
কথা বলা কলসের গল্প
কথা বলা কলসের গল্প
আগুন আবিস্কারের মতোই আচানক একদিন
শিখেছিল আদিম মানুষ
নদী থেকে জল ধরে রাখার কোশেশ
কুমোরের প্রযত্নে আবিস্কার হলো কলসবিদ্যা
মুখাবয়বে ছিল যার বালতির ছায়া
গুহাযুগেরও আগে প্রাগৌতিহাসিক মানুষের
হয়েছিল আজব এক ব্যামো
রাগলেই ঝাল মেটাতো মাটির কলসে
পলকে গুঁড়িয়ে দিত জলাধারের যৌবন
আধুনিক স্বামীদের মতো কলসও জন্মাবধি
ছিল চমৎকার এক ভৃত্য-রা হীন
শুধু একদিন একান্তই ভুলবশত
‘টুকাতেই হই ভেঙ্গেচুরে গুঁড়গুঁড় প্রভু
লাথি কেনো মারো আমায়?’
হঠাৎ রেগে যাওয়া ডায়াবেটিস রোগীদের
মতো বলেছিল পলকা হাওয়ার সাহসে, যদিও তার
ণ-ত্ব বিধান ষ-ত্ব বিধানের মতোই জানা ছিল
কলসদের কথা বলতে নেই
যেমন কথা বলতে নেই ভৃত্য-হরিপদ কেরাণী
প্রজা, ভাড়াটে, ক্রেতা এবং আধুনিক স্বামীদের
পাগল যেমন না বোঝে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা
মানুষেরাও তেমনি সেদিন কলসের জবান
খুলেছে খুব এই যুক্তিতে-না করে নিজেদের চিকিৎসা,
আটকে দেয় কলসের জবান বেরোনোর পথ
প্রভুর হাতে
চেপে দেয় গলা—
সেই থেকে কলসের পেটটা মোটা
গলাটা সরু—নিঃসঙ্গ—বন্ধুহীন
শুন্য রাজার গল্প
বিশ্বাস করুন আমি রাজা নই
স্বপ্নে-বাস্তবে-কস্মিনকালে কখনোও না
হাফ প্যান্টের জীবন আমার
জীবনান্ত জানালায়ও জানা হয়নি
শার্ট গায়ে দেয়ার সুখ
গেঞ্জিতেই কোর্ট পরা জো এর কনফিডেন্ট
হামাগুড়ি দেয় আমার ডানপাশে
আমি রাজা নই, আছে যদিও ঢের রাজ স্বভাব
জানি, মনুষ্যকুলে সবচেয়ে নরাধম এই আমি
লোক-লস্কর-সান্ত্রী-সেপাই-উজির-নাজির
কেউ নাই আমার-ছিল না কোনো জন্মেও
হাতি-ঘোড়া-টাকা নেই হাতিশাল-ঘোড়াশাল
টাঁকশাল রাজ্য-প্রজা তো দূর অস্ত
কিছু নেই, ফাটা পা সম্বল আমার
মেলেনি কখনো রূপসার চটি-চপ্পল
কিন্ত আমার চলাতে আপনারা নাকি খুঁজে পান
রাজার হাবভাব
বিশ্বাস করুন, আমি রাজা নই
আমি ভূমিহীন এক কৃষক
পদ্মায় বসতবাড়ি হারা এক রুস্তম
চাকরিহারা মধ্যবয়সী এক হতভাগা নাসির
আমি কেউ পছন্দ না করা অবাঞ্চিত-উপেক্ষিত
এক ঊনমানুষ, শেয়ার বাজারে সর্বস্ব হারা
চোখে-মুখে সর্ষেফুল দেখতে পাওয়া স্বপ্নবাজ রাজীব
সিন্ডিকেটের যাঁতায় সর্বস্ব খোয়ানো এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী
এমপিও না হওয়া এক স্কুল মাস্টার
আমি জবাইয়ের উদ্দেশে বেড়ে ওঠা ফার্মের এক মুরগি
আমি সকলের লাথি-ঝাটা খাওয়া রাস্তার মোড়ে
চা দোকানীর গরমপানি ছিটিয়ে দেওয়া এক সারমেয়
দিনের পর দিন গলিতে গলিতে চিৎকার করে একটু
খাবার প্রত্যাশী এক বাঘের মাসী—এসবই আমি কিংবা
আমারই ভাগ্য
আমি ফেলে দেওয়া কলার খোসার মতো-বাপে খেদানো
মায়ে তাড়ানো-ভাইবোনে দেখতে না পাওয়া-স্বজনহীন
সংযোগ সড়ক ছাড়াই নির্মিত পথিক প্রতীক্ষিত সেতু
তবুও আমার ছায়ায় খেলা করে স্বয়ম্ভূ এক রাজা
বিশ্বাস করুন আমি রাজা নই
আপনারা হাসছেন, মহামান্যরা, জ্ঞানীরা এবং মহাজ্ঞানী
নারীরা আপনারা একটু থামবেন প্লিজ
এই তো থেমে এসেছে আপনাদের হাসি…
হ্যাঁ হ্যাঁ এবার, এবার আপনারা কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন
পাচ্ছেন? বাহ্ ভারী চমৎকার, তাহলে শুনুন এবার
আমি আসলে মিথ্যা বলেছি, আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন
অবশ্য ক্রস ফায়ারের উর্বর ভূমিতে ক্ষমারা কেবলিই ঘুমায়
আপনারা শুনছেন, পৃথিবীর উদয় এবং
অস্ত না হওয়া অবধি ক্ষমতার লিজ নেওয়া
যে রাজাধিরাজ, তিনি আসলে আমি
আজ-কালের রাজাদের লাগে নামিদামি আচকান
আমার কিছু নেই তবুও আমি রাজা
কারণ আমি সন্তানের বাবা
পৃথিবীর সকল বাবারাই রাজা
এমনকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যে পাগল, জেনো রেখো
সেও তার সন্তানের কাছে রাজাধিরাজ
বাবা পাগল হলেও সন্তান নিরাপদ-নির্ভয়
কালাশনিকভের রাইফেল যে নিরাপত্তা দিতে পারে না
বাবার হৃদয় হয়ে ওঠে সেই নিরাপদের অভয়াশ্রম
হে নপুংশুক সভ্যতা,
জেনো রাখো, রাজার ক্ষমতা শেষ হয়, বাবাদের নয়
ছেঁড়া আস্তিনে থেকে কেবলই স্বর্ণমুদ্রার
জন্ম হয়—কারণ বাবারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর
এক পৃথিবীর ভার বাবার চওড়া কাঁধ ছাড়া
কোথাও নাহি ধরে—কেহ বহিবার নাহি পারে
হে মুখোশধারী শ্রেণীকূল, হে পোশাকী সময়
বাবারা শুন্য-শুন্য এবং শুন্য, কিন্তু জানো কী
শুন্য ছাড়া অচল এক থেকে নয় এর বিস্তার
শুন্য ছাড়া ক্লিশে-ঠুনকো অবুঝ সভ্যতা
হে মহামান্যরা এক মিনিট উঠে দাঁড়িয়ে একটু শ্রদ্ধা
জানাবেন কি, আজন্ম শ্রদ্ধা না পাওয়া—
বাবারূপী পৃথিবীর সকল রাজাদের
আমি নই কাজল রশীদ শাহীন
কাল যাকে দেখেছেন সে কিন্তু
আমি নই—আমি নই
বানের তোড়ে ভেসে গেছে বলে যা করছেন জ্ঞান
সে জানে জলেতে না ছিল তার বসতের অধিকার
আজ যাকে দেখছেন সে কিন্তু
আমি নই আমি নই
ভোরের সূর্যের সঙ্গে সে গেছে পাটে—প্রত্যাশার সেই ঘুঙুর
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য হওয়ার মতো অসম্ভব
কাজল রশীদ শাহীন বলে যে নাম আওড়াচ্ছেন সে কিন্তু
আমি নই আমি নই
আমার কোনো নাম নেই, এমনই ভাগ্য আমার
পৃথিবীর সব নাম শেষ হয়ে গেছে আমি পর্যন্ত এসে
এই যে ফটোগ্রাফ-অটোগ্রাফ-স্কেচ কিংবা
কার্টুন-গ্রাফিক্সের ক্যারিকেচার
তিনি আমারই মতো হুবহু কিংবা কিছুটা উনিশে-বিশে
মানুষের তালিকায়, স্বজনের বেশে, বন্ধুর সঙ্গীনে
পিতার ব্যর্থতায় ডাহুকের মতো ডুব দিয়ে
ভেসে উঠছে যে নাম—তার বানান আমারই নামের মতো
আমি কিন্তু আমি নই আমি নই
আমি কখনো ছিলাম না
না অতীত-না বর্তমান-না ভবিষ্যতে
আমি কখনো জন্মায়নি, শুনেনি মৃত্যুর আর্যনাম
চাঁদ হয়তো লক্ষ কোটি বিলিয়ন বছর পরিভ্রমণ শেষে
পেয়ে যেতে পারে আলোর নিজস্ব অধিকার
মাছরাঙাদের কোশেশ ছাড়া শিকারের মোজেজা হতে পারে রপ্ত
ইলিশ নদীতে না আসলেও ব্যাহত হবে না জীবনচক্র
মহাজাগতিক কোনো পরিবর্তনে হয়তো থেমে যেতো পারে
জোয়ার-ভাটার জ্বর-পূর্ণিমা-অমাবশ্যার মেয়েলি গীত
অসম্ভব হয়তো হয়ে যেতে পারে গোলাপের গন্ধ নেয়ার মতো
সহজ ও সুন্দর কাজ
কিন্তু কাজল রশীদ শাহীনকে পাবে না পাবে না পাবে না