
এক অধ্যাপকের স্ত্রীর ভাগ্য
(দানিল খার্মসের জন্ম ১৯০৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে। আসল নাম দানিল ইভানোভিচ ইওভাচেভ।
সোভিয়েত আমলে তিনি ছিলেন সুররিয়ালিস্ট ও উদ্ভট ধারার কবি, লেখক ও নাট্যকার। দু’বার তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। জেলে তাকে লিখতে দেওয়া হয়নি। কাগজ কলম কেড়ে নিয়ে বলা হয়েছিল— চুপ করে থাক। ১৯৪২ সালে লেনিনগ্রাদে জেলখানার ভেতরে অনাহারে মারা যান তিনি।)
একদিন এক অধ্যাপক কিছু একটা খেয়েছিলেন, তবে বলতে পারবেন না অল্প কিছু একটা খেয়েছিলেন। খাওয়ার পর তিনি অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। তার বউ এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে তোমার?’
‘তেমন কিছু না।’
এ কথা শুনে তার বউ রান্নাঘরে চলে গেল। অধ্যাপক একটা ডিভানের ওপর শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ শুয়ে রইলেন তিনি। ফলে তার খানিকটা বিশ্রাম হল। একটু পরে কাজে চলে গেলেন।
কর্মক্ষেত্রে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল একটা বিস্ময়। কর্তৃপক্ষ তার বেতন ছয়শ’ পঞ্চাশ রুবল থেকে কমিয়ে পাঁচশ রুবল করে দিয়েছে। অধ্যাপক এই বিষয়ে সব ধরনের চেষ্টা তদবির করলেন; কিন্ত কোনো লাভ হল না। তিনি পরিচালকের কাছেও গেলেন, তিনি তাকে গলা টিপে মারতে চাইলেন। তিনি হিসাবরক্ষকের কাছে গেলেন। সে বলল, ‘পরিচালকের সঙ্গে দেখা করা উচিত আপনার।’
অধ্যাপক একটা ট্রেনে চড়ে তার সঙ্গে দেখা করতে মস্কো গেলেন।
ট্রেনেই তিনি ফ্লুতে আক্রান্ত হলেন।
মস্কো পৌঁছে তিনি এত অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে, ট্রেন থেকে নামতে পারলেন না। একটা স্ট্রেচারে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। চার দিনেরও বেশি ওখানে থাকেননি তিনি, তারপর মারা যান।
অধ্যাপকের শব দাহ করা হল, আর তার ছাই একটা জারে ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হল তার স্ত্রীর কাছে। অধ্যাপকের স্ত্রী তখন কফি পান করছিল। হঠাৎ কলিংবেল বাজার শব্দ শুনে বলল, ‘কে?’
‘আপনার একটা পার্সেল আছে।’
একথা শুনে সে খুশি হল। পার্সেল বহনকারীকে পাঁচ রুবল বকশিস দিল, তারপর একটু খানি হেসে প্যাকেটটা খুলল।
প্যাকেটের ভেতর ছাইয়ের ছোট্ট একটা জার, সঙ্গে একটা চিরকুট। ওখানে লেখা : আপনার স্বামীর শেষটুকু এখানে রাখা আছে।
স্ত্রী বুঝতে পারল না আসলে কী ঘটেছে। সে জারটা ধরে ঝাকুনি দিল, বার ছয়েক। চিরকুটটা পড়ল, তারপর এক সময় কান্নায় ভেঙে পড়ল। খুবই দুঃখ পেল সে।
ওই ঘটনায় সে এত কষ্ট পেল যে, তিন ঘণ্টা ধরে কাঁদল। সিদ্ধান্ত নিল জারটা সে পুঁতে রাখবে। ওটা সে একটা খবরের কাগজে মুড়িয়ে ফার্স্ট পেটলেটকা পার্কে নিয়ে গেল। আগে ওই পার্কের নাম ছিল তাভরিনশেস্কি।
অধ্যাপকের স্ত্রী একটা জায়গা খুঁজে পেল যেখানে জারটা পুঁতে ফেলা যায়। সে মাটি খোঁড়া শুরু করতেই পার্কের একজন প্রহরী ছুটে এসে বলল, ‘আপনি এখানে কী করছেন?’ সে ভয় পেয়ে বলল, ‘তেমন কিছু না, ভাবছি একটা ব্যাঙ ধরে এই জারটার ভেতর ঢোকাব।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে, তবে ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটা কিন্তু নিষেধ। খেয়াল রাখবেন।’
প্রহরী চলে গেলে অধ্যাপকের স্ত্রী জারটা মাটিতে পুঁতে ফেলল। আবর্জনা একটা প্যাকেটে ভরে আশপাশে হাঁটতে গেল।
হাঁটার সময় একজন নাবিক তার কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘চলো কোথাও গিয়ে শুই।’
‘এই মাঝদুপুরে শোবো কেনো?’
এ কথা বলে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ঘুম পেল তার। আশপাশে নীল আর সবুজ মানুষেরা দৌড়ে চলেছে আর তার আরও বেশি ঘুম পাচ্ছে।
সে হাঁটছে আর ঘুমাচ্ছে। তখন সে স্বপ্ন দেখে— তলস্তয় তার কাছে এসেছেন, হাতে একটা প্যাটিস। সে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার হাতে ওটা কী?’
তিনি বললেন, ‘আমি এটা বানিয়েছি। আমি চাই পৃথিবীর সবাই এটা দেখুক। সবাই এর ভাগ পেতে পারে।’
অধ্যাপকের বউ ভাল করে তাকিয়ে দেখল ওটা আর তখন তলস্তয় নেই, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা কুটির। কুটিরের ওপর বসে আছে একটা মুরগি।
অধ্যাপকের বউ মুরগিটাকে ধাওয়া করল, আর ওটা গিয়ে লুকাল খাটের তলায়। একটু পরেই ওটা মুখ বের করল, তখন ওটা আর মুরগি নয়—খরগোশ। বউ ওটাকে ধাওয়া দিলে খাটের তলায় গিয়ে গিয়ে লুকাল, তখনই ঘুম ভেঙে গেল তার। নিজেকে সে সত্যি সত্যি খাটের তলায় আবিষ্কার করল।
ওখান থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, নিজের ঘরে আছে সে। টেবিলের ওপর রাখা কাপ ভর্তি শেষ না-হওয়া কফি। পাশে সেই চিরকুট, যেখানে লেখা : ‘আপনার স্বামীর শেষটুকু এখানে রাখা।’
বউটা আবার কাঁদল। কফি শেষ করল। তখন কলিংবেল বেজে উঠল। কে এল আবার? কয়েকজন লোক ভেতরে ঢুকে হুকুম করল, ‘আমাদের সঙ্গে চলো।’
‘কোথায়?’ বউটি জিজ্ঞেস করল |
লোকগুলো বলল, ‘পাগলা গারদে।’
অধ্যাপকের বউ চিৎকার করে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু ওরা তাকে ধরে পাগলাগারদে নিয়ে গেল। ওখানকার বিছানায় বসে ছিল সম্পূর্ণ সুস্থ এক মহিলা। তার হাতে একটা চিরকুট। মেঝেতে মাছ ধরছিল সে— অদৃশ্য ছোট ছোট মাছ।
এই অধ্যাপকের স্ত্রী বহু হতভাগ্য রমণীদের একজন যারা নিজের পাওনাটা থেকে বঞ্চিত হয়।