
কথা-ব্যক্তিক, নৈর্ব্যক্তিক
প্রতিকথা’র এবারের আয়োজন এই সময়ের ১০ জন কথাসাহিত্যিকের গল্পভাবনা। কেন তাঁরা গল্প লেখেন, গল্প লিখে আসলে কী হয়, গল্প কেমন হওয়া উচিত, বাংলা গল্প কতদূর অগ্রসর হল, গল্প নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি, এমন নানা বিষয় নিয়ে ব্যাক্ত করেছেন প্রত্যেকে তাঁদের নিজস্ব ভাবনা। গল্পভাবনার সঙ্গে রয়েছে একটি করে গল্প।
পড়ুন কবীর রানার গল্পভাবনা ও গল্প।
গল্পের বাইরে কে
একজন মানুষের দিকে তাকাই, সকল মানুষের দিকে তাকাই। সে কথা বলছে, সে কাজ করছে; সকলেই কথা বলছে, সকলেই কাজ করছে। সে শুনছে অথবা সকলেই শুনছে। কী বলছে—গতকাল যা ঘটেছিল, আগামীকাল যা ঘটতে পারে। কী শুনছে—গতকাল যা ঘটেছিল, আগামীকাল যা ঘটতে পারে। একটা প্রশ্ন করি। অজস্র প্রশ্ন করি। শিশুর প্রশ্ন, শিশুর উত্তর কিংবা সবার প্রশ্ন, সবার উত্তর। বাবা কী করছে—মা’র সঙ্গে গল্প করছে, মা কী করছে—বাবার সঙ্গে গল্প করছে। শিশু কী করছে—বাবা মা’র গল্পের ভেতর ঢুকে পড়ছে। গল্পের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কে— কেউ না। এই কথা ঠিক চিরটাকাল, গল্পের বাইরে যাবার সাধ্য কারোরই নেই। প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি বস্তু গল্পের আলোতে, গল্পের অন্ধকারে আটকে আছে। আলোর ভেতরে অন্ধকারের গল্প, অন্ধকারের ভেতরে আলোর গল্প।
গল্প-আদি উত্তমর্ণ
গল্প বলতে গিয়েই কবিতা, নাটক, উপন্যাস, সিনেমা, চিত্রকলা—বলা ভালো শিল্পের সকল শাখা বিকশিত হয়েছে। লিখিত গল্পের শুরু যখন থেকেই হোক না কেনো প্রত্যক্ষে অথবা পরোক্ষে গল্প সকল শিল্পের নিউক্লিয়াস। গল্পকে বদলে ভিন্নতর শিল্পে রূপ দিতে কতোভাবেই না পোশাক পরানো হয়েছে আদিম কাল থেকে। কবিতা যখন জীবনের গল্পকে নেয় তখন তার পোশাক শ্রেষ্ঠ বিবাহের। স্বপ্নের পোশাক তার শরীরে পরিয়ে তাকে ডাকা হয় কবিতা নামে। নাটক যখন গল্পকে নেয় তখন তার পোশাকে কী দারুন ঝড়। কতো পাতা ওড়ে, কতো শাখা-প্রশাখা ভাঙে। সিনেমা যখন গল্পকে নেয় তখন কতো যে রঙের বিজ্ঞাপন। সকল শিল্প গল্পকে নেয়, নিয়ে পাল্টে দেয়, পাল্টে দেয় গল্পের পরিচয়। তাই অন্য শিল্পের সঙ্গে নিজেকে পৃথক করার জন্য তার, গল্পের, পরিচয় ঘোষণার প্রয়োজন হয়।
গল্প-জীবনের আশ্রয়
এই চিন্তা দুঃসাহসিক, হয়তো দুর্বিনীত যে জীবনের আশ্রয় গল্প। জীবনের আশ্রয় কিছুই হতে পারে না। কিন্ত যদি আমরা তাকাই সংসার বিপুল মানব স্রোতের দিকে, তবে দেখি সেখানে প্রতিটি মানুষ নিজের জীবনকে গল্প আকারে সাজিয়ে হাজির করছে অন্যের কাছে, নিজের কাছে। প্রতিটি মানুষকে মনে হয় গল্পকার। যে মানুষ গল্পের ভেতর দিয়ে বেঁচে আছে। গল্পে তার জয় উদ্যাপন, গল্পে তার পরাজয় পতন। তার সকল আলো-অন্ধকার গল্পে গল্পে আশ্রয় পাচ্ছে নিজের কাছে, অন্যের কাছে।
গল্প কাকে বলে এই ব্যর্থ তাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়ে বলি মানুষ তার জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়সমূহ যেভাবে দেখে, বলে অথবা যা ঘটতে পারে তা যেভাবে দেখে, বলে তাই গল্প। এই ব্যাখ্যার ভেতর ব্যাপকতা আছে। আর এই ব্যাখ্যার ভেতর অজস্র আপত্তি থাকবে সবার এবং আমারও। কিন্তু শুরুতেই যা বলার আভাষ দিয়েছিলাম, মানুষ তার জীবনের ঘটে যাওয়া সকল ঘটনাকে গল্প জ্ঞান করে চেতনে কিংবা অবচেতনে। একেকটা বিষয়কে, ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষ একেকটা গল্প বলে। এর সবগুলোই আসলে ছোট ছোট গল্প। একেকজন মানুষের জীবনে রয়েছে অসংখ্য ছোট গল্প। এ সবই মৌখিক গল্প, মৌখিক ছোট গল্প। এ কথা অবশ্যই মিথ্যা নয় যে ভাষা আবিষ্কারের পর মৌখিক ছোট গল্প পৃথিবীর আদি শিল্প। গুহা যুগে কথাকুশলী মানুষটি মুখে মুখে বাস্তব আর কল্পনা মিশিয়ে গল্প বলেছে চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষদেরকে। হয়তো তা শিকারে জয়ী হবার গল্প, শিকারে ব্যর্থ হবার গল্প। জীবন যদি অবিনাশী, জীবনের গল্পও অবিনাশী। জীবনের স্রোতে স্রোতে ছোটগল্পও সততই প্রবাহমান ছিল। কিন্তু সেসব মৌখিক গল্প মানুষের শ্রুতিনির্ভর ও স্মৃতিনির্ভর হওয়ার কারণে হারিয়ে যায়, পালিয়ে যায়। মৌখিক ছোটগল্পকে লিখিত ছোটগল্পে রূপ দিতে মানুষ ভীষণই অলসতার পরিচয় দেয় যখন দেখি সচেতনভাবে ছোটগল্প একটা আঙ্গিক পাচ্ছে, কাঠামো পাচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে। অথচ যে ছোটগল্প মৌখিকভাবে তৈরী হয়েছে গুহাযুগেই।
কী নিয়ে গল্প
যে নগরীতে আমার বসবাস তার স্থানগুলোর নাম মাথাকেন্দ্রিক এবং জীবনযাপনও মাথাকেন্দ্রিক। অবচেতনভাবে হয়তো এ নগরীর সকলেই মাথায় বিশ্বাস করে অথবা মাথার বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করে। এ স্থানের নাম সাতমাথা। এ নগরীর সকল আগমন, সকল গমন এ সাতমাথাকে কেন্দ্র করে। একদা একটা সকালের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকি। সূর্য এ নগরে এখনো আসে, আর সকাল তৈরী হয় সে আলোয়। সকালের ভেতর কতো যে দৃশ্য তৈরী হয়ে গেছে। কতো কতো যে মানুষ। দৃশ্য জলের ঢেউয়ের মতো। দৃশ্য তৈরী হচ্ছে, দৃশ্য ভেঙ্গে যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষ নগরের বাইরে যাবার চেষ্টা করছে, নগরে প্রবেশের চেষ্টা করছে। আমি এতো সব দৃশ্যের ভেতর থেকে একটা দৃশ্যের ভেতর পরিপূর্ণভাবে প্রবেশের চেষ্টা করি। সাতমাথার একমাথায় একজন বৃদ্ধ লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে। হাতে লাঠি যা বৃদ্ধ বয়সের আত্মীয়। আমি তার কাছে যাই। আমি তার দিকে তাকাই। তার মুখের অভিব্যক্তিতে এক ধরণের সমস্যা। সে জানায় তার টুপি হারিয়ে গেছে। আমি তার পোশাকের দিকে ভালো করে তাকাই। পরণের লুঙ্গিটা উঁচু করে পরা। গায়ে আধা ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জি। লাঠিটার রং কালো। সে তার হারানো টুপিটা খুঁজছে এই সাতমাথায়। টুপি না পাওয়া পর্যন্ত সে তার স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে যেতে পারছে না। তাকে আমি আরো কিছু প্রশ্ন করার চেষ্টা করি আমার কাছে তাকে আরো পরিচিত করার জন্য। সে টুপি প্রশ্নের বাইরে যেতে পারে না। দেখি সে হারানো টুপি বিষয়ের বাইরে যাবে না। তার সকল গতি এখন স্থগিত হয়ে গেছে। টুপি যেন তার কাছে একমাত্র পরিচয়। পরিচয় সংকটে ভুগছে সে। আমি তার অভ্যন্তরে, বলা ভালো এই বৃদ্ধ দৃশ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ না করতে পারলে কল্পনার আশ্রয় নিই। তাকে, বৃদ্ধকে, নিয়ে যাই অতীতে। সে হয়তো গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। ধর্মীয় ভ্রমণে বা নগরে আত্মীয় থাকার কারণে এ নগরে প্রবেশ করেছে। তার প্রাক্তন সংসারে তার ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলে সংসারের ভেতর সে আর প্রবেশ করতে পারছে না। মাথায় টুপি লাগিয়ে সে চেষ্টা করছে প্রবেশ করতে অন্য কোনো অবস্থানে। অতঃপর বৃদ্ধকে নিয়ে যাই ভবিষ্যতে, তার কোনো নির্ভরযোগ্য আশ্রয় নাই। টুপি মাথায় দিয়ে যাবে যে নতুন আশ্রয়ে। তাকে ভাবি ধর্মীয় পরিচয়ে, সামাজিক পরিচয়ে, সাংস্কৃতিক পরিচয়ে, রাজনৈতিক পরিচয়ে। ভাবনা কতো কতো দিকে যে যায়। তার ভেতর আবিষ্কার করি জীবনের কিংবা গল্পের অজস্র সম্ভাবনা। তার ভেতর পুরো বাংলাদেশ চলে আসে। চলে আসে গ্রাম, নগর, নিসর্গ, মানুষের ইতিহাস। তার ভেতরে অজস্র মানুষ আবিষ্কার করি। রূপকের সাহায্যে, প্রতীকের সাহায্যে তার টুপি হারানোকে ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছা হয়। এভাবে এক সময় দেখি আমি নিজেই রূপান্তরিত হয়ে গেছি ঐ বৃদ্ধ ব্যক্তিটিতে। যে আমি নিজেই টুপি হারিয়ে ফেলেছি কবে কোথায় জানি না। টুপির সন্ধানে আমি। আমি থেকে দেখি পুরো বাংলাদেশ টুপি খুঁজছে। টুপিটা মূর্ত থেকে বিমূর্ত হয়ে যায়। না দেখা টুপিটা হয়ে যায় কতো কিছুর প্রতীক। এক সময় টুপিটাকে মনে হয় আমার অথবা আমাদের সকলের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়ের প্রতীক। আমরা বুদ্ধির সাহায্যে আমাদের পরিচয় খুঁজে পাচ্ছি না। নানা রাস্তায় টুপি খুঁজে ফিরছি। আর টুপি না পেলে প্রতি সকালে সাতমাথায় টুপি খুঁজতে যেতে হবে। আর কোনো সূর্যোদয়ই আমাকে গন্তব্যে নিয়ে যাবে না। বৃদ্ধের দিকে আর তাকাই না। এই এক দৃশ্যেই আমার চিন্তা খাবি খায়। আমি এই দৃশ্যের সম্ভাবনা ও বিশালত্ব দেখে হতবাক হয়ে যাই। আর দেখি কিভাবে বাস্তব হয়ে যায় অবাস্তব এবং এই অবাস্তব হয়ে যায় বড় বাস্তব। বুঝি এক সকালের এতো সব দৃশ্য, এতো সব গল্প যে কাউকেই চিরকাল ভাবানোর ক্ষমতা রাখে। এক সকালের ভেতর কতো অতীত, কতো বর্তমান, কতো ভবিষ্যত আলো ছড়াচ্ছে, অন্ধকার ছড়াচ্ছে। তখন আবারো ভাবি কী নিয়ে গল্প? মানুষ যা বলছে সারাক্ষণ তা নিয়ে, নাকি মানুষ যা করছে সারাক্ষণ তা নিয়ে অথবা মানুষ যা বলছে ও করছে সারাক্ষণ তা নিয়ে। অথবা মানুষের না-বলা কথা ও না-বলা কাজ নিয়ে গল্প। উত্তর হয়তো এ রকম—মানুষ যা বলছে, মানুষ যা করছে, মানুষ যা বলতে পারছে না, করতে পারছে না—সব নিয়েই গল্প। বাস্তব নিয়ে গল্প, অবাস্তব নিয়ে গল্প। একথা তো ঠিক যে শিল্প মানুষের জীবনের পরিধি বাড়িয়ে দেয়। আদিকাল থেকে মানুষের আয়তনকে বাড়িয়ে দেবার কাজ করছে শিল্প। আর গল্প তো জীবনকে সব সময় সম্প্রসারিত করে। গল্প বলার, গল্প লেখার অনেকগুলো কারণের একটা প্রধান কারণ এই বোধ হয় একজন গল্পকার মানুষের পরিচয় সন্ধানে যান নানা ভঙ্গিতে। ছোট গল্প জীবনের অজস্র দৃশ্য থেকে একটা দৃশ্যে যায়। একটা দৃশ্যের ভেতর গল্পকার দেখে জীবনের সকল দৃশ্য। ঐ বৃদ্ধ আমার চিন্তায় এসে আরেকটি প্রশ্ন হয়, আরেকটি উত্তর হয়। এই বৃদ্ধ মানুষটি সাতমাথার বাইরে মানসিকভাবে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। তখন মনে হয় মানুষের অবস্থান নির্ণয় করতে গিয়ে একজন গল্পকার সংকটে পড়ে যাচ্ছে। নানামুখী সংকটের ভেতর বড় সংকট এই যে আজকের যে চরিত্রটিকে সে তার গল্পে হাজির করতে চায় মানসিকভাবে সে দাঁড়িয়ে আছে কোন মাথায়। সে কি দাঁড়িয়ে আছে গ্রামে, নগরে; মাঠে, বাজারে; বর্তমানে, অতীতে; মানুষের পক্ষে, মানুষের বিপক্ষে; ধর্মে, অধর্মে; রাজনীতিতে, অরাজনীতিতে- আরো নানাবিধ দ্বান্দ্বিক অবস্থানে। আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি মোটা দাগের এ সকল বিভাজন অবলুপ্ত হয়ে গেছে। একই সাথে একজন ব্যক্তি নানা অবস্থানে পতাকা ওড়াচ্ছে। এক সময় অথবা এখনো গল্প আলোচনায় অনেক ভাগের একটা ভাগ করি গল্পের সেটিং এর বিষয়ে—গল্প সে গ্রামীণ জীবনের অথবা নগর জীবনের। কিন্তু বিষয়টির গভীরে গেলে দেখি গ্রাম ও নগরের বিভাজন রেখার বেশীর ভাগটুকুই লুপ্ত হয়ে গেছে। নগর গ্রামকে গিলে খেয়েছে আক্ষরিক অর্থেই। এই সত্য এখন খুব ঠিক যে গ্রামে বা নগরে যেখানেই অবস্থান করুক না কেনো মানসিক দিক দিয়ে এখন সকলেই নাগরিক চেতনার অধিকারী। স্যাটেলাইট টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, রাজনীতি, ইন্টারনেট, যৌনতা ব্যবহারে গ্রামের সঙ্গে নগরের কতটুকুই বা প্রভেদ। তাই দেখি আজকে আমাদের সকল মানুষই কম-বেশী নাগরিক চেতনায় জীবন উদযাপন করছে। একজন গল্পকারের কাছে আজকের মানুষের পরিচয় গ্রামীণ বা নাগরিক বিভাজনে নয়। স্থানিক বৈশিষ্ট্য ব্যক্তির কাছে মুখ্য হচ্ছে না তার পরিচয় প্রকাশে। একজন অথবা সকল মানুষের কাছে নগর একটা বাস্তবতা, মূর্তে অথবা বিমূর্তে। আর গ্রাম একটা কাব্যিক কনসেপ্ট এর নাম। যে কনসেপ্ট বাস্তবতায় অতীত কিংবা ভগ্ন বাস্তব। এই নতুন স্থানিক বাস্তবতা এবং আরো নানাবিধ বাস্তবতা গল্পে ধারণ করতে হলে গল্প লেখার কৌশল তো নতুন হতে হবে। আর একজন গল্পকারের বিষয় ধারণা অর্জন করার পরপরই আবিষ্কার করতে হয় ঐ বিষয়টাকে গল্পে ধারণ করার শিল্প কৌশল।
নিজস্ব পোশাক
এই কথা ঠিক যে প্রতিটি শিল্পকর্ম শিল্পীর জীবনদর্শন, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। মূলত শিল্পী তার জীবনদর্শন, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিটি অন্যের সামনে উপস্থাপন করার জন্যই শিল্পটি সৃষ্টি করেন। আর সেটি করতে গিয়েই তার প্রয়োজন হয় শিল্প কৌশল। শিল্প কৌশল শিল্প সৃষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গ্রীক নাটকের বিষয়বস্তু আগেই জানা থাকতো দর্শকদের। তবুও দর্শকেরা যেত সে নাটক দেখতে। তার কারণ তারা সেখানে যেত নাট্যকারের সে বিষয়টির ট্রিটমেন্ট দেবার শিল্পকৌশল দেখতে। শেক্সপিয়ারের নাটকের একটা দু’টা ছাড়া সকল প্লটই ধার করা। অন্য নাট্যকারদের সঙ্গে তার সকল পার্থক্য ঘটে গেছে বিষয় উপস্থাপনার শিল্প কৌশল ও ট্রিটমেন্টে। নতুন গল্প লেখা যাবে অথবা যাবে না এ বিতর্ক মহাভারতের মতো চিরজীবি হোক। কিন্তু নতুন দর্শন, নতুন জীবনদৃষ্টি, নতুন কন্ঠস্বর গল্পে যে কালে কালে প্রদান করা সম্ভব তা নিয়ে বিতর্কে যাবে কোন অর্বাচীন। আর নতুন সময়ে জীবনকে নতুন করে দেখা ও নতুন করে উপস্থাপন করার ভেতর দিয়ে নতুন গল্প তৈরী হয়। আর এই নতুন গল্প সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক গল্পের শিল্পকৌশল। প্রতিটি যুগ দাবী করে তাকে উপস্থাপন করা হোক ব্যাখ্যা করা হোক নতুন করে। তাই প্রতিটি যুগের প্রয়োজন হয় নতুন গল্পকারের। পুরাতন চেতনার গল্পকারেরা পারেন না নতুন যুগের গল্প লিখতে। সঙ্গে এই কথা ঠিক যে পুরাতন শিল্প কৌশল দিয়ে নতুন যুগের গল্প লেখাও যায় না।
বাস্তব-অবাস্তবের সীমারেখা
যখন একজন মানুষের দিকে তাকাই, তখন তার ভেতর অনেক রকমের বাস্তবতা দেখি। কিছু মূর্ত বাস্তবতা কিছু বিমূর্ত বাস্তবতা। যে বৃদ্ধকে সাতমাথায় দেখি টুপি হারিয়ে পরিচয়হীন হয়ে পড়েছে, অতীতহীন হয়ে পড়েছে, বর্তমানহীন হয়ে পড়েছে, ভবিষ্যতহীন হয়ে পড়েছে; তার এই মূর্ত অসহায় অবস্থার বাইরে আরো আরো বাস্তবতা আছে, যেগুলো বিমূর্ত। আর সে সকল বাস্তবতা আপাতভাবে উদ্ভট মনে হতে পারে। প্রতিটি মানুষ তার মনোজাগতিক বাস্তবতায়, কল্পজাগতিক বাস্তবতায় অসংখ্য অবাস্তব বিষয় নিয়ে বাস করেন যে সকল অবাস্তবতার তেমন ব্যাখ্যা তার কাছে নাই। কিন্তু ব্যক্তি জানে সে সকল মনোজাগতিক, কল্পজাগতিক অবাস্তবতা, উদ্ভটতা ছাড়া সে চলতে পারবে না, বাঁচতে পারবে না। অনেক সময় প্রতিকূল সামাজিক অবস্থানে দৃশ্যমান বাস্তবতার চাইতে ব্যক্তির মনোজাগতিক, কল্পজাগতিক বাস্তবতা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, জীবিকা যখন ক্রমশ একজন ব্যক্তির ব্যক্তিজীবনকে শৃংখলিত করে ফেলছে তখন তার মনোজাগতিক ও কল্পজাগতিক বাস্তবতা অ্যাবসার্ড হতে বাধ্য। আর একজন গল্পকার তাকে নিয়ে গল্প লিখতে গিয়ে দৃশ্যমান বাস্তবতার সাহায্যে ব্যক্তির, সমাজের, রাষ্ট্রের চরিত্র প্রকাশ করতে পারছেন না। একজন গল্পকার এ সকল মনোজাগতিক ও কল্পজাগতিক বাস্তবতাকে প্রকাশ করতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন রূপকের, প্রতীকের। সে রূপক, প্রতীক অনেক ক্ষেত্রেই প্রথাবদ্ধ নয়। এর ফলে গল্পে জীবন প্রকাশের সীমানা বেড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে একথা তো ঠিক যে একজন গল্পকার কেবল দৃশ্যমান বাস্তবতাকেই হাজির করেন না গল্পে, অদৃশ্যমান অসংখ্য বাস্তবতা থাকে তার গল্পে। আর এ অদৃশ্যমান বাস্তবতাকে অনেক সময় আপাতভাবে অবাস্তব মনে হতে পারে। একজন গল্পকার সর্বদাই বাস্তবতা ও জীবনের পরিধি বাড়িয়ে দেন, বাস্তবতা ও জীবনের সম্ভাব্যতা বাড়িয়ে দেন।
রূপকথা টিকে আছে। রূপকথার ফ্যান্টাসির খুব বেশি ব্যাখ্যা হয়নি আমাদের দেশে। রূপকথা যদি রূপকের আড়ালে কথা হয় তবে দেখি তা উদ্ভট নয়। তার আছে নিজস্ব যুক্তি শৃংখল, তার আছে এক বা একাধিক বাস্তবতা। গুহাযুগের প্রথম মানুষটি যখন কোনো নারীকে বলেছিলো নারীটি দেখতে লাল গোলাপের মতো তখন তার মতো উদ্ভট কথা আর কে-বা সৃজন করেছিল। অথচ সে কথা আজ অতি স্বাভাবিক, ক্লিশে। আজকে লাতিন আমেরিকার কুহকী বাস্তবতা বা যাদুবাস্তবতা গল্পে বাস্তবতার সীমানা বাড়িয়ে দিলে আমরা কখনো তা পড়ে বিভ্রান্ত, কখনো মুগ্ধ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হতাশ। বুঝি অসহায় হয়ে যাচ্ছি এসব গল্প পড়ে। নাগাল পাচ্ছি না, তল পাচ্ছি না এসব গল্পের বক্তব্যের, উদ্যেশ্যের। তারপর শুধু ভালবাসার অনুকরণবোধে, ভালবাসা বোধে থেমে থাকি। বুঝি না এই ভালবাসার ভেতর কোন যুক্তি কিভাবে কোথায় আছে। অথবা আমরা আমাদের শহিদুল জহিরের বেশির ভাগ গল্পের কাছে হতাশ হই তাকে যুক্তি দিয়ে ধরতে পারি না বলে, পড়তে পারি না বলে। যে বাস্তবতা তার গল্পে আছে তার বেশিটুকুর ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। তাই নতুন গল্পের, নতুন বাস্তবতার নতুন ব্যাখ্যা জানা জরুরী। নতুন গল্প যেমন একদিনে হয় না, তেমনি সে নতুন গল্পের ব্যাখ্যা-কাঠামোও একদিনে দাঁড়ায় না। অনেকের হাতে কিংবা একজন শক্তিশালী, উচ্চ কল্পনাশক্তিসম্পন্ন সমালোচকের হাতে সে সব নতুন গল্পের ব্যাখ্যা কাঠামো তৈরি হয়। তৈরি হয় নতুন গল্পের, নতুন ব্যাখ্যার নতুন নন্দনতত্ত্ব।
পুনরাবৃত্তি : যথা-অযথা
এই কথা খুব ঠিক যে গল্প ভাবনা অনুযায়ী বেশিরভাগ লেখক গল্প লিখতে পারেন না। যারা ভালো গল্প লেখেন, তার চেয়ে যারা গল্প লেখেন না, কিংবা যারা গল্প সমালোচক, তাদের গল্প ভাবনা ভালো হতে পারে। যারা ম্যানিফেস্টো দিয়ে কবিতা, গল্প বা উপন্যাস লিখতে আসেন, তাদের সে ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে তাদের লেখার থাকে বিস্তর ব্যবধান। এমন অনেক লেখক আছেন, যারা ভালো সাক্ষাৎকার দেন, ভালো তত্ত্ব দেন, ভালো আলোচনা করেন, অথচ লেখায় তাদের দীনতা প্রকাশ পায়। আর এটাও ঠিক যে গল্প ভাবনায় বা কবিতা ভাবনায় একজন গল্পকার বা কবি তার গল্প বা কবিতা লেখার আকাঙ্ক্ষা বা আদর্শকে তুলে ধরেন। লিখতে গিয়ে তিনি দেখেন যা তিনি ভাবেন বা বলেন লেখা দিয়ে তা করে দেখানোর সক্ষমতা তার নাই।
প্রযুক্তি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি প্রতিদিন যে পরিমাণ নাটকীয়তা ও টুইস্ট নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় যে পাঠক গল্পের নাটকীয়তায় ও টুইস্টে তেমন মুগ্ধ হয় বা চমকে যায় বলে মনে হয় না। গল্পের কাজ পাঠকের অনুভবের, চিন্তার, অভিজ্ঞতার সীমানা বাড়িয়ে দেয়া। একটা ভালো গল্প পাঠককে খনন করে।
একটা স্থুল উদাহরণ এমন যে, বেশির ভাগ ব্যবসায়ী বা মানুষ তাদের পণ্য পরিবহনের জন্য অন্যের যানবাহন ভাড়া করেন; তেমনি বেশিরভাগ লেখক তাদের গল্পটা বলেন অন্যের ভাষা ও টেকনিক ধার করে। নিজের ভাষা ও টেকনিক নির্মাণ করতে পারেন না।
যখন দেখি একজন গল্পকার দশটা গল্প লিখছেন দশ রকম ভাষায়, তখন মনে হয় তার নিজস্ব কোনো ভাষা তৈরি হয়নি। ধূসর পান্ডুলিপি থেকে জীবনানন্দের ভাষা তেমন বদলায়নি। এরকম উদাহরণ আরো দেয়া যায়। নিজস্ব ভাষা, স্বর তৈরি হলে মনে হয় না তার আর বদলানোর দরকার আছে।
যে কোনো শিল্পে, যে কোনো সৌন্দর্যে না বোঝার বিষয় খানিকটা থাকলে তার শিল্পগুণ, সৌন্দর্যগুণ বেড়ে যায়। কেউ সেটার নাম দিতে পারে রহস্য বা ভিন্ন কিছু। গল্পের ভেতর যে গল্পটুকু বুঝি সেটুকু ছাড়া না বোঝা কিছু তো থাকা উচিত। আর না বোঝাটুকুর জন্য একটা গল্পের নিকট একাধিকবার যাই। অনেক কাল জীবিত থাকা গল্প সবটুকু কখনো বুঝি না।
আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন অন্তহীন তথ্য আমাদেরকে ক্লান্ত করে দিচ্ছে, বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। গল্প যদি এরকম তথ্য হাজির করে সেটাও ক্লান্তিকর মনে হয়। গল্পের তথ্য হতে পারে চেহারার বর্ণনা, পোশাকের বর্ণনা, প্রকৃতির বর্ণনা এরকম নানান কিছু।
এটা খুব ঠিক যে শুধু প্রয়োজনীয় বাক্যগুলো দিয়ে কোনো একটা গল্প লিখতে পারা দারুণ ব্যাপার। যেখানে প্রতিটি শব্দ গল্পের সম্পত্তির ভাগ পায়। কিন্তু এ পর্যন্ত শুধু আমাদের নয়, সারা দুনিয়ায় গল্পেই অপ্রয়োজনীয় শব্দ প্রয়োজনীয় শব্দের চেয়ে বেশি। আর এটাও ঠিক কিছু অপ্রয়োজনীয় শব্দ, বাক্য ছাড়া প্রয়োজনীয় শব্দ ও বাক্যে দাঁড়াতে পারে না। বেশিরভাগ গল্প, যা তিন পাতায় বলা যায় তা হয়তো বলা হয় তিরিশ পাতায়। পাঠক চায় যে কোনো শিল্প, গল্প হোক অনিঃশেষ। আয়তনে নয়; আবেগে, চিন্তায়, অভিজ্ঞতায়। রবীন্দ্রনাথের ৭/৮ লাইনের অনেক গান সারাজীবন শুনেও শেষ করা যায় না।
গল্প : আমাদের গ্রামটা বিক্রি হয়ে গেল
যখন আমরা চাঁদে যাবার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখনি আমাদের গ্রামটা বিক্রি হয়ে গেল। এটা প্রথম কে জানল। জানল এক বুড়ি, যে তার ছোট নাতনীকে আমাদের গ্রামের গল্পটা বলছিল। সে গ্রামের ভেতর ছিল, গ্রামের গল্পের ভেতর ছিল। কিন্তু হঠাৎ সে খেয়াল করল গ্রাম থেকে তাকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে, যেভাবে কাউকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় টিকেট না কাটার জন্য। সে বুঝতে পারে না কেন তাকে গ্রাম থেকে, গ্রামের গল্প থেকে নামিয়ে দেয়া হল। গ্রাম থেকে নামিয়ে দেবার পর, গল্প থেকে নামিয়ে দেবার পর সে দেখল সে তার নাতনীকে গ্রামের গল্পটা বলতে পারছে না। গল্পটা তখনো অসম্পূর্ণ ছিল। যদিও সে জানে কোনো গল্পই শেষ করা যায় না কেয়ামতের আগে কিংবা পরে। তার নাতনীটা তাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে গল্পটা চালিয়ে যেতে বলে। কিন্তু সে গল্পটা চালিয়ে যাবে কিভাবে যখন তাকে গ্রাম থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। সে তার নাতনীকে বলে এ গল্প এখন তার আয়ত্বে নাই। তার বাস্তবতার আয়ত্বে নাই, তার বসবাসের আয়ত্বে নাই, তার স্বপ্নের আয়ত্বে নাই, তার কল্পনার আয়ত্বে নাই। তবে সে কিভাবে তাকে শোনায় এ গল্প। সে তার নাতনীকে বলে ঘুমিয়ে পড়ুক সে গ্রামের বাইরে, গল্পের বাইরে। যদি এ রকম হয় কখনো, ঘুমের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করা যায় সে গ্রামে। ঘুম কি কখনো টিকেট হতে পারে গ্রামে যাবার। জানে না বুড়ি, জানে না নাতনী।
বুড়ির গ্রাম বিক্রি হয়ে যাবার অনুভবটা আমরা তার পরদিন অনুভব করি। আমরা অনুভব করি সকালে রুটি খেতে গিয়ে এইভাবে যে, রুটিতে স্বাদ পাচ্ছি না। রুটি খাবার সময় আমরা বেশি করে আলু ভাজি নিই। কিন্তু এরপরও দেখি আলু ভাজিরও স্বাদ নাই। আমরা আমাদের তরকারীতে বেশি করে লবণ, মরিচ দিয়ে রুটি খেতে গিয়ে দেখি তাতেও স্বাদ লাগে না। আমরা ভাত খেতে গিয়েও দেখি তাতেও স্বাদ নাই। আমরা আমাদের মাকে মা ডাকি, বাবাকে বাবা ডাকি, ভাইকে ভাই ডাকি, বোনকে বোন ডাকি। কি কথা, কি আশ্চর্য কথা এই যে, মা’তে স্বাদ নাই, বাবাতে স্বাদ নাই, ভাইতে স্বাদ নাই, বোনে স্বাদ নাই। মা-বাবা, ভাই-বোনের স্বাদ কেমন ছিল তা স্মরণ করার চেষ্টা করি। একটা বাতি রাতের ভেতর। চারপাশে মা-বাবা, ভাই-বোন। বাতির আলো থেকে নরম আলো আমাদের শরীরে পড়ে। মা চুপ, বাবা চুপ, ভাই চুপ, বোন চুপ। এই নীরবতা নদীর মতো আমাদের সবাইকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার সমুদ্রে। যে সমুদ্রে গেলে জানি আমরা একটা একক অন্ধকার। সে অন্ধকার কি ভীষণ আনন্দের, কি ভীষণ অনিঃশেষ। এই স্মৃতিকে মনে হয় স্বাদ।
এরপর স্বাদ আর কিসে কিসে নাই তা জানার চেষ্টা করি। ঘুমের ভেতর যাই, ঘুমে স্বাদ নাই। জাগরণের ভেতর যাই, জাগরণে স্বাদ নাই।
স্বাদ হারিয়ে আমরা এতিম হয়ে পড়ি। আমাদের মনে হয় আমরা আমাদের সকল পথ হারিয়ে ফেলেছি। সকালের পথ, দুপুরের পথ, বিকেলের পথ, সন্ধ্যার পথ, রাতের পথ আমাদের দৃষ্টির, আমাদের স্বাদের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু পথ ছাড়া আমরা চলি কিভাবে। যখন আমাদের পা দাবি করে পথ, যখন আমাদের জীবিকা দাবি করে পথ, যখন আমাদের শরীর দাবি করে পথ। পায়ের কথা বললে মনে হয় প্যারালাইসিস হয়ে যাবার কথা—যেন আমরা প্যারালাইসিস রুগী। জীবিকার কথা বললে মনে হয় যেনো রাস্তার ধারে দাঁড়ানো শ্রমিক। শরীরের কথা বললে মনে হয় কাপড় হারানো কেউ দু’হাত দিয়ে পরিচয় ঢাকছে।
এভাবে স্বাদহীন কিছু দিন যায়। এভাবে স্বাদহীন কিছু রাত যায়। এভাবে স্বাদহীন যেন চিরদিন যায়। চিরদিনের ভেতর একদিন হঠাৎ দেখি আমাদের গ্রামের রাস্তায় কয়েকটা বড় গাড়ি। তাহলে তো আমাদের গ্রামে যাবার এখনো সকল পথ হারিয়ে যায়নি। অথবা এ রকম হতে পারে গ্রামের সকল পথ, সকল স্বাদ এ সকল গাড়ি দখল করে নিয়েছে।
এরপর আমরা গাড়ির নিকটে গিয়ে জানতে পারি আমাদের গ্রাম কে কিনে নিয়েছে। কে বিক্রি করে দিয়েছে। পুরো গ্রাম যে কিনেছে তার নাম জান্নাতুল ফেরদৌস। নাম শুনে বোঝা যায় না সে কি মেয়ে অথবা ছেলে। আর এই কথা জানা হয় গ্রামটা বেচেছি আমরা সবাই।
একবার তো খুব খরা। আমাদের আহার কোথায়। যাও গ্রাম যাও আহারের কাছে। একবার তো বন্যা। যাও গ্রাম যাও আহারের কাছে। একবার তো আমাদের মেয়েদের বিয়ের যৌতুক। যাও গ্রাম যাও যৌতুকের কাছে। একবার আমাদের দারুণ অসুখ। যাও গ্রাম যাও অসুখের কাছে। তারপর আমাদের গ্রাম খরার নিকটে গেলে, বন্যার নিকটে গেলে, যৌতুকের নিকটে গেলে, অসুখের নিকটে গেলে কি লাভ গ্রামকে ভাই বলে ডেকে, বোন বলে ডেকে। গ্রাম ফেরে না ভাই হয়ে, বোন হয়ে। আমাদের গ্রাম ভাই হয় অন্য কারো, বোন হয়ে অন্য কারো।
জান্নাতুল ফেরদৌস, যে আমাদের গ্রাম কিনেছে, পরিচয় হয় তার কথার নিচে বসে। সে এতো উপর থেকে কথা বলে যে মনে হয় পাহাড়ের চুড়ায় বসে আছে সে। পাহাড় যেন সিংহাসন। সে বসে আছে গ্রামের পাহাড়ের সিংহাসনে। আমাদের গ্রামে যে পাহাড় ছিল তা গ্রাম বিক্রি হয়ে যাবার আগে জানিনি। অবশ্য এই কথা খুব ঠিক যে গ্রাম আবিষ্কার হয় গ্রাম বিক্রি হয়ে যাবার পর। মানুষ আবিষ্কৃত হয় মানুষ বিক্রি হয়ে যাবার পর। জীবন আবিষ্কৃত হয় মৃত্যুর পর। এসব পুরাতন প্রবাদ। যা লেখা আছে অথবা লেখা নাই, উক্ত আছে অথবা উক্ত নাই দ্য বুক অফ ডেড-এ।
জান্নাতুল ফেরদৌস আসলে একজন পুরুষ। পুরুষ ছাড়া কারো গ্রাম কেনার শখ থাকে না। সে জানায় তার জীবনী। আত্মজীবনী। সে প্রথমে কবি ছিল। আমাদের গ্রাম নিয়ে সে লিখেছে অনেক কবিতা। গ্রামপ্রেম নিয়ে তার মতো কবিতা আর কেউ লেখেনি। সে জানায় সে কবিতার সাহায্যে পুরো গ্রামকে ভালোবাসতে চেয়েছে, দখল করতে চেয়েছে। দখল না করতে পারলে কাউকে ভালোবাসা যায় না পুরোপুরি। গ্রামের সকল কিছু নিয়ে তার কবিতা আছে। এই যে এ গ্রামের একটা ব্যাঙ, এই গ্রামের এক ফোঁটা শিশির, সবই তার কবিতায় জমা আছে। এক সময় সে বোঝে শুধু কবিতা দিয়ে এ গ্রামকে সে দখল করতে পারছে না, আয়ত্বে আনতে পারছে না। তখন সে গ্রাম দখলের আধুনিক পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করে। গ্রাম দখলের আধুনিক পদ্ধতি গ্রাম উন্নয়ন হলে সে গ্রাম দখলের জন্য, গ্রাম আয়ত্বের জন্য, গ্রামের উন্নতির জন্য খুলে ফেলে একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা। তার মনে আসে গ্রামের ধনী লোকেরা দরিদ্র মানুষদেরকে টাকা দিয়ে তাদের সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে করতো। এই পদ্ধতি তার কাছে খুবই আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত মনে হয়। সে আমাদের সঙ্গে এসব কথা বলতে বলতে আমাদেরকে নিয়ে আমাদের বিক্রি করে দেয়া ও তার কেনা গ্রামে প্রবেশ করে।
গ্রামে আগে গেট ছিল না। এখন গ্রামে গেট হয়েছে। গ্রাম যেন এখন একটা বৃহৎ কক্ষ। যার গেট আছে। জানালা আছে। গ্রামে প্রবেশ করেই প্রথমেই আমাদেরকে সে জানায় গ্রামে আজ থেকে শুরু হয়েছে সাতদিনব্যাপী মেলা। গ্রামের নানান জায়গায় নানা রকম মেলা বসেছে।
কতো রকম যে মেলা। একটা ব্যানারে গ্রামের নতুন গেটে সে সকল মেলার নাম লেখা। নাম পরিবর্তন মেলা, পাখি মেলা, প্রজাপতি মেলা, মৎস মেলা, বৃক্ষ মেলা, শস্যবীজ মেলা, কৃষক মেলা, লাঙল মেলা, চন্দ্রমেলা, হত্যা মেলা, সমাধি মেলা- আরো কতো কতো মেলা হাঁটতে হাঁটতে, গুনতে গুনতে, দেখতে দেখতে, জানি সে সব মেলা।
প্রথমে যে মেলায় প্রবেশ করি তার নাম, নাম পরিবর্তন মেলা। অনেকগুলো স্টল এ মেলায়। গ্রামের সকল কিছুর নাম যে বদলে দেয়া হয়েছে তা জানি এ মেলা থেকে। আমাদের গ্রামের নাম বদলে দেয়া হয়েছে। এ গ্রামের নাম এখন জান্নাতুল ফেরদৌস। আমরা এখন মনে করতে পারছি না আমাদের গ্রামের নাম কি ছিল। এ মেলা আয়োজনের দায়িত্ব যাদের উপরে ন্যস্ত তারা জানায় গ্রামটা কেনার পর জান্নাতুল ফেরদৌস নিজের নামে এ গ্রামের নামকরণ করেছে। সে তো কবি। নামকরণ বিষয়ে তার কবিতা পড়ি। কবিতায় সে জানিয়েছে গ্রামের প্রতিটি বিষয়ের ছিল ভুল নামকরণ। শুদ্ধ করার জন্য তার রয়েছে বিশাল আয়োজন। সে চায় গ্রামের পুরাতন সকল নাম বদলে যাক। গ্রামের সে সকল পুরাতন নামের ভেতর ভুল ছিল, পাপ ছিল। গ্রামের সকল কিছুর নাম বদলানোর মাধ্যমে সে গ্রামকে ভুলমুক্ত, পাপমুক্ত করতে চায়। গ্রাম উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ গ্রামের নাম বদলে দেয়া। আমরা তার কবিতা থেকে জানতে পারি তার মতো গ্রামকে আর কেউ ভালোবাসেনি। সে পৃথিবীর নানা অঞ্চলের নানা ভাষার ভালোবাসার কবিতা পড়েছে গ্রামকে ভালোবাসার জন্য। পৃথিবীর নানান প্রতিষ্ঠান তাকে অর্থ দিয়েছে গ্রামকে ভালোবাসার জন্য, গ্রামের উন্নয়নের জন্য। স্টলের লোকজন জানায় গ্রামের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসার জন্যই তার নামেই গ্রামের নামকরন জান্নাতুল ফেরদৌস। তারা পুনরাবৃত্তি করে এই বলে যে, এ গ্রামের মালিক জান্নাতুল ফেরদৌস। তার নামেই গ্রামের নাম। সে, অর্থাৎ জান্নাতুল ফেরদৌস কখনো স্যান্ডেল বা জুতা পায়ে দিয়ে গ্রামের উপর দিয়ে হাঁটে না। তার পায়ের ছাপ আছে এ গ্রামের সকল মাটিতে। তার সকল কবিতাতেও আছে এ গ্রামের মাটির ছাপ। তার প্রিয় গন্ধের নাম মাটি গন্ধ। মাটিকে সে সময় আমাদের ফুল বলে মনে হয়। সে যে মাটিকে ফুল বলে ভাবতে পেরেছে, গ্রহণ করতে পেরেছে তার তুলনা কোথায়। তার মতো আর কে এমন করে মাটিকে ভালোবাসতে পারে তা ভাবতে ভাবতে জুতা পায়ে দিয়ে, স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাই। আমরা জানি আমরা কখনো স্যান্ডেল বা জুতা খুলে হাঁটতে পারবো না এ গ্রামের মাটির উপর দিয়ে। কারণ লেখা চোখে পড়ে পথের এক পাশে, জান্নাতুল ফেরদৌস ব্যতীত কেউ জুতা স্যান্ডেল খুলে এ গ্রামে হাঁটতে পারবে না। কারণ আরো এই যে আমরা এ গ্রামকে বিক্রি করে দিয়েছি জানা পথে, অজানা পথে, পয়সায়, বিনা পয়সায়। এখন আমাদের সঙ্গে আমাদের গ্রামের সম্পর্ক, গ্রামের দূরত্ব জুতা ও স্যান্ডেলের। পায়ে জুতা-স্যান্ডেল থাকলে আমরা হাঁটতে হাঁটতে কখনো যেতে পারবো না আমাদের বিক্রি হয়ে যাওয়া গ্রামে। পায়ের তলায় বিক্রি হয়ে যাওয়া গ্রাম। আমরা হাঁটতে হাঁটতে, দৌড়াতে দৌড়াতে যতো দূরেই যাই গ্রাম পাবো না, গ্রামের মাটি পাবো না। এ সময় একথা মনে হয়, আমরা কি তবে গ্রাম বেচে কিনেছিলাম জুতা কিংবা স্যান্ডেল।
আমরা আসি প্রজাপতি মেলায়। নানা রকম বিদেশী গ্রামের প্রজাপতি মেলা চলছে। প্রজাপতিগুলোকে রাখা হয়েছে কাঁচের বড় বড় খাঁচায়। এ রকম বড় বড় প্রজাপতি কখনো দেখিনি আমরা। আমাদের স্মৃতির ভেতর যে সব প্রজাপতি ছিল তা এখন মৃত, সমাধিস্থ। কয়েকটা শিশু এ প্রজাপতি মেলা তত্ত্বাবধান করছে। শিশুরা বলে তাদের সামনে রাখা ক্যাটালগ দেখে, এ সকল প্রজাপতি বিদেশী ঝোপঝাড় থেকে আনা হয়েছে গ্রামের প্রজাপতি উন্নয়নের জন্য। এ সকল প্রজাপতির একটা বৈশিষ্ট্য এই যে তারা মিনিটে মিনিটে রং বদলায়। আমরা এতো সব বিস্ময়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। শিশুরা বলে প্রজাপতি নিয়ে তারা গান জানে। তারা প্রজাপতি নিয়ে গান গায়। আমরা কখনো প্রজাপতি নিয়ে এমন গান শুনিনি। এ গানে আছে প্রজাপতির শারীরিক বৃদ্ধির অনুপম ইতিহাস। কিভাবে প্রজাপতি এতো বড় শরীর পেলো তার বর্ণনা। গানের শেষের চরণে আছে গীতিকারের নাম। গীতিকারের নাম জান্নাতুল ফেরদৌস। আমরা শিশুগুলোকে জিজ্ঞেস করি তারা প্রজাপতি বিষয়ক গান ছাড়া আর কোনো গান জানে কি-না। তারা বলে গানের গ্রাম, প্রাণের গ্রাম জান্নাতুল ফেরদৌস গ্রাম। তারা অনেক গান জানে। তারা বলে গানের ভেতর কতো বিদেশী কথা, কতো বিদেশী সুর কতো বিদেশী পাখী, কতো বিদেশী ফুল ও ফুলের যে গন্ধ আছে তার ইয়ত্তা নাই। তারা জানায় তাদের গ্রামের সকল গানের গীতিকার জান্নাতুল ফেরদৌস। গ্রামের আগের সকল গান সবাই মুছে ফেলেছে তাদের স্মৃতি থেকে। আমাদের গ্রামের আগেকার গানগুলো কি মনে আছে আমাদের। সব গান কি আমাদের বিক্রি হয়ে গেছে। সব গান কি আমরা বিক্রি করে দিয়েছি। কোথাও কি লেগে নাই সে সব গানের মায়া, সে সব গানের ছায়া। আমাদের একজনের মনে পুরাতন প্রেম ছিল। সে প্রেমের স্মৃতি মনে আসে করুণ ভাবে। সে বলে এক পংক্তি, ছিঁড়ে যাওয়া পংক্তি পড়ে আছে তার মনে। বটবৃক্ষের ছায়া যেমন আমার বন্ধুর মায়া তেমন। সে এই পংক্তিটা গাইতে চাইল। কিন্তু সুর কোথায়। কোন বটতলায় পড়ে আছে সে সুর কিভাবে তাকে আনা যায় এখন এ কন্ঠে। সুর ছাড়া গান তো অচল মুদ্রার মতো। অচল মুদ্রা দিয়ে কে কবে বাজারে গিয়ে কিনতে পেরেছে কোনো জিনিস। কিনতে পেরেছে গান। শিশুরা গান বিষয়ে আরো কথা বলে। তারা আসলে তাদের সামনে রাখা পাঠ্য বই দেখে দেখে এ সব কথা বলছে। তারা বলে তাদের গ্রাম-সংগীত আছে। এ গ্রাম-সংগীতের রচয়িতা জান্নাতুল ফেরদৌস। গ্রাম সংগীতে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাবার নাম আছে, মা’র নাম আছে, দাদার নাম আছে, দাদীর নাম আছে এবং অতি অবশ্যই তার নাম আছে। আমাদের সে সময় মনে হয় জান্নাতুল ফেরদৌস এমন একজন ক্রেতা, আধুনিক ক্রেতা, আধুনিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যে কি-না দখল করেছে, কিনেছে মূর্ত-বিমূর্ত সকল কিছু। আমরা স্মরণ করি আমাদের গ্রাম সংগীত কি ছিল। আমরা অনেক চেষ্টা করেও স্মরণ করতে পারি না আমাদের গ্রাম সংগীতে কী কী ছিল। কার কার বা কিসের কিসের নাম ছিল। আমরা আবিষ্কার করি আমরা আমাদের অধিকাংশ স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি। যদি স্মৃতি হারিয়েছি তবে আমাদের গ্রাম কোথায়। তবে কি আমরা আমাদের স্মৃতিগুলোকেও বিক্রি করে দিয়েছি। একটা শিশু বলল এখানে স্মৃতি ধারণের সু-ব্যবস্থা আছে। ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে। কাঁচের বাক্সের প্রজাপতিগুলোর নিকটে যাই। ছবি তুলি। স্মৃতি তুলি। স্মৃতি ভুলি।
আমরা আরো হাঁটি ছবি থেকে, প্রজাপতি থেকে বেরিয়ে এসে। আসি যে মেলায় সেটি শস্য মেলা। নানা বিদেশী মাঠ থেকে শস্য এনে এ স্টলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা এ সব শস্যের কোনোটারই নাম জানি না। আমাদের মনে হয় আমরা কতোদূর চলে গেছি শস্য থেকে, শস্যের মাঠ থেকে। যে খাবার রোজ খাই তার হয়তো নাম জানি না আমরা। যারা শস্য প্রদর্শনীতে ছিল—তারা একে একে নাম বলতে থাকে সে সব শস্যের। আমরা জানি না এসব শস্য কখন হয়, কোথায় হয়, কিভাবে হয়। আমরা স্মরণ করার চেষ্টা করি। আমাদের গ্রামের মাঠে কি কি ফসল জন্মাত। হায়! আমাদের স্মৃতির কী বিপুল ক্ষয়, কী বিপুল বিক্রয়। আমরা স্মরণ করতে পারছি না আমাদের গ্রামের মাঠে কি কি ফসল জন্মাত। আমরা কি তবে গ্রাম বিক্রি করার সাথে সাথে আমাদের সকল শস্য ও তার স্বত্ব বিক্রি করে দিয়েছি।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা আসি এমন এক জায়গায় যেখানে কয়েকটা পুকুরে বসেছে চন্দ্র মেলা। পুকুরগুলোর জলে কয়েকটা চাঁদ দোল খাচ্ছে। আমরা পুকুরগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়াই। পুকুরগুলোর ভেতর কয়েকটা চাঁদের দোল খাওয়া দেখি। পুকুরগুলোর ভেতর চাঁদগুলোর স্নান দেখে আমরা মুগ্ধ হই। এ সকল চাঁদের তবে স্নান প্রয়োজন হয়। কিংবা কি-যে চাঁদগুলোকে পুকুরগুলোতে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে, বেঁধে রাখা হয়েছে। চাঁদগুলোকে তখন মাছ মনে হতে পারে। আমরা চাঁদগুলোকে যদি মাছ মনে না করি তবে কী মনে করি। তখন কেউ বলে, মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে, মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে। এ সব চাঁদ তবে আমাদের মা হতে পারে। আমাদের মায়েরা কেনো চাঁদ, চাঁদ হয়ে পুকুরগুলোর ভেতর। আমাদের মায়েরা কি তবে চন্দ্রমেলার স্টলে দর্শনীয় কিছু। আমরা কি তবে গ্রাম বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মাগুলোকে বিক্রি করে দিয়েছি। চাঁদগুলোকে বিক্রি করে দিয়েছি। আমরা এক সময় এই ভাবনায় যাই যে আমাদের মায়েরা তো অনেক আগেই মারা গেছে। কিংবা কি-যে মায়েরা বিক্রি হওয়া এবং না-হওয়ার সঙ্গে আমাদের বিক্রি হওয়া এবং না-হওয়া জড়িত থাকলে আমরা জলের ভেতরের চাঁদগুলোকে গভীরভাবে দেখতে থাকি। চাঁদ আমাদেরকে যতোদূর নিয়ে যায়, যতোদূর না নিয়ে যায়; আমরা ততোদূর যাই, ততোদূর না যাই। পুকুরগুলোকে, চাঁদগুলোকে যদি আমাদের মা মনে হয় তবে আমরা মায়েদের কাছে যাব। কতোকাল মায়েদের কাছে যাইনি। আমাদের চোখ দিয়ে চাঁদের মতো জল পড়ে। চোখের জল ফেলতে ভালো লাগে। মনে হয় চোখের জলের মাধ্যমেই কেবল মানুষ নিজের কাছে ফিরতে পারে, মায়ের কাছে ফিরতে পারে। কতোদিন চোখের জল ফেলিনি, কতোদিন মায়ের কাছে যেতে পারিনি। এই রাত, এই মেলা, এই পুকুরসমূহ, এই চাঁদসমূহ হয়তো সুযোগ দিয়েছে নিজের কাছে ফেরার, মায়ের কাছে ফেরার। আমরা পুকুরগুলোতে নামতে চাই। চাঁদগুলোর কাছে যেতে চাই, মায়েদের কাছে যেতে চাই। আমাদের কাপড় ভিজুক। কিংবা ভাবি কাপড় খুলেই নেমে পড়ি পুকুরগুলোতে। মায়েদের কাছে যাবার জন্য কাপড়গুলোকে আমরা খুলতে চাই। কাপড় খুলতে গিয়ে দেখি কাপড়গুলো শরীরের অংশ হয়ে গেছে। কাপড় খুলতে পারি না। বিস্ময় এমন যে কাপড় খুললে শরীর খুলে যায়। শরীর ছাড়া আমরা কিভাবে যাব জলে, কিভাবে যাব চাঁদের কাছে, কিভাবে যাব মায়েদের কাছে। তাহলে পোশাকসহ পুকুরগুলোতে নেমে পড়ি আমরা। চাঁদগুলো যেখানে ভাসছে, ডুবছে, সেখানে যাই। জলের ভেতর কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া কি যে কঠিন। জলের সাঁতার জানি আমরা। আমরা সাঁতার দিয়ে চাঁদের নিকট যাবার চেষ্টা করি, মায়েদের নিকট যাবার চেষ্টা করি। কিন্তু কি কথা এটা যে জলের চাঁদ হারিয়ে যাচ্ছে, জলের মা হারিয়ে যাচ্ছে। জলে আছে তারা, অথচ তাদের কাছে যেতে পারছি না আমরা। চাঁদগুলো ভেঙ্গে যায়, মাগুলো ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গা চাঁদ, ভাঙ্গা মা আমরা কি করব। আমরা পুকুরগুলো থেকে উঠে পড়ি। পুকুরগুলোর পাড়ে দাঁড়াতেই আবার জলের ভেতর চাঁদগুলো, মাগুলো। তাহলে চাঁদের শরীরে সাঁতার কেটেও চাঁদ পাওয়া যাবে না, মায়ের শরীরে সাঁতার কেটেও মা পাওয়া যাবে না।
আমরা মা মেলা, চাঁদ মেলা থেকে বেরিয়ে আসি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করি টুকরো টুকরো চাঁদ আমাদের শরীরে লেগে আছে, টুকরো টুকরো মা আমাদের গায়ে লেগে আছে। আমাদের মনে হয় আমাদের শরীর ভিজেছে চাঁদ দিয়ে, মা দিয়ে। এই ভাবনায় আমাদের হাঁটাটা মনোরম হয়।
আমরা এসেছি এবার হত্যা মেলায়। হত্যা মেলার স্টলে নানা রকম হত্যা সাজান, নানারকম ইতিহাস সাজান। আমাদের হাতে স্টলের ছেলেগুলো হত্যার ইতিহাস সংবলিত একটা করে স্যুভেনিয়র দেয়। ভিডিও চলছে নানা হত্যাকান্ডের। যে গ্রামটা আমরা বিক্রি করে দিয়েছি সে গ্রামের হত্যাকান্ডের ইতিহাস প্রদর্শনী চলছে এ মেলার এ স্টলে। কতো রকম যে হত্যা। হত্যা দৃশ্য আমরা সহ্য করতে না পারলে তাদেরকে বলি তারা যেনো হত্যাকান্ড দেখায় রূপকে, প্রতীকে। তখন ভিডিওতে একটা ফুল নদীর ভেতর পড়লো। কোথাও কোনো শব্দ নাই। আরেকটা ফুল নদীর ভেতর পড়লো। কোথাও কোনো গাছ নাই। ফুল দু’টো ভেসে যাচ্ছে। ফুল দু’টো শিশু হয়। শিশু দু’টো কিশোর কিশোরী হয়। কিশোর-কিশোরী দু’টো তরুণ-তরুণী হয়। তরুণ-তরুণী দু’টো এক রাতে চাঁদ হয়। জলের চাঁদ। নদীর পাড়েই ছিল কুকুর। কুকুরের মুখে চাঁদ। কুকুরটা কোথায় যায় দেখা যায় না। এখানে ভিডিওটা বন্ধ হয়। আমরা প্রদর্শনীর ছেলেগুলোকে বলি এভাবে ইতিহাস শেষ হল কেন। তারা জানায় ইতিহাস কখনো চাঁদকে নিরাপদে কোথাও পৌঁছে দিতে পারে না। তারা জানায় এ ইতিহাসের লেখক জান্নাতুল ফেরদৌস, যে এ গ্রামটা কিনেছে। যে ইতিহাস বদলে এ গ্রামের নাম রেখেছে জান্নাতুল ফেরদৌস।
আমাদের গ্রামটা বিক্রি হয়ে যাবার পর এতো বড় হয়ে গেছে তা বুঝিনি আমরা। আমাদের সঙ্গের একজন বলল বিক্রি হয়ে যাবার পর সব কিছু বড় হয়ে যায়, হারিয়ে যাবার পর সবকিছু বড় হয়ে যায়। সে বলল একটা পুরাতন বইয়ে সে পড়েছে, যে কোনো বিক্রি হয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, মারা যাওয়া জিনিস অসীম হয়ে যায়। সেভাবে বিক্রি হয়ে যাওয়া গ্রাম অসীম, হারিয়ে যাওয়া মা অসীম, মারা যাওয়া আমাদের পায়ের শব্দ অসীম, হারিয়ে যাওয়া মুখ অসীম। অসীম বিষয়ের প্রতি আমাদের আগ্রহ অসীম। আমরা আমাদের সকল প্রার্থনায় চেয়েছি, সকল যাত্রায় চেয়েছি অসীমের গন্তব্য।
আমাদের এই সঙ্গীর কথায় আমাদের ইচ্ছা হয় কোথাও অসীমের মেলা থাকলে যাওয়া যায় সেখানে। হাঁটতে থাকি। প্রথমে ধূপের গন্ধ। তারপর আগরবাতির গন্ধ। তারপর গোলাপ জলের গন্ধ। তারপর অচেনা ভাষার কথার গন্ধ। আমরা যেখানে থামি সেখানে সমাধি। সমাধি মেলা। কয়েকজন অচেনা ভাষায়, অজানা ভাষায় আমাদেরকে বোঝাতে সমর্থ হয় এখানে সমাধি মেলা চলছে। যদি তাদের ভাষা অচেনা ও অজানা হয় তবে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা শংকিত হই। আমরা বুঝতে পারি না যারা সমাধি মেলায় স্টলে বসে আছে তারা জীবিত না মৃত। সমাধি মেলায় কতো রকম যে সমাধি। আমরা এবার আমাদের পুস্তকের জ্ঞান থেকে স্মরণ করি সমাধি মেলা নতুন নয়। পৃথিবীর প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আজ অবধি নানা রকম সমাধি মেলা চালু আছে। কিছু কিছু সমাধি মেলা এমন যে তা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গেছে। কেউ কেউ আমরা স্মরণ করি গ্রীসের আর্ন-এর কথা। কেউ কেউ স্মরণ করি মিশরের পিরামিডের কথা। কারো মনে নারীর ছবি থাকলে তার মনে আসে তাজমহলের কথা। পৃথিবীর একক সবচেয়ে মূল্যবান সমাধি তাজমহল হলে আমাদের সে সঙ্গী বলে ওঠে সত্যি চমৎকার এ সমাধিমেলা। একজন ইতিহাসের ছাত্র আমাদের সঙ্গে থাকলে সে বলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমাধি মেলা রয়েছে ইতিহাসের বইসমূহে। কেউ একজন সে সময় বলে সমাধি সব কিছুর শেষ কথা। যদি শেষ কথা সমাধি হয় তবে আমরা আমাদের বিক্রি হয়ে যাওয়া গ্রামের কথা ভাবি। বিক্রি হয়ে যাওয়া গ্রামটার কোন কোন অংশ এখন যাত্রা করেছে সমাধি মেলার দিকে।
সমাধি মেলা আরো অনেকক্ষণ ধরে দেখি। ভয়ও যে সুন্দর হয়, মৃত্যুও যে মেলা হয় তা জানতাম না আমরা কেউই। সত্যি কি চমৎকার বিষয় এটা যে এখানে চলছে সমাধি মেলা। জান্নাতুল ফেরদৌসকে আমরা এবার ধন্যবাদ দিই। সে আমাদের গ্রামটা কিনে নিয়ে কতো কতো মেলার আয়োজন করেছে। জান্নাতুল ফেরদৌস সত্যি একজন বড় উন্নয়নকর্মী। আমরা জানি না আর কতো কতো গ্রাম কিনে সে সে সবের উন্নয়ন করছে। সেখানে বসাচ্ছে নানা রকম উন্নয়ন মেলা।
মেলার বাইরে বের হতে পারি না আমরা। আমাদের সকল হাঁটা ঘুরে ঘুরে মেলাতেই আসে। মেলার বাইরে কে-বা যেতে পারে। আমাদের এবার মনে হয়, হয়তো মনে হওয়াটা ঠিক; আমরাও মেলার স্টলে সাজানো আছি। আমাদের গ্রাম বিক্রি হয়ে গেলে আমরাও তো বিক্রি হয়ে গেছি।
রাত স্থির। সে নড়বে না। আমরা স্থির। নড়ব না। বিক্রি হওয়া গ্রাম স্থির। নড়বে না। মেলার স্টলগুলোয় প্রদর্শিত হচ্ছে প্রাচীন রাত, প্রাচীন চাঁদ, প্রাচীন মা, প্রাচীন আমরা, এবং প্রাচীনতম গ্রাম। একজন বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে নাতনীকে নিয়ে, গল্পের কাছে, চাঁদে চড়বে বলে।