
কঙ্কণের কিঙ্কিণীতে
লন্ডনে এরকম বৃষ্টি সাধারণত হয় না, অথচ এই বৃষ্টি অকালের বৃষ্টি, পূর্ণশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, অবিরাম অঝোরধারার আবছায়াতে আকাশ ও মাটি একাকার হয়ে যাচ্ছে; সর্বত্রই শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি— মাঠঘাট, পথ-জনপদ, ঘরবাড়ি, গাছগাছালি ভিজে ঝুপঝুপ; তবুও কাচের জানালা দিয়ে লরেন বাইরে তাকিয়ে আছে, আর দেখছে— সারিবদ্ধ ছোটো-বড়ো দোকানগুলোর ভিড়ের মধ্যদিয়ে এলিয়ে যাওয়া গলিপথ ধরে দুটো লোক হেঁটে যাচ্ছে। একজন বেশ লম্বা-চওড়া, সঙ্গে একটি ট্রলি, টানতে বেশ কষ্ট হচ্ছে, মনে হয়, ট্রলিটা মাঝেমধ্যে রাস্তার ভেতর বসে যাবে, তবুও লোকটি রাস্তা ঠুকে ঠুকে নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলেছে; তার বগলে একটি ব্যাগ— কাত হয়েও বেড় পাওয়া যাচ্ছে না; অবশেষে মাথায়, সেটাই সবচেয়ে সুবিধের; একহাতে মাথার ওপর ব্যাগটা ধরে, আরেক হাতে ট্রলিটি টেনে চলেছে; জিনসের প্যান্টটা গোড়ালি পর্যন্ত গোটানো, বেশ ভাঁজ করে করে, যেন রাস্তার জলেরও একটা আন্দাজ আছে। আর একজন ছোটো, কলেজের ছাত্র; কুচকুচে কোঁকড়ানো চুল, বৃষ্টিভেজা পাতলা নেটের গেঞ্জির ভেতর থেকে শরীরের রঙ চিকচিক করে ঝরে পড়ছে; ঘাড়ে-গর্দানে, পিঠে-কোমরে বেশ পেটানো মাংস; সে তার পিঠের সঙ্গে কলেজের থলি ঝুলিয়ে, একটি হাত টাইট প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে, বৃষ্টির মধ্যেই, নেভানো বিড়ি টেনে টেনে চলেছে; বিড়ি না-ধরালে আরেক হাত করবেটা কী, হাঁটুর নিচেই তো তার প্যান্ট শেষ হয়ে গেছে— জল-বৃষ্টি-কাদা-বালি ডিঙিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাই যেন; পায়ের নতুন চামড়ার স্যান্ডেলটি আঙুলের সঙ্গে মিশে আছে; সে একবার তাকাল, লরেনের দোকানের সাইনবোর্ডের টিনে ঢংঢং আওয়াজ উঠছে, জানালার কাচের গায়ে বৃষ্টির জল লাফাচ্ছে, তবে সে থামল না, তার চলার ছন্দ সাইনবোর্ডের টিন পেটানোর আওয়াজের মতো— সবদিকে ছড়িয়ে পড়ছে; গলিটা এত নির্জন যে, তার পদশব্দ ভারী হলেও কেমন যেন মিশে যাচ্ছে। চারপাশ নির্জন; শুধু বড়ো রাস্তার বাসস্টপ থেকে কেউ কেউ এই গলি দিয়ে হেঁটে চলেছে। আজকাল অবশ্য লন্ডনে রিকশা এসেছে, তবে শখের রিকশা, দেশের মতো কেউ গলি দিয়ে ঠেলেঠুলে রিকশা পার করে না, রিকশাওয়ালাও তার রিকশায় মাল তোলে না, শুধু যাত্রী; তবে রিকশাওয়ালা জানে, বড়ো বড়ো মালপত্রের জন্য মাল টানার গাড়ি আছে, অবশ্য এরকম গলিতে মাল টানার গাড়ি প্রবেশ করে না, ট্রলি টেনেই কাজ সেরে নিতে হয়। বাঁকে বা মাথায় বোঝা নিয়ে, ছোটো ছোটো মুরগি উলটো করে ঝুলিয়ে, বা গোরু-ছাগল তাড়িয়ে কেউ রাস্তা ভাঙে না, তবে গলিতে না-হলেও বড়ো রাস্তা দিয়ে মোটরগাড়ি ছুটে চলেছে, কখনো-বা হর্নটর্নও দিচ্ছে, এই নির্জন গলিটায় মানুষ এলে যেন তার পায়ে বেগ বেড়ে যায়; কেউ কারও দিকে তাকায় না, কথাও বলে না; অবশ্য তাড়াতাড়ি হাঁটার ফলে মানুষজনের দ্রুত নিশ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শোনা যায়। মানুষের শ্বাস নেওয়া-ছাড়ার নিঃশব্দ আওয়াজও মিশে যেতে পারে না এই গলির আমেজ থেকে, আলাদা হয়ে থাকে, লরেন একমনে শুনে চলেছে এসব ছন্দ ও আওয়াজ; আর তখনই দোকানের মালিক আস্তে-ধীরে এগিয়ে এসে বলল, ‘কাল নয়টা নাগাদ প্রিন্টার্সের মাল আসবে। তোমাকে সকাল সকাল এসে পৌঁছতে হবে।’
কথাটি শোনামাত্র লরেন তার চারদিকে ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না— দুর্ভেদ্য, নিদ্রিত অন্ধকার যেন। প্রথমে মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু লন্ডনের এই দোকানে এমন তো হওয়ার নয়; ঘরে মৃদু সাদা আলো, গলি থেকে ভেসে আসা বৃষ্টিভেজা আলোয়, পাশে জীবন্ত একটি মানুষের উপস্থিতি— যা একরকম আলোয়, জলে ভিজেভেজা ভাব, সেটাও আলো— সব মিলিয়ে হিম করা আলোর মাঝে সে স্বপ্ন দেখবে কী করে! মাঝেমধ্যে লরেনের মনে হয় জীবনমরণ, বিরহপ্রেম লোক থেকে লোকান্তরে যে-শক্তি সদা প্রবহমান সে যেন ওকে কোনোদিনই শান্তিতে থাকতে দেবে না; ও যখন ভেবেছিল কাল সকালে ওর কিছুই করার নেই, শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তখনই এই নিবিড় আনন্দকে এমনিভাবে বিনষ্ট করে দিলো। মনের শান্তি এমনিতেই নষ্ট হতো, যদিও সে-বিষয়ে ওর কোনো সন্দেহ নেই, তবুও…; আতঙ্কের আর্তনাদ যেন; আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা, মেঘের আড়ালে সূর্যের অজ্ঞাতবাস; তবুও এই অন্ধকারে, জলপ্লাবনের মহারোষের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দোকানের মালিক দোকান বন্ধ করে নিজ পথ ধরল; আর লরেন সাইকেলে উঠে বসল।
সাইকেল ছুটে চলল আহত ঘোড়ার মতো, এক মহল্লা ছেড়ে অন্য মহল্লায়; কী একটা খড়খড়ে জিনিস চাকার তলায় উলটেপালটে ভেঙে গেল, সে ভ্রূক্ষেপ করল না। বৃষ্টি থামল, তবে আকাশ মেঘলা হয়ে দম ধরে আছে, জল উপচানো ফ্যাকাশে পরিবেশ; অদূরে একটি লম্বা জলাশয়ের পাশে দাঁড়িয়ে একজন লোক তার গলা থেকে টাই খুলে নিয়ে পরম যত্নে আবার বেঁধে নিচ্ছে, তারই পাশ থেকে একটি ছেলে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটি পাথর ছুড়ে দিলো মাঝজলে, ধুপ করে চমৎকারভাবে ডুবে গেল পাথরটি। কতদিন হয় রোদের পাত্তা নেই, রাস্তার পাশে বৃষ্টির জলে হড়হড়ে হয়ে আছে কাদায়— বিলেতি কাদা, কালো কাদা, একদিনের বৃষ্টিতেই কাদা আঠাআঠা হয়ে গেছে; আঠালো কাদা অবশ্য বিপজ্জনক, তার ওপর সরু রাস্তা, খুব সাবধানে সাইকেল চালাচ্ছে লরেন, কোনোমতেই মাটিপথে যাওয়া যাবে না, কাদায় চাকা বসে যেতে পারে সে-ই তার ভয়। এই মহল্লার প্রায় সবগুলো দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, লন্ডনের প্রায় দোকানই বন্ধ হয়ে যায় ছ’টায়, পথে এই সময় লোকজনও তেমন নেই। টেমস নদী পেরিয়ে সাইকেল ছুটে চলল সাউথ ব্যাংকের দিকে, থিয়েটার দেখার অজুহাতে বেশ কিছু মানুষ ভিড় জমিয়েছে নদীর পাড়ে, বেশিরভাগই কলেজের ছেলেমেয়ে। নদীর পাড় ঘেঁষে যে-রাস্তা ব্ল্যাকফ্রায়ার্স ব্রিজের দিকে ছুটে চলেছে সেই পথে সাইকেল চালিয়ে চলেছে লরেন। বৃষ্টির জল বিপুল বিস্তারে নেমে এসেছে টেমস নদীতে; সেই জল বিপুল বেগে ইঁটের রাস্তার নিচে, দেয়াল বরাবর আঘাত করছে; জল তো নয়, যেন ক্রুদ্ধ নাগরাজ ছুটে এসে তার বিষাক্ত ছোবলে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে লন্ডনকে; ক্ষুদ্র নাগালের বাইরে যে-নদীর আবাস, অদম্য স্রোতশক্তি তার, পথসম্মুখে যা পায় তা চূর্ণ করে দেয়, কেউ তাকে বাধা দিলে সে পরোয়া করে না, বা মানে না অন্যের কোনো বাধা; তার দ্বিধা নেই, মমতা নেই, কী ভাঙল, কী বাঁচল— তা দেখার সময়ও নেই, নির্মম সম্রাজ্ঞীর রীতিই যেন তার।
ব্ল্যাকফ্রায়ার্সের গোড়ায় যে-সিঁড়িগুলো আছে সেগুলো ভেঙে সাইকেল হাতে নিয়ে লরেন যখন ওপরে উঠে আসে তখন সে দেখতে পেল— একটি ৬৩ নম্বর বাস এলিফ্যান্ট অ্যান্ড ক্যাসলের দিকে ছুটে যাচ্ছে, একমাত্র ফলের দোকানটিও বন্ধ করে দিয়েছে দোকানি। সাইকেলটি হাত থেকে রাস্তায় রেখে সে মনস্থির করতে পারল না কোনদিকে যাবে— ডানে, না বাঁয়ে? বাঁয়ে ফ্যারিংডন রোড ধরে কিংসক্রস, না ডানে স্যাদার্ক নিজ বাসভবনে। আজ কথা ছিল কিংসক্রসে যাওয়ার, কিন্তু এখন যেতে তার মন চাচ্ছে না। রোজই দোকান বন্ধ করে ফেরার পথে এখানে পৌঁছলেই তার মন বিষণ্ণ হয়ে যায়, মনকে সে বোঝাতে পারে না কোনদিকে যাবে— একদিকে স্বপ্ন আর অন্যদিকে বাস্তবতা; অবশেষে তার সাইকেলের হ্যান্ডেল মোড় নিল ডানদিকেই।
সাউথ লন্ডন একটু চুপচাপই থাকে নর্থ লন্ডনের চেয়ে। একটি নিউজ এজেন্ট চোখের সামনে পড়তেই সাইকেল থেকে নেমে পড়ল লরেন। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই তার চোখে পড়ল দোকানের মালিক রাজিব প্যাটেলের কপালের তিলকটি, সে গুজরাট থেকে কেনিয়া হয়ে লন্ডনে এসে দোকান পেতেছে। লরেন ছোটো একটি নমস্কার জানাতেই সে মিষ্টি হাসিতে প্রত্যুত্তর দিলো; কিন্তু লরেন যখন কয়েকটি ক্যাডবেরির চকলেট কিনে থলিতে পুরে, টাকার লেনদেন শেষ করে, দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসবে তখন রাজিব প্যাটেল জিজ্ঞেস করল, ‘আর ইউ ইন্ডিয়ান?’ প্রশ্নটি লরেনের কাছে ভারি অদ্ভুত লাগল, সে একটি কথাও বলতে চাইল না; প্যাটেলের কথাবার্তা, চালচলন, ব্যবহার— সবই ওর কাছে অপরিচিত; কিন্তু সে মনে মনে হাসল, আর চোখের পাতা না-কাঁপিয়ে সত্যকে মাটি চাপা দেওয়ার চেষ্টায়, তর্ক করার মতো নোংরামির মধ্যে সে এখন যেতে চাচ্ছে না, বলল, ‘আপনি তো সবই জানেন! খুব ভালো করেই জানেন। ভ্যারিফাই করার কোনো প্রয়োজন আছে কি!’ রাজিব প্যাটেল কোনো উত্তর দিলো না, লরেন দোকান থেকে রেবিয়ে দেখতে পেল পৃথিবীটা অনেক বড়ো এবং ওর কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, তার মন ভারি বিষণ্ণ, ‘আর ইউ ইন্ডিয়ান’— প্রশ্নটি ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এর উত্তর তার জানা নেই। সে কী? সে শিকড়ের খবর জানে না, সে এসবে কোনোদিনও মাথা ঘামায়নি, কী করবেই-বা জেনে, অবশ্য সে তার মায়ের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল, কিন্তু স্নেহ চিরদিনই নিম্নমুখী। তার মা ইংরেজ; তিনি ভারতবর্ষীয় মনুষ্যজাতির আচার-আচরণটা ঠিক বুঝতে চান না, যদিও ক্ষুধা-তৃষ্ণা-কাম-ক্রোধ ইত্যাদি দ্বারা তাড়িত হন, তবুও সময় ও নিয়মের গণ্ডিকে অতিক্রম করতে পারেননি। তিনি সেসব মনুষ্যজাতির চরিত্রাধ্যয়ন করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে ছিলেন যে, ভারতবর্ষীয় মানুষের অপেক্ষা ইংল্যান্ডের কুকুরই শ্রেয়। পিতৃভিটে দমদম থেকে লেখা লরেনের বাবার একটি চিঠি ছাড়া তার মায়ের হেফাজতে আর কিছুই ছিল না, শিকড় সন্ধানের সম্বল এইটুকুই; তাছাড়া সে শিকড় অন্বেষণে ঔৎসুক্যও ছিল না, কিন্তু আজ, প্যাটেলের কথায়, তার মন সত্যিই ক্ষুণ্ন-ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। ব্যাগ থেকে একটি ক্যাডবেরির চকলেট বের করে, সবটুকু শেষ করে।
অধোবদনে সাইকেলে আবার চড়ল লরেন। সাইকেলের চাকা চলতে লাগল দ্রুতলয়ে। সেই আগের লরেন, মনে হয়, আর নেই। সাইকেল চলতে থাকে ক্লান্তভাবে। এক সময় তার রক্তের তেজও বেগহীন, মন্থর হয়ে আসে। নিজের শিকড়ের সন্ধান করা প্রয়োজন, ভবিষ্যতের কথা একটু হলেও ভাবা উচিত— এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ি পৌঁছল লরেন; এখানে এসে সে খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। গেট ঠেলে, লিফট চেপে, সাইকেলকে দোতলায় তুলে এনে, পকেট থেকে চাবির রিং বের করে, চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলল লরেন, সে ভেবেছিল হয়তো দরজার শব্দ শুনে ছুটে আসবে পলিন, কিন্তু…। সাইকেলকে করিডরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসার ঘরে এসে আলো জ্বালাল সে, সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র কোণ এবং দিনের প্রতিটি অসমাপ্ত ছোটো কাজ তার চোখের সামনে জাজ্বল্যমান হয়ে উঠল। মাঠের মতো বসার ঘরের নিবিড় কার্পেটের ওপর শব্দহীন মার্জার। চরণে সে শোবার ঘরের আয়ত আলস্যের মধ্যে এসে পৌঁছল। পলিনকে পাওয়ার জন্য তার হৃদয়ে যে-আকুলি, যে-বিকুলি, যে-নৈবেদ্যতা তা সহজেই প্রকাশ পাচ্ছে তার চোখেমুখে। প্রশস্ত খাট বিছানার আবরণী তাকে স্বাগত জানাচ্ছে, স্বাগত জানাচ্ছে দেয়ালে ঝোলানো পলিনের হাস্যমুখের ছবিটিও, হাসিতে সংযত আহ্লাদ, তীক্ষ্ণ নাকমুখে মায়াময় মূর্চ্ছনার একটি ইন্দ্রজালও। ছবিটির ছায়া দরজার পাশের আয়নায় পড়ছে। শোবার ঘরে আলো কম, প্রতিবিম্বও তাই ছায়াময়; ছবিটিকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না খাট থেকে, তাই আয়নার কাছে গিয়ে তার পাশের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে ছবিটি দেখতে লাগল সে— সেই মধুমুখ, সেই মৃদুহাসি, সেই সুধাভরা চোখ; খুব নরম চেহারার, নরম ধাতের পলিন; ক্যারট-লাল চুল, মাখনে গড়া মুখ, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, গলায় সরু হার। এই নিভৃত জীবন এবং এই ক্ষুদ্র সংসারটি তার কাছে হবে স্বর্গ, আর এই স্বর্গের রাজকন্যাটি তার জন্য গভীর অপেক্ষায় নিমগ্ন থাকবে— তা-ই তো সে চেয়েছিল। চেয়েছিল— তার সারাদিনের ছোটোখাটো নিরানন্দে ভরা প্রহরগুলো, তার আগমনে, পলিন শান্তিময়প্রিয় হাস্যপূর্ণ একটি দৃষ্টি তার ওপর পতন করবে, যেখানে সহসা কোনো লজ্জা প্রকাশ পাবে না, পাবে না কোনো লাঞ্ছনা, কিংবা হাহাকার; কিন্তু এখন, না-পাওয়ার বেদনাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার হৃদয়ে, ক্ষতস্থানে খুব জ্বালা ধরেছে, যেন বন্দিশালার প্রহরী যেমন বীরাঙ্গনার পবিত্র গোপনতাকে উদ্ধার করে এনে সে উপলব্ধি করে, অনাবৃত শুচিশুদ্ধ বিচারে, বীরাঙ্গনার গোপন অপবিত্রতাকে ঠিক তেমনি। লরেন সংযতপ্রকৃতি হওয়া সত্ত্বেও তার চোখে দেখা দেয় রাগ-অভিমান, যেন ওর চোখ হঠাৎ একটি শকুন বিষাক্ত তীক্ষ্ণ ঠোঁটে অতর্কিতে কামড়ে ধরল। দ্রুত জামাকাপড় বদলে ফেলল সে, তারপর চুপিচুপি গ্লাসে করে বয়ে আনা জল পান করে তার রাগ-অভিমান লুপ্ত করার ইচ্ছেয় শুয়ে পড়ল বিছানায়, কিন্তু তার সারা শরীরের জ্বালা বন্ধ হলো না, বরং গুনগুন গানের মতো তাকিয়ে রইল ছবিটির দিকে, তবে তার মগজ ভাবতে লাগল— পলিন কোথায়, এত দেরি করছে কেন? শোবার ঘরের ঝাপসা আলোটা চর্বি হয়ে যাচ্ছে যেন, এই থলথলে চর্বিটা যেন লরেনের গায়ে লাগছে আর পিছলে যাচ্ছে। বিপৎসংকুল চলন্ত ট্রেনের দরজায় ঝুলে থাকা একটি মানুষের বাঁচার জন্য প্রার্থনার মতো তার অবাক চোখ দুটো খুঁজতে লাগল এক টুকরো কাগজের; পলিনের হদিস পাওয়ার সন্ধানই যেন, অতৃপ্তির সীমাহীন হাহাকার; কিন্তু পেল না, তাই তার সমস্ত চৈতন্য একত্রিত করে উঠে দাঁড়াল বিছানা থেকে; অন্য কেউ হলে পলিনকে অগ্রাহ্যই করত, কিন্তু সে তা করতে পারে না; কারণ, সে-ই যে পলিনের একমাত্র সম্বল। চোখ আর মন একাগ্র রেখে অবশেষে সন্ধান পেল ছোটো একটুকরো কাগজের— ‘ওয়েন্ট আউট। পলিন।’ পলিনের আশ্চর্য বিবেচনাবোধ লরেনের মানসিক অশান্তিকে নানাভাবে বাড়িয়ে তোলে। সে কাগজের টুকরো থেকে মুখ তুলে পলিনের ছবিটির দিকে ভালো করে তাকাল আবার, তখনই অনুভব করল, তার প্রিয় মানুষটি যেন পরিচয় হারিয়ে ক্রমেই হয়ে যাচ্ছে রোবট, তার জীবন হয়ে যাচ্ছে হৃদয়হীন; তাদের মানব-সম্পর্কের নৈতিকতা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে; আর তখনই আরেকটি অশ্রুসজল প্রীতিসুকোমল সলজ্জশঙ্কিত মুখের সাদৃশ্য একটি প্রতিমা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ছবিটির গায়ে, সঙ্গে সঙ্গে লরেন পুঁটলি হয়ে, হাঁটু দুটো বুকের কাছে জড়ো করে, মাথাটি নুইয়ে, মাতৃগর্ভে ভ্রূণের মতো শুয়ে পড়ল একটি সোফা-চেয়ারে। সোফা-চেয়ারে শুয়ে শুয়েই বিলাতি ম্যাড়মেড়ে সন্ধ্যায়, রাতে মেশাবার আগেই, তার মন ক্রমশ আরও মনমরা হতে লাগল। পলিন কোথায় গেছে, সে কি বাজারে, না অন্য কোনো প্রয়োজনে বেরিয়েছে, ভাবতে লাগল লরেন, রোমান্টিক পলিন দেখতে দেখতে কোথায় যেন লাজলজ্জার আড়ালে হারিয়ে গেছে, সে সেন্টিমেন্টাল ধাতের মানুষ কোনোদিনই ছিল না; যদিও গ্রীষ্মের বিকালে বাড়ি ফিরে ব্যালকনিতে বসা, একজন নারীর আলুথালু মুখে বিষাদের ভাবই ফুটে উঠত; সন্ধ্যা হলেও মনে হতো ওই মুখে আলো আর জ্বলবে না সেদিনের মতো; কিন্তু আজ সবদিক থেকেই যেন অচেনা হয়ে উঠেছে পলিন; লরেনের কথা যে পলিন ভাবে না তা নয়, কিন্তু আজকাল তার ধৈর্যশক্তিই নষ্ট হয়ে গেছে, এখন শুধু ওকে নিয়ে তার মায়া হয়, তবে ওর জন্য যে-দায়িত্ব আছে সেটা সে সহ্য করতে পারে না, তাদের সম্পর্ককে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সংসার বলেই ভাবে; এতোদিনের ভালোমন্দ আজ ধৈর্যের ভালোবাসাতে পরিণত হয়েছে। পলিন যেখানে খুশি সেখানেই চলে যায়, নানা ছুতোয় ঘর থেকে পালায়, এখন আর গভীর রাতে লরেনের দেহের স্পন্দন সে পেতে চায় না, চায় না নিজ মনের কষ্ট বাড়াতে। লরেনের সঙ্গে দেহের ভাগাভাগি আজকাল ওর অপছন্দ হয়ে উঠেছে। যে-লরেন একদিন ছিল পলিনের ইহকাল-পরকালের সঙ্গী, সুখদুঃখের সাথী, যার কথা কখনো ভুলেও অমান্য করত না, যত কষ্টই হোক-না কেন কিছুতেই ‘না’ শব্দটি তার ঠোঁটের কোণে প্রকাশ পেত না, সেই পলিনকে আজ লরেন ঠিকই বুঝতে পারছে না; তবে সে জানে ডাকাতি করে কারও মন-অন্তর জয় করা যায় না; সবকিছুই যেন নিঃশব্দ, প্রেমের বাহ্যিক এক রকম একটি কৃত্রিম আবরণে তাদের মনের ক্ষুব্ধ কামনা সব আবৃত করে রাখা হয়েছে যেন; তাই তাদের জীবন আঁধার-অদ্ভুত স্তব্ধতায় ঢেকে গেছে, যৌবনের অপমৃত্যুতে তাদের সংসার এখন ঘুমন্ত যেন, ঘুমন্ত শরীরে শিরশির সম্পর্ক, বলতে গেলে তাদের সম্পর্কে বরাবর সন্ধ্যাই নেমে এসেছে, যদিও অন্ধকার নিবিড় নয়, ফাঁকে ফাঁকে ক্লান্ত জ্যোৎস্নার উঁকিঝুঁকি দেখা দেয়; তবুও লরেন একরকম চাঁদ দেখতে চায়, কিন্তু ভুলে গেছে তাদের জীবনের ধার পড়ে গেছে অনেক আগেই; এখন তো আকাশে শুধুই মেঘের আস্তরণ। পলিন নিজের মতো করে চিন্তা করতে শিখেছে, তবে তার অন্তরের অন্ধকারটা কখনোই ভালোভাবে চিনে নেয়নি লরেন, যেমন ওকে চেনে না পলিনও; যদিও দুজনের অন্ধকারের প্রকৃতি আলাদা। এখন আর লরেন ধরতে পারে না পলিনের হৃদয়ের গোপন স্পন্দনটি কী, কেমন যেন একটা অস্বস্তি সেখানে স্থান করে নিয়েছে। একইসঙ্গে তাদের সম্পর্ক মাথা খুঁড়ে মরছে— শরীর ঠিকই আছে, শুধু মনটাই সমস্যা। সত্যিকারের অচিন মানুষই এখন পলিন; ভালোবাসার ছদ্মবেশটি ঝাপটি মেরে জর্জরিত আজ। লরেনের ক্ষোভটা ফের জেগে উঠল, একটা অক্ষম জ্বালাই বটে, সঙ্গে বোধহয় খানিকটা পোড়াও; বলা নেই, কওয়া নেই পলিন ড্যাংড্যাং করে কোথায় চলে গেল, একটা ফোনকলও না, একটু প্রস্তুতির অবকাশও দিলো না, শুধু এক টুকরো কাগজ! একরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব-সংকোচ ওকে কাবু করতে লাগল। জীবনের ঋজু পথটিকে লরেন চিনে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু এক অপ্রত্যাশিত পথে সে যেন ধরা দিয়েছে; বিশ্বাস করতে পারছে না সে নিজেকেই, এরকম এক অপরিপূর্ণ পথে ওকে ঠেলে দেবে।
হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। সোফা-চেয়ার থেকে উঠে উত্তর দিলো লরেন। কথা শেষ হলো হা হা করে অজান্তে হেসে ওঠা অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা হাসিতে। কোনো প্রত্যাশা নেই, অভিযোগ নেই, বিদ্বেষও নেই, অদ্ভুতপ্রসন্ন একটি হাসি যা শুনে লরেনের মন এখন একরকম আশ্চর্য মাদকতায় ভরে উঠেছে। প্রেম ছাড়া তো জীবন ব্যর্থই হয়, লরেনের মধ্যে যৌনজীবনের এক সুন্দর আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছে, সেটা নিবারণ করবে কেমন করে; কিন্তু পলিনের তিরস্কারও তো আর সহ্য করতে পারছে না। যা হোক, এই মুহূর্তে সে খুব সুখী, একরকম বিশেষ আকর্ষণ সে অনুভব করছে, যেমন বিপরীত দুটো চুম্বক একে-অন্যের সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য আকর্ষণবোধ করে ঠিক তেমনি।
রাস্তায় নেমে গেল সাইকেল আবার। আকাশময় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অগুনতি মেঘের ঝাঁক। রাত ছেয়ে গেছে লন্ডনের দিগ্দিগন্তে। ঘোলাটে চাঁদের আলো যেন সাউথ লন্ডনকে ভৌতিক করে তুলেছে। সাইকেলের গায়ে বাতাসের শনশন আঘাত। হ্যান্ডেল শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে আবছা আকাশের দিকে তাকাল লরেন। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ঘোলাটে চাঁদ হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে। সেদিকে তাকিয়ে প্রেমের গন্ধ শুঁকছে সে। সাইকেল ব্ল্যাকফ্রায়ার্স রোড বেয়ে এগিয়ে চলল। ফোনের ‘হ্যাঁ, তাই হবে’ — কথাটি মনে পড়তেই সে শিউরে উঠল, শিশিরের সৌন্দর্য যেন স্পর্শ করছে তার অনুভূতিকে; যেন তার অন্তরের বিষাদ এখন আনন্দের সৌন্দর্যে কুণ্ঠিত; তার শিরায়-উপশিরায় কীসের যেন টান পড়েছে, মাথায় শুরু হয়ে গেছে বাতাসের মাতামাতি, হৃদয়ে খ্যাপা তুফান। উল্কার মতো ছুটে চলেছে তার সাইকেল, গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছনোর জন্য সাইকেলের বাদাম যেন তুলে দেওয়া হয়েছে মাতালের মতো। রাতের এই নির্জন রাস্তায়, লোক প্রায় নেই বললেই চলে, শুধু মাঝেমধ্যে দু-একজন চলাচল করছে, আর রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়ে মাঝিহীন গাড়িগুলো দীর্ঘনিশ্বাসে সমস্ত দিনের ক্লান্তি দূর করছে; এরই অদূরে ফাঁকা মাঠের শূন্যতায়, সারি বাঁধা বিরল অউক-ফিগের নির্জনতায়, ওর মুখে ক্লান্ত ঘামের ফোঁটা জমে উঠেছে।
সাইকেল এক সময় এসে পৌঁছল লরেনের গন্তব্যে, রাত হয়তো এগারোটা; না না দশটা, সাড়ে দশটা তো বটেই; আর তখনই ঢলঢলে আলুথালু রূপের, চাবুকের আঘাতে পাকিয়ে শুকিয়ে ওঠা এক টানটান চেহারার, মধুরস্নিগ্ধ ভাবমূর্তিওয়ালা আতিয়া একটি বাটি নিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। গালে তার মিম কায়দায় রোজের আলপনা আঁকা। তার রূপ ধরতে না-পেরে লজ্জায় কুঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে ঘরের আবহাওয়া। তার রূপে ঘরের জ্বালানো ঝাপসা আলোও লাজে বসন্তের দুপুরের উইপিং গাছের পাতার মতো ঝুলে পড়েছে। আতিয়া তার চলনভঙ্গিতে সে নিজেই চমকে উঠল, থমকে গেল তার ছন্দপতন। হঠাৎ সে দরজার সামনে পৌঁছতেই, তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল খাবার-সহ একটি বাটি, মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে ঘরের পরিবেশ ঝনঝন শব্দে ডালপালা ভাঙতে লাগল; যদিও সব খাবার মাটিতে পড়ল না, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল অনেকটাই; এই অভাবনীয় কাণ্ডটি তার চৈতন্যের বৃত্তকে বিড়ম্বনায় আর বিহ্বলতায় গ্রাস করল, যেন আলোকিত চন্দ্রকে গ্রাস করে নিল সূর্য, যেন শিকারির বিষাক্ত তীর আহত করল উড়ন্ত বিহঙ্গকে। আতিয়া এই মুহূর্তে লরেনের কষ্টটুকু বোঝার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠল। তার মনের পর্দায় তখন ভেসে উঠল একটি অবয়ব যার অর্ধেক লরেন আর অর্ধেক তার জীবনসঙ্গিনী পলিন। দু’জন মানুষ তাদের একটি করে চোখ দিয়ে ভীষণ বেদনাহত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তার দেহ শিউরে উঠল, সে মনে করল, পলিন যেন তার শরীরে জোর করে একটি সুচ ফুটিয়ে দিয়েছে। অস্থির হয়ে পড়ল আতিয়া, দুর্বোধ্য কষ্টে, যেন বোবাকান্না। তার শব্দহীন চিৎকারে যেন ভেঙে যাচ্ছে দেয়ালে ঝোলানো বড়ো আয়নাটি; তবে ডোরবেল বেজেই চলল। স্বাভাবিক জগতে ফিরে এলো আতিয়া, আর এক অবয়বের পলিন-মুখটি তীব্র ভ্রূকুটি কেটে অদৃশ্য হয়ে গেল তার মনের পর্দা থেকে। চট করে ছড়ানো-ছিটানো খাবারটুকু তুলে নিয়ে, দরজা খুলে সে করিডরের ঝাপসা অন্ধকারে আচ্ছন্ন জায়গাটায় দাঁড়িয়ে রইল, তবে তার চোখে ঘৃণাসহ হিংস্রতা ঝিলিক মারছে।
অবনত মস্তকে, নিঃশব্দ পদক্ষেপে লরেনের উপস্থিতিতে, এই অন্ধকারেই, তার মনে একরকম মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো— লাজুকতা নয়, পলিন বিদ্বেষই; তবে দৃঢ় বিদ্রোহ নয়; তারপর তার মন আর্দ্র হয়ে উঠল করুণায়, মমতায়; কিন্তু প্রেম পর্যন্ত গড়াতে চাইল না, তবে চোখে শুকোনো জলের রেখা ঠিকই স্পষ্ট হয়ে ভাসতে লাগল। লরেনকে তার মনে হচ্ছে সে এক অদ্ভুত রহস্যময় নিষ্ঠুর পুরুষ; নিষ্ঠুর ভাবার আরেকটি কারণও আছে, তার বুকখানা উষ্ণ কারবালা যেন, ইস্পাতে তো আর রোম গজায় না, গজানোর জন্য প্রয়োজন নরম বুক। আতিয়া এক দিশাহীন উত্তেজনায় অপেক্ষা করছিল, সে প্রতিবাদী হতে চায়, তাই তার মনে হচ্ছে— লরেনকে এখানে আসার কথা বলাই তার মস্ত বড়ো ভুল হয়ে গেছে, এ-যেন একরকম বিহ্বল আত্মপীড়ন; সে তো গলা বাড়িয়ে কিচ্ছু বলতে পারে না; আহ্বান না-জানিয়ে সে কী করবে— ওর জন্য যে, তার বুকে এক দুঃসহ লোভ-তৃষ্ণা-ভালোবাসা অনুভব করে; সে সত্যিই তাকে পেতে চায় রক্তমাংসে, যৌবনের আকুতি মিশিয়ে; তবে গভীর গহনে নামতে সে ভয় পায়, ভয় পায় এ কারণেই যে, পলিন নামে এক নারী লরেনের জীবনাংশ। সে একপ্রস্থ অমাবস্যার চাঁদ মুখে ঝুলিয়ে, হঠাৎ, কিন্তু কর্কশ কণ্ঠে নয়, তবে গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘এত দেরি হলো কেন?’ তারপর অতুল রূপযৌবন নিজের হাতে খণ্ডবিখণ্ড করে ভেঙে ফেলে, আপন অনাদরের প্রতিশোধ নিতেই যেন সে যোগ করল, ‘তোমার কথা ভাবতে ভাবতে আমার মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।‘ বৈষ্ণব কাব্যে যেমন প্রেমের নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে রাধার খণ্ডিত রূপটি প্রকাশ পায়, তেমনি আতিয়ারও অবস্থা, লরেনের কামুক মায়ায় তার প্রেমকাব্যের সৌন্দর্য খণ্ডিত হয়ে ঝরে পড়তে লাগল, যদিও তার এই অবমাননায় লরেন-জীবনও অবমানিত। কিছুই যেন লরেনের কানে পৌঁছে না, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। তারপর ক্ষুধার্ত লরেন ফোঁস করে একটি দীর্ঘশ্বাস বুকের গভীরে জমিয়ে রেখে— সেখানে কুয়াশার সূর্যের আলো স্পর্শ করতে পারে না, শুধুই ঝাপসা আলুথালু অন্ধাকার— ক্ষণিকের জন্য নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে, ম্লান হেসে, বোধের পীড়নে দ্রুতগতিতে আস্তে-ধীরে আতিয়াকে কাছে টেনে নিল। লরেনের আহ্বান-আমন্ত্রণ আতিয়াকে আন্দোলিত করল, যেন বিদ্যুৎঝলকসহ মেঘ গর্জনে চারদিক প্রকম্পিত হতে লাগল এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের গুমোট খুলে গেল, খসে পড়ল অচেনা ওড়নার আঁচল, অপ্রত্যাশিত হাসিতে ফ্যাকাশে হয়ে গেল করিডরের ঝাপসা অন্ধকার, তবে উৎফুল্ল না-হয়ে বরং বিচলিত হয়ে ঘড়ির কাঁটা টুকটুক শব্দে একটানা চলতে লাগল; এক অনিঃশেষ সৌন্দর্য যেন ঘিরে রইল আতিয়াকে, যার ধমনিতে অজানা ভয়ের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে লাগল হিমেল স্রোত, আর যেন তার মুখ থেকে সরে গেল সমস্ত চঞ্চল রক্ত; তবে কচি কলাপাতা রঙের ঝলমলে সালোয়ার-কামিজে ওকে দারুণ মানিয়েছে, যেন বসন্তের অরণ্যে ঘুরে বেড়ানো বনদেবীর মধ্যে সে একজন। এই একজনকেই আস্তে-ধীরে লরেন নিজের বুকে পুঁতে নিল। আতিয়ার গলার হার, কানের দুল এই ঝাপসা আলোতে ঝলসে উঠল। দীর্ঘদিনের বাঁধ দিয়ে রাখা কষ্টের স্রোত এখন আর বাঁধন মানতে চাচ্ছে না, অধৈর্য হয়ে পড়ল আতিয়া। লরেনের শক্ত বুকে মুখ লুকোতেই তার চামড়ায় পুলক শিহরণ খেলে উঠল; প্রেমিকের বুকে সে আজ সান্ত্বনা প্রত্যাশা করছে, তাইতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার বুকে; আর সে ঠোঁট কামড়ে, ওর ঠোঁটের অসীম সহ্যের শক্তি নিয়ে, নিজের মনের কষ্ট সামলিয়ে, তার চোখের শুকোনো জল দিয়ে আলপনা আঁকতে লাগল ওর শার্টে। আতিয়া চায়, একমাথা ঝাঁকড়া তামাটে-কালো চুল, শক্ত মুখ, হালকা-পাতলা নাক, উঁচু-লম্বা মানুষটির দেহের সঙ্গে মিশে যেতে; প্রেমিকের প্রেমসাগরে ডুবে গিয়ে নিজের সত্তাকে একেবারে লোপ করে দিতে; বুকে তলিয়ে গিয়ে স্পর্শসুখ অনুভব করতে। তার মনে লরেনের জন্য অদ্ভুত এক যন্ত্রণার যুদ্ধ চলছে; যেখানে আশ্রয় করে নিয়েছে কান্না আটকা একরকম কষ্ট, যা প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু তার মন যে, এই মানুষটির জন্যই অটল, তবে তার মন জানে এই ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে হয়তো সে সংসার পাততে পারবে না; কারণ, সমাজের চোখে তার অনুভব অন্যায়, সমাজের মানুষ এরকম নিয়মকে তুচ্ছজ্ঞান করে থু-থু দেয়, যদিও তারা জানে এরকম করা অবিচার, তবুও তারা শাস্তি দেয়; এসব কারণেই সে নিজেকে অপরাধী মনে করে সময়-অসময়, মনের সত্য সে প্রকাশ করতে পারে না সব সময়, তাইতো সে মাঝেমধ্যে প্রকাশ করতে না-পারার যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়, এ-যেন দ্বন্দ্বপ্রহেলিকার অতিপ্রাকৃতিক কর্মের আবিষ্কার; দ্বৈতসত্তার উৎপাতে প্রলম্বিত, নদীর জলে প্রাণ বিসর্জনের বন্দোবস্ত, কিন্তু এই দ্বৈতসত্তার লোভই তাকে আঁকড়ে আছে, বাঁচিয়ে রেখেছে, এ-যেন কৃষ্ণপ্রেমের আধুনিক সংস্কার, সে কৃষ্ণও চায়, সমাজও চায়; চায় সমাজের কঠিন আঘাতের ভেতরেও তার প্রেমিককে জয় করে নিতে, চায় প্রেমিকের গলায় গামছা পেঁচিয়ে তার মনুষ্যশরীরের চামড়ায় নিজের নখ কেটে আলপনা আঁকতে। লরেনের জন্য সে তো চঞ্চলই— পাগলপ্রায়; যদিও সে রুক্ষতায়-মমতায়, সর্বোপরি ক্রোধ অসহায়ত্বে, সমাজের কাছে দোদুল্যমান প্রেমের সত্য প্রকাশে; তবুও সে লরেনের শরীরের মিষ্টি গন্ধে পাগল; এ-যেন নিজের গোপন অস্ত্রে নিজেই ঘায়েল হওয়ার শামিল, আত্মহন্তারকের দায় কাঁধে নেওয়া দ্বান্দ্বিক দর্শন; স্বেচ্ছায় নির্বাসনের মতো নির্বাসিত করার বন্দোবস্ত; তার ক্রোধ, তার অভিমান, তার কষ্টগুলো তাই হয়তো তার দেহে যৌন-উত্তেজনা হিসেবে বিদ্যুৎ খেলতে শুরু করেছে, যা সমুদ্রের তরঙ্গের মতোই চঞ্চল। অবহেলার সংযোগে প্রণয় যে-পরিমাণ প্রাপ্ত হয়, তাতে প্রণয়ের স্বরূপ বিকৃত হয় না; অবহেলা দূরীভূত হলে অবিকৃত প্রণয়ই যেন থেকে যায়। সমর্থারতির মূর্তিমতী বিগ্রহ আতিয়ার লরেন-প্রেম। অহংভাবের লেশমাত্র এতে নেই; অবহেলাই এই স্বভাবকুটিল প্রেমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগ্রত হয়ে উঠেছে; নির্হেতুমান সহেতুমানকে স্বীকার করে নিয়ে; সঙ্গে সঙ্গে আতিয়ার দেহে দেখা দিলো অভিমানের এক মাধুর্য। দু’হাতে লরেনের কোমর জড়িয়ে ধরল, নিবিড় আলিঙ্গনে বেঁধে নিল এক-দেহের প্রতিটি অংশ অপর-দেহের সমাংশের স্পর্শ ও উত্তাপ অনুভব করতে করতে, নীরবে দেহভোগ করার অস্ফুট ভাষায় কথা বলতে থাকল; এ-যেন এক দুর্বোধ্য চেতনা, যেখানে আনন্দ ও বেদনা এক মিশ্র অনুভব বুকজুড়ে আস্তানা গেড়ে আছে। মাথাকে উঁচু করে সৌরভ শুঁকতে লাগল আতিয়া। ঠোঁটে, গালে, কপালে চুমো খেলো লরেন। ঠোঁট, জিভ চুষতে চুষতে একে-অপরকে সজোরে পরাজিত করতে লাগল। দু’জনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এক নতুন পুলক শিহরণ জেগে উঠল, আর ঠিক তখনই আতিয়া ছিটকে সরে পড়ে বলল, ‘তুমি মাঝেমধ্যে এমন কাজ করো, যা আমার ওপর খুব অন্যায়-অনাচার হয়ে যায়।’ লরেন তার প্রিয়ার হাত লুফে নিল, তারপর তার পিঠে আঙুল বুলিয়ে, আস্তে-ধীরে মাথার চুলে আঙুল ডুবিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ‘তুমি যখন যা চাও, যত কষ্টই হোক, আমি তোমাকে তা দেবো। তবে আমার একান্ত অনুরোধ, আমাকে ঘেন্না কোরো না, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ সন্ধ্যামেঘলেখার মতোই ক্ষণস্থায়ী আতিয়ার অনুরাগ। সে ‘ই-হু’ বলে পাতলা সাড়া দিলো; কিন্তু লরেনকে বাধা দিলো না, বরং সে আতিয়ার পাগল-পুলকানন্দ স্পর্শে ভুলে গেল পলিনের কথা। জ্বালাময়ী প্রেমের মধ্যে এমন এক মাদকতা আছে যা, এমন এক বিশেষ সময়ে, পাষাণ এই পুরুষটিকে চরমকাম্য বলে অনুভব করতে বাধ্য করল, তবুও তার মনোনদীতে দুটো বিপরীত স্রোত সবেগে বয়ে চলেছে; নিজেকে সংযত রাখতে না-পেরে কেঁদে ফেলল; চোখ দিয়ে চিকচিক করে জল গড়াতে লাগল। লরেন বলল, ‘সব দুঃখ দুর্লক্ষণের চেয়ে ভালোবাসাই যে বড়ো। কেঁদো না লক্ষ্মীটি। আমি শুধু তোমারই।’ লরেনের কথা শুনে আতিয়ার মধ্যে যৌনজীবনের এক নতুন, এক সুন্দর আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল; তবুও বলল, ‘তোমার আতিয়া তোমাকেই ভালোবাসে, এইটুকু জানাই যথেষ্ট; বাকি সমস্তই থাক অজানা।’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল লরেন, তারপর বলল, ‘তোমাকে পরিপূর্ণভাবেই পেতে চাই। কারণ আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। এতে কোনো সংশয় নেই। যথার্থ সম্মান আমি তোমাকে দেবোই।’ আতিয়া কোনো উত্তর দিলো না; এই মুহূর্তে শুধু ভেবে চলল, লরেনের রক্তমাংসের ছোঁয়া তার সারাজীবনের ব্যর্থতাকে জয় করে নেওয়ার সমান। এই অন্ধকারেই সে আত্মসমর্পণ করল; তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হারিয়ে গেল, ভাবের গতিই তাদের হারিয়ে দিলো, গভীর এক অন্তর্দৃষ্টির উৎস থেকে, শরীরশিল্পীর নিপুণ স্পর্শে, তাদের দেহ ভাঙতে লাগল। তার জীবনে, এই সময়ে, অন্য বসন্ত শুরু হলো, এ-যেন আলো ও অন্ধকারের মধ্যবর্তী প্রোথিত বসন্ত। ঝড় বাড়তে থাকল এই দুজন মানব-মানবীর মধ্যে; এবং তারা অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ে তাদের দেহকলার পরিবর্তন ও পূর্ণবিন্যাস ঘটাতে লাগল। হঠাৎ বৃষ্টি আবার তার রস ফেনিয়ে, রঙ ছাপিয়ে ঝরতে লাগল। নারী-পুরুষের যৌনরুচির অনুভূতির তরঙ্গের-পর-তরঙ্গ তুলে, বৃষ্টিভিজে বিলাতি রাতের অন্ধকারে, তারা একে-অপরের শরীরকে রাক্ষসের মতো গিলে নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।