
ওপারেতে যত সুখ
দীর্ঘদিন ছুটি কাটিয়ে অফিসে পা রাখতেই কেমন যেন সংকোচ পেয়ে বসেছে নন্দিনীকে। যেন কিছু একটা চুরি করে এসেছে। নিজের চেয়ারে বসতে না বসতেই নাসির এসে হাজির।
তুমি তো জানই এই অফিসের কেউ আমাকে সহ্য করতে পারে না।
সবাই নয় নাসির ভাই, কিছু কিছু লোক।
ঐ হলো আরকি। খালি ভুল ধর। কথাগুলো যে কাকে বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার তো আবার পেটে কথা থাকে না। বলতে না পেরে আমার পুরাই বদ হজম হয়ে যাচ্ছিলো। কি যে ভালো হয়েছে তুমি চলে আসছো।
আমি বোধ হয় প্রেমে পড়েছি।
কম্পিউটারের ফোল্ডারগুলোতে জরুরি একটা ফাইল খোঁজায় ব্যাস্ত ছিলো নন্দিনী। নিতান্ত অবহেলার সুরে জানতে চাইলো
কার! রজনী ভাবীর?
ধুর, তুমি আর মানুষ পেলে না, ও প্রেমের কিছু বোঝে নাকি! কি যে আসতে না আসতেই কাজে ডুবে গেলে! এই যে জলজ্যান্ত মানুষটা তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একবারও তাকিয়ে দেখেছো?
বাচ্চাদের মত অভিমানের সুরে কথাগুলো বলে পাশের চেয়ার টেনে বসে নাসির। তার বসা দেখে বুঝতে আর বাকি থাকে না, গল্প সত্যিই অনেক দূর গড়িয়েছে।
আমি আপনার দিকে না তাকালেও আপনার প্রেমের গল্পটা যে আমার কান পর্যন্ত পৌছাতে সময় লাগবে না, সে আমি জানি। তবে কার!
জানই তো আমি ঘুরতে পছন্দ করি। ছুটির দিনে বাসায় বসে থাকতে দম বন্ধ লাগে। দুইদিনের ছুটি, সাথে আরও একদিন ছুটি নিয়ে ঢাকায় থাকা বন্ধুরা মিলে পরিবার নিয়ে চলে গেলাম সেন্টমার্টিন ঘুরতে।
সে তো বুঝলাম, ঘুরতে যাওয়ার সাথে প্রেমের কী সম্পর্ক!
গল্পে রোমান্টিক দৃশ্য তো আর দৌড়ে দৌড়ে চলে আসে না, ধিরে ধিরে কত সুর আর রং নিয়ে হাওয়ায় শাড়ির আচল উড়িয়ে উড়িয়ে তারপর আসবে। সময় দাও।
ওহ! শাড়ির আচল! আমি তো ভাবলাম হাওয়ায় ওড়না উড়বে।
সেখানেই চকিত হরিনীর দেখা পেলাম।
চকিত হরিণী নয়নের বান মেরেছে বুঝি?
সে আর বলো না, উফ! সোজা বুকে বিধে গেলো।
আর ওমনি প্রেম হয়ে গেলো! প্রেম এত সহজে হয় নাসির ভাই! ও মোহ্, চোখের ভ্রম। যে আছে গৃহ কোণে, নীরবে, নির্জনে, তাকে খুঁজুন। প্রেমের বীজ ওখানেই পোতা আছে। তাকে যত্ন করুন চারা গাছ গজাবে। সে একদিন ফল দিবে।
হবে না রে হবে না, ও বীজ পচে গেছে। দুই বছর তো দেখলাম।
দুই বছর কি খুব বেশি সময়!
পাশাপাশি থাকা দুটি মানুষের জন্য এই ঘোর কলিকালে দুই বছর অনেক বেশি সময়। যখন দুই মিনিটে নুডুলস হয়ে যায়। হা হা হা।
নাসির উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। সেই হাসির শব্দ অফিসের অন্যান্যদের কানে গিয়ে পৌছায়।
ঐ, শুরু হয়ে গেছে।
কথাটা নন্দিনীর কানে আসে।
নাসিরকে এই অফিসের অনেকেই পছন্দ করে না। না করার অবশ্য কিছু কারণ আছে। সত্য যত সুন্দরই হোক, তাকে নাকি সামনে আনতে নেই। নাসির সেই কাজটাই করে বার বার। তার মধ্যে অন্যতম কারণ এই সামনা সামনি সত্য বলে দেওয়া। যার কারণে অনেকেই তার বিরুদ্ধে ডিরেক্টরের কাছে কান ভারি করেও সুবিধা করতে পারে না। যেটুকু সময় কাজ করে, সততার সাথেই কাজ করে। দুই ঘন্টার কাজ দশ ঘন্টা লাগিয়ে করে না।
প্রথম প্রথম অনেকেই নন্দিনীর কাছেও তার নামে অনেক কথাই বলে কান ভারি করতে চেয়েছিলো। নাসির নাকি নারী ঘেষা স্বভাব, যেন দূরে থাকে। এমন কখনই মনে হয়নি তার। অথচ এই অফিসেই এমন অনেক সাধু পুরুষ আছে; যারা আড়ালে নারী শরীর নিয়ে গল্প করে আনন্দ পায়। চোখ দিয়ে নারী শরীর গিলে খায়।
আশ্চর্য রকমভাবে সেই নাসিরের সাথেই নন্দিনীর ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। যতই বন্ধুত্ব হোক, পশ্রয় পাওয়ার মতো কোনো আচরণ সে কখনও করে না। সমস্ত সম্পর্কের একটা সীমানা থাকে। সেই দূরত্ব বজায় থাকলেই সম্পর্ক নির্মল থাকে। সীমানা লঙ্গন করলেই সৌন্দর্য বিলুপ্ত পায়।
অফিসে প্রথম দিন সকলের সাথে পরিচিত হবার এক সময় নাসিরকে দেখেই চমকে গিয়েছিলো নন্দিনী। মনে মনে ভাবছিলো বদি ভাই (আব্দুল কাদের) এই লোকটা এখানে কী করে! তেমন সাইজ, ঢং, হাঁটার স্টাইল! ভার্সিটি জীবনে কাকে যেন মনে মনে পছন্দ করতো, কিন্তু এই হাইটের কারণেই নাকি প্রস্তাব না মঞ্জুর হয়ে যায়। বিয়েটাও করেছে বয়স বেশি হয়েই।
নাসির ভাইয়ের বিয়েতেই তার প্রথম পাবনা যাওয়া। সারা দিন টিপ টিপ বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যেই উঠোনে ত্রিপল টানিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করা হলো। ত্রিপলের এক কোণায় বৃষ্টির পানি জমে রশি ছিড়ে বর যাত্রির খাবারের পাতে জল পড়ে ভিজিয়ে দিয়ে একাকার। সে নিয়ে কি কান্ড! বিয়েটাই ভেঙে যায় আর কি। আর বিয়ের অনুষ্ঠানে সামান্য কিছু নিয়ে গন্ডগোল পাকানোর লোক দুই-একজন যেন সব সময় হাজির থাকেই। এই সমাজে বর পক্ষের দাপটে কনে পক্ষ মিইয়ে থাকে। স্বয়ং কনের বাবা হাতে প্রায় ডজন খানেক নতুন গামছা নিয়ে তড়িগড়ি করে ছুটে এলো। মাথা থেকে পা পর্যন্ত মুছে দিতে লাগলো সকলের। নন্দিনী অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো এক কন্যা দায়গ্রস্থ পিতার অসহায়ত্বের দিকে।
আবার নতুন প্লেট এলো, নতুন করে খাবার সাজানো হলো। ওদিকের লোকেরা ডাল খায় সবার আগে। তাদের সকলের পাতে ডাল দেয়া হলো সবার আগে। এই নিয়েও নানান কথা! মুরগীর রোস্টের কথা সে কখনই ভুলবে না। এমন ভালো রোস্ট সে কোথাও খায়নি। কাঁচা লঙ্কা বেটে দিয়েছিলো হয়তো। আর সব কিছু খাঁটি জিনিস ব্যবহার করার কারণেই হয়ত অন্যরকম একটা স্বাদ হয়েছিলো। রজনী ভাবীর কাছে রেসিপিটা শিখে বহুবার চেষ্টা করেও তেমনটি হয়নি।
তারপর শুরু হলো কনের গায়ের রং আর গহনা নিয়ে। ২৫ বছরের মেয়ের মনের ভেতর তখন কি বেদনা বয়ে চলেছে কে রাখে তার খবর! চেনা প্রিয়জন, চেনা ঘর, চির চেনা উঠান, চেনা গন্ধ সব ফেলে যেতে হবে অচেনায়, তার ভেতরটা কি অচেনা আশংকায় কেঁপে উঠছে কেউ পেয়েছে তার খবর! শহর থেকে কত বাহারি পোশাক গায়ে চাপিয়ে, দামি দামি গাড়ি নিয়ে তোমাকে নিতে এসেছে কত লোক, এ যে তোমার প্রতি কত দয়া; প্রতিটি আচরণে, কথায়, যেন তার হুল ফুটিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ক্লান্তিতে চোখ বুজে নন্দিনী এক কোণায় চুপ করে বসে আছে। নাসির ইচ্ছে করেই নন্দিনীকে তাদের গাড়িতে নিয়ে নিলো। সারা পথ নন্দিনীর আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করল না। ভেবেছিল এই সব বাড়াবাড়ি আচরণের নাসির অন্তত পক্ষে প্রতিবাদ করবে।
কী মিষ্টি দেখতে রজনী ভাবী! গ্রাম্য একটা সরলতা আর মায়ায় ভরা মুখ। তারপর অফিসের অনুষ্ঠানে বহুবার দেখা। কেন যেন রজনীরও নন্দিনীকে বেশ পছন্দ। এই শহরের কাউকে নাকি তার নন্দিনীর মত আপন মনে হয় না। শহরের লোকজনের কাছে যেতে, তাদের সাথে কথা বলতেও নাকি তার ভয় হয়। কোন কথার কি মানে করে তাকে হাসির পাত্র করে দিবে, সে ভেবে। এই নিয়ে নাসিরের সাথে বহুবার আলোচনা হয়েছে, যেন তার এই ভয় ভাঙতে সাহায্য করে।
নাসির নিজের মত তার নতুন প্রেমের কথা বলে চলে। নন্দিনীর মোটেও ভালো লাগে না বিষয়টা। সে যতই উদার আর আধুনিকমনা হোক না কেন, বিবাহিত পুরুষের মুখে অন্য পুরুষের বউয়ের প্রশংসা এত শুনতে ভালো লাগে না। এই জায়গাতে তার নিজেরও নিজেকে খুব সংকির্ন মনে হয়। তাছাড়া গত একটা মাস তার নিজের মনের উপর বয়ে যাওয়া ঝড় তাকে কতখানি উলোট-পালোট করে দিয়ে গেছে, সে ক্ষত সে কাকে দেখাবে!
নাসির ভাই, আপনাকে আমারও কিছু বলার ছিলো।
নন্দিনীর কন্ঠে এমন কিছু ছিলো, যা নাসিরের বুকে গিয়ে লাগে।
কী হয়েছে, এমন করে বললে বুকটা কেঁপে উঠলো।
নন্দিনীর নিজেরও এই বিষয়ে কারো সাথে কথা বলতে গেলে কন্ঠ চেপে আসে। খুব অস্বস্তি হয়। যেন মাথার উপর দিয়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। অনেক শব্দ করে কানে স্তব্দতা দিয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত মনে হলো থাক না, সবাই তো আর মানুষকে ভেতরটা দেখায় না, দেখাতে পারে না, কেউ কেউ কান্না গিলে ফেলে।
এর পর আর কথা এগোয় না কারো। অনেক দিন গড়িয়ে যায়। নাসির তার নতুন প্রেমের মোহে আটকে থাকে। কোনোভাবেই তাকে আটকানো গেলো না।
দূরের জিনিস আমাদের চোখে টুলি পড়িয়ে রাখে। অনেক ঝলমলে আর সুন্দর লাগে, তখন কাছের জিনিসে ততটা আর মন বসে না। রজনীর সাথে মানিয়ে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার হতে পারতো নাসিরের, রজনীকে গড়ে নেওয়া যেতো। নরম মাটির মত মন ছিলো তার।
রজনী বুঝতে পারে সব। কিছু কিছু সত্য বলতে হয় না, লুকিয়েও রাখা যায় না। কিন্তু রজনীর মত মেয়েরা শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে নীরবে কাঁদতে পারে। সেই সুযোগে তাদের জীবন নিয়ে, ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়ে, অন্যেরা খেলে যায়।
নন্দিনী নতুন চাকরি নিয়ে তড়িগড়ি করে শহর ছেড়ে এক প্রকার যেন পালিয়ে গেল দূরের কোনো গ্রামে। সেখানে বরফের ঠান্ডা নিয়ে শীত আসে, দূরে ট্রেন ছুটে যাওয়ার শব্দে নিজের ভেতরের ক্ষতটা যেন জেগে ওঠে। তবুও ভালো আছে সে; অন্যের গল্প শুনে শুনে, নিজের গল্প আড়াল করে, সরল লোকেদের ভিড়ে।
প্রায় দেড় বছর পর এক সকালে পত্রিকার খবরে সে চমকে ওঠে। বিকেলের ট্রেন ধরে আবার ফেলে যাওয়া শহরে আসে সে। কৌতুহলে কিংবা মায়ার টানে। মনে হলো এক যুগ পর ভিন্ন নাসিরকে সে দেখছে।
সেদিন আমার ফেরার কথা ছিলো না। পরের দিন ফেরার কথা থাকলেও ট্যুর একদিন কমিয়ে ফিরে আসি। ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে যায়। আমাকে দেখে তার ভূত দেখার মত অবস্থা। ক্লান্ত ছিলাম ভিষণ, সোজা বেড রুমে ঢুকে যাই। আমার বিছানায় ঐ শূয়রটা উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে। মাথায় রক্ত উঠে গেলো।
নাসিরের চোখে যেন তখনও আগুণ জ্বলছে। খানিক থেমে সে আবার বলতে শুরু করে।
হাতে কি তুলে নিয়েছিলাম জানি না, সেই সময়ে যা পেয়েছি তাই দিয়েই পাগলের মত ঘুমন্ত শুয়রটাকে আঘাত করতে থকি। যখন শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে নিজে নিস্তেজ হয়ে ঘৃনায়, দুঃখে মেঝেতে বসে পড়লাম, ততক্ষণে শেষ দমটা ছেড়েছে শুয়র। ঐটাকেও দিতাম শেষ করে, অন্য রুমে দরজা বন্ধ করে বেঁচেছে।
নন্দিনী এই প্রথম খুব কাছে থেকে পরিচিত কোনো মানুষের, বলতে গেলে একজন খুনি মানুষের খুব কাছাকাছি বসে আছে। অথচ এই খুনিটার জন্য তার মায়া হচ্ছে, একটুও ঘৃনা হচ্ছে না। অথচ কত সুন্দর হতে পারতো জীবনটা। ছোট ছোট পা ফেলে দৌড়ে যাওয়া মিষ্টি স্বরের কিচির মিচির কোলাহলে ভরে থাকা একটা সুন্দর সংসার।
মানুষ যখন ভুল পথে পা বাড়ায় সে নিজেই একবারের জন্যও বুঝতে পারে না তার আগামী ভবিষ্যত কেমন হবে! কিংবা যে নিরপরাধ মানুষটার সাথে অন্যায় করে, সেটাও কখনও অন্যায় বলে তার মনে হয়!
জান নন্দিনী, ঐ শূয়রটাও আমার মতই একটা সরল মেয়েকে ঠকাচ্ছিলো। ভালো হতো যদি ঐ বদ মেয়েটাকে শেষ করে দিতে পারতাম! জীবনে একটা আফসোস থেকে গেল।
বলতে বলতে নখ দিয়ে টেবিল খুটাতে থাকলো নাসির। চোখে কোনো অনুশোচনা নেই। যেন টিকরে একটা আগুণ বের হচ্ছে চোখ থেকে। সে নিজেও জানে তার ফাঁসি হবে। তার জন্য এই জগতে লড়বার কেউ নেই। জগতের এক কোণে বসে হয়তো একটা গ্রাম্য মেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু সময়ের জন্য চোখের জল ফেলবে। যাকে সে কোনোদিন মূল্যায়ন করেনি। যার নীরব ভালোবাসা তাকে টানেনি। যার ভালো লাগা মন্দ লাগার খোঁজ সে কখনও রাখেনি।
রজনীকে কেমন ঠান্ডা, প্রাণহীন মনে হতো নাসিরের। কেমন যেন আগুণ নেই ভেতরে। মনে হতো মা-চাচীদের মতো সেকেলে, সংসার ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। অথচ শারমিন কি চটপটে! চোখের দিকে তাকালে ভেতরটা পুড়ে যায়। এমন আগুণ যে শুধু মন নয়, সব পুড়িয়ে দেয়, বুঝতে পারেনি।
তার চাহিদা পূরণ করতে করতে আমি প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। শপিং, আড্ডা, বাইরে ঘুরে বেড়ানো, ফেসবুক, ফোন ছাড়া তার কাছে কিছুই মূল্য পেতো না।
রজনী ভাবী এখন কোথায় আছে? শুনেছি তিন মাস আগে পাশের গ্রামের এক স্কুল শিক্ষকের সাথে বিয়ে হয়েছে। ভালো আছে। খাঁটি জিনিস যে সহজে পেয়ে যায়, তার মূল্য সে বোঝে না। তাকে সৃষ্টি কর্তাও তাই ক্ষমা করেন না।
আপনার বন্ধু আশিক? তিনি বিয়ে করেছেন?
হ্যাঁ, সেও ভালো আছে। লক্ষ্মী বউ পেয়েছে। পাপ করেছিলাম, তার ফল পাচ্ছি। শারমিন কোথায় কার সাথে দেখা করতো, কিছুই একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলে বলতো বান্ধবীদের সাথে। প্রায় সময় বাসায় ফিরে তাকে পেতাম না। বাইরে থেকে খেয়ে আসতো। ফ্রিজের ঠান্ডা ভাত তরকারি গরম করে খেতে হতো। তার জন্য তার মধ্যে একটুও খারাপ লাগা তৈরি হতো না।
শুরুতে তার সব কথা বিশ্বাস করতাম। বরং খুশি মনে অফিস থেকে ফিরেও নিজে রান্না করতাম। ক্লান্তি লাগতো না। শেষের দিকে আর সহ্য হচ্ছিলো না। আমার অবর্তমানে তার ছেলে বন্ধুরা বাসাতেও আসতে শুরু করলো। তারা আমার বেডরুম পর্যন্ত পৌছে গেল। প্রায় সময় অফিস থেকে ফিরে দেখতাম রুমে সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ। আমি যখন ট্যুরে ঢাকার বাইরে থাকতাম, তখন তো সারা রাত তাদের আড্ডা চলতো। আর সহ্য হচ্ছিলো না। আমি এসব থেকে মুক্তি চাইছিলাম।
সব কিছুর তো একটা সমাধান আছে, কিন্তু এভাবে কেন! আপনি যখন বুঝতে পারছিলেন তার জীবনে একাধিক পুরুষের আনাগোনা, আপনি তাকে ছেড়ে দিতে পারতেন। রজনী ভাবি তো আপনাকে ভালোবাসতো, যখন বুঝতে পেরেছিলেন, ফিরে যেতেন, নিশ্চয় সে আপনাকে ফিরাতো না।
মনে করে করে অনুশোচনায় ভেতরে ভেতরে গুমরে মরেছি। সংকোচে, অপরাধবোধে যেতে পারিনি।
বাচাদের মত হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে নাসির। নাসিরের ফাঁসি না হয়ে যাবৎজীবন জেল হয়ে গেল। নন্দিনী আবার সেই গ্রামে ফিরে গেল, যেখানে নিজেকে লুকিয়ে রাখে নিজের মত করে।
কিছু দিন পর কৌশিকের সাথে ডিভোর্সটা হয়ে গেলো নন্দিনীর। তাড়াটা কৌশিকের পক্ষ থেকেই আসছিলো বার বার। নতুন বন্ধনে জড়াতে হলে পুরনো অলগা হয়ে যাওয়া বন্ধনের সুতোটা কেটে দিতে হয় ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে।
কতবার অফিসের লিগ্যাল এইড বিভাগে এমন ঘটনা দেখেছে সে। কত বউ কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। কখনও কখনও নিজের চোখেও জল চলে আসতো। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকালে বুকটা হুহু করে উঠতো। এমন একটা সময়ে এসে নিজেকেও দাঁড়াতে হবে, বুঝতেই পারেনি।
তার নিজেরও কি একবারও কান্না পাচ্ছিলো!
রাত যত গভীর হয়, নীরবতার ঘনত্ব ততটাই প্রকাশ পায়। সেই নীরবতায় সূক্ষ্ণ কোমল শব্দগুলো জায়গা করে নেয়। নিজের ভেতরের দীর্ঘ শ্বাসটাও তখন দীর্ঘ হয়ে কানে বাজে। মধ্য রাত। একটা নির্ভেজাল দীর্ঘ ঘুমের প্রয়োজন বুঝতে পারে নন্দিনী, তবুও নিজের ভারি দীর্ঘশ্বাস যেন সেই ঘুমের কাটা হয়ে আটকে থাকে।
ঝড় থামে, রাত কেটে কেটে ভোরের আলো জানালার পর্দার ফাঁকে উকি দেয়, কিন্তু দীর্ঘদিনের রাত জাগা ক্লান্ত প্রাণ যেন পরবর্তী যুদ্ধের স্বপ্ন চাবির খোঁজে ঘুমের রাজ্যে ঢুবে থাকে তখনও। অপেক্ষায় থাকে কেউ তার কানের কাছে এসে বলে যাক, নন্দিনী উঠো, বাইরে আলোর ছটা, এবার তোমার আগামীর পথে হাঁটো, এপথ তোমার, তাকে নিজের মত গড়ে নাও।