলীল ব্যঞ্জনায় পাঠকের মনে সঞ্চারিত হয়। তার কবিতার জনপ্রিয়তাও ঈর্ষণীয়।
এখন কথা হলো, লীলার কথা অবলীলায় বলে ফেলবার ক্ষমতা স্বভাব কবিদের ছিল। এখন জীবনলীলা প্রাসঙ্গিক নয়। আধুনিক যুগে কবিরা কবিতায় উপজীব্য করেন জীবনসংগ্রাম। আর সংগ্রাম মানেই তো শুধু সৃষ্টি নয়, অনাসৃষ্টিও। ‘পাপ’ তথা নেতির প্রশ্রয়। তাই আত্ম-সঙ্কটের প্রাঞ্জল বর্ণনায় নিজের পরিচয় নিয়েও কোনো মাঙ্গলিক মহিমায় তাড়িত নন কবিরা। ‘ভয়াবহ ভয়ের আর্শিতে’ নিজেকে ‘পশুর মতো মনে হতে থাকে’ আল মাহমুদের। ‘একদিন পালকের মতো ঝ’রে’ যাবার ভয় ছিল বিনয়ের। তাই হয়তো শক্তির চিৎকার মূর্ত হয়ে ওঠে: ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’। আর শহীদ কাদরী বলেন: ‘জন্মেই কুঁকড়ে গেছি যেন মাতৃজরায়ন থেকে নেমে’। ষাটের আবুল হাসান নিজেকে মনে করেন ‘জনকের জীবনের রুগ্ন রূপান্তর’ তিনি যার ‘অনিচ্ছুক দাস’। আর দাউদ হায়দার শিল্পের তোয়াক্কা না করে সরল খেদোক্তি করেন: ‘জন্মই আমার আজন্মের পাপ’। জীবনের প্রতি এই নিরাসক্তি আসলে জীবনাকাঙ্ক্ষারই উভবল তাড়না। সেই জীবনাকাঙ্ক্ষা সুতীব্র বলেই শিল্পকে কচুকাটা করে সরল নির্ঝরের মতো নেমে এসেছে। শিল্পের মহাকালিক সম্ভাবনাকে আঁকড়ে থাকতে পারেনি। তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তায় নি:শেষ হয়েছে জীবনঘনিষ্ঠ এই কবিতার চেতন জগৎ। তবু এ সময় অবধি অনেক কবিই বুঝেছিলেন অবচেতনার রহস্যঘোর ডিঙিয়ে কেবল জীবন চেতনার স্বত:স্ফুর্ত প্রকাশে কবিতা এখন আর স্বার্বভৌম নয়। প্রয়োজন নির্মিতির। সৃস্টি ও মননের সমন্বয়। তাই ভাষা, শৈলী বা প্রকরণের অভিনবত্বে কেউ কেউ স্বকীয় হয়ে উঠলেন অনন্য বিশিষ্টতায়। কালে হয়তো টিকেও যাবেন কেউ কেউ। শুধু পাঠকপ্রিয়তায় টিকে যাবেন তারা এমন তো নয়। শিল্পবোদ্ধারাও স্বীকৃতি দিয়েছেন বলে আমরাও বলবার ফুরসৎ পাই।
আশির দশক থেকে কবিতা আবার সংহত হলো। পাঠকসম্পৃক্ত নয়, বরং বলা যায় শিল্পসম্পৃক্ত হবার প্রেরণাই তাদের কবিতাকে কিছুটা বুদ্ধিবৃত্তিক, প্রকরণচেতন এক আরোপিত সুষমার দিকে নিয়ে গেলো। টেকনিক আর চিন্তার পরিচর্যায় সেই কবিতা ভিন্ন স্বাদের হলেও মনে হয় এর পাঠকশ্রেণি সাধারণ নয়, নির্বাচিত। তবু বিশুদ্ধ চেতনার দিকে কবিতার এই অভিগমন বৈচিত্র্য এনেছিল। অতএব অনেক রকম কবিতা আছে বলেই কবিতার স্বাদ ভিন্ন হয়। আর তাই কবিতার শিল্প ব্যাখ্যাও হয় ভিন্নতর। নাজিম হিকমত লিখেছিলেন: শিল্পকলা/আমার জিভের ওপর/তেতো শশার মতো কোনো স্বাদ রেখে যায়। বিপ্লবী জীবনের তেতো স্বাদ নিয়েও তিনি লিখেন:
ভোর,
পেটা ঘড়িতে ছ’টা
দিনের ঝলমল আলোর ফটক খুলে আমি অন্দরে পা রাখলাম,
আমাকে জানালায় সুপ্রভাত জানালো সদ্যফোটা
নীলিমার ঘ্রাণ
আয়নায় দেখলাম আমার কপাল,
সেখানে গতকালের ফেলে-দেয়া রেখাগুলো জ্বলজ্বল করছে
আমার পেছনে পীচফলের চেয়েও কোমল
কোনো নারীর মিষ্টি কণ্ঠস্বর
আজ রেডিওতে আমার দেশের হালচালের খবর দিয়েছে
আর এখন,
উপচে পড়ছে আমার ভীষণ আশা
সময়ের ফুলবাগিচায়
এক গাছ থেকে আর এক গাছে আমি হৈ হৈ করে
ছোটাছুটি করব…
মোহনীয় দৃশ্যের আরেক ভোরকে আমরা দেখব জীবনানন্দের কবিতায়:
ভোর;
আকাশের রঙ ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল:
চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।
একটি তারা এখনো আকাশে রয়েছে:
পাড়াগাঁয়ে বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো;
কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে মুক্তা
আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিল
হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তেমনি-
তেমনি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনো।
প্রথম কবিতাটি অনাড়ম্বর, সাদামাটা। এই কবিতার উপকরণগুলো ঠিক জীবনের মতো সরাসরি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। একজন স্বাপ্নিক বিপ্লবীর চেতন জগৎ থেকে উঠে আসা দীপ্যমান আশাবাদ নান্দনিকতাকে ছাড়িয়ে এক মানবিক মূল্যে পৌঁছে দিয়েছে কবিতাটিকে। দ্বিতিয় কবিতার মোহনীয়তা চেতন জগৎ আচ্ছন্ন করে যেন এক পরা জগতের দিকে পাঠককে অবচেতন করে দিতে চায়। প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনাও তখন আর মানবিক জগতের মনে হয় না। মনে হয় মানবিকতাকে ডিঙিয়ে অতি প্রাকৃত নান্দনিক বিভা ছড়ানোই কবিতাটির উদ্দেশ্য।
মোদ্দা কথা হলো, চেতন বা অবচেতন যা-ই হোক, শিল্পের এক অলিখিত শর্ত শেষ পর্যন্ত মানতেই হয়। এই শর্ত আরোপ করে শেখানো যায় না, নিজে থেকেই তৈরী হয়। নইলে পাগলের প্রলাপও কবিতা বলে চালানো যেত। অস্তিত্বের অসহনীয় লঘুতার এই যুগেও তা কিন্তু সম্ভব হয়নি। আর সেই অন্তর্নিহিত শর্তের তাগিদ গুরুত্ব পায়নি বলেই ষাট আর সত্তর দশকের বহু জনপ্রিয় কবিতা আজ আর ধোপে টিকে না। হাল আমলেও কবিতার নাম করে শুধু মোহন ছবির জগৎ কেউ কেউ নির্মাণ করেন। যুক্তি কাঠামোয় মিলে না বলেই তাতে চমক থাকে। তাই তার ভালোলাগাও সাময়িক মজা, স্থায়ী কোনো আনন্দ নয়। খোদাইয়ের দৃশ্যই স্থায়ী হয়। জলের ওপর দাগ দিলে যা হয় তা কিন্তু আলোড়ন, ছবিও নয়। কেননা জলের শরীর অঙ্কনের শর্ত মানে না।